পাপড়ি রহমান
সেই গন্ডগোলের বছর দয়ালহরির বয়স ছিল চৌদ্দো। সদ্য কৈশোরে দাঁড়ানো দয়ালহরির চোক্ষের সামনে এমন ধুরমার গন্ডগোল লেগেছিল যে, সে-দৃশ্য এখনো সে ভুলতে পারে নাই। দয়ালহরির মা শৈলবালা একমাত্র সন্তানকে সেই গন্ডগোলের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কত চেষ্টাই না করেছিল! আর সে-গন্ডগোলেরও কি এমন-তেমন গন্ডগোল ছিল নাকি? দয়ালহরি একটু বুঝদার হওয়ার পর বুঝেছিল – ওইটা আদতে গন্ডগোল-ফন্ডগোল না – ওইটা ছিল স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। পাকিস্তানিদের হাত থেকে নিজের দেশকে উদ্ধার করার জন্য যুদ্ধ। সর্বোপরি ওইটা ছিল মুক্তির জন্য যুদ্ধ। শৈলবালা যাকে গন্ডগোল বলে জানে – ওইটা ছিল আসলে স্বাধীনতাযুদ্ধ। কিন্তু নিরক্ষর শৈলবালা কী করে বুঝবে যে ওইটা যুদ্ধ? বা মুক্তিযুদ্ধ?
সবখানে এন্তার গোলাগুলি-পলায়ন-ত্রাস-আগুন এসব দেখেশুনে শৈলবালা নিজের মতো করে একটা শব্দ বানিয়েছে ‘গন্ডগোল’।
আর শুধু কি শৈলবালা?
জলদী গ্রামের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর বলে তারাও বলে ‘গন্ডগোল’! বলে বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের ‘গন্ডগোল’। তা হতে পারে, গন্ডগোলের মানে এরা বোঝে, সম্পর্ক সুবিধার না। সম্পর্ক তাইলে কিসের? সম্পর্ক ঝগড়াঝাঁটি ও মারপিটের। দয়ালহরি ইশ্কুলের কয়েক ক্লাস ডিঙিয়ে ছিল। ফলে সে জানতো এইটা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এবং সে কয়েকবার বলেও ছিল –
‘মা – এইটা গন্ডগোল নারে, এইটা মুক্তিযুদ্ধ।’
কিন্তু শৈলবালা এই শব্দটাতে সহজ হতে পারে নাই। বরং নিজের অজস্র বলিরেখাপড়া মুখটাকে আরো অত্যধিক কুঁচকে-মুচকে বলেছিল –
‘বাপন – মুক্তিযুদ্ধ! বুঝছি তো। কিন্তু এত খটমটা ব্যাপারটা বুঝবার পারি না। কইতেও পারি না। আর যুদ্ধ কইতাছ বাপন, হাতি-ঘুড়া ছাড়াই কি অহন যুদ্ধ অয়?’
দয়ালহরি হেসে ফেলেছিল। অতঃপর শৈলবালাকে বোঝাতে চেয়েছিল –
‘মা – অহন তো আর রাজা-উজিরের যুগ নাই। তাই হাতি-ঘুড়াও নাই। ওইসবের বদলে আছে বন্দুক। আছে কামান? আর আছে উড়োজাহাজ। অহন তো যুদ্ধ অয় ওইসব দিয়াই।’
শুনে-টুনে শৈলবালা ততোধিক চিন্তিত হয়ে বলেছিল –
‘বাপন – কী অত ভারিসারি কতা কও? বুঝতে চাইলে চক্ষে আন্ধার দেহি। আমরা তো আমাগো মতো কইরা বুঝি – পাকসেনাগো লগে আমাগো গন্ডগোল পাকাইছে – এইডাই তো? এই গন্ডগোলের কারণ হইল আমরা নিজেগো মতো থাকবার চাই। নিজেগো যা আছে তাই নিয়াই থাকবার চাই। পাকিস্তানিরা তুমরা ভাইগ্যা যাও বাঙাল মল্লুক থিক্যা – এইডাই তো?’
