ফেলে আসা মাটি : জলপাইগুড়ি

সুরজিৎ দাশগুপ্ত

মাটির সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক নাড়ির বন্ধনের মতো। যে-মাটি ফেলে এসেছি সেটা হলো জলপাইগুড়ির মাটি। এই মাটি আমি বংশগতভাবে পাইনি, পেয়েছি আমার গর্ভধারিণীর কাছ থেকে আর সে-মাটি আমি ফেলে এসেছি মায়ের শেষ নিশ্বাস ত্যাগের সঙ্গেই। ব্যাপারটা খুলে বলি। জন্মেছিলাম কাশীপুরের রতনবাবুর ঘাটের কাছে কোনো বাসাতে। মা তখন ছিলেন কাশীপুরের নর্থ সুবারবন হাসপাতালের লেডি ডাক্তার। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো বিরোধের জবাবে কাশীপুর হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে তিনি ১৯৩৫-এ পাবনা হাসপাতালে চাকরি নেন। তখনকার শুধু দুটো 888sport sign up bonus মনে আছে আজো : আমাদের বাসার বাউন্ডারি ওয়ালের ওধার থেকে অজানা কেউ মাথা তুলেছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। সেই ধড়ছাড়া মুণ্ডুটাই আমার সবচেয়ে পুরনো 888sport sign up bonus। অন্য 888sport sign up bonusটা হলো, আমার দুহাতের পাতা ঘায়ে ভরে গিয়েছিল, কারণ আমি তখন নাকি খপখপ করে খুব ব্যাঙ ধরতাম। সেই পাবনার হাসপাতালে একবার একটা মেডিক্যাল ইন্সপেকশন বোর্ড গিয়েছিল, সেই বোর্ডের সুপারিশে মাকে নিয়ে আসা হয় জলপাইগুড়িতে ১৯৩৭ সালে।
মাকে হাসপাতাল কম্পাউন্ডেরই দক্ষিণ প্রান্তে কোয়ার্টার্স দেওয়া হয়। হাসপাতালের মূল দোতলা বাড়ি ও মায়ের কোয়ার্টার্সের মধ্যে ছিল ২০-২৫ ফুটের ব্যবধান। কোয়ার্টার্সের সামনের ফাঁকা জমিটা বাঁশের নিচু বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয় আর পেছনের অংশে দেওয়া হয় প্রায় আট-দশ ফুট উঁচু টিনের পাঁচিল। হাসপাতাল ও মায়ের কোয়ার্টার্সের সামনে ছিল যে-রাস্তাটা সেটা যে কোনো জেলা শহরের সদর রাস্তার পক্ষে যথেষ্ট চওড়া। এই রাস্তাটার দক্ষিণ প্রান্ত পৌঁছেছে তিস্তা নদীতে, তিস্তার এপাড়ে ছিল কোর্ট-কাছারি, ট্রেজারি, জেলাশাসকের দপ্তর ও বাংলো ইত্যাদি, রাস্তাটা সোজা উত্তরে চলে গেছে রাজবাড়ি ছাড়িয়ে গ্রাম-মাঠের দিকে। এই সদর রাস্তার ওধারে ছিল একটা বিশাল বটগাছ – একদিন ঝড়ের সন্ধ্যায় গাছটা পড়ে গেল, পুরের আকাশে যে আড়ালটা ছিল সেটা সরে গিয়ে থেকে-থেকে বিদ্যুৎ ঝলকাতে লাগল।
ওই রাস্তাটার পুবে ছিল জ্যাকসন মেডিক্যাল স্কুল, স্কুলটার বিরাট কম্পাউন্ড ছিল, তাতে ছিল বিশাল ফুটবল মাঠ ও দুটো টেনিস কোর্ট এবং এছাড়াও আরো অনেকটা জমি যেখানে ছোট ছেলেরা ফুটবল খেলত। স্কুলবাড়ি ও মাঠগুলোর পশ্চিমে ছিল একটা ডিম্বাকৃতি ঝিল, ঝিলটার ধারে ছিল সারি-সারি শিরীষ গাছ এবং কয়েকটা বার্মিজ পিঙ্কক্যাসিয়া গাছ। মেডিক্যাল স্কুলবাড়িটার পাশে ছিল আর একটা একতলা বাড়ি যেটাতে ডাক্তারি ছাত্রদের মড়া কাটা শেখানো হতো এবং যেখানে অস্বাভাবিকভাবে মৃতের দেহ ব্যবচ্ছেদ অর্থাৎ পোস্টমর্টেম করা হতো। মেডিক্যাল স্কুলটার সীমানার মধ্যেও অনেক রকম ফলের বড়-বড় গাছ ছিল। আবার স্কুলটার পেছনে ছিল এক মাড়োয়ারির বিশাল ফলের বাগান যেটার মধ্যে ঢুকলে মনে হতো জঙ্গলে হারিয়ে গেছি। আমি একবার এই মেডিক্যাল স্কুলের চারপাশের কিছু ফটো পাঠিয়েছিলাম জীবনানন্দ দাশকে, সেই ছবিগুলি পেয়ে ২৪/৬/৫১ তারিখে আমাকে লিখেছিলেন : ‘জলপাইগুড়ির ঝিল, হাঁস ও শিরীষগাছের যেসব ছবি পাঠিয়েছ – অপূর্ব বোধ হলো। এখুনি ঝিলের পারে ঘাসের ওপরে আকাশের মুখোমুখি নিজেকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। নদী, ঝিল, পাহাড়, বন, আকাশ – কোনো নিরালা জায়গা থেকে এসবের নিকট সম্পর্কে আসতে ভালো লাগে আমার।’
জীবনানন্দকে যে-ছবিগুলো পাঠিয়েছিলাম সেগুলি ১৯৫০-এর জুনের পরে তোলা ছবি। ওই জুনে জলপাইগুড়িতে এক বিধ্বংসী বন্যা হয়। জলপাইগুড়ি শহরে বন্যা ছিল প্রত্যেক বর্ষার এক স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের উঠোনে প্রায় কোমর পর্যন্ত জল হতো। আমাদের বারান্দাটা ছিল মাটি থেকে প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু। সেবারকার বন্যায় আমাদের ঘরে জানালা পর্যন্ত অর্থাৎ উঠোনের ওপরে আট ফুট কি নয় ফুট জল উঠেছিল। সেই বন্যায় আমার ছোটবেলার জলপাইগুড়ির অনেক সৌন্দর্যই নষ্ট হয়েছিল। জীবনানন্দ সেই নষ্ট-সৌন্দর্যের ছবি দেখেই ওই চিঠি লিখেছিলেন।
জলপাইগুড়িতে মায়ের কোয়ার্টার্সের উত্তরে ছিল হাসপাতাল আর দক্ষিণে ছিল একটা বস্তি, তার বাসিন্দারা প্রায় সকলেই ছিল মুসলমান আর বস্তির ছেলেমেয়েরা ছিল আমার ছোটবেলার খেলার সাথি। বাবার কড়া হুকুম ছিল যে, রাস্তায় আলো জ্বলবার মধ্যে বাড়িতে এসে চেয়ার-টেবিলে বসতে হবে। ঘরের মধ্যে চেয়ার-টেবিলে বসে আমি টের পেতাম বস্তির ছেলেমেয়েরা রাস্তার আলোতে খুব হইহই করে নানা রকম খেলাতে মাতামাতি করছে। মহররমের বেশ কয়েক দিন আগে থেকে বাঁশ, বাতা, রঙিন কাগজ ইত্যাদি দিয়ে বস্তির মুখের ফাঁকা জমিটাতে তাজিয়া বানানো হতো আর সন্ধে হলেই তাজিয়া ঘিরে ঢাকঢোল ধুমধুম করে বাজানো হতো। দাদাকে পড়াতে আসতেন মণি সাহা যাঁকে আমরা মণিকাকা বলতাম। আমার লেখাপড়া সম্বন্ধে আমার বাবা-কাকা প্রমুখ গুরুজন হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। ঠিক মনে নেই, কথাটা কোনো গুরুজন বলেছিলেন যে, আমার ভবিষ্যৎ জীবন কাটবে বস্তিতে কালো হাফ প্যান্ট পরে।
যা হোক, মণিকাকা একদিন আমাকে জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে নিয়ে গেলেন সবচেয়ে নিচু ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করতে। ক্লাস থ্রির ক্লাস টিচার মণিকাকাকে বললেন, ‘এর তো অক্ষরজ্ঞানই নেই, ওকে পাঠশালায় নিয়ে যান, আগে অক্ষরগুলো শিখে আসুক।’ মণিকাকা হাল ছাড়লেন না, আমাকে নিয়ে গেলেন হেডমাস্টার মশায়ের কাছে। বললেন, ‘সারাদিন পাশের বস্তির ছেলেদের সঙ্গে মারামারি, কাটাকাটি, লেখাপড়াতে একদম মন নেই, হয়তো ক্লাসে বসলে অন্য ছেলেদের দেখাদেখি লেখাপড়াতে আগ্রহ আসবে। ওর মা লেডি ডাক্তার, দাদা রণজিৎ আপনার ছাত্র, ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়। ওকে পরীক্ষা করে দেখুন, লেখাপড়া হবে না এমন নয়, শুধু যা একটু দুরন্ত।’ হেডমাস্টার মশায় উঠে গিয়ে দেয়ালঘেঁষা আলমারি থেকে একটা বড়মাপের চকোলেট রঙের বই বের করে আনলেন, তারপর তার থেকে একটা 888sport app download apk পড়ে আমার কাছে কী বুঝলাম জানতে চাইলেন। কী উত্তর দিয়েছিলাম মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে যে, অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘মাইগড’। তারপর তাঁর কথাতে স্কুলের ক্লার্ক আমাকে ভর্তি করে নিলেন। সমস্যা হলো আমার নাম নিয়ে। আমার নাম কী জিজ্ঞেস করাতে আমি বলেছিলাম, ‘শ্রীবাস গুডম্যান দাশগুপ্ত।’ শুনে হেডমাস্টার মশায় ফিক করে হেসে ফেললেন। কাশীপুরের বাসাতে একেবারে ন্যাড়া মেঝেতে জন্মেছিলাম বলে আমার নাম রাখা হয়েছিল ভূপাল। আর দাদাকে যিনি দেখাশুনো করতেন গলায় কণ্ঠী সেই মানুষটিকে আমরা ঝিমা বলতাম – ঝিমা আমার নাম রেখেছিলেন শ্রীবাস। আর গুডফ্রাইডেতে জন্মেছিলাম বলে অমরাগুড়ির অখিলদাদু নাম রেখেছিলেন গুডম্যান। অখিলদাদু অমরাগুড়ি ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য ছিলেন, অবিবাহিত ও ভীষণ রাগী ছিলেন বলে বাবা-কাকা-কাকিমারা তাঁকে নিয়ে খুব চর্চা করতেন, কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে তিনি আমার মা ও আমাকে খুব ভালোবাসতেন এবং মধ্যে-মধ্যে চিঠি দিতেন আর আমিও ১৬ বছরে পৌঁছে তিনবার অমরাগুড়িতে গেছি। যাহোক, হেডমাস্টার মশায়ের কথায় আসি। তিনি বললেন, ‘শ্রীবাস গুডম্যান দাশগুপ্ত – অতবড় নাম চলবে না, তোমার নাম বরং সুরজিৎ থাকুক, রণজিতের ভাই সুরজিৎ।’ এভাবে তিনি আমার নাম সুরজিৎ রাখলেন আর সেটাই আজো বহাল আছে।
যিনি আমার নাম রেখেছিলেন সুরজিৎ এবার বলি তাঁর নাম ছিল তামসরঞ্জন রায়। যেবার দেশ স্বাধীন ও বিভক্ত হলো সেবার তিনি আমাদের ক্লাসে এসে বললেন, ‘এই ক্লাস এইটেই তোমাদের স্কুলশিক্ষা শেষ, ক্লাস নাইন থেকে শুরু হবে তোমাদের ইউনিভার্সিটির শিক্ষা।’ এখানে জানাই যে, আমাদের সময় স্কুল ছাড়ার যে-পরীক্ষা হতো তাকে বলত ম্যাট্রিক পরীক্ষা আর ম্যাট্রিক পরীক্ষা হতো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে এবং ক্লাস নাইন থেকেই আমাদের এমন কিছু-কিছু বই পড়তে হতো যেগুলো ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত। হয়তো সেজন্যেই তামসবাবু বলেছিলেন যে, এবার শুরু হবে ইউনিভার্সিটির শিক্ষা। তারপর বললেন, ‘তাই এবারে তোমাদের বার্ষিক পরীক্ষা হবে কার্যত স্কুল ছাড়ার পরীক্ষা। এটা একটা বিশেষ পরীক্ষা। এর প্রশ্নপত্র হবে বিশেষ ধরনের। এর উত্তর লেখার সময় হলে কোনো ইনভিজিলেটর থাকবে না। খাতা ও প্রশ্নপত্র দিয়ে একজন টিচার বেরিয়ে আসবেন, তোমরা উত্তর লিখবে, দরকার হলে বইও দেখতে পারবে, বই দেখে উত্তর লেখার কোনো বাধা থাকবে না। রেজাল্টে ধরা পড়বে এই দুবছরের স্কুলশিক্ষায় কী শিক্ষা তোমরা পেলে।’ আশ্চর্যের বিষয়, সেবারের পরীক্ষায় আমি থার্ড না সেকেন্ড হলাম। অথচ আমার স্থান থাকত সাধারণত কুড়িজনের আগে-পিছে। সেবারে আমি অত সামনে জায়গা পেলাম কী করে তার রহস্য অনেক বছর পরে ভেদ করেছি। এমএ পরীক্ষা পর্যন্ত আমি প্রত্যেক পরীক্ষাতে প্রতিদিন পরীক্ষার হল থেকে খাতা দিয়ে সবার আগে বেরিয়েছি। সেই ক্লাস এইটের পরীক্ষাতে যখন ভালো ছাত্রেরা 888sport free bet login দেখে ভালো ও লম্বা উত্তর লেখাতে ব্যস্ত ছিল তখন আমি তাড়াতাড়ি বেরোব বলে যা মনে এসেছে তাই লিখে বেরিয়ে পড়েছি। আমাদের এই হেডমাস্টার মশায়ের নাম ছিল তামসরঞ্জন রায়। পরের বছরের গোড়াতেই তিনি বদলি হয়ে যান। বোধহয় ১৯৫৬-৫৭ সালে খবর পাই যে, তিনি উত্তরপাড়াতে আছেন, দেবীশ্বরী বিদ্যালয় নামে একটা বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমি কয়েকবার গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তিনি অন্য ভাবনার অন্য স্বভাবের মানুষ ছিলেন। আমার বাবা-কাকা-দাদা প্রভৃতি গুরুজনের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে, কালো হাফ প্যান্ট পরে আমার বাকি জীবন বস্তিতে কাটবে। তা যে আমাকে কাটাতে হয়নি তার জন্য আমি মণিকাকা ও তামসবাবুর কাছে অশেষ ঋণী।
গুরুজনরা যে আমার বাকি জীবন সম্বন্ধে অমন কথা বলতেন তার কারণ ছিল আমার দিনের বেলার অনেকখানি সময় কাটত মায়ের কোয়ার্টার্সের পেছনে মুসলমান বস্তিতে। বস্তিবাসীদের অধিকাংশই কথা বলত হিন্দি-উর্দু-বাংলা মেশানো এক খিচুড়ি ভাষাতে। ফলে মুসলমান ছাত্রদের সঙ্গে আমার সহজেই ভাব হয়ে গেল স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলে। আবদুল ও গোলাম দুজনেই খুব ভালো ছাত্র ছিল, তবে আমার বেশি ভাব ছিল আবু ও সাত্তারের সঙ্গে। আমাদের সময় ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে সংস্কৃত বা আরবি অর্থাৎ একটা কোনো প্রাচীন বা ধর্মীয় ভাষা পড়তে হতো। আমি বন্ধুদের সঙ্গে আরবি পড়া শুরু করি। স্কুলের তখন পণ্ডিতমশায় ছিলেন রমণীমোহন বসাক। কেন জানিনে স্কুলের দুর্দান্ত ছেলেরাও তাঁকে বাঘের মতো ভয় করত। তিনি কখনো কারও গায়ে হাত তুলেছেন বলে শুনিনি, তবে তাঁর চোখ দুটো ছিল ভাটার মতো, খুব আস্তে কথা বলতেন, ওই দুটি বৈশিষ্ট্য দিয়েই তিনি সবাইকে সন্ত্রস্ত রাখতেন। তিনি যখন আবিষ্কার করলেন যে আমি সংস্কৃত না পড়ে আরবি পড়ছি তখন এক রবিবার সকালে চলে এলেন আমাদের বাড়ি। জেলা স্কুলের সংস্কৃত পণ্ডিত হিসেবে তাঁর কর্তব্যের মধ্যে ছিল প্রতি রবিবার জেলখানাতে গিয়ে কয়েদিদের গীতা পাঠ ও ব্যাখ্যার ক্লাস নেওয়া। সেই ক্লাস নিয়ে ফেরার পথে এলেন মায়ের কাছে, বললেন, হিন্দুর ছেলে সংস্কৃত জানবে না এটা ঠিক নয়, তিনি প্রতি রবিবার জেলখানা থেকে ফেরার পথে আমাকে সংস্কৃত পড়িয়ে যাবেন। কেন জানিনে তাঁর সঙ্গে আমার একটা গভীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। দুঃখের বিষয় মাস দুয়েকের মধ্যে তাঁর ম্যালেরিয়া হয়। থাকতেন তেলিপাড়ার মোড়ে একটা ঘর ভাড়া করে, নিজের রান্না নিজে করতেন। মা তাঁকে সেখান থেকে নিয়ে এসে ভর্তি করে দিলেন হাসপাতালে আর খবর দিলেন বগুড়াতে তাঁর বাড়িতে। ক্রমশ সেরে উঠলেন, এবারে ছাড়া পাবেন। শেষ ইঞ্জেকশনটা দেওয়ার সময় সুচটা হঠাৎ মাটিতে পড়ে গেল, তরুণ ডাক্তার, আসলে মেডিক্যাল স্কুলের ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট, সেই সুচটা মাটি থেকে কুড়িয়ে ইঞ্জেকশনটা দিলেন। এটুকু ভুলের জন্য ঘরে ফেরার দিন সকালে তাঁর দেহে দেখা দিলো ধনুষ্টঙ্কারের লক্ষণ এবং দুদিন লড়াইয়ের পর তাতেই মৃত্যু। আমার জীবনের সেই প্রথম শোক। শ্মশানে যেতে চাইলাম। বাবার ঘোর আপত্তি, কিন্তু মায়ের সম্মতিতে শ্মশানে যেতে পারলাম। পণ্ডিতমশায়ের ভাই মুখে আগুন দিলেন। যখন আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল তখন এক তাজ্জব কাণ্ড হলো। মৃতদেহ হঠাৎ চিতার কাঠগুলো ফেলে উঠে দাঁড়াল। ডোমরা বাঁশ দিয়ে আবার সেই মৃতদেহটাকে শুইয়ে দিলো চিতাতে।
স্কুলের আরো একজন মাস্টার মশায়ের কথা আমার আজো মাঝে মাঝে মনে পড়ে – তাঁর বাড়ি ছিল স্কুলের উত্তর কোণের সীমানার বাইরে। তাঁর নাম ছিল রমেশ গুপ্ত ভায়া। আমি তখনো স্কুলে ভর্তি হইনি, বস্তির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ফুর্তিতে খেলে বেড়াচ্ছি। তখন থেকেই বাবা ও দাদা আমাকে ভয় দেখাতেন রমেশবাবুকে দেখিয়ে। তিনি প্রায়ই আমাদের বাড়ির রাস্তার সামনে দিয়ে বাজার করে লম্বা-লম্বা পা ফেলে বাড়ি ফিরতেন। তাঁর         চলনে-বলনে খুব একটা গম্ভীর ভাব ছিল। একেকদিন আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে বাবার সঙ্গে বাজারের বিষয়ে গল্প করতেন। আমাকে ভয় দেখানো হতো যে, তাঁর স্কুলে আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হবে। তা হলে বুঝব যে লেখাপড়া ছেড়ে খেলেধুলে বেড়ালে কী শাস্তি জোটে। ঘটনাক্রমে তাঁর স্কুলেই আমাকে ভর্তি করা হয়। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন একদিন বাংলার টিচার গোরক্ষবাবু এলেন না, তাঁর জায়গায় ইংরেজির টিচার রমেশবাবু এলেন। হাতে একখানি বড়মাপের বই, সেটা খুলে তিনি আমাদের ডিকটেশন দিতে লাগলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বোরোবুদুর দেখতে যাওয়ার কাহিনি। অনেকক্ষণ ডিকটেশন দেওয়ার পরে তিনি আমাদের খাতা চেয়ে নিয়ে পরখ করতে লাগলেন, যেগুলো পরখ করা বাকি থাকল সেগুলো বগলদাবা করে নিয়ে গেলেন পরদিন ফেরত দেবেন বলে। আমার ভীষণ কৌতূহল হলো বইটি পড়ে দেখার জন্য। টিচার্স কমনরুমে গিয়ে দেখি তখন টিফিন হয়ে গেছে বলে সেই বড়মাপের বইখানি জানালার পাটার ওপরে রেখে তিনি বাড়ি গেছেন। স্কুলবাড়ি ঘুরে গিয়ে পেছনের জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বড়মাপের বইটা হাতিয়ে নিয়ে দেখি বইটার নাম ‘দ্বীপময় ভারত’, লেখকের নাম শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। বইখানি বগলদাবা করে চলে গেলাম পাশের শচীন চন্দের বাড়িতে, সে-বাড়িতে ছিল আম, লিচু, কাঁঠাল ইত্যাদির বাগান। একটা লিচু গাছে উঠে বইটা পড়া শুরু করলাম। কখন পাশের স্কুলে টিফিনের পরে ক্লাস বসল, আর কখন স্কুল ছুটি হয়ে গেল, সেসবের কোনো হুশ ছিল না। যখন অন্ধকার হয়ে গেল, বইয়ের খুদে-খুদে লেখা পড়া অসম্ভব হয়ে গেল তখন লিচুগাছ থেকে নেমে রমেশবাবুকে বইটা ফেরত দিতে গেলাম। বইটা ফেরত পেয়ে তিনি খুশি তো হলেনই না, বরং ভীষণ খেপে উঠলেন। ‘আমি তখন থেকে বইটা খুঁজে খুঁজে পাগল হয়ে গেলাম। এতক্ষণে বাবু এলেন বইটা হাতে নিয়ে।’ তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে, বইটা নিয়ে যাও, সামনের দিনে এই বইটা পড়ে একটা রচনা লিখে নিয়ে আসবে।’ এক হপ্তা পরে বইটার ওপরে একটা রচনা লিখে নিয়ে হাজির হলাম রমেশ স্যারের কাছে। তিনি বোধহয় আমার অপূর্ব লেখাটা পড়ে খুশি হলেন। বললেন, ‘লেখাটা ফেয়ার কপি করে সুনীতি চাটুয্যেকে পাঠিয়ে দাও।’ তাঁর পরামর্শমতো একটা চিঠির আকারে লেখাটা পাঠালাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায়। কিমাশ্চর্যম অতঃপরং। একদিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর অন্যদিকে সুধর্মা বাড়ির ঠিকানা ছাপা কাগজে এসে গেল সুনীতিকুমারের চিঠি। তিনি লিখেছিলেন যে, আমার চিঠি পেয়ে তিনি খুব খুশি হয়েছেন, সেই সঙ্গে লেখার অভ্যাস বজায় রাখার জন্য উপদেশ দিয়েছিলেন। পরে বুঝেছি, আমার মধ্যে যে লেখক হওয়ার সম্ভাবনা আছে এটা প্রথম রমেশবাবুই বুঝেছিলেন।
স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে আমার তেমন কোনো গভীর বন্ধুত্ব ছিল না। তবে প্রসূণ ও মৃণালের কথা আজো মনে পড়ে। দুজনেই ভালো গান গাইত আর মৃণাল ছাত্র হিসেবেও খুব ভালো ছিল। সহপাঠীদের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব ছিল নির্মল সান্যালের সঙ্গে এবং এখনো তার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তর প্রথম খণ্ডের অনেকখানি এবং নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের শিলালিপির অনেকখানি তার মুখস্থ ছিল। এক ক্লাস নিচে পড়ত দেবেশ রায় – একবার সে আমাকে খুব মেরেছিল। আমরা একটা নাটক করছিলাম। একটা দৃশ্য ছিল, ডাকাতদলের হয়ে দেবেশ ও দুলু আমাকে বেকায়দায় পেয়ে খুব মারবে আর মার খেতে-খেতে আমাকে আর্তনাদ করতে হবে। তখন দেবেশ মনের আনন্দে আমাকে মেরেছিল, আমি কিছুই করতে পারিনি। ঘটনাটা দেবেশের এখনো মনে আছে কি না জানিনে। তবে আমার এটা মনে আছে যে, দাদা ছিলেন নেহাত নিরীহ এবং তাঁর ক্লাসের তিনজন দাদাকে খুব নির্যাতন করত। আমার ছোটবেলার অনেকটা কেটেছে মুসলমান বস্তিতে, মারামারিতে যথেষ্ট পোক্ত ছিলাম। দাদার নির্যাতনকারী সেই তিনজনকে আমি ও আমার এক বন্ধু যথেষ্ট শিক্ষা দেওয়ার ফলে আমাদের দুজনকে ক্ষমা চাইতে হলো তিন দাদার কাছে আর ওই তিন দাদাকে ক্ষমা চাইতে হলো আমার দাদার কাছে। আর একবার ভোকাট্টা ঘুড়ি নিয়ে করলা নদীর এপারে মুসলমান বস্তির ছেলেদের সঙ্গে নদীর ওপারে সমাজপাড়ার ছেলেদের ভীষণ মারামারি হয়েছিল। এখানে বলে রাখি যে, করলা নদীর এপারে ছিল হাসপাতাল আর ওই বস্তি এবং ওপারে ছিল ব্রাহ্মসমাজের মন্দির ও মাঠ, তাই ওপাড়াটাকে সমাজপাড়া বলত। ওই মারামারির জন্য সমাজপাড়ার ভদ্রলোকদের কাছে বস্তির ছেলেদের হয়ে মাকেও ক্ষমা চাইতে হয়েছিল, কারণ বস্তির ‘খুনেগুণ্ডা’দের নাকি আমি ছিলাম পাণ্ডা।
আমাদের আসলে করলা নদীতে তখন দুটো পাকা পুল ছিল আর একটা ছিল দোলনা পুল। মোটা লোহার কাছি দড়ি দিয়ে ঝোলানো পুলটাতে একসঙ্গে বেশি লোক পারাপার করলে পুলটা দুলত। হাসপাতাল ও হাকিমপাড়া থেকে ওপারে সমাজপাড়া, সওদাগরপট্টি ও থানাতে যেতে হলে এই দোলনা পুলটা পার হয়েই যেতে হতো। দিনবাজারের পুল আর দোলনা পুলের মাঝখানে করলা নদীতে যে অংশটা ছিল সেই অংশে হতো বিভিন্ন পুজোর পরে প্রতিমা বিসর্জন। জলপাইগুড়ির দুর্গাপুজোর ভাসান ছিল একটা অপূর্ব দেখার জিনিস। ভাসানের দিন সকাল থেকেই করলার দুপাড়ে জমে যেতে নানারকম নৌকোর ভিড়। শহরের পুজো কমিটিগুলো নদীপাড়ে এসে নৌকো ভাড়া করত এবং নিজেদের পছন্দমতো সাজাত। অনেক সময় দুটো নৌকো পাশাপাশি বেঁধে মাঝখানের পাটাতনটার আকার বা প্রসার স্বাভাবিকের চেয়ে চওড়া করা হতো। ডায়নামোর বিজলি আলোতে বা হ্যাজাকের কি পেট্রোম্যাকসের আলোতে করলা নদীর ওই এলাকাটা হয়ে উঠত রূপকথার দেশ। নৌকোগুলো রঙিন কাগজে, বেলুনে, পতাকায় সাজানো হতো। ফরাশ পেতে বসার ব্যবস্থা করা হতো মাতব্বরদের জন্য। প্রতিমার সঙ্গে ঢাকি, কাঁসি ও সানাই বাজনদারদেরও নাচানাচির জায়গা ছেড়ে দেওয়া হতো, প্রতিমার সামনে ছাড়া হতো আরতি ও ধুনুটি নাচের ফাঁকা পাটাতন। এরকম সব ছোট-বড় নানা রকম নৌকো করলা নদীতে একবার উত্তরে একবার দক্ষিণে সারা সন্ধে ধরে ভেসে বেড়াত। নৌকোগুলোতে তুবড়ি ফুলঝুরি থেকে পটকা হাউই ইত্যাদিও পোড়ানোর কম্পিটিশন হতো। শিলিগুরি, হলদিবাড়ি প্রভৃতি জায়গা থেকেও অনেকে আসত জলপাইগুড়ির ভাসান দেখতে।
