হাবিব আর রহমান
রেনেসন্স : বাংলার রেনেসন্স ষ গোলাম মুরশিদ ষ অবসর
ষ 888sport app, ২০১৫ ষ ১০০০ টাকা
চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে ইতালিতে সংঘটিত রেনেসাঁস এবং ইউরোপসহ পৃথিবীর অন্য কিছু দেশে এর প্রভাব ও সেই প্রভাবের চরিত্র নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। এই আলোচনায় বাঙালির ভূমিকা বড় কম নয়। বাংলা ও ইংরেজি – এই দুই ভাষায় অনেক কৃতবিদ্য বাঙালি পৃথিবীর ইতিহাসের গতিমুখ পরিবর্তনকারী ঘটনাটিকে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে বুঝতে চেয়েছেন। আগ্রহের প্রত্যক্ষ কারণও রয়েছে। তাঁদের নিজেদের দেশে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে রেনেসাঁসের মতো একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছিল। তাকে রেনেসাঁস বলা যাবে কি না তা আলাদা বিষয়, কিন্তু শিক্ষিত বাঙালির চিত্তে যে একটা নতুন আলোর বিচ্ছুরণ লেগেছিল এবং তার নানামুখী বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল, তা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। তবু বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে। ইতালীয় রেনেসাঁস ও বাংলার রেনেসাঁস বা নবজাগরণ – দুদিকেই রয়েছে সেই অমীমাংসা। খ্যাতনামা গবেষক গোলাম মুরশিদ মীমাংসার একটা আকাক্সক্ষা থেকে লিখেছেন রেনেসন্স : বাংলার রেনেসন্স নামে বইটি। জানামতে, রেনেসাঁসবিষয়ক বাংলা বইয়ের এটিই সর্বশেষ সংযোজন।
রেনেসন্স বা রেনেসাঁস – উচ্চারণ যা-ই হোক না কেন, একটা কথা সত্য যে, ইতালিতে যা ঘটেছিল তা নিয়ে কিছু ভুল বোঝাবুঝি আছে এবং সেটা কেবল বাঙালি লেখকদের মধ্যে নয়, পাশ্চাত্য লেখকদের মধ্যেও। যেমন, ভূমিকায় গোলাম মুরশিদ জানিয়েছেন, বুর্কহাট তাঁর বিখ্যাত বই The Civilization of the Renaissance Italy-তে আঠারো শতকের ফরাসি এনলাইটেনমেন্টের মূল্যবোধ রেনেসাঁসের ওপর আরোপ করেছেন। রেনেসাঁসের মানবিকতা সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়নও যথার্থ নয়। এই অভিযোগ বাঙালি লেখকদের কারো কারো সম্পর্কেও প্রযোজ্য। এর বাইরেও শেষোক্তদের সমালোচনা করার মতো বিষয় আছে, যাঁরা বাংলার জাগরণের পরিপ্রেক্ষিতে ইতালির দিকে তাকিয়েছেন তাঁরা সবাই রেনেসাঁসের স্বরূপ অনুধাবন করতে পারেননি।
বেশ কয়েকজন বাঙালি লেখকের নামোল্লেখ করে ভূমিকায় গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, ‘ … রেনেসন্স-সম্পর্কিত এসব লেখা পড়েও আমি ইতালীয় রেনেসন্সের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিক কেমন ছিলো, তা বুঝতে পারিনি। বিশেষ করে বুঝতে পারিনি, রেনেসন্সের সঙ্গে রিভাইভালের পার্থক্য কোথায়। হিউম্যানিটিজের সঙ্গে হিউম্যানিজমের কোনো যোগাযোগ আছে কি? রেনেসন্সের মানে কি ঈশ্বরের দিক থেকে মানুষের দিকে মুখ ফেরানো? পরলোকের দিক থেকে ইহলোকের দিকে মনোযোগ দেওয়া? রেনেসন্সের সঙ্গে সেকিউলারিজমের যোগাযোগ কি সিত্য, না কল্পনা?’