শৈলবালার এমন অকাট্য যুক্তি শুনে দয়ালহরি আর পীড়াপীড়ি করে নাই। মুক্তিযুদ্ধ আর গন্ডগোলের ফারাক শৈলবালাকে বোঝাতে চেষ্টাও করে নাই।
শুধু মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল –
‘যাউক গা। মায়ে যেমতে বুঝবার চায় তেমতেই বুঝুক না। আমি কতা বেশি বাড়াইতে গেলেই মায়ের মাতার ভিতরেই গন্ডগোল পাকায়া যাইতে পারে। পাকিস্তানিগো লগে আমাগো গন্ডগোল বাধছে এই যে সে বুঝবার পারতেছে – হেইডাতেই অইব।’
ফলে দয়ালহরির ‘মুক্তিযুদ্ধ’, শৈলবালা ও জলদী গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের বোঝাপাড়ায় যে-গন্ডগোল – তার মাঝ দিয়েই দেশে স্বাধীনতা এসেছিল।
তবে স্বাধীন হওয়ার ঠিক আগে আগে – সে-বছর আশ্বিন ও কার্তিক মাসটা যে কীরকম ভয়-তরাসে কেটেছিল সে-কথা বলাই বাহুল্য।
শুধু দয়ালহরি ও শৈলবালা নয়, জলদী গ্রামের সবাই আতঙ্কে একেবারে আধমরা হয়ে উঠেছিল। এর কারণও ছিল –
পাশের গ্রাম মহালখালিতে তখন ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও। আর দেদার লুটপাট চলছিল। মহালখালিতে যে-কয়টা সাহা ও শীল পরিবার ছিল, তাদের ভিটায় একরকম ঘুঘু চড়ানোর ব্যবস্থা করে ফেলেছিল রাজাকাররা। ফলে এইসব দেখেশুনে ভয়-তরাসের কমতি ছিল না কোনোখানেই। পাকসেনারা কি হাঁড়ির খবর জানতো নাকি? তাদের পথঘাট চেনানোর দায়িত্ব নিয়েছিল রাজাকাররাই। আর এইসব রাজাকার সুযোগসন্ধানী হয়ে 888sport free betলঘুদের প্রতিই যেন নির্যাতন চালিয়েছিল। ওইসব ঘটনা তিল থেকে তাল হতেও সময় লাগে নাই। ফলে জলদী গ্রামের শৈলবালা শীল, সুলতা সমদ্দার, পরান মন্ডল, বাসন্তী রায়, সুরঞ্জন বসাকসহ সকলেই আতঙ্কিত ছিল। তাদের আতঙ্ক ছিল ঘরের শত্রুদের কায়-কারবারে। গুজব এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, হিন্দু পেলে নাকি কিছুতেই আর নিস্তার নাই! সামান্য সন্দেহ হলেই পাকসেনারা নাকি নানানভাবেই পরীক্ষা নিত।
‘তুম হিন্দু ইয়ে মুসলমান? কলমা জানতা হ্যায়?’
শুধু কি প্রশ্নের উত্তর পেলেই মুক্তি? না, তেমন ছিল না। শৈলবালা, বাসন্তী বা পরান মন্ডলেরা শুনেছিল আরো নানাভাবেই নাকি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতো। এমনকি আদিম পরীক্ষাও। হিন্দু-মুসলমান যাচাই করার জন্য কারো কারো পুরুষাঙ্গ পরীক্ষাও! আর এসবই তো আদিম কার্যের ভেতরই পড়ে!
শৈলবালার ত্রিভুবনে এই একমাত্র পুত্রসন্তান দয়ালহরি ছাড়া আর কেউ ছিল না। ফলে শুধু মাতৃত্ব নয়, তার সঙ্গে একেবারে নিঃস্ব মানুষের আকুতিও যুক্ত হয়েছিল। এবং এই আকুতির সঙ্গে শঙ্কা, ভয়, আশঙ্কা, ত্রাস, মৃত্যুভয় ইত্যাদি মিলেমিশে প্রকট আকার ধারণ করেছিল। মৃত্যুভয় এতটাই বিভীষিকা রূপে সকলকে আচ্ছন্ন করলো যে, তারা চার কলেমা শিখতেও আগ্রহী হয়ে উঠলো। শৈলবালা নিজেও তা শিখল এবং দয়ালহরিকেও শেখাতে লাগল।
দয়ালহরির দশাও তো শৈলবালার মতোই। শৈলবালা ছাড়া ত্রিভুবনে তারও তো আর কেউ-ই নাই!
ফলে দয়ালহরির শৈলবালার প্রতি মায়ের বাইরেও আরো কিছু অবলম্বন জুড়ে গিয়েছিল।
কলেমা শেখা দয়ালহরির জন্য সহজ ছিল না! এ নিয়ে সে ওজর-আপত্তিও কম তোলে নাই! এবং শৈলবালার সঙ্গে সে রীতিমতো লড়াই দিয়েছিল। এ লড়াই ছিল কলেমা না শেখার লড়াই। দয়ালহরি, শৈলবালাকে বোঝাতে চেয়েছিল –
‘মা এইডা কি কতা কও তুমি? আমি কলমা শিখলে আমার নিজের ধর্মডা কই থাকবো?’