আমাদের ছোটবেলায় জলপাইগুড়ির ব্রাহ্মসমাজ ছিল খুবই জীবন্ত, সক্রিয় ও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। প্রতি রবিবার সন্ধ্যায় উপাসনা ও সংগীত হতো, তাতে উপস্থিত হতেন ব্রাহ্ম-অব্রাহ্ম নির্বিশেষে ৩০-৪০ জন শহরবাসী। ব্রাহ্মসমাজ ছিল বিদ্যা ও মননচর্চার কেন্দ্র, জিজ্ঞাসু ও শিক্ষিতদের মিলনস্থল। মহিলারাও আসতেন। এজন্যে নিন্দাও ছিল কোনো-কোনো মহলে। বিশেষত সমাজপাড়াতে। অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী ও বিশিষ্ট আইনজীবীও আসতেন। মনে আছে, জেলাশাসক হয়ে জলপাইগুড়িতে এসে হিরণ¥য় বন্দ্যোপাধ্যায়ও নিয়মিত আসতেন ও এক দফায় পরপর কয়েক রবিবার উপনিষদ ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। এতদিনে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, আমি যেতাম মায়ের সঙ্গে। একবার সমাজ চলার মধ্যে কয়েকজন গ্রাম্য লোক হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লেন, কারণ প্রসূতির অবস্থা খুব খারাপ, মাকে এখনই যেতে হবে, ভাড়ার ঘোড়াগাড়ি সঙ্গেই নিয়ে এসেছেন। তখনই বেরিয়ে গেলেন মা। তারপর থেকে মা মাঘোৎসব ছাড়া সমাজে আসা বন্ধ করে দেন। জলপাইগুড়িতে এককালে খুব বড় করে সারাদিন ধরে মাঘোৎসব হতো এবং একশ-দেড়শো নর888sport promo code ও শিশু তাতে যোগ দিতেন। দুপুরে একসঙ্গে ফুলকপির খিচুড়ি খাওয়া হতো। সকালে উপাসনা ও সংগীত, দুপুরে হইহই করে ভোজনকাণ্ড, সন্ধ্যায় আবার উপাসনা ও সংগীত। আমার ছোটবেলার ব্রাহ্মসঙ্গীদের মধ্যে বাবলু সত্তর-আশির দশকে উত্তরদেশ বলে একটা পত্রিকা বের করেছিল, নব্বই দশকের গোড়ার দিকে আমাকে জলপাইগুড়িতে তার বাড়িতে থাকার জন্য ডেকেছিল। তার মা খুব ভালো গান করতেন। আর একজন সুগায়িকা ছিলেন এক কংগ্রেস নেতার স্ত্রী। কী কারণে জানি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে-পরে জলপাইগুড়ির ব্রাহ্মসমাজ ম্রিয়মাণ হয়ে যায়।
ছোটবেলার জলপাইগুড়ির সঙ্গে অনেক বাঘের গল্প জড়িয়ে আছে। তিস্তা নদী ও চর দিয়ে একাধিকবার বাঘ এসেছিল শহরে। বাঘ এলে শহরে ঢোল-শোহরত করা হতো সবাইকে সাবধান করে। হাসপাতালপাড়াতে থাকতেন মাখন সেন, তাঁকে অনেকে বলতেন ম্যাকিনসন সাহেব, তিনি বিখ্যাত ছিলেন বন্দুকের নিশানার জন্য। আর একজন ছিলেন দুর্গা রায়। যেবার রঞ্জিত রায় জলপাইগুড়ির জেলাশাসক হয়ে এলেন সেবার শীতের সময় তিস্তার চরে একটা ডোরাকাটা বাঘ নদীর পারাপারকারীদের ত্রাস হয়ে ওঠে। শেষে ম্যাকিনসন, দুর্গা রায় ও রঞ্জিত রায় তিনজনে তিনটে হাতির পিঠে চরে বাঘ মারতে গেলেন। চর ভরে ছিল শুকনো কাশবনে। তার মধ্যেই কোথাও বাঘটা ছিল। বাঘ খুঁজে-খুঁজে যখন তাঁরা হয়রান তখন ম্যাকিনসন খেয়াল করলেন, বাঘটা দুর্গা রায়ের হাতির পিঠের নিচে হাতিটার সঙ্গে চলেছে। তখন হাতিটার পিঠে গলায় পেটে বাঁধা হাওদার দড়িতে বুটসুদ্ধ পা জোড়া গলিয়ে দুর্গা রায় মাথা নিচু করে ঝুলে পড়ে গুলি চালালেন বাঘটাকে। বাঘ মরল, কিন্তু হাতি ছুটতে লাগল। অনেক কষ্টে হাতিটাকে যখন থামানো গেল তখন মাথায় রক্ত জমে দুর্গা রায় অজ্ঞান। আমাদের পাড়া থেকে হাকিমপাড়া যেতে হলে ধরধরা নদীর পুল পার হতে হতো। পুলটা পেরিয়েই বাঁদিকে ছিল কাজলদের বাড়ি। একদিন সকালে কাজলের মা ধরধরা নদীর জলে বাসনকোসন ধুতে গেছেন, অমনি মানকচুর ঝোপের আড়াল থেকে একটা চিতাবাঘ ফ্যাঁস করে উঠল। লোকজন আসার আগেই বাঘটা হাওয়া। বাঘের চেয়ে সাপের উৎপাত ছিল বেশি। বিশেষত বর্ষা ও বন্যার সময় সাপ এসে ঘরে ঢুকত। দাদার টিউটর চলে যাওয়াতে দাদা বাইরের দরজা সবে বন্ধ করেছেন, অমনি একটা অদ্ভুত আওয়াজ। দরজা বন্ধের পাল্লায় চেপটে গেছে একটা গোখরো সাপ। আর একবার খাবার ঘরে ঝিমার তক্তপোশের নিচে পাওয়া গেল কিলবিলে একরাশ পোনার সঙ্গে একটা পাহাড়ি সাপ। বর্ষা এলেই মা ঘরের কোণে কোণে কার্বলিক অ্যাসিড ঢেলে রাখতেন। উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরের কোণে থাকত একটা পাঁচ-ছ ফুট লম্বা সাপ, উঠোনে মানুষের সাড়া পেলেই পালিয়ে যেত। ব্যাঙ বিছে পোকামাকড় যে কত রকমের ছিল তার আর ইয়ত্তা নেই।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে পর্যন্ত বাঘ-সাপ সত্ত্বেও জলপাইগুড়ি ছিল মফস্বল শহরের পক্ষে বেশ আধুনিক। তার কারণ চা-888sport live chatের সুবাদে সাহেবদের রমরমা। ইউরোপীয়দের ক্লাব ছিল, বলনাচের বিশাল হলঘর ছিল, রেসকোর্স ছিল যেখানে ঘোড়দৌড় হতো, বড়দিনে কার্নিভ্যাল হতো। যুদ্ধ বাধার ফলে, বিশেষত জাপান যুদ্ধে নামার পরে, জলপাইগুড়ির ভোল পালটে যায়। তিস্তা ও করলা নদীর মোহনার দুপাড়ে ছিল সাহেবদের বাংলো, ইমপিরিয়াল ব্যাংক, বলরুম, কিং সাহেবের ঘাট ইত্যাদি। ওসব দিকে মানে বড় পোস্টাপিসের মোড় থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত রাস্তাটার পুবদিকে শহরবাসীর যাওয়া-আসা করতে হলে বন্দুকধারী পাহারাওয়ালাদের কাছে জবাবদিহি করতে হতো। এটা আগস্ট বিপ্লবের পর থেকে, না জাপান যুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর থেকে শুরু, তা ঠিক জানিনে। আবার এই সময় থেকে ব্ল্যাকআউট চালু হয়।
বোধহয় ছোটবেলা থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমি গুরুজনদের কাছে উদ্বেগের কারণ। কয়েকটা কথা আমার মনে আছে। একটা হলো, মোটরগাড়ির সামনে ঝাঁপ দেওয়ার খেলা। খেলাটা ছিল এরকম – রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতাম, মোটরগাড়ি খুব কাছে এসে গেলে সামনে ঝাঁপ দিয়ে পড়তাম, ড্রাইভার কোনোমতে অ্যাকসিডেন্ট বাঁচিয়ে আমাকে গালাগালি দিয়ে চলে যেত। আমার দর্শকমণ্ডলী ছিল বস্তির ছেলেমেয়েরা। মোটরগাড়িটা যখন খ্যাঁচ করে টাল খেয়ে আমাকে পাশ কাটিয়ে গালাগাল দিয়ে বেরিয়ে যেত তখন আমি বীরদর্পে রাস্তায় উঠে দাঁড়াতাম আর আমার দর্শকমণ্ডলী হাততালি ও শিস দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানত। কিন্তু একবার ঘটে গেল অ্যাকসিডেন্ট আর সেটা হলো ডিস্ট্রিক্ট হেলথ অফিসারের গাড়িতে। তাঁর নাম যতদূর মনে পড়ছে হরিপদ কি হরিহর দত্ত ছিল। আমাদের পরিবারের বন্ধু ও হিতৈষী ছিলেন তাঁদের পরিবার এবং তাঁর বৃদ্ধ মা ছিলেন জলপাইগুড়ি ব্রাহ্মসমাজের প্রাণ। আমার মাথাটা গাড়ির বাম্পারে ঢুকে আটকে গিয়েছিল, ফলে গাড়িটা থামাতে-থামাতে অনেকটা পথ আমাকে ছেঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিল। কোনোমতে বাম্পার থেকে আমার মাথাটা বের করে আমাকে নিয়ে আসেন হাসপাতালে। সেবার তিন-চার মাস আমি গৃহবন্দি ছিলাম। এর পরেরবার আমি হাসপাতালে যাই বার্মিজ পিওক ক্যাসিয়া ফুল পাড়তে গিয়ে ডাল ভেঙে পড়ে যাওয়ার ফলে গাছের লম্বা-লম্বা তিনটে কাঁচিতে আমার পেট ফেঁসে নাড়িভুঁড়ি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, আমি কোনোমতে পেট চেপে হাসপাতালে চলে যাই। সেবার মাস দুয়েক গৃহবন্দি ছিলাম। তবে তখন আমি গল্পের বই ও রবীন্দ্রনাথের 888sport app download apk পড়তে শিখেছি। পরের বছরেই আমার হার্নিয়া অপারেশনের দরকার হলো এবং আবার গৃহবন্দি হলাম। অপারেশনের পরেপরেই আমাকে ওটি থেকে নিয়ে আসা হয়। ঝাপসাভাবে মনে পড়ে যে, আমাকে বাড়িতে নিয়ে এলে ঝিমা কান্নাকাটি শুরু করেন : জ্যান্ত ছেলেটাকে নিয়ে গেলে আর লাশ বানিয়ে নিয়ে এলে।
যেবার পেট ফেঁসে যায় সেবার আমি ছিলাম ক্লাস সিক্সের ছাত্র। মাত্র কিছুদিন আগে পণ্ডিতমশায় মারা গিয়েছেন। আমার পেট ফাঁসার কিছুদিন পরে আমাদের এক কাকা জলপাইগুড়িতে আসেন। আমি যখন সেরে উঠে স্কুলে যাব তখন মা আমাকে একটা কালো শেফার্স কলম কিনে দেন, বোধহয় স্কুলে যেতে উৎসাহ পাব বলে। আমার সেই কাকা তখন যে মাকে বলেছিলেন, ‘বউদি, আপনি ছেলেটাকে বংশের কুলাঙ্গার বানাচ্ছেন’, কথাটা আমি ভুলে যাওয়ার ঢের চেষ্টা করলেও আজো ভুলতে পারিনি। বাবা-কাকা-দাদার ওপরে আমার রাগ হলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতাম মেডিক্যাল স্কুলের মড়াকাটা ঘরটার বারান্দায়। ভীষণ নির্জন ছিল জায়গাটা। কয়েকটা বড়-বড় গাছ ছিল ঘরটার আশপাশে। ফলে দিনের বেলাতেও জায়গাটা ঝুপসি-ঝুপসি আঁধারে-ছায়াতে রহস্যময় ছিল। ওই ঘরটার একজন বয়স্ক ডোম ছিল, তার নাম ছিল শীতল, সে আমাকে ওখানে বসে বা শুয়ে থাকতে দেখে মধ্যে-মধ্যে আমার সঙ্গে এসে গল্প করত। সে আমাকে বলেছিল, সাদা ইঁদুরের তোলা মাটি এনে তাকে দিলে সে নাকি আমাকে জ্যোৎøা রাতে ওই সামনের মাঠে ভূতের ফুটবল খেলা দেখাতে পারবে। দুঃখের বিষয় আমি তাকে সাদা ইঁদুরের তোলা মাটি জোগাড় করে দিতে পারিনি। ফিরে আসি মর্গের বারান্দায়। সন্ধের পর মা যখন ঘরে এসে দেখতেন যে আমি তখনো বাড়ি ফিরিনি তখন আমাকে খুঁজতে প্রথমেই আসতেন ওই ভূতেদের আসরে, যদিও মা বা আমি কখনো কোনো ভূত দেখিনি।
মাঝে মধ্যে-মধ্যে শহরের বাইরে রুগী দেখতে যেতে হতো। একবার বর্ষার মধ্যে তিনি গ্রামাঞ্চলে গেলেন, তারপর তিনি নিরুদ্দেশ, এদিকে চারদিক ভেসে যাচ্ছে বন্যায়, আমাদের উঠোনে কোমরজল, বড় রাস্তার উপরে হাঁটুজল। এই অবস্থায় আমাদের দুশ্চিন্তা কাটিয়ে মা মাঝরাতে ফিরে এলেন হাতিতে চড়ে। আর একবার মা কোথা থেকে বাড়ি ফিরে আসতেই পিছুপিছু পুলিশ এসে হাজির। মা যেখানে গেছলেন সেটা ডাকাতের গ্রাম বা বাড়ি। পুলিশ তাদের বিশদ খবর জানতে চাইলে মা বললেন, তিনি কোনো ডাকাতের বাড়ি যাননি, গিয়েছিলেন রুগীবাড়ি। উত্তর বাংলায় মা তখন একা লেডি ডাক্তার। কখনো দিনাজপুর, কখনো মালদহ, কখনো দার্জিলিং থেকে তাঁর ডাক পড়ত, ছুটি নিয়ে চার-পাঁচদিনের জন্য সেসব রুগীবাড়িতে যখন যেতেন তখন আমাকেও নিয়ে যেতেন সঙ্গে, কারণ বাড়িতে থাকলে বাবা-দাদার পক্ষে নাকি আমাকে সামলানো কঠিন হতো। ছোটবেলায় আমি ধুলোভরা মালদহের যে পাথরফেলা রাস্তা ও সেখানে এক্কা-টাঙ্গার যাওয়া-আসা দেখেছিলাম তার কোনো চিহ্ন আজকের মালদহে পাওয়া যাবে না। জলপাইগুড়িতেও এককালে ঘোড়াগাড়িই ছিল যানবাহন, সাইকেল রিকশা চালু হয় যুদ্ধের বাজারে। একবার মা আমাকে দিনাজপুরের ভূপালপুর রাজবাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিশাল বাড়ি, মস্ত বাগান, কত রকম পাখি, দু-তিনটে পুকুর, মেয়েদের জন্য আলাদা পুকুরে মেয়েদের সঙ্গে মাখামাখি করে øান, সন্ধ্যায় ঢুবঢুব ডায়নামোর বিজলিতে ঘরে-ঘরে আলো, রুপোর থালায় ভাতের সঙ্গে রুপোর বাটিতে বাটিতে দু-তিন রকম মাছ আর পায়েস এসব এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়। দার্জিলিংয়ে প্রথমবার ছিলাম চকবাজারের নিচে বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে এক বাড়িতে, তাঁদের বাড়িতে কাজ করতেন যিনি তাঁকে ডাকতাম লেপচাদি বলে, লেপচাদির একটি মেয়ে ছিল আমারই বয়সী। সামনের বোটানিক্যাল গার্ডেনে ছিল কত রকম আশ্চর্য-আশ্চর্য সুন্দর-সুন্দর ফুল, কিন্তু লেপচাদির সেই মেয়েটি পাহাড়ের গা থেকে আমাকে তুলে দিয়েছিল একটা ডেউজি ফুল। এত বছর পরেও ওই একরত্তি মেয়ের দেওয়া চোখের তারার মাপে সেই ফুলটার কথা মনে আছে আমার। তারপর আর একবার একা আমাকে দার্জিলিংয়ে নিয়ে গেছলেন মা, সেবার ছিলাম ঘড়িওয়ালা ক্যাপিটল বাড়িটার গায়ে এক বাড়িতে, সেখান থেকে ম্যাল ও মহাকাল ছিল যথেষ্ট কাছে। এই পথটাতে আর ম্যালে তখন অনেক মিলিটারিকে দেখেছি, তাদের কারও রং খুব ফর্সা, কারও রং খুব কালো ছিল। সাদা আর কালো মানুষকে যুদ্ধ মানুষ মারার একই কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল।
যুদ্ধের পর আমাদের জেলা স্কুলে আনন্দ-উৎসব হয় ইংরেজরা জিতে গেছে বলে। খেলার মাঠে সাদা পর্দা টাঙিয়ে চার্লি চ্যাপলিন, লরেল অ্যান্ড হার্ডি, ট্রেডার্স হর্ন প্রভৃতি সিনেমা দেখানো হয়। চ্যাপলিনের কাণ্ডকারখানা দেখে তাজ্জব বনে গেছলাম। মুখে হাসছি, সবাই হাসছে, কিন্তু বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা কান্না গলায় এসে আটকে গেছে। হাসির পেছনে কান্না পুরে দেওয়ার অমন সিনেমা পরেও দেখিনি। ওই বিজয়োৎসবের এক বছর পরে শুনলাম, কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানে দারুণ দাঙ্গা বেধেছে। দাঙ্গার খবরে বস্তির মানুষ চঞ্চল হয়ে ওঠে – এখানেও দাঙ্গা বাধবে নাকি! বাবা ও স্কুলের একজন মাস্টারমশায় আমাকে আগের মতো মুসলমান বস্তিতে যাওয়া-আসা করতে বারণ কলেন – ‘কাউকে বিশ্বাস নেই।’ বলতে ভুলে গেছি, ওই বস্তির ছেলেরাই আমাকে পাঁঠা কাটতে শিখিয়েছিল, হালাল আর ঝটকার মানে বুঝিয়েছিল। সেবার দাদা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পরে কয়েকজন বন্ধু মিলে ফিস্ট করবেন ঠিক করলেন। একটা গোটা ছোট পাঁঠা কিনে আমাকে কেটে দিতে বললেন। দাদার বন্ধু রবীনদা বা অসিতদা কেউ একজন বললেন, ‘এ তো পাঁঠা কাটতে-কাটতে মানুষ কাটবে একদিন।’ এখনো অবশ্য মানুষ কাটিনি, কিন্তু যে মাংস খাব তার প্রাণ নেওয়াতে আমি এখনো দোষ দেখি না, বরং অন্যে মেরে দেবে আর আমি খাব এর মধ্যেই দোষ দেখি। ফলে নানা কারণে আমাকে আরো বহুবার প্রাণী হত্যা করতে হয়েছে।
দেশ স্বাধীন হবে বলে স্কুলে যখন আনন্দের হাওয়া বইতে লাগল তখন আমাদের বস্তিতে দুশ্চিন্তার হাওয়া। দেশ ভাগ হলে কোন নতুন দেশে যাবে তারা? সেখানে কে বুঝবে তাদের বুলি? এখানে নবাব সাহেব থাকতে দিয়েছিলেন তাদের, সেখানে কোথায় তারা থাকবে? শেষ পর্যন্ত নিশ্চয়ই কোথাও গেল তারা আর বস্তিটা আস্তে-আস্তে ভর্তি হয়ে গেল নোয়াখালি থেকে আসা নোয়াইল্লাদের দিয়ে। আন্দাজ করতে পারছিলাম যে, বস্তির বন্ধুরা পাকিস্তানেই কোথাও গেছে। একদিন বিকেলে একা-একা ঘুরতে-ঘুরতে স্টেশনে যেই পৌঁছেছি অমনি ডান দিক থেকে এসে দাঁড়াল নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস, যাবে পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে কলকাতার শেয়ালদায়। আমার সেই বন্ধুরা তো পাকিস্তানেই গেছে। এই ট্রেনে করে পাকিস্তানে গেলে নিশ্চয়ই খুঁজে পাব তাদের। অজানা ভাবনায় উঠে পড়লাম ট্রেনে। চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখলাম, রাখাল গরুর পাল নিয়ে ফিরছে গ্রামে। মাঠের শেষে অস্ত যাচ্ছে লাল সূর্য। মিশকালো অন্ধকারে ট্রেন এসে দাঁড়াল পাকিস্তানের কোনো স্টেশনে। যা ভয় পাচ্ছিলাম তা-ই হলো। একমুখ জবরদস্ত দাড়ি, গায়ে কালো কোট, টিকিটচেকার উঠলেন কমপার্টমেন্টে। আমি অন্য যাত্রীদের আড়ালে লুকিয়েও রেহাই পেলাম না। চেকার সাহেবের কথায় একজন অল্পবয়সী যাত্রী আমাকে তলাশ করে জানাল, প্যান্টের ভিতরে ইংলিশ কলমটা ছাড়া একটা লাল পয়সাও নেই। চেকার সাহেব আমার চুলের মুঠি ধরে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে গেলেন স্টেশন মাস্টারের ঘরে, বললেন, এই মালাউন ব্যাটাকে রাইতটার মতো আইটকে রাখেন গুদাম ঘরে, কাল পাঠাইয়া দেবেন জলপাইগুড়িতে। ঘুটঘুটে অন্ধকার গুদাম ঘরে ঝাঁক-ঝাঁক মশা। অনেক রাতে স্টেশন মাস্টার এসে আমাকে মশার হাত থেকে উদ্ধার করলেন বটে কিন্তু তার জ্বলুনি আজো আমার কাছে দুঃস্বপ্ন। দার্জিলিং মেল পাস করার পরে তাঁর ছুটি। লণ্ঠন হাতে আগে-আগে তিনি চলেছেন স্টেশনের পেছনে কচুবনের ভেতর দিয়ে হাঁটাপথে। এক ফালি বারান্দা পেরিয়ে একটা ঘর, লাগোয়া রান্নাঘর। সামনের অন্ধকার উঠোনে কুয়ো থেকে জল তুলে হাতমুখ ধুলাম আমরা। একটা থালাতে ভাত, ডাল, শাক ভাজা 888sport app ছিল। একজনের খাবার দুজনে ভাগ করে খেলাম। তারপরে এক বিছানায় এক মশারিতে ঘুম। বেলাতে ঘুম ভাঙল জ্বর নিয়ে। তিনদিন পরে মাস্টারসাহেব শিলিগুড়িগামী একটা মালগাড়িতে তুলে দিয়ে গার্ডসাহেবকে বললেন জলপাইগুড়িতে নামিয়ে দিতে।
আমি ফিরে আসার পরে-পরে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন যেন আমার সঙ্গে দেখা করে যাবেন বলে অপেক্ষা করছিলেন। ছোট মামিমা এসে দাদাকে নিয়ে গেলেন কলকাতায় আর তাঁদের সঙ্গে মা ঝিমাকেও পাঠিয়ে দিলেন মেদিনীপুরে তাঁর বাড়িতে। জলপাইগুড়িতে তখন শুধু মা আর আমি। মাকে কখনো কোনো অবস্থায় ভেঙে পড়তে দেখিনি, কিন্তু এবার ভেঙে পড়লেন। অনেকদিন ঘর থেকে বেরোননি একেবারে, বিছানাতেই শুয়ে থাকতেন। শুধু ডাল-আলু সেদ্ধ আর ভাত দিয়ে জীবনধারণ। আস্তে আস্তে হাসপাতালে যাওয়া শুরু করলেন। প্রাইভেট প্র্যাকটিস তাঁর চাকরির শর্তগুলির অন্তর্গত ছিল, কিন্তু ওই পর্বে তিনি চাকরির বাইরে রুগী দেখতেন না, হাসপাতাল সেরে ঘরে এসে শুয়েই থাকতেন। এখনই সময় ঘটল গান্ধিহত্যা। মা যেটুকু সেরেছিলেন ওই খবরে আবার ভেঙে পড়লেন। শুধু সকালবেলাতে হাসপাতালে যেতেন, বিকেলে যেতেন না। একজন ডাক্তার রাইটার্সে চিঠি দিলেন যে, লেডি ডাক্তার হাসপাতালে না এসে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে বেড়াচ্ছেন। এই চ্যালেঞ্জের ফলে মা আবার মোকাবিলা করতে উঠে পড়লেন। কলকাতা থেকে তদন্ত করার জন্য কমিশন পাঠাতে অনুরোধ করলেন। কলকাতা থেকে দুজন ডাক্তার এলেন। যিনি সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন তিনি বললেন, মানবিক কারণে তিনি লেডি ডাক্তারকে একবেলা আসার অনুমতি দিয়েছেন, বিকেলবেলাতে তিনি হসপিটাল কম্পাউন্ডে নিজের কোয়ার্টার্সেই থাকেন। এই সুপার ছিলেন পাঞ্জাবি কি কাশ্মিরি, টকটকে গায়ের রং এবং দৈত্যের মতো বিশাল বপু।
যা হোক এমন সময় স্বাধীন ভারত সরকারের পররাষ্ট্র দফতর থেকে মায়ের কাছে একটা চিঠি এলো – অশ্র“বালা দাশগুপ্তের জাপানি আত্মীয়রা ভারতে এসে থাকতে চান, তাঁদের দায়দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ভারত সরকারের কাছে বন্ড দিতে মা রাজি কিনা। মায়ের বড় বোন হরিপ্রভা ১৯০৪ সালে এক জাপানি ভদ্রলোককে বিয়ে করেছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপান হয়ে যায় ইংল্যান্ডের শত্র“পক্ষ এবং পরে যুদ্ধে পরাজিত হয়। মায়ের দেওয়া বন্ডের ভিত্তিতে মা ও মেসোমশায় জলপাইগুড়িতে এলেন। মেসোমশায়ের তখন চলৎশক্তি ছিল না, প্রায়ই ‘তোজো হেরে গেছে’ ‘জাপান হেরে গেছে’ বলে কাঁদতেন। দিদি-জামাইবাবুর সেবাযতœ করার তাগিদে মা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। তবু জামাইবাবুকে সাত-আট মাসের বেশি রাখতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর পরে মাসিমা বাংলা-বিহার-ওড়িশাতে ছড়ানো আত্মীয়স্বজনের কাছে ঘুরে ঘুরে থাকতে ও বেড়াতে চলে গেলেন। আমার সামনে তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা – তার জন্য টেস্ট পরীক্ষা সবে দিয়েছি – এমন সময় শহরে প্রচণ্ড চাঞ্চল্য। কী ব্যাপার? শিয়ালদহ থেকে পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে যে-দার্জিলিং মেল এসেছে তার কামরায় কামরায় রক্তগঙ্গায় ভাসছে গাদাগাদা লাশ। সান্তাহার ছাড়ানোর পরে ট্রেন থামিয়ে এই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড হয়েছে। স্বভাবতই শহরজুড়ে দারুণ উত্তেজনা। আমরা ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থীরা আলোচনা করছিলাম যে, এবার দোলের সময় নির্ঘাত দাঙ্গা বাধবে।
সেবার মাঘোৎসব তেমন জমল না। এতদিনে আমি ঈশ্বর-ভগবান-আল্লাহ-গড ইত্যাদির অস্তিত্বে বিশ্বাস হারিয়েছি, কিন্তু ব্রহ্মসংগীত-রবীন্দ্রসংগীত ইত্যাদির আকর্ষণ যেন আরো প্রবলভাবে অনুভব করছি। বুঝতে চাইছি যে, ধর্মগ্রন্থগুলির এত কাল ও এত দেশ জুড়ে প্রভাবের রহস্য কী! তবে মাঘোৎসবে সমাজে যাওয়া বন্ধ হয়নি। তখন সমাজের আচার্য ছিলেন জলপাইগুড়ি কলেজের প্রিন্সিপালের স্ত্রী শান্তি মজুমদার। তিনি আবার আমার মায়ের বন্ধু ছিলেন। মধ্যে-মধ্যে আসতেন মায়ের কাছে বেড়াতে।
সেদিন ঠিক কী কারণে মনে নেই, দিনবাজারে গেছি। রাস্তার একধারে সবজি, মাছ-মাংস, মুদি ইত্যাদির বাজার। একটা মোড়, তার বাঁ পাশে একটা ইদারা, আর মোড়টাতে আপেল, খেজুর ইত্যাদির মেওয়াওয়ালাদের কয়েকটা সারি-সারি দোকান। তার একটা দোকানের সামনে কে একজন এমনভাবে একটা বাইসাইকেল রেখে গেছে যে কোনো ক্রেতার পক্ষে ওই দোকানে সওদা করা যাবে না। তাই ওই মেওয়ার দোকানদার সাইকেলটার মালিকের উদ্দেশে চেঁচামিচি করতে-করতে উঠে দাঁড়িয়ে তখনো চেঁচাচ্ছে সাইকেলটা সরিয়ে নেওয়ার জন্য। এমন সময় একজন লোক হঠাৎ দোকানের ওপর লাফিয়ে উঠে ছুরি চালিয়ে দিলো মেওয়াওয়ালার পেটে। এ আমার একেবারে চোখের সামনের ঘটনা। সঙ্গে-সঙ্গে হুড়োহুড়ি, দৌড়াদৌড়ি, হল্লাফ্যাসাদ। দু-তিনজন মেওয়াওয়ালা জখমি লোকটাকে কোলে করে একটা সাইকেল-রিকশাতে তুলে নিয়ে চলল হাসপাতালে। আমি বাড়ি ফিরে শান্তি মাসিমাকে দেখে বললাম, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যান, আজই দাঙ্গা বাধবে। সেদিনই বাধল দাঙ্গা। বস্তির ঘরগুলো ততদিনে নোয়াখালি থেকে আগত উদ্বাস্তুদের বস্তি হয়ে গেছে, শুধু একজন মুসলমান রিকশাওয়ালা ও একজন মুসলমান অন্ধ ভিখিরি ছিল। অন্ধ ভিখিরিটার লাশ পাওয়া যায় কামারপাড়ার একটা কালভার্টের নিচে। রিকশাওয়ালাকে বস্তা চাপা দিয়ে মা লুকিয়ে রেখেছিলেন আমাদের বারান্দায়। দাঙ্গার তৃতীয় দিনে কয়েকটা লোক এসেছিল তার খোঁজে – গোয়ালঘর থেকে আমাদের সবগুলি ঘর খুঁজে-খুঁজে তারা চলে যায়। জলপাইগুড়ির জেলাশাসক ছিলেন তখন কোনো আয়ার বা আয়েঙ্গার। চারদিনে তিনি কড়া হাতে দাঙ্গা থামিয়ে দেন। তার 888sport app download bd হিসেবে তাঁকে সরিয়ে কলকাতায় এনে বসিয়ে রাখা হয়। তখন তিনি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কাছে আইনি পরামর্শ নিতে এসেছিলেন এবং অন্নদাশঙ্কর তখন তাঁকে ইস্তফা দেওয়ার পরামর্শই দিয়েছিলেন। অন্নদাশঙ্কর নিজেও সরকারি দ্বিচারিতার প্রতিবাদে ইস্তফা দিয়েছিলেন।
পাকিস্তান থেকে লাশভরা দার্জিলিং মেল আসার পর থেকে আমি মানসিকভাবে ভীষণ বিচলিত ছিলাম। লেখাপড়া মাথায় উঠেছিল। মাকে বললাম, আমার পক্ষে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। মা বললেন, ‘তা হবে না, পাশ করো কি ফেল করো, পরীক্ষা দিতেই হবে।’ শেষে রফা হলো, ফেল করলেও পরীক্ষা দেব, কিন্তু তার বদলে মা আমাকে ঘুড়ির মতো আকাশে উড়তে দেবেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েই মাকে মনে করিয়ে দিলাম কথাটা। বাগডোগরা থেকে তখন প্রাইভেট প্লেন কোম্পানি চালু হয়েছে। আমাদের ডাকোটা প্লেন আকাশে ওড়ার একটু পরেই পাইলটের কাছ থেকে পেনসিলে লেখা চিরকুট এলো, ‘ঝড় আসছে, আমরা কোথাও নামার চেষ্টা করছি।’ প্লেন ওলটপালট করতে লাগল। কয়েকজন সাহেব-মেম যাচ্ছিলেন কলকাতায় ঘোড়দৌড় খেলতে। তাঁদের একজন বমি করতে লাগলেন। একজন রাজসন্ধি ব্যবসায়ী কান্নাকাটি করতে লাগলেন – যত টাকা চাই দেবেন, তাঁকে এখনই নামিয়ে দিতে হবে। কোনোমতে প্লেন নামল দুধারে ক্ষেতওয়ালা একটা পাকা রাস্তায়, রাস্তাটার পাশে-পাশে ঝড়ে ধরাশায়ী অনেক গাছ। যখন সন্ধেবেলায় দমদমের ওপরে এলাম তখন নিচের রানওয়ে জলে ভিজে আলোয়-আলোয় ঝলমল করছে। যেন আলোর বাগান।
দাদার সঙ্গে ফিরলাম জলপাইগুড়িতে। এবার ট্রেনে চড়ে। দাদা ফিরলেন গরমের ছুটি উপলক্ষে। দাদা ধরলেন এই গরমে দার্জিলিং যাওয়ার বায়না। দাদার ম্যানেজারিতে ছোট কাকা ও তাঁর পরিবারও চললেন দার্জিলিংয়ে। তখনকার দিনে দার্জিলিংয়ে ঘর ভাড়া হতো মরশুম হিসেবে। সেবার দার্জিলিংয়ে ভীষণ ধস নামে। দার্জিলিং শহরের ইতিহাসে এতো বড় ধস আজ পর্যন্ত হয়নি। স্টেশনের কাছে ধীরধাম মন্দিরের সবুজ লনটার বেশিটাই ধসে যায়। রেলস্টেশনের কাছে রেল কোয়ার্টার্সে ধসে মারা যায় অনেকে। একটা লাশ বের করা হয় ১৩-১৪ বছরের এক মেয়ের। বিছানায় বসে এক হাতে বাটি ধরে মুড়ি খাচ্ছিল, সেই অবস্থাতেই ধসে চাপা পড়ে মৃত্যু। সোনাদা স্টেশনের কাছে একটা ধস নামে প্রায় দুমাইল জোড়া মাটি ঘরবাড়ি গাছপালা নিয়ে। এই সময় হিল কার্ট রোডে বাজারের কাছে একটা দোকান থেকে আঠারো বসন্ত নামে একটা বই কিনি, তাতে ছিল কিছু ছোটগল্প ও কিছু 888sport app download apk। একটি 888sport app download apkর নাম ছিল ‘বনলতা সেন’ আর কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। দেখলাম ডাকসাইটে পড়–য়া দাদাও জীবনানন্দ দাশের নাম জানেন না। সপ্তাহখানেক পরে কার্শিয়াং পর্যন্ত পথ পায়ে হেঁটে এসে যখন জলপাইগুড়িতে পৌঁছলাম তখন দেখি, জলপাইগুড়িতেও ইতিমধ্যে ভীষণ বন্যা হয়ে গেছে, আমাদের ঘরের ভেতরে জল উঠেছিল জানলা অর্থাৎ সদর রাস্তার ওপরে অন্তত আট ফুট পর্যন্ত। এমন বন্যা আগে কখনো হয়নি। এই বন্যার পরে বছরখানেকের মধ্যে জলপাইগুড়ি শহরের অনেক পুরনো বড়-বড় গাছ মরে যায়, বিশেষজ্ঞরা বললেন, মাটির নিচের জলের স্তর উঁচু হয়ে যাওয়ার ফলে ওইসব গাছের শিকড় পচে গেছে।
ম্যাট্রিকের ফল বেরোনোর পরে আমি ইন্টারমিডিয়েটে 888sport apk নিয়ে আনন্দ চন্দ্র কলেজে ভর্তি হলাম। বিষয় নিলাম গণিত, পদার্থ ও রসায়ন। গণিতের অধ্যাপক ধীরেন্দ্রচন্দ লাহিড়ি খুব ভালো পড়াতেন, পদার্থ পড়াতেন রণজিৎ স্যার যাঁর পদবিটা আমার মনে পড়ছে না, কিন্তু রসায়নের অধ্যাপকের পদবি দূরে থাক, শুভনামটাও মনে নেই। কেমিস্ট্রিটা আমার শুরু থেকেই কঠিন ঠেকছিল। কলেজটা তখন ছিল রেসকোর্স মাঠের বিপরীতে একটা মাঠে। কলেজের বারান্দা থেকে দেখা যেত রেসকোর্স মাঠের ওধারে তিস্তা নদীর চর। বলতে ভুলে গেছি, আমাদের স্কুলও ছিল তিস্তার পাড়ে। স্কুলে ক্লাস করতে করতে জানলা দিয়ে দেখা যেত দক্ষিণে স্কুলের গা ঘেঁসে গেছে ফুট পনেরো চওড়া পাকা রাস্তা, রাস্তার ওপারে ধানক্ষেত, ধানক্ষেত পেরিয়ে চিকচিকে সাদা বালির চর, নীল রঙের জলের ধারা একেক সময় ঝলসে উঠছে রোদ্দুরে, সেই জলের ওপারে ছিল দিগন্ত পর্যন্ত ছড়ানো চর, ক্লাস থেকে বা রাস্তা থেকে দেখা না গেলেও জানতাম যে চরটা পার হলেই তিস্তার আসল গভীর ধারা যেটা নৌকো করে পার হতে হতো। তবে কলেজ থেকে তিস্তা ছিল বেশ দূরে, মাঝখানে ছিল মস্ত রেসকোর্স মাঠ আর চওড়া চর।
তিস্তার চরে কাশফুল ফুটিয়ে পুজোর ছুটি এলো। কলকাতা থেকে দাদা এলেন ছুটিতে। সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজ লাইব্রেরি থেকে নিয়ে এলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন মুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত আধুনিক বাংলা 888sport app download apk বইখানি। দেখালেন যে তাতে জীবনানন্দ দাশের মাত্র চারটে 888sport app download apk আছে, অথচ বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সমর সেন প্রমুখের 888sport app download apk আছে অনেকগুলি করে। এমনকী প্রেমেন্দ্র মিত্রেরও পাঁচটে বা ছটা 888sport app download apk। সেই বইখানি আমার সেবারকার পুজোর ছুটিতে ভরে থাকল। পাহাড় জঙ্গল হ্রদ ঝর্ণা নদী ইত্যাদি নিয়ে সে যেন এক আশ্চর্য মহাদেশ। বইখানির প্রকাশক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। তাঁর গল্প-888sport alternative link আগেই পড়া ছিল। তাঁকে চিঠি দিলাম জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ঠিকানা চেয়ে। কেন এই তিনজনের ঠিকানা চেয়েছিলাম তার ঠিক কারণ বলতে পারব না। পরে নিজের কাছে নিজেই ব্যাখ্যা দিয়েছি যে, ওই বইখানির কবিদের মধ্যে ওই তিনজনের 888sport app download apkই আমাকে সবচেয়ে বেশি টেনেছিল।
আমি ঠিক করে ফেললাম, সায়েন্স ছেড়ে আর্টস পড়ব, কিন্তু আর্টসেও অঙ্ক রাখলাম কম্বিনেশন হিসেবে। ভেবেছিলাম, কম্বিনেশনে আরেকটা বিষয় রাখব, ইতিহাস। কিন্তু বলা হলো, অঙ্কের সঙ্গে ইতিহাসের কম্বিনেশন হয় না। তখন স্পেশাল বেঙ্গলি আর পলিটিক্যাল সায়েন্স নিলাম অপর দুটি কম্বিনেশন হিসেবে। সায়েন্স ছেড়ে আর্টসে এসে ভাবলাম, এখানকার ছাত্রছাত্রীরা নিশ্চয়ই জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, সুভাষ প্রমুখের লেখার বা নিদেন নামের সঙ্গে পরিচিত। দেখলাম দু-একজন সুভাষের নাম জানে সুকান্ত ভট্টাচার্যের গুরু বা অগ্নিকোণের কবি হিসেবে, কিন্তু জীবনানন্দ ও সুধীন্দ্রনাথের নাম কেউই জানে না। তখন ঠিক করলাম, এই সব আধুনিক কবিকে জলপাইগুড়ির 888sport live footballপ্রেমীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটা পত্রিকা চাই।  জলপাইগুড়িতে তখন বাবুপাড়া পাঠাগার আর কদমতলায় আজাদ হিন্দ পাঠাগার বলে দুটো পাঠাগারের বেশ নাম ও প্রতিষ্ঠা ছিল, হাকিমপাড়ায় ছিল চলতি হাওয়ার পন্থী, তেলিপাড়ার কালীবাড়িতে ছিল আর একটা পাঠাগার। এগুলোর ঝোঁক ছিল গল্প-888sport alternative linkের ওপর। খোঁজ নিয়ে বুঝলাম, জলপাইগুড়িতে তখনো আধুনিক বাংলা 888sport app download apk হিব্র“-গ্রিক 888sport app download apkর শামিল। আমাদের পরিকল্পনার পত্রিকার নাম ঠিক করে দেওয়ার জন্য দাবি জানালাম প্রেমেন্দ্র মিত্রকে। আগে থেকেই তাঁর বাড়িতে যাওয়া-আসা ছিল। তিনি জলপাইগুড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পত্রিকার নাম দিলেন জলার্ক – জলে প্রতিবিম্বিত সূর্য থেকে মানে করা যায় 888sport live footballে প্রতিবিম্বিত জীবন। জলার্ক প্রকাশের ইচ্ছেটা হলো জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, সুভাষ, বিষ্ণু দে প্রমুখের দরজা খোলার চিচিং ফাঁক মন্ত্র।
সৌভাগ্যক্রমে নিত্যানন্দ, বনবিহারী, মৃণাল, সোমনাথ, বিমান, ভবানী চিন্ময় প্রমুখ কয়েকজন সহপাঠীকেও পেয়ে গেলাম বন্ধু হিসেবে। আমার মা হলেন প্রথম পৃষ্ঠপোষক। অল্পদিনের মধ্যে আমি যথেষ্ট আস্থা ও øেহ পেলাম জীবনানন্দ ও সুধীন্দ্রনাথের কাছ থেকে এবং ক্রমশ তাঁদের বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। সুনীতিকুমার অবশ্য আমার সায়েন্স ছেড়ে আর্টস নেওয়ার জন্য কিছুটা বকুনি দিলেন, বললেন, ১৬ বছর বয়স হয়েছে, এখন জীবনের লক্ষ্য স্থির করে এগোনোর বয়স, বারবার এটা-ওটার পেছনে ছোটাছুটি করলে কোথাও পৌঁছবে না। কিন্তু একধরনের লক্ষ্যহীনতা ও অস্থিরতা ছিল ও আছে আমার স্বভাবে। আইএ পাশ করে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে ইংরেজিতে অনার্স পড়তে গেলাম, কিন্তু দুমাসের মধ্যে শান্তিনিকেতনে গিয়ে বিশ্বভারতীতে ইতিহাসে অনার্স নিলাম। সুনীতিকুমার আবার বললেন, এই একটা দোষ তোমার সমস্ত গুণ গ্রাস করে নেবে। তবে শান্তিনিকেতন আমার জীবনকে অনেকটাই পালটে দেয়। ছোটবেলায় কত শুনেছি ‘জীবনে কিচ্ছু হবে না’, ‘বস্তিতে জীবন কাটবে’, ‘আগের জন্মে জেলে ছিলে এ জন্মেও জেলে হয়েছ সামনের জন্মেও জেলে হবে’ ইত্যাদি তার ইয়ত্তা নেই। আমার জন্যে মাকেও অনেক কথা শুনতে হয়েছে। আনন্দচন্দ্র কলেজেও শুনেছি ‘লেডি ডাক্তারের ছেলে বলে যেন সবার মাথা কিনে নিয়েছে’, ‘পাকা হওয়া ভালো, বেশি পাকা হওয়া ভালো না’ ইত্যাদি মন্তব্য। কিন্তু শান্তিনিকেতনে এসে পেলাম সবার আদর, প্রশংসা এবং প্রচুর প্রশ্রয়। তবে শান্তিনিকেতনের শেষ কয়েক মাস আমি অজানা সব ব্যাধিতে খুব ভুগেছি, বারে-বারে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি, টেস্ট পরীক্ষার আগে অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিশেষ সেবাযতেœ রাখলেন। পরীক্ষা দেব না ভেবেছিলাম। অন্নদাশঙ্কর ও শিক্ষাসদনের অধ্যক্ষ হীরেন্দ্রনাথ দত্তের পরামর্শে অনার্স ছাড়াই পরীক্ষা দিলাম। বিএ পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের এমএ ক্লাসে ভর্তি হলাম। পুজোর ছুটিতে জলপাইগুড়িতে গিয়ে আবার ভীষণ অসুস্থ। এবার এক্স-রে করে ধরা পড়ল ফুসফুসের মস্ত ক্ষত মানে যক্ষ্মা। ফলে এক বছর গৃহবন্দি। প্রায় রোজই মায়ের কোয়ার্টার্সে জলপাইগুড়ির তরুণ 888sport live footballিকদের আড্ডা বসত। আসতেন কার্ত্তিক লাহিড়ি, সুরজিৎ বসু, কমলেশ চক্রবর্তী প্রমুখ। ছমাস বিছানায় থাকার পরে বন্ধুদের সঙ্গে সামনের ঝিলের ধারে ও মাঠে বেড়াতে যাওয়ার ডাক্তারি অনুমতি পেলাম। ততদিনে মেঘ কেটে উত্তর আকাশের নিচে তুষারে আবৃত পর্বতশ্রেণি সারাদিন আমাদের পাহারা দিতে হাজির হয়েছে, লক্ষ্মী পূর্ণিমার রাতেও কাঞ্চনজঙ্ঘার নগ্ন দেহ নিশ্চল শুয়ে থাকত জ্যোৎøার প্রবল প্লাবনে মূর্ছিতের মতো।
জলপাইগুড়ির বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা ও নরতত্ত্বজ্ঞ এবং বিখ্যাত চিকিৎসক চারুচন্দ্র সান্যাল মাকে বলেছিলেন, যক্ষ্মার জন্যে জলপাইগুড়ির স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার চেয়ে শান্তিনিকেতন বা অন্তত কলকাতার অপেক্ষাকৃত শুকনো আবহাওয়া ভালো। অনেকটা তাঁর কথাতেই মা কলকাতার যাদবপুরে একটা ছোট বাংলোবাড়ি করেন আর আমি সেখানে এসে বাস শুরু করি। এ সময় কেউ মাকে বলেন যে, তার ছোট ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে পা রাখার মুরোদ নেই। এতে মা দুঃখ পান এবং আমাকে এমএ ক্লাসে ভর্তি হতে বলেন। অন্যদিকে সুধীন্দ্রনাথ দত্তও আমাকে যাদবপুরে এমএ পড়ার জন্য চাপ দিতে থাকলেন। ‘যেটা শুরু করবে সেটা শেষ করবে’ – তাঁর এই কথাটা এখনো কানে বাজে। যাদবপুরে পড়লে ট্রামবাসের ধকল সইতে হবে না অথচ সুশোভন সরকারের মতো লিভিং লেজেন্ডের কাছে পড়তে পারবে। এমএ পড়তে এসে প্রেমে পড়লাম। প্রণয় থেকে পরিণয়। শাশুড়ি-বউমার এক অভিনব ইতিহাসের শুরু। শাশুড়ির কাছে থাকার জন্য মঞ্জু কাজ নিল দার্জিলিংয়ের লরেটো কলেজে। ইউনিভার্সিটির গোল্ড মেডালিস্ট সহজেই কাজ পেল পছন্দের জায়গায়। আমরা প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই শুক্রবার বিকেলে গাড়ি ভাড়া করে জলপাইগুড়ি চলে যেতাম আর ফিরে আসতাম রবিবার সন্ধ্যায়। আমরা দার্জিলিংয়েই পাকাপাকি বাস করব ভেবে ‘তপোবন’ নামে একটা বাড়ি কেনার পরিকল্পনাও করে ফেললাম। এমন সময়, ১৯৬৮-র অক্টোবরে, দার্জিলিংয়ের ইতিহাসে ঘটল দ্বিতীয় বৃহত্তম ধসবিপর্যয়। সৌভাগ্যক্রমে তখন মা দার্জিলিংয়ে আমাদের কাছেই ছিলেন। আর তখন জলপাইগুড়িতে ঘটে জলপাইগুড়ির সবচেয়ে বিধ্বংসী বন্যা। ওদিকে অবসরের ফলে মায়ের তখন কোয়ার্টার্স ছেড়ে দেওয়ার সময় এসে গিয়েছিল। তিনি দার্জিলিং থেকে ফিরে জলপাইগুড়ির রেসকোর্স পাড়াতে বাসা ভাড়া করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে লাগলেন। এক বছর পাঁচ মাস পরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দু ছেলে দু বউমা ও দু নাতি উপস্থিত। ছোট বউমার উদ্দেশে আধো আচ্ছন্ন মা কখনো বলছেন, ‘মা, গান করো’, কখনো বলছেন, ‘মা আমাকে কোলে করো।’ অবশেষে ১৯৭০-এর ৪ মে ঘোর অমাবস্যার ঝড়বৃষ্টির রাতে বজ্রবিদ্যুতের আলোতে একা-একা এতদিনের দেহ ছেড়ে চলে গেলেন অসীম শূন্যের অভিমুখে। আমারও জলপাইগুড়ির সঙ্গে বন্ধন ছিঁড়ে গেল।