এসব জিজ্ঞাসা, ধারণা করি, সন্ধিৎসু অনেকের মনেই জাগে। বর্তমান আলোচকও তাদের একজন। আমাদের আরো বিভ্রান্তি রয়েছে ইংরেজি শব্দের বাংলাকরণের ক্ষেত্রে। দু-একজনের সঙ্গে কথা বলেও বিভ্রান্তি ঘোচেনি। যেমন হিউম্যানিজমের যথার্থ বাংলা কি মানববাদ, না মানবতাবাদ, অথবা মানবিকতাবাদ? তদ্রƒপ হিউম্যানিস্ট কি মানববাদী, না মানবতাবাদী, নাকি মানবিকতাবাদী? তদ্রƒপ হিউম্যানিস্ট কি মানববাদী, না মানবতাবাদী, নাকি মানবিকতাবাদী? হিউম্যানিস্টের অর্থ আলোচ্য গ্রন্থেই একবার লেখা হয়েছে মানবতাবাদী, আরেকবার মানববাদী (পৃ ৫০ ও ৫২)। দেখা যাচ্ছে বিভ্রান্তি সহজে ঘুচবার নয়। হিউম্যানিস্টের বাংলা মানবতাবাদী করা হলে হিউম্যানিটারিয়ানের বাংলা কী হবে? এরকম রিভাইভাল ও রেনেসাঁস! দুটোরই অর্থ এক। কিন্তু রিভাইভালিজমের অর্থ আবার আলাদা। বাংলা পুনরুত্থানবাদ দিয়ে কি ইংরেজি শব্দটির সঠিক অর্থ বোঝানো যায়? এসব বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা নিরসনের জন্য গোলাম মুরশিদের কাছে একটা প্রত্যাশা আমরা জানিয়ে রাখতে পারি।
গ্রন্থের নাম থেকে বোঝা যায় এর দুটো অংশ। প্রথমটা রেনেসাঁস অর্থাৎ ইতালির রেনেসাঁস, দ্বিতীয় অংশ বাংলার রেনেসাঁস। রেনেসাঁসের দুটো দিক – একটি জীবন ও জগৎ-ভাবনা, অন্যটি নন্দনভাবনা। অন্য কথায় বৌদ্ধিক দর্শন বা চিন্তা এবং নান্দনিকতা। এই দুটো দিকই একেবারে আনকোরা নতুন নয়, পুনরুদ্ধার। প্রধানত ধ্রুপদী যুগের গ্রিস ও অংশত রোমান ঐতিহ্যের উজ্জ্বল পুনরুদ্ধার। পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য তাকে নতুন রূপদান ও ব্যবহার। রেনেসাঁসের অন্যতম রূপকার লিওনার্দো ব্রুনি বলেছিলেন, ‘আমি অবশ্যই প্রাচীন বিদ্যার চর্চা করবো, তবে তা প্রাচীন বিদ্যাকেই প্রয়োগ করার জন্য নয়, বরং প্রাচীন বিদ্যা ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন কিছু সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে।’ নন্দনচর্চা অর্থাৎ 888sport live football ও 888sport live chat সৃষ্টির ক্ষেত্রেও একই মনোভঙ্গি কাজ করেছে। জীবনভাবনা ও যাপনে একটা নতুন অভিমুখ সৃষ্টির লক্ষ্যে এই যে মননচর্চা ও সৌন্দর্যসাধনা – সংক্ষেপে এটাই হচ্ছে রেনেসাঁস।
ইউরোপে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রসার ও রোমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রভূমি রোমে তার ঘাঁটি (ভ্যাটিকান) প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ধ্রুপদী যুগের যাবতীয় মননশীল চর্চা গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতার শেকলে বাঁধা পড়েছিল। বিখ্যাত সেন্ট অগাস্টিন পার্থিব আর অপার্থিব জগৎকে অভিহিত করেছিলেন ‘সিটি অব ম্যান’ ও ‘সিটি অব গড’ বলে। পার্থিব জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে সিটি অব গডের দিকে তাকানোর আদর্শকেই খ্রিষ্ট ধর্ম গুরুত্ব দিয়েছিল। ফলে জীবন হয়ে পড়েছিল বিষাদময়, পাপভীতিতে সস্ত্রস্ত ও স্থবির। এই পটভূমিতে ইতালিতে গড়ে-ওঠা স্বাধীন নগর রাষ্ট্রগুলোতে বাণিজ্যিক ধনতন্ত্রের উদ্ভব হওয়ায় সমাজের
একাংশে প্রয়োজন অনুভূত হয় সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের। এই সময়েই জন্ম হয় কিছু অসামান্য ব্যক্তি-প্রতিভার। বিশেষভাবে ফ্লোরেন্সে ধনাঢ্য পরিবারের পৃষ্ঠপোষণায় ব্যক্তি-প্রতিভার মণি-কাঞ্চন সহযোগে ঘটে সেই সাংস্কৃতিক উজ্জীবন। যেহেতু এই উজ্জীবনের প্রেরণাদায়ী উৎস ধ্রুপদী গ্রেকো-রোমান সংস্কৃতি, সেহেতু এ আসলে পুনরুজ্জীবন, তবে অবশ্যই নতুন ভাবে ও রূপে। ইংরেজিতে এরই নাম রেনেসাঁস। লেখক বইয়ের শুরুতে খুব সংক্ষেপে কিন্তু স্পষ্টভাবে সমগ্র এই ইতিহাস দক্ষতার সঙ্গে বিবৃত করেছেন।
ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘ইতালিতে যে রেনেসন্স হয়েছিলো, তার প্রধান ক্ষেত্র ছিলো চিত্রকলা, ভাস্কর্য এবং স্থাপত্য। আমরা এতোকাল বাংলায় যেসব বই পড়েছি, ছবির অভাবে তা থেকে এসব ক্ষেত্রে ঐতিহ্যের যে-প্রভাব পড়েছিলো এবং অতীতের ওপর ভিত্তি করে যে-নতুনের জন্ম হয়েছিলো, তা বোঝা সম্ভব হয়নি। একটা চিত্রের নাম উল্লেখ করা আর সে চিত্রটির প্রতিকৃতি চোখের সামনে তুলে ধরে তার বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করা এক নয়। এ গ্রন্থে সেই চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের বিবেচনায় এটাই এ-বইয়ের প্রধান অভিনবত্ব। ধ্রুপদী যুগ থেকে রেনেসাঁসের সময় পর্যন্ত ৬৬টি 888sport live chatকর্মের প্রতিকৃতি সংযোজন বইটির একটি সম্পদও বটে। এরই ফাঁকে ফাঁকে রেনেসাঁসের অপরদিক – 888sport live football ও বৌদ্ধিক চিন্তাচর্চার দিক আলোচনা করা হয়েছে। সে-আলোচনা কিছুটা সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তাতে রেনেসাঁসের স্বরূপ অনুধাবনে অসুবিধা হয় না।
এ-আলোচনার অভিমুখ বইয়ের দ্বিতীয় অংশের দিকে ফেরানোর আগে ভূমিকায় লেখক গোলাম মুরশিদ রেনেসাঁস সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা, বিশেষ করে বুর্কহার্টের মূল্যায়ন সম্পর্কে যে-সংশয় বা প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, সেদিকে একটুখানি দৃষ্টিপাত করা দরকার। দ্বিতীয় অংশের আলোচনায়ও হয়তো তা কাজে লাগতে পারে। ১৮৫৮-৬০ সালে বুর্কহার্টের পূর্বোল্লিখিত বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে, গোলাম মুরশিদের মতে, ‘… হিউম্যানিটিজ সম্পর্কে পাঠকদের মনে একটা আদর্শায়িত ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। এ কথাটার প্রায় সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে হিউম্যানিজম – মানবমুখিনতা এবং ইহলৌকিকতা। এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, মিউম্যানিটিজের চর্চা ধর্মের চর্চাকে নিরুৎসাহিত করেছিলো এবং মানুষকে দান করেছিলো ইহলৌকিক দৃষ্টিভঙ্গি।’
সত্য যে, হিউম্যানিটিজ আর হিউম্যানিজম এক নয়। রেনেসাঁসের হিউম্যানিটিজ হচ্ছে ভাষা, 888sport live football, ব্যাকরণ, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি লিবারেল আর্টসের চর্চা। আর সেই চর্চাকারী হচ্ছেন হিউম্যানিস্ট। আজকের সঙ্গে তার অর্থগত তফাত বিস্তর। কিন্তু হিউম্যানিজমের সবচেয়ে বড় দুটো বৈশিষ্ট্য মানবমুখিনতা ও ইহলৌকিকতা রেনেসাঁসে আরোপ করা অযথার্থ, এমন কথা কি বলা যাবে? মানুষের সর্ববিধ নিয়ামকতা সম্পর্কে গোলাম মুরশিদের বইতেই দুজনের দুটো উক্তি রয়েছে। প্রথমটি ধ্রুপদী যুগের প্রোটাগোরাসের। তিনি বলেছিলেন, সবকিছু বিচারের মানদণ্ড হলো মানুষ (পৃ ৫০)। আর রেনেসাঁস যুগের জোভান্নি পিকো দেল্লা মিরান্দোলা বলেছিলেন, মানুষ মানুষের
ভাগ্য-বিধাতা (পৃ ৪৭)। পিকোর Oration on the Dignity of Man বইয়ের কয়েক পঙ্ক্তির একটা বক্তব্য গোলাম মুরশিদ সম্ভবত তাঁর নিজের 888sport app download apk latest versionে উপস্থাপন করেছেন। তা থেকে বর্তমান প্রসঙ্গে তো বটেই, হিউম্যানিটিজের চর্চা ধর্মের চর্চাকে নিরুৎসাহিত করেছিল কি না, সে-বিচারও ফলবান হতে পারে। পিকের বক্তব্যটি এই :
গড মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন অন্য সবকিছু সৃষ্টি প্রায় শেষ করে, যাতে সে মানুষ মহাবিশ্বের নিয়মকানুন জানতে পারে, তার সৌন্দর্য ভালোবাসতে পারে এবং তার বিশালত্বের প্রশংসা করতে পারে। মানুষকে তিনি কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় বন্দী করে রাখেননি; তার জন্যে কোনো নির্দিষ্ট কাজ বেঁধে দেননি, বরং তাকে দিয়েছেন ইচ্ছা করার এবং ভালোবাসার স্বাধীনতা। অ্যাডামকে গড বললেন, ‘আমি তোমাকে বিশ্বের কেন্দ্রে স্থাপন করেছি, যাতে তুমি সহজে তার সবকিছুই দেখতে পাও। আমি তোমাকে দৈবশক্তি দান করে সৃষ্টি করিনি, অথবা পার্থিব করেও সৃষ্টি করিনি, তোমাকে কেবল মরণশীল অথবা অমর হিসেবেও সৃষ্টি করিনি, যাতে তুমি নিজেকে গঠন করতে পারো এবং যাতে উঠতে পারো তোমার সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে। তুমি ইচ্ছা করলে পশুর মতো হতে পারো, অথবা দেবতার মতো হতে পারো। তোমার স্বাধীন ইচ্ছায় তুমি নিজেকে গড়ে তুলতে পারো।’ মানুষ মানুষের ভাগ্য-বিধাতা।
পিকো ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন। এ-ও সত্য যে, রেনেসাঁসের কবি-888sport live chatী-বিদ্বানরা কেউ সে-বিশ্বাস থেকে নিজেদের বিযুক্ত করেননি। কিন্তু পিকোর বক্তব্যে মানবজীবনের স্বনির্মাণ সম্পর্কে যে-ঘোষণা রয়েছে তা কি সেমেটিক কোনো ধর্মের (ইহুদি, খ্রিষ্ট ও ইসলাম) বক্তব্যের সঙ্গে মেলে? মিল যদি কোথাও পাওয়া যায়ও, তার বিপরীত বক্তব্যও কম পাওয়া যাবে না। ফলে কেবল পিকো কেন, গ্রন্থকার কবি ও 888sport live chatীদের সৃষ্টি, হিউম্যানিস্টদের ধর্মভাবনা, জ্যোতির্888sport apkীদের প্রকৃতিভাবনা ও আবিষ্কার সম্পর্কে যেখানে-যেখানে আলোচনা ও ব্যাখ্যা করেছেন, সবখানেই মানুষের মুখ ও ইহলোক অস্ফুট যদি হয়ও তবু স্বপ্রকাশ হয়ে উঠেছে। তা চিনে নেওয়া কঠিন নয়। আর ধর্মবিশ্বাস? যে-সুতোর ওপর তা নির্ভর করে ছিল, তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, তার শক্তি ক্রমহ্রাসমান। ফলে বুর্কহার্টের বক্তব্য নস্যাৎ করে দেওয়ার শক্ত কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। তবে এ-কথা সত্য যে, হিউম্যানিস্টদের মধ্যে হিউম্যানিটি বা মানবতার পরিচয় লক্ষ করা
যায় না, বাংলার রামমোহন-বিদ্যাসাগর প্রমুখের মধ্যে যা আমরা দেখতে পাই।
সবাই জানেন, ইতালির রেনেসাঁস আর বাংলার জাগরণের মধ্যে দেশকালগত ব্যবধান বিস্তর। অন্তত দুটো তফাতের কথা বলি। ইতালি ছিল স্বাধীন। অন্যদিকে বাংলা ছিল ব্রিটিশের উপনিবেশ। দ্বিতীয়ত, ইতালির সামনে ছিল ইতিবাচক একটি সমৃদ্ধ প্রাচীন ঐতিহ্য। সমৃদ্ধ ঐতিহ্য প্রাচীন ভারতেরও ছিল। কিন্তু তাতে ইতিবাচকতা যতটা ছিল, নেতিবাচকতাও কম ছিল না। বাংলার জাগরণের উদ্দীপক হিসেবে তাই প্রধানত কাজ করেছিল ইউরোপীয় জ্ঞান-888sport apk ও
888sport live chat-সংস্কৃতি।
দেশকালের এই বিস্তর দূরত্ব ও পরিস্থিতির ভিন্নতার কারণে দু-দেশের জাগরণ স্বাভাবিকভাবেই একরকম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এ-দুইয়ের মৌল চরিত্রের মধ্যে যে অনেক মিল রয়েছে তা অস্বীকারের উপায় নেই। বইয়ের দ্বিতীয় অংশে নানাদিক আলোচনা করে লেখক গোলাম মুরশিদ সেসব মিল-অমিল দেখিয়েছেন এবং সীমিত অর্থে হলেও বঙ্গীয় ঘটনাবলিকে রেনেসাঁসের স্বীকৃতি দিয়েছেন। এ-ব্যাপারে দ্বিমত না হলেও তিনি যেসব অমিল দেখিয়েছেন সেগুলোর
কোনো-কোনোটি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে বলে আমাদের মনে হয়েছে।
প্রথমে একটা স্ববিরোধী বক্তব্যের কথা বলি। দ্বিতীয় অংশের শুরুর পৃষ্ঠায় (পৃ ১০৫) বলা হচ্ছে, ইতালিতে রেনেসাঁস আসার ফলে মানুষের মনোভাব ও জীবনধারায় যে-ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল, বাংলায়, বিশেষ করে তার বৃহত্তর সমাজে সে-ধরনের প্রভাব বা পরিবর্তন দেখা যায় না। অথচ বইয়ের একেবারে শেষে ১৬৬ পৃষ্ঠায় বাংলার রেনেসাঁসের নিতান্ত সীমাবদ্ধতার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছে, ইতালির রেনেসাঁসও সীমাবদ্ধ ছিল একান্তভাবে নাগরিক সমাজে, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও ধনীদের মধ্যে। অমিল দেখাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মিলই দেখানো হলো না কি?
ইতালির হিউম্যানিস্ট পণ্ডিতদের প্রধান বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, প্রাচীন বিদ্যার উদ্ধার, 888sport app download apk latest version ও পুনঃপ্রচার করে মধ্যযুগের জীবনবিমুখ ধ্যান-ধারণাকে বাস্তব ও ভবিষ্যৎমুখী করার তাঁরা চেষ্টা করেছিলেন। এই প্রয়াস বাংলায়ও লক্ষ করা যায়। তবে তা শুরু করেছিলেন বাঙালিরা নয়, বিদেশিরা – এশিয়াটিক সোসাইটির মাধ্যমে – কী ছিল তাদের উদ্দেশ্য? গ্রন্থকার নিজেই লিখেছেন, গবেষণা করা; বলেননি যে, বাঙালির দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেওয়া
(পৃ ১০৬)। তাহলে কীভাবে তাদের ইতালীয় হিউম্যানিস্টদের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে ঠাঁই দেওয়া যায়? বিদেশি প্রাচ্যবিদদের অন্যতম ভূমিকা অস্বীকার না করেও বোধকরি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত না হলেও রামমোহন রায়কে ভারতীয় প্রাচীন বিদ্যাচর্চা করতে হতো। সেটা অনিবার্যই ছিল।
১১২ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ইতালির রেনেসাঁসের সঙ্গে তুলনা করার মতো প্রবল কোনো ‘ব্যক্তিক ও সামাজিক আন্দোলন’ বাংলায় হয়নি, এখানে ‘যেটুকু হয়েছিলো, তার প্রধান ভাগই নিহিত ছিলো প্রাচীন দর্শন, 888sport live football এবং ইতিহাস চর্চায়।’ এই পুরো বক্তব্যের মর্মার্থ আমাদের কাছে ঠিক স্পষ্ট হয়নি। ‘ব্যক্তিক’ আন্দোলন মানে কি ব্যক্তিগতভাবে কৃত আন্দোলন? তা যদি হয় তবে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের নাম কি মনে না পড়ে পারে? সতীদাহ নিবারণ ও বিধবা বিবাহ আন্দোলন কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে করা হয়নি। বিদ্যাসাগরের শিক্ষা আন্দোলনও 888sport app download for androidীয়। এসব প্রচেষ্টাকে সামাজিক আন্দোলন বলতে বোধকরি বাধা নেই।
বাংলায় বিদ্যা ও সংস্কৃতিচর্চা কেবল প্রাচীন দর্শন, 888sport live football ও ইতিহাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল – এ-মন্তব্যও তথ্যসম্মত নয়। লেখক নিজেই বাংলার জাগরণকালীন শিক্ষিত বাঙালির ধর্ম, মানবতাবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, 888sport promo code-সচেতনতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। বাস্তব কর্মপ্রয়াসের সঙ্গে এগুলো মননচর্চার সঙ্গেও সম্পৃক্ত। এসব বিষয় নিয়ে সমকালে বহু লেখালেখি ও তর্কবিতর্ক হয়েছে।
গোলাম মুরশিদ-সম্পাদিত বিদ্যাসাগর গ্রন্থে (পু. মু. ২০১৬) রমেন্দ্রনাথ ঘোষ তাঁর ‘বিদ্যাসাগরের নীতিবোধ এবং কর্মনিষ্ঠা’ 888sport liveের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘… বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলতে হয় যে তিনি প্রতীচ্যের প্রায় চারশত বৎসর পরে রেনেসাঁর স্বীকরণ করলেও, প্রতীচ্যের চেয়ে প্রাচ্যের চিন্তাধারাকে আরও কয়েক শত বৎসর এগিয়ে নিতে প্রয়াস পেয়েছিলেন।’ (পৃ ৬১) এটি হয়তো অতিশয়োক্তি, কিন্তু এতে সত্যতাও কম নেই। তাছাড়া তাঁর কর্মনিষ্ঠা ও নীতিবোধ অতুলনীয়। তাঁর মতো ‘দার্ঢ্যে শালকড়ি’ ও ‘করুণার সিন্ধু’ ইতালীয় রেনেসাঁসে একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং নৈতিক শিথিলতার বেশ কিছু দৃষ্টান্ত সেখানকার বিখ্যাত একাধিক হিউম্যানিস্টের মধ্যে দেখা যায় (শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, রেনেসাঁসের আলোয় বঙ্গ দর্শন, কথাপ্রকাশ, 888sport app ২০১৩, পৃ ৩০)। দৃষ্টান্ত অধিক না বাড়িয়ে কেবল যদি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কথা ধরি, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে, একসঙ্গে অতো মেধা-প্রতিভার সাক্ষ্য পৃথিবীর আর কোনো পরিবারে দেখা যায়নি। আর চিন্তা, কর্ম ও সৃজনশীলতা – সবদিক থেকে ওই বাড়ির ছোট ছেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো জোড়া নেই। এ-প্রসঙ্গে বাংলার 888sport promo codeশিক্ষা ও 888sport promo codeমুক্তির প্রচেষ্টার কথাও বলতে হয়, যা ইতালিতে দেখা যায়নি। তুলনার ক্ষেত্রে তুলনীয়ের কোনো কোনো দিক থেকে অতিক্রম করে যাওয়ার প্রতি, বিশেষ করে বর্তমান প্রসঙ্গের মতো বিষয়ে, দৃষ্টিপাত করার প্রয়োজন পাঠকের প্রত্যাশার মধ্যে থাকা স্বাভাবিক। গ্রন্থকার এদিকটায় একটু নজর দিলে আলোচনা আরো ফলপ্রসূ হতো বলে মনে হয়।
বাংলায় কলকাতাকেন্দ্রিক এই যে রেনেসাঁস বা নবজাগরণ, তা সংঘটিত হয়েছিল বাঙালি হিন্দু সমাজে। জানতে চাওয়া স্বাভাবিক যে, বাঙালির অপর প্রধান অংশ মুসলমান সমাজে অনুরূপ কিছু ঘটেছিল কি না। গোলাম মুরশিদ তাঁর বইয়ের দু-জায়গায় এ-সম্পর্কে ছোট্ট দুটো মন্তব্য করেছেন, ওয়াকিবহাল পাঠকের কাছে যা একটি বড় রকমের হোঁচট হতে পারে। ১২৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘সদ্যশিক্ষিত মুসলমানরা ত্রিশের দশক থেকে রেনেসন্স শব্দটা ব্যবহার করতে আরম্ভ করেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে রেনেসন্সের স্পিরিট দেখা দেয়নি, দেখা দিয়েছিলো সাম্প্রদায়িকতা – সচেতন পুনরুজ্জীবন আন্দোলন – রিভাইভাল।’ আর ১৬৬-সংখ্যক শেষ পৃষ্ঠায় মন্তব্য করা হয়েছে, ‘এই আন্দোলন মুসলিম সমাজকে যে আদৌ আলোড়িত করবে – এমন প্রত্যাশা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কারণ, বাংলার মুসলিম সমাজে রেনেসন্স আসার মতো অনুকূল অবস্থা তখনো তৈরি হয়নি। নজরুল ইসলামের কণ্ঠে রেনেসন্সের যে-উদাত্ত কিন্তু স্বল্পস্থায়ী আহ্বান শোনা গিয়েছিলো, তা ছিল নিতান্তই ব্যতিক্রমী।’ বই এখানেই শেষ।
বিস্তারে যাওয়ার সুযোগ এখানে নেই। তা না হলে এ-বিষয়ে বলবার মতো কথা অনেক আছে। অবাক হতে হয় একথা ভেবে যে, বিশ শতকের শুরু থেকে চল্লিশের দশকের পূর্ব পর্যন্ত চল্লিশ বছর সময়ের মধ্যে গোলাম মুরশিদের মতো পণ্ডিত ব্যক্তি ও পরিশ্রমী গবেষকের একমাত্র নজরুলের কথাই মনে পড়ল! রোকেয়াকে তিনি তাঁর আলোচনায় ঠাঁই দিয়েছেন। এই মহীয়সীর রচনাকর্ম ও শিক্ষাপ্রকল্পের মধ্যে কি রেনেসাঁসের কোনো লক্ষণ নেই? 888sport appর বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনকে কী করে পাশ কাটানো যায়? শিখা পত্রিকার মুখবাণী হিসেবে মুদ্রিত ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট মুক্তি সেখানে অসম্ভব’-এর মধ্যে রেনেসাঁসের স্পিরিট জ্বলজ্বল করছে। হিন্দু সমাজের নবচেতনা মুসলিম সমাজকে আদৌ আলোড়িত করেনি – এ-মন্তব্যও অযথার্থ। কাজী আবদুল ওদুদের বহু রচনা এর প্রমাণ।
সম্পূর্ণ আর্ট পেপারে ছাপা রয়্যাল সাইজের রেনেসন্স : বাংলার রেনেসন্স বইটির মুদ্রণসৌকর্য নজর কাড়ে। রাফায়েল-অঙ্কিত
‘স্কুল অফ এথেন্স’ চিত্র অবলম্বনে সব্যসাচী হাজরার প্রচ্ছদ
একে কেবল দৃষ্টিনন্দন করেনি, দ্যোতনা সৃষ্টিও করেছে।
গ্রেকো-রোমান যুগের ও রেনেসাঁস-কালের অনেক 888sport live chatকলার ফটোচিত্র ও 888sport live chatগত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এ-বইয়ের প্রধান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.