যে-কোনো সমাজব্যবস্থা তার সংস্কৃতি ও ভাষার চলনকে নির্ধারিত করে দেয়। পুরুষশাসিত সমাজ বলে নানাকে আগে আনতে হয়। পরে নানি। যদিও আমার কাছে আমার জীবনের প্রথম দশ বছরের প্রিয় মানুষ ছিল নানি। সুখে-দুঃখে নানি-নির্ভর। মা-র চেয়ে বেশি। সেখানে নানা ছিলেন বলতে গেলে শাসক। আমার ক্ষেত্রে খলনায়ক। কর্তাব্যক্তিরা বাকিদের কাছে একরকম খলনায়ক হয়েই দাঁড়ায়। কারণ তিনি নিয়ম-কানুনের নিয়ন্ত্রক। নিয়ম মানেই বাধা। আর যা অসহিষ্ণুতা তৈরি করে। বলতে গেলে সভ্যতাও এক ধরনের খলনায়কত্ব শাসিত সমাজ। সভ্যতা মানে ছোটাছুটি বন্ধ। তাসের দেশ। চিড়িতন, হরতন, রুহিতন, ইস্কাপন। ছন্দে ছন্দে চলতে হবে। তালকানা হলে চলবে না।
মা ছিলেন কুলাক-(রাশিয়ান জমিদার) তনয়া। হাতে তাঁর পাখার ডাঁট। মানে তালপাতার পাখা। এইসব শাসনের ক্ষেত্রে একমাত্র জগদ্ধাত্রী ছিলেন নানি গোলাপজান বেগম। তাঁর পেছনে গেলে যেন প্রাণ আসত ধড়ে। না হয় কপালে গোটা দুই দুমাদুম কিল ছিল অবধারিত। মা ঘুসিটা মারত না। কারণ হাজার হলেও মা-তো!
নানিকে, যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে, দেখেছি একই রকম স্নেহপ্রবণ মানুষ। আমার দাদি মানে ঠাকুরমাও ছিলেন তাই। তফাৎ দাদি ছিলেন বেশি গরিবঘরের মেয়ে। আর রংও চাপাশ্যামলা। একহারা বা পাতলাই বলা চলে। সারাজীবন ছিলেন একই ধরন। তবে কৃষ্ণকলি। দাদা শেখ মহম্মদ এহিয়া মনে হয় তাতেই মজেছিলেন। বিয়েটা অবশ্য প্রস্তাবিত বিয়ে। প্রেমমূলক নয়। একেবারে আইন মেনে। আমাদের পাড়ার পাশেই। মুনশিপাড়া।
নানি ছিলেন ফর্সা। নানির মা, যাকে বলতাম ঝিমা তিনি আরো উজ্জ্বল আর ছিলেন হলুদ ধরনের ফর্সা। ছিলেন একহারা চেহারার। দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি ছিল ঝামটিয়ার পুবে লাগোয়া গ্রাম খাজুরদহ। মাইক্রোফোন চালু হবার পর ও-গ্রামের আজানের ধ্বনি এ-গ্রাম থেকে শোনা যেত। এতেই বোঝা যেত নামাজের ওয়াক্ত। কিন্তু ঝামটিয়ায় তার প্রভাব ছিল না বললেই চলে। বরং সন্ধ্যায় পাশের পাড়া থেকে শঙ্খধ্বনি ও কাঁসরঘণ্টা কানে এসে বাজত। আর জানাত একটা দিনের অবসান। সন্ধ্যার এই শঙ্খধ্বনি আর কাঁসরঘণ্টা আমার মনকে বড় ছুঁয়ে যেত। দেখতে পেতাম সনাতনধর্মী 888sport promo codeদের তুলসীতলায় প্রদীপ জ¦ালানো, ঠাকুরঘরে ধূপধুনো দেওয়া – আর শুরুতে শঙ্খে কয়েকবার থাপ্পড় মেরে ফুঁ দেওয়া।
সাদাশাড়ি-লালপাড় এয়োতি মহিলাদের ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠত। সিঁদুর আর কপালের বড় টিপটাও মানসপটে আঁকা হয়ে যেত। মনটা হয়ে যেত কেমন একটা উদাস। মন ছুটত কাশী থেকে কৈলাস পর্যন্ত। প্রত্যেক ঘরে থাকা লক্ষ্মীর মূর্তি মাতৃমূর্তি হয়ে মনে গভীর ভালোবাসায় রূপান্তরিত হতো। মনে ভাসত লক্ষ্মী-সহোদরা সরস্বতীর মূর্তি। শ্বেতপদ্মের ওপর হংসাসনে বীণা হাতে পদ্মিনীরূপ, যাকে ভালোবাসতে ইচ্ছা করে। সেই শৈশবে ভালোবাসার কি-ই বা বুঝি। তবু মনে রাধাকৃষ্ণ ভর করে আসত। এই যুগলমূর্তি সব জায়গায় দেখতে দেখতে ভালোবাসার একটা বিমূর্ত রূপ তো গড়ে উঠেছিল।
তো নানির কথা। জন্মের পর থেকে নানি ছিল আমার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ। আর তিনিও আমাকে প্রায় আঁচলে বেঁধে রেখেছিলেন। সব কাজেই আমার ডাক। দীর্ঘদিন ছাড়া-গরু ছিলাম। না সবলসিংহপুর না ঝামটিয়া কোনো জায়গার বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়নি। কারণ আমাদের পরিবার ছিল যাযাবর। তিন মাস সবলসিংহপুরে তো ন’মাস ঝামটিয়ায়। এই দোলাচলে পড়ে আমি ছিলাম ছাড়া-গরু। ছাগলও বলা যায়। বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ান, পাখির ডিম দেখা … কাঠবেড়ালির পেছনে ধাওয়া করা, মামাদের ছোট-বাগানে গরু ঢুকলে টাঁটি বন্ধ করে তালডাঁটা দিয়ে পিটিয়ে লেদিয়ে ছেড়ে দেওয়া … সে এক রাখালরাজত্ব কায়েম ছিল। সঙ্গী ছিল পরের তিন ভাই। সব বাঁটুলের দল। আমি দলপতি। শুধু অসুবিধা হতো বান এলে। বছরে তিন-চারবার বান আসত। এটা ভাদ্র থেকে কার্তিক পর্যন্ত। বান যে আসছে তা আমরা দু-তিন দিন আগেই জানতে পারতাম। নানি ছিলেন আমাদের বান দর্শনের ক্যাপ্টেন। তিনতলার ছাদ থেকে দূরে উত্তরে দিকচক্র রেখা ধরে বানের জল ধেয়ে আসত। দুপুরে রোদ পড়ে চকচক করত সেই বাসুকির ফণায়। নানি আমাদের ডেকে বলতেন, ওই দেখো বান আসছে … আমরা দূরে চিকচিকে জলের রেখা দেখতে পেতাম। এই বান মাঠ ডুবিয়ে ঝামটিয়ায় ঢুকতে প্রায় তিনদিন লাগত।
বান ঢোকার প্রথম প্রহরটা ছিল খুবই রোমাঞ্চকর। উত্তরের দুলুইপাড়া, বাগপাড়া, ধাড়াপাড়া, তারপর দক্ষিণপাড়া। বানের জল সমতল মাঠে প্রবেশের আগে পুকুরের বাঁধ ছাপিয়ে ভেতরে প্রবেশ করত। আমরা বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে। পায়ের পাতার ওপর দিয়ে জলের ধারা। শিরশির করত সারা অঙ্গ। একটা মজার শিহরণ। এভাবে সব পুকুর আর খানাখন্দ ভরে গেলে মাঠের ওপর জলের সমতা ক্রমশ বাড়ত। হাঁটুসমান পর্যন্ত আমাদের চলাচল চলত। তারপর আসত নিষেধাজ্ঞা। এবার ভিটেয় বন্দি। তো শুরু হলো বানের জলের বাড়া-কমা লক্ষ করা। বাড়ির পশ্চিমদিকের সিঁড়ি হলো এর মাপদণ্ড। ক’সিঁড়ি ডুবল এটাই আমরা সবাইকে ঘোষণা করে জানাতাম। ছোট বান তিনদিন। বড় হলে সাত-আটদিনও থাকত।
বান আসাটা খুব আনন্দের কিন্তু জল নেমে গেলে নিরানন্দ। সব রাস্তা পলিমাটিতে গড়া কাদার আস্তরণ। ঘাস আর ঝোপঝাড় পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। স্নানের পুকুর ঘোলাটে। শুধু নলকূপটা থাকাতে রক্ষা। এটা দক্ষিণপাড়ায় বলে এদের সুবিধে – বাকিরা দূর-দূরান্ত থেকে এসে কলসি আর ঘড়া ভরে জল নিয়ে যেত। খাবার জল বলে অনেককে দু-তিনবারও আসতে হতো।
বানের একটা ক্ষতি ছিল। অনেক গাছ মরে যেত। যেসব গাছের গোড়ায় জল জমলে গাছ বাঁচে না।
এ-ছাড়া পুকুরের বড় মাছ সটকে পড়ত। আবার কিছু কিছু ছোট মাছ আসত পুকুরে। পড়ে এগুলো বড় হয়ে কিছুটা পোষাত।
স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে প্রায় মাসখানেক লেগে যেত।
বানের সুফল হলো মাটি নতুন জীবন পেত। পলি পড়ে ক্ষেতগুলোকে নতুন জীবন দান করত। এটা বানের সবচেয়ে উপকারী দিক।
ঝামটিয়া বন্যাপ্রবণ এলাকা বলে এখানকার সব ঘরদোর উঁচু ভিটের ওপর। কারো ক্ষতি হতো না। শুধু একবার খড়িগেড়ে ও খালনার বন্যানিরোধক বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ঝামটিয়া দুর্যোগ থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু বাঁধের ভেতরে যারা তাদের ঘরদোর সব ভেসে যায়। নিদারুণ কষ্টে পড়ে ওইসব গ্রামের মানুষজন। অনেক গবাদিপশুও প্রাণ হারায়। এটা হয়েছিল ১৯৪৭-৪৮-এর দিকে। সঠিক মনে নেই। তবে দেশভাগের পর ১৯৭৮ সালে দামোদরের জল ছেড়ে দেওয়ার কারণে ঝামটিয়া ও আমাদের বাড়ি সবলসিংহপুর ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জল প্রায় মাসাধিককাল স্থিত অবস্থায় ছিল। ওই বানে সবলসিংহপুরে আমাদের দোতলা মাটির বাড়িটি সম্পূর্ণভাবে ধসে পড়ে। যাকে আর দাঁড় করানোর কোনো অবস্থা রাখেনি। আমাদের বসবাসের চিহ্নটি ওই বন্যার পর চিরতরে হারিয়ে যায়। সেই বাড়িটি বেশ মোটা দেয়াল দিয়ে তৈরি ছিল। কিন্তু এক মাস জল গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকায় ক্রমশ বসে যেতে থাকে এবং মুখ থুবড়ে পড়ে। বাবার জন্মভিটে সেইসঙ্গে চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়। আমরা ওই বাড়িতে দশ বছর কাটিয়েছি। ভাবলে এখনো মন খারাপ হয়। ভাবি শুধু যদি বাড়িটা বৃদ্ধ হয়েও টিকে থাকত! তাহলে বাবার জন্মভূমির চিহ্নটি থাকত। আজ হয়তো টিকিয়ে রাখার একটা ব্যবস্থা নেওয়া যেত বা অন্য কোনো ধারায় বাঁচিয়ে রাখা।
তো নানির কথা। 888sport sign up bonusর পর্দার আরম্ভ থেকে দেখে এসেছি ফর্সা নানির মুখে দু-তিনটে বসন্তের দাগ। খুব গভীর নয়। মধ্যম উচ্চতার নানি প্রায় সাদা-শাড়ি পরতেন। তবে পাড় ছিল লাল, কালো বা নীল। বয়সকালে সধবারাও প্রায় সাদা শাড়ি পরত।
নানি ছিলেন খুব সাহসী। একবার বানের সময় একটা বিষাক্ত খরিশ সাপ দেখা যায় বাকুলে মানে উঠোনে। সবাই প্রাণপণে যে-যেদিকে পারছে ছুটছে। নানি কিন্তু নিশ্চল। ভাবলেন কী ব্যবস্থা নিতে হবে। রান্নাঘর থেকে একটা লাঠি নিয়ে সাপের পেছনে ধাওয়া। আর বেচারা আত্মরক্ষার জন্যে ঘুরে ফণা তোলার আগেই নানির সজোর আঘাত। পিঠ বরাবর। আর ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেল না। আর নানির তখন রণচণ্ডীমূর্তি। একের পর এক আঘাত করে চলেছেন। মাথাটা থেঁতলে তবে থামলেন। চোখেমুখে ঘাম। নানির এমন মূর্তি জীবনে আর দেখিনি।
নানির মুখ ছিল স্নেহময়ী মাতৃমূর্তি। কিন্তু প্রয়োজনে সংহারমূর্তি। সনাতন দেব-দেবীদের মাতৃমূর্তিগুলো চোখে ভাসে। দেবীর এরকম রূপ। সবই বাস্তববাদী। কল্পনার কোনো জায়গা নেই। ধর্ম আসলে বাস্তবেরই প্রতিরূপ। সম্ভবত এই উপমহাদেশ মাতৃতান্ত্রিক ছিল। মধ্য এশিয়ার মানবকুলের আগমনহেতু তাদের সেই অবস্থান বদলে যায়।
আঞ্চলিক দেবী মনসা, শীতলা, বনদেবী প্রমুখ সবাই 888sport promo code।
মামাবাড়িতে আমার ছিল দুজন নানি। একজন নানার স্ত্রী। দ্বিতীয়জন নানার বোন নজিমননেসা। নজিমন নানির সঙ্গে তেমন কথা হতো না। কারণ দুই নানির সদ্ভাব ছিল না। পারলে মুখ দেখাদেখি না করা। অথচ মামি হালিমা খাতুন নানির বউ, আমাদের সঙ্গে বসবাস করছেন। মামি হালিমা খাতুন বেশ কৌতুকপ্রিয় ছিলেন। ছোটখাটো চেহারা। চাপা শ্যামবর্ণ, কিন্তু গোলাকার মুখে সোনালি ফ্রেমের চশমা পরতেন এবং বেশ মায়ামাখা মুখ। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। মা-র সঙ্গেও ছিল খুব ভাব। দুজন প্রায় সমবয়সী। মামি কিছুটা বড়।
এদিকে পাশের অংশে আছেন আমার মেজখালা শাহিদা বেগম। তিনি নজিমন নানির পুত্রবধূ। আসলে বদলা-বদলি বিয়ে। মামা বিয়ে করেছেন নজিমন নানির মেয়েকে আর মেজ খালু শেখ আলি আকবর বিয়ে করেছেন শাহিদা খালাকে। ঘরে ঘরে বিয়ে যাকে বলে।
দুই নানির মধ্যে কেন জানি সদ্ভাব ছিল না। প্রায় দেখতাম ছোটখাটো সব ব্যাপার নিয়ে বাকবিতণ্ডা, যা ঝগড়ায় রূপান্তরিত হতো। একই বারান্দার ওপর প্রায় দুই বাড়ির সীমান্ত ঘেঁষে এই কথা কাটাকাটি চলত। বেশি উত্তেজনা হলে : সামনে হাত উঁচু করে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো হতো। তাদের মুখে গালাগালি শুনতাম না। শুধু শুনতাম অভিশাপ। একজন আরেকজনকে অভিশাপ ঝাড়ত। আর তা-ও চূড়ান্ত পর্যায়ের। দুদিক থেকে একই কথার উচ্চারণ। আর তা বারংবার বলা। কথাটা হলো : তোর ব্যাটা-ভাতারের মাথা খা। দুজনই একই কথা একশবার বলে চলেছেন।
এটা বেশি বাড়াবাড়ি হলে মা ও হালিমা মামি দুজনকে দুদিকে টেনে নিয়ে যেত।
আমরা দূর থেকে দেখতাম। আর কূল-কিনারা করতে পারতাম না। হাসিও লাগত, আবার হাসতেও পারতাম না ব্যাপারটার গুরুত্বের কথা ভেবে। বড়দের ঝগড়া। আমরা হাসলে বেয়াদবির পর্যায়ে পড়বে। তখন মা-র হাতে উঠবে মুগুর। বড়দের ঝগড়ার ঝাল ঝাড়বে আমাদের ওপর। ঝগড়া কিছুটা থিতিয়ে এলে আমরা তিন ভাই অকুস্থল ত্যাগ করে বাগানের দিকে চলে যেতাম। আর দূরে গিয়ে বড়দের এই কাণ্ড নিয়ে নকল ঝগড়া করতাম। তোর ব্যাটা-ভাতারের মাথা খা।
এক ভাই বলে ওঠে, আচ্ছা, মাথা কি কেউ খেতে পারে?
আমি বড়। বিজ্ঞ। বলি, আসলে মাথা খা … মানে মৃত্যু কামনা করা।
ব্যাখ্যাটা একেবারে পুরোহিতের মন্ত্র-উচ্চারণের মতো হয়ে যেত। অবশ্য আমার ভাইয়েরা তা বুঝত। তারা কার সাগরেদ এটা ধর্তব্যের মধ্যে আনতে হবে তো।
আমি পরে গভীরভাবে চিন্তা করতাম, নানিরা এমন কথা উচ্চারণ করত কী করে! ধরা যাক নজিমন নানির কথা। তিনি যদি আমার নানিকে বলেন, তোর ব্যাটা-ভাতারের মাথা খা … তার মানে তিনি তাঁর নিজের ভাই ও ভাইপোর মৃত্যু কামনা করছেন। সত্যি তাঁরা যদি মারা যান, তিনি কি খুশি হতে পারবেন? তাহলে এমন কথা বলেন কী করে? তাছাড়া আমার মামা তো তাঁর জামাইও। তিনি কি মেয়ের বৈধব্য কামনা করছেন? উল্টোদিকে আমার নানির ব্যাপারটাও তাই। তিনি কি সাহিদা খালার বৈধব্য কামনা কামনা করছেন?
তখন মুণি-ঋষিদের মতো আমি বুঝলাম, সংসারে ক্রোধ অতি বিষম বস্তু। ইহাতে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। আর মানুষের পশুপ্রবৃত্তি প্রকাশ পেয়ে যায়।
নানিদের এই ঝগড়া আমার শিশুমনে একটা বড় প্রভাব ফেলে। সারা জীবন আমি চেষ্টা করে এসেছি ক্রোধ দমন করে রাখতে। অবশ্য কখনো যে অকৃতকার্য হইনি তা নয়।
মুণি-ঋষিরাও চরম ক্রোধান্বিত হন। আর তখন দেন অভিশাপ। আমরা যে সৃষ্টি। স্রষ্টার সব গুণ আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। কাম ক্রোধ … এই মূল কাঠামো থেকে কেউ বাইরে নয়। বুদ্ধ-যিশু এসব থেকে মুক্ত ছিলেন। তাই তাঁরা মহামানব। দেবতাদের চেয়েও ঊর্ধ্বে তাঁদের স্থান। মানুষ হয়ে এ-পর্যায়ে যাওয়া কঠিনতম কাজ।
নানির বাড়ি রঞ্জবাড় গ্রামে। ঝামটিয়া থেকে বেশ কিছু দূরে। কিন্তু তাঁর মামাবাড়ি পাশের গ্রাম খাজুরদহে। যেখানে আমার বড়খালার বিয়ে হয়েছে। নানির মা খাজুরদহের মেয়ে। তিনি খুব ফর্সা ছিলেন। হলুদাভ। আমরা ডাকতাম ঝিমা বলে। সুন্দরী। কণ্ঠস্বর জীবন্ত। মাঝে মাঝে মেয়ের বাড়িতে আসতেন। আমাদের খুব আদর করতেন।
এই ঝিমার এক ভাই ছিলেন মুন্সী। তিনি মিলাদ পড়াতে আসতেন। পাতলা ছিপছিপে গড়ন। রং ফর্সা। মাথায় থাকত পাগড়ি। আর মুখে সামান্য দাড়ি।
তাঁর মিলাদে একবার বাংলার ব্যবহার আমাকে খুব আকর্ষণ করে।
নবীর প্রশস্তি গাওয়ার সময় তিনি বাংলা তর্জমা করে সুরে সুরে সবাইকে উচ্চারণ করতে বললেন :
ইয়া নবী, সালাম আলাইকা
ইয়া রসুল, সালাম আলাইকা …
ইয়া হাবিব, সালাম আলাইকা
সালাবাত তুল্লা আলাইকা।
তারপর তিনি বাংলায় বলতে শুরু করেন :
তুমি যে নূরেরও নবী,
তুমি না এলে দুনিয়ায়
আঁধারে ডুবিত সবি …
কোরাস চলে :
ইয়া নবী, সালাম আলাইকা
এরপর তিনি সুরে বলতে শুরু করেন :
চাঁদ-সুরুজ আকাশে আছে …
সে-আলোয় হৃদয় নাচে …
তুমি না এলে দুনিয়ায়
আঁধারে ডুবিত সবি …
ইয়া নবী, সালাম আলাইকা… আমাদের কোরাস।
বাংলা শুনে আমার মনটা নেচে ওঠে। কী সুন্দর কথা।
এবার কয়েকদিন ধরে থেকে থেকে নবীর প্রশস্তি গেয়ে চলি। আমার সঙ্গে কোরাসে যোগ দেয় বাকি ছোটভাইগণ।
আমরা ঝামটিয়ার মামাবাড়ির তিনতলা মাতিয়ে রাখতাম।
বড়রা আমাদের ধর্মপ্রীতিতে সন্তুষ্ট।
নানির এক জ্ঞাতিভাই ছিলেন শাহজাহান নানা। ফর্সা, সুন্দর চেহারা, মুখভরা কালো দাড়ি … এক কথায় সুপুরুষ। শাহজাহান বলে কথা।
তিনি মাংসের ব্যবসা করতেন।
খাসির মাংস।
ঝাঁকা মাথায় আসতেন।
একসঙ্গে কত সের ছিল তা অবশ্য জানতাম না। তবে অনেকটা মাংস। পাঁচ সেরের কম হবে না। তখন খাসির মাংস ছিল এক সের দু-টাকারও কম। ধনী নানাবাড়িতে পাঁচ সেরের কমে মানায় না। যদিও খানেওয়ালা কম। আমরা তখন চার ভাই পিঠোপিঠি। এক একটা গুঁটলি মার্কা। আমি আর মেজভাই একটু চোখে ধরি। বাকিরা তো গণনার বাইরে।
বাড়িতে রান্না বেশিরভাগ সময় করতেন মামি হালিমা খাতুন। তাঁর রান্নার হাত খুব পাকা ছিল।
নানিও রান্না করতেন। তাঁর রান্নাও আমার খুব পছন্দ ছিল। বিশেষ করে রোগীর পথ্য কাঁচকলা-শিঙ্গিমাছের ঝোলের ছিল খুব স্বাদ। ঝোল স্যুপের মতো পান করা যেত। সবকিছু ছিল চায়নিজ রান্নার মতো।
মা কখনো-সখনো রাঁধতে বসতেন। নানির মেয়ে তো! ভালো হাত ছিল রন্ধনে। সবচেয়ে ভালো রাঁধতেন মুরগির কোর্মা।
নানার কথা বলতে গিয়ে দু-একটা বড় ঘটনা বাদ পড়ে গেছে।
চতুর্থ শ্রেণি পাশ করে আমাদের দলপতি রেজাউল দাদা নানার সঙ্গে চলে গেল কলকাতা। আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হলেন। বাংলায় আলিয়া মাদ্রাসা সেরা বিদ্যালয়ের মধ্যে একটি। রেজাউলদাদা ছাত্র হিসেবে ছিলেন মেধাবী। নানার ইচ্ছা ছিল তাঁকে ডাক্তারি পড়াবেন। কম্পাউন্ডারের সুপ্ত বাসনা। পৌত্র ডাক্তার হবে। ডাক্তারের সহকারী নয়। নানা অবশ্য ডাক্তারের সহকারী হিসেবে জীবনে অনেক অর্জন করেছেন। অষ্টম শ্রেণি পাশ একজন জীবনে এতো সম্পদ করতে পারেন না। তা করেছেন সততার সঙ্গে। জাহাজে করে ফিজি পর্যন্ত গেছেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অনেক জায়গা পরিদর্শন করেছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মামা ব্রিটিশ সোলজার হিসেবে সিঙ্গাপুরে ছিলেন। তাঁর খোঁজ না পেয়ে নানাকে খুব গম্ভীর দেখাত। কিন্তু মামা ফিরে আসার পর তাঁকে খুব হাসিখুশি মানুষ হিসেবে পেয়েছি।
গ্রামে আমরা সবাই শনিবারের জন্যে অপেক্ষা করতাম। নানা আসবেন। গ্রামে থাকলেও আমাদের ভাগে প্রতি সপ্তাহে
আঙুর-আপেল-বেদানা-নাশপাতি ছিল বাঁধা। বাড়িতে ছোট বলতে শুধু আমরাই। নানা তাঁর ছোট মেয়েকে খুব ভালোবাসতেন। আমরা সেই মেয়ের সন্তান হিসেবে প্রচুর
আদরযত্ন পেয়েছি। নিজ বাড়ি সবলসিংহপুরে আমরা এসব থেকে বঞ্চিত হয়েছি। প্রায় জ¦র হতো। কখনো পেট খারাপ। কখনো ম্যালেরিয়া। আসলে সবলসিংহপুর আমার কাছে জেলখানা মনে হতো। চারদিকে খানাখন্দ আর বাঁশঝাড়ের আধিক্য। সবদিক অন্ধকার। শুধু মাঝখানে নতুন পুকুরটা একটা আকাশ দেখার ফোকর। পুকুরের পশ্চিম আর দক্ষিণ পাড়েও বাঁশঝাড়। বাঁশ একটা অর্থকরী ফসল। কিন্তু বাঙালি পরস্পরের পশ্চাদ্দেশে বাম্বু প্রবেশ করানোয় ওস্তাদ। অত্যন্ত ঈর্ষাপরায়ণ জাতি। কেউ একটু উঠলেই সবার কাজ হবে মিলিতভাবে টেনে নামানো।
বাঙালিদের নিয়ে একটা প্রচলিত রসিকতা :
নরকে সব জাতির পাহারাদার আছে – যাতে পালাতে না পারে। কিন্তু বাঙালিদের অংশে কোনো প্রহরী নেই। তো নরক সরকারকে জিজ্ঞেস করা হলো, এরকম কেন?
হিসাবরক্ষক উত্তর দিলেন : ওদের কেউ পালাতে চাইলে বাকিরা তার পা ধরে টেনে নামায়। তাই আর প্রহরী লাগে না।
তো নানির কথা।
ভাদ্র মাসে আমি আর নানি গভীর রাতে ঘর থেকে বেরোতাম। নানির হাতে একটা হুড়কো। আত্মরক্ষার অস্ত্র। অভিযান হলো তাল কুড়োনোর। বাড়ি থেকে শ-খানেক গজ দূরে বেশ কয়েকটা তালগাছ আছে। এটা দক্ষিণ দিকে। সব গাছ প্রায় ফলন্ত। পুরুষ গাছ খুব কম। প্রায় রাতে আমরা তিন-চারটে তাল পেতাম। তাই এক ধরনের নেশায় পেয়েছিল নানি-নাতিকে।
এরপর তালের নানা রকম সব পিঠে আর পাকান বানানো হতো। তালের বড়া এখনো আমার প্রিয় আহার্য। তালের গন্ধটা আমাকে এখনো ঝামটিয়ায় টেনে নিয়ে যায়। পূর্ববঙ্গে তালগাছ কম। বেশি হলো সুপুরি আর নারকেল গাছ। কলাগাছও আছে। আর এখন তো ধানের ক্ষেতে কলাগাছের চাষ। কলা এখন ব্যবসায়ী ফসল। শৌখিন নয়।
নানার একটা মহাকাহিনি বলতে ভুলে গেছি। রেজাউলদাদা কলকাতায় মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ায় আমরা দলপতিহীন হয়ে পড়ি। তাছাড়া দাদা গরমের ছুটিতে গ্রামে ফিরে কলকাতার অনেক গল্প করত। তাই আমরা মা-র কাছে ও নানির কাছে বায়না ধরলাম : কলকাতা যাবো … নানাকে বলো। নানা রাজি হলেন। আমি আর আমার মেজভাই ভিসা পেয়ে গেলাম। নানার সঙ্গে কলকাতা। থাকতাম ২৫নং সারেঙ্গ লেনে। জায়গার নাম তালতলা। নাম শুনে আমার মনে জাগে একসময় এখানে নিশ্চয় অনেক তালগাছ ছিল ঝামটিয়ার মতো।
তো চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, গড়ের মাঠ সব দেখে এক শনিবার সকাল ৮টার দিকে হাওড়া স্টেশন অভিমুখে যাত্রা। নানা একটা সুতির সাদা কোট পরে নিয়েছেন। ট্রামে উঠতে হবে। সোনাতলা ট্রাম স্টপেজে আমরা অপেক্ষায়। হিস হিস করে ট্রামের ধীরলয়ে ছুটে চলা আমার খুব ভালো লাগে। আরো ভালো লাগে ট্রামের ঢং ঢং ঘণ্টাধ্বনি। পাশ দিয়ে যখন ছুটতে থাকে, কেমন একটা রোমাঞ্চ লাগে। রাতে ইলেকট্রিক তারে ট্রামের সংযোগ চাকাটা মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ফুলকি ছোটায়। যেন তারাবাজি।
কলকাতায় তখন রবারের হর্ন। পঁক পঁক করে বাজতে থাকে সব মোটরে।
এ-ছাড়া কলকাতায় কেমন একটা কয়লা জ¦ালানো ও পেট্রোলের গন্ধ পেতাম। এটা তেমন ভালো লাগত না।
হাওড়াগামী ট্রাম এসে গেল। নানা আমাদের কোলে করে ভিড় ঠেলে ওঠাতে লাগলেন।
হাওড়া ব্রিজ ছাড়িয়ে ট্রাম থামল।
নানা টিকিট কাটলেন। তারপর ট্রেনের একজন অ্যাটেনডেন্টকে ডেকে আমাদের জন্যে ফ্রুটস-কেক আনার অর্ডার দিয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখেন খামে মোড়া তাঁর পুরো মাসের মাইনের তিনশো টাকাই গায়েব। নানা চমকে উঠে বারবার পকেটে হাত দিচ্ছেন মানিব্যাগটা আছে, কিন্তু পেছনে খামে রাখা টাকাটা উধাও। তিনি কলকাতার লোক। মুহূর্তে বুঝে ফেললেন পকেট মারা গেছে। মুখটা খুব কালো হয়ে গেল। পুরো মাসের মাইনের টাকা!
আমাদের কেক এসে গেল। নানা পার্স থেকে টাকা দিলেন। মুখ তেমনি আঁধার।
একবার শুধু কষ্ট করে হেসে বললেন, তোমরা খাও!
সারা রাস্তায় নানাকে আর একটা কথা বলতে শুনিনি। আমরাও নানাকে বিরক্ত করিনি।
বাড়িতে ঢুকে সহজ হওয়ার জন্যে নানা মাকে ডেকে বললেন, পুঁটো, তোর ছেলেদের কলকাতা দেখাতে গিয়ে আমি আমার পুরো মাসের মাইনে পকেটমারদের হাতে তুলে দিয়েছি।
পুরো ঘটনার জন্য আমাদের দুই ভাইয়ের কলকাতা যাওয়ার আনন্দটাই মাটি হয়ে গেল।
দিনের মধ্যে কয়েকবারই হাসিমুখে নানি বলেন, তোমরাও কলকাতা গেলে আর তোমার নানার পকেটটাও সাফ হয়ে গেল।
পকেট অবশ্য সাফ হয়নি। খামে রাখা তিনশো টাকাই শুধু গায়েব হয়ে গিয়েছিল। কি অদ্ভুত ওদের কৌশল বা পারদর্শিতা।
সারা ভারতবর্ষে কলকাতার পকেটমারদের একটা সুনাম আছে। অর্থাৎ কলকাতার পকেটমার হলো ভারতবর্ষে নম্বর ওয়ান।
এ-ব্যাপারে একটা গল্প চালু আছে :
একজন বাঙালি ভদ্রলোক গ্রাম থেকে এসে কলকাতার পকেটমারদের চ্যালেঞ্জ দেয়। দেখব তোরা কেমন ওস্তাদ। এই কথা বলে, তিনি পাঞ্জাবির পকেটে একটা সোনার মোহর রেখে ট্রামে-বাসে সারাদিন ঘুরে বেড়ান। মাঝে মাঝে পকেটে হাত দেন। টের পান যে ওটা জায়গামতো আছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলল তাঁর পরিক্রমণ। শেষে হাওড়া ব্রিজ পার হয়ে ট্রাম থেকে নামার সময় বলেন, শালা পকেটমার, আমার কিছু করতে পারল না। সারাদিন পকেটে একটা সোনার মোহর নিয়ে ঘুরে বেড়ালাম – ওটা এখনো পকেটে বহাল তবিয়তে আছে।
তিনি মাত্র ট্রাম থেকে নেমেছেন। এমন সময় শুনতে পেলেন ট্রামের ভেতর থেকে একজনের গলার আওয়াজ। বলছেন, শালা … পকেটে একটা তামার আধলা পয়সা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে … আর বলে কি না সোনার মোহর!


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.