শৈলবালার প্রায় শেষ বয়সের সন্তান এই দয়ালহরি। যৌবনের সলতে পাকিয়ে প্রদীপটাও আর উজ্জ্বল ছিল না। দেহের শক্তি নিঃশেষ হলেও জিহবার ধার শৈলবালার তখনো ছিল – এ-ধার যুক্তির ধার! জিহবার ধারে সে দয়ালহরিকে একেবারে কেটে খন্ডবিখন্ড করে বলেছিল –
‘নিজ জেবনডা বাঁচানো কি ধম্ম নয় রে বাপন? আর কলেমা শিখলেই কি তুমার ধম্ম অধম্ম হইব? এইডা কে কইছে তুমারে? ধম্ম অধম্ম হওয়া কি মুহের কথা?’
সামান্য থেমে শৈলবালা ফের ছেলেকে বলেছিল –
‘ইশ্কুলে যাইয়া কী শিখছ বাপন? ধম্ম-কম্ম যাই কও না কেন, সব থাহে মাইনষের অন্তরে। থাহে মাইনষের কাজ-কম্মে। কাউরো জবানে কি তুমি তার ধম্ম ঠাহর করবার পারবা?’
দয়ালহরি মায়ের ওপর কথা বলতে শিখে নাই।
মাকে হেনস্থা করা তার স্বভাবে নাই। মায়ের কথার ওপর জবানের লাগাম ছাড়া তার ধর্ম নয়। ফলে নিজের মতো করে কিছু একটা দয়ালহরি বুঝেছিল এবং বুঝে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল। হয়তো সে শৈলবালার কথার সত্যতা অনুধাবন করেছিল। আর শৈলবালাও তো মন্দ কিছু বলে নাই!
শৈলবালার কথা সত্য। দিনের আলোর মতোই সত্য। এটা বুঝেই দয়ালহরি মনে মনে আউড়েছিল – তাই তো! মায়ের কথা সত্য! অন্যের ধম্মের বাণী মুখে আনলেই কি কেউ বিধম্মী হইয়া যায়? অন্তরে যারে আমি ঠাঁই দিছি, সেই তো আমার ধম্ম! তারে তুমি ভগবান, আল্লাহ, খোদা, ঈশ্বর, গুরু যাই কও না কেন – অন্তর থিক্যা তারে কি তুমি খেদাইতে পারবা? পারবা না। যারে তুমি মনে রাখছ – যারে তুমি 888sport app download for android করো – সেই তো তুমার ধম্ম!
এমন একটা বুঝ – শান্তির বুঝ! এই বুঝের কথা দয়ালহরি আর কাউকে বলে নাই। এমনকি শৈলবালাকেও নয়। বিধবা মাকে অযথা চিন্তায় ফেলা কোনো কাজের কাজ না – এত অল্প বয়সেই দয়ালহরি বুঝে গিয়েছিল।
আহা রে! কিসব দিন যে তখন গেছে সকলের!
শৈলবালার! দয়ালহরির! পরানের! বাসন্তীর! এইরকম ভয়-তরাসে থাকার জন্য শৈলবালা এক মুহূর্তের জন্যও দয়ালহরিকে চক্ষের আড়াল করে নাই। দয়ালহরিকে চক্ষে-চক্ষে রেখেছে শৈলবালা। অথচ জলদী গ্রামের কত যুবক তখন নিরুদ্দেশ।
বসাক, রিপন, মন্তাজ, বাচ্চু, শরিফ, মিত্তির, রমাকান্ত, প্রণব – এভাবে কত যুবক যে রাতের অন্ধকারে হাওয়া হয়ে গেছে! দয়ালহরি শুনেছিল, এরা সকলে ভারত চলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে।
দয়ালহরির বয়স এদের সকলের চাইতে কম, অন্তত হাতের আঙুলের দুই-তিন কড় কম – ফলে নিরুদ্দেশের সাহস তার নাই। নিরুদ্দেশের সাহসে যে-সঞ্চয় করতে পারে নাই। হলে কী হবে? ভেতরে ভেতরে ভয়ানক এক ছটফটানি দয়ালহরিকে বেদিশা করে দিয়েছে।
পাকসেনারা যেদিন জলদীর বাজারের দোকানপাটে আগুন দিলো, সেদিন থেকে দয়ালহরির ওই ছটফটানি আরো তীব্র হয়েছে। জলদীর মানুষ তখন আতঙ্কে উন্মাদ। জলা-জংলা-ঝোপে যে যার মতো করে আত্মগোপনের চেষ্টা করছে। ঝোপে-জংলায় ট্রেঞ্চ খুঁড়ে নিজেদের নিরাপত্তাকে দৃঢ় করার শপথ নিচ্ছে। পরবর্তীকালে এই ট্রেঞ্চের ভেতরই তো শৈলবালাকে থাকতে হয়েছে। থাকতে হয়েছে দয়ালহরিকেও। বাসন্তীকে। জলদী গ্রামের বেশিরভাগ লোক ট্রেঞ্চের ভেতর নিজেদের গুটিয়ে রেখে নিরাপত্তা চেয়েছে। দীর্ঘক্ষণ ট্রেঞ্চের ভেতর বসে থাকতে থাকতে দয়ালহরির দম আটকে যেত। বসাক, রিপন, বাচ্চুর যুদ্ধের খবর পেলে প্রচন্ড বেদনা তাকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে গেঁথে ফেলতো। কিন্তু সে প্রকাশ করতো না। কিছুতেই প্রকাশ করতো না। শৈলবালাকে কিছুই সে বুঝতে দিত না।
দয়ালহরি, শৈলবালাকে বুঝতে দিত না, নাকি শৈলবালাই তাকে কিছুই বুঝতে দিত না? – এই গোলকধাঁধায় কয়দিন পরই তাকে ভয়ানকভাবে আবর্তিত হতে হলো।
চারপাশে গোলাগুলির শব্দ, লুটপাট এসব চলছিল। এরই মাঝে জলদী গ্রামে পাকবাহিনী ঢুকবে এরকম কানাঘুষা! শৈলবালার অবস্থা দাঁড়ালো প্রচন্ড ঝড়ে-পড়া ডিঙি নাওয়ের মতো। চক্কর খেতে খেতে সে যেন অস্থির হয়ে উঠল। গ্রামে পাকবাহিনী ঢুকলে কী যে লঙ্কাকান্ড ঘটাবে বলা মুশকিল।
এরকম আতঙ্কে দয়ালহরিকে রাখা অনুচিত, এই ভাবনায় শৈলবালার পাগলদশা! একরাতে কুপির ম্লান আলোতে ভাত খেতে খেতে শৈলবালা প্রসঙ্গ তুলল। প্রসঙ্গ তুলল ধীরেসুস্থে, যেন তীব্র সাইক্লোন থেকে বেঁচে-ওঠা কোনো চারাগাছ! যে জানে ঝড়-জীবন তার জন্য অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এও জানে, আলো-বাতাস তার জন্য প্রতুল! ঠিক এরকম অবস্থা থেকেই যেন শৈলবালা বলল –
‘বাপন বাতাসের ভাও কিছু বুঝবার পারতেছ নাকি?’
দয়ালহরি কাঁসার গ্লাসের জলটুকু কোনোমতে খেয়ে জানতে চাইল –
‘কী কইতাছ মা? যুদ্ধের ভাও?’
শৈলবালা নীরবে মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে বলল –
‘বাপন, তুমি কয়ডা দিন বাঁশখালীতে থাইক্যা আসো।’
‘বাঁশখালী? কেন?’
‘না, আমি বলতেছি তাই। যাও ঘুরান দিয়া আসো।’
‘বাঁশখালী যামু কার কাছে? আর এ-অবস্থায় কেনই বা যামু?’
‘যাইবা নিজের গরজে। ওই গেরামে আমার সই আছে ‘গীতা’। হের বাড়িত যাইয়া বলবা শৈলবালার পুত্র তুমি।’
‘ইমা কিজন্য যামু? আর আমি গেলে তুমি যাইবা না ক্যান?’
‘বলতেছি যাও। আমি এইহানেই থাকি। কয়দিনেরই তো ব্যাপার। সব একটু সামাল হইলে আইস্যা পইড়ো।’
‘না, আমি এলকা এলকা যামু না। তুমিও লগে লও। নইলে আমিও এইহানে তুমার লগে থাকি।’
দয়ালহরির কথা একদম কানে নিল না শৈলবালা। একপ্রকার জোর করেই তাকে পাঠিয়ে দিলো বাঁশখালীতে। দয়ালহরিকে বিদায় করেই শৈলবালা আছড়ে পড়ল দেবতার সম্মুখে।
‘ভগবান, তুমার হাতে দিলাম পুতরে। তুমি তারে খেয়াল কইরো।’
আর এমনই কাকতালীয় ঘটনা – পাকসেনারা জলদীতে ঢুকলো সেই রাতেই! হিন্দুপাড়ায় আগুনও দিলো সেই রাতে! আগুনের ভয়ানক উত্তপ্ত নৃত্য ঘুমঘোরে কেউ-ই টের পেল না। একেবারে হাওয়ায় ভর করে উড়ে এলো তা-থই আগুন। লহমায় ভস্ম বানিয়ে দিলো বাসন্তীকে। শৈলবালাকে। মিনতিকে। তবে শৈলবালাকে ভস্ম করতে অগ্নিশিখার বেশিক্ষণ লাগে নাই! শৈলবালার দেহটাই তো পলকা হয়ে গিয়েছিল। তদুপরি তার হাতে শাঁখা ছিল না, সিন্দুর ছিল না! শৈলবালার পরনে ছিল জীর্ণ হতে হতে একেবারে বিবস্ত্রপ্রায় ধুতি। ছোট করে ছাঁটা চুল। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। শৈলবালার পলকা দেহের এই তুচ্ছাতিতুচ্ছ আভরণ মুহূর্তে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল।
আগুনের তান্ডব থামতে থামতে পরের দিন বিকেল গড়িয়ে গিয়েছিল। হিন্দুপাড়ার পুড়ে যাওয়া বাড়িঘর থেকে কেউ কোনো জিনিস খুঁজে পায় নাই। দয়ালহরিও কিচ্ছুই খুঁজে পায় নাই, ছাইয়ের স্তূপ ছাড়া।
শৈলাবালার আশীর্বাদ দয়ালহরির সঙ্গে ছিল। ভগবানের দয়াও ছিল এবং সে বেঁচে গিয়েছিল।
দয়ালহরিও যেন নতুন করে প্রাণ পেয়েছিল! ছাইভস্মের মাঝেও বেঁচেছিল সে!
মায়ের মুখাগ্নিও তাকে নতুন করে করতে হয় নাই। এবং এই ছাইভস্ম, ক্রন্দন-হাহাকার, নিঃস্ব-রিক্ততার মাঝেই দেশে স্বাধীনতা এসেছিল। শৈলবালার ‘গন্ডগোল’ থামিয়ে দেওয়া স্বাধীনতা!
ঘরপোড়া-ছাই হাওয়ায় উড়তে শুরু করলেই দয়ালহরি বিষাদগ্রস্ত হতো! তার মনে হতো ছাইয়ের স্তূপের নিচে 888sport app পড়ে যাচ্ছে সে। ঘন-ঘোর অন্ধকারে ডুবতে ডুবতে দয়ালহরির চকিতে মনে পড়তো –
– মা যে কলমা শিখছিল! সেইডাও কি কুনু কামে লাগে নাই! বাঁচনোর কত যে আশা আছিল মায়ের! আইচ্ছা আগুন দেওনের আগেও কি মায়েরে কেউ পুছ করে নাই –
‘তুম হিন্দু ইয়ে মুসলমান? কলেমা জানতা হ্যায়?’
দয়ালহরি ক্রমে জলদীর বাস তুলে দিলো। এবং বাঁশখালীতেই স্থায়ী হলো। জলদীতে সে আর টিকতেও পারছিল না। একেবারে শ্মশান হয়ে যাওয়া হিন্দুপাড়ায় নতুন বসতি করা দয়ালহরির জন্য অসম্ভব ছিল। ফলে দয়ালহরি পালালো। নিজেকে বাঁচানোর তাগিদেই সে পালালো। জলদী থেকে বাঁশখালী। বাঁশখালীর আশ্রয় তার জন্য নিরাপদ। এইখানে গীতামাসি আছে। আর আছে তার মেয়ে বরুণা।
দুই
সেই যুদ্ধের বছর গীতামাসির ঘর-লাগোয়া যে-পুকুর ছিল, তাতে জলের পরিমাণ কমেছে। বেড়েছে দামের জঙ্গল। ফি-বছর দাম তুলে না ফেললে এতদিনে পুকুরে আর জলচিহ্ন দেখা যেত না।
বাদলার কালে মাটি-ধোয়া-জল গড়িয়ে গড়িয়ে পুকুরের বুক প্রায় ভরাট করে তুলেছে; কিন্তু এতে জলের টলটলা ভাব বিন্দুমাত্র ম্লান হয় নাই।
প্রত্যহ চানের সময় দয়ালহরি দুই কানে ও নাভির গর্ভে দুই ফোঁটা করে সর্ষের তেল ফেলে দেয়। অতঃপর শুশুকের মতো ডুব দিয়ে পরক্ষণেই ভেসে উঠলে নানা দৃশ্য তার চোখের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যায়।
দয়ালহরি বেশ গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত থেকে ভেবে চলে – জলদী গ্রামের ওপর দিয়া এতদিনে কয়টা বাদলা ঋতু পার হইল? কয়টা শীত অথবা ফাগুন?
দয়ালহরির এমত ভাবনার সঙ্গী হয়ে আমরাও দেখতে থাকি সেই যুদ্ধের সময় যার বয়স ছিল চৌদ্দো – সেও আর চৌদ্দোতে বসে নাই। ঝড়-বৃষ্টি-বাদলা-শীত বা বসন্তে অথবা গ্রীষ্মের অত্যধিক গরমে তার মাথার ঝাঁকড়া কেশরাজি প্রায় বিরান, দুই বা চারগাছি যাওবা চুল বর্তমান, তাও ধবধবা সাদা মেঘদলের বর্ণ। ফলে আমাদের দয়ালহরির যতো না বয়স, তার চাইতেও তাকে অধিক বয়স্ক মনে হয়।
বৃদ্ধ দেখায় কিংবা তরুণ – এইসব নিয়ে দয়ালহরির কোনো মাথাব্যথা নাই। বরুণা তাকে ভালো রেখেছে। সুখ ও শান্তিতে রেখেছে।
বরুণা বড় ধর্মভীরু 888sport promo code। এয়োতির চিহ্নকে সে খুব সমীহ করে চলে। বরুণা আর দয়ালহরির এক কন্যা আর এক পুত্র জন্মেছে। কন্যার নাম শিউলিবালা। শৈলবালা রাখতে চেয়েও রাখে নাই। নিজের মায়ের নামে কাউকে ডাকতে দয়ালহরির বাধো বাধো ঠেকেছে।
গীতামাসি স্বর্গবাসী হয়েছে। বরুণা আর দয়ালহরিই তার ভিটায় প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে। গীতামাসিরও ত্রিভুবনে একমাত্র কন্যা বরুণা ছাড়া আর কেউ ছিল না। এতগুলো বছরে শঙ্কার কিছু ঘটে নাই। আতঙ্কে থাকার মতোও কিছু নয়। তবে ওই যুদ্ধের বছরের বছর বিশেক পরে হাওয়ার জোর সামান্য বেড়েছিল। তখন মানুষ অস্থির হয়ে উঠেছিল মিলিটারি শাসকের বিরুদ্ধে। তখন এরশাদ সিংহাসনে। এরশাদশাহীর পতনের জন্য মানুষজন পঙ্গপালের মতো পথে নেমেছিল। দয়ালহরি রাজনীতি-ফিতি বোঝে না। বুঝবে কী করে? শৈলবালার মৃত্যুর পর তার লেখাপড়াও আর এগোতে পারে নাই!
তবে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া মায়ের দেহ সে এখনো ভুলতে পারে নাই!
এরশাদশাহীর পতনের জন্য আন্দোলন দয়ালহরি টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছিল।
দয়ালহরি নিরুপদ্রবে থাকতেই ভালোবাসে। শিউলিবালার পরে যে-পুত্র – তার নাম গঙ্গাহরি। দয়ালহরি ইচ্ছে করেই নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে এ-নাম রেখেছে।
গঙ্গাহরির দিকে তাকালে দয়ালহরির যেন নিজের কৈশোরে ফিরে যায়। মা শৈলবালার কী প্রাণান্তকর চেষ্টাই না ছিল নিজের সন্তানকে বাঁচানোর! তা দয়ালহরি তো বেঁচে রইলোই। সত্যি সত্যিই বেঁচে রইলো। গীতামাসি বেঁচে থাকতেই বাঁশখালীর বাজারে দয়ালহরিকে একটা মুদিদোকান করে দিয়েছিল। তা থেকে এখনো যা আয় হয় তাতে খুব ভালোভাবে না হলেও দিন চলে যায়। শিউলিবালা বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে অনেকদিন। কিন্তু টাকা-পয়সার টানাটানিতে তাকে পাত্রস্থ করা যাচ্ছে না।
দয়ালহরির এরকম ঢেউবিহীন দিন। জল যেখানে স্থির ও বিবর্ণ! নিজ ঘরের বারো ইঞ্চি সাদা-কালো টেলিভিশনের একাগ্র দর্শক দয়ালহরি। হঠাৎ করে ওই সাদাকালো রঙের ভেতর ঢেউ আছড়ে পড়ে! দয়ালহরি দেখে, মানুষের মিছিল আর মুখে তাদের জয়বাংলা।
চকিতে তার মনে পড়ে যায় সেই মুক্তিযুদ্ধের বছর। শৈলবালার কাছে ছিল ‘গন্ডগোল’। আরো অনেক সাধারণ মানুষের কাছেও ছিল ‘গন্ডগোল’।
‘এত বছর বাদে জয়বাংলা কোন শ্মশান থাইক্যা ফের উইঠ্যা আসতেছে?’
দয়ালহরির চক্ষু ফেটে জল নামে। এত বছর বাদে ফের কেন এত লোকের ভিড়ভাট্টা? শৈলবালা তো এদের মাঝে নাই। দয়ালহরি শব্দ করে কেঁদে ওঠে –
‘আহ্হা রে! মায়ে যে কই লুকাইয়া পড়লো। মার লগে আর দেখা হইল না!’
তা ঠিক। শৈলবালা তো দয়ালহরিকে সত্যি একরকম ফাঁকিই দিয়েছে। ছেলেকে নিরাপদ দূরত্বে পাঠিয়ে দিয়ে সে নিজে পুড়ে ছাইভস্ম হয়েছে।
তা এত মানুষ ফের ক্যান জড়ো হইছে? দয়ালহরি কেমন যেন তবদা মেরে বসে থাকে।
‘888sport appsে কি ফের যুদ্ধ শুরু হইল নাকি? কিন্তু কিয়ের জন্য এই যুদ্ধ?’
দয়ালহরি নতুন করে যেন ধন্দে পড়ে। তার ভেতর নানা চিন্তার আনাগোনা শুরু হয়।
‘এইডা ফের কিয়ের যুদ্ধ? মায়েরে যারা পুড়ায়া মারছিল হে গো কি বিচার অইব? ওই যে যুদ্ধের সমুয় যারা যারা লুটতরাজ করছিল হে-গো কি বিচার অইব?’
এর মাঝেই গঙ্গাহরি স্লোগান দেয় –
‘ক তে কাদের মোল্লা – তুই রাজাকার। তুই রাজাকার।’
‘ন তে নিজামী – তুই রাজাকার। তুই রাজাকার।’
‘রাজাকারের গালে গালে, জুতা মার তালে তালে।’
দয়ালহরি প্রৌঢ় চোখ যেন যুদ্ধের দৃশ্যই দেখে। বহুকাল পূর্বে ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য! কিন্তু দয়ালহরি ফের চিন্তায় ঘুরপাক খায় –
‘কিন্তুক এই স্বাধীন দ্যাশে এহন কিয়ের যুদ্ধ? এই দ্যাশের শত্রুরা কি নিপাত হয় নাই?’
এইসব আবোল-তাবোল চিন্তার মাঝে, দয়ালহরি আচ্ছন্ন হয়ে বসে থাকে। ঘর থেকে মুহূর্তমাত্র বের হয় না। দোকান খোলে না। দিনরাত টেলিভিশনের সামনে উবু হয়ে বসে থাকে। তবে এখন আর দয়ালহরির অন্তরে আগের সেই শঙ্কা নাই। সেই ভয় নাই। সেই আতঙ্ক নাই। বরং সে মনে মনে ভাবে –
‘নিজের দ্যাশের মাটিতে কে আর কার শত্তুর অইব? হইলেও কতডা হইব? দ্যাশ অহন একটাই। কিন্তুক দ্যাশের মুক্তির জন্য দুইডা মত-ই কেমতে তৈরি হইল?’
দয়ালহরির সাদা চুল-দাড়ি-গোঁফ আরো সাদাটে হয়ে ওঠে। যেন সে কতকাল ধরে রোগ-বালাইয়ের আছরে আছে। দেখে বরুণা রাগ করে বলে –
‘কী হইছে আপনের ভগবান জানে। কী এত ভাবনায় মইজ্যা রইছেন? দোহানেও তালা মাইরা থুইছেন – এমনে কি সংসার চলবো? ওঠেন – দোকান খুলেন গিয়া।
বরুণার রাগ-গোস্যার জ্বালায় পরদিন দয়ালহরি ভোর-ভোরই ওঠে। আজ সে দোকান খুলবে।
পুকুরের জলে তড়িঘড়ি চান সেরে নেয়। বরুণা তখন দেবী লক্ষ্মীর সামনে গড় হয়ে আছে। সকালের নিবেদন করছে।
এমন সময় দেউড়ির দিক থেকে হট্টগোল ওঠে। আর বাঁশ-লাঠি হাতে নিয়ে টুপি পরা একদল মানুষ পলকে দয়ালহরির উঠানে জড়ো হয়। তাদের চেনামুখ হিংস্র। গলায় গর্জন –
‘পাইছি শালার মালুডারে।’
দয়ালহরির মাথায় যদি বজ্রপাত হতো, তবু সে এত আশ্চর্য হতো না। এই কথায় সে একেবারে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই লোকগুলো তো তারই পাড়া-প্রতিবেশী। যাদের সে দেখে আসছে এই বাঁশখালীতেই। ভয়ানক হিংস্র চেহারার লোকগুলোকে যেন দয়ালহরির আর পরিচিত মনে হয় না। ততক্ষণে তারা পূজার ঘরে ঢুকে বরুণাকেও উঠানে টেনে এনেছে। পূজার থালার সিন্দুরে মাখামাখি হয়ে হয়ে আছে বরুণার মুখমন্ডল। ফলে তাকেও কেমন অচেনা দেখাচ্ছে।
বরুণার দিকে তাকিয়ে এইবার হুঙ্কার ছাড়ে তারা –
‘ওই মাগি, হাতের শাখা খোল। কথা না শুনলে কিন্তু তোর গুদ মাইরা দিমু।’
বরুণাকে জলেপড়া পক্ষী-শাবকের মতো দেখায়। দয়ালহরিকে ওরা জোর করে ধরে রেখেছে। বরুণার মাথার ভেতর অন্ধকার নামতে থাকে। দয়ালহরি বেঁচে থাকতেই কীভাবে সে সিন্দুর মুছে ফেলবে।
কীভাবে খুলবে এয়োতির চিহ্ন? তখনই ফের হুঙ্কার শোনা যায় –
‘কি রে মাগি, সোজা কথায় কাম হয় না, না? শাঁখা খোল – সিন্দুর মোছ। কথা শুনবি, যহন জায়গামতো ধন হান্দাইয়া দিবো।’
