পাগলা কানাই ও তাঁর প্রাসঙ্গিকতা

সাধক পাগলা কানাইকে নিয়ে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সূচনাতেই অভিনন্দন জানাই বঙ্গ রাখালকে। বাংলা গানের একটি বিশেষ সাংগীতিক ধারা ‘জারিগান’-এর প্রবর্তক হিসেবে খ্যাত এই মনীষীকে নিয়ে অল্পবিস্তর গবেষণা হয়েছে। তবে সংগীতবিদ্যার মানদণ্ডে নৃতত্ত্ব ও সমাজতাত্ত্বিক নিরীক্ষণের অবস্থান থেকে তাঁকে নিয়ে পর্যালোচনার সময় এসেছে। চারণ কবিগণ আপন সৃজনেই ভাস্বর, কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণার উল্লম্ব অবস্থান থেকে সুচারুরূপে পর্যবেক্ষণ করলে এবং তা থেকে প্রকৃত নির্দেশনা পেলে তাঁদের মূল্যবান সৃষ্টিকে সমাজ  পরিশোধিত করতে পারে। পাগলা কানাইয়ের (১৮০৯-৮৯) গানে তৎকালীন মুসলমান সমাজের সাংস্কৃতিক মনস্তত্ত্বের যে-বীক্ষণ ধরা পড়ে, তা সমকালের বাস্তবতায়ও  অনেকটা প্রযোজ্য। এখন পর্যন্ত বাংলার ধর্মান্তরিত মুসলমান সমাজ তার স্বকীয় সংস্কৃতির দিশা পায়নি। ঐতিহ্যবাহী ও আমদানিকৃত কোনো কিছু নিয়েই এখনো দ্বিধা ঘোচেনি। অথচ আঠারো ও উনিশ শতকের কবিগণ গভীর অবলোকনের মধ্য দিয়ে যে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন, তা এখন পর্যন্ত ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ উভয় আদর্শকে আস্থা দান করে চলেছে। ফলে এই লোকসাধকগণ যতটা 888sport live football ও সংগীত বলয়ে তাৎপর্যময়, তাঁর চেয়েও অধিক তাৎপর্যময় রাজনীতি ও সামাজিক ইতিহাস প্রাঙ্গণে।

বিচিত্র ও অফুরন্ত সংগীতের এই দেশে লোকসংগীতকে প্রধানত দুটি ধারায় ভাগ করা শ্রেয়। প্রথমটি আঞ্চলিক ও সাধারণ পর্যায়ের, যা রচয়িতা দ্বারা নির্ণেয় নয়, অর্থাৎ আত্মনির্লিপ্ত। এই দলে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, পালাগান প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় দলের ধারা আঞ্চলিক রচয়িতা দ্বারা নির্ণেয় হলেও তা আঞ্চলিক পরিসীমায় আবদ্ধ নয়। যেমন জারিগান, কবিগান, বাউলগান ইত্যাদি। বাংলার প্রতিটি দর্শন ও ঐতিহ্যগতভাবে অধ্যুষিত এলাকায় মহৎ সংগীত রচয়িতার আবির্ভাব ঘটেছে, তাঁরা সেই অঞ্চলের তাঁদের দর্শন ও ভাবান্দোলনের মাধ্যমে মানবসমাজকে গতিশীল করেছেন ও পথনির্দেশ দিয়েছেন। ঝিনাইদহ জেলার পাগলা কানাই তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন সাধক, যাঁর ধুয়া ও তত্ত্বগান ব্যতিক্রমী ও অনবদ্য। বাংলাগানের জগতে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারা জারিগানের মাধ্যমে তিনি তাঁর তাত্ত্বিক অবস্থানকে প্রকাশ করেছিলেন। ধুয়াগান বা ধুয়াজারির পাশাপাশি তত্ত্বগান, ভাবগান ও তৎকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক প্রসঙ্গ নিয়ে রচিত গানের প্রায় সবই দিকনির্দেশনামূলক।

তাঁর অনবদ্য ও দিকনির্দেশনামূলক গান মূলত সমাজবদলের হাতিয়ার এবং পরোক্ষভাবে হলেও রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক স্থবিরতার মুক্তির বাণীবাহিত। গ্রামীণ নিরক্ষর জনপদের চিন্তার পরিশীলন ঘটিয়ে, ধর্মের কুসংস্কারে আবদ্ধ স্থবির মানুষকে নতুন প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা দ্বারা তিনি নতুন চিন্তার বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং বাঙালি সংস্কৃতিকে আরো বৈশ্বিক ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন, ঠিক যেমনটি দেখা যায় পাশ্চাত্যে রোমান্টিক যুগের চৈতন্যে। রোমান্টিক যুগ প্রধানত জাতীয়তাবাদ চর্চার পাশাপাশি বহির্বিশ্ববাদের প্রতি অনুরক্তিমূলক। আর এই চেতনা সার্থক হয়েছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উন্মোচনে। দেখা যায় গিওর্গি বিজেত ও ইতালির জাকোমোপুচিনি (১৮৫৮-১৯২৪) প্লট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন জাপানের ম্যাডাম বাটারফ্লাই, রাশিয়ান রিমিস্কি নিকোলাই করসাকভ (১৮৪৪-১৯০৮) আরব্য রজনীর কাহিনি নিয়ে তৈরি করেন সার্থক অর্কেস্ট্রা ‘শেহজাদে’। ঠিক একই সময়ে বাংলার কবিগণ বিদেশি মহাকাব্য, মিথ ও ইতিহাসের বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে রচনা করেছেন 888sport app download apk, 888sport alternative link ও সংগীত। আলাওল, শাহ মুহম্মদ সগীর, দৌলত কাজী প্রমুখ কবি রচনা করেছেন ইউসুফ-জোলেখা, লাইলি-মজনু, সোহরাব-রুস্তম ইত্যাদি বহির্দেশীয় ঘটনা অবলম্বনে পুথি888sport live football। মহান সাধক পাগলা কানাই যুক্ত করেছেন ইরাকে ঘটে যাওয়া মুসলিম খেলাফতের মর্মান্তিক ইতিহাস কারবালার যুদ্ধের ঘটনা অবলম্বনে ধুয়া সংগীত। এর মধ্য দিয়ে গ্রামবাংলায় বিষাদগাথার সংযুক্তি ঘটে এবং সাবলীলভাবে ঢুকে পড়ে পারস্য অঞ্চলের ঐতিহাসিক ঘটনা।

বাংলার লোক888sport live chatচর্চা এতকাল যে অসংখ্য পুরাণ কাহিনির ভেতর দিয়ে চর্চিত হয়েছে, 888sport app download apk ও গানে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলগীত, ভজন, হোরি প্রভৃতির প্রচলন ছিল, মুসলমানদের জন্য মধ্যযুগের শেষ দিকে এসে দেখা যায় ব্যতিক্রমী 888sport live football নিদর্শন। তবে এই বিদেশি কাহিনিগুলিতে ধর্মীয় উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে বরং প্রেমই মুখ্য থেকেছে। ধর্মান্তরিত মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুধর্মীয় পুরাণকথার পরিবর্তে তারা যে মুসলিম ঘটনাবলির কাহিনি তুলে এনেছে তা ধর্মনিরপেক্ষ, আবার সুর প্রয়োগে দেখা যায় কীর্তন ও মঙ্গলকাব্যেরই অনুকরণ। ময়মনসিংহ অঞ্চলে রচিত পালাগানেও প্রধানত ধর্মনিরপেক্ষ মনোবৃত্তি লক্ষ করা গেছে। বিদেশি সংস্কৃতিকে আত্তীকরণের ইতিহাস এদেশে অনেক পুরনো। গান্ধর্ব যুগেও পারস্য ও গ্রিক সংগীত এদেশে এসেছে, কিন্তু তা ছিল শাসকদের ইচ্ছায়। কিন্তু একালে এই বিষয়গুলি গ্রামীণ নিম্নবর্গীয় সমাজ স্বেচ্ছায় গ্রহণ করার আরেকটি প্রধান কারণ হলো তাদের নিজস্ব একটা সাংস্কৃতিক মঞ্চের প্রণোদনা। নিম্নবর্গীয় বাঙালি নব মুসলমান সমাজের কাছে পরিবেশনা 888sport live chat হিসেবে মঙ্গলকাব্য, পুরাণ, উপনিষদ, রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি নিষিদ্ধ না হলেও বিষয়বস্তু অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। ফলে মুসলমানদের জন্য নৈতিক মূল্যবোধের উপযোগী ঐতিহাসিক এবং কাল্পনিক বা কখনো কখনো দার্শনিক বিষয়গুলি মনীষীদের জীবনকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে।

পাগলা কানাইয়ের গানকে অনেকেই বাউল গান হিসেবে বিবেচনা করে আসছেন। সংকলিত এই গ্রন্থের অধিকাংশ রচনার শিরোনামে দেখা গেছে, লালনের সঙ্গে তুলনা করে পাগলা কানাইয়ের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে, কারণ একই অঞ্চলে দুই মহান সাধকের দুই পথপরিক্রমা বিস্ময় ও কৌতূহল তৈরি করে। তবে মূল প্রাসঙ্গিক কথাটি হলো, লালন ছিলেন সুনির্দিষ্ট পথ ও মতের অনুসারী এবং সেই আদর্শের ওপর ভিত্তি করে তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে পাগলা কানাইয়ের পথ ও মত ছিল প্রচলিত সমাজের বাস্তবতার গভীরে গিয়ে তার নানা সংকটকে নিরীক্ষণ ও অনুধাবনের মাধ্যমে সেসবের সমাধান নির্ণয় করা। ফলে লালনের গানে সান্ধ্য ভাষার উপস্থিতি অর্থাৎ বক্তব্যের আড়ালে তত্ত্ব লুকায়িত থাকে; কিন্তু পাগলা কানাইয়ের গানে তত্ত্ব সরাসরি ওপরে উঠে আসে।

ব্রিটিশ উপনিবেশের সঙ্গেও সাংস্কৃতিক উত্থানের কিঞ্চিত সম্পর্ক রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের কালে ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রভাবকে প্রতিরোধের জন্য মুসলিম শাসনের সদ্য পরাজয়ের ক্ষত সারিয়ে তুলতে ইসলামের ইতিহাসের চরিত্রকে সংস্কৃতির উপজীব্য উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করতে চাওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ কর্তৃক হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তুলনামূলকভাবে বেশি সুবিধা প্রদান মুসলমানদের জন্য অবজ্ঞা ও কোণঠাসা করে তুলেছিল। তখন ধর্মীয় মূল্যবোধের বিচারে ইসলামি জাগরণের সংগীত হিসেবে সাযুজ্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ফলে বহির্বিশ্বের 888sport live chatভাবনা বাংলায় গ্রামীণ জনপদসহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঢুকে পড়েছে। ঠিক একইভাবে লোকজীবনের বর্ণনামূলক গীতি তত্ত্বমূলক চর্চায় এই বিদেশি গল্পগাথা হিসেবে নয়, কারবালার যুদ্ধ একটি মর্মান্তিক বিষাদের ইতিহাস হলেও, তা মূলত রাজনৈতিক। কিন্তু বাংলার সংস্কৃতিতে এই ঘটনাটি ধর্মীয় মূল্যবোধ, বিয়োগাত্মক বিষাদ এবং সামাজিক ও মানবিকীকরণের উচ্চপর্যায়কে স্পর্শ করেছে। ফলে ইসলামের ধর্মীয় ইতিহাসের সঠিক ঘটনার তাৎপর্য তুলে ধরা এখানে মুখ্য নয়, বরং প্রকৃত ইতিহাসকে কিছুটা আড়ালে রেখে তার প্রতিফলন ও প্রতিক্রিয়াকেই সামনে আনা হয়েছে। এ-কারণে বর্ণনার পরতে পরতে বাংলার প্রচলিত সাংস্কৃতিক উপাদানই রূপকায়িত ও উপমায়িত হয়েছে। প্রকৃত ইতিহাস থেকে সরে এসে যেন নিজ পরিমণ্ডলের ঘটনায় রূপান্তরিত হয়েছে। 

রূপান্তরের মাধ্যমে আত্তীকরণ লোক888sport live chatের একটি প্রবণতা, বিশেষ করে মৌখিক 888sport live chatে এই প্রবণতার কারণ হলো, প্রকৃত ঘটনা পরিবেশন করার মধ্য দিয়ে দর্শককে খুব বেশি সময় ধরে আটকে রাখা কঠিন। দর্শককে আবেগ দিয়ে বেঁধে রাখার জন্য এবং পরিবেশনা 888sport live chatকে দীর্ঘ স্থায়িত্বদানের জন্য যে অতিরঞ্জিত বিষয় যুক্ত করা হয় তা থেকেই গল্পের ভেতর অনেক কাল্পনিক এবং উপমানির্ভর, উৎপ্রেক্ষানির্ভর অন্য ঘটনাবলি মিশ্রিত হয়। যেমন ইমাম হোসেনের মৃত্যুর সময় তার দুলদুল ঘোড়াকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, ‘তুমি প্রথমে আমার মায়ের কাছে গিয়ে বল যে/ তোমার সন্তান আর ফিরে আসবে না’, এই ধরনের কাল্পনিক বর্ণনা প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে পরিবেশনার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। আবার ভারতীয় পুরাণের বিকল্প হিসেবেও যে এই ধরনের জারি গান রচিত হয়েছে তার প্রমাণ মেলে যেরকম পাগলা কানাইয়ের ‘সখিনার পাশা খেলার ইচ্ছা প্রকাশ পাওয়া’ অথবা ‘কাশেমের মৃত্যু’ মানে সখিনার জন্য – বেহুলা-লখিন্দরের মতো বিষাদাত্মক, এই ধরনের একটি বিকল্প কাহিনি উপস্থাপনায়। এছাড়া যেমন ইমাম হোসেন (রা.)-এর জননী ফাতেমা (রা.)-র সঙ্গে ভারতীয় চরিত্র দৈবকী কিংবা কারবালার জয়-পরাজয়ের সঙ্গে ভরত-রামের যুদ্ধের তুলনা অথবা মদিনার সঙ্গে নবদ্বীপের তুলনা করা হয়েছে, এই সুদক্ষ 888sport live chat নির্মাণকে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, পাগলা কানাই তৎকালীন সমাজের সংস্কৃতির ভেতরে বাঙালি মুসলমানদের জন্য এক সংস্কৃতি জাগরণের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।

এই গ্রন্থে পাগলা কানাইয়ের জীবন ও সংগীতের অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যাবে, এদেশের প্রথিতযশা গবেষকদের সুনির্বাচিত 888sport live এখানে স্থান পেয়েছে। এসব তথ্য ও উপাত্ত থেকে প্রতিশ্রুতিশীল প্রজন্মের জন্য রয়েছে অনেক উদ্দীপক ও রসদ, যা সংগীত বিশ্লেষণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।