কৃষেন্দু পালিত
রাজার বিয়ে বলে কথা, হেলাফেলা তো নয়। বাঁধুনি তাই বজ্র আঁটুনি। আর আমরাও আহাম্মক, খোঁজখবর না নিয়েই বিয়ের ঠিক এক সপ্তাহ আগে সীমান্ত শহর জয়গাঁও এসে হাজির হয়েছি। জয়গাও থেকে হাঁটাপথে ভুটানের প্রবেশদ্বার ভুটান গেট, ওপাশে রয়্যাল ভুটান রাষ্ট্র বা বজ্র ড্রাগনের দেশ। পারাপারে কোনো বিধিনিষেধ নেই। গেট পেরোলেই ফুন্টশেলিং। পারমিশন করাতে হবে এখান থেকেই। ভারতীয়দের জন্যে পাসপোর্ট-ভিসার প্রয়োজন নেই। সচিত্র পরিচয়পত্র দেখালেই চলবে।
এক সপ্তাহের প্রোগ্রামে বেরিয়েছিলাম, পারমিশন পেলাম মাত্র তিনদিনের। কারণ বিয়ের তিনদিন আগেই আমার মতো অবাঞ্ছিত অতিথিদের দেশছাড়া করে বিবাহবাসর ঝঞ্ঝাটমুক্ত রাখতে চায়। তাছাড়াও দেশবিদেশের হেভিওয়েট অতিথিরা আসছেন, তাঁদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করাও রাজার দায়িত্ব। কী আর করা যাবে, রাজ আদেশ শিরোধার্য করে পরদিন সকালেই রওনা হলাম রাজধানী থিম্পুর উদ্দেশে। ১৭৬ কিলোমিটার রাস্তা যেতে প্রায় আট ঘণ্টা লাগবে, অর্থাৎ পুরো একটা দিন যাকে বলে পথে মারা যাওয়া, ফেরার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। হাতে থাকল পেনসিলের মতো একটা দিন। অগত্যা এটুকুতেই খুশি হতে হবে।
ফুন্টশেলিং ছেড়ে কিছুদূর এগোতেই একপাশে চপল তোর্সা তো অন্যদিকে দামাল ছেলের মতো সারসার সবুজ পাহাড় – মাঝখানে পিচঢালা চওড়া মসৃণ রাস্তা। ভুটানের সর্বত্রই রাস্তাঘাট এরকম, কোথাও একটা পাতা পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক, মাত্র চার কিলোমিটার ব্যবধানেই ভুটানযাত্রার পথে প্রথম ব্রেক। ১৫০০ ফুট উচ্চতায় খারবন্দি পাহাড়ের ওপর গোয়াবাড়ি টিলা, টিলার ওপর বর্তমান রাজার পিতামহীর তৈরি চমৎকার একটি বৌদ্ধগুম্ফা। ২০ ফুট উঁচু পদ্মসম্ভবার মূর্তি রয়েছে এখানে। পাশেই খারবন্দি চেকপোস্ট। বিদেশিরা বিনা অনুমতিতে এই পর্যন্ত আসতে পারেন। চেকপোস্টে অনুমতিপত্র দেখিয়ে ভেতরে ঢোকার পারমিশন পাওয়া গেল। কিছুদূর এগোতেই চুখা বিদ্যুৎনগরী। তিববত থেকে আসা ওয়াং চু (চু অর্থাৎ নদী), ভারতে ঢুকে যার নাম হয়েছে রায়ডাক – নদীর ওপর ভারতীয় কারিগরি সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে চুখা হাইড্রেল প্রজেক্ট। সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই এখানে। পাখির চোখে চুখা বিদ্যুৎনগরী দেখতে-দেখতে এগিয়ে চলি আমরা।
দুপুর গড়িয়ে সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলেছে, আমাদের স্বাগত জানাল ‘ওয়েলকাম টু থিম্পু’ লেখা বিশাল তোরণ। এখানেও আর এক প্রস্থ চেকিং। চেকিংয়ের পর তোরণদ্বার পেরোনোর অর্থ ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে প্রবেশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই থিম্পুর প্রাণকেন্দ্র ঘড়ি টাওয়ারের সামনে পৌঁছে যাই আমরা। টাওয়ারের নিচে তখন চলছে ম-প সজ্জার কাজ। সাতদিনব্যাপী ভুটান উৎসবের আজই শেষদিন। স্থানীয় 888sport live chatীর সমন্বয়ে গান-বাজনার আসর বসবে। রেট একটু বেশি হলেও ঠিক উলটোদিকের একটা হোটেলে উঠলাম আমরা। ফ্রেশ হয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই টাওয়ারসংলগ্ন স্থায়ী গ্যালারিতে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে জায়গা করে নিলাম আমরা। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলল অনুষ্ঠান। তারপর ঘুরে দেখা স্যুভেনির শপগুলো। স্থানীয় হসত্ম888sport live chatের পসরা ছাড়াও চীন, ভারত ও 888sport appsের পণ্যের বেশ রমরমা এখানে। দাম আকাশছোঁয়া।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা হলাম পারোর উদ্দেশে। ভুটানের রাজধানী থিম্পু থেকে পারোর দূরত্ব মাত্র ৬৫ কিলোমিটার। পথে-পথে পড়ল পারো চু আর থিম্পু চু-র সঙ্গম। সঙ্গমে চেকপোস্ট। পারমিশন দেখিয়ে নদীর ওপর সুন্দর ঝুলন্ত সেতুটি পেরোলেই রাস্তা দুভাগ হয়ে একটি গেছে পুনাখা, অন্যটি পারোর দিকে। পারো চু সঙ্গী হয় এ-পথে। পথ যত এগোয়, নদীর রূপও তত মোহময় হয়, শেষে পারো পৌঁছানোর কিছু আগে থেকেই সে নিজেকে সম্পূর্ণ মেলে ধরে। তখন আর কোনো দিকে তাকানোর অবকাশ থাকে না। পারো চু বাধ্য করে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে। সম্মোহন জানে সে। সেই সম্মোহনের ঘোরে কখন পারো
পৌঁছে যাই বুঝতেও পারি না। নিসর্গের অকৃত্রিম মাধুর্য, উচ্ছল নদী, রং-বেরঙের ফুল, ক্যাকটাস, ছোট-ছোট গ্রাম, বাজার আর মেঘ কুয়াশা নিয়ে ২২৯০ মিটার উচ্চতায় চারপাশ পাহাড়ঘেরা এই গাঢ় সবুজ উপত্যকা নিঃসন্দেহে এক স্বপ্নের জগৎ।
আমাদের গাড়ি অর্ধচন্দ্রাকারে বাঁক নিয়ে খাড়া রাস্তায় বেশ খানিকটা উঠে এসে একটা হেয়ার পিন বাঁকের মুখে দাঁড়াল। এখান থেকে নিচে তাকালে বিসত্মীর্ণ উপত্যকাজুড়ে ছবির মতো পারো এয়ারপোর্ট। একটা ছোট বিমান রানওয়ে ধরে ছুটছে আকাশ ছোঁয়ার জন্য। এয়ারপোর্টের পেছনে ভুটানি শৈলীর এক বিশাল অট্টালিকা ব্যাকগ্রাউন্ড সিনারির মতো লটকে আছে পাহাড়ের গায়ে। ওটা নিশ্চয় পারো জং?
প্রশান্ত উপত্যকায় পাহাড়ের ওপর চারকোনা প্রকা- সাদা দুর্গটি মজবুত পাথরের তৈরি, কাঠের দরজা-জানালায় রংবেরঙের কারম্নকার্য একটি কাঠের পুল পেরিয়ে জংয়ে যাওয়ার রাস্তা। পুলটি সরিয়ে নিলেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, শত্রম্নর আক্রমণ থেকে বাঁচতে এই সতর্কতা। বর্তমানে এটি জাতীয় মিউজিয়াম। আটতলা এই মিউজিয়ামের প্রথম পাঁচতলা মাটির নিচে, ওপরে তিনতলা। ভেতরে অস্ত্রশস্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং প্রাচীন মূর্তি সযত্নে রক্ষিত আছে। এছাড়া আছে বিখ্যাত 888sport live chatীর হাতে আঁকা এক বিরাট তংখা। তংখাটি লম্বা ও চওড়ায় প্রায় ৪০ হাত। প্রতি বছর বসন্ত উৎসব বা সেচু উৎসবে এটি দেখানো হয় এবং এটি নিয়ে শোভাযাত্রা হয়। জংয়ের ভেতরে বিভিন্ন বয়সের লামারা বাস করেন। প্রায় ১১০০ বছর আগে তৈরি এই জংয়ের সমসত্ম খরচ বহন করে সরকার।
পারো মিউজিয়ামের পাশেই আছে কিছু লাখাৎ। এর আর এক নাম দুঙ্গুলি লাখাং। বিভিন্ন দেবদেবীর অবস্থান এখানে। লোককাহিনি অনুযায়ী পারো জংয়ে রাখার জন্য এই মূর্তিগুলো লাসা থেকে আনা হয়েছিল এবং এখানে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীকালে কোনো এক দৈবিক কারণে মূর্তিগুলোকে আর নাড়ানো যায়নি। সেই থেকে এখানেই আছে।
পারো থেকে আট কিলোমিটার দূরে কিছু গুম্ফাটি ভুটানের সবচেয়ে পুরনো গুম্ফা। ৬৫৯ সালে লাসার শাক্যমুনির গুম্ফারও আগে তৈরি এই গুম্ফা। শোনা যায় গুম্ফাটি একরাতে তৈরি হয়েছিল।
এছাড়া আছে ড্রুকগিয়েল জং। ষোড়শ শতাব্দীতে নওয়াং নামগিয়েল এটি তৈরি করেন। আছে তাকসাং মনাস্ট্রি। কথিত আছে গুরম্ন পদ্মসম্ভব বাঘের পিঠে চড়ে পারোর এই পাহাড়ে এসে যে গুম্ফাটিতে বসবাস শুরম্ন করেছিলেন সেটিই আসলে তাকসাং মনাস্ট্রি বা তাকসাং গুম্ফা। প্রায় চার কিলোমিটার চড়াই ভেঙে এই গুম্ফায় উঠতে হয়। ভুটানিদের কাছে এটি একটি পবিত্র তীর্থস্থান। আর আছে তুষারাচ্ছন্ন জোমলহরি, ভুটানের সর্বোচ্চ (২৩,৯৯৭ ফুট) শৃঙ্গ। কিন্তু এসব ঐতিহাসিক বা ধর্মীয় নিদর্শন বাদ দিলেও কেবল সৌন্দর্যের নিরিখেও পারোর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
পারোকে সুন্দরী বললে কম বলা হবে। রূপে-গুণে সে স্বর্গের উর্বশী কিংবা রম্ভাকেও হার মানায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে তীর্থ, ধর্ম আর ইতিহাসের আশ্চর্য সমন্বয়। এত পরিচ্ছন্ন আর শান্ত শহর এই উপমহাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। রাস্তায় কোথাও একটি পাতা পড়ে
থাকতে দেখা যায় না পর্যন্ত। সবকিছুই নিয়মবদ্ধ, সুশৃঙ্খল। মলিনতা নেই এখানকার মানুষের মনেও। তাই বোধহয় ক্রাইম শব্দটাও পারোর অভিধানে নেই। সাইপ্রাস গাছের জঙ্গল, তিববতি স্থাপত্যে নির্মিত ঘরবাড়ি আর রংবেরঙের জাতীয় পোশাকে সজ্জিত 888sport promo code-পুরম্নষ নিয়ে সুন্দরী পারোকে স্বপ্নরাজ বলেই মনে হয়। যে কোনো সময়, যে কোনো ঋতুতে, যে কোনো দিকে তাকালেই মনে হবে বিশাল ক্যানভাস জুড়ে অসাধারণ 888sport live chatকর্ম। যে কোনো পথে, যে কোনো দিকে যতদূর ইচ্ছা হেঁটে যান, মনে হবে স্বপ্নের মাটিতে পদচারণা করছেন। ফিরে এসে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। মনে হবে সবটাই একটা সুখস্বপ্ন।
সারাদিনের পারো সফর শেষ করে থিম্পুতে ফিরতে রাত হয়ে যায় আমাদের। অহেতুক দেরি না করে রাত ১০টার মধ্যে বিছানায়। কাল ভোরে উঠব। ভুটান 888sport slot gameে কালই আমাদের শেষ দিন। ১৭৬ কিলোমিটার উজিয়ে জয়গাও পৌঁছাতে হবে। তার আগে যতটুকু সম্ভব দেখে নেব ভুটানের রাজধানী থিম্পু।
ড্রাইভারকে সকালে আসতে বলেছিলাম। সেইমতো সকাল ৬টার মধ্যে সে গাড়ি নিয়ে হাজির। আমরাই বেরোতে লেট করি। ৭টা নাগাদ শুরম্ন করি থিম্পু-দর্শন।
ভুটানের অধিকাংশ শহরের নাম নদীর নামে। যেমন থিম্পু চু-র নামের থিম্পু। ভুটান ড্রুক রাজার দেশ বলেও পরিচিত। জাতীয় প্রতীক ড্রাগন। সরকারি ভাষা জোঙথা। ভারতের সঙ্গে সময়ের হিসাবে আধঘণ্টা এগিয়ে। এখানে টাকাকে বলা হয় নুলট্রাম বা ন্যু। মান ভারতীয় টাকার সমান। ভারতীয় টাকা ব্যবহারেও কোনো অসুবিধা নেই এখানে। ভুটানের পুরম্নষরা পরে রোব বা জোববা গোছের একরকম পোশাক, ভুটানি ভাষায় যার নাম খো। মেয়েরা পরে লং স্কার্টের মতো দেখতে কিরা। এগুলো ভুটানের জাতীয় পোশাক। সরকারি অফিসে জাতীয় পোশাক পরা বাধ্যতামূলক। যদিও অধিকাংশ ভুটানিই পছন্দ করেন জাতীয় পোশাক পরতে। বিশুদ্ধ সংস্কৃতি এবং অতীত ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে স্বকীয় জীবনযাপনেই তারা অভ্যসত্ম।
থিম্পুর দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য থিম্পু জং বা তাশি চো জং। অতীতের বৌদ্ধ বিহারকে সংস্কার করে ১৬৪১ সালে এই বিশাল দুর্গটি গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে এটি ভুটান সরকারের সচিবালয়। থিম্পু চোর্তেন আর একটি দর্শনীয় স্থান। ধবধবে সাদা রঙের এই বৌদ্ধ বিহারটির ভেতরে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ, সামনে অজস্র প্রদীপ জ্বলছে, প্রার্থনা করতে-করতে মন্দির প্রদক্ষিণ করছে অসংখ্য লামা। চোর্তেন প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াচ্ছে অজস্র পায়রা। টিভি টাওয়ার বা টাওয়ার ভিউ পয়েন্ট থেকে পাখির চোখে শহর থিম্পুর রূপও ভুলবার নয়। তবে চিড়িয়াখানা দর্শন একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা। এখানেই দেখা পেলাম ভুটানের জাতীয় পশু তাকিনের। অদ্ভুত দর্শন এই জীবটি এখন বিলুপ্তির পথে। এছাড়া উলেস্নখযোগ্য সার্ক বিল্ডিং, থিম্পু হাইকোর্ট, থিম্পু মনাস্ট্রি, হ্যান্ডিক্রাফটস্ এম্পোরিয়াম, সিমতোখা জং ইত্যাদি।
দুপুর ১২টার আগে হোটেলে ফিরে আসি। হোটেল ছাড়তে হবে। ব্যাগ গোছানোর কাজটা আগেরদিন রাতেই সেরে রেখেছিলাম, দ্রম্নত স্নান ও খাওয়া-দাওয়া সেরে ১টায় চেপে বসলাম গাড়িতে। ফিরতেই হবে। রাজার বিয়েতে আমরা অনাহূত, থাকার অনুমতি নেই যে।
কীভাবে যাবেন
শিয়ালদা থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে উত্তরবঙ্গের হাসিমারা নেমে সেখান থেকে জয়গাও। হাসিমারা থেকে জয়গাওয়ের দূরত্ব মাত্র ১৮ কিলোমিটার। এপারে জয়গাও, ওপারে ফুন্টশেলিং। ফুন্টশেলিং থেকে পারমিশন করাতে হবে। ভারতীয়দের জন্যে পাসপোর্ট বা ভিসার প্রয়োজন নেই, সচিত্র পরিচয়পত্র হলেই হবে। ফুন্টশেলিং থেকে কোস্টার বাসে বা রিজার্ভ গাড়িতে থিম্পু পৌঁছাতে পারেন। এছাড়া কলকাতা থেকে ভুটান পরিবহনের বাস ছাড়ে ফুন্টশেলিং যাওয়ার।
কোথায় থাকবেন
এখানে বিভিন্ন মানের এবং দামের অসংখ্য হোটেল আছে। সুবিধামতো একটায় দেখেশুনে উঠলেই হলো, বুক না করে গেলেও বিশেষ অসুবিধা নেই।
কখন যাবেন
বছরের যে কোনো সময়েই ভুটান যাওয়া যায়।
সতর্কতা
এখানে ধূমপান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কখনই প্রকাশ্যে ধূমপান করবেন না।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.