ভিক্টোরিয়া চূড়া থেকে ঝুঁকে নিচের দিকে তাকাতেই সমস্ত শরীর যেন শিরশির করে উঠল আকাশের। অনেক নিচে যতদূর দৃষ্টি যায় কিছুটা আবছা ধূসর বিশাল একটা ছবির মতো হংকং শহরটা ভেসে উঠল চোখের সামনে।
তার একদিকের অনেকটা জুড়ে ভিক্টোরিয়া হারবারের নীল জল ঘিরে আছে। দুপাশে কাউলুন আর হংকং – পুরনো আর নতুন শহর।
বিশাল বিশাল আকাশছোঁয়া স্কাইস্ক্র্যাপার মুখ তুলে তাকিয়ে আছে আরো দূর আকাশের দিকে।
দুই শহরের মাঝে হারবারে চলাচল করছে দোতলা স্টার। ফেরি অনেকটা আমাদের দেশের স্টিমারের মতো। টুরিস্টসহ প্রচুর লোকজন যাতায়াত করছে।
ভেতরে একটু ভয়-জড়ানো কাঁপুনি থাকলেও আবার একটু ঝুঁকে আকাশ পুনরায় নিচের দিকে তাকায়।
কাছে-দূরে দৃষ্টিসীমার মধ্যে নানা ধরনের গাছপালা আর বনভূমিসহ সমস্ত শহরটা যেন বিশাল একটা ল্যান্ডস্কেপ হয়ে শুয়ে আছে। এদিকটায় সামনের দিকে ছোট-বড় গাছপালায় ঘেরা সবুজ পাহাড়। সেই পাহাড়ের গা-ঘেঁষে সাপের মতো ঘুরে ঘুরে দীর্ঘ পিচঢালা পথ উঠে এসেছে উপরে। সেই পথ ধরে চলাচল করছে প্রচুর গাড়ি। অনেকটা দার্জিলিংয়ের টয়ট্রেনের মতো উঠছে-নামছে পিক ট্রাম। কয়েক বছর হয় দোতলা ট্রামও চলাচল করছে।
হারবারের ওপারে হংকং নগরীর মাথার ওপরে আবছা ধূসর বেশ বড় ধরনের একখণ্ড মেঘ ঝুলে আছে। বিকেলের এই সময়টা হালকা শীতের চাদরে মোড়ানো। ওই ঝুলন্ত মেঘ থেকে বৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না। যদিও আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় কিছুটা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ছিল। এখন নেই। হংকংয়ের আকাশ জুড়ে এখন শুধু মেঘ আর আলো-ছায়ার খেলা।
আকাশ এখানে আসার পর থেকে চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এই অচেনা শহরটিকে শুধু দেখছিল। উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে ভাবছিল, 888sport appsের মতোই তো আকাশের চেহারা। সেরকমই হালকা নীল, তার মাঝে ছোট ছোট মেঘের আনাগোনা।
বিকেল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ডুবন্ত সূর্যের সিঁদুরে রং হারবারের নীল জলে কত যে ছবি এঁকে চলেছে তার ঠিক নেই।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু উদ্বিগ্ন হয় আকাশ। এখানে ও এসেছে কম সময় হয়নি।
এর মধ্যেই এখানে আসার কথা বলেছিল শালিনী।
আসলে এভাবে অপেক্ষা করার ব্যাপারটা একেবারেই পোষায় না আকাশের। ভারি বিরক্ত লাগে। তবে শালিনীর ব্যাপারটা আলাদা। কারণ এই মেয়েটা ওর তেমনভাবে পরিচিত কেউ নয়। মাসতিনেক আগে মাত্র আলাপ হয়েছে। তাই এই সময়ের মধ্যে ওর সবকিছু বুঝে যাওয়ার কথা নয়। আরো কিছুদিন সময় লাগবে। তাছাড়া কোথায় থাকে সেটা দু-একবার শুনলেও এই অচেনা শহরে ইচ্ছে করেই সেখানে যাওয়ার কথা ভাবেনি আকাশ। আর সেভাবে কখনো ওকে বলাও হয়নি।
কলকাতার মেয়ে শালিনীর সঙ্গে এখানেই প্রথম দেখা হয়েছে আকাশের। আগে কোনোরকম আলাপ-পরিচয় ছিল না। মাসতিনেক বা তার কিছুটা আগে এখানেই একদিন বিকেলে রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তার মোবাইলে একটা ছবি তুলে দেওয়ার জন্য একবার অনুরোধ করেছিল শালিনী। তারপরে আরো কিছু ছবি তোলা, একসঙ্গে কিছুটা পথ হাঁটাহাঁটি আর ঘোরাঘুরি, তারপর কফিবারে কফি খেতে খেতে এটা-সেটা নিয়ে কিছু হালকা কথাবার্তা ইত্যাদি মিলিয়ে ছিল সেদিনের আলাপ-পরিচয়।
সেদিন শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। তারপরে অনেকবার দেখা হয়েছে। তবে পরে ওদের দুজনার কেউই বেশি উৎসাহী হয়ে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেনি। আর হয়তো সেজন্যই ওদের মধ্যে নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব বলতে যা বোঝায়, সেটা এখনো বজায় রয়েছে।
এতদিনে আকাশ শুধু জেনেছে, কলকাতার শ্যামবাজারের শালিনী মিত্র নামে এই মেয়েটি একটি মাল্টিন্যাশনাল আইটি কোম্পানিতে চাকরি করে। বছর দুয়েক আগে ইন্টারন্যাশনাল স্টাফ হিসেবে হংকং অফিসে সিনিয়র আইটি এক্সিকিউটিভ পদে জয়েন করেছে। এর আগে ছিল ভারতের ব্যাঙ্গালোর অফিসে। এর বেশি কিছু আর জানা হয়নি আকাশের। কিন্তু …।
– আকাশ …
সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ছিল আকাশ। হঠাৎ পেছন থেকে আসা ডাকটি একেবারে চমকে দিলো। ছিন্ন হলো মনের ভেতরের চিন্তাভাবনা। আকাশ ঘুরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। সামনে দাঁড়িয়ে শালিনী।
– কেমন আছেন? মৃদু হাসির সঙ্গে জিজ্ঞেস করে শালিনী।
– এই তো, চলে যাচ্ছে। আকাশ সোজাসুজি ওর মুখের দিকে না তাকিয়ে বলে, কখন এলেন?
– একটু আগে। কিন্তু আপনি তো দেখছি অন্যমনস্ক হয়ে কী সব ভাবছিলেন। বাড়ির কথা মনে পড়ছে নিশ্চয়ই।
আকাশ শালিনীর কথার জবাব না দিয়ে কীসব ভাবতে ভাবতে শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, এই তো মাত্র দুদিনের পরিচয়। আমার সম্পর্কে কতটুকু জানে আর শালিনী। অথচ কথা শুনে মনে হচ্ছে, সে অনেকটাই যেন বিশ্বাস করে ফেলেছে আমাকে। আমি যা বলেছি তাই সব সত্য বলে ধরে নিয়েছে, কিছুমাত্র সন্দেহ করেনি।
একটু পরে মৃদুস্বরে আকাশ বলে, কিছুটা। আবার কবে বাড়ি যাবো, সবাইকে দেখব, কে জানে!
– এমনভাবে বলছেন কেন? শালিনীর কণ্ঠস্বরে কোমলতা ফুটে ওঠে, এখানে যে জন্য এসেছেন, সে-কাজ শেষ হলেই তো ফিরে যাবেন। তখন তো সবার সঙ্গে দেখা হবে। তারপরে আর হয়তো এখানে কখনো আসাই হবে না।
– কী জানি, আকাশের বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ^াস যেন উঠে আসতে চাইছে। কোনো কথা না বলে সে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
শালিনীর কালো টানা ভ্রু খানিকটা কুঁচকে যায়, বলে, আপনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন …
আকাশ ওর দিকে তাকাতেই কথা থেমে যায়। একটু পরে বলে, আপনি কিছু মনে করবেন না, প্লিজ। আমি কোনো কথাই কিন্তু তেমনভাবে ভেবে বলিনি।
আকাশের মনের ভেতরে ওকে কিছু কথা বলার জন্য যেন তোলপাড় করতে থাকে। কিন্তু সেসব কথা কি কোনোদিন ওকে বলতে পারবে? জানাতে কি পারবে ওর কী পেশা, নাম-ধাম, ঠিকানা, ওর আসল পরিচয়?
আসলে এখন ওর নিজের প্রতি নিজেরই কেমন যেন ঘেন্না ধরে গেছে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আর টানতে ইচ্ছা করছে না এই পলাতক জীবন। কিন্তু এখন এমন অনিশ্চিত পলাতক জীবন বয়ে বেড়ানো ছাড়া ওর আর তো কোনো উপায় নেই। কারণ, ধরা পড়লে তা পুলিশের কাছেই হোক বা এলএম গ্রুপের কাছেই হোক, কেউ ওকে আর ছেড়ে দেবে না, জান নিয়ে ছাড়বে।
আকাশ এখন প্রায় নিশ্চিত, সে যদি ব্যাংকক বা মালয়েশিয়া এমনকি সিঙ্গাপুরেও থাকত তাহলেও ওদের হাত থেকে রক্ষা পেত না। কেননা, ও জানে, ওদের হাত কতটা লম্বা। এতদিনে ওরা ওকে ট্রেস করে ঠিক মেরে ফেলত।
888sport appsের মানুষের কাছে এখনো হংকং দূরবর্তী এক অচেনা শহর। তেমন আসা-যাওয়া বলতে গেলে নেই। ওরা হয়তো ধারণাই করতে পারছে না, এখানে এসে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারে।
আপনমনে গুনগুন করে গান গাইছিল শালিনী। উল্টো হাওয়ার কারণে এতক্ষণ কানে আসেনি, বাতাস ঘুরে যেতে টের পাওয়া যাচ্ছে।
আকাশ বলে, ভালোই তো লাগছে, আর একটু জোরে হলে স্পষ্ট শুনতে পেতাম।
– মানে? অবাক হয় শালিনী, কী বলছেন?
– আমি কিছু বলছি না, হাসে আকাশ, আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আপনার গুনগুন করা দু-একটা গানের কলি আমার কানে এসে বেজেছে, ব্যস এই পর্যন্তই।
– আচ্ছা, এই ব্যাপার! শালিনীও হেসে ফেলে, সত্যি, পারেনও আপনি!
কিছুক্ষণ চুপচাপ সময় কাটে। একসময় শালিনী জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
আকাশ তাকায় শালিনীর দিকে, করুন না।
– আপনি যেন কোথায় কাজ করেন, বলেছিলেন তো একদিন, ভুলে গেছি।
– এম অ্যান্ড কিউ অ্যাসোসিয়েটস আইটি লিমিটেডে।
– তাই হবে, শালিনী বলে, সেদিন এক ভদ্রলোক এসেছিলেন আমাদের অফিসে কিছু আউটসোর্সিংয়ের কাজে। তিনি তাদের কোম্পানির এমনি একটা নাম যেন বলেছিলেন।
সতর্ক হয় আকাশ। বলে, ঠিক এই নামটাই কি বলেছিলেন তিনি?
হতে পারে, আবার নাও হতে পারে, ঠিক মনে নেই, ক্যাজুয়ালি উত্তর দেয় শালিনী।
– আচ্ছা ছাড়ুন তো এসব, বরং এক কাপ কফি নেওয়া যাক, অসুবিধা নেই তো।
– অসুবিধা থাকলেও শুনছে কে? হাসতে হাসতে বলে আকাশ, এখন কিন্তু লেডিস ফার্স্ট নয়, আপনি বসুন, আমি আনছি। আকাশ উঠে কফি আনতে চলে যায়।
শালিনী বসে বসে আকাশের চলে যাওয়া দেখতে থাকে। মানুষটা বড় অদ্ভুত তো …
কখনো কখনো শালিনীর কেন যেন খুব একা একা লাগে। সময়-অসময়ে এরকম কেন লাগে, কে জানে। ও আনমনে একসময় নিচের দিকে তাকায়।
সন্ধ্যার ছায়া ছায়া অন্ধকার কাছে-দূরের স্কাইস্ক্র্যাপারগুলিকে কেমন আলতোভাবে ঘিরে আছে। কখনো কখনো পেঁজা তুলোর মতো ভাসতে থাকা চলমান মেঘমালা আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
আসলে নিজের কিছু কথা আকাশকে কি এতদিনে জানানো উচিত ছিল? শালিনী ভাবে, আকাশ তো এখন ওর একজন বন্ধুর মতো হয়ে গেছে। কিন্তু তার বেশি কিছু কি? এই প্রশ্নটার উত্তর ঠিক এই মুহূর্তে দিতে পারবে কি শালিনী?
কফি নিয়ে ফিরে আসে আকাশ। শালিনী হাত বাড়িয়ে কফি নেয়। বলে, এটা তো আমার করার কথা ছিল। আপনি কেন করতে গেলেন?
– এই প্রশ্নের উত্তর এখন দেবো না, মৃদু হেসে বলে আকাশ, কারণ সব কথা সব সময় আপনাকে বলা যাবে না।
– এর মধ্যে আবার গোপন আছে নাকি কিছু?
– আছে তো, আকাশ বলে, আমাদের সব কথা কি আমরা সবাইকে বলি? তাছাড়া, আপনি এখানে আর কতদিন
থাকবেন, বছরখানেকের বেশি তো নয়। বলছিলেন তো কবে যেন, তিন বছরের কন্ট্রাক্টে এসেছেন।
– এতসব আপনি মনে রেখেছেন? শালিনী অবাক হয়ে তাকায় আকাশের দিকে, আমি তো কন্ট্রাক্ট এক্সটেনশনও করতে পারি।
– কেন, দেশে যেতে মন চায় না? তারপর তেমন কেউ যদি … বলতে বলতে থেমে যায় আকাশ।
ভ্রু কুঁচকে আকাশের মুখের দিকে সোজাসুজি তাকায় শালিনী।
– সরি, কিছু মনে করবেন না, প্লিজ, আমি কিন্তু সত্যি কিছু ভেবে বলিনি। আকাশ দৃষ্টি নামিয়ে আনে নিচের দিকে।
শালিনী কোনো কথা বলে না। বেশ কিছুটা সময় চুপচাপ থাকে দুজনেই।
একসময় আকাশ বলে, এবার বোধহয় ফেরার সময় হলো, যাবেন না?
শালিনী উঠে দাঁড়ায়, হ্যাঁ, তাই তো, চলুন, সত্যিই দেরি হয়ে গেল …
আকাশ দাঁড়িয়ে শালিনীর দিকে তাকিয়ে বলে, কদিন ধরে ভাবছি, আপনাকে আমার কিছু কথা বলা উচিত, বলি বলি করে আর বলা হয়ে ওঠেনি।
– কী কথা ? বলুন না।
– এখন থাক, আকাশ বলে, আরেকদিন বলব।
যখন ফেরার জন্য নেমে আসে ওরা, তখন কিছু মনে হয়নি, এমনকি যখন ঘরে ফিরে এসেছে, তখনো আকাশের কথাটা তেমনভাবে ভাবার মতো কিছু মনে হয়নি শালিনীর। কিন্তু ফিরে এসে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে একসময় যখন শুতে গেছে তখন ঠিক মনে হয়েছে, কী এমন কথা আছে আকাশের, যা বলার জন্য সে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাহলে কি ওর নিজের কোনো গোপন কথা আছে, যে-কথা শালিনীকে না বলা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছে না। কী এমন কথা?
ভালোমন্দ কত রকম কথা যে মনের মধ্যে ঘুরেফিরে চলে আসছে। অস্থির হয়ে ওঠে শালিনী। রাত গভীর হতে থাকে কিন্তু ঘুম আসে না।
একসময় হঠাৎ করে ওর অজান্তেই যেন নিখিলের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। যদিও এতদিন পরে নিখিল ভরদ্বাজ নামের মানুষটিকে আর মনে রাখতে চাইছে না। ব্যাঙ্গালোরে একসঙ্গে কাজ করার সময় কীভাবে যেন চমৎকার চেহারার অবাঙালি এই মানুষটি ওর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল।
প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনি, কিন্তু পরে যখন বুঝেছে তখন দুটি মানুষের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে বেশ কিছু অসংগতি ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু তারপরও বাঙালি মেয়েরা যেমন হয়, কষ্ট হলেও সবকিছু মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে, শালিনীও করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়েছিল। সম্পর্কটা আর টিকিয়ে রাখতে পারেনি।
জীবনের শুরুতে যার কাছে সে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল, সে-ই তাকে সবচাইতে বড় আঘাতটা দিয়ে একসময় চলে গেছে। কেন এমন হলো? এই প্রশ্নের উত্তর কোথাও পায়নি শালিনী।
ব্রেকআপের সেই সময়টা রীতিমতো দুঃসহ হয়ে উঠেছিল ওর জীবনে। তখন সে বারবার ভেবেছে, এই ভালো হলো, আর কখনো দেখা না হওয়াই বোধহয় ভালো।
অন্ধ নিষ্ঠুর ভালোবাসার ভিক্ষাপাত্র হাতে কাঙালিনীর মতো কখনো ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ানো সত্যিই বড় লজ্জার হবে। বরং জীবনপাত্রে আর যতটুকু ভালোবাসা অবশিষ্ট আছে সেটুকু থেকে যাক না কেন আগামীদিনগুলোর জন্য। যদি কেউ কখনো হাত পেতে নিতে আসে, তখন তাকে যেন শূন্য হাতে ফিরে যেতে না হয়।
এই সান্ত্বনাটুকু গোপনে বুকের মধ্যে লালন করে একসময় ইচ্ছা করেই যেন ব্যাঙ্গালোর ছেড়ে, এমনকি কলকাতার আত্মীয়স্বজন সবাইকে ছেড়ে এই দূর দেশে এসে নতুন করে জীবন শুরু করেছিল শালিনী। এটা ছিল ওর নিজের জন্য তখন যেন একরকম স্বেচ্ছানির্বাসন। আর তখন অন্য কিছু না ভেবে, কারো কথা না শুনে বরং ভাগ্যের দোহাই দিয়ে সেটাই সেদিন সে মেনে নিয়েছিল।
যদিও কলকাতায় সে ফিরে যেতে পারতো তার সেই পুরনো পেশা সাংবাদিকতায়। ভালো অফারও ছিল; কিন্তু গেল না। কারণ জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন মানুষের মতো সে আর ফিরতে চাইছিল না তার সেই অতিপরিচিত পুরনো শহরে।
ব্যাঙ্গালোরে আসার আগে বিজনেস ট্রিবিউন নামে একটি বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিকে ডেপুটি এডিটর হিসেবে কাজ করছিল শালিনী। আর সেই কাজ করার সুবাদে অনেক বড় বড় আইটি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গিয়েছিল তার। বছর দুয়েক পরে তেমনি একটি ব্যাঙ্গালোর বেইজড আইটি কোম্পানি ‘ইনফোটেক সলিউশনস লিমিটেড’ তাকে বেশ বড় একটা অফার দিলে শালিনী সেটা অ্যাকসেপ্ট করে ব্যাঙ্গালোরে চলে গিয়েছিল। মনের ভেতরে গোপন উদ্দেশ্য ছিল, করপোরেট ওয়ার্ল্ডে আরো উঁচুতে স্থান করে নেওয়া।
সেখানে সে কাজ শুরু করেছিল তাদের ‘ইনফরমেশন অ্যান্ড আউটসোর্সিং ম্যানেজমেন্ট’ ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর হিসেবে।
জয়েন করার পর থেকেই মনে মনে চাইছিল, একদিন সে এই কোম্পানির সিইও হবে। যদিও সে জানত, সেজন্য তাকে আরো অনেকটা পথ পেরোতে হবে। তবে তার জন্য তার কোনো ক্লান্তি বা দ্বিধা ছিল না। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো কই?
ভাগ্যের নিষ্ঠুর খেলায় একরকম পরাজিত হয়েই তাকে ব্যাঙ্গালোর ছেড়ে চলে আসতে হলো একেবারেই
অজানা-অচেনা এই হংকং নগরীতে। যেখানে শুরু হলো তার আরেক নতুন জীবন।
সেদিন আকাশের সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটানোর পর দু-তিনটা দিন আর বিনিদ্র রাত কেমন করে যেন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেল।
জীবনের সবটাই কেমন যেন অহেতুক মনে হচ্ছিল শালিনীর কাছে। অর্থবিত্ত, প্রতিপত্তি, প্রমোশন, আরো ওপরে ওঠার অসম প্রতিযোগিতা, দিনশেষে কী মূল্য আছে এসবের? যেখানে জীবন-যৌবন আর ভালোবাসার মূল্যই ফিকে হয়ে গেল, সবকিছুই বন্দি হয়ে রইল একটা অলীক ঘেরাটোপের মধ্যে!
এইসব চিন্তাভাবনার মধ্যে আজ একসময় যেন নিজের অজান্তেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে শালিনী।
বেশি রাতে ঘুমানোর জন্য পরদিন বেশ কিছুটা দেরিতেই ঘুম ভাঙে। তখন রাতের কিছুই মনে ছিল না। তাড়াহুড়া করে অফিসে চলে গিয়েছিল।
অফিসে আসতে আসতে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না। অফিসের কাজেও মন বসাতে পারছিল না। সারা শরীরজুড়ে কেমন একটা ক্লান্তির আবহ নিয়ে মনটা শুধু অস্থির অস্থির লাগছিল।
আজ তাই লাঞ্চের পরে ডিপার্টমেন্টাল হেডকে কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে অন্য কোথাও না গিয়ে সোজাসুজি ঘরে ফিরে এলো।
তিনদিনের দিন দুপুরের পরে ফোন এলো আকাশের, খুব কি ব্যস্ত ম্যাডাম, একটু সময় দেওয়া যাবে কি?
মনে মনে শালিনীও কেন যেন ভাবছিল আকাশের ফোন আসবে। তাই হলো।
ফোন তুলে তাই যতটা সম্ভব হালকা কণ্ঠে জানতে চাইল, কতটুকু সময় চাই? তারপর ভেতরের কষ্ট চেপে মৃদু কণ্ঠে বলে, আপনি ভালো আছেন তো?
– আছি আর কী, ভালো থাকার অন্তত চেষ্টা করি তো।
– এভাবে বলছেন কেন?
বুকের ভেতরে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপতে চাপতে আকাশ বলে, এসব কথা এখন থাক, কখনো সময় পেলে তখন বলা যাবে, এখন বরং বলুন ঘণ্টা তিনেক সময় দিতে পারবেন?
– কবে?
আকাশ বলে, যদি বলি আজকেই। ভাবছি একবার ‘ব্লু স্টার’-এ যাব। যাবেন, নাকি কোনো কাজের ব্যস্ততা আছে, গলাটা কেমন ভারী শোনাচ্ছে?
– না, তেমন কিছু নয়, এত ব্যস্ত হয়ে কী আর হবে? অসুবিধা নেই, আসব। বিকেলে ৫টার দিকে আসার চেষ্টা করব।
– ঠিক আছে। ফোন রাখে আকাশ। শালিনীর কথার মাঝে হঠাৎ যেন কেমন একটা হতাশার সুর টের পায়। কী জানি কী হয়েছে, তবে এসব নিয়ে ও মাথা ঘামাতে চায় না।
কাউলুনে মডি রোডের একটা পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ির চারতলার এক ফ্ল্যাটের একটা রুম নিয়ে থাকে আকাশ। সিলভিয়া নামে এক বুড়ির চার রুমের ওই ফ্ল্যাটের তিন রুমে সে নিজে থাকে তার এক মেয়েকে নিয়ে। বাকি একটা রুম ভাড়া দিয়েছে আকাশকে।
সেখান থেকে বে পেরিয়ে ভিক্টোরিয়ায় আসতে কিছুটা বেশি সময় লাগে বলে আকাশ একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়ে।
শালিনী থাকে ভিক্টোরিয়াতেই, অফিসের কাছাকাছি একটা ডরমিটরিতে। সেখান থেকে আসতে ওর খুব সময় লাগবে না।
ওপারে ‘ব্লু স্টার’ নামে একটা দোকান আছে, স্টার ফেরি টার্মিনালের কাছে, সেখানে নানা ধরনের জিনিস পাওয়া যায়। গত কয়েক দিন এখানে বেশ কয়েকবার আসা-যাওয়ার জন্য কিছুটা মুখচেনা হয়ে গেছে মেরি নামে একটা সেলসগার্ল। কোনো কিছু কিনতে গেলে তার সঙ্গে একটু-আধটু কথা হয়। তার কাছে কাছাকাছি কোনো ঘটনা ঘটলে তার খোঁজখবর পাওয়া যায়।
দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ও আছে এই হংকংয়ে, তাই বেশিরভাগ এলাকাই ওর মোটামুটি চেনা। আশপাশে কোনো ছোটখাটো ঘটনা ঘটলে কথাচ্ছলে ও বলে দেয়।
তবে এবার এসে যেটা শুনলো, তাতে রীতিমতো চমকে উঠলো আকাশ। বুকের ভেতর একটু ভয়ের কম্পনও যেন টের পেল।
দিন তিনেক আগে যেদিন শালিনীর সঙ্গে দেখা করতে এদিকে এসেছিল, সেদিনও ‘ব্লু স্টারে’ ঢুকেছিল একটা টুথপেস্ট কিনতে। সেদিন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মেরির সঙ্গে এটা-সেটা নিয়ে কথাও বলেছিল। তারপর চলে গিয়েছিল টার্মিনালের দিকে।
আজ মেরি জানালো, সেদিন ও চলে যাওয়ার পর কেউ একজন এসে ওর সম্পর্কে খোঁজখবর করছিল, কোথায় থাকে, কী করে ইত্যাদি জানতে চেয়েছিল।
মেরির বর্ণনা অনুসারে, তার পরনে ছিল নীল রঙের টি-শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট, মাথায় ছিল লাল রঙের ক্যাপ ও চোখে কালো চশমা। হাতে ছোট একটা ব্যাগ।
মেরি বলে, তবে তার কথা শুনে মনে হচ্ছিল লোকটা লোকাল নয়। এশিয়ান কোনো দেশের হবে। বেশ ধীরস্থিরভাবে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছিল। তবে বেশিক্ষণ এখানে থাকেনি। কিছু কেনেওনি, কিছু জিনিসপত্রের দরদাম করে চলে গেছে।
মেরি বলে, আই টোল্ড হিম, আই ডোন্ট নো মাচ অ্যাবাউট হিম, অনলি আই নো দ্যাট হি ইজ অ্যা টুরিস্ট, অর মে হ্যাভ সাম অফিসিয়াল ওয়ার্ক হিয়ার, দ্যাটস অল, নাথিং মোর …
বিষয়টা ওর কাছে খুব হালকা হলেও সবটা শোনার পর থেকে আকাশের কাছে রীতিমতো উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। মনের ভেতরে ধীরে ধীরে একটা অজানা আতঙ্ক দানা বেঁধে উঠছে।
এদিকে আজ আর দেরি হলো না, ৫টার কিছু পরপরই শালিনী চলে এলো হারবারের কাছে সেই ছোট্ট রেস্তোরাঁটিতে, যেখানে সাধারণত ওদের দেখা হয়। তারপর কোথাও যেতে হলে এখান থেকে যায়।
আজকে একটু ভিড় ছিল সেজন্য ভেতরে ঢুকে একটু দাঁড়িয়ে আকাশকে খুঁজতে হলো। পরে ডানদিকে একটু দূরে আকাশকে একটা টেবিলে বসা দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল শালিনী। তারপর চেয়ারে বসতে বসতে তাকালো ওর মুখের দিকে, কেমন আছেন?
– এই তো, চলে যাচ্ছে, এদিক-ওদিক একবার তাকিয়ে কেমন যেন খসখসে গলায় জবাব দেয় আকাশ, আপনি কেমন আছেন?
– ভালো না, শালিনী বলে, কেন যেন মনটা ভালো নেই। তারপর একটু থেমে আবার বলে, তবে। কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে; কিন্তু আপনাকে আজ কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে কেন?
শালিনীর কথার জবাব না দিয়ে আকাশ বলে, স্টার ফেরিতে ঘুরতে যাবেন?
– প্রস্তাবটা মন্দ নয়, যাওয়া যেতেই পারে, কিন্তু আমি তো ভাবছিলাম পিক মার্কেট কিংবা দোতলা পিকট্রামে ঘোরার কথা বলবেন।
– তাও চলতে পারে।
– না, শালিনী বলে, আজ না হয় স্থল ছেড়ে জলেই ঘোরা হলো, তাছাড়া আপনি যখন আগে থেকেই ভেবে রেখেছেন, তখন আপনার কথাই মেনে নিলাম। আরেকটা কথা কি জানেন, আসলে ‘স্টার ফেরি’তে ঘোরার বিষয়টা আমার মাথায়ই ছিল না। ঠিক আছে, সব মিলিয়ে ভালোই লাগবে, চলুন।
এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আসলে ভুল হলো কি না কে জানে, ভাবে আকাশ, একটু পরে অন্ধকার হয়ে যাবে, চারদিকে অনেক আলো থাকলেও দিনের মতো সবকিছু অতটা পরিষ্কার দেখা যাবে না, তাহলে ফেরিতে যাওয়া রিস্কি হয়ে যাবে না তো!
আসার সময় মেরির কাছে সেই অচেনা মানুষটার কথা শুনে রীতিমতো অস্বস্তিতে আছে আকাশ। অচেনা স্থান আর অপরিচিত পরিবেশে ধীরে ধীরে দুশ্চিন্তাটা রূপ নিচ্ছে আতঙ্কে। এখন এই পরিবেশে কী করা উচিত, এই মুহূর্তে ঠিক বুঝতে পারছে না আকাশ।
– কই চলুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে তো, দাঁড়িয়ে তাড়া দেয় শালিনী।
না, এখন আর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার সুযোগ নেই। আকাশ ভাগ্যের ওপরই ছেড়ে দেয় সবকিছু। তারপর, ঠিক আছে, বলে আশপাশে তাকিয়ে একটা ক্যাব খুঁজতে থাকে।
– এটুকু পথ না হয় হেঁটেই চলে যাই, বলে শালিনী সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
আকাশ একটু থমকে দাঁড়ায়। চারদিকে একবার দেখে নেয়, কেউ কোথাও থেকে ওদেরকে এখন বিশেষভাবে লক্ষ করছে কি না।
চারদিকে প্রচুর লোকের আনাগোনা। কিন্তু কোথাও তেমন সন্দেহজনক কাউকে মনে হলো না, লাল ক্যাপ মাথায় কাউকে দেখাও গেল না। তবু মনের ভেতর থেকে অজানা ভয়ের রেশ যেন কাটছে না।
মিনিট বিশেক পরে দুজনে টিকিট নিয়ে উঠে আসে ফেরিতে। টার্মিনাল পেরিয়ে ফেরিতে ওঠার সময় আকাশ চারদিকটা আর একবার দেখার চেষ্টা করে। আর ঠিক তখনই ঘটে বিপত্তি। কিছু দূরে বাঁদিকে টার্মিনালের উপরেই মাথায় লাল ক্যাপ পরা একজনকে দেখে আকাশ রীতিমতো চমকে ওঠে। সে আকাশকে দেখতে পেয়েছে কি না ঠিক বোঝা গেল না। যদিও এদিকে মুখ করেই সে অন্য আরেকজনের সঙ্গে কথা বলছিল।
শালিনী ততক্ষণে ফেরিতে উঠে গেছে। মিনিট দুয়েক পরে আকাশ উঠলো; কিন্তু মনের দ্বিধাটা গেল না। তাহলে কি ওরা ওর হদিস পেয়ে গেছে? তারপর কিলার পাঠিয়েছে? আর সে-ই কি ওকে ফলো করে যাচ্ছে, সুযোগ খুঁজছে হিট করার উপযুক্ত সময়ের? এসব প্রশ্নের উত্তর এই মুহূর্তে ঠিক পাওয়া যাচ্ছে না।
একসময় আকাশ লক্ষ করে, শালিনী ওর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
আকাশ চোখ ফেরাতেই বলে ওঠে, আপনার আজ হয়েছে কী বলুন তো?
– কেন, কী হবে আবার? আকাশ একটু হাসার চেষ্টা করে, নতুন কী দেখলেন?
– আসলে কী যেন হয়েছে আপনার, শালিনী বলে, দেখা হওয়ার পর থেকেই দেখছি, আপনি কী নিয়ে যেন গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করছেন। আমাকে বলবেন, কী হয়েছে? একসময় তো বলেছিলেন কী যেন কথা বলার আছে, এখন বলবেন?
আকাশ কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ শুধু অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর একসময় যেন নিজে নিজেই বলে ওঠে, জানি না, আর কোনোদিন সেসব কথা বলার আর সময় পাব কি না!
