১৯৬৭ সালের ২৪ আর ২৫ মে। পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়িতে ঘটে যাওয়া এক তুমুল বিস্ফোরণ গোটা ভারতবর্ষকে যেন নাড়িয়ে দিয়েছিল। কৃষিজীবী-শ্রমজীবী মানুষগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীর যে-লড়াই, তাকে কমরেড চারু মজুমদার বলেছিলেন ‘স্বতঃস্ফূর্ত’। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবেই শ্রমিক-কৃষক রাষ্ট্রের সশস্ত্র শক্তির বিরুদ্ধে হামলা করে রাজনৈতিক পরিপক্বতার লক্ষণই দেখিয়েছে। কিন্তু এবারে তো সবাই মিলে প্রস্তুত-শক্তির সামনে লড়তে পারবে না। গেরিলা দলের সংগঠন ও কার্যকলাপের ওপর এখন থেকেই জোর না দিলে সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যেতে বাধা পাবে।’ অন্যদিকে, চিনের পিপলস ডেইলি পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হলো : ‘প্রচণ্ড গর্জনে ভারতের বুকে ধ্বনিত হয়েছে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ। দার্জিলিং অঞ্চলের বিপ্লবী কৃষকেরা বিদ্রোহে ফেটে পড়েছেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটি বিপ্লবী অংশের নেতৃত্বে গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী সশস্ত্র সংগ্রামের এক লাল এলাকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতীয় জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামের পক্ষে এটি এক প্রচণ্ড তাৎপর্যপূর্ণ বিকাশ।’ সেই বিকাশের ঢেউ পূর্ব বাংলা তথা 888sport appsেও বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে সেটাই তো ছিল স্বাভাবিক। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘পূর্ব বাংলা থেকে আগত বন্ধুদের প্রতি’ এক খোলা চিঠিতে কমরেড চারু মজুমদার লিখেছিলেন, ‘আপনারা এখানেই থাকুন অথবা পূর্ব বাংলাতেই ফিরে যান, আপনাদের সংগ্রাম করতে হবে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বাদ দিয়ে আপনারা সম্মানিত জীবনযাত্রা ফিরে পাবেন না। পূর্ব বাংলাতেও আজ বিপ্লবী পার্টি … সশস্ত্র সংগ্রামের পথ গ্রহণ করেছেন। আপনাদের উচিত তাঁদের সঙ্গে হাত মেলানো এবং তাঁদের সংগ্রামকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা।’ সেই সঙ্গে তিনি একথা বলতেও ভোলেননি যে, ‘দরিদ্র মানুষের পূর্ব বাংলা যেমন সোনার বাংলা গড়ে তুলবে, তেমনি দরিদ্র মানুষের পশ্চিম বাংলাও গড়ে তুলবে সোনার বাংলা। সেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আজকের সংগ্রামের জন্য তৈরি হন।’ পূর্ব বাংলায় বিশেষভাবে একাত্তর-পরবর্তী সময়ে 888sport appsে সেই সংগ্রাম বেশ জোরদারভাবেই শুরু হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখেই আফসান চৌধুরীর 888sport alternative linkটি নির্মিত হয়েছে।
