ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী

ফেরদৌসীর সঙ্গে পরিচয় ওদের ধানমণ্ডির ৭নং রাস্তার বাড়িটিতে। আমার বন্ধু সংগীত888sport live chatী জাহানারা নিশি (যে নিজেকে বলত নাড়াচাড়া নিশি) নিয়ে গিয়েছিল ওর বাসায়। চওড়া পাড়ের শাড়ি, পিঠ-ছাওয়া কোঁকড়া চুলে ঘেরা মায়াময় মুখখানি, কপালে মস্ত বড় টিপ। তিন কন্যা ও স্বামী নিয়ে বিশাল শ্বশুরবাড়ির একটিমাত্র ঘরে ঠাঁই।

সামনে একটু খোলা সবুজ বাগান, নিশ্বাস ফেলার। আপ্রাণ চেষ্টায় ঘরটিকে গুছিয়ে রাখা, অহরহ অতিথি আপ্যায়ন, চাকরি সামাল দেওয়া, বাচ্চাদের দেখাশোনা, রান্না করা – সবকিছু হাসিমুখে চালিয়ে গেলেও বুঝতে পারতাম, সে-বাড়িতে তার অবস্থান বড় একটা সুখের নয়। তবে ফেরদৌসীর আচরণে সে-কথা মোটেই বোঝা যেত না। আভিজাত্যের অবহেলা-অবজ্ঞা উপেক্ষা করে হাসিমুখে সবকিছু মেনে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা দেখে অবাক হতাম। ফেরদৌসীর তিন মেয়ে রাজেশ্বরী, রত্নেশ্বরী ও ফুলেশ্বরী আমার মেয়ে তিয়াকে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেত। তিয়াও ও-বাড়িতে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে থাকত।

তাই ফেরদৌসীরা যখন বাসা বদল করে প্রতিবেশী হয়ে এলো পাশের বাড়িতে, বাচ্চাদের আর খুশির সীমা রইল না।

আমারও ভালো লাগল এই ভেবে যে, এতদিনে ওরা নিজেদের মতো করে থাকতে পারবে। নিজের একটা জায়গা পেয়ে ফেরদৌসী ওর গৃহটিকে সুচারু, 888sport live chatমণ্ডিত একটি আবাসে পরিণত করেছিল। গাছপালা দিয়ে ঘেরা বারান্দাটি, গাছের গুঁড়ি, শিকড়-বাকড়, ডালপালা দিয়ে নিপুণ হাতে সাজানো, ওরই মধ্যে ফেরদৌসীর কাজের জায়গা।

আমাদের দুই বাড়ির মাঝের দেয়ালে ছিল একটা লোহার গেট, সবসময় আসা-যাওয়ার জন্য। দিনে বহুবার ওই গেট দিয়ে
আসত-যেত ফেরদৌসী, কখনো আমার মাকে দেখে যেত, কখনো রান্না করে নিয়ে আসত এটা-সেটা। কোনোদিন দেখা না হলে ছোট্ট চিরকুট পাঠাত যেতে বলে। আমাদের বন্ধুত্ব ক্রমে গভীর থেকে গভীরতর হলো। আমি কাজ সেরে ফেরার সময় আগে ওর সঙ্গে দেখা করে বাসায় ফিরতাম। যেমন ফেরদৌসীর গল্প, তেমনি অপূর্ব ওঁর হাতের রান্না।

গল্প শুরু হলে কোনোমতেই ওঠা যেত না। অভিনয় করে, হেসে-গেয়ে, গল্প করে, মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল ফেরদৌসীর। মেয়েরা মেয়েদের মতো খেলত, বীয়ারভাই ঘরে বসে বই পড়তেন, কখনো এসে বসতেন আমাদের সঙ্গে। গল্পে গল্পে দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সন্ধে হয়ে যেত। কিছুতেই ওঠা যেত না। কত মানুষ যে আসতেন ওর বাসায়। কী যত্নে-মমতায় সবাইকে আপ্যায়ন করত।

কখনো কখনো অনেক সকালে ভেসে আসত গানের শব্দ, হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইত ফেরদৌসী -পুরনো দিনের গান, হয়তো-বা হারানো ভালোবাসার!

ফেরদৌসী আমাদের অবাক করে দিত তার নতুন নতুন কাজ দিয়ে। গাছের গুঁড়ি, শিকড়-বাকড়, শুকনো ডাল, পড়ে থাকা, ফেলে দেওয়া আপাততুচ্ছ সাধারণ উপকরণ নিয়ে তার 888sport live chatকর্ম ছিল তাক-লাগানো, আশ্চর্য হওয়ার মতো। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ সে পায়নি, ছিল স্বশিক্ষিত, ভাস্কর, সৃষ্টি করেছে আপনাআপনি সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত অথচ ব্যঞ্জনাময় একেকটি জীবনধর্মী কাজ। অবাক হয়ে দেখতাম, বুঝতে চেষ্টা করতাম কোন গভীর অন্তর্দৃষ্টি থেকে সৃজন করা তাঁর কাজগুলো, 888sport live chatের অন্য এক ভুবন প্রাণ পেয়ে উঠত চোখের সামনে – নিরন্তর সৃষ্টিশীল, নিরন্তর যন্ত্রণাবিদ্ধ এই মানুষটির মধ্যে ছিল তৃতীয় নয়নের অধিকারী এক সত্তা, যাঁর 888sport live chatীজীবন উৎসারিত হয়েছে অসম্মান, অপমান, বঞ্চনা আর গভীর বেদনাবোধ থেকে। কিন্তু কোনো এক আশ্চর্য শক্তিতে, আবেগ-অনুভূতিতে তাড়িত হয়ে কাজ করে গেছে বিরতিহীন, হার মানেনি।

খুব কাছে থেকে ওকে দেখেছি, একেক সময় কী নিদারম্নণ অর্থকষ্ট, অনিশ্চয়তায় একেকটা দিন পার করত, অবর্ণনীয় কষ্ট বহন করে। কঠিন থেকে কঠিনতর সংগ্রাম করে গেছে সারাজীবন। মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে দিয়েছে একাধারে সম্মান, অবহেলা ও কষ্ট থেকে বেঁচে ওঠার প্রেরণা। যন্ত্রণাবোধের বাস্তবতা থেকে উত্তরণের পথে তাই সে খুঁজে বেড়াত অনায়াসলব্ধ সৌন্দর্য, লালিত্য এবং কল্পনার আশ্রয় – তাঁর যাত্রাপথের পাথেয় হিসেবে।

ফেরদৌসীর সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল জীবনের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় ভালোবাসা। জীবনকে যে সে কী ভালোবাসত, এই একজীবনে সে-ভালোবাসা শেষ হয় না। দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, 888sport live chatের প্রতি,সুন্দরের প্রতি, এমনকি নিজের সংসারের প্রতি ছিল তাঁর গভীর ভালোবাসা আর মমতা। ভালোবাসত সাজতে, সাজাতে। পথের ধুলো থেকে কুড়িয়ে এনে কোনো আশ্চর্য জাদুতে বদলে দিত একেকটি তুচ্ছ উপকরণকে, রূপ দিত অনন্যসাধারণ 888sport live chatে। তাঁর গভীর জীবনবোধ, অভিজ্ঞতা তাঁকে শিখিয়েছে হার না মেনে 888sport live chatের ভুবনে নিজের আসনখানি প্রতিষ্ঠিত করতে।

ভালো থেকো, বন্ধু আমার, শান্তিতে থেকো। যে-জীবনকে তুমি প্রচণ্ড ভালোবাসতে, সে-জীবন তোমাকে ধরে রাখতে পারল না; যেখানে থাকো, ভালো থেকো গভীর ভালোবাসায়।