বলতে বলতে আকাশ রেলিংয়ের পাশে সরে আসে। তারপর মুখ ঘুরিয়ে একমনে দূরের রং-বেরঙের আলোতে উজ্জ্বল ঘরবাড়ি আর নিওন সাইনগুলো দেখতে থাকে। আসলে আকাশ দেখছিল আশপাশের মানুষগুলোকে, বিশেষ করে যারা না বসে পকেটে হাত ঢুকিয়ে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছিল।
পকেটের ভেতরে নয়, আকাশ তার পিস্তলটা রেখেছিল কোমরে গুঁজে, পেছনদিকে। যাতে হাত ঘুরিয়ে যখন-তখন তুলে নিতে সুবিধা হয়। আগে দেশে থাকতে এভাবেই সে কারো কন্ট্রাক্ট নিয়ে কাজে গেছে। পুরনো অভ্যাসটাই রয়ে গেছে।
ঘণ্টা দুয়েকের ট্রিপ। স্বাভাবিক গতিতে চলছে ফেরি। ফেরির ভেতরে প্যাসেঞ্জার ডেকের আলো কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে বাইরের হারবারে চলমান জলযান এবং নানা রঙের আলোকসজ্জায় সজ্জিত দূরবর্তী স্কাইস্ক্র্যাপার, ভিক্টোরিয়া পিক, বড় বড় মলসহ 888sport app স্থাপনা আর রাতের আলো-আঁধারিতে আদিগন্ত জুড়ে থাকা বিশাল স্কাইলাইন ভালোভাবে দেখা যায়।
আকাশের মনটা কেন জানি অজানা আতঙ্কে ভারি হয়ে আছে। বারবার শুধু বাড়ির কথা, বাবা-মার কথা, বন্ধুবান্ধবদের মুখ মনে পড়ছে। কতদিন দেখা হয়নি ওদের সঙ্গে। কোনো খবরাখবরও নেই। ভাবতে ভাবতে একসময় একটা দীর্ঘশ্বাস বুক কাঁপিয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে। চারদিকে এত আলোর ঝলকানি, সব যেন কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে।
আকাশ তাকায় শালিনীর দিকে। ও চুপচাপ বসে আছে বাইরের দিকে তাকিয়ে। কিছু আগে আকাশের বলা কথায় হয়তো কিছু মনে করেছে। তাই চুপ করে বসে আছে। কথা বলে আকাশকে বিরক্ত করতে চাইছে না।
কিন্তু কীভাবে সে তার নিজের ভয়ংকর জীবনের কথা বলবে শালিনীকে? কীভাবে বলবে যে, সে এখন এক পলাতক খুনির জীবনযাপন করছে এখানে, এইভাবে, আর তার মাথার ওপরে ঝুলছে যেমন আইনের খড়গ, সেইসঙ্গে প্রতিপক্ষের মৃত্যুপরোয়ানা?
না, আজকে না, আজ কোনোভাবেই শালিনীকে এসব কথা বলা যাবে না। ওর মনটাও আজকে ভালো নেই, এসেই তো তেমনি কিছু বলছিল যেন।
বসে বসে অনেকটা আনমনে এইসব ভাবছিল আকাশ আর ঠিক তখনই ওর ভেতরে কেউ যেন হঠাৎ ওকে সতর্ক করে দিয়ে বলে উঠলো, সাবধান!
অভ্যাসবশতই চট করে উঠে দাঁড়ালো আকাশ। তারপর চারদিকে একবার ভালো করে দেখতে গিয়েই ফেরির পেছনদিকে আরেকজনের সঙ্গে পরনে নীল জিন্স প্যান্ট, মাথায় লাল ক্যাপওয়ালা সেই অচেনা মানুষটাকে ঠিক দেখতে পেল। সেই সঙ্গে আরো দেখল, ওরাও তাকিয়ে আছে যেন ওর দিকেই।
এখন পরিষ্কার বোঝা গেল, কোনো ভুল নেই, আগে থেকেই ওকে ফলো করে এতদূর চলে এসেছে ওই লাল ক্যাপওয়ালা এবং তার সঙ্গী।
ওদেরকে দেখামাত্রই নিজের অজান্তেই যেন আকাশের হাত চলে যায় কোমরে গোঁজা পিস্তলের বাঁটে। তবে ও জানে, জলের উপর চলন্ত ফেরিতে ওরা কিছু করতে আসবে না। তাহলে? তাদের টার্গেট হবে কি ফেরি থামলে, নাকি ফেরার পথে কোথাও? কারণ ওরা দেখেছে ওর সঙ্গে শালিনী রয়েছে।
এর মধ্যেও শালিনীর জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল আকাশ। কিছু না জেনেশুনে অহেতুক বিপদে জড়িয়ে গেল মেয়েটা! ও আরো ভাবে, এখন এত কেন চিন্তা হচ্ছে ওর জন্য? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আকাশের মনে হয়, তাহলে কি ওর জন্য মনের ভেতরে কোথাও এতদিনে কিছুটা দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে? কিন্তু এমন তো কখনো মনে হয়নি! তবে এসব চিন্তাভাবনা করার সময় এটা নয়।
আকাশ তীক্ষè দৃষ্টিতে একবার তাকায় চারদিকে। সব মিলিয়ে আশপাশের অবস্থাটা বুঝে নিতে চেষ্টা করে।
আকাশকে হঠাৎ উঠে দাঁড়াতে দেখে শালিনী চমকে তাকায় ওর দিকে। কপালে ভাঁজ, ভ্রুতে প্রশ্নবোধক চিহ্ন, কী হলো?