তাঁর এক বক্তৃতায় ঔপন্যাসিক দেবেশ রায় অত্যন্ত সংগতভাবেই জানিয়েছিলেন, ‘888sport alternative linkই একমাত্র 888sport live chatরূপ যার কোনো রূপ নেই। 888sport alternative linkই একমাত্র 888sport live chatরূপ যা সফল কি বিফল, সার্থক কি ব্যর্থ, ভালো কি মন্দ এ কোনো কিছুই নির্ধারিত নয়, এমনকী সেটি একটি 888sport alternative linkই কি না, তাও এমনকি লেখকের কাছে স্পষ্ট নয়।’ তার মানে 888sport alternative linkের একটা সংজ্ঞাতিরিক্ততার কথাই দেবেশ রায় আমাদের বলতে চেয়েছেন। আর সেই প্রসঙ্গের উপান্ত থেকেই তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, ‘এই সংজ্ঞাতিরিক্ততা 888sport alternative linkকে এক মুক্তি দিয়েছে, কোনো নির্ধারিত আকৃতি থেকে মুক্তি, কোনো নির্ধারিত প্রকৃতি থেকে মুক্তি। আর এই, এই মুক্তিই 888sport alternative linkকে 888sport live chatের বাঁধন দিয়েছে, সে-বাঁধন 888sport alternative link নিজেই তৈরি করে।’ শুধু এইটুকুতেই তিনি থামছেন না; কোনো-কোনো অভিজ্ঞ পাঠককে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে আরো বলেছিলেন, ‘একটি অত্যন্ত খারাপভাবে লেখা 888sport alternative linkও আমাদের অপ্রস্তুত করে, শুধু এই একটি মাত্র কারণে, আমরা সেই 888sport alternative linkটির প্রথম লাইন থেকে শেষ লাইনে পৌঁছবার আগে জানতেই পারি না, এই 888sport alternative linkটিতে আমরা কী প্রত্যাশা করব।’ দেবেশ রায়ের কথার সূত্র ধরেই এবার জানাই আফসান চৌধুরীর 888sport alternative linkের নাম বিশ্বাসঘাতকগণ। এই 888sport alternative linkে দেখতে পাই একটি সাংগীতিক গঠন – তার স্থায়ী আছে, আছে অন্তরা, সেইসঙ্গে সঞ্চারী আর আভোগ।
দুই
888sport alternative linkটি শুরু হয়েছে জলিলের ঘটনা দিয়ে। গ্রামের সর্বস্বহারা মানুষদেরই একজন। যে এখন আর মানুষ নেই, লোকের চোখে একটা ‘জানোয়ার’ বই আর কিছুই নয়। সেই জলিলের চোখে একসময় স্বপ্ন ছিল, নতুন সমাজ গড়ার আশা ছিল। সে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে গিয়ে মিশেছিল যারা ছিল শিক্ষিত, শহুরে মানুষ – সেইসঙ্গে প্রতিবাদী, বিপ্লবী। যারা তাকে আর তার মতো আরো অনেককেই এই স্বপ্ন দেখিয়েছিল যে, ‘শুধু দেশ স্বাধীন হলেই চলবে না, মানুষকে স্বাধীন করতে হবে।’ জলিলের সঙ্গে জুটেছিল গ্রামের আরো মানুষজন, যাদের মধ্যে ছিল মস্তান গাজী। কিংবা এ-ও বলা যায়, জলিলই জুটেছিল মস্তান গাজীর সঙ্গে, আনন্দে আর উত্তেজনায়। সঙ্গে ছিল মনের একরাশ ক্রোধ আর আশা। তারই ওপর ভর দিয়ে মস্তান গাজী জলিলকে বলেছিল, ‘শোন জলিল, সাহেবদের ছাওয়াল-পাওয়ালদের কথা কইতে দে। হেরা শিক্ষিত মানুষ, হেরা শহরের লোক, তারা আমার লাহান চাষা আর কামলার বেটা নাকি, না বুইজ্যা এই কামে আইবো। এইটাই আমাগো পথ। এখানে আগে আইছি, তোর বাপেও গেছে, আমার বাপ-দাদা সবাই গেছে। ওর মধ্যে হার-জিত কই? এটাই আমাগো পথ।’ এ যেন ঠিক সেই ‘নকশালবাড়ির পথই আমাদের পথে’র প্রতিধ্বনি। মস্তান গাজীর কথা শুনে আনন্দে আত্মহারা জলিলও তার সঙ্গে সায় দিয়ে একদিন বলে উঠেছিল, ‘সত্যিই! আমরা কত লোক হইছি এক হমানে। সবাই মিলা গেছি। দেহো না, আমরা কত জন! আমাদের কত বল, আমরা সবতে মিলা পারুম। সাহেবের পোলারাও আইছে গেরামে। হেরা কি আর না জাইনা আসছে। হেরা ঠিকই জানে, দিন আইসা গেছে। কামলার দুনিয়া অইবো, ভাতের কষ্ট জিন্দিগিতে থাকব না।’ জলিল আর মস্তান গাজীর এই যে আশা আর এইটুকু স্বপ্ন – এদের মধ্যে দিয়েই 888sport alternative linkটির পটভূমি যেন নির্মাণ করেন ঔপন্যাসিক। বাকিটা পাঠককেই বুঝে নিতে হয়। আর 888sport alternative linkের ঘটনা? তাকেও শুরুতে বিