রাত আড়াইটা। বাইরে তখন অঝোরধারায় বৃষ্টি ঝরছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘনঘন। হৃৎ-কাঁপিয়ে চলছে টানা বজ্রপাত। বৈদ্যুতিক সংযোগও বিচ্ছিন্ন। দেশলাই আছে, মোমবাতি নেই। এরকম ভর অন্ধকার সঙ্গী করে কফিলভাই ফকিরিতত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় মশগুল। তিনি যেন ‘তত্ত্বের ভা-ার’! উজাড় করে সে-ভা-ার থেকে ফকিরি ভেদবিধি আর গোপন গুহ্যসাধনার বিষয়-আশয় যেন তিনি আপনমনে ঢেলে দিতে লাগলেন আমার মস্তিষ্কে। জানাচ্ছিলেন, বাউল-ফকির-সুফিবাদ নিয়ে অভিজ্ঞতালব্ধ ধ্যান-ধারণা-তত্ত্ব-দর্শন।
কফিলউদ্দিন সরকার প্রয়াত সাধক দুর্বিন শাহের শিষ্য। বাউল-ফকিরি জ্ঞানচর্চায় একজন তাত্ত্বিক হিসেবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক। বাউল-গীতিকার এবং মালজোড়া গানের 888sport live chatী হিসেবেও নামযশ আকাশছোঁয়া। তাঁর রচিত ‘আমি চাইলাম যারে, ভবে পাইলাম না তারে’ কিংবা ‘বন্ধুয়া বিহনে গো, সহে না পরানে গো’ গানদুটি তো এখন তরুণ প্রজন্মের মুখে মুখে ফেরে। সেই কফিলভাই, বৃষ্টিস্নাত শ্রাবণরাতে সিলেট শহরতলির নোয়াগাঁও গ্রামের ঠিক প্রবেশমুখে অবস্থিত আমার ভাড়া-করা দোতলা ঘরের কক্ষে বসে গল্প-আড্ডায় ফকিরি মতবাদ নিয়ে আলাপে রত।
বছর-বারো আগে নোয়াগাঁও গ্রামের যে-দোতলা বাড়িটিতে ভাড়া থাকতাম, সেটি ছিল শাহপরান মাজারের ঠিক পাশেই। প্রতি বৃহস্পতিবার মাজারে বাউল আর ফকিরি গানের আড্ডা বসত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ফকির-বাউলেরা এসে সেখানে ভিড় জমাতেন। এক বৃহস্পতিবার কফিলভাইয়ের সঙ্গে মাজারে রাত এগারোটা পর্যন্ত ফকিরসঙ্গ করে বাসায় ফিরি। বাসায় ফেরার ঘণ্টাখানেক পর ঝুম বৃষ্টি নামে। আশপাশে প্রচুর বাঁশঝাড়। সামান্য বাতাস দিলেই এক বাঁশ আরেক বাঁশের সঙ্গে লেগে কেমন যেন একটা ভীতিকর শব্দ তৈরি হয়। সেদিনের ভীতিকর শব্দমিশ্রিত ঝুম বৃষ্টিতে যখন নির্জন-নিস্তব্ধ হয়ে পড়া গোটা গ্রামটি ভাসছে, তখন অন্ধকার কক্ষে বসে কফিলভাই আমাকে শোনাচ্ছিলেন ফকিরিতত্ত্বের গুহ্য বিষয়াদি।
কফিলভাই বলেন, ‘বাউলদের মতো ফকিরদের মধ্যেও বস্তুসাধনা আছে। ফকিরিধারায় বিন্দুসাধনা অর্থাৎ দমসাধনা করেই তবে সাধকে পরিণত হতে হয়। ফকিরেরা সংসার পাতেন না। কারণ সংসার মানেই তো জাগতিক মায়ামোহে জড়িয়ে পড়া। তবে মানুষের মধ্যে যে সৃষ্টিকর্তা বিরাজমান, সেটি বাউলদের মতো কিছু তরিকার ফকিরও বিশ^াস করেন, ধারণ করেন। এ-কারণে ফকিরদের মধ্যেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষ-ভজনার বিষয়টি রয়েছে। ফকিরি ধারায় নিজেকে জানার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়। নিজেকে জানতে পারলেই সৃষ্টিকর্তাকে জানা সম্ভব, এ-দর্শন ফকিরেরা বিশ^াস করেন। অনেক ফকির আবার গানও রচনা করেন। এসব গানের মধ্যে ফকিরি মতবাদের পাশাপাশি নবিতত্ত্ব, মুর্শিদতত্ত্ব, অধ্যাত্মতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, পারঘাটাতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, দমতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, মানুষতত্ত্বসহ বিচ্ছেদ পর্যায় এবং নানা বাতেনি বিষয়-আশয়েরও গান রয়েছে।’ তবে প্রায় সব তরিকার ফকিরেরা সাধারণত সৃষ্টিকর্তার গুণগানেই জীবন উৎসর্গ করে দেন বলেও তিনি জানালেন।
কফিলভাই এরপর ফকিরি-পরম্পরার তরিকা বা ধারা সম্পর্কে ধারণা দেন। তিনি জানান, লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বের অবসান ঘটার পরপরই বাংলায় ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের জোরেশোরে প্রসার ঘটে। সেটা ১২০১ খ্রিষ্টাব্দে। এ সময়টাতেই মূলত বাংলায় সুফি-দরবেশ-পির-ফকিরদের ভাবধারা বিস্তৃত হয়। এটি সুফিবাদী ধারা হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে। শুরুতে তাঁদের মাধ্যমে বাংলায় ইসলামের বাণী প্রচারিত হয়, এরপর পরম্পরায় তাঁরা বাংলায় মানুষ-ভজনা এবং মানবতাবাদকেও প্রসারিত করার পাশাপাশি সৃষ্টিকর্তার বন্দনায় জীবন অতিবাহিত করেছেন। এই সুফিবাদের প্রভাবেই বাংলায় বৈষ্ণব মতবাদ ও বাউল মতবাদের উদ্ভব ঘটে।
888sport appsে চিশতিয়া, কাদেরিয়া, মুজাদ্দেদিয়া, আহ্মাদিয়া, আদ্হামিয়া, ওয়ায়েসিয়া, নকশবন্দিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া, তাবাকাদি, কলন্দরিয়া, রিফাইয়া, মৌলবিয়া, মুজাদ্দিদিয়া, সাত্তারিয়া, সাদিলিয়া, সানুসিয়া, খিজিরিয়া, মাইজভা-ারিসহ বহু সুফি তরিকাপন্থি রয়েছেন বলে কফিলভাই জানালেন। এসব তরিকাপন্থি মুর্শিদ-গুরু ধরে সৃষ্টিকর্তার সন্ধানে মত্ত থাকেন। কফিলভাইকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, স্রষ্টার প্রেমে বিভোর হয়ে দেহ ও আত্মার মিলনে বিচ্ছুরিত আলোকচ্ছটায় যে মরমি মানবিক সত্তার বিকাশ ব্যক্তির মধ্যে ঘটে থাকে, তাই একজন ফকিরিধারায় দীক্ষিত ব্যক্তিকে প্রকৃত সাধক হতে সহায়তা করে। দীক্ষার পদ্ধতিগত ভিন্নতা এবং দু-একটি সাদৃশ্য ছাড়া বাউল মতবাদের সঙ্গে ফকিরি মতবাদের খুব একটা ফারাক নেই।
বৃষ্টিস্নাত সে-রাতে কফিলভাই আমাকে ফকিরদের চর্চিত বাতেনি বিষয়-আশয় সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা দিয়েছিলেন। শুনিয়েছিলেন বেশকিছু ফকিরিধারার গানও। ফকিরি-মতবাদ নিয়ে পরিচ্ছন্ন ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই তিনি গেয়েছিলেন –
জানবে কিরে গু-া বেটা
তুই ফকিরের ভেদের কথা
ওরে তুই বেটা কালীর পাঁঠা
নাই মনে তোর উজান-ভাটা ॥
ফকিরি নয় রে জুয়া খেলা
ফকির নয় রে দরজালের চেলা
ওরে ফকির নয় রে ফাড়া ছলা
ফকির নয় রে মাইনসা কাটা ॥
ফকির ছিলা বয়তুল আলী
হাসন হোসেন খোদার ওলি
ওরে লিল্লাভাবে রইলা বলি
মাঙ্গি লইলা গলা কাটা ॥
যে হইয়াছে খোদার ফকির
নাই মনে তার ফিকির নিকির
ওরে দমে দমে তার আল্লার জিকির
ছাড়িয়ে ভবের ল্যাঠা ভ্যাঠা
ইয়া হরফে ইয়াদে খোদা
লাম হরফে করছে জুদা
মিম হরফে মোহাম্মদ পয়দা
নু হরফে সারছে গাটা।
ফকিরও ইয়াছিনে বলে
রাসুলুল্লার চরণতলে
ওরে দেখছি ফকির দলে দলে
চিনছি না যে ফকির কেটা ॥
গানটি গাওয়া শেষে কফিলভাই একটু দম নেন। সামনে রাখা পানির বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে পানি পান করেন। বলেন, এটি তত্ত্বজ্ঞানী ফকির ইয়াছিন শাহের রচিত পদ। তাঁর জন্মস্থান ও সমাধিক্ষেত্র ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের লক্ষ্মীপুর গ্রামের কৈলাশহরে। আঠারো শতকের শেষদিকে এ-সাধকের জন্ম। তাঁর কিছু উত্তরাধিকারী বর্তমানে 888sport appsের মৌলভীবাজার জেলায় বসবাস করছেন। গানটিতে তিনি ফকিরদের পরিচিতিসূচক বর্ণনা দেওয়ার পাশাপাশি ফকিরি ভেদের কিছুটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতও দিয়েছেন।