বরুণার শাঁখা খোলার দৃশ্য দেখে দয়ালহরির হঠাৎ মনে পড়ে শৈলবালা না তাকে কলেমা শিখিয়েছিল? সে কি এখন এই উন্মত্ত লোকগুলোর সামনে কলেমা পড়বে? শৈলবালাকে তো কলেমা পড়ারও সুযোগ দেওয়া হয় নাই – তাকে ঘুমের ভেতরই পুড়িয়ে মারা হয়। কলেমা পড়তে যেয়ে দয়ালহরি দেখে কিছুই তার মনে পড়ে না। শৈলবালার পোড়া দেহটা যেন বরুণার শরীরে মিশে যেতে শুরু করে । দয়ালহরি তখন দুর্বৃত্তদের হাত ছাড়িয়ে ভোঁ দৌড় দেয়। দয়ালহরির পিছু পিছু হিংস্র মানুষগুলোও দৌড়ায়। দয়ালহরি পায়খানার ভেতর ঢুকে দরজা আটকানোর পূর্বেই ফের ওদের হাতে ধরা পড়ে। এবার আর তার নিস্তার হয় না। তাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে লাঠির কয়েক ঘা বসায়। দয়ালহরির চোখে তখন আর কোনো কিছু নাই। শিউলিবালা বা গঙ্গাহরিও নাই। সে শুধু দেখে বরুণার শরীর – যা ইতোমধ্যে পুড়ে কালো অঙ্গার হয়ে আছে। কোথাও অগ্নিকান্ড ঘটে নাই। কিন্তু দয়ালহরি অমন দেখে! আগুনের বিশাল হল্কা তাকে গ্রাস করার আগেই সে ফের দৌড় লাগায়। পেছনে পেছনে হল্লা করে দুর্বৃত্তরাও দৌড়ায়। কোথায় লুকাবে দয়ালহরি এখন? আত্মরক্ষার আর কোনো উপায় না পেয়ে পুকুরের জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে। এই সেই পুকুর – কত দীর্ঘ সময় দয়ালহরি এতেই স্নান সেরেছে। ঝাঁপ দিয়েই সে কচুরিদামের আড়ালে লুকাতে চেষ্টা করে। কিন্তু বাঁশের বাড়িটা পড়ে তার মাথার তালু বরাবর। দয়ালহরি তখন ডুব দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালায়। কিন্তু কতক্ষণ সে ডুব দিয়ে থাকবে? ভুঁশ করে ভেসে উঠতেই দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বাড়ি পরে তার মাথায়। তাজা রক্তে পুকুরের জল লালচে হয়ে ওঠে।
লালচে জলে ফের ডুব দিতে দিতে দয়ালহরি যেন স্পষ্ট দেখতে পায় –
এই পুকুরের জলে গীতামাসি দেবতার থালা-বাসন ধুয়ে সাফ করছে। এই জলে বরুণা ও শিউলিবালা স্নান করছে। স্নান করছে গঙ্গাহরি। বরুণা তো এর জলেই থপথপ করে কাপড় কাচছে পিঁড়ি পেতে। সেও তো এই জলেই ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে দেবতার তৈজস। দয়ালহরির তবে আর ভয় কী? এই ভেবে সে ফের জলের ওপরে মাথা তোলে। তখন অজস্র বাঁশ ও লাঠির বাড়ি পরে তার মাথায়-কাঁধে-ঘাড়ে-পিঠে। দয়ালহরির তখন কি ফের মনে পড়ে –
মায়ের শেখানো কলেমাডা কি পড়বো এগো সামনে?
অথবা সে কী ভাবে –
অহন কি মুক্তিযুদ্ধের কাল?
ওসবের কিছুই আমরা জানতে পারি না।
হয়তো দয়ালহরিও এইসবের কিছুই ভাবে না। সে শুধু নিজের কথাই ভাবে। নিজেকে বাঁচানোর কথা। নিজের বাঁচার কথা! সে হয়তো ফের লুকাতে চায় কচুরিদামের আড়ালে। লুকাতে চায় প্রাচীন ও শীতল জলের তলায়।
দয়ালহরি হয়তো ভাবে – জলের তলায় আর যাই হোক মানুষের হিংস্রতা থাকে না। মানুষের হিংস্রতা সেখানে পৌঁছাতে পারে না। এমন ভেবেই দয়ালহরি ফের ডুব দেয়। দীর্ঘ ডুব। প্রাচীন ও শীতল জলের তলায় নিরুপদ্রব ডুব!
পরদিন ফুলে-ফেঁপে-ভেসে না ওঠা পর্যন্ত – দয়ালহরির সন্ধান সত্যিই পাওয়া যায় নাই।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.