শঙ্করলাল ভট্টাচার্য
দ্বিতীয় কিস্তি
তিন
ডাবল ডায়মন্ড, থ্রি অফ স্পেডস, জ্যাক অফ ক্লাবস, কুইন অফ হার্টস, ট্রাম্প…
মারি অাঁতোয়ানেত নিজের মনে তাস ছাড়াই ব্রিজ খেলে যাচ্ছেন। থেকে থেকে উঠে গিয়ে চিঠি লিখতে বসছেন। ডিয়ার স্যার… মাই ডিয়ার… ইয়োর অনারেবল স্যার… ম্যাডাম… ডিয়ারেস্ট… চিঠিরও শেষ নেই, রাগে জ্বলছে সেসব চিঠি… কিন্তু অভিযোগ একটাই… ভিক্টর আমার মেয়েটাকে খুন করেছে…
বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু বিশ্বাস করতেই হবে, যেহেতু এই মৃত্যুটা আকাশ থেকে পড়েনি। মনে করছি এটা অমৃতার জঠর থেকে উৎপন্ন হয়েছে, যে-জঠরে বীজও বপন করেছে ভিক্টর। যে আমার দূরের কেউ নয়, কিন্তু আমার কন্যার স্বামী হওয়ার নৈকট্য আমি কোনোকালেও পছন্দ করিনি। শুধু পাগলের মতো জেদ ধরেছিল অমরি, অসম্ভব জেদ এবং আমার প্রতি আক্রোশ। তাই যেদিন বুদাপেস্তে ওরা বিয়ে করল, আমি জানতাম শের-গিল পরিবারে একটা ফাঁড়া পড়ল, কারণ যতই আমার পক্ষপাতিত্ব থাক ইন্দুর প্রতি, অমৃতাই ছিল আমাদের বিশ্বের কেন্দ্র। তাই ওর এই বিয়ে একটা অমঙ্গলের বার্তা বয়ে এনেছিল, যার একমাত্র পরিণতি হতে পারত বিচ্ছেদ অথবা মৃত্যু। এবং যেহেতু অমৃতার কাজে রঙই ছিল প্রধান আশ্রয় তাই আমি অনুমান করতে পারছিলাম, ও লড়াই করে যাচ্ছিল যাতে ওর জীবন বিবর্ণ হয়ে না পড়ে, পড়লেও কী হতে পারত তোমরা তা দেখতেই পেলে; ভিক্টর ওকে অন্তঃসত্ত্বা করল। পরে সেই ভ্রূণ নিকেশ করল নিজের হাতে, তাও যদি কাজটা জানত! সব ডাক্তার সব রোগের ডাক্তারি জানে না, অ্যাবরশনের অ আ ক খ ও কবে জানল আমি জানি না, তবে অমরিকে মারার মতো বিদ্যে নিশ্চয়ই হয়েছিল। না মেনে উপায় নেই খুবই পাকা হাত, না হলে ২ ডিসেম্বর যে-মেয়ে অত হাসিখুশি, সে ৫ তারিখে শেষ হয়ে গেল! ডিসেন্ট্রি কি এতই ভয়ঙ্কর যে ধরল আর মারল… আমি মানব না, মানতে পারছি না, শুধু খুনই এই মৃত্যুর ব্যাখ্যা জোগাতে পারে, একমাত্র ব্যাখ্যা, যে-খুন অবহেলা থেকে ঘটেনি, মেপেজোকে, পৃথিবীকে না জানিয়ে, ঘরের নির্জনে নির্মমভাবে সেরে ফেলা, কেউ কোথাও জানল না, কাউকে খবর করা হলো না। ডক্টর জেকিলই মিস্টার হাইড হয়ে অত সুন্দর একটা প্রাণকে নিশ্চিহ্ন করে দিলো, যে-জন্য আজ একটাই প্রশ্ন তাড়া করছে আমাকে, পৃথিবীতে ন্যায়বিচার বলে কি কিছু নেই? নিজের স্ত্রীর জীবন নিয়ে এই খেলা যে খেলে তাকে মৃত্যুর দূত ছাড়া আর কী বলব বলো, যদিও সব মৃত্যুই তো আর খুন নয়, খুন হলো ভয়ঙ্করতম, নৃশংসতম, অক্ষমনীয় মৃত্যু… এই মৃত্যুর জন্য আমরা কেউই তৈরি ছিলাম না, এই মৃত্যু ডেকে আনবে আরো মৃত্যু। লাহোরে অমরির ওই ঘর থেকে একটা রক্তের ধারা আমি বইতে দেখছি, যা চৌকাঠ ডিঙিয়ে সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় নেমে আমার পিছন পিছন চলে এসেছে দিল্লিতে ইন্দুর বাড়ি অবধি, এরপর খুব শিগগির পাহাড় বেয়ে সিমলা পর্যন্ত যাবে, বাগানের সব ফুলকে লাল করে দিয়ে উঠে আসবে আমার গলা অবধি… তারপর…
মারি অাঁতোয়ানেত চিঠির পাতাগুলো সরিয়ে রেখে বড় আয়নার সামনে দিভানটায় গিয়ে বসলেন। আয়নায় প্রতিফলিত মূর্তিটাকে নিজের প্রেতাত্মা বলে মনে হলো। কে রেখেছিল অত ঐতিহাসিক একটা নাম? মা… রি… অাঁ… তো… য়া… নে… ত! ষোড়শ লুইয়ের ওই মাথামোটা বউ। গরিবের মিছিল যখন রুটির দাবিতে প্রাসাদে এসে হামলে পড়েছে তখন কী বলল? রুটি নেই তো কী? কেক খাক।
আমাকে সুন্দরী না মেনে উপায় ছিল না। তা বলে মারি অাঁতোয়ানেত? যাকে ঘটা করে গিলোটিনে কতল করা হলো। প্যারিসে থাকতে ওই প্লাস দ্য লা কঁকর্দের পাশ দিয়ে গেলে আমি মনে মনে দেখতাম গিলোটিনে চড়ছি। আর কাটা যাবার পর বালতিতে করে আমার মুন্ডু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শঁজেলিজে গা বেয়ে ছড়ানো রু দ্য বাসানোয় আমাদের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। আমার ধড়ের সঙ্গে মুন্ডু জুড়ে সাজিয়ে বসানো হচ্ছে সোফায়। তারপর সেই অবস্থায় আমার ছবি তুলছে উমরাও। সোফায় এলিয়ে মারি অাঁতোয়ানেত দেখছে মারি অাঁতোয়ানেতকে দেওয়ালজোড়া আয়নায়। ঠিক এখন যেমন আয়নায় নিজের প্রেতাত্মার সামনে বসেছি আমি…
কিন্তু প্রেতাত্মার হাতে ওটা কী? একমুঠো ঘুমের বড়ি। যে-ঘুম এলে সব দিন, সব রাত এক হয়ে যায়। যে-ঘুম নিদ্রা আর জাগরণকে এক করে দেয়। যে-ঘুম নামলে সত্য ও মিথ্যে একাকার হয়ে যায়। যে-ঘুম ঘটলে মানুষ ছবি হয়ে যায়। অমরি অবশ্য বলত, একটা সার্থক ছবি হলো সত্য ও কল্পনার সঙ্গম। যেখানে মিথ্যে নেই।
আমি দেখছি মারি অাঁতোয়ানেতের প্রেতাত্মা গেলাসের জলে ঘুমের বড়িগুলো টপটপ করে ফেলল। তারপর ঠোঁটে গেলাস তুলে… আহ্! নিজের মৃত্যু নির্বাচন করতে পারলে কী প্রয়োজন ডাক্তারের! হোক না সে নিজের নির্বাচিত পুরুষ। হায়, এই সামান্য ভুলটাই করল আমার অমরি!
গেলাসের জলে চুমুক দিতে দিতেই ঘুমিয়ে পড়লেন মারি অাঁতোয়ানেত। উমরাও সিংহ এসে বারকয়েক ডেকে সাড়া পেলেন না। নাড়ি টিপে বুঝলেন ঘুম আর মৃত্যুর মাঝখানে কোথাও ঝুলে আছে ও।
উমরাও ডাক্তার ডাকতে গেলেন।
ডাক্তার নিয়ে ফিরতে ফিরতে মনে পড়ল গিন্নির প্রথম আত্মহত্যার চেষ্টার পর ওর প্রাণ বাঁচিয়েছিল ভিক্টর। যার ডাক্তারি বিদ্যেবুদ্ধি নিয়ে এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য ওর। এবার অন্তত জ্ঞান ফিরলে, যদি ফেরে, ওকে ভিক্টরের মুখ দেখতে হবে না।
জ্ঞান ফেরানোর পর ওকে ফের ঘুম পাড়ানো হলো।
মারি ঘুমিয়ে, টেবিলে ছড়ানো চিঠিগুলোয় একবার চোখ বুলোনোর দায়িত্ব বোধ করলেন উমরাও। কাল বা পরশুর মধ্যে চিঠিগুলো ঠিকানামতো পৌঁছলে একটা বড়সড় কেলেঙ্কারি বাধবে। ভিক্টরকে লাহোর, দিল্লি, সিমলা, সারায়াতে অমৃতার খুনি বলে ধরে নেবে। একটা সময় ছিল, বাজারে পা রাখার জো ছিল না, অমৃতা নতুন কার সঙ্গে শুচ্ছে সেই চর্চার চোটে। একটা চিঠিতে ক্ষোভও করেছিল অমরি তাই নিয়ে। লিখেছিল, তোমার অন্তত একটা নিশ্চিন্তি এখন : তোমার মেয়ে এখন বৈধভাবে কারো সঙ্গে শয্যাগত হচ্ছে!
উমরাও যেসব চিঠি লিখেছেন মেয়েকে দীর্ঘদিন তার মধ্যেও এত নির্মমতা, দূরত্ব ও ভদ্রবেশী রাগ এসে পড়ত কেন? পৃথিবীর কেউ টের না পেলেও অমরি বুঝে যেত, এ হলো পিতার প্রেম ও অভিমান। অমরিও তার দুরন্ত জবাব দিত জেদ, ভিক্টরস্ত্ততি ও পিতার অনুভূতিকে অবহেলা দিয়ে। ভিক্টরের প্রতি ওর মার বিরূপতা বাবা-মেয়ের মধ্যে একটা গরলের নদী তৈরি করে রেখেছিল। সাঁতরে পার হওয়া দূরস্থান, তাতে পায়ের কড়ে আঙুল ডোবানোরও জো ছিল না। চিঠি ও চিঠির জবাব মনের দূরত্বগুলো আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল। বরং শাশুড়ির সমস্ত গালমন্দ সহ্য করেও শ্বশুরকে লেখা চিঠিতে ভিক্টর কিন্তু থেকে গেছে সংযত, ভদ্র।
টেবিলের এইসব চিঠি জায়গামতো পৌঁছলে ভিক্টরের কি আর এদেশে ডাক্তারি করে খাওয়া জুটবে? না, অমৃতা শের-গিলের এদেশে থাকার অনুমতি? গুজবই তো এদেশের সবচেয়ে বড় লোকগীতি।
চিঠি যেখানে-যা ছিল সাজিয়ে রেখে উমরাও নিজের লেখার টেবিলে ফিরে গিয়ে স্ত্রীকে লেখা একজনের একটা শোকবার্তা পড়তে বসলেন। মারি কি এ-চিঠির কোনো উত্তর পাঠিয়েছে? যদি পাঠিয়ে না থাকে ভালোই করেছে। কে জানে এই উন্মাদিনী অবস্থায় কী লিখতে কী লিখে বসবে।
শোকবার্তাটা দুবার পড়া হয়ে গেছে আগে, তবু আরেকবার পড়ার ইচ্ছে হলো। কিন্তু তার আগে দেওয়ান চমনলালকে একটা দরকারি কথা জানানো দরকার। উমরাও লিখতে বসলেন…
বেচারি ভিক্টরের সারায়া হাসপাতালে শান্তিতে কাজ করতে পারাটা জরুরি। কাজের মধ্যে ডুবতে না পারলে খুব সমস্যা ওর। অমৃতাকে হারিয়ে গুমরে গুমরে শেষই হয়ে যাবে। ওর ওই চুপ মেরে থাকাটাকেই যত ভয় আমার। ও কাজের আর বন্ধুর অভাবে থাকলে অমৃতার শান্তি নেই। আমাদেরও না।
তবে আরেকটা দরকারি কথা। শহরের গুজবকলে কান দেবেন না। আপনার মুখে যা শুনলাম সেদিন আর আমার স্ত্রীর যা-চিঠিপত্তর যাচ্ছে লোকজনের কাছে, তাতে ভিক্টর তো ড্রাকুলা হয়ে যাচ্ছে। ওসব দয়া করে কানে নেবেন না, আমার গিন্নির শক কাটেনি, যা পারছে বলছে। চিকিৎসায় অবহেলা নিশ্চয়ই হয়েছে, তা বলে খুন? বিনিদ্র রজনীর পর বিনিদ্র রজনী… দুঃস্বপ্নের কারাগারে আছে মারি। অকল্পনীয় কল্পনা তখন ভর করে মনে। ও তাই অমৃতার খুন দেখছে সারাক্ষণ। আমাদের দেখতে হবে ওর মনের অবস্থাটা।
চিঠি শেষ করে উমরাও সিংহ অনেকক্ষণ জানালার বাইরে পাহাড়ের দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে রইলেন। আগামীকাল, ২১ ডিসেম্বর, ১৯৪১, অমৃতার প্রদর্শনীর উদ্বোধন হবে লাহোরে। পাঞ্জাব লিটেরারি লিগ হলে। উমরাওয়ের একটা অদ্ভুত বিশ্বাস জন্মাল, প্রদর্শনীতে কোনো না কোনো বেশে বা ছদ্মবেশে, মানুষ অথবা ছবি হয়ে, আত্মায় বা রক্তমাংসে, সত্য এবং কল্পনায় অমৃতা পৌঁছে যাবে। এ তো প্রদর্শনী নয়, এ যে ‘অমৃতা পুনর্গ্রহণ’।
অদ্ভুত একটা শান্তি এলো উমরাও সিংহ শের-গিলের মনে। অমৃতার মৃত্যুর তারবার্তা পাবার পর এই প্রথম। উনি ইলাহাবাদের আনন্দ ভবন থেকে পাঠানো চিঠিটা পড়া ধরলেন।
প্রিয় শ্রীমতী শের-গিল,
বিগত পাঁচ বছরে বারছয়েক দেখা হয়েছে অমৃতার সঙ্গে, দীর্ঘ ব্যবধানের পরপর। তবে প্রথম যেদিন সাক্ষাৎ হয় সেদিনই ওর প্রতিভা ও লাবণ্যে চমকে গেছি। খুব আকর্ষণ বোধ করে আমরা বন্ধু হয়ে গেছিলাম। মনে হয়েছিল ভারতের পক্ষে খুব দামি ও, তাই ওর প্রতিভার বিকাশের প্রতি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম কিছুদিনের জন্য ছুটি কাটাতে ও ইলাহাবাদ আসবে। ও-ও প্রায় সেরকম কথা দিয়েছিল।
এইসব 888sport sign up bonusই এখন অতীত। ওর অকালমৃত্যুর কথা শুনে যে কী আঘাত ও দুঃখ পেয়েছি তা বলার শক্তি নেই। ওর তরুণী জীবনের উজ্জ্বল ফুল, যার থেকে কত যে আশা আমাদের, হঠাৎই এত ব্যথা দিয়ে ঝরে গেল। প্রায়ই তো ভাবতাম ওর কথা। আমারই যদি এই আঘাত আসে, না জানি আপনি আর ওর বাবা কী ব্যথায় অবসন্ন এখন। কোনো সমবেদনা জানানো নিরর্থক, সেই চেষ্টাও করছি না। তবে এই আশ্বাসটুকু দিতেই পারি যে, যে-অসংখ্য মানুষের সৌভাগ্য হয়েছে ওর সংস্পর্শে আসার, তারা সবাই আজ আপনার দুঃখ ভাগ করে নিচ্ছে। আমি ওর 888sport sign up bonus আগলে রাখব।
যে-সব পত্রপত্রিকা ও সাময়িকী আপনি আমায় পাঠিয়েছিলেন তা ফেরত দিচ্ছি। শুধু একটি জিনিসই ওর থেকে বার করে নিজের কাছে রেখে দিলাম। অমৃতার একটা ছবি।
আপনার অনুগত,
জওহরলাল নেহরু
উমরাও সিংহ পড়া শেষ করে ফের একবার পাহাড় দেখলেন। তারপর উঠে গিয়ে ওপরের ঘরে দূরবীন নিয়ে বসলেন। মনে পড়ল অমৃতার প্রিয় রবীন্দ্রনাথের কথা : আমি দেখি বলেই তো বিশ্বসংসার আছে। না দেখলে নেই।
কেন, প্রিয় পাস্কালও তো বলছেন : এই মহাবিশ্ব কী প্রকান্ড, অসীম। আর কি ক্ষুদ্র এই আমি। কিন্তু ও কি জানে যে ও আছে? আমি জানি বলেই ও আছে!
উমরাও দূরবীনে আকাশ দেখতে বসলেন। ওঁর মনে হলো, দূরের কোনো তারা থেকে হয়তো অমৃতাও ওঁকে দেখছে। হয়তো ও দেখছে বলেই এই পৃথিবীটা আছে।
চার
অমৃতার মৃত্যুর খবর আসতেই দিল্লি থেকে ইন্দিরা আর কল্যাণ গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেল। গাড়িতে যেতে যেতে দিদির অপরূপ মুখশ্রীটা চোখের সামনে ভাসছিল। যে-রূপের আগুন মাঝে-মাঝে, তলে-তলে কিছু কি জ্বলুনি ধরায়নি ইন্দিরার মধ্যে? সেদিনের ওই বিশ্রী ব্যাপারটার পর ভাবনাটা কিছুতেই মন থেকে সরছে না।
আমি ইন্দু, অমৃতাকে বাড়ির থেকে বার করে দিলাম! এটা আমি কোন ইন্দু? কল্যাণ সুন্দরমের সঙ্গে বিয়ে হয়ে অতীব সচ্ছল, আমি অবস্থার টানাপড়েনে থাকা অমরি ও ভিক্টরকে ওদের নিজেদের জায়গাটা একটু চিনিয়ে দিতে চাইছিলাম? ছি! ছি! এটা পারলাম কেন আজ মনেও করতে চাই না।
অথচ, পেরে তো ছি!
বিয়ের পর একটা বড়লোকি দেখানোর বাতিক হয়নি কি আমার? চিরটাকালই তো অমৃতার সৌরভে আর গৌরবে 888sport app পড়েছি। কই, তখন তো ভাবিনি এত কিছু! নাকি ভাবতাম, মনের কোনো গহিন স্রোতস্তরে। ঈর্ষা জানান দেবে না, তা কি হয়? খুব চঞ্চল হলে, কী জানি, হয়তো পিয়ানোয় বসে যেতাম।
অমরির কিন্তু খুব মায়া ছিল আমার প্রতি। মার সঙ্গে সর্বক্ষণের ঠোকাঠুকি, আর আমাকে যেন কিছুটা আগলাতেই চায়।
সত্যি কথাটা সত্যি করেই ভাবি, আজ অন্তত। অমৃতা শের-গিলে 888sport app পড়ে ভেতরে কোথাও একটা বাঘিনী-রোষ তৈরি হয়েছিল। নাহলে ওই সন্ধ্যার বিস্ফোরণ সামান্য চাপা ঈর্ষায় ঘটে যায় না।
অমৃতা আর ভিক্টর তখনো সারায়ায়, শুধু প্রস্ত্ততি চলছে লাহোরে ঘাঁটি গাড়ার। সিমলায় যে-ঘরটায় স্টুডিও করেছিল অমৃতা সেটায় দখল নিয়েছে ইন্দু আর কল্যাণ। ’৪১-এর গোড়ায় লাহোরে বসবাস শুরুর আগে অমৃতা একবার সিমলায় এলো। এসে স্টুডিও ঘরটা নেই দেখে সমস্যায় পড়ল – ছবি অাঁকা হবে কোথায়?
অভিমান হলে তো অমৃতারই হতে পারত। ও কিন্তু সামলে নিল। ও নতুন বন্ধু করা আর পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কটা ঝালিয়ে নেওয়ায় ব্যস্ত হলো। অচিরে সিমলার বাড়ি ফরাসি সালঁর চেহারা নিল।
এটা ঠিকই যে, আমার বড়লোকি চালে হাঙ্গেরি থেকে সদ্য বিয়ে করে আসা অমৃতার সঙ্গে আমার দূরত্বটা বাড়তে শুরু করে। পূর্বেকার ঈর্ষার অন্তঃশীল স্রোতকে তো কখনো চোখে দেখার মতো হয়ে উঠতে দিইনি। কিন্তু হালের দেখনদারিটা দৃষ্টিকটু হয়ে পড়তেই পারত অমৃতার চোখে।
কিন্তু শেষমেশ ইন্দিরা যেটা করল তা আজ ওকেই লজ্জা দিচ্ছে।
এক সন্ধ্যায় ডিনার পার্টি দিলাম, সেখানে আমন্ত্রিতদের মধ্যে তিন বিদেশি। ঘটার কোনো ঘাটতি ছিল না, কায়দার কোনো কমতি। কিন্তু বাকিটা যেভাবে যাবে ভেবেছিলাম মোটেই সেভাবে গেল না। অমৃতা ছাড়া কাকে দুষব!
বিদেশি অতিথিরাই কারণ হলো। যে-মুহূর্তে ওদের চোখ গেল দেওয়ালে অমৃতার ছবির দিকে, অমনি কথা শুরু হয়ে গেল ওই নিয়ে। যে-দিদিকে একটু চমকে দেবার চেষ্টা সে-ই আলোর ফুলঝুরি হয়ে ঝরে পড়ছে আহারের আয়োজনায়।
অভ্যাগতদের শত প্রশ্ন ছবি নিয়ে, 888sport live chatী নিয়ে, যত সন্ধে গড়ায়, রাত নামে, রাতের রানি হয়ে ওঠে অমৃতা। অতিথিদের ঝোঁক হয় অমৃতার স্টুডিও দেখার।
অমৃতা সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছিল ইন্দুকে কথাবার্তায় টেনে নিতে। নিজের বিষয় থেকে সরে যেতে। পার্টিটা তো ইন্দুর।
পার্টিটা কার ছিল? – সবাই চলে যেতে অমৃতার কাছে জানতে চাইল ইন্দু।
– কেন তোর! অমৃতা চমকেছিল।
– সারা সন্ধে তো সেটা মালুম হয়নি।
– তাতে আমার কী করার?
– যা করার তো করেইছ!
– কী করলাম?
– যা করো!
– মানে?
– নিজেকেই তো একটা 888sport live chatকর্ম করে বসেছ। নিজেই একটা প্রদর্শশালা। এই আমি… এই আমার ছবি… এই এক রঙ, এই আরেক… এই আলো, এই অন্ধকার… এই প্যারিস, এই হাঙ্গেরি… এই বোজার, এই বেঙ্গল স্কুল, এই বম্বে পেন্টার্স…. গোগ্যাঁ মাতিস পিকাসো… অমৃতা শের-গিল… অমৃতা… শের-গিল… মুশকিল হচ্ছে তুই পৃথিবীর আর কোনো দিকে তাকাস না। পৃথিবীকে তুই নিজের আয়না করেছিস। পার্টিটা যে আমার ছিল সেটাই তুই মানতে পারিসনি… ছবির রঙ, আলো নিয়ে এত বড় বড় কথা বলিস, সেই রঙের জমিতে, আলোর বৃত্তে শুধু তো তুই, তুই আর তুই। আলোর অপচ্ছায়ায় আমরা তো দোঁহার… নিজেকে হাজার অবজ্ঞা করলেও তোকে আর সহ্য করা যায় না। কী করলাম মানে? তুই কি জানিস তুই কী করিস?
অমৃতা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ও বুঝতে পারল না যা শুনছে, যা দেখছে তা সত্যি। যে বলছে সে বোন ইন্দু। যেখানে বলছে সেটা সিমলায় ওদের সেই 888sport sign up bonusর সৌখিন বাড়ি। আর বলছে এমন একটা সুন্দর সন্ধ্যার পর, যখন রাতটা পাহাড় বেয়ে স্বপ্নের মতো নামছে।
শেষে বলল, আমার সম্পর্কে এটাই যদি তোর বক্তব্য, এটাই যদি তুই ভেবে থাকিস তাহলে আমার এখানে আর থাকা চলে না। তোর সঙ্গে এক ছাদের নিচে আর একদিনও নয়।
ইন্দুও ঝলসে উঠল, হ্যাঁ, যা! বেরিয়ে যা! এক্ষুনি!
অমৃতা কোনো ব্যাগ গোছাল না। ছবি অাঁকার নীল, পুরনো জামাটা পরে দুহাতে দুটো ক্যানভাস ঝুলিয়ে বাগান দিয়ে বেরিয়ে গেল। ওপরের জানালা দিয়ে ইন্দু সেই দৃশ্য দেখে অবিরত কেঁদে গেল। কিন্তু তীর ছোড়া হয়ে গেছে। অমৃতা ফেরার নয়।
দুহাতে দুটো চিত্রপট, অমৃতা হেঁটেই চলেছে অন্ধকার থেকে অন্ধকারে। সিমলার রাস্তা ধরে উপরে উঠেছে, উপরে উঠছে। একটু নিচে তাকালে পাহাড়ের গায়ে জোনাকির মতো আলো, উপরে মধ্যরাত্রি নীল আকাশে হীরের মতো তারার মালা। একদিন এই অন্ধকারও অাঁকতে হবে আমাকে, মনে করল অমৃতা।
বাগান ডিঙিয়ে মা-র কাছে গিয়ে ওঠার কথা মনেও আসেনি অমৃতার। মা?। সে এক সাংঘাতিক জিনিস! কিছু শোনার আগেই ইন্দুর পক্ষ নিয়ে বসত। কী যে শত্রুতা বড় মেয়ের সঙ্গে লর্ড ক্রাইস্ট জানেন। আজ নয়, সেই কবের থেকে! কন্যার রূপে এত ঈর্ষা! তার প্রতিভায় এত ক্ষোভ! বেচারি বাবাকেও বুঝিয়ে গেলে, অমরি নয়, ইন্দুকে দ্যাখো।
তাই দ্যাখো, আমি চললাম। এই রাস্তা কোনোদিন ফুরোবে কিনা জানি না, কিন্তু আমার চলা থামবে না। আসলে তুমি তো চলার গুণে পথের দূরত্ব তৈরি করো। কেউ না চললে পথের আর কী দূরত্ব! কেউ পথে না নামলে কীসের গন্তব্য? ‘এ’ থেকে ‘বি’ থেকে ‘সি’ গেলে সরলরেখা হতে পারে, ত্রিভুজও হতে পারে। ‘এ’ থেকে ঘুরে ‘এ’-তে এসে পড়লে বৃত্ত হয়, আরো কত কী! সবটাই নির্ভর করছে তুমি কীভাবে এগোচ্ছ, বেঁকছ, যাচ্ছ। আসলে সবটাই একটা দেখার ধরন। ছবি অাঁকার মতো।
সাদা ক্যানভাসটাও আসলে একটা আলো বা অন্ধকারের ক্ষেত্র। তোমার তুলি-বুরুশ তাতে চলে চলে পথ করে একটা আকার, বর্ণ, ভাবনা নিয়ে আসছে। আজকে এই অন্ধকার পাহাড়ের বুকে একটা তুলিকার মতো 888sport slot game করছি। ছবিটা অাঁকছেন বিধাতা। সেই ছবির প্রকার, বস্ত্ত, রহস্য বা ভবিষ্যৎ আমরা জানি না। শুধু যদি সামনের এই খাদটা থেকে নিজেকে নিচে ছুড়ে দিই তাহলে এই ছবিটা ফুরিয়ে যাবে। মাঝপথে ছবির ইতি হবে।
আমার অনেক ছবিই তো এভাবে হঠাৎ থমকে গেছে। নতুন করে শুরু হবে বলে।
সব ছবিই তো এক হিসেবে নানা নতুন শুরুর সমাবেশ। কত ছবিই তো ভেঙেচুরে নতুন করে করেছি, পরে শেষ করে সেই ছবির মধ্যেই লুকিয়ে থাকা সেইসব শুরুকে দেখার চেষ্টা করেছি। বোজারে থাকতে শুনেছিলাম, একটা সুন্দর শুরুর মধ্যেই একটা সুন্দর শেষ তৈরি হয়। তখন মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করেছি : একটা সুন্দর শুরু কখন শুরু হয় কে বলতে পারে?
আজ ইন্দু যে আমাকে রাস্তায় দাঁড় করাল এও কি নতুন কোনো শুরু? একটা দীর্ঘ নিবিড়, রক্তের সম্পর্কের শেষের শুরু? নাকি একটা ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্কের অবধারিত শেষ? মা-মেয়ের সম্পর্কের মতো বোন-বোনের এই সম্পর্কটাও একটা ধাষ্টামোয় এসে দাঁড়িয়েছে। মা-র মনের যে-চরিত্র সেখানে বিষ আপনা-আপনিই তৈরি হয়, বাবা সেটাকে পাগলামি বলে চালাতে চেষ্টা করে।
ইন্দুর মনের বিষকে পাগলামি বলাও আদিখ্যেতা। শের-গিলদের মধ্যে কেউ হীনমন্যতায় ভুগবে এটা মানা যায় না। ওর নিজের ক্ষুদ্রতা ও নিজেই সৃষ্টি করেছে। নিজেকে সংকুচিত করা ওর চরিত্রগুণ, যেটাকে ও অমৃতার প্রতিরোধ বলে দেখতে চায়। আজ রাতের এই পথ ফুরোলে ওর থেকে এতই দূরে চলে যাব যে, ও চাইলে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে। যদি কোনোরকম নতুনত্বই ওর পক্ষে বরণ করা সম্ভব হয়। মা-র মতো। যে মৃত্যুবরণ করতে পারবে কিন্তু ভিক্টরকে জামাই হিসেবে নয়।
বাঁচা গেছে, ইন্দু আমাকে তাড়িয়ে দিলো। ছবির মতো জীবনেও আমার একটা মুক্তির দরকার ছিল।
প্রায় সারারাত হেঁটে, দশ মাইল পেরিয়ে, হেলেন চমনলালের বাড়িতে এসে পৌঁছল অমৃতা, তখন ঘড়িতে সাড়ে তিনটে!
দরজা খুলে হেলেন চমকে উঠল, এ কি, তুমি!
অমৃতা অবসন্ন-কণ্ঠে বলল, আমি।
– কেন, গাড়ি ব্রেকডাউন?
– জীবনের ব্রেকডাউন।
– খুব খারাপ কিছু?
– খুব ভালো কিছু।
– মানে?
– গরম কফি হবে?
– অ্যাক্ষুনি দিচ্ছি। ভেতরে এসো।
ঘরের ভেতর এসে চারদিক দেখতে লাগল অমৃতা। ওর হাতে কফি ধরাতে ধরাতে হেলেন জানতে চাইল, কী খুঁজছ?
– একটা ছবি অাঁকার জায়গা।
– কেন, বাড়িতে জায়গা হচ্ছে না?
– ফিরব না।
– তাহলে এখানেই থাকো।
– থাকব।
– তোমার স্টুডিও করে দিচ্ছি।
– দাও।
– যত খুশি ছবি অাঁকো।
– অাঁকব।
– আর?
– যদি আমাকে কখনো খারাপ লাগে, মুখের ওপর বলো।
– কারণ?
– তাহলে আমি আবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ব। আমার ঘর হারাবার ভয় নেই আর।
– সত্যিই তো, কাকেদের মতো বাসা। কোকিলরা বাস্ত্তহারা।
– দ্যাখো হেলেন, আস্তানা গাড়া তো একটা পছন্দ, চয়েস।
– আর রাস্তায় দাঁড়ানো?
– আরো সূক্ষ্ম, গভীর নির্বাচন। প্রায় থাকা বা না-থাকার মতন। একটা মতের পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়াবার মতন। জানো হেলেন…?
– বলো শুনছি…
– রাস্তায় দাঁড়ানোও একটা রাস্তা খুঁজে পাওয়া। কোনো একটা গন্তব্যের দিকে।
– সর্বস্ব হারিয়ে?
– কে বলতে পারে, হয়তো সর্বস্ব ত্যাগ করে।
– তোমার ক্ষেত্রে?
– আপাতত হেলেনকে পাওয়া।
– আর মাশোবরার এই বাড়ি, এই নতুন স্টুডিও?
– নতুন ছবিই প্রমাণ দেবে, কতটা পেলাম এসব।
সিমলা পাহাড়ের পাকা বেয়ে সূর্য উঠল যখন ক্লান্ত অমৃতা সোফায় ঢলে পড়েছে গভীর ঘুমে। ওর সুন্দর, কিন্তু বিষণ্ণ মুখটার ওপর সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়েছে।
সেই মুখের দিকে মুখ করে বসেছিল হেলেন চমনলাল।
সেই সুন্দর, বিস্মিত মুখটা অন্ধকারে উইন্ডস্ক্রিনে দেখছিল ইন্দিরা। চোখে জল নামব-নামব করছে; কিন্তু চোখে একটা প্রায় অদৃশ্য, বাঁকা হাসি। গোটা জগতের সমালোচনা কিংবা বিরোধিতার বিরুদ্ধে অমৃতার বেপরোয়া হাসি। আজ সেই বিরুদ্ধ জগতে জায়গা হলো ইন্দিরারও। যে-অবস্থান ও কোনোদিনই কামনা করেনি। অমৃতাকে ও ঈর্ষা করেছে, মনে মনে গাল পেড়েছে, কিন্তু শত্রুজ্ঞানে নয়। অমৃতার বিরুদ্ধশিবিরে নিজেকে আবিষ্কার করা ইন্দিরার পক্ষে একটা নতুন ইন্দুকে খুঁজে পাওয়া। একই সঙ্গে অমৃতা এবং নিজের ওপরে রাগ চড়ল ওর। অমৃতা বাগান দিয়ে রাতের বেলা বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে যেভাবে হু-হু করে চোখ দিয়ে জল নেমেছিল সে-রাতে, তেমন অশ্রুপাত শুরু হলো ইন্দিরার শীতের রাতের অন্ধকারে উইন্ডস্ক্রিনে অমৃতার সেই আশ্চর্যান্বিত এবং ব্যথাতুর চোখদুটো দেখতে দেখতে।
এত কাছাকাছি ছিলাম আমরা দুজন সারাজীবন, এত অন্তরঙ্গ, তবু হিংসা, দ্বেষ, পরশ্রীকাতরতার এই অন্তঃশীল নদীর উৎসটা কোথায়? এ-নদীর উৎস আমার আমিতে। যত বছর গড়াল, বয়স বাড়ল, অমৃতার পাশে নিজেকে একটা ছায়ার মতো মনে হলো। অসার, বস্ত্তহীন, শূন্যতা যেন। ও যেন সবকিছু, আমি কিছু নই। এটা যে ওর অপরাধ নয়, এই বোধটাও এক সময় চলে যাচ্ছিল। আমি হয়তো আমার ক্ষুদ্রতাতেই পূর্ণ হয়ে উঠছিলাম। বিন্দু বিন্দু ক্ষোভ থেকে এক পূর্ণ ইন্দু।
এক ভয়ানক ডিপ্রেশনেই ছিলাম তখন, তার ওপর একটা ঘুসঘুসে জ্বর। কেন যে জ্বর তার হদিসই মেলে না। তাই বিশ্রী এক ক্লান্তিতে সারাক্ষণ শুয়েই থাকি, স্টুডিওর ঘর থেকে নেমে কারো সঙ্গে দেখা করার সৌজন্য দেখাতেও ইচ্ছে হয় না। অথচ অমৃতার অনুরাগীর যাতায়াত তো লেগেই আছে।
অমৃতা বিয়ে করতে হাঙ্গেরি গেল বলেই বাড়ির এই স্টুডিওয় আস্তানা হলো আমার। তাতে একেক সময় একেকটা অপরাধবোধ জেগেছে। অমৃতার কত অজস্র, অপূর্ব কাজ এই ঘরে। আমার বেলায় শুধুই ডেরা। একেকদিন ঘরের জানালা বেয়ে এসে পড়া রোদ নয়তো ঘরের কোনো কোণের অন্ধকার অমৃতার কোনো গল্প শোনায়। আমি পিয়ানোয় বসে কোনো বাখ, মোৎজার্ট বা শোপ্যাঁ পিস ধরলে মনে হয় আমার পিছনে কোথাও বসে অমৃতা শুনছে।
একদিন হাঙ্গেরিয়ান র্যাপসডির একটা মুভমেন্ট মাথায় ঘুরছিল। কী মনে করে জানালার বাইরে তাকালাম। তাতে যা দেখার তা দেখলাম না। চোখের সামনে কেবলই ভাসছে অমৃতার অাঁকা হাঙ্গেরির সেই বাজারদৃশ্য।
বাজারে এত কর্মতৎপরতা, ট্রলিতে শাকসবজি, মাংস ভরে মহিলারা বাজার থেকে বেরোচ্ছে। তাদের সবারই গায়ে কালো পশমি পোশাক, তাতে ছবিটা ছেয়ে গেছে কালোয়। দিনটাও মেঘাচ্ছন্ন, তাই আকাশেরও কোনো আলো নেই। বাজারের গা-বেয়ে দাঁড়ানো শুধু গির্জার প্রকান্ড মিনারটা সাদা রঙে দাউ দাউ করে জ্বলছে। আর বাজারের দেওয়ালে কিছু সাদা রঙ ছড়িয়ে। আবার, গির্জার মিনারের চূড়ো মিশমিশে কালো, যেন কালো গ্র্যানাইটে বাঁধানো। ছবিটাতে যতখানি চাঞ্চল্য, ততখানিই অবসাদ। দেখতে শুরু করলে ভূতের মতো ভর করে।
হয়তো অমৃতাকেও ভর করেছিল, তাই ১৯৩৮ সালের ছবিটা নতুন করে 888sport sign up bonus থেকে এঁকেছিল ১৯৪০-এ।
আমি দুটো ছবির কোনটা দেখেছিলাম জানি না, কারণ দুই ছবির মধ্যে কোনো ফারাক চোখে পড়ার নয়। কেবল পরেরটায় মেঘাচ্ছন্ন আকাশে ঈষৎ… অতি, অতি সামান্য একটু আলোর আভাস। অথবা অন্ধকারের এক অন্য চেহারা। আমাদের মাসতুতো ভাই ভিক্টরকে বিয়ে করার পর থেকে আমার ভেতর এক হাঙ্গেরিয়ান র্যাপসডি চালু করে দিয়েছিল অমৃতা। আমার ভেতরটা শূন্য করে দিয়ে সেই শূন্যকেও নিজেকে দিয়ে ভরিয়ে তুলছিল অমৃতা।
সারাদিন অতিথির আসা-যাওয়া, অমৃতার ছবির সামনে ঘেঁষাঘেঁষি, মুখে অমৃতার স্ত্ততি। তাদের কথা ভেসে আসে উপরে, আমি শুনে শুনে ক্লান্ত হই। একেক সময় ঘর থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, নতুবা সববাইকে তাড়িয়ে দিতে। যার কোনোটাই আমার ক্ষমতায় নেই। আমি শুয়ে শুয়ে অমরির সঙ্গে ওদের গোপন আলাপও শুনি। তাতে একটা জিনিস বুঝি : 888sport promo code-পুরুষের শরীরী কার্যকলাপ দেখার চেয়ে তাদের বেহায়া প্রেমালাপ শোনা আরো কঠিন। আর এই বেহায়াদের মধ্যে অমরির এখনকার অনুরাগীটি আরো সরেস। সে আসে গভীর রাতে, শব্দ এবং স্পর্শের ভাষায় বোধহয় উত্তাল করে অমরিকে, অমৃতা মন্থন করে গরল কিংবা অমৃত তোলে, তারপর ভোরের আলো ফোটার আগে অন্ধকারে মিশে যায়।
তাতে আমার ঘুমের অষ্টরম্ভা, কিন্তু সকালে নিচে নেমে দেখি অমৃতা ঘোরঘুমে আচ্ছন্ন। সঙ্গমের মেদুর যন্ত্রণা এখনো ওর ওষ্ঠে লেগে আছে।
ফলে গ্রীষ্মের সেই ডিনারের সন্ধেটা ক্রোধ, ঈর্ষা ও অভিমানের আতসবাজির স্তূপে টেক্কা মার্কা দেশলাইয়ের একটা কাঠির মতো হলো। মুখ ফসকে প্রথম কথাটা বলেই বুঝেছি, কী ভুল করলাম। কিন্তু তার মধ্যেই ভেতরের আতসবাজি-স্তূপে বিস্ফোরণ শুরু হয়ে গেছে।
আমি আর অমৃতা একই সঙ্গে জ্বলছি।
ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে অনেকদূর অবধি। অমৃতার সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবনের একটা অংশ, নিবিড় অঙ্গ আগুনে শেষ হচ্ছে। সেই কবে, কোনকালে মোৎজার্টের রিকুইয়ম শুনতে শুনতে পাশে বসা আমাকে কনুইয়ের গুঁতো মেরে বলেছিল, এমন কিছু বাজলে আমার মরায় আপত্তি নেই। আশা করি আমার মৃত্যুতে এমন কিছু বাজবে।
বলেছিলাম, অত ভাবিস না। মরা অত সহজ না।
ও বলল, কী বলছিস, জন্মালে জীবনে তো সারাক্ষণ কিছু ঘটতেই থাকে, তুই চাস বা না-চাস। মৃত্যু কিছু না জানিয়ে আসে। তাই তৈরি থাকা দরকার। জীবনকে এমনভাবে ভেবে তৈরি করতে হবে যেন একটা ছবি। মৃত্যু এসে সেটাকে শুধু ফ্রেমে বাঁধবে।
বললাম, যার মিউজিক নিয়ে তোর এই স্বপ্ন, সেই বেচারা ভলফগাঙ্গ আমাডেয়স কিন্তু এটা কম্পোজ করতে করতেই মারা গিয়েছিল। ৫ ডিসেম্বরের সেই মৃত্যুর রাত্তিরে, ঝড়জলের মধ্যে রওনা হতে হয়েছিল কবরের পথে। আরো তিনজনের সঙ্গে বস্তায় বেঁধে একটা এজমালি, নামগোত্রহীন গর্তে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
সঙ্গে সঙ্গে ‘হুর্রে!’ বলে ডেকে উঠেছিল অমৃতা। তারপর বলল, আহা রে, যদি প্রিয় মোৎজার্টের মতো মরতে পারি! অসাধারণ লাগে, যখনই ওটা নিয়ে ভাবি।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, অসাধারণ কীসে?
বলল, কারণ ওই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই তো মোৎজার্ট অমর হয়ে গিয়েছিল। একটা রাজকীয় শোভা করে ওর শবযাত্রার কোনো প্রয়োজন ছিল না। জানিস তো, অমরত্ব হলো ধনদৌলত, পদ, ক্ষমতা, জাঁকজমক, খেতাব, উপাধি, প্রচার, মিথ্যে, স্তাবক, গর্ব আর ঈর্ষা থেকে মুক্তি। অমরত্ব হলো সেইসব মানুষের ভালোবাসা পাওয়া, যাদের তুমি চেনোওনি, তোমাকে ভালোবাসার জন্য যারা দায়বদ্ধ নয়। অমরত্ব হলো আমাডেয়সের মতো রাতের অন্ধকারে একটা নামগোত্রহীন কবরে শুয়ে পড়া, যাতে সেটাই বিশ্বের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
অমৃতার ইচ্ছামৃত্যু নয়, কিন্তু ৫ ডিসেম্বর তারিখটা ও মনে রেখেছিল।
ইন্দিরা দেখল, দূরে বসে চিতার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বসে আছে ভিক্টর। যেন ডাক্তারির সেরা পরীক্ষায় ফেল হয়েছে। অমৃতার সঙ্গে ছেলেবেলা থেকে প্রেম ওর। এখন হয়তো মনে মনে নিজেকে বোঝাচ্ছে : ডক্টর, হিল দাইসেলফ! কবিরাজ, নিজেকে সারাও!
ইন্দিরা ও কল্যাণ আস্তে আস্তে ওর পাশে এসে দাঁড়াল। ওর একার নির্জনতা এবার তিনজনের নির্জনতা হলো।
পাঁচ
অমৃতার শরীরের শেষ মুহূর্তগুলো দেখতে দেখতে ভিক্টরের মনে পড়ল ওকে দেখার সবচেয়ে প্রাচীন 888sport sign up bonus।
হাঙ্গেরির সেই সুদূর, সুনির্মল শৈশব। মা ব্লাঙ্কা, মাসি মারি অাঁতোয়ানেত, বোন ভিয়োলা, অমৃতার বোন ইন্দিরা, উমরাও মেসো, আর অমৃতা। এক ছাদের নিচে, বুদাপেস্ত থেকে একটু বেরুলেই, দানিউবের এক শাখা নদীর পাড়ে, দুনাহারাস্তি গ্রামে। বাড়ির বিপরীতে গির্জা, তার স্টেন্ড গ্লাসের জানালাগুলো চোখ টানে, আর প্রতিদিন দুপুরে, ঠিক বারোটায়, ঢং ঢং করে ঘড়িটা বেজে ওঠে। ওটা 888sport app download for androidে আনে সবার, কীভাবে হাঙ্গেরীয়রা ১৪৫৬-য় তুর্কি সুলতানের আক্রমণ ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিল।
সেখানেই দুই বোন মারি ও ব্লাঙ্কার পরিবার জড়ো হয়েছে আরেক যুদ্ধ – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ – থেকে গা বাঁচাতে। বুদাপেস্তের বুদা হিলসের শহুরে নিবাস ছেড়ে এই চোখের আরাম মনের আরাম গ্রামে।
অমৃতা কখন মনের আরেক আরাম হয়ে উঠল আজ মনে করা বড় কঠিন ভিক্টরের পক্ষে। কিন্তু সেই এক প্রথম 888sport sign up bonus আজো মনের অদৃশ্য দেওয়ালে জলছবি হয়ে আছে। সেই সকাল, যখন ভিক্টরের বয়েস সাত, অমৃতার পাঁচ। ভিক্টর দেখল…
সকালের নরম রোদ এসে পড়েছে ঘরে। কিন্তু তাতেও এক উষ্ণতার ছোঁয়া। ঘরে আমি আর অমৃতা কেবল। এরকম সুন্দর দিন পেলে সময়টা নিয়ে কী করব ভেবে পাই না। অমরির একটা রাস্তা আছে নিজেকে ব্যস্ত করে তোলার। রঙের বাক্স, রঙ পেনসিল, ছবির বই আর ছবি অাঁকার কাগজ নিয়ে বসে যাওয়া। আর সঙ্গে সঙ্গে নিজের অন্য জগতেও।
আজ কিন্তু তা করল না। বলল, কী ভালো! কী আলো! গায়ের এই জামাগুলোই যাচ্ছেতাই!
জিজ্ঞেস করলাম, কেন, জামার কী দোষ?
অমরি চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বলল, নাচতে দেয় না।
‘তুমি নাচতে চাও?’ এইটে জিজ্ঞেস করেছি কি করিনি অমরি দেখি পটপট, পটপট করে মাফলার, সোয়েটার, ফ্রক, প্যান্টি সব খুলে পাশে ছুড়ে ফেলেছে। বলল, এবার নাচতে পারি।
বলেই বেদম এক চক্কর দিয়ে নাচতে লাগল। একদম ন্যাংটো!
আমি একমনে ওকে দেখে গেলাম, আর ও নাচল।
আমার মনে নেই তখন কী মনে হয়েছিল। জানি না, মনে হওয়ার বয়েস কি-না সেটা। শুধু দুচোখ ভরে দেখছিলাম। হয়তো জীবনে প্রথমবার মনে হয়েছিল, কী সুন্দর মেয়েটা!
একটুও কি লজ্জাভাব হয়েছিল! মনে নেই। শুধু মনে আছে, অমরি নাচ শেষ করে জিজ্ঞেস করেছিল, ভালো না?
বলেছিলাম, খুউব!
অমনি কিছুই ঘটেনি এমন একটা ভাব করে অমরি ছুড়ে ফেলা জামা-কাপড় পরে বাগানে চলে গেল, যেখানে বাগানের দেখভাল করছিল উমরাও আঙ্কল। ও পাশে দাঁড়িয়ে ফুল দেখতে লাগল।
আমি ঘরের জানালার এক কোণ থেকে ওকে দেখতে পেলাম। বাবার পাশে মেয়েকে দেখে হঠাৎ একটা প্রশ্ন ঝিলিক দিলো মনে – ও কি ওর বাবাকে এটা বলবে?
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটা মনের ভেতর কোথাও হারিয়েও গেল। আমি ফের নিজের জায়গায় গিয়ে বসে মনে মনে অমৃতার নাচ দেখতে লাগলাম। যেভাবে তার আগে সার্কাস, প্যান্টোমাইম বা বায়োস্কোপের কোনো ভালোলাগা দৃশ্য মনে মনে নতুন করে দেখেছি।
চিতার জ্বলন্ত কাঠের স্তূপে অমৃতার পরমাসুন্দরী নগ্ন দেহটা জ্বলেপুড়ে খাক হচ্ছে দেখে ভিক্টরের কয়েকটা দৃশ্য কল্পনায় এলো। দেখা নয় সেসব দৃশ্য, তবু দূর ছাই করে ফেলে দেওয়ার মতোও নয়। কারণ মেয়েটির রূপের ওর সঙ্গকামী পুরুষদের দগ্ধে মরার অদ্ভুত, অদ্ভুত সব গল্প হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ওর কানে এসে পড়ত। আইরিশ ও হাঙ্গেরীয় রক্ত মিশে এমন এক রসবোধ ও শক্ত ভাব ছিল ভিক্টরের মধ্যে যে, এসব বার্তা বেশ সহজেই হজম হয়ে যেত ওর। তাছাড়া সিমলার হোমরা-চোমরা, পদস্থ সরকারি অফিসার বদরুদ্দিন তায়েবজির সঙ্গে ঘটনাটা বিয়ের আগেই। শোনা হয়েছিল, তবে ভুলক্রমেও কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। ঠিক যেমন নেপলস বন্দরে ওকে জাহাজ থেকে নামিয়ে, জেনোয়া হয়ে বুদাপেস্তে এনে বিয়ে করার আগে ভিক্টরের জানা হয়নি অমৃতা অন্য কারো দ্বারা অন্তঃসত্ত্বা। আগে না-জানানোয় কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু অভিযোগ করেনি ভিক্টর। ওদের শর্তেই ছিল ওরা দুজনাই বিয়ের পরও অন্য যৌন সম্পর্কের জন্য স্বাধীন।
তায়েবজির মতো আরো দু-একটা গুজব কানে এসেছিল ভিক্টরের। তাতে মনে হয় আগুনের পাশে নগ্ন হয়ে শুয়ে থাকার একটা ইতিহাস হয়তো ছিল অমৃতার। উষ্ণতা ও নগ্নতার যে হাত-ধরাধরির শুরু হয়তো দুনাহারাস্তির সেই সুদূর সকালে।
তায়েবজি সংক্রান্ত ঘটনাটা বেশ মানিয়ে যায় অমৃতার দেহের লাস্য ও মনের মাধুরীর সংলাপের সঙ্গে। উড়োখুড়ো হয়ে যেভাবে চরেছিল তা এরকম…
এক সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে তায়েবজি সিমলায় ওর হোটেলের ঘরে বসে বাখের ব্রান্ডেনবার্গ কনচের্তোর রেকর্ড বাজিয়ে শুনছিল। তখন ঘড়িতে রাত দশটা দেখাচ্ছে, যখন অমৃতা এসে দরজায় নক করল।
শীতের রাত সেটা, ভয়ঙ্কর ঠান্ডা বাইরেটায়। কিন্তু তায়েবজির ঘরের ফায়ারপ্লেসে দাপিয়ে আগুন জ্বলছে, জানালার ভারী ভারী পর্দা সব অাঁট করে টানা। ঘরটা তাই একই সঙ্গে উষ্ণ আর আরামপ্রদ।
অমৃতা খুব একটা কথা বলল না। শুধু বলল, ব্রান্ডেনবার্গ কনচের্তোর যে-রেকর্ডিংটা ডিস্কে বাজছে সেটা ওর মনে ধরেছে। একটু পর ফায়ারপ্লেসের সামনে কার্পেটের ওপর ও শুয়ে পড়ল। আর তারপর একটা-একটা করে গায়ের কাপড়চোপড় খুলে ফেলতে লাগল। শেষে একদম উদোম হয়ে আগুনের পাশে পড়ে রইল প্রায় এক ঘণ্টা। সারাক্ষণ একটা মৃদু ঠাট্টার হাসি ছড়িয়ে রেখে মুখে, আর একটা দুষ্টুমির চাহনি নিয়ে চোখে।
ওভাবে শোনা হলো বাখ। এক সময় গা-ঝাড়া দিয়ে উঠল অমৃতা। একটা একটা করে কাপড় চড়াল শরীরে, শেষে একটা প্রায় লাজুক হাসি হেসে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। গোটা মুখে তখন একটু কৌতুকও ঝিলমিল করছে।
যে-হাসির কোনে সুযোগ নেই আর এখন। আওয়াজ করে করে চিতার কাঠ পুড়ছে, হঠাৎ-হঠাৎ পাকানো ধোঁয়া ছুটে আসছে। তাতে আচমকা জল এলো চোখে। ভিক্টর নিশ্চিত নয়, সেটা কান্নার না ধোঁয়ার। কিন্তু ও চোখ মুছল না। ও ধোঁয়া, কান্না, আগুন, দাহ ও মৃত্যুর থেকে মন সরাতে চাইল। অমরির অসুখের দিন থেকে কেবলই বিদায়ের বেহালাবাদন শুনছে মাথার মধ্যে। ওর মৃত্যুর কারণ নিয়ে কত না অবান্তর মতামত। এর কোনো কিছুই অমরির বরদাশত হতো না। মৃত্যুযন্ত্রণার মধ্যেও ওর চোখে ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা ও পিপাসাই দেখেছে ভিক্টর।
ওর শেষ যে ঠোঁট নাড়া দেখেছে, তাতে কী বলার চেষ্টায় ছিল ও? ইংরেজিতে ‘বিদায়!’ না হাঙ্গেরিয়ানে ‘ভালোবাসি’ না যে-কোনো ভাষায় শুধু ‘ভিকি’? তবে যে-মুহূর্তে ও চলে গেল, ঠিক তখন ওর দিকে চোখ ছিল না ভিক্টরের, ডাক্তারটার সঙ্গে রক্ত দেওয়া নিয়ে তর্ক চলছিল। বলতে গেলে চোখের আড়ালেই চলে গেল ও। কেউ জানুক, না-জানুক, আমি তো জানি, সেই কবেকার এক যৌন রোগের এক নতুন, গোপন, বিজন আবির্ভাবে।
আমার একমাত্র আশ্রয় এখন অমৃতার ভালোবাসায়। ওর ভালোবাসার যা-যা এখনো মন ছেয়ে আছে। যার কিছুই হয়তো ভুলতে চাইব না। ওর ভালোবাসার জন্যই এত দুঃখ, এত লজ্জা, এত অপমান নীরবে সয়ে গেলাম। যখন মনে পড়ে প্যারিস থেকে হালকা নীল কাগজে কালো কালিতে লেখা ওর সেই চিঠিগুলো… বিশেষ করে সেই কথাগুলো, যার উত্তরে নিজে কী লিখেছিলাম আজ আর মনে করাও বৃথা। এই ধোঁয়াতে চোখের দৃষ্টির মতো সময়ের মেঘে ওর সেই চিঠির কথাগুলোও ঝাপসা হয়ে এসেছে। কিন্তু চিঠিগুলো নিপুণ করে তারিখে তারিখে সাজানো যে-তরঙ্গে সেটা ভাসছে চোখের সামনে।
রাতে সবাই যখন চলে গেছে গঙ্গারাম ম্যানশন ছেড়ে, শুধু দুটো ঘরে শ্বশুর-শাশুড়ি আর কল্যাণ-ইন্দিরা শুতে গেছে, ভিক্ট সন্তর্পণে দশ বছরের পুরনো চিঠিগুলো বের করে কোলে রাখল। আজ থেকে এগুলোই ওর অমৃতা…
সে লিখছে…
ফেব্রুয়ারি ১৯৩১ : আমার সব সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা ও আশা হলো মানুষের ভবিষ্যদ্বাণীকে বাস্তব করা। সেইসঙ্গে এটাও বিশ্বাস করি যে, তুমিও একজন কেউকেটা হবে।
মার্চ ১৯৩১ : তুমি এমনই সৎ একজন মানুষ যে, কোনো ছদ্ম বিনয় না করেই বলতে পারি, আমি তোমার উপযুক্ত নই। নিজেকে সার্থক 888sport live chatী হিসেবে প্রমাণ করার ঢের সুযোগ আমি পেয়েছি, কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে খুবই অপদার্থ জ্ঞান হয়। আমার অক্ষমতার শেষ নেই, চরিত্রে অজস্র খামতি। একটাই বাঁচোয়া যে, আমি জানি, আমার দোষ-দুর্বলতা আছে।
এপ্রিল ১৯৩১ : বাস্তববাদী চরিত্র হলেও আমি একজন 888sport live chatী এবং ঝুঁকে থাকি রোম্যান্টিকতার দিকে।
এরপর ভিক্টরের হাতে একটা চিঠি উঠে এলো, যেটা পড়ে ও বেশ বেদনা অনুভব করেছিল সে-সময়ে। কতবার পড়েছিল আর এর কী উত্তরও দিয়েছিল মনে নেই। মাসের উল্লেখ নেই চিঠিতে, শুধু বছরটাই ধরা যাচ্ছে – ১৯৩১-ইং। ও লিখছে…
বাবা আর মা যা আমার সম্পর্কে বলে বেড়ায় তার পরেও কেউ যে আমাকে এতখানি পছন্দ করতে পারে ভেবে অবাক হই। একেক সময় ওই বিশ্রী ভাবনাটাও আসে : কী জানি, ওদের ভাবাটাই হয়তো ঠিক! তখন অবাক হই, এর পরেও একজন কী করে এত ভালোবাসতে পারে আমাকে।
একেক সময় এটাও মাথায় আসে যে, মা-বাবার ওইসব বকাবকি, গালমন্দ একদিন হয়তো সত্যি ফলে যাবে আর লোকজন মহানন্দে আঙুল তুলে বলবে, ‘কী, বলেছিলাম না, এ-বিয়ে টেকার নয়? অমরির যা নষ্ট স্বভাব!’
আমি এখন ইন্দু আর ওর এক বন্ধুকে অাঁকছি। ছবির এক কোণে যে-মেয়েটা কী-একটা পরিষ্কার করছে ও এক মডেল। এই চিঠির সঙ্গে ছবিটার একটা ফটো পাঠাচ্ছি। দেখলেই বুঝতে পারবে মানুষটা কী দুঃখী। ওর দুঃখী চেহারাটাই তুলে ধরতে চাই আমার কম্পোজিশনে। মডেলের শরীরের ফ্যাকাসে ভাবটাই হলো অন্যদের তরতাজা, শক্তপোক্ত দেহ ও বাদামি চুল, লাল গাল আর পোশাকের বিপরীতে। এই বড়সড় বিষয়-ভাবনাটাই আমাকে উত্তেজিত করছে। এমন একটা দারুণ বিষয়ের সঙ্গে পাঞ্জা কষতে আমার দারুণ লাগছে। এক অদ্ভুত, আশ্চর্য অনুভূতি!
সেপ্টেম্বর ১৯৩১ : নিজেকে নিয়ে একটা অসাধারণ কাজ করেছি। অকাদমির প্রদর্শনীর উদ্বোধনে দেখানো হবে। চুকা গেজা আরো পাঁচটা কথার মধ্যে এটাও বললেন যে, আমি বড় সুন্দর অাঁকি।
মাসের উল্লেখ নেই, ১৯৩১ : আমি অন্য লোককে জয় করতে পারি, কিন্তু নিজেকে নয়। অদ্ভুত পরিস্থিতি। গর্ব কিংবা অহঙ্কার, যে-জন্য কারো দিকে হাত বাড়াতে পারি না। আমি মরে শেষ হয়ে যাব, তবু কারো সাহায্য চেয়ে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করব না।
মাসের উল্লেখ নেই, ১৯৩১ : যে-সেলফ পোর্ট্রেটার কথা তোমায় বলছিলাম, সেটা আজ সকালে পাঠিয়েছিলাম মাস্টারমশাইকে। ভাবখানা ছিল, যেন ওঁর মতামত চাইছিলাম, যদিও ব্যাপারটা হলো ওঁকে আমার ক্ষমতার দৌড় দেখাচ্ছিলাম। বুড়ো তো ধাঁ মেরে গিয়েছিলেন : ‘এই অাঁকায় দারুণ ক্ষমতা ধরা পড়ছে। ছবিতে শক্তি আছে আর রঙের জোরালো ব্যঞ্জনা।’
আমার ছবি দাঁড়িয়ে আছে লেবুরঙ, কমলা আর হলুদের মিশ্রণের ওপর, যেটা রঙের ভারসাম্যের গড়ন এখানে। শরীরে ছাড়া অন্যখানে একটা নীলের আভাস আছে। শরীরে উষ্ণ বাদামির ছোঁয়া। অদ্ভুত শোনাবে, তবু বলতেই হবে যে, ছবিতে শুধু 888sport live chatীরই আত্মপ্রতিকৃতি নয়, তার সময়েরও আত্মপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে। অাঁকতে অাঁকতে জ্ঞান হলো যে, একেকটা সময়ে বিশেষ কিছু কিছু রঙ আমাকে চেপে ধরে, তখন যা-ই অাঁকি না কেন, সেই রঙের সন্ধি-সমাস থেকে বেরুনো মুশকিল। আমার সমস্ত প্যাশন দিয়ে কেবল ওই রংগুলোর সৌন্দর্যই খুঁজে মরছি।
এখন যা অবস্থা তাতে 888sport app রঙের বিন্যাস নিয়ে কাজ করলেও অচিরে নীল আর সবুজ ফিরে আসে। এমনকি, ভিন্নরকম কোনো বিষয়ে হাত দিলেও একটা সময় নীল আর সবুজ বাঁধা পড়ে থাকে। কাজেই যা-ই অাঁকছি আপাতত তাতে তুমি নীল আর সবুজের সুরের প্রাধান্য পাবে।
নভেম্বর ১৯৩১ : একটু একটু করে উপলব্ধি করছি যে, প্রত্যেকটা মানুষ তার ভেতরে এমন একটা বৃত্তি লালন করে চলে, যার বিরুদ্ধে লড়াই করা বৃথা।
জানুয়ারি ১৯৩২ : আমি সেই রাস্তাই নেব, যা আমাকে আমার লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাবে – আমার ছবি অাঁকাই সেই রাস্তা, যা আমার অস্তিত্বকে ভরিয়ে রাখে। দিন-দিন নিশ্চিত হচ্ছি এ-ই আমার কাজ, হয়তো একমাত্র কাজ। ভেতর থেকে এক প্রবল অনুভূতি ভেসে উঠছে, জানিয়ে দিচ্ছে বিবাহ আমার জন্য নয়, আমার জন্মই হয়েছে 888sport live chatের জন্য। গতকালই স্টিল লাইফ ছবির প্রতিযোগিতাটা হয়ে গেল। আমার কাজটা দ্বিতীয় 888sport app download bd পেল।
ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৩ : এক মস্ত বড় জায়গায় প্রদর্শনী হলো আমার। আমার দুজন প্রাক্তন অধ্যাপক আমার কাজ দেখে অবাক। একজন তো বলেই দিলেন আমার কাজ কুর্বের মতন প্রায়, যা এক অসাধারণ প্রশংসা। তাহলেও বলব, আমি কুর্বের মতো অাঁকতে চাই না। আমার ছবি কুর্বের মতো ভালো না হলেও আমি আমার মতোই অাঁকতে চাই।
এছাড়াও আরেকটা প্রাইভেট গ্যালারিতেও আমার একটা ছবি আছে। ছবিটা ভয়ানক ভালো, হয়তো আমার জীবনের সেরা। একটা পেশাদার মডেলের ন্যুড স্টাডি। মেয়েটার বয়স চল্লিশ, দেখলে মনে হয় ফুসফুসের যক্ষ্মায় ভুগছে। যেসব লোকের বিচারবুদ্ধিতে আস্থা রাখি তারা সবাই বলছে, এ আমার সেরা কাজ, আর যাঁদের 888sport live chatকলা সম্পর্কে কোনো ধ্যান-ধারণাই নেই তারা অাঁতকে উঠে বলছে, দূর, যাচ্ছেতাই! আমি প্রথম গোত্রের লোকদের ধার ধারি, কারণ আমার জানতে বাকি নেই যে, এই ছবিই আমার মাস্টারপিস!
আগস্ট ১৯৩৩ : এখন আর সেই উচ্ছ্বাস আর বিনোদন নেই ভেতরে। নিঃসন্দেহে আগের চেয়ে অনেক ভালো অাঁকি, তবে ভেতরের সেই আগুনটা নেই। কে জানে, সেজন্যই হয়তো অাঁকাটা ভালো হয়। রঙ নিয়ে কাজ করি এবং লাইনের প্রতিটা লজিককে অনুসরণ করে এগোই। এই জ্ঞানটা হয়েছে অ্যাদ্দিনে যেসবের পেছনে একটা লজিক, যুক্তি থাকতে হবে, যে-লজিক আমি আগে উদ্ধার করতে পারিনি। পূর্বের স্ফূর্তি ও বিনোদনের পর্বে কোনো কিছুকে সুন্দর করে তুলতে আমি যুক্তিকে বলি দিয়েছি। আর নিজেকে বুঝিয়েছি – ও ঠিক আছে, কিছুকে সুন্দর করতে ওটা করতেই হয়।
আজ কিন্তু নিজের ওপর আস্থা অনেক বেড়েছে। আগের চেয়ে কাজ অনেক ভালো হয়েছে। আজ আর অাঁকার জন্য মেজাজমর্জির ওপর নির্ভর করতে হয় না আমাকে। বরং নিজেকে বারবার প্রশ্ন করতে হয় যে, এত সুস্থ মন, মেজাজ, মাথা কি প্রকৃত 888sport live chatের পক্ষে ভালো? কোনো বাড়তি যোগ, এফেক্ট ছাড়া কাজ ঠিকঠাক হওয়ার তো?
অক্টোবর ১৯৩৩ : অবশেষে আমি আমার পূর্বের প্রতিভা পুনরুদ্ধার করছি। দুঃখের বিষয়, 888sport live chatকলা ছাড়া আর সব কিছুতেই আমি সারাক্ষণ সন্দেহ, প্রশ্ন, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, অনাস্থার মুখোমুখি।
এইসব দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব আমার নিজের প্রত্যয় ব্যক্ত করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ সুন্দর করে বাঁচতে হলে আমাকে আমার বিশ্বাস নিয়েই বাঁচতে হবে। তা ব্যক্তও করতে হবে। এটা নিয়ে অন্তত আমার কোনো সন্দেহ নেই।
পড়তে পড়তে এক সময় ভিক্টরের খেয়াল হলো, কালো আকাশ একটু একটু নীল হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ ভোর এলো বলে। ঠিক তখনই দেশে ফিরে সিমলা থেকে লেখা চিঠিটা হাতে উঠে এলো। এই চিঠিতে এক নতুন অমৃতার মুখচ্ছবি দেখেছিল ভিক্টর। বড় আনন্দ পেয়েছিল এর প্রতিটি বাক্যের ভাবনায়। ঊষার আলোয় পড়বে বলে চিঠিটা হাতে নিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল ভিক্টর।
আকাশের আলো যখন বেশ কিছুটা ছড়িয়েছে, ১৯৩৫-এর চিঠিটা পড়া ধরল প্রয়াত অমৃতার নিঃসঙ্গ বর। আর এই প্রথম অবিরত অশ্রুধারা নামল ওর চোখ বেয়ে। অমৃতা লিখেছিল…
আমি কাজ করছিলাম আর আমার বিবর্তনও শুরু হচ্ছে। ইউরোপে আমার মনে হতো যে, ওখানকার ওই ধূসর আকাশ আর অদ্ভুত আলোর জগৎ থেকে আমাকে পালাতে হবে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য। এখানে সব কিছুই স্বাভাবিক। ইউরোপে সব রঙই যেন কী রকম অন্যরকম, ওখানকার বড় বড় শহরের ধূসরভাব আর ঠান্ডা আমার কোনোদিনই সয়নি। ওখানে আমি কখনো সৎ ও স্বাভাবিক হতে পারিনি। কারণ আমি জন্মেই ছিলাম রঙের প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে। ইউরোপে শুধু রঙই নয়, সবকিছুই কীরকম পানসে। পাশ্চাত্যে বসে আমরা প্রাচ্যের মতো অাঁকতেই পারব না, কারণ একজন শ্বেতাঙ্গ এবং একজন হিন্দুর চোখে দেখা রঙ ভিন্ন হয়; সূর্যালোকই আলোকে আলাদা আলাদা করে দেয় ওদের চোখে। শ্বেতাঙ্গ মানুষের ছায়া হলো নীলচে খয়েরি এবং হিন্দুর ছায়া হলো স্বর্ণালি সবুজ। আমার ছায়া হলুদ। ভ্যান গঘ শুনেছিলেন যে, হলুদ হলো দেবতাদের প্রিয় রঙ। এবং কথাটা ঠিক।
ভিক্টরের পড়া যখন শেষ হলো ততক্ষণে তীরের মতো এক ফলা সূর্যালোক এসে পড়েছে ওর হাতে ধরা অমৃতার চিঠির ওপর।
ছয়
অমৃতা যেভাবে চেয়েছিল ঠিক সেরকমই দাঁড়িয়ে গেল ব্যাপারটা। ডিসেম্বরের ২১ তারিখ উদ্বোধন হলো ওর একক প্রদর্শনীর। শুধু সেই এককটির অনুপস্থিতিতে!
কাপুরথালার কঁওয়ার দলীপ সিংহ উদ্বোধন করলেন। পাশে ছিলেন তাঁর রানীও। পঞ্জাব লিটেরারি লিগ হলো তখন বাস্তবিকই চাঁদের হাট। লাহোরের কেউকেটাদের ভিড়ে গমগম করছে। বুদ্ধিজীবীদের গা-ঘেঁষাঘেঁষি। ছবির সামনে দাঁড়িয়ে অনেকেরই প্রথমবারের মতো মনে হলো, মেয়েটা তো সাংঘাতিক ছিল!
ভিক্টর একটু একটু করে ছবির ইতিহাস বোঝাচ্ছিল অতিথিদের কাউকে কাউকে, আর থেকে থেকে অবাক হচ্ছিল – এই তো সেদিনের কথা, তাও ইতিহাস হয়ে গেল! ভবেশ সান্যালের মতো কেউ যখন কোনো কোনো ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ‘মাস্টারপিস’ শব্দটা উচ্চারণ করেছেন ভিক্টর একটা শিহরণ বোধ করেছে ঠিকই, সেইসঙ্গে কিছু 888sport sign up bonusও ঝলকেছে মনের কোথাও।
একটা 888sport sign up bonus হাঙ্গেরির। যখন অমৃতা ওর পোর্ট্রেট অাঁকল। স্যুট, মাফলার-টাফলার চড়িয়ে ও যখন পোজ দিয়ে বসল, মনে একটা ক্ষুদ্র প্রশ্ন : হাতে কি সিগারেট থাকবে?
ও কী ভেবে আনমনে হাতের সিগারেটটা পাশের টেবিলে অ্যাশট্রেতে শুইয়ে রেখেছিল। অমৃতা ইজেলের সামনে থেকে ওকে একনজর দেখেই এগিয়ে এসে সিগারেটটা তুলে দিয়েছিল হাতে। বলেছিল, সিগারেট ছাড়া ভিক্টর এগানের ছবি সম্পূর্ণ নয়। জানো না, উইলিয়ম ক্রমওয়েল কী বলেছিলেন ওঁর পোর্ট্রেট আর্টিস্টকে?
কী? – জিজ্ঞেস করেছিল ভিক্টর।
– দেখো বাপু, মুখের যা-যা ত্রুটি আছে রেখো। অাঁচিলটাও বাদ দিও না।
এই অমৃতাই ভিক্টরের আরেকটা পোর্ট্রেট অাঁকার সময় ওর ঠোঁট থেকে সিগারেট সরিয়ে মাথায় একটা হ্যাট চাপিয়ে দিয়েছিল। ভিক্টর যখন জানতে চাইল, ‘সিগারেটে কী সমস্যা?’ অমৃতা বলেছিল, টুপি আর সিগারেট দুটো রাখলে অ্যামেরিকান টাইকুন কিংবা গ্যাংস্টার লাগবে।
ভিক্টর যখন বলল ‘তাতে দোষ কী? আমি তো আমিই থাকব’ ও বলেছিল, না, তুমি ওদের থেকে অনেক ভালো।
– দেখতে, না লোক হিসেবে?
– অবশ্যই লোক হিসেবে। তবে লোক কেমন তা তো কিছুটা ধরা পড়ে তাকে কেমন দেখতে তার মধ্যেও।
কথাটা শুনে একটা সুন্দর হাসি হেসেছিল ভিক্টর।
এসে গিয়েছিল। তবে পোর্ট্রেটটা যে কোথায় এখন কেউ জানে না।
সন্ধেশেষে অতিথিরা যখন চলে গেছেন, ভিক্টর ফের সিগারেট ধরিয়ে অমৃতার এক আত্মপ্রতিকৃতির সামনে একটা সোফায় গিয়ে বসল। গতকাল সন্ধ্যায় ছবি টানানোর তদারকি করতে এসে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল ভিক্টরের। মনে হলো, চাইলে ওর অনেক ছবির সঙ্গেই সংলাপ তৈরি হয়ে যায়। ওরা যেন নির্জনতা খুঁজছে কথা বলবে বলে। ভিক্টরের ডাক্তারি মন সেটাকে স্নায়ুর দুর্বলতা মনে করে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিল।
কিন্তু আজ ১৯৩১-এর সেই আত্মপ্রতিকৃতিটার সামনে বসতে ফের কেন একটা সংলাপের আভাস তৈরি হলো ওর মাথায় খেলল না। কেবলই মনে হচ্ছে, অমৃতা ওকে মনের বেদনা জানাচ্ছে মা ভিক্টরকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করছে বলে। বলছে, মা বললেই তুমি খুনি হয়ে যাও না। সারা পৃথিবী বললেও না। আমি নিজে তোমাকে কম কষ্টে ফেলিনি, কিন্তু এই কষ্টটা তোমার প্রাপ্য ছিল না। এরপর তুমি হাঙ্গেরি ফিরে গেলে আমি তোমাকে বারণও করব না। শুধু অনুনয় করব, আমার অাঁকা তোমার পোর্ট্রেটটা সঙ্গে করে নিয়ে যেও, প্লিজ।
নিজের মাথার মধ্যে অমৃতার এসব কথা নিজেরই কল্পনা, অটো-সাজেশন বুঝে ভিক্টর উঠে ছবিটার খুব সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এ ওর নীল আর সবুজ রঙের প্রাধান্যে গড়া বলে চিঠিতে লিখেছিল অমৃতা। কিছু হলুদও আছে সেইসঙ্গে। তবে রঙ নয়, এ-ছবিতে অমৃতার মুখের ভাবই ওকে টেনেছে এতদিন। আর আজো টানছে। শাশুড়ির অদ্ভুত ও নির্মম অভিযোগের এই পর্বে ছবিটা ওকে ভরসা জোগাচ্ছে – ধৈর্য ধরো। এই তো আমি তোমার পাশে।
ছবির সামনে দাঁড়াতে অবশ্য মাথার ভেতরের সেই সংলাপ ক্রমশ মিলিয়ে গেল। মনে এলো সন্ধেবেলায় রানী দলীপ সিংহের কথাটা – আপনাদের কী সৌভাগ্য অমৃতার তুলি-কালিতে ধরা রইলেন!
তখন মনে এসেছিল আরেকটা বৃত্তান্ত, অমৃতার মুখে শোনা। এই তুলি-কালিতে ধরা পড়ারই এক বৃত্তান্ত। ঘটনাটা ইন্দুকে নিয়ে। ইন্দু আর আরেক কিশোরী দনিজ প্রুতোকে নিয়ে ‘কিশোরীরা’ ছবি অাঁকার সময়। বছরটা ১৯৩২, জায়গাটা প্যারিস। ছবিটা এত পছন্দ হলো ভিক্টরের যে, অমৃতা ওকে ছবি অাঁকার ফ্যাসাদ নিয়ে বলা শুরু করেছিল।
জানো ভিকি, ইন্দু আমার দুই মডেলের একজন, বেচারি সকাল থেকে সন্ধে পোজ দিয়ে বসে, অথচ ওর পোর্ট্রেট যেন শেষ হয়েও হয় না। ওদিকে দনিজ শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে ওর পোর্ট্রেটের জন্য সিটিং দিতে আসে। আর সেরকমই এক সিটিংয়ের সময় আমি হেলায় হারালাম। কী জন্য? না কোলারোসির এক পেশাদার মডেলকে নিয়ে একটা কাজ করব বলে। তার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টও হলো, আর হলো তো হলো সেই দনিজের সিটিংয়ের সময়ে। অগত্যা আমার স্টুডিওতে ওর জন্য একটা ‘সরি!’ নোট রেখে কোলারোসি ছুটলাম। আর গিয়ে কী দেখলাম? মডেলের সেদিনের আর সব কাজ অন্য এক স্টুডিওতে বদলি হয়েছে। তাই আমার সঙ্গে সিটিংটাও বাতিল হয়েছে!
খুব দুঃখ করে একটা চিঠি লিখতে হয়েছিল দনিজ প্রুতোকে সেদিন।
তো এই দনিজ আর ইন্দুকে মুখোমুখি বসিয়ে সারতে পেরেছিলাম ‘ইয়াং গার্লজ’ ছবিটা। বাবার কী আহ্লাদ, যেদিন শেষ হলো! একই ছবিতে ওঁর দুই কন্যে হাজির। একজন অাঁকছে, আরেকজন পোজ দিচ্ছে। তড়িঘড়ি ক্যামেরা নিয়ে স্টুডিওয় হাজির বাবা; 888sport live chatী, তাঁর ছবি আর দুই মডেলকে নিয়ে একটা কম্পোজিশন তুলতে হবে। সে ছবি তুমি দেখেছ।
তুমি এও জানো, ভিকি, যে আমার ওই ‘ইয়ং গার্লস’ ঘ্রঁ সালঁর সোনার মেডেলে পেয়েছিল। আর ওই এক ছবির জোরেই ইনস্টিটিউটের অ্যাসোসিয়েট মেম্বার নির্বাচিত হয়ে গেলাম। কিন্তু ছবির আসল চেহারাটা তখনো সেভাবে লোকের চোখে পড়েনি।
ছবিটা আসলে আমার পরের দিকের এক সেরা ছবি ‘ট গার্লজ’-এর পূর্বসূরি। যেখানে এক শ্বেতাঙ্গিনী এবং এক কৃষ্ণাঙ্গীকে নগ্নিকা করে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে এক প্রাচ্য-পাশ্চাত্য অবস্থান ও সংলাপ সৃষ্টি করেছি। 888sport promo code-পুরুষ সম্পর্কের বাইরেও যে 888sport promo code-ও-888sport promo code সম্পর্ক, বিরোধ, জাতি ও বর্ণভেদের সূক্ষ্ম অথচ জোরালো অন্তঃশীল ধারা একটা বহতা, তার সম্ভবত প্রথম দৃশ্যায়ন সেটাই। সেই মুখোমুখি হওয়ার শুরু আমার এই শরীরায়। একটু অন্য মেজাজে যদিও।
অন্য মেজাজ বলছি কেন? কারণ ‘ইয়ং গার্লসে’র মেয়ে দুটো দুই বর্ণের বলেও তারা মুখোমুখি আলাপে বসে। দুই মেয়েরই নিজের নিজের ব্যক্তিত্ব স্পষ্ট ধরা আছে ওদের বসা ও মুখের ভাবে। কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েটির টান টান হয়ে বসার সঙ্গে শ্বেতাঙ্গিনীর আয়েশের সঙ্গে এলো চুল সম্পূর্ণ এলিয়ে বসার একটা অন্য দ্যোতনাও চেয়েছি। বিশেষ করে সেই এলো চুলে কিছুটা আড়াল করার চেষ্টা আছে ওর নগ্ন বুক। কৃষ্ণাঙ্গীর চাহনিও কি কিছুটা ওই স্তনের ও চুলের দিকে নামানো নয়?
আড়াল আরো একটা আছে। চুলের আড়ালে শ্বেতাঙ্গিনীর সুন্দর মুখ। দুটো সুন্দর মুখের দ্বিত্ব চেয়েছিলাম, একজনের আংশিক নগ্নতা এবং একটা মোটামুটি বড়লোকি পরিবেশে ওদের আড্ডায় বসা। কালো বা বাদামি যাই বলো, ওই মেয়েটা শ্বেতাঙ্গিনীর সঙ্গে এক ধরনের মমতা চাইছে, শ্বেতাঙ্গিনীর আয়েশের মধ্যেও ঈষৎ অস্বস্তি আছে। ওর চাহনি বোঝার চেষ্টা করো, যা চুলে 888sport app। বা নগ্ন স্তন, যা-ও আসলে চিরুনির অাঁচড়ে চুল দিয়ে 888sport app। কৃষ্ণাঙ্গীর চুলই বরং নিতান্ত ঘাড় অবধি, আর পেতে অাঁচড়ানো।
তুমি লক্ষ করে দ্যাখো, দু-মেয়ের মধ্যে আসলে আমিই ছড়িয়ে আছি। দু্ই গোলার্ধে আমারই ছড়িয়ে থাকা। নিরন্তর নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা। স্বগতসংলাপ। ভুল বললাম? স্বগতোক্তি নয়। স্বগতভাষণ নয়। স্বগতসংলাপ। ভেতরে ভেতরে এমনই বিভক্ত। দিন ও রাতের মতো নয়, যা আপনা-আপনিই ধরা দেয়। বরং বলি, শেষ দুপুর ও বিকেলের মতো কাছাকাছি এসেও রোদের হেরফেরে দূরে।
ভিক্টরের সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল। আরেকটা ধরাতে ধরাতে মনটা বেরিয়ে এলো অমৃতার ছবি থেকে। একবার ইচ্ছে হলো অমৃতার নিজের নগ্নিকা প্রতিকৃতিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর। প্রদর্শনী শেষ হলে ওটা সম্ভবত ইন্দু নিয়ে যাবে দিল্লি। ফের কবে দেখা হবে কে জানে!
তখনই খেয়াল হলো সন্ধে শেষ হয়েছে। হল বন্ধ হওয়ার সময় হয়েছে। তাছাড়া কাল তো আসা আছেই। হাতে একটা সুভ্যেনির আর ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে রাতের অন্ধকারে নেমে গেল ভিক্টর। ওর চোখে পড়ল না, ঠিক তখনি ওর সেই প্রিয় জংলা সবুজ শাড়িতে অমৃতা তরতর করে উঠে গেল লিগ হলে, যখন একটা-একটা করে বাড়ির আলো নেভানো শুরু হয়েছে।
সাত
নিভল না শুধু প্রদর্শনীর ঘর, নেভার কথাও না আরো এক ঘণ্টা, যেমন একটা অনুরোধ এসেছিল সহসা এবং রক্ষিতও হলো।
সবুজ শাড়িতে অমৃতা এসে বসল ছবির অমৃতার মুখোমুখি। ১৯৩২-এর যে-আত্মপ্রতিকৃতির নাম রেখেছিল ‘সেলফ পোর্ট্রেট ইন গ্রিন’। সবুজ শাড়িতে অমৃতা যেন ছবিটার আয়নামূর্তি হয়ে এসেছে।
আগে কথা বলল ছবিই – কী রে – ইন্দু, তোকে সেই আমিই সেজে আসতে হলো আজো? অমৃতার চেহারায় নিজেকে সাজিয়ে আনা ইন্দু বলল, আসার তো কথা ছিল, কিন্তু সবার সামনে আসব না তাও জানতাম।
অমৃতা জানতে চাইল, কী কারণ?
ইন্দু বলল, লোকের ঘটা করে অমৃতাস্ত্ততি আর কত শুনব?
– তুই তো এমন ছিলি না…
– কবে?
– সেটা আর অত মনে পড়ে না এখন…
– তবু এলি…
– নিজের মতো করে তোকে দেখব বলে।
– শুধু দেখবি?
– কথাও আছে।
– আরো কথা?
– এই তো শুরু!
– মানে?
– শুধু তোর ছবিই কথা বলবে? আমি নীরব রইব নিশীথিনীসম?
ইন্দু উঠে একটা-একটা করে গ্যালারির ছবি নিভিয়ে কেবল ‘সবুজ শাড়িতে আত্মপ্রতিকৃতি’র সামনে এসে বসল। একটাই আলো তখন ও-দিকটায়। ঘরের এক ধারে না-জ্বালানো ফায়ারপ্লেসটার দিকে চোখ গেল। অন্ধকার ঘনিয়ে ঘরটা আরো ঠান্ডা হয়ে গেছে। হাতের ওভারকোটটা গায়ে চড়াতে যাচ্ছিল ইন্দু যখন অমৃতার গলা ভেসে এলো, বেশিক্ষণ অমৃতা সাজা পোষাচ্ছে না?
ইন্দু কোটটা হাতেই রেখে দিয়ে বলল, তোর নিজের পক্ষেও অমৃতার জীবনটা কাটানো খুব সহজ ছিল কি?
অমৃতা নীরব হলো অনেকক্ষণ। যেন ঘরে ইন্দুও নেই, ছবির অমৃতাও নেই। একটা শান্ত অস্থিরতা একটু একটু করে ছড়াতে লাগল।
শেষে অমৃতা বলল, আসার জন্য ধন্যবাদ।
ইন্দু বলল, সবাইকে ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য কী চাস? ধন্যবাদ?
অমৃতা বলল, তোর না জানার কথা নয় যে, ইউরোপে যে-কোনো অজুহাতে একটা থ্যাংক ইউ ঠুকে দেওয়া যায়। ‘শুভদিন’ বা ‘শুভরাত্রি’ জানালেও থ্যাংক ইউ শুনতে হয়। ভারতে অতখানি চল নেই ধন্যবাদের। তা বলে মরে বিদেয় হওয়ার জন্যও ধন্যবাদ?
ইন্দু বলল, এই না হলে অমৃতা! সকালে চলে যাওয়াটাও যে কত রহস্যময় করা যায় তাও তো করে দেখালি। যেন একটা নতুন 888sport live chatকীর্তি। তা নিয়েও কত চর্চা চারিদিকে। আর গেলি তো গেলি, এমন একটা ঘটনার পর গেলি যে, সারাটা জীবন ওই ঝগড়ার রাতটা ভর করবে আমার 888sport sign up bonusতে। ধন্যবাদ দেব না?
অমৃতা বলল, তোর 888sport sign up bonus ভুলে যাওয়ার নামান্তর। তুই যে কোনো বিদেশিকে বিয়ে করে ইউরোপে পড়ে নেই তার বড় কারণ আমি। খুব সম্ভবত জেরো নামের ওই ছোকরাকে স্বামী হিসেবে বরণ করে পড়ে থাকতিস প্যারিসে। তুই বিয়ে করতে না চাইলেও বাবা-মা খুব একটা তোয়াক্কা করত না। আমি তোর হয়ে বলেছিলাম।
ইন্দু বলল, থ্যাংক ইউ।
– বিয়ে করিস বা না করিস তোকে আর আমাকে ইউরোপে ফেলে রাখার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল বাবা। তেমনি একটা প্রস্তাব দিয়ে চিঠি লিখেছিল বাবা। প্রায় বিস্ফোরক চিঠি। আমি উত্তর দিইনি। জানতাম এক সময় ওর ধৈর্যচ্যুতির আগুনটা নিভে আসবে। এলোও। আমি ফিরতে পারলাম। তুই আরো একটা বছর পড়ে রইল। তবু ফিরলি।
ইন্দু ফের বলল, থ্যাংক ইউ।
– এই ধন্যবাদগুলো আজ খুব অসার শোনাচ্ছে। কিসের জন্য ধন্যবাদ সেটা মনে রাখাটা বেশি প্রয়োজনীয়। মনে রাখাটাই ধন্যবাদার্হ।
ইন্দু বলল, কিছু কিছু জিনিস ভুলে যাওয়ার জন্যও ধন্যবাদ প্রাপ্য হয় আমার। তাই না?
– কী রকম?
– এই যে আমি তোর বোন। সামান্য এক বছরের ছোট। একসঙ্গে বড় হলাম, কিন্তু ছায়ার মতন। হয়তো মনেও রাখতে চাইছিলাম না যে, আমি ইন্দিরা। যা-ই মনে রাখি তা-ই অমৃতা। যা এক ধরনের ভুলে যাওয়া। তুই মানিস সেটা?
অমৃতা চুপ রইল ছবির মতো। তারপর এক সময় ছবির মতোই সরব হলো। বলল, তাহলে এখনই তো সেই সময়, নিজেকে নিজের মতো করে মনে পড়ানোর। কী বলিস?
ইন্দু বলল, পারি না তো, অমরি। সেই বিশ্রী রাতের পর থেকে কম চেষ্টা করেছি! তোকে না জড়িয়ে নিজেকে 888sport sign up bonusতে আনতে পারি না।
– বেশ তো, সেভাবেই নিজেকে মনে মনে ডাক। পারলে আত্ম888sport sign up bonus লেখ।
– বয়ে গেছে। তুই তো জীবনী, আত্মজীবনীকে দূর ছাই করতিস।
– এখনো করি। বলতাম, আত্মজীবনী নিজেকে তুলে ধরার মঞ্চ ছাড়া কিছু নয়। অহঙ্কারের ঝঙ্কার সর্বক্ষণ। বলেওছিলাম, কেউ লেখে না ‘যেদিন আমি প্রথম সমুদ্র দেখলাম’। লেখে ‘সমুদ্র যেদিন প্রথম আমাকে দেখল’।
– কেন লিখেছিলি তাহলে জওহরলালকে, ‘অবশ্য তোমার আত্মজীবনী একটু অন্যরকম হলেও হতে পারে। কারণ তুমি সময় সময় তোমার খ্যাতির ছটা ঝেড়ে ফেলতে পারো?’
– বলতে পারিস আমিই তখন কিছুটা মোহাচ্ছন্ন।
– তুই? মোহাচ্ছন্ন? সেসব দৃশ্য চাক্ষুষ হলে তোর একটা জীবনীই লিখে ফেলতে পারতাম। সমস্ত নগ্ন সত্য ঢেলে। ‘ছবির আড়ালে অমৃতা’। কিংবা ‘নগ্ন অমৃতা’। নয়তো ‘অমৃতার অমৃতা’।
হলজুড়ে অমৃতার আত্মপ্রতিকৃতির হাসি খেলল। ইন্দু বুঝল না হাসিটা আমাদের না বিদ্রূপের। তবু হাসিটা ওর ভালো লাগছিল। ও অমৃতার ছবির দিকে চেয়ে থেকে মন দিয়ে ওর হাসি শুনল। কিশোরী বয়সে হাঙ্গেরি কিংবা প্রথম যৌবনে প্যারিসে যে-হাসি শুনে ও অদ্ভুত ফুর্তির ছোঁয়া বোধ করত।
হাসিটা এক সময় থেমেও গেল। প্রবল হাসির পরে যে-নীরবতা কখনো কখনো একটু ভয়ের কারণ হয়। ইন্দুকে জিজ্ঞেস করতেই হলো, কেন, টাইটেলগুলো খুব বিদ্ঘুটে লাগল বুঝি?
অমৃতার উত্তর এলো, তোর ওই নামকরণগুলো শুনতে শুনতে একটা আইডিয়াও এলো। খুব অদ্ভুত আইডিয়া যদিও।
ইন্দু বলল, শুনি তবু…
– জীবনী ও আত্মজীবনী মিলিয়ে কিছু কি সম্ভব নয়?
– কে লিখবে?
– কেন, তুই।
– সে তো আত্মজীবনী হবে।
– আর আমি। শুধু তোর লেখনীতে।
– কে পড়বে?
– মা আর বাবা।
– আর?
– ভিক্টর আর কল্যাণ।
– আর?
– ইকবাল, কার্ল, হেলেন, জওহরলাল…
– আর?
– সমস্ত প্রাক্তন প্রেমিক ও প্রেমিকা এবং সমস্ত অনুরাগী ও অনুরাগিণী এবং…
– এর পরেও এবং?
– এবং উত্তরকাল।
হঠাৎ ফের এক নীরবতা নামল। ইন্দুর মুখে কোনো কথা জোগাচ্ছিল না। অমৃতার মুখে এরকম গভীর দাবির কথা আগেও শুনেছে ও। কালে কালে অন্য অনেকে সে-কথা স্বীকারও করে নিয়েছে। যেমন ওর দাবি যে, ভারতের চিত্র888sport live chatে ও-ই আধুনিকতার হোতা। যেমন ওর ধারণা যে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য-শৈলী ওর অাঁকাতেই প্রথম মিশেছে। যেমন ওর এক সারিতে বসানো রবীন্দ্রনাথ, যামিনী রায় ও নিজেকে।
পরিবেশটাকে হালকা করার জন্য শেষে ও বলল, কিন্তু আমার হাতের লেখা তো তোর অপছন্দ।
অমৃতা বলল, তাতে কী? মা ও বাবা তো পড়তে পারবে।
– পড়ে উনুনে গুঁজে দেবে।
– দিক। সব সত্যি কথাই তো আগুনে যায়, হিন্দুর শরীরের মতো। সত্য হলো সেই আগুন যা নিজেকে দহন করে। বাবা শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলে, না? –
– সত্যের দ্বারাই সত্যের মুখ আলোকিত এবং আবৃত।
– তবু কী জানিস? তোর হয়ে লিখতেই আমার তৃপ্তি হবে। নিজের দৃষ্টিতে লেখাটাই গন্ডগোলে।
– তবু লিখবি। তাতে শেষ অবধি জীবনী ও আত্মজীবনী কিছুই বর্তাবে না। একটা 888sport alternative link হয়ে যাবে।
– আমার হাত দিয়ে 888sport alternative link! তুই খেপেছিস?
– 888sport alternative link এভাবেই হয়, ইন্দু। সময়-অসময়, সত্যি ও মিথ্যে, সম্ভব ও অসম্ভব, 888sport sign up bonus ও বি888sport sign up bonus, গদ্য ও 888sport app download apk, অনুরাগ ও বিরাগ, দূরত্ব ও নৈকট্য, আলো ও অন্ধকার, তত্ত্বু ও মনস্তত্ত্ব, হাসি ও কান্না, প্রেম ও দ্বেষ, স্বপ্ন ও বাস্তব, অমৃতা ও ইন্দিরা, অমরি ও ইন্দু এবং অমৃতা, অমৃতা, অমৃতা… সব মিলেমিশে একরাশ অসংলগ্ন পৃষ্ঠায় একটা বাতিল বহুবর্ণ তেলরঙ ছবির মতো। আমার যে-অজস্র ছোট্ট ছোট্ট ড্রইং, স্কেচ বা রঙিন পোর্ট্রেট ছড়িয়ে এখানে-ওখানে ওরাও আমার না-লেখা 888sport alternative linkের ছেঁড়া পাতা। এতকাল আমি তোকে বাস্তবের চেহারায় এঁকেছি রঙ আর তুলিতে। এবার তুই আমায় ধর কালি আর কলমে নিজের ঔদ্ধত্যে। দেখিস তুই পারবি।
ইন্দু অবাক হয়ে শুনছিল অমৃতার কথা। যেভাবে শুনল প্যারিসের দিনগুলোয় প্রুস্তের 888sport alternative link, দস্তয়েভস্কির 888sport alternative link, বোদলেয়ার বা ভের্লেনের 888sport app download apk নিয়ে ওর বিচার ও আবেগের কথা। একবার তো নিজেই লিখে ফেলল 888sport app download apk মনের কথা বোঝাতে। এই ছোট্ট জীবনেও তো নিজেকে কী সুন্দর এঁকে গেল লেখায়-লেখায়, চিঠিতে-চিঠিতে। ইস, জীবনটা যদি আরো কিছু বছর পেত!
সময় এরকমই। অমৃতার জীবনের দৈর্ঘ্য নিয়ে যখন ভাবছে ইন্দিরা, তখন পাঞ্জাব লিটেরারি লিগ হলের ম্যানেজার এসে জানাল, ম্যাডাম, এবার কিন্তু হল বন্ধ করব।
ইন্দু ওর চটকা থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ও, তাই তো! এই বাড়তি সময়টুকুর জন্য অজস্র ধন্যবাদ।
ইন্দু ফের গায়ে কোট চড়িয়ে হেঁটে বেরিয়ে যেতে ম্যানেজারের বেশ কৌতূহল ও কৌতুক বোধ হলো। এক ঘণ্টা এক্সট্রা টাইম নিয়ে ভদ্রমহিলা তো একটাই ছবির সামনে চুপ করে কাটিয়ে গেলেন পুরো সময়টা!
ইন্দু শীতের অন্ধকারে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে এক ঘোর অস্বস্তির মধ্যে পড়ল। এরকমই এক রাতে ও বাড়ির থেকে দূর করে দিয়েছিল অমরিকে। দুহাতে দুটো ক্যানভাস নিয়ে ও বাগান পেরিয়ে রাস্তায় চলে গিয়েছিল। তারপর হেঁটেছিল হয়তো সারারাত।
একটা বড় শ্বাস ছেড়ে ইন্দু নিজেকে বলল, এটাই তো 888sport sign up bonusর কাজ কারো জীবনে! দুঃখ, লজ্জা আর তীব্র অনুশোচনা, যা দিয়ে নাকি 888sport alternative link হয়!
পরের শ্বাসে আরেকটা কথা উত্তরোল – হায়, 888sport alternative link!
দ্বিতীয় অ্যালবাম
এক
আমার সব মনে পড়া ছবি দেখার মতো। সেইসব অনেক ছবিরই সঙ্গী ধ্বনিগুলো হয়তো হারিয়ে গেছে, কিন্তু ছবিগুলো দিব্যি টুকটুক করছে রঙে, আলোয়, আলোছায়াতেও।
আলোছায়াতে, বলতে হলো, কারণ আমার সবচেয়ে দূরের 888sport sign up bonus হলো হাঙ্গেরির। যে-দেশের শহর বুদাপেস্তে আমি জন্মেছিলাম এক শীতের জানুয়ারি ভোরে। অত শীতে, ওই ঠান্ডার দেশে, আমার নিশ্চয়ই মায়ের পেট থেকে বেরোতে আরাম হয়নি। যেমন, এক শীতের লাহোরে, মধ্যরাতে, প্রায় বিনে চিকেচ্ছেয় দুনিয়া থেকে পাততাড়ি গোটাতেও মন দেয়নি।
তবে এই আসা আর যাওয়া, দুটোই, আমাদের ইচ্ছেয় তো নয়। কার ইচ্ছেয়? এর উত্তরে তো সব মানুষই প্রায় এক কথায় বলে দেবে – ঈশ্বর। তেমনও লোক খুব কম নয় যারা বলবে, জানি না। অবিশ্য যারা বলবে ‘ঈশ্বর’, তাদেরও ওই শব্দটায় আসতে নানা রাস্তা নিতে হয়। ঈশ্বর, আল্লাহ, গড আমরা সবাই জানি, এ ছাড়াও ভাষার হেরফেরে, বিশ্বাসের তারতম্যে, ইতিহাস-ভূগোল-নৃতত্ত্বের পার্থক্যে আরো কত-কত নাম থেকে গেল, কত নাম হারিয়েও গেল। জেয়ুস, জুপিটাররা তো ছিলেন এক সময়; কিন্তু এখন কোথায়? হিন্দুদের তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর কজনের নাম জানি?