কফিলভাই গল্পে মজে যান। তাঁকে যেন কথায় পেয়েছে। এর মধ্যে আমি মুঠোফোনের টর্চ জ¦ালিয়ে বৃষ্টির ছাঁচ গায়ে মেখে বারান্দা পেরিয়ে রান্নাঘরে যাই। সেখানে দ্রুত দু-মগ চা বানিয়ে অন্ধকার কক্ষে পুনরায় ঢুকি। ধোঁয়া-ওড়া কাপে চুমুক দিতে দিতে কফিলভাই জানান, ফকিরিতত্ত্বের নিয়মানুযায়ী, সাধনপথে মুখ্যত চারটি স্তর অতিক্রম করতে হয়। এগুলো হচ্ছে আলমে নাসুত, আলমে মালুকাত, আলমে জবরুত এবং আলমে লাহুত। এসব স্তর অতিক্রমের ফলে জীবাত্মা আর পরমাত্মা একে অপরের সঙ্গে বিলীন হয়ে এক অপার্থিব প্রেমের পার্থিব রূপ তৈরি করে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহতের দিকে যাত্রা কিংবা পরমসত্তা অর্থাৎ মনের মানুষের সান্নিধ্য অথবা তাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে নেওয়া এবং নিজের ভেতরের আমিকে খুঁজে বের করার প্রবণতা অবশ্যই সাধকদের মধ্যে থাকতে হয়। ফকিরদের তরিকা অনুযায়ী জিকিরের রেওয়াজও রয়েছে। শ^াস-প্রশ^াস নিয়ন্ত্রণ করে দমসাধনার মাধ্যমে জিকিরের পদ্ধতি মুর্শিদ তাঁর শিষ্যকে শিখিয়ে দেন। আর মুর্শিদ-নির্দেশিত পথে নিজেকে সমর্পণ করে সাধনার ধাপগুলো অতিক্রম করে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে হয়।
কথা বলতে বলতেই কফিলভাই পুনরায় গান ধরেন। এবার তিনি গাইলেন লালন-শিষ্য দুদ্দু শাহের রচিত একটি পদ –
কোন দিন থাকিতে সাঁইয়ের খাতায় সই প’লো না
দিনে দিনে গেল দিন আর তো পাবে না ॥
ভেবেছিলেন লঙ্কাপতি স্বর্গ-সিঁড়ি করবেন স্থিতি
আজ করি কাল বলে শেষ হলো না ॥
শুভস্য শীঘ্রম বাণী শাস্ত্রেতে আছে বাখানি
জানলে না কী যে করণী তাইতে সই দিলে না
আহা রে জনম পেলি পেয়ে জনম কি যে হলি
কথা বেচে রাত পোহালি দুদ্দু দিনকানা ॥
গান শেষ করে কফিলভাই এবার এ-গানেরও ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘চুরাশি লক্ষ যোনি 888sport slot gameের পর মনুষ্যজীবন লাভ হয়। তাই হেলায় এই মনুষ্যজীবন বিনষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। বেঁচে থাকা, খাওয়া, ঘুমানো কিংবা বংশবৃদ্ধি করা ছাড়াও জীবনের ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে। আর এই তাৎপর্য হচ্ছে নিজের ভেতরের সত্তার সন্ধান করা। তাই মানবজনমকে কাজে লাগাতেই ফকিরেরা সবসময় সাধনায় থাকেন। দুদ্দুই তো এক গানে লিখেছেন – ‘আপন হাতে জন্ম মৃত্যু হয়/ খোদার হাতে হায়াত মৌত কে কয়/ বীর্যরস ধারণে জীবন অন্যথায় প্রাপ্তি মরণ/ আয়ুর্বেদ করে নিরূপণ, করি নির্ণয় ॥’ অর্থাৎ, বীর্য রক্ষা করলে সুস্থ সবল নীরোগ দেহ ধরে রাখার পাশাপাশি দীর্ঘায়ু লাভ সম্ভব। আর এই বীর্যরক্ষাই বাউল-ফকিরিতত্ত্বে ‘বিন্দু ধারণ’ হিসেবে পরিচিত। কামকে নিয়ন্ত্রণ করতে না-পারলে ফকিরিজীবন বৃথায় পর্যবসিত হয়। ফকিরেরা বিশ^াস করেন – দেহের জাত-ধর্ম-সম্প্রদায় কিছুই নেই।’
সিলেটে ফকিরি মতবাদের বিস্তার ও হালহকিকত নিয়েও কফিলভাই কথা বললেন। তিনি জানালেন, সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর আগমনের পর থেকেই অঞ্চলটিতে ব্যাপকভাবে পির-ফকির-দরবেশ-ওলিদের পদার্পণ ঘটে। এরও আগে-পরে চর্যাপদের বৌদ্ধ-সহজিয়া এবং হিন্দু শাক্ত-বৈষ্ণবদের পদচারণা – সব মিলিয়ে বাউল-ফকিরি ঘরানার এক মরমি ভুবন হিসেবে সিলেট পরিচিত। অবশ্য একই সঙ্গে চট্টগ্রাম, দক্ষিণবঙ্গ, উত্তরবঙ্গ অঞ্চলেও পির-ফকিরদের উজ্জ্বল উপস্থিতির বিষয়টি উল্লেখ করারই মতো। পির-ফকিরেরা ফকিরালি জীবনযাপনের পাশাপাশি ফকিরিধারার গানও রচনা করেছেন। তত্ত্বজ্ঞানপিপাসু ভাবুকের ভক্তিবাদী হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটায় এসব ফকিরি পদ। পির-সুফি-ফকিরদের শরিয়ত, মারিফত, হকিকত আর তরিকত সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা থাকতে হয়। নতুবা পরম সত্যের দিকে ধাবিত হওয়া তাঁদের জন্য একটু কষ্টকরই হবে।
সে-রাতে কফিলভাই ফকিরি মতবাদ নিয়ে আরো খুঁটিনাটি এবং পারিপাশির্^ক কথা বলেছিলেন। শুনিয়েছিলেন তাঁর রচিত বেশকিছু গানও। সে-ঘটনার অনেক অনেক দিন পর কিছুদিন আগে আপনমনে সিলেটের শাহজালাল মাজারে ঘুরছিলাম। আচমকা আমার পথ আগলে দাঁড়ালেন লালশালু-পরিহিত পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ফকির। তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে, যেন অন্তরাত্মা ভেদ করতে চাইলেন। আমি তাঁর চোখে চোখ রাখলাম। এভাবে হয়তো মিনিট দুয়েক কাটল। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না-কাটতেই ওই ফকির আমাকে দুই হাতে আগলে ধরে বুকে চেপে ধরলেন। এমনভাবে ধরলেন, বুঝি শ^াস-প্রশ^াস বন্ধ হওয়ার জোগাড়, যেন-বা বুকের হাড় মড়মড় করে উঠল! কোনোক্রমে ফকিরের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে গভীর নিশ^াস ছেড়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। যখন একটু রাগত ও ধমকের সুরে হুংকার ছুড়ব-ছুড়ব ভঙ্গি করলাম, তখনই ভেসে আসে ওই ফকিরের কণ্ঠ, ‘ব্যাটা! একটু আগলে ধরতেই শ^াস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! সাধনপথের রাস্তা তো কেবল শ্বাস-প্রশ্বাসের খেলা! আমার পথে এলে তো তুই প্রথমেই ফেইলের খাতায় নাম লেখাবি!’
ফকিরের এরকম শ্লেষমিশ্রিত কথার জবাব না দিয়ে বিষয়টি হজম করে নেওয়ার চেষ্টা করি। মনে মনে ওই ফকিরকে একটু বাজিয়ে নেওয়ারও ফন্দি আঁটি। কারণ মাজার ঘুরে ঘুরে অন্তত এ-অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, প্রতিটি মাজারেই বেশকিছু ব্যক্তি থাকেন, যাঁরা ‘ফকির’ সেজে পাগলামি করে কথার ফাঁদে ফেলে
সহজ-সরল মাজার-দর্শনার্থীদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেন। ওই ফকির সেরকমই কেউ কি না, সেটি যাচিয়ে দেখতে তাঁর সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিই। কিন্তু সামান্য সময়ের মধ্যেই আমার ভ্রম কাটে, বুঝতে পারি, যাঁকে ‘পাগল’ ঠাহর করছি, তিনি আসলে ‘পাগল’ নন। আমাকে ভড়কে দেওয়ার কোনো উদ্দেশ্যই তাঁর ছিল না। তবে ঠিক কী কারণে তিনি আমার পথ আগলে দাঁড়ালেন, সেটিও এক রহস্য। যাহোক, এরপর আলাপে আলাপে যা জানলাম, সেটি মোটামুটি এরকম : ওই ফকিরের প্রথাগত অর্থে কোনো পির বা মুর্শিদ নেই। তিনি ‘বেমুর্শিদা’ হিসেবেই পরিচিত। তাঁর আদি বাড়ি চট্টগ্রামে। পর্যায়ক্রমে দেশের নানা মাজার ঘুরে বেড়ান। স্বেচ্ছায় কেউ কিছু দিলে খান, নতুবা দিনের পর দিন উপোস থাকেন। মাজারেই রাত কাটান, মাজারেই গানের জলসা বসান। বাকিটা জীবন সৃষ্টিকর্তার সন্ধানেই কাটিয়ে দিতে চান। মুর্শিদ না-থাকায় ফকিরিবিদ্যা অপর সাধকদের দেখে দেখেই শিখেছেন। ভবসংসার থেকে মুক্তি পেতেই মূলত বিয়েশাদি করেননি।
ফকিরের কথা শুনতে শুনতে তাঁর দিকে তাকাই। দেখি, তাঁর শরীর জুড়ে একটি লোহার শিকলে কেবল তালা আর তালা ঝুলছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ তাঁকে ‘তালাবাবা’ ডাকছে, আবার কাউকে কাউকে বলতে শুনলাম ‘তালা ফকির’। সেই তালা ফকির একসময় তাঁর কাঁধে রাখা বহু পুরনো জোড়াতালি দেওয়া কাপড়ের ঝোলা থেকে বের করলেন একটি ঢপকি। সেটি বাজিয়ে তিনি গান ধরলেন, ‘আলিপের দিকে চাইও রে/ দম গেলে দম আর পাবে না।/ আব আতস খাক বাদ চারিচিজ দিয়া/ এমন সুন্দর তনু বানাইল কানাইয়া ॥/ নাহি দিলো সোনা রুপা নাহি দিলো সিসা/ কেমনে গড়িল তনু মায়ে না পাইল দিশা ॥/ শিতালং ফকির কয় মনে বড়ো ভয়/ আখেরেনি করবা শফা নবি পেগাম্বর ॥’ গান শেষেই তালা ফকির বলতে থাকেন, এটি শিতালং শাহ মহাজনের পদ। সিলেটের জকিগঞ্জে তাঁর মাজার রয়েছে। সৃষ্টিকর্তা পানি, আগুন, মাটি ও বায়ু দিয়ে এই দেহ তৈরি করেছেন। তাঁর সুপারিশেই আখেরে পার পেতে হবে। এ-গানটিতে সে-সতর্কতাই নির্দেশিত হয়েছে। তাই আখেরে পার পেতে হলে সৃষ্টিকর্তাকে মনেপ্রাণে ডাকতে হবেই, এর কোনো বিকল্প নেই।
তাঁকে নাম জিজ্ঞেস করি। তিনি তাঁর প্রকৃত নাম জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে এখন সবাই তাঁকে তালা ফকির নামেই চেনে। এই নামের আড়ালে অনেক আগেই তাঁর মূল নাম হারিয়ে গেছে। কতজন মহাজনের পদ জানা আছে, এ-প্রশ্নের জবাবে তালা ফকির বলেন, অনেক মহাজনের পদ জানি। সৈয়দ শাহনুর, ফকির আফজল শাহ, মুনশি ইরফান আলী, ইয়াছিন শাহ, সৈয়দ আবদুল লতিফ, আরকুম শাহ, শিতালং শাহ, দীন ভবানন্দসহ অনেকের পদ জানি।
কথাপ্রসঙ্গে মনে পড়ে, সিলেট অঞ্চলেরই আরেক প্রখ্যাত বাউল888sport live chatী শাহ আবদুল করিমের কথা। তিনিও অসংখ্য ফকিরিধারার সাধকদের গান জানতেন। এমনকি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিলুপ্তপ্রায় নাগরিলিপিতে রচিত ফকিরদের একাধিক পা-ুলিপিও তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল। একবার শাহ আবদুল করিমের বাড়িতে গিয়ে এক দুপুরে তাঁর সঙ্গে ফকিরি মতবাদ নিয়ে ব্যাপক কথাবার্তা হয়। তিনি সেদিন জানিয়েছিলেন, ‘যা নেই ভা-ে, তা নেই ব্রহ্মা-ে। মানুষের দেহেই সব রয়েছে। বাউলদের মতো ফকিরি মতবাদও একটি গুরুবাদী ধারা। ফকিরিধারার সাধকেরা আত্মানুসন্ধান আর সৃষ্টিকর্তার সন্ধানে জীবন উৎসর্গ করে দেন।’
বাড়ির দাওয়ায় বসে আমাদের কথা যখন চলছিল, তখন ভেতর থেকে নুরুনেছা বোয়াই নামে শাহ আবদুল করিমের এক শিষ্যা তাঁর জন্য চা নিয়ে আসেন। সেইসঙ্গে একটি বাটিতে করে আনেন সেদ্ধ ডিম। করিম আয়েশ করে সেই ডিম চায়ে ভিজিয়ে খাচ্ছেন, যেমনটা আমরা খাই বিস্কুট চুবিয়ে। এর আগে এমন অভিনব দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। তবে আপাতত সেদিকে আমার নজর ছিল না। আমি বরং উৎসুক ছিলাম ফকিরের ভেদ-প্রসঙ্গ নিয়ে করিমের ভাবনাচিন্তা প্রকাশের দিকে। করিম বলছিলেন, ‘ষড়রিপুকে জয় করতে না পারলে সাধক হওয়া অসম্ভব। সেটা ফকিরই হোক আর বাউলই হোক। ফকিরেরা নবি, আদম আর খোদাকে আলাদা করে বিবেচনা করেন না, তাঁরা এঁদের যূথবদ্ধভাবেই বিবেচনা করেন।’
প্রায় একই ধরনের কথা আমাকে শুনিয়েছিলেন করিমেরই স্ব-উপজেলা সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের চ-ীপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব পির নজরুল ইসলাম। ফকিরিধারার তিনিও এক নমস্য সাধক। পির নজরুলের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। রাতবিরেতে কত যে আড্ডা-গল্প তাঁর সঙ্গে হয়েছে, এর কোনো ঠিকঠিকানা নেই। এক জ্যোৎস্নাস্নাত মধ্যরাতে পির নজরুল ইসলাম আর আমি চ-ীপুরের আঁকাবাঁকা মেঠোপথে হাঁটছিলাম। নজরুল আমাকে অনেকটা আবৃত্তির ঢঙে শোনাচ্ছিলেন একের পর এক ফকিরি গান। সেসব গান আওড়ানোর পাশাপাশি ব্যাখ্যাও জানাচ্ছিলেন। ফকিরি দুনিয়ার তাবৎ তথ্য যেন তাঁর কাছে। মানুষটি ফকিরিতত্ত্ব নিয়ে এত জানেন, সেটা সেবারই প্রথম টের পেলাম। নজরুল বলেন, ‘আল্লাকে অনেক ফকির জিকিরের মাধ্যমে 888sport app download for android করেন। আবার অনেক ফকির ফকিরালি গানে আল্লাকে 888sport app download for android করেন। ফকিরিবাদেও নানা তরিকা, নানা ধারা-উপধারা রয়েছে। একেক ধারার একক নিয়মরীতি রয়েছে। বায়েত হওয়ার ক্ষেত্রেও ধারা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। যে যার তার ভাবে আল্লাকে 888sport app download for android করে। এই ইবাদত-বন্দেগির কিছু গোপন পদ্ধতি বা পন্থা রয়েছে। আর এই পদ্ধতি আয়ত্ত করতে হয় মুর্শিদের মাধ্যমে। মুর্শিদ মানেই তো পথপ্রদর্শক। ভক্ত ছাড়া ফকিরিবিদ্যার গোপন পদ্ধতি কারো কাছে বলার রেওয়াজ নেই। অনেকে মুর্শিদের কাছে শিষ্যত্ব নেওয়ার পরও পির হিসেবে কোনো সাধককে মান্য করে থাকেন। একজন পির শিষ্যকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে পারেন।’
888sport appsে খুলনা-যশোরের হজরত খানজাহান আলী, ফেনীর পাগলা মিয়া, দিনাজপুরের হজরত সুফি শাহ সৈয়দ নাসিরুদ্দিন ও চিহিল গাজী, রাজশাহীর শাহ দৌলা, হজরত শাহ মখদুম ও হজরত নানু শাহ ফকির, চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী, বদর শাহ, কাতাল পির, আমানত শাহ, ময়মনসিংহের শাহ মোহাম্মদ সুলতান রুমী, 888sport appর বাবা আদম শহীদ, সিলেটের হজরত শাহজালাল ও হজরত শাহপরান, পাবনার হজরত শাহ দৌলাহ শহীদ, বগুড়ার হজরত বাবা আদম, পির ফতেহ আলী ও হজরত শাহ সোলতান বলখী, রংপুরের মওলানা কেরামত আলী চৌধুরী জৌনপুরি প্রমুখ সাধকের প্রভাবে সুফিবাদী আর ফকিরিধারার বিস্তার ঘটেছে বলে পির নজরুল ইসলাম জানান। তিনি আরো জানান, বঙ্গে সুফিবাদ বিস্তারেরও আগে স্পেন, পারস্য, ভারত, ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ নানা স্থানে সুফিবাদ ধারার প্রচলন ছিল। নজরুল বলেন, ‘মুর্শিদের কাছে বাইয়াত গ্রহণ করা মানেই হচ্ছে আত্মসমর্পণ করা। মুর্শিদ-নির্দেশিত পথে চলাই হচ্ছে মুরিদের ধর্ম। মুরিদ হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তবেই কলেমা পড়িয়ে বাইয়াত করিয়ে থাকেন মুর্শিদ।’
কথাশেষে পির নজরুল ইসলাম আফসোস করেছিলেন এই বলে যে, এখন আর প্রকৃত ফকিরের দেখাই মেলে না! তাঁর সেই আফসোস আর খেদোক্তির কারণেই মনে পড়ে সুনামগঞ্জের ফকির সমছুলের কথা। এই তো কিছুদিন আগে তিনি মারা গেলেন। দু-একবার তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তবে সেসব আলাপে খুব একটা কথাবার্তা হয়নি। যা হয়েছে, সেটিও টুকটাক। ইচ্ছে ছিল, একবার তাঁর কাছ থেকে শুনি ফকিরি সাধনতত্ত্বের বিষয়াদি নিয়ে। সেটা আর হয়ে ওঠেনি। অথচ সিলেটে ফকিরিধারার প্রকৃত সাধক হিসেবে যে কয়েকজন বেঁচে ছিলেন, তিনি ছিলেন উল্লেখযোগ্য। ষোলো বছর বয়সে সংসার ছেড়ে স্ব-জেলার ছাতক উপজেলার জাউয়াবাজারের নিকটবর্তী হাবিদপুর গ্রামের পিরে কামিল শাহ নয়ান ভানু আহমেদের মুরিদ হয়েছিলেন। টানা এক যুগেরও বেশি সময় তিনি মুর্শিদের সেবায় নিয়োজিত থাকেন। পরে, মুর্শিদ-নির্দেশে তিনি নিজ গ্রাম আখতাপাড়া ফিরে মাসিং নদীর তীরে ফকিরি-আস্তানা তৈরি করেন। তাঁর কামেলতিতে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই বায়েত হন।
ফকির সমছুলের দেহ রাখার বছরখানেক আগে তাঁর সঙ্গে একবার সামান্য সময়ের জন্য ঘনিষ্ঠ আড্ডা হয়েছিল। এ-সময়ের মধ্যেই তিনি আমার কিছু প্রশ্নের জবাবে ঐহিক ও পারলৌকিক মুক্তির উপায় সন্ধানরত ফকির-সাধকদের তত্ত্ব নিয়ে খোলামেলা তথ্য জানিয়েছিলেন। তখন আলাপে আলাপে উল্লেখ করেছিলেন তাঁর লেখা সেই গানটির কথা, যেটিতে ফকিরি বিষয়-আশয়ের ভেদ উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি সেদিন বাদ্যযন্ত্রহীন কেবল কণ্ঠের মাধুর্য দিয়ে গেয়েছিলেন : ‘দেহ কোরআন পড়লে না রে মন/ ত্রিশ হরফ এই দেহেতে দিয়াছেন পাক নিরাঞ্জন ॥/ […] / ত্রিশ হরফ কোরআনে আছে, দশ হরফ রয় গোপনে/ জানতে চাইলে এসব খবর, ধরো পিরের চরণে/ ফকির সমছুলে কয় তনে মনে করো আত্মসমর্পণ ॥’ গানশেষে ফকির সমছুল বলেন, ‘কীভাবে এই দেহ তৈরি হয়েছে, সেটি জানতে হলে ত্রিশ হরফ পাঠ করতে হবে। তবে এর বাইরে আরো দশ হরফ রয়েছে, যা কোনো ধর্মগ্রন্থ-শাস্ত্র-পুঁথি কোথাও নেই। আর সেই দশ হরফ জানতে চাইলে মুর্শিদ অথবা গুরুর দ্বারস্থ হতে হয়। মুর্শিদ বা গুরু সেই জানার তৃষ্ণা মেটাতে পারেন, এটিই ফকিরালি ধারার রীতি বা পরম্পরা। এককথায় সৃষ্টিকর্তাকে জানতে হলে আগে নিজেকে জানতে হবে। নিজের আত্মা বা রুহুকে জানার জন্য তাই মুর্শিদ ধরতে হয়। সেই মুর্শিদই দেখিয়ে দেন অনন্তের সন্ধান আর ফকিরিধারার গোপন ও গুহ্য বিষয়াদি।’
ফকির সমছুলের সঙ্গে বছরখানেক আগে শেষবার যখন আলাপ হয়, ততদিনে তাঁর গানের সংকলন আশিকের রত্ন সমগ্র প্রকাশিত হয়ে গেছে। এরই সূত্রে পড়ে নিয়েছিলাম সে-বইয়ে ‘লেখকের কথা’ শিরোনামে প্রকাশিত তাঁর একটি ছোট ভূমিকাও। সেখানে যেন বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে ফকিরি-মতবাদ –
মানুষ সৃষ্টির পরে আল্লাহপাক মানুষের মধ্যে একটি যন্ত্রণা-জ¦ালা দিয়াছেন, যাহাকে ত্রিতাপ জ¦ালা বা যন্ত্রণা বলা হয়। এ ত্রিতাপ জ¦ালা ১. আধ্যাত্মিক ২. আধিদৈবিক এবং ৩. আধিভৌতিক নামে পরিচিত।
মানবজনম একটি দুর্লভ জনম এবং সমস্ত সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জনম। এই শ্রেষ্ঠ জন্ম পাওয়ার পর যদি কোনো মানুষ ত্রিতাপ জ¦ালা থেকে মুক্তি না পায় তবে অন্য কোনো জন্ম দ্বারা এই জ¦ালার নিবারণ করিতে পারিবে না। এই ত্রিতাপ জ¦ালা বা যন্ত্রণা মানুষের মধ্যে কেন দিলেন, একমাত্র উত্তর, তাহাকে পাওয়ার জন্য; এ-জ¦ালায় জ¦লিত হয়ে মানুষ আল্লাহর সন্ধানে ধাবিত হয় শান্তি পাওয়ার জন্য।
