অপূর্ব শর্মা
লোকসংগীতের কোনো স্বরলিপি নেই, নেই কোনো বাধ্যবাধকতা। সব লোকই লোকগীতি গাইতে পারে নিজের ইচ্ছামতো। এর রচয়িতা মূলত গ্রামীণ মানুষ। শহরেও আছে এদের আবাস। নিরক্ষর মানুষের অভিজ্ঞতাপ্রসূত গানকে অনেকে লোকসংগীত বলে থাকেন। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এই গান আহৃত হয়। এই গানে উঠে আসে প্রকৃতি, মানুষের ভালোবাসা, দুঃখ-বেদনা ইত্যাদি। আচার, অনুষ্ঠান, উৎসব সবকিছুই রয়েছে লোকগানে। সাধারণের জীবনচিত্র উঠে আসা এই সংগীতে নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখা না থাকলেও একটা সীমিত কাঠামো লোকসংগীতকে আবদ্ধ করে রেখেছে। অঞ্চলভেদে একটা নিজস্বতা আছে এই সংগীতের। আঞ্চলিকতাকে লোকগীতির প্রাণ বলা হয়ে থাকে। বৈশিষ্ট্যে ভরপুর এই সংগীতের মাধ্যমেই একসময় আবহমান বাংলার মানুষের যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা ও অগ্রসর চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল।
প্রথমদিকে সাধারণ মানুষ লোকগীতিকে নিজেদের করে নিয়েছিল। ত্রিশের দশকে সংগ্রামের কৌশল হিসেবে এই সংগীত রাজপথে, গ্রামেগঞ্জে মানুষের মুখে মুখে ফিরত। কালের বিবর্তনে অন্যসব সংগীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লোকসংগীত গণসংগীতকে লোকালয়ে টেনে আনতে শুরু করে। তৎকালীন সিলেট জেলার ভৌগোলিক অবস্থান, আন্দোলন-সংগ্রাম এক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে ওঠে। রাধারমণ দত্ত, হাছন রাজা, শীতালং শাহ, দুরবীন শাহ প্রমুখের গীত রচনা এই অঞ্চলের লোকসংগীতের ভা-ারকে যেভাবে সমৃদ্ধ করে, ঠিক সেভাবে সৃষ্টি করে নবজাগরণ। এখানকার পল্লিগাঁয়ের মানুষের নিজের মনের কথা উঠে আসে প্রখ্যাত গীতিকবিদের রচনায়। এসব কালজয়ী গানকে আবালবৃদ্ধবনিতা কণ্ঠে ধারণ করে নিজের মতো।
দেশীয় পরিম-লে গ্রামবাংলার এই গানকে মানুষের মুক্তির সোপান রচনায় কাজে লাগাতে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। বাংলার লোকজ গানকে তিনি শুধু জাতীয়ভাবেই সমাদৃত করেননি, ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বলোকে। কণ্ঠজাদুতে লোকসংগীতের যাত্রাপথকে সুদৃঢ় করার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে লোকগীতি-সম্রাট অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়। প্রখ্যাত এই 888sport live chatী লোকান্তরিত হয়েছেন ১৯৮১ সালে। তাঁর মৃত্যুর তিন দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। সিলেট তথা দেশের সংগীতাঙ্গনে এখন অনেকটাই বি888sport sign up bonusর অতলে তাঁর অবস্থান! অথচ নির্মলেন্দু চৌধুরীর সংগীতভুবনে প্রবেশের ভিত্তি রচিত হয়েছিল এ-অঞ্চলের কাদামাটিতে।
জন্ম ও শৈশব
নির্মলেন্দু চৌধুরী ১৯২১ সালের ২৯ জুলাই সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে উঠেছেন পিত্রালয়ে, জামালগঞ্জ থানার (উপজেলার) বেহেলী গ্রামে। পিতা স্বর্গীয় নলিনীনাথ চৌধুরী ও মাতা স্নেহলতা চৌধুরী। পিতা-মাতা তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মা স্নেহলতা সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি নির্মলেন্দু চৌধুরীকে 888sport live chatী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অভিপ্রায়ে গানের তালিম দেন। প্রায় প্রতিদিনই ছেলেকে রেজওয়াজ করাতেন তিনি। বাবা জোগাতেন উৎসাহ। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পরিপক্ব হতে থাকেন নির্মলেন্দু। সংগীতের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে বাড়িতে একজন সংগীতশিক্ষক রাখা হয়। শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে আসার পর নির্মলেন্দু নিজেকে শানিত করে তোলেন।
নির্মলেন্দু চৌধুরী বেহেলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর চলে আসেন সিলেটে। সিলেট নগরীর লামাবাজারে তাঁদের নিজস্ব বাসা ছিল। সে-সুবাদে তিনি রসময় মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন এমসি কলেজে। এ-সময় তিনি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করতে তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয় প্রতিবাদের গান।
যেভাবে লোকগানে
ম্যাট্রিক পাশ করে নির্মলেন্দু চৌধুরী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কৃষক ফ্রন্টেই তিনি কাজ করতেন। রাজনৈতিক কারণে একাধিকবার কারাবরণ করতে হয় তাঁকে। একদিন দলীয় কাজে খাসিয়া পাহাড়ঘেঁষা একটি গ্রাম অতিক্রম করার সময় দেখলেন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সন্তান কামনায় সারাদিন হাতে জ্বলন্ত প্রদীপ রেখে 888sport promo codeরা দিগন্তে সেগুলো নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। আর গাইছে গান। আশ্চর্য এক গান। সূর্যব্রতী মেয়েদের সেই গানে নির্মলেন্দু জীবনের পরমার্থ খুঁজে পেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন – এই গান, এই লোকসংগীত মানুষের কামনা-বাসনার সঙ্গী, যার প্রকাশভঙ্গি অকৃত্রিম। মানুষের হৃদয়রাজ্যে পৌঁছানোর চাবিকাঠি পাওয়া যাবে এই গানেই।
এরপর থেকেই তিনি লোকগানে অনুরক্ত হলেন। নিজ মনের অনুরণনের সঙ্গে যুক্ত হলো রাগ-অনুরাগ। গাইলেন নির্মলেন্দু। খাসিয়া ও গারো পাহাড়ের গান – ভাটিয়ালি, জারি, সারি, বাউল, ঝুমুর আরো কত কী। যতই গেয়ে যান, ততই যেন তৃষ্ণা বাড়ে। আর গানের প্রতি গভীর ভালোবাসাই তাঁকে লোকগানের সম্রাটের আসনে অধিষ্ঠিত করে। তাঁর দরাজ গলা জয় করে লাখো-কোটি মানুষের মন। তিনি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে, নির্মলেন্দু বললে তাঁর নামের সঙ্গে আর কোনো বিশেষণ যুক্ত করতে হতো না। এক নামেই সবাই চিনত তাঁকে।
নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবক
নির্মলেন্দু লোকসংগীত ও গণসংগীতের মধ্যে একটা সীমারেখা টেনে এনেছেন। তিনি সহজ-সরল লোকসংগীতে নিজস্ব একটি গায়ন পদ্ধতি জুড়ে দিয়েছিলেন, যার ফলে তাঁর গাওয়া গানগুলো মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেত। অনেক গানে সংযোজন করেছেন ভিন্নধর্মী সুরের মিশ্রণ। মূলত নিজের মতো করে গাইতে পছন্দ করতেন। কাউকে অনুকরণ করার চেষ্টা করেননি কখনো। তিনি ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন লোকসংগীতে মানুষের আবেগের গান। আবেগ-অনুভূতিটাই এখানে বড়। বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, দরদ বা নিজের আবেগ-অনুভূতিকে গানের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়াই ছিল নির্মলেন্দুর সাফল্যের চাবিকাঠি।
পরিপূর্ণ জীবনের অধিকারী
বর্ণাঢ্য ও পরিপূর্ণ জীবনের অধিকারী ছিলেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। জীবদ্দশায় শতাধিক গানের রেকর্ড বের হয়েছে তাঁর। অধিকাংশ গানের সুর তিনি নিজেই করেছেন। এসব রেকর্ডের মধ্যে একাধিক লং প্লে রয়েছে। উল্লেখযোগ্য দুটি লং প্লে হচ্ছে – মালুয়া এবং চাঁদ সওদাগর গীতিনাট্য। তন্মধ্যে মালুয়া গীতিনাট্য ষাটের দশকে ভারতে আলোড়ন তুলেছিল। ময়মনসিংহের এই গীতিনাট্যে ৫০ জন 888sport live chatী অংশগ্রহণ করেছিলেন। মালুয়ার গানগুলোর সুর করেছেন তিনি নিজেই। আর মনসামঙ্গল থেকে করেছেন আলোচিত চাঁদ সওদাগর।
সিলেটের হারিয়ে যাওয়া লোকসংগীতকে ধরে রাখার তাগিদ থেকেই তিনি এ-অঞ্চলের অসংখ্য লোকগান রেকর্ড করেন। ভারতে অবস্থান করলেও মাতৃভূমির প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা।
১৯৬৯ সালে জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে অধ্যাপনায় যোগ দেন তিনি। আমৃত্যু সেখানে জবধফবৎ রহ সঁংরপ ছিলেন। জীবদ্দশায় প্রতিষ্ঠা করেন লোকভারতী। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর প্রায় ছয় হাজার ছাত্রছাত্রী ছিল।
যুবক বয়সে নির্মলেন্দু সুরমা ভ্যালি ফুটবল দলের কৃতী খেলোয়াড় ছিলেন; এছাড়া শিকারে ছিলেন দক্ষ। সুযোগ পেলেই শিকার করতেন। ছাত্র-আন্দোলনে একজন চৌকস ছাত্রনেতা এবং কৃষাণ সম্মেলনে ছিলেন পার্টির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল ক্যাডার।
কণ্ঠজাদু ভোটের মাঠে
সংগীতও যে রাজনীতির অনুষঙ্গ হতে পারে, কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তরা ভালোভাবেই সেটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং তাঁরা তা প্রমাণ করেছিলেন। তাঁদের সেই উপলব্ধিই গণজাগরণের সৃষ্টি করেছিল। সিলেট তথা পূর্ব বাংলার প্রেক্ষাপটে এক্ষেত্রে সবচেয়ে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। হেমাঙ্গ বিশ্বাস গান লিখতেন, কখনো কখনো সুরও করতেন। আর তাঁর কথা ও সুরের সার্থক রূপায়ণ করতেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। শুধু তাঁর গানই নয়, আবদুল গাফ্ফার দত্ত চৌধুরীসহ অন্য গণসংগীত রচনাকারীদের সংগীত পরিবেশন করে পুরো দেশে আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি।
১৯৫৪ সালে সুনামগঞ্জ থেকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হন কৃষক নেতা বরুণ রায়। বরুণ রায় নির্মলেন্দু চৌধুরীর শুধু আত্মীয়ই ছিলেন না, ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধুও। দলীয় প্রার্থী, সুখ-দুঃখের সাথিকে নির্বাচনী বৈতরণি পার করাতে তিনি মাঠে নামেন সুরের জাদু নিয়ে। বরুণ রায়ের ব্যক্তি-ইমেজ ও জনপ্রিয়তার সঙ্গে যুক্ত হয় নির্মলেন্দুর গীতপ্রতিভা। তাঁর গান মানুষের অনুভূতিকে নাড়া দেয়। আন্দোলিত করে সত্তাকে। যেন জেগে ওঠে মানুষ। প্রতিটি জনসভায় উপস্থিত হাজার হাজার মানুষকে তাঁর গাওয়া গানগুলো যেন পথ দেখায়। ওই নির্বাচনে কারান্তরীণ থেকে বিজয়ী হন বরুণ রায়।
মায়ের ভালোবাসায় বিশ্বলোকে
একজন শিক্ষিত মা, জাতিকে একটি শিক্ষিত সন্তান উপহার দিতে পারেন। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর থেকে সবচেয়ে বেশি যাঁর কাছ থেকে শিক্ষা নেয়, তিনি হচ্ছেন জন্মদাত্রী। নির্মলেন্দু চৌধুরীও মা স্নেহলতার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছেন। তাঁর সংগীতের হাতেখড়ি হয়েছিল মায়ের কাছেই। প্রথম সন্তান হওয়ার সুবাদে বাড়তি আহ্লাদ পেয়েছেন। এক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে মিষ্টি গলা। মা তাঁর সুরে বিমোহিত হন। বিরল প্রতিভার অন্বেষণ করেন কৈশোরেই। কথা বলেন স্বামীর সঙ্গে। তিনি ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন স্ত্রীকে। পাশাপাশি খোঁজখবর নেন ছেলেকে ভালো সংগীত888sport live chatী করার ব্যাপারে। অনেক ভাবনাচিন্তার পর নির্মলেন্দু চৌধুরীকে শান্তিনিকেতনে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নেন পিতা নলিনীনাথ চৌধুরী। কিন্তু নির্মলেন্দুর শারীরিক অবস্থা এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আশাহত হৃদয়ে এ-ইচ্ছার বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকেন তিনি। বাড়িতেই রাখেন রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষক। কিন্তুউচ্চারণ সমস্যার কারণে সে-যাত্রা রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষা থেকে বিরত থাকতে হয় নির্মলেন্দুকে। কিন্তু সংগীতচর্চা থেমে থাকে না তাঁর। পাশাপাশি চালিয়ে যেতে থাকেন লেখাপড়া। সিলেটে অবস্থানকালীন সময়ে সুরসাগর প্রাণেশ চন্দ্র দাশের কাছে তালিম নেন তিনি।
সিলেটের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, মধ্যমণি নির্মলেন্দু