এইসব ভেবেই কি ইতালিতে বালিকা বয়েসে গির্জায় যেতে অত আপত্তি ছিল আমার? রসুন, রসুন, সময়মতো সেসব গল্পে আসব। আমি আর আমার ধর্ম!
আগে আমার জন্মবৃত্তান্তই শোনাই…
বুদাপেস্তে জন্মের কথা বলেছি। আমার বাবা উমরাও সিংহ শের-গিল পাঞ্জাবের এক অভিজাত পরিবারের শিখ। মা মারি অাঁতোয়ানেত একজন শৈল্পিক গুণাবলির হাঙ্গেরীয়। ওদের বিয়েটারও সাতকাহন শুনে আসছি কবে থেকে। আমার জীবনকথা বলতে হলে ওদের সেইসব কথারও কিছু তো এসে পড়ে। আমার শোনাতে মন্দও লাগে না। শুনিয়েওছি আগে, সংক্ষেপে। এবার আরো সংক্ষেপে…
বাবার বংশ পাঞ্জাবের, পরে ইউপিতে বসত নেয়। তারও ইতিহাস আছে। আপাতত এটুকুই জানাই – বাবার সত্যিই কোনো পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। বেশ উদাস প্রকৃতির মানুষ বাবা; কাজেকর্মে-স্বভাবে দার্শনিক, পড়াশোনার বিষয় তুলনামূলক ধর্ম, সামাজিক মুক্তি আন্দোলনের এক হোতা।
সেই বাবা বিয়ে করল মাকে, এক সূক্ষ্ম রুচির হাঙ্গেরীয়, যে আমাকে সেই শৈশব থেকে 888sport live chatকলার পথে টেনে নিয়ে গেছে। আজ অবধি ছবির রাস্তায় যদ্দুর আসতে পেরেছি, এর অনেকখানি পথ মা পাশাপাশি হেঁটেছে। সে এক যুদ্ধই বলা যায় সময় ও পরিবেশের সঙ্গে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক শুরুর মুখেই তো জন্ম। কিছুদিনের মধ্যে বোন ইন্দিরা হলো। বুদাপেস্তেই। যেখানে যুদ্ধ শেষ হওয়া অবধি থাকতেই হলো আমাদের।
বড় হওয়ার পর হাঙ্গেরির যেসব দৃশ্য এঁকেছিল তার শৈশবের দেখা হাঙ্গেরির দৃশ্য কি খুব দূরের? জানি না, এই নিজের কথা বলতে বলতে হয়তো হদিস পাব। আসলে দৃশ্যের লোকজন, পরিবেশ, ঘটনাই তো সব নয়, তার আলো ও অন্ধকারই তো দেখার চোখ, মন ও 888sport sign up bonusকে নিয়ন্ত্রণ করে। একেবারে শৈশবের চোখ কি যৌবনেও ফিরে আসে? সেই আলো, সেই আকাশ, সেই রোদ অথবা মেঘ, সেই নদী, সেই ফুল, মানুষের সেইসব মুখ?
কিন্তু একেবারে শিশুকালে যে কেমন ছিলাম তা-ই বা মনে রাখব কী করে? সৌভাগ্যবশত আমি মারি অাঁতোয়ানেত গটেসমানের কন্যা। হ্যাঁ, গটেসমান; ওটাই মার পরিবারের পদবি। আমার জন্ম বুদাপেস্ত নদীর বুদাপাড়ের এক সাততলা বাড়িতে; যার মাঝখানে একটা মস্ত উঠোন ছিল, দেয়ালের গায়ে অাঁকা টাইল, আর উঠোন থেকে ধরা দেয় নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে একটা গির্জা। বাড়ির ঠিকানা ৪ নং সিলাগি দেশো স্কোয়ার, যেখানে এক সময় থেকেছেন কম্পোজার বেলা বার্তক। হ্যাঁ, বেলা বার্তক। ১৯২২ থেকে ১৯২৮। আমি জন্মালাম ১৯১৩-র ৩০ জানুয়ারি, এক সময় চলেও গেলাম ও-বাড়ি ছেড়ে।
জন্মের পর ছিলাম তো মোটে কমাস। তবু বাড়িটার একটা ছবি আমার মনে থেকে গেছে। ছবিটা অাঁকা নয়, লেখা। মার লেখা। লিখেছিল…
হাঁটু অবধি বরফ বুদার অাঁকাবাঁকা রাস্তায়। হাঙ্গেরির চারশো বছরের সুন্দর, পুরনো, আজব রাজধানী শহরটার গড়ে ওঠাও দানিউব নদীর পাড় বেয়ে। আজ রোববার… বরফে মোড়া, ঝকঝকে, জানুয়ারির সকাল।
একটা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া শিস দিতে দিতে বয়ে আসছে দানিউব থেকে। ফলে বাড়ির জানালাগুলো ভারী হয়ে আছে হিমে, জানুয়ারির হিমশীতল ভোরে। জানালার কাচে ফুল, তারা, কত কিছুর নকশা ফুটে আছে হিমের আন্তরণে, যেন কোনো অদৃশ্য, জাদুকরী হাত এসে ওদের সাজিয়ে দিয়ে গেছে। জানালা দিয়ে চোখ মেললে দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে ফেলে তুষারের শ্বেতশুভ্র ঔজ্জ্বল্য – কেমন এক পরীর দেশের দৃশ্যই বুঝি – আর আরেকটু দূরে দৃষ্টি গেলে ঝলসে ওঠে পশ্চাদপটের বরফ888sport app বুদা পাহাড়।
এমনি একদিনে জগতে এলো অমৃতা। কানে বাজছে পরিবারের প্রিয়, পুরনো ডাক্তারবাবুর উল্লাসের ডাক, ‘আহা রে, কী সুন্দর একটা মেয়ে! কী সুন্দর, কী মিষ্টি! ঈশ্বরের আশীর্বাদ!’
মিনিটকতক পরে নার্স কাঁথায় মুড়ে একটা ছোট্ট পোঁটলা তুলে দিলো হাতে… আর অত সুন্দর একটা দৃশ্যে ভেতরটা আমার খুশিতে চমকে গেল, গলায় একটা ভালোলাগার কান্না থমকে রইল। তাই ঠোঁটে যে-কথা ফুটব-ফুটব করছিল, তাও যেন স্তব্ধ হয়ে পড়ল। নির্মল আনন্দে আমি কাঁদতে থাকলাম।
প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের ঘণ্টা এক সময় বাজা শুরু করল, মধ্যাহ্ন ঘোষণা করতে। এক নতুন জীবন পৃথিবীতে এসেছে এবং তার আগমন ঘোষণা করেছে প্রথম কান্না দিয়ে।
… এ তো গেল আমার জন্মস্থান আর জন্মদিনের বর্ণনা। আমার জীবন888sport sign up bonusকে নিটোল করার জন্য আরো কিছু ছবি রেখেছে মা। একেক সময় ভাবি, আমার জগৎ ও জীবন দেখার মধ্যে অনেকখানি সেঁধিয়ে আছে মার দেখার চোখ, দৃষ্টিকোণ। নাহলে আমি যে কেমন শিশু ছিলাম তা উদ্ধার করতেও মার কাছেই হাত পাততে হয়। আমার একেবারে প্রথম শৈশব আমি মার কাছ থেকে জানি। মা লিখেছিল…
ও ছিল এক সুন্দর শিশু, যার কালো, রেশমি চুল নেমে আসত ঘাড় অবধি। ওর বড় বড় চোখ দিয়ে অপূর্ব বিস্ময়ে জগৎ দেখত।
প্রথমে ছোটখাটো, নরমসরম চেহারার অমৃতা ক্রমে গোলগাল, হৃষ্টপুষ্ট একটা বাচ্চা হয়ে গেল। তখন চুপচাপ দোলনায় শুয়ে থাকত, আর কেউ কাছে এলেই বিগলিত হাসি মেলে ধরত। আমি দুমাস ধরে ঘাঁটাঘাঁটি করেছি, যে-সুখের সময়গুলো জীবনেও ভুলতে পারব না। খুব শিগগির ও সারা ঘরজুড়ে হামা দেওয়া ধরল, সেইসঙ্গে পাখির মতো রুপোলি কণ্ঠে কিচির-মিচির করা।
দিনকে দিন ও বড়, শক্তপোক্ত আর জমকালো হলো আর ন’মাসে পড়তে এক্কেবারে এক পরীই বনে গেল। সারা খাটে ছুটে বেড়াচ্ছে আপন মনে হেসে, কেউ ধরতে গেলে খাটের রেলিং ধরে ধরে আবার ছুট।
১৯১৪-র মধ্য জুলাইয়ে আমরা উত্তর হাঙ্গেরির বসনিয়ো গ্রামের এক চমৎকার গ্রীষ্মাবাসে থাকতে গিয়েছিলাম। অমৃতা এখন হাঙ্গেরিয়ানে ছোট্ট ছোট্ট বাক্য বলতে পারে। পাড়ার ছেলেপুলেদের সঙ্গে কী হইচই, দৌড়ঝাঁপ, দৌরাত্ম্য তখন ওর। তবে ওর সেরা আমোদ তখন ছোট বোন ইন্দিরার চান দেখা। এখনো চোখের সামনে দেখতে পাই ওই দৃশ্য। ইন্দিরা বাথটাবে চানে, আর অমৃতা পা টিপে টিপে এসে ওর খেলনাগুলো ছুড়ে ছুড়ে জলে ফেলছে বোন খেলবে বলে। সেসব হলো সেলুলয়েডের মাছ, ব্যাঙ, হাঁস – যারা জলে পড়েই ভেসে উঠছে – যা দেখে অমৃতার কী মজা! কী হাসি! বোনের ওপর দিদির তখন এত টান যে, রোজ নতুন নতুন জন্তু-জানোয়ারের নাম ধরে ডাকা শুরু হয়েছে।
মার লিখে যাওয়া এই ছবিটার সঙ্গে আমি মাঝে মাঝে মিলিয়ে দেখেছি বাবার লেখা আমার ছবি। মার লেখায় যেমন আমাকে নিয়ে কতকগুলো দৃশ্য আছে, বাবার লেখায় আছে জ্যোতিষগুণ, যেন কোষ্ঠীবিচারের পর্যবেক্ষণ। লক্ষণ নিরূপণ। বাবা লিখেছিল…
ওর জন্মের পরে পরেই অমৃতাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ওর অপেক্ষাকৃত চওড়া কপাল দেখে। মাথার কাছে কপালটা যেন আরো চওড়া। যাতে আভাস দেয় যে, ওর মস্তিষ্ক অতি আদর্শ প্রকারের, আদিম মগজের গড়ন থেকে ঢের আলাদা। ওর শৈশবের সেরা 888sport sign up bonus আমার এটাই যে, ওকে কখনো অন্য বাচ্চাদের মতো চেঁচাতে দেখিনি। ওকে দেখতাম শুধু বড়-বড় চোখে ঘুরে ঘুরে দেখছে আশপাশ, মানুষজন।
বাবা-মার 888sport sign up bonusর পাশে আমার নিজের এক টুকরো শৈশব888sport sign up bonus তুলে ধরলে মন্দ হয় না। আমি মাঝেসাঝে মজা করে তো বলিই, আমার সব 888sport sign up bonusই চিত্রপটে। সাত বছর বয়েসেই ডায়েরি ভরে ফেলেছি ছোট ছোট রূপকথা, 888sport app download apk আর অাঁকিবুকিতে। শোনা রূপকথা নয় কিন্তু, নিজেরই মনগড়া রূপকথা। বড় হয়ে সেইসব স্কেচ দেখে নিজেই নিজের তারিফ করে বসেছি। পরে বুঝেছি কেন করলাম।
আসলে আমার শৈশবটাও একটা প্রাপ্তবয়স। নাহলে ওই কচি বয়েসে জামাকাপড় ছেড়ে একবার উদোম হয়ে নেচে ফেলেছিলাম কী করে মাসতুতো দাদা ভিক্টরের সামনে? লজ্জা কি ছিল না? ছিল। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল ভালোলাগা। একটা সময়কে, একটা পরিবেশকে, কী জানি হয়তো একটা মানুষকেও! হ্যাঁ, একটা ছেলেকে ছেলে হিসেবে চিনে। মেয়েদের থেকে আলাদা একরকম বুঝে। আজ আর বলতে পারব না, কেন সেদিন এমনটা করে বসেছিলাম। তবে ভিক্টরকে কিছু দেখানোর বাসনা নিশ্চয়ই ছিল। একটু নাচ, ওকে পছন্দ করা এবং নিজেকে। একদম খোলামেলা করে।
যাক গে, যে-888sport sign up bonusর কথা বলছিলাম, একরাশ ঝাপসা 888sport sign up bonusর মাঝখানে ওই যে একটা জ্বলজ্বলে 888sport sign up bonus। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে…
আমার মনে হয় আমি এক্কেবারে ছোটবেলা থেকে ছবি অাঁকছি আর রঙ করছি। এও মনে আছে যে, ওই সময় যে-উপহারের জন্য মুখিয়ে থাকতাম তা হলো রঙের বাক্স, রঙিন পেনসিল, ড্রইং পেপার আর ছবির বই। ওই বয়েসেও বেশ স্বাধীন স্বভাবের ছিলাম বলে ছবি অাঁকার বইতে শুধু রঙ চাপাতে ইচ্ছে করত না, ভীষণ অপছন্দ ছিল ব্যাপারটা। কোনোদিন বড় কাউকে কিছু এঁকে দিতে দিইনি, যা দেখি সব বাচ্চাদের খুব পছন্দ। ছবি অাঁকার সবচেয়ে কঠিন যে-কাজ সেই ড্রইংটা কেউ সেরে দিলে তাতে রঙ বসিয়েই তাদের ফুর্তি। আমি বরাবর নিজের ছবি এঁকে তাকে রঙ করেছি, আর কাউকে সে-কাজে সংশোধন বা খবরদারি করতে দিইনি।
আমার এইটুকুই মনে পড়া। তবে মা দেখি সেই দিনগুলোর আরো একটা মনের মতো ছবি লিখে রেখেছে। আজ যখন নিজেকে নিয়ে ভদ্র, সংযত কিছু বলার চেষ্টা করছি, তখন মার ওই বর্ণনাটাও মনে করব। দানিউবের পাড়ে, দুনাহারাস্তি গ্রামের ওই কঠিন সময়, কিন্তু সুখের দিনগুলো নিয়ে বলতে গিয়ে মা লিখেছে… r (চলবে)

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.