সঠিক পথের সন্ধান না পাইয়া মানুষ হতাশ হইয়া এই জ¦ালায় পুড়িয়া মরে। আল্লাহকে চেনার একমাত্র পথ হলো প্রেম। এই পথ ভিন্ন আল্লাহর সন্ধান পাইবার অন্য কোনো পন্থা নাই। এই প্রেমের সন্ধান পাইতে হইলে একমাত্র পির-মুরশিদ, আউলিয়া-দরবেশ, সাধু-সন্ন্যাসী এবং মহৎ ব্যক্তির সান্নিধ্যে যাইতে হয়। তাহাদের কৃপা বা করুণা ছাড়া আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিনের সন্ধান পাওয়ার কোনো উপায় নাই। তাহাদের সংশ্রবে গেলে এবং তাহাদের স্নেহভাজন হইতে পারিলেই সেই পথের সন্ধান পাইয়া, নিজেকে জানিয়া নিতে পারলেই আত্মা বা রুহুকে জানা যায়। এই রুহু সম্বন্ধে যিনি ধারণা দিতে পারেন সেই ব্যক্তিসত্তাকে বলা হয় পিরে কামিল বা সদ্গুরু। এই সদ্গুরু বা পিরে কামিল ব্যক্তিসত্তার উপদেশে স্নেহ ও করুণার পথের সন্ধান মিলে এবং তাহাতে ত্রিতাপ জ্বালার উপশম হয়; ইহাতে মানুষ স্বর্গীয় আনন্দ উপভোগ করে।
প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পড়াশোনা নেই, স্বশিক্ষিত, অথচ কী গভীর তাঁর উচ্চারণ! এ-ভূমিকার প্রসঙ্গ টানতেই তিনি বলেছিলেন, ‘কী জানি, কতটুকু জানি, বলতে পারব না। আমরা আসলে নিজের জীবন আর অভিজ্ঞতায় শিখেছি। মুর্শিদ আমাদের জীবনের সন্ধান দেখিয়েছেন। আমার মুর্শিদ ছিলেন একজন তত্ত্বজ্ঞানী মনীষী।’
ফকির সমছুলের বলা ‘তত্ত্বজ্ঞানী মনীষী’ শব্দটি কেবল একটি শব্দবন্ধই নয়, বরং এটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক বেশি। এরকম ‘তত্ত্বজ্ঞানী মনীষী’ ফকিরের ভূরি ভূরি উদাহরণ অনায়াসেই দেওয়া সম্ভব। ছয় বছর আগে সেরকমই একজন ফকিরের সন্ধান পেয়েছিলাম কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের ডেরায়। নাম ফকির শাবান শাহ। শতবর্ষী এই ফকিরের বাড়ি কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ঢেপাহাটি গ্রামে। প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন শাবান শাহ একের পর এক তত্ত্ব আর দর্শন আউড়ে আমার মুগ্ধতার মাত্রা ক্রমশ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আলোচনার ফাঁকে একসময় তিনি লালন সাঁইয়ের লেখা পদ গাইলেন, ‘হেলায় হেলায় দিন ফুরাল/ আর কি হবে রে এমন মানব জনম।’ গানশেষে নিজেই প্রশ্ন রাখেন, আবার মানব জনম পাওয়ার পর কী হবে? এই জীবনেই আমি কী করলাম? পুনরায় জীবন পেলে কি-ই-বা হবে?
ফকির শাবান শাহের সঙ্গে ঘণ্টাদেড়েক কথা বলে যখন লালন আখড়ার বাইরে বেরোই, তখন চরাচর জুড়ে নেমে এসেছে সন্ধ্যার আলো-আঁধারি। লালন 888sport app download for androidোৎসবে আসা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো জনস্রোত ঠেলে আমি কুমারখালী গ্রামের পাকা রাস্তা ধরে এগোই। এত এত মানুষের ভিড়, এত হই-হুল্লোড় আর হট্টগোল, তবু কেন জানি নিজেকে তখন বড্ড একা একা লাগে। কেন জানি বারবার কানে বাজে শাবান শাহের দরদি কণ্ঠে গাওয়া পঙ্ক্তি ‘আর কি হবে রে এমন মানব জনম’। যে আবেগ আর আকুতি নিয়ে শাবান শাহ সেদিন গাইলেন, সে-দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। এখনো সে-দৃশ্য চোখে ভাসলে এক নিজস্ব নির্জনতা আমাকে পেয়ে বসে। কেবল তখন, কেবল তখনি আমি ডুবে রই নীরবতার অতল গভীরে। সহসা আমার এ থেকে মুক্তি মেলে না।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.