– তেমন কিছু নয়, বসতে বসতে আকাশ বলে, চুপচাপ শান্ত হয়ে বসে থাকুন। আপাতত একটা ঝামেলা হচ্ছে। তবে সেটা আপনার জন্য কিছু নয়। ভয় পাবেন না।
ইতোমধ্যে ভেতরের আলো বাড়তে শুরু করেছে। অর্থাৎ ট্রিপ শেষ। এবার ফিরে গিয়ে যাত্রীদের নেমে যাওয়ার পালা।
কিছুক্ষণ পরেই টার্মিনালে চলে আসে ফেরি। এবার নামতে হবে।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় আকাশ। শালিনীও ওঠে। কিন্তু কেন যেন কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে।
শালিনীর দিকে তাকিয়ে কী ভেবে হঠাৎ ওর একটা হাত নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে নেয় আকাশ। বলে, চলুন এবার; কিন্তু একটু পরেই হাতটা ছেড়ে দিয়ে নিজের হাতের ছোট প্যাকেটটা ওর হাতে দিয়ে বলে, এটা বরং আপনি একটু রাখুন।
দুজনে ভিড়ের মধ্যে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। সামনে তাকায় আকাশ, না, মাথায় লাল ক্যাপওয়ালাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। তার সঙ্গীকেও না। ভিড়ের মধ্যে নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে আছে। সতর্ক হয় আকাশ। ভেতরে উত্তেজনা বাড়ছে।
চলমান ভিড়ের মধ্যে একটু থেমে শালিনীর দিকে একটু ঝুঁকে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, ঠিক এই মুহূর্তে একটা বড় ধরনের সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমরা। যদিও ব্যাপারটা আমার, আপনার কিছু নয়। কিন্তু আপনি ঝামেলায় জড়িয়েছেন আমার সঙ্গে থাকার জন্য।
– মানে! রীতিমতো চমকে ওঠে শালিনী, বলছেন কী …
– থামবেন না, চলতে থাকুন, সাবধানে চারদিকে লক্ষ রাখুন। মনে হচ্ছে, আমাদের কেউ ফলো করছে। সম্ভবত তারা আমাদের কাছাকাছিই আছে।
– কেন ফলো করছে?
শালিনীর প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বরং ওর একটা হাত মুঠো করে ধরে একপাশে টেনে নিয়ে আকাশ বলে, আমি যা বলছি একটু মনোযোগ দিয়ে শুনুন, বাইরে বেরিয়ে গিয়ে আমার দিকে আর না তাকিয়ে সোজা বড় রাস্তার দিকে চলে যেতে থাকবেন। একবারও পেছনে তাকাবেন না। এখন নয়, পরে সবকিছু বলব।
আকাশের কথা শুনতে শুনতে হতবাক, কিছুটা ভীত শালিনী সামনের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে।
কোথায় কী হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারে না।
বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার গেটে আসার একটু আগেই শালিনীর হাত ছেড়ে দেয় আকাশ। নিচে নামানো হাতে উঠে আসে পিস্তল। দ্রুত চারদিকে একবার তাকায়।
– আপনি ডানদিক দিয়ে চলে যান, পেছনে তাকাবেন না, বলতে বলতে আকাশ দ্রুত বাঁদিকে দাঁড়ানো কয়েকজন মানুষের পাশ দিয়ে থেমে থাকা একটা জিপের পেছন দিকে চলে যায়।
আর ঠিক তখনই উল্টো দিক থেকে একটা গুলির শব্দ পাওয়া যায়। একটু পরে কিছু মানুষের দৌড়ে যাওয়া পায়ের শব্দের সঙ্গে কিছুটা দূর থেকে আরো দুটো গুলির শব্দ ভেসে আসে। হঠাৎ গুলির শব্দে টার্মিনাল জুড়ে মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্য বেড়ে যায়।
অন্য যাত্রীদের সঙ্গে শালিনী দ্রুতপায়ে কিছুটা দূরে এসে নিজের অজান্তেই একবার থমকে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে তাকায়, কিন্তু আধো অন্ধকারে বেশ কিছু মানুষের দ্রুত চলাফেরা ছাড়া তেমন কিছুই দেখতে পায় না।
ওদিকে যে কী হচ্ছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। তবু বেশ খানিকটা সময় ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। যদি আকাশ ফিরে আসে; কিন্তু সে আসে না। একসময় বড় রাস্তায় চলে আসে শালিনী। একটু পরেই কিছু দূরে শুনতে পায় পুলিশের গাড়ির সাইরেন।
বড় রাস্তায় এসেও বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত ঘরে ফিরে আসে শালিনী। কিন্তু ঘরে ফেরার পরও অনেকটা সময় যেন ঘোরের মধ্যে কেটে যায়। আকাশ এবং কিছু আগে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনাগুলির সঙ্গে কোনো কিছুই যেন মেলাতে পারে না।
গেট দিয়ে বেরোনোর আগে এক মুহূর্তের জন্য হলেও আকাশের হাতের পিস্তলটা দেখে ফেলেছিল শালিনী। তাহলে কি আকাশকে যেমন সে দেখছে, তেমন সে নয়? সে কি আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ? একসময়ের দক্ষ সাংবাদিক শালিনীর চোখকেও কি চমৎকারভাবে ফাঁকি দিয়ে নিজের আসল চেহারা লুকিয়ে রেখেছিল আকাশ!
এটা ভাবতে গিয়েই রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে ওঠে শালিনী। কিন্তু তারপরও নিজের অজান্তেই এখন কেন ও আকাশের জন্য দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠছে? চোখের ভেতরে কেন টের পাচ্ছে অশ্রুর আভাস।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.