চল্লিশের দশকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছিল সংস্কৃতি-আন্দোলনের মাধ্যমে। কমিউনিস্ট পার্টি আন্দোলনকে বেগবান করতে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল মানুষের মধ্যে গণজাগরণ সৃষ্টি। আর সেজন্য দলীয় ও দল সমর্থনকারী সংস্কৃতিসেবীদের বেছে নেওয়া হয়। বিকশিত হয় গণনাট্য আন্দোলন ও প্রগতিশীল 888sport live football-সংস্কৃতি আন্দোলন। সমগ্র ভারতবর্ষে গড়ে ওঠে গণনাট্য সংঘের শাখা-প্রশাখা। দিন দিন এই সংঘ স্বাধীনতাকামীদের প্রতিবাদের প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়। সিলেটে এই আন্দোলন বেগবান করতে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন প্রখ্যাত কবি, সুরকার ও সংগীত888sport live chatী হেমাঙ্গ বিশ্বাস। এই কমিউনিস্ট নেতা অসংখ্য গণসংগীত রচনা করেন লোকগীতির আদলে, যা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হয়। তাঁর লেখা গানগুলো পরিবেশন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। গণনাট্য সংঘ সিলেটের মধ্যমণিতে পরিণত হন তিনি। তাঁর সুরের জাদুতে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে কৃষক-কামার-কুমার-জেলেসহ মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষজন।
বিপ্লবী হেনা দাস তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন –
…সিলেটের গণনাট্য আন্দোলনে আমরা একজন প্রখ্যাত কণ্ঠ888sport live chatীকে পেয়েছিলাম। সে হলো উপমহাদেশখ্যাত পল্লীসংগীত 888sport live chatী নির্মলেন্দু চৌধুরী। হেমাঙ্গদার নেতৃত্বে গঠিত সুরমা উপত্যকা কালচ্যারাল স্কোয়াডের কণ্ঠ888sport live chatীদের মধ্যমণি ছিল নির্মল।… একক গান পরিবেশনে তার জুড়ি ছিল না। মাঠে-ময়দানে হাজার হাজার শ্রোতাকে নির্মল মাতিয়ে তুলত তার উদাত্ত কণ্ঠের সুর ও ঝঙ্কারে, তাদের অন্তরের গভীরে পৌঁছে দিত প্রতিটি গানের মর্মবাণীকে।
…১৯৪৫/৪৬ সালে নেত্রকোনায় সারা ভারত কৃষক সম্মেলনে গিয়েছিলাম সিলেটের একজন 888sport promo code-সংগঠক হিসেবে। হেমাঙ্গদা, নির্মল, গোপাল দাসের গণনাট্য সংঘেরও একটি সিলেটি দল সেখানে গিয়েছিল। লক্ষাধিক কৃষকের সমাবেশে বাইদ্যার গানের সুরে হেমাঙ্গদার রচিত একটি দুর্ভিক্ষের গান পরিবেশন করা হয়েছিল। সেই গানে মৈমনসিংহের দুর্ভিক্ষপীড়িত গৃহহারা কৃষক গফুরের ভূমিকায় গান করেছিল নির্মল এবং বাইন্যাচঙ্গের উদ্বাস্তু অসহায় কিষাণীর ভূমিকায় গান করেছিলাম আমি। এটি আমার জীবনের একটি অমূল্য 888sport sign up bonus। একক কণ্ঠে এ গান গাওয়ার আমার যোগ্যতা ছিল না। প্রথমত একা গান গাওয়াতে আমি মোটেই অভ্যস্ত ছিলাম না। দ্বিতীয়ত, লক্ষাধিক জনতার সামনে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। তৃতীয়ত, হারমোনিয়ামের সর্বোচ্চ স্কেলে গান পরিবেশনের ক্ষমতা সম্পর্কে আমি ছিলাম সন্দিহান।
…এটা শুধু একটা গানই ছিল না। কিষাণ-কিষাণীর বাক্যালাপের মধ্য দিয়ে গানটি হয়ে উঠেছিল একটি প্রাণবন্ত নাটক। গানের সুর ও কথায় অভিব্যক্ত হয়েছিল দুর্ভিক্ষপীড়িত কিষাণ-কিষাণীর দুঃখ যন্ত্রণার অনুভূতি ও তাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের শানিত চেতনা। কৃষাণীর অভিনয় করতে গিয়ে গান গাইতে গাইতে আমি একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম কিষাণীর দুঃখের সাথে, আমার চোখ দিয়ে জল ঝরছিল। আমার ও নির্মলের এই গান লক্ষাধিক শ্রোতার হৃদয়ে জ্বেলে দিয়েছিল প্রতিবাদের আগুন। রাতের আঁধার ছিন্ন করে বিপুল করতালি ও সেøাগানে ভেঙে পড়েছিল সেদিন সম্মেলনের ময়দান।
যেভাবে রাজনীতিতে
প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা রোহিণী দাসের জন্মস্থান সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার পুরানবারুংকা গ্রামে। বারুংকা থেকে নির্মলেন্দু চৌধুরীদের গ্রামের দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। বেহেলীতে রোহিণী দাসের মাসির বাড়ি ছিল। পাঁচ বছর বয়সেই রোহিণী দাস মাসির বাড়ি চলে আসেন। তাঁর শৈশব কেটেছে বেহেলী গ্রামেই। নির্মলেন্দুদের সঙ্গে রোহিণী দাসের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। তাঁদের বাড়িতে দীর্ঘদিন অবস্থানও করেছেন রোহিণী দাস। রোহিণী দাস যখন পুরোপুরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন, তখন বেহেলী গ্রামই হয়ে ওঠে তাঁর আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। স্থানীয় কৃষকদের সংগঠিত করতে রোহিণী দাস নির্মলেন্দুদের সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ করেন। রোহিণী দাসের হাত ধরেই বামধারার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন নির্মলেন্দু।
১৯৪১ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভ করেন। এরপরই তিনি জাপবিরোধী, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হন।
বেহেলী গ্রাম, বিপ্লবীদের নিরাপদ ঘাঁটি
বেহেলী গ্রামের যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না হলেও গ্রামটি পশ্চাৎপদ ছিল না। এখানকার বসবাসকারীরা অগ্রসর চিন্তা-চেতনা লালন করতেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এই গ্রামের লোকজন সম্পৃক্ত হয়েছিল দেশের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে। নিজেদের জমিদারি থাকলেও পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে নির্মলেন্দুদের পরিবার বিপ্লবীদের প্রেরণা জুগিয়েছে। ব্রিটিশবিরোধীদের সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন নির্মলেন্দুর পিতা-মাতা। মূলত তাঁদের বাড়ি বিপ্লবীদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়। গ্রামে কংগ্রেস-কমিউনিস্ট উভয় ধারার লোকজন ছিল।
অবস্থানগত কারণে আত্মগোপনকারীদের নিরাপদ ঘাঁটিতে পরিণত হয় বেহেলী। হাওরবেষ্টিত হওয়ায় পুলিশ আসার আগেই খবর পৌঁছে যেত গ্রামে। সে-কারণে এখানে আত্মগোপনকারীরা নিরাপদে সটকে পড়তে পারতেন।
লোকসংগীতের তীর্থস্থান!
নির্মলেন্দুর পিতৃভূমি বেহেলীকে লোকসংগীতচর্চার অনন্য স্থান বললে ভুল হবে না। কারণ গ্রামের শান্ত পরিবেশ সংগীতচর্চায় শুধু সহায়কই ছিল না, এই গ্রামে অবস্থানকারীরাও ছিলেন সংগীতপিপাসু। সংগীতের প্রতি তাঁদের অগাধ ভালোবাসা ছিল। শুধু লোকগীতিই নয়, গণসংগীতের প্রতিও গ্রামের লোকজন ছিল দুর্বল। সংস্কৃতিচর্চায় অগ্রসর ও বিভিন্ন কর্মকা-ে 888sport promo codeদের সম্পৃক্ততা এই গ্রামের আবহকে দিয়েছিল ভিন্ন মাত্রা।
গ্রামের সংগীতচর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল নির্মলেন্দুদের বাড়ি। নির্মলেন্দুদের পরিবারের প্রায় সব সদস্যই সংগীতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই গলা ছিল গান গাওয়ার উপযোগী। চার পুরুষের কাহিনীতে হেনা দাস উল্লেখ করেছেন –
…নির্মলদের বাড়ি ছিল লোকসঙ্গীতের প্রাণকেন্দ্র। প্রতিদিন সেখানে বসত গানের আসর। ওরা ভাইবোন সবাই তাদের সুরেলা কণ্ঠ ও প্রতিভা দিয়ে লোকসঙ্গীতের ভুবনকেই আলোকিত করে তুলেছিল। আর সেই সংগীতভুবনের রাজা ছিল নির্মল নিজে। তবে নির্মল যে কেবলমাত্র তার প্রতিভার সাহায্যে এই রাজ্যকে জয় করে নিয়েছিল তা নয়, এ ব্যাপারে তার মা ছিলেন প্রেরণা ও শক্তি। তাঁর ছিল চমৎকার সঙ্গীতের এক দরাজ কণ্ঠ আর ছিল অফুরন্ত লোকসঙ্গীতের ভা-ার। একাই গান গেয়ে মাতিয়ে তুলতে পারতেন আসর। আর যখন ছেলে মেয়েদের নিয়ে একসাথে গান ধরতেন তখন সত্যিই সেই সম্মিলিত কণ্ঠের সুরের মূর্ছনায় মনে হতো ঘরের পরিবেশ পাল্টে গিয়ে যেন আমরা খোলা আকাশের নীচে উন্মুক্ত প্রান্তরে প্রকৃতির কোলে বসে মাটি, নদী, হাওর, ক্ষেত, খামার ও গ্রামের মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে যাচ্ছি।
হুলিয়া : অতঃপর ওপার বাংলায়, বিশ্বলোকে
তাঁর বিরুদ্ধে তখন হুলিয়া জারি করা হয়েছে। যে-কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন – এই শঙ্কা থেকেই নির্মল ওপার বাংলায় পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন। বৈরী পরিবেশের কারণে ধনীর দুলাল হওয়া সত্ত্বেও নির্মলেন্দু তখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। সিলেটে এলেন, বন্ধু-বান্ধবরা সিদ্ধান্ত নেন; শহরে নাটক করে এ থেকে অর্জিত সমুদয় টাকা তুলে দেওয়া হবে তাঁর হাতে। তা নিয়েই ভারতে পাড়ি জমাবেন নির্মলেন্দু। শহরে দুই পুরুষ নাটকের আয়োজন করা হলো। এ থেকে অর্জিত অর্থ পৌঁছে দেওয়া হলো নির্মলেন্দুর কাছে। নন্দরানী চা বাগান হয়ে ওপার বাংলায় পাড়ি জমালেন এপার বাংলার লোকসংগীতের উজ্জ্বল এই নক্ষত্র।
কলকাতায় গিয়ে রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। শুরু হয় সংগ্রামী জীবনের আরেক অধ্যায়। পূর্বপরিচিতরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ১৯৫৫ সালে কলকাতা শহরে অনুষ্ঠিত বঙ্গ-সংস্কৃতি সম্মেলনে নির্মলেন্দু অংশগ্রহণ করে ‘শ্রীহট্টের লোকসংগীত’ পরিবেশন করেন। তবে এর আগেও বেশ কয়েকটি আসরে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করেন তিনি। কিন্তু এ-অনুষ্ঠানে নতুনভাবে নির্মলেন্দুকে চিনল কলকাতাবাসী। এদিন তিনি একে একে পরিবেশন করেন নৌকাবাইচের গান – ‘সোনার বান্দাইল নাও’, ভাওয়াইয়া – ‘প্রেম জানে না রসিক কালাচান’, হাছন রাজার – ‘লোকে বলে, বলেরে’, টানা ভাটিয়ালী ‘মইষ রাখ মইষাল বন্ধুরে’, নাচের গান – ‘সোহাগ চান বদনে ধ্বনী’, ধামাইল – ‘আমি কি হেরিলাম জলের ঘাটে গিয়া’ প্রভৃতি। নির্মলের গানে মুগ্ধ হলেন শ্রোতারা। সুনাম ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। এ বছরই শান্তিনিকেতনে গিয়ে সংগীত পরিবেশনের আমন্ত্রণ জানানো হলো তাঁকে। শান্তিনিকেতনের সবাই মুগ্ধ হলো তাঁর সুরশৈলীতে। শুরু হয় নতুন এক নির্মলেন্দুর
পথচলা। নানা অনুষ্ঠান থেকে আমন্ত্রণ আসতে থাকে। সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন তিনি। দরাজ কণ্ঠে গান ধরা মাত্র অনুষ্ঠানস্থল পরিপূর্ণ হয়ে যায় কানায় কানায়। চৌরাস্তার মোড়ে অনুষ্ঠান হলে ট্রাফিক জ্যাম এড়ানো যায় না।
জনপ্রিয়তা যখন এই পর্যায়ে, তখন নির্মলেন্দুকে রাষ্ট্রীয় সফরে নেওয়ার জন্য মনোনীত করা হয়। এ-প্রসঙ্গে 888sport sign up bonusচারণমূলক ‘নির্মল হৃদয়’ নিবন্ধে ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন – ‘একদিন মন্ত্রী অনিলকুমার চন্দের চিঠি পেলাম। তিনি লিখেছেন –
অমিতাভ, আমি ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক দল নিয়ে যাচ্ছি পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়া। রাণী (চন্দ) লিখেছে, একটি ছেলে নাকি শান্তিনিকেতনে এসে দারুণ গান গেয়ে গেছে। তুমি চেন তাকে? চেনা থাকলে নামটা জানাও, আমি পঁচিশে বৈশাখ কলকাতা যাচ্ছি। ৪৮ চৌরঙ্গি রোডে সকাল বেলা আমার সঙ্গে ওকে দেখা করতে বল।
চিঠি পড়েই বুঝলাম, অনিলদা নির্মলের কথা বলছেন। ওকে খবরটা দিতেই বুকে জড়িয়ে ধরল। ১৯৫৩ সালের ৮ মে সকালে নির্মলকে নিয়ে অনিলদার কাছে গেলাম। গান শুনে অনিলদা নির্মলকে বুকে টেনে নিলেন। নির্মল ছোটভাই শিবুকে দোহার হিসেবে নিয়ে পূর্ব ইউরোপের পথে চলে গেল দিল্লি। হাওরা স্টেশনে তাকে তুলে দিলাম।
ওই সাংস্কৃতিক দলে আছেন বিলায়েত খাঁ, সিতারা, শান্তা প্রসাদ, দ্বিজেন মুখার্জি এবং আরো নামজাদা সব গাইয়ে-বাজিয়ে। বিদেশ রওনা হওয়ার মুখে দিল্লিতে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে নির্মল সবাইকে ছাড়িয়ে গেল। অনিলদা তাকে নিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহ্রুর কাছে। নেহ্রু আলাদা আবার গান শুনে হুকুম দিলেন বিদেশের কোনো মান্য অতিথি দিল্লিতে এলে এই গাইয়েকে যেন বিনোদনের জন্য ডাকা হয়। বছরের পর বছর এই হুকুম বহাল ছিল। আইজেনহাওয়ার এসেছেন, ডাকো নির্মল চৌধুরীকে। কুইন এলিজাবেথ এসেছেন, ডাকো নির্মল চৌধুরীকে। ভরোশিলভ একনক্রমা – যিনিই আসুন, রাজদরবারে সভা-গায়ক নির্মলেন্দু চৌধুরী। এসব খবর কাগজে একটু একটু করে বেরোয় আর কলকাতার আসরে নির্মলের কদর বাড়ে।
ওদিকে সরকারি দলে – ওয়ারশ, সোফিয়া, বুদাপেস্ট, প্রাগ, বেলগ্রেড, মস্কো – নির্মল যেখানে গিয়েছে, অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হয়েছে সে। অনিলদা খুশি, ভারত সরকার খুশি। বাংলার পাড়াগাঁর গান, তার কণ্ঠে বিদেশে গৌরব বাড়াল স্বদেশের। নির্মল গান শেষ করলে হাততালি থামে না, কাগজে কাগজে বেরোয় তার পাতাজোড়া ছবি, তার গাওয়া গানের কলি ঘোরে সবার মুখে। বলশয় থিয়েটারে স্বয়ং ক্রুশ্চেভ প্রথম সারিতে বসে সাধুবাদ জানান, বেলগ্রেডে মার্শাল টিটো তাঁকে প্রশংসা করতে ছুটে আসেন।’
১৯৫৫ সালে পোল্যান্ডের ওয়ারশ বিশ্ব যুব উৎসবে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করে স্বর্ণপদক জিতে সবাইকে চমকে দেন তিনি। তাঁর আগে কোনো বাঙালির এ-ধরনের পদক পাওয়ার নজির নেই। এরপর জীবদ্দশায় অনেকটা ধারাবাহিকভাবেই অসংখ্য পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন তিনি। বিদেশ সফর
ইউরোপের এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে নির্মলেন্দু যাননি এবং গান করেননি। শুধু ইউরোপই নয়, আমেরিকাসহ 888sport app মহাদেশেও তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। জীবদ্দশায় এশিয়ার শ্রেষ্ঠ লোকগীতি গায়কের সম্মান অর্জন করেছিলেন তিনি।
বিদেশে রাষ্ট্রীয় ডেলিগেশনে যেতে হলেই নির্মলেন্দু চৌধুরীর ডাক পড়ত। চীনে ভারতের প্রথম সাংস্কৃতিক ডেলিগেশনে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। এরপর ভারতের সরকারি সফরে অসংখ্যবার বিদেশ 888sport slot game করেছেন তিনি। উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে – সোভিয়েত রাশিয়া, যুগোসøাভিয়া, রুমানিয়া, চেকোসেøাভাকিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, জাপান প্রভৃতি। এসব দেশে বাংলার লোকগান পরিবেশন করেছেন তিনি। তবে সবচেয়ে বেশি সফর করেছেন ইংল্যান্ড। প্রায় প্রতিবছরই সেখানে যেতে হতো তাঁকে। যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পেছনে অন্য একটি কারণ ছিল – সেটি হচ্ছে তৎকালীন সময়ে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাঙালিদের মধ্যে ৯০ শতাংশই ছিলেন সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দা। তাঁদের অনেকের সঙ্গেই নির্মলেন্দুর পরিচয় ছিল, ছিল সখ্য। বাল্যবন্ধুদেরও অনেকেই ছিলেন সেখানে। তাঁদের আমন্ত্রণ কখনো ফেলতে পারেননি এই লোক888sport live chatী। আর যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাঙালিরাও তাঁকে পেয়ে হয়েছেন আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত।
বহুমুখী প্রতিভার সম্মেলন
নির্মলেন্দুর চরিত্রে বহুমুখী প্রতিভার সম্মেলন ঘটেছিল। শুধু গান গাওয়া, সুর করা, অভিনয় এবং প্রযোজনার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি তিনি। বইও লিখেছেন। এপার বাংলা ওপার বাংলার গান নামে দুই বাংলার লোকসংগীত ও গণসংগীতের সংগ্রহ নিয়ে লেখা বইটি প্রয়াত আলাউদ্দিনকে উৎসর্গ করেছেন তিনি। লোকসংগীতের স্বরলিপিসহ লেখা দ্বিতীয় বইটি এখনো প্রকাশিত হয়নি।
শুধু লোকগানেই সীমাবদ্ধ ছিল না নির্মলেন্দু চৌধুরীর প্রতিভা। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ অভিনেতা। তাঁর অভিনয়শৈলী ছিল মনোমুগ্ধকর, ব্যতিক্রমী ও নিখুঁত। তিনি অভিনয়কে কখনো অভিনয় হিসেবে নেননি। চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে উপলব্ধি করে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন ক্যামেরার সামনে। তাই তাঁর অভিনীত প্রতিটি চরিত্রই ছিল জীবন্ত। জীবনের কাছাকাছি তিনি নিয়ে গেছেন অভিনয়কে।
পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত অভিনেতা উৎপল দত্তের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত থিয়েটার অঙ্গার, ফেরারী, ফৌজ, তিতাস একটি নদীর নামে তাঁর অনবদ্য অভিনয় এখনো জনমনে স্বীকৃত।
live chat 888sportেও অভিনয় করেছেন। ভারতের প্রখ্যাত পরিচালক রাজেন তরফদারেরর গঙ্গা, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাঞ্চন মালা, নতুন ফসল, ডাকাতের হাতে ইত্যাদি live chat 888sportে তাঁর অভিনয় 888sport app download for androidীয় হয়ে আছে। ডাকাতের হাতে ছবিতে তিনি অত্যাচারী জমিদারের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক মাতিয়েছিলেন। অথচ ব্যক্তিজীবনে জমিদার বংশের হয়েও তিনি ছিলেন নিরহংকারী। কোনো কিছুর প্রতি লোভ ছিল না তাঁর।
দৃঢ়চেতা নির্মলেন্দু
চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পছন্দ করতেন নির্মলেন্দু। হার মানার পাত্র ছিলেন না। জীবনসংগ্রাম অথবা সংগীতযুদ্ধে, কোনো কিছুতেই পরাজিত হননি তিনি। সব সময়ই থেকেছেন অদ্বিতীয়।
নির্মলেন্দুর মেজাজ এবং দুর্জয় সাহসের কথা বলতে গিয়ে মা স্নেহলতা জীবদ্দশায় গল্প করেছিলেন – এক বর্ষায় তার কঠিন অসুখ হয়েছিল। চিকিৎসকের নির্দেশমতো ওষুধ বেহেলীর কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে সংগ্রহ করা সম্ভবপর ছিল না। সে-সময় প্রকৃতি ছিল বৈরী। ঝড়-বৃষ্টি-বিদ্যুৎ উপেক্ষা করে মায়ের জন্য ওষুধ আনতে নির্মলেন্দু ছুটে গেলেন সাচনা বাজারে, সেখান থেকে স্টিমারে করে সুনামগঞ্জ শহরে। ফেরার পথে নদী সাঁতরে মুমূর্ষু মায়ের জন্য নিয়ে এসেছিলেন প্রয়োজনীয় ইনজেকশন। মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা আর নিজের আত্মবিশ্বাস নির্মলেন্দুকে সেদিন বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে সহায়তা করেছিল। কাজে লেগেছিল সেই ইনজেকশন।
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে নির্মলেন্দুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে। ভারতের যে সাংস্কৃতিক দলটি সে-সময় বিভিন্ন দেশ পরি888sport slot game করত, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন সিতারা। তাঁর মনোমুগ্ধকর কত্থক নাচে দর্শকরা হতেন মাতোয়ারা। নির্মলেন্দুর দর্শকপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন তিনি। ক্ষুব্ধ সিতারা দলনেতাকে বলেন, ‘মি. চন্দ, কাগজে কাগজে কেবল একজনের প্রশংসা। আমরা কি ফেলনা? নির্মল চৌধুরীকে আপনি গান গাইতে দেন আমার আগে। গাক তো দেখি, আমার নাচের পরে; দেখি কেমন হাততালি পায়।’ মন্ত্রী অনিল তাকে বললেন, ‘কাগজের প্রশংসায় আমার হাত নেই। তবে আপনার চ্যালেঞ্জের কথা নির্মলকে জানাব।’ দলনেতা
নির্মলের রুমে গিয়ে দেখেন, পেটের ব্যথায় তিনি শয্যাশায়ী। তাঁকে দেখেই নির্মলেন্দু বললেন, ‘আজ সন্ধ্যার প্রোগ্রামে আমাকে বাদ দিলে হয় না!’ তিনি তাঁকে বলেন, ‘কী সর্বনাশ, আমি যে সিতারার চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করে তোমার কাছে এসেছি।’চ্যালেঞ্জ জেনে নিয়ে তিনি দলনেতাকে আশ্বস্ত করলেন। সিতারার নৃত্যের পর সন্ধ্যায় বুলগেরিয়ার সোফিয়ার মঞ্চে আসেন নির্মলেন্দু – এরপর এমন গান গাইলেন যে, হাততালি আর থামে না। দর্শকরা যখন নির্মলে বিমোহিত, তখন সাজঘরে চোখের জলে বুক ভাসান সিতারা।
আত্মপ্রত্যয়ী নির্মলেন্দু জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকেও ফিরে আসেন একবার। বড় ধরনের একটি দুর্ঘটনায় তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু দুর্বিপাক তাঁর কাছে পরাজিত হয়। ছেলে উৎপলেন্দু চৌধুরী এ-প্রসঙ্গে লোকাতীত লোক888sport live chatী নির্মলেন্দু চৌধুরী লেখায় উল্লেখ করেছেন –
১৯৫৯ সালে ভারতের রানাঘাটে গান গাইতে যাবার সময় এক দুর্ঘটনায় সাংঘাতিকভাবে জখম হলেন বাবা। বুকের পাঁজর ভাঙল, ভাঙল হাত-পা। শিরদাঁড়ায় লাগল ভারি চোট। অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে আসা হল ন্যাশনাল মেডিক্যাল হাসপাতালে। তাঁর অবস্থা দেখে সকলেই ভেবেছেন বোধহয় আর বাঁচবেন না। বাঁচলেও পঙ্গু হয়ে কাটবে বাকি জীবন। কিন্তু বাবা ইচ্ছাশক্তি আর মনের জোরে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও, হাতে-পায়ে
প্লাস্টার নিয়ে ইডেন গার্ডেনে যুব উৎসবে গাইতে গেলেন। মঞ্চে উঠলেন স্ট্রেচারে। মাঠভর্তি শ্রোতাদের প্রায় না-থামা অভিনন্দন গায়ে মেখে বাবা ছোটালেন গানের তুফান।
গানের ভুবনে নির্মলেন্দু : হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মূল্যায়ন
গানের ভুবনে নির্মলেন্দুর শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর সম্পর্কে করা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের অকপট বক্তব্যে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস উজান গাঙ বাইয়া বইয়ে নির্মলেন্দু চৌধুরীকে যেভাবে মূল্যায়ন করেছেন, তা থেকে 888sport live chatী হিসেবে তাঁর সুদৃঢ় অবস্থানেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তিনি সাবলীলভাবে নির্মলেন্দু চৌধুরীর অসাধারণ প্রতিভাকে উপস্থাপন করে তাঁকে অনন্য স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন। ব্রিটিশবিরোধী সুরমা উপত্যকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সরল উচ্চারণ – ‘একটা দুটো ভালো কণ্ঠের অভাব বোধ করছিলাম,’ …আমার এই দাবী পূরণ করতে গিয়ে কৃষক নেতা রোহিণী দাস (সুনামগঞ্জ) একটি তরুণ ছেলেকে এনে বললেন – গলাটা পরীক্ষা করে দেখতে। গলা শুনেই আমি লাফিয়ে উঠেছিলাম। তখন মাইক চোখেও দেখিনি আমরা। তাই দরকার ছিল যেমন সুরেলা, তেমনি জোরালো, তেমনি মেঠো গলার। ছেলেটি সেই দাবি পূরণ করেছিল। তার নাম নির্মলেন্দু চৌধুরী। তাকে তখনই শিখিয়েছিলাম – চল চলরে কমরেড গানটি। এই সময় লোকসুরে ভাটিয়ালিতে রচনা করেছিলাম একটি গান, যা আমার ধারণায় অতি সফল সুর সংযোজনার কল্যাণে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। নির্মল এ গান বহু জায়গায় গেয়েছিলো, কলকাতাতেও তার গলায় এ-গান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো।
গানটি ছিলো –
ও চাষী ভাই –
তোর সোনার ধানে বর্গী নামে দেখরে চাহিয়া।
তোর লুটে নেয় ফসল
দেশবিদেশী ধনিক, বণিক, ফ্যাসীদস্যুদল।
পঙ্গপালে দলে দলে ছাইলো দুনিয়া।
জাপানের হাওয়াই জাহাজ
আসমান হতে মোদের বুকে হানছে কলের বাজ।
তারা জোর জুলুমে কুলের বধূ নেয়রে হরিয়া।
এর পরেই আমি রচনা করেছিলাম ‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান’, যে-গান অভূতপূর্ব জনপ্রীতি লাভ করেছিল।
…বেহেলী কৃষক সম্মেলনে গানটি নিয়ে গিয়েছিলো সুরথ পাল চৌধুরী, গেয়েছিলো নির্মলেন্দু চৌধুরী। অসুস্থ থাকায় আমি নিজে যেতে পারিনি। সম্মেলনে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিলো এ-গান। কৃষকদের কণ্ঠে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে অতিদ্রুত ছড়িয়ে গিয়েছিল। এই বিরাট সাফল্য আমাকে একটা ব্যাপারে সুনিশ্চিত করেছিলো যে, জনগণের চেনাজানা পরিচিত আঙ্গিকে বিপ্লবী বিষয়বস্তু পৌঁছে দেওয়াই হলো সঠিক রাস্তা।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা – ‘ইনক্লাবী হ্যাঁকে ঐ শোন পেতে কান/ লড়ে লাল বাহিনী শোন কাহিনী/ মুক্তিবাণী শোন ভারত সন্তান’, ‘হামরা – কোদাল চালাই পয়দা বাড়াই/ ধনদৌলত গড়ি/ দেশ বাঁচাবার ডাক এলো আজ/ চুপে রইতে নারি, কাউয়ায় ধান খাইলরে ডাকাউরা মানুষ নাই’, ‘দিব না দিব না দিব না; দস্যুকে পথ ছেড়ে দিব না’ প্রভৃতি গান নির্মলেন্দু চৌধুরী গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচ-ভাবে সাড়া পড়ে যায় সর্বত্র। গণসংগীতগুলো অনুপ্রেরণার সংগীতে পরিণত হয় প্রতিবাদকারীদের। আন্দোলনের অপরিহার্য সেনানী হয়ে ওঠেন তিনি।
তাঁর সর্বাধিক গাওয়া গানগুলোর অন্যতম একটি হচ্ছে – ‘এগো বাটার উপর পইলো ঠাটা/ গাল ভরি পান খাইতা নি/ গুয়া গাছো ট্যাকসো লাগিলনি।’ আব্দুল গাফ্ফার দত্ত চৌধুরী এ-গানটি তৎকালীন আসাম সরকার কর্তৃক সুপারির (সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় ‘গুয়া’) ওপর ট্যাক্স বসানোর প্রতিবাদে লিখেছিলেন। গানটি এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে, যা ছিল 888sport live chatীর কাছেও কল্পনাতীত। হুলস্থুল কা- পড়ে যায় সর্বত্র। গ্রামবাংলার লোকেদের মুখে মুখে ফিরতে থাকে গানের চয়নগুলো। এই গানটির জনপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়ে তেলের দাম বৃদ্ধি হলে হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেন – ‘আজব দেশের আজব কথা/ কোন যুগে শুনছনি/ হৈরর (শর্ষের) তেল/ কোন দেশে গেল/ খবর জাননি’ – এ-গানটির সুর করতেও ভূমিকা রয়েছে নির্মলেন্দু চৌধুরীর।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের লেখা একটি বা দুটি গানে সুরারোপের ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখেননি নির্মলেন্দু, তাঁর সুরের ছোঁয়া রয়েছে গণসংগীত-সম্রাটের অসংখ্য গানে। এ প্রসঙ্গে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সরল উচ্চারণ – ‘আমার তখনকার গানের সুর সংযোজনায় নির্মলের যথেষ্ট অবদান আছে।’ তাঁর মতে, ‘তখন যে রাজনৈতিক বিরুদ্ধতাকে ঠেলে প্রতিপদে এগিয়ে চলতে হতো, তার মধ্যে গানের স্কোয়াড ছিল অগ্রণী বাহিনী এবং নির্মলেন্দু চৌধুরী ছিলেন তার প্রধান গোলন্দাজ।’
অন্যদিকে আপসহীন, সংস্কৃতিবান মানুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের প্রতিও 888sport apk download apk latest version-ভালোবাসা ছিল নির্মলেন্দুর মর্মমূলে। উভয়ের রাজনৈতিক জীবনের প্রত্যয় প্রোথিত হয়েছিল সিলেটের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সুরসংগ্রামে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের লেখায় – ‘সুনামগঞ্জের হাওর, বিলের ঢেউয়ের বিস্তার ছিল নির্মলের গলায়, সেদিনকার সংগ্রামের দিনে, আমাদের কাছে সংগীত হয়ে উঠেছিল সংগ্রাম আর সংগ্রাম হয়ে উঠেছিল সংগীত।’
…১৯৪৩ এ ফ্যাসিবিরোধী লেখক সম্মেলনে আমাদের জেলার প্রতিনিধি হিসাবে আমি ও নির্মল চৌধুরী (কলকাতা) আসি। আমরা এসে উঠেছিলাম চির888sport app download for androidীয় ৪৬ ধরমতলায়। সেখানে তখনকার কলকাতা এবং 888sport appsের প্রখ্যাত 888sport live footballিক ও 888sport live chatীদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় ঘটে। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে 888sport apk download apk latest versionনন্দ পার্কে অনুষ্ঠিত মুক্ত অধিবেশনে হরিপদ কুশারীর ‘মরণ শিয়রে দলাদলি করে’, বিনয় রায়ের কণ্ঠে ‘শুনো হিন্দকে রেহনেওয়ালে, শোন শোন’ গানটি, রংপুরের দলের পানু পাল ও রেবা রায়ের ‘ভুখা বাংলা’ নৃত্যনাট্য ইত্যাদির সঙ্গে ‘কাস্তেটারে দিয়ো জোরে শান’, ‘সোনার ধানে বর্গী নামে’, ‘তোরা আয় আয়রে ছুটে আয়’ – আমার এ কয়টি গান নির্মলের কণ্ঠে প্রচ- সাড়া জাগায়। সন্ধ্যায় মিনার্ভা থিয়েটারে বিজন ভট্টাচার্য্যরে ‘জবানবন্দী’, বিনয় রায়ের ‘ম্যঁয় ভুখা হুঁ’ গীতিনাট্য, মালদহের বিশু প-িতের গম্ভীরা (একি 888sport appsে থাকা দায় বাপরে) ইত্যাদির সঙ্গে সিলেটের দুটি গানে নির্মল চৌধুরীর নেতৃত্বে নৃত্যরূপ দেওয়া হয়।…
এই সময়েই ৪৬ ধরমতলায় থাকাকালীন আগন্তুক স্বাধীনতা দিবস ২৬শে জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি গান রচনার জন্য সুভাষ মুখার্জী ও চিন্মোহন সেহানবীশ আমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। তখনই আমি লিখলাম ‘দুঃখের রাতে ঘোর তমসাভেদি স্বাধীনতা দিবস এলো যে ফিরে – শহীদের মৃতপ্রাণ, শোন করে আহ্বান, করাঘাত হানে তব দ্বারে।’ তখনো মন্বন্তরের কালোছায়া সরে যায় নি। ইমন রাগকে ভেঙে নির্মলের সঙ্গে মিলে মধ্যরাত্রে সুর দিলাম। কলকাতাসহ সমস্ত পশ্চিমবঙ্গে নাড়া দিয়েছিল – ‘মুমূর্ষু বাংলার এ দুঃখতাপ/ হত দেশপ্রেম করে অভিশাপ/ ঘুচাও এ লজ্জা ঘুচাও এ পাপ’ গানটি।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যেভাবে তাঁর গান সাধারণ মানুষকে মাতোয়ারা করেছিল, তেমনি বাংলার লোকগানকে সমাদৃত করতে নির্মলেন্দু চৌধুরীর অনবদ্য ভূমিকা হয়েছে প্রশংসিত। এ-ধারার গানকে বিশ্বময় প্রচার করে তিনি স্থাপন করে গেছেন বিরল দৃষ্টান্ত।
মূলত দেশভাগের পর নির্মল জোরেশোরে গ্রামবাংলার সংগীতকে বিশ্বজনীন করতে উদ্যোগী হন। যে-গান রাখাল আর পালতোলা নৌকার মাঝি গেয়ে যান সর্বদা। যে-গানে বিরহের পঙ্ক্তিমালা উচ্চারিত হয়, যে-গানে প্রাণ ফিরে পায় কিষানি, যে-গান রমণীর মনে দোলা দিয়ে যায় – সেই গান নির্মলেন্দু গাইতে শুরু করলেন ওপার বাংলায়। এপার বাংলার লোকগানের সঙ্গে ওপার বাংলার লোকজন তখনো পরিচিত হয়নি। আর পরিচিত করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ‘গাঁও গেরামের’ গান গাইতে লাগলেন তিনি। এ-প্রসঙ্গে 888sport live chatী ও সুরকার বিদিত লাল দাস বলেন, ‘আমাদের পাড়াগাঁয়ের গানকে নির্মলেন্দু যেভাবে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছেন,
তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। নতুন এবং পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো সব দেশের লোকজনদের পক্ষে সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু নির্মলেন্দু সেই সীমারেখার দেয়াল টপকেছেন সুনিপুণভাবে। তিনি লোকগানকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বময়। হাছন রাজার – ‘লোকে বলে বলে রে ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার’ তাঁর কল্যাণেই বিশ্বব্যাপী পরিচিত।’
অর্থকষ্টেও অবিচল, দেশপ্রেমে অনন্য
কলকাতায় জীবনের বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অর্থকষ্টে পড়তে হয়েছিল নির্মলেন্দু চৌধুরীকে। তবে অর্থকষ্ট তাঁকে টলাতে পারেনি নিজ আদর্শ থেকে। ছেলে উৎপলেন্দুর লেখায় ফুটে উঠেছে সেই চিত্র –
দেশভাগের দগদগে ক্ষত বুকে নিয়ে, আরও বহু মানুষের মিছিলে শামিল হলেন আমার বাবা, নির্মলেন্দু চৌধুরী। গলায় গান, হাতে দোতারা এবং বুকে অসীম সাহস। সঙ্গে বিরাট পরিবারের দায়িত্ব। শুরু এক নতুন সংগ্রাম। বিত্তবান পিতার পুত্র, হাসিমুখে বরণ করে নিলেন দারিদ্র্য।
888sport sign up bonusর পর্দা সরিয়ে দেখতে পাচ্ছি সেই দিনগুলি। উত্তর কলকাতার মহেন্দ্র গোস্বামী লেনে এক কামরার ছোট্ট বাসস্থান তখন আমাদের মাথাগোঁজার ঠিকানা। মনে পড়ে বাবার তখন একটিমাত্র শার্ট। সেটি পরম মমতায় কেচে, ইস্ত্রি করে আমার মা প্রতিদিন বাবার হাতে তুলে দিতেন। সঙ্গে দিতেন এক আনা পয়সা। যাতায়াতের সেকেন্ড ক্লাস ট্রামভাড়া। মায়ের কাছে শুনেছি, এমনও হয়েছে, সারাটা পথ পায়ে হেঁটে বাবা ওই এক আনা পয়সা ফিরিয়ে এনেছেন বাড়িতে।
উৎপলেন্দু পিতার দারিদ্র্যের কথা বলেছেন অকপটে। বিশাল বিত্তবৈভব ফেলে রেখে জীবনসংগ্রামে রত হতে হয় নির্মলেন্দু চৌধুুরীকে তৎকালীন রাষ্ট্র পরিচালনাকরীদের রক্তচক্ষুর কবলে পড়ার কারণে। সোনার চামচ মুখে দিয়ে যে-শিশুর জন্ম সে-ই সংসারজীবনে দারিদ্র্যের অক্টোপাসে বন্দি হয়ে দিনপাত করেন অনাহারে-অর্ধাহারে। কিন্তু আর্থিক দৈন্য তাঁকে সততার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র যা-ই করুক মাতৃভূমির প্রতি তাঁর ছিল অগাধ ভালোবাসা। দেশপ্রেম ছিল তাঁর অস্থিমজ্জায়। তাঁর বিশ্বাস ছিল, একদিন না একদিন এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। ১৯৭১ সালে সেই পরিবর্তন আসে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাটির টানে ছুটে আসেন নির্মলেন্দু। ’৭২ সালে 888sport appsে অবস্থানকালীন সময়ে সিলেটে নবরাগ সংগীত বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বন্ধু-বান্ধব, নিকটজন ও শ্রোতাদের ভালোবাসায় সিক্ত হন তিনি।
যে-আশা পূর্ণ হয়নি
নির্মলেন্দু চৌধুরীর একটি বাসনা অতৃপ্ত রয়ে গেছে। তাঁর সাধ ছিল – ভারতের প্রতিষ্ঠিত ১৫ 888sport live chatীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি 888sport appsে আসবেন। গ্রামবাংলার পথে ঘুরে বেড়িয়ে তিনি নিজে ও 888sport live chatীদের দিয়ে মানুষকে গান শোনাবেন। এরপর যাওয়ার সময় এখানকার ১৫ 888sport live chatীকে নিয়ে ভারতে গিয়ে অনুরূপ আয়োজন করবেন। এপার বাংলা ও ওপার বাংলার সংগীতের মাধ্যমে সেতুবন্ধের উদ্দেশ্য থেকেই তিনি এমন আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর অমোঘ বাস্তবতা তাঁর সে-সাধ পূর্ণ হতে দেয়নি।
মৃত্যুর পর বিশিষ্টজনের প্রতিক্রিয়া
১৯৮১ সালের ১৮ এপ্রিল সকালে বুকে ব্যথা অনুভব করেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। তাৎক্ষণিক তাঁকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিকেল সাড়ে ৩টায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। 888sport appsের সুধীজনরাও হন শোকাহত। অকালপ্রয়াত এই মহান 888sport live chatীকে দেখতে মান্না দে, সলিল চৌধুরী, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত, সবিতা চৌধুরী, সবিতাব্রত দত্ত, চিন্ময় চ্যাটার্জি, ডি বালসারা প্রমুখ ছুটে যান তাঁর কলকাতাস্থ বাসভবনে। রাজ্যপালের পক্ষ থেকে মরদেহে মাল্য দেওয়া হয়। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু পরিবারবর্গের কাছে এক শোকবার্তায় সমবেদনা জানান। তাঁর পক্ষ থেকেও নির্মলেন্দুর মরদেহে পুষ্পার্ঘ্য দেওয়া হয়।
তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘নির্মলেন্দু চৌধুরী শেষ দিন পর্যন্ত নিজেকে গণসংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত রেখেছিলেন। গণনাট্য ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁর ছিল বিশিষ্ট ভূমিকা।’
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আমরা এক বড় 888sport live chatীকে হারালাম।’
দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আমাদের পরিচয় তিরিশ বছরের। নির্মলেন্দু নেই ভাবতে পারি না।’
সলিল চৌধুরী শুধু বলেন, ‘আমি হতবাক।’
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘এই মৃত্যু আমার কাছে বজ্রপাতের মতো।’
শেষ কথা
নির্মলেন্দু শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য সংগীত পরিবেশন করেছেন। তিনি তাঁর নীতি-আদর্শে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অবিচল ছিলেন। সংগীত তাঁকে যশ-খ্যাতি সবকিছু দিয়েছে। কিন্তু তিনি কখনো সংগীতকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেননি। যাঁরা তাঁকে গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তাঁদের ডাকেই সাড়া দিয়েছেন। যে-সংগঠনগুলো অসহায় মানুষের জন্য সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করত, তাদের কাছ থেকে তিনি কোনো ধরনের সম্মানী গ্রহণ করতেন না।
নির্মলেন্দু চৌধুরী একজন সমাজসেবীও ছিলেন। অসংখ্য দরিদ্র মানুষকে তিনি অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করেছেন। দাঁড়িয়েছেন নির্যাতিতদের পাশে। অন্যায় তিনি সহ্য করতে পারতেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি সবসময় ছিলেন সোচ্চার।
সুরের মূর্ছনায় আচ্ছন্ন শ্রোতাদের কাঁদিয়ে তিনি চিরবিদায় নেন। চিতার কাঠে পুড়ে যায় তাঁর নশ্বর দেহ। শেষকৃত্যানুষ্ঠান তাঁর দেহের সমাপ্তি ঘটায়; কিন্তু নিজ সুরসঞ্জীবনীতে নির্মলেন্দু আজো বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন, যতদিন থাকবে লোকগান।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১. উজান গাঙ বাইয়া, হেমাঙ্গ বিশ্বাস।
২. চার পুরুষের কাহিনী (আত্মজীবনী), হেনা দাস।
৩. সোনার মলাট, তাজুল মোহাম্মদ।
৪. শ্রীহট্টের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা, বিজনবিহারী পুরকায়স্থ।
৫. হাছন রাজা : মরমি মৃত্তিকার ফসল, আবুল আহসান
চৌধুরী-সম্পাদিত।
৬. কালের যাত্রাধ্বনি, আবদুল আজিজ।
পত্রপত্রিকা
১. সাপ্তাহিক যুগভেরী, ২৪ এপ্রিল, ১৯৮১।
২. আনন্দবাজার পত্রিকা, এপ্রিল, ১৯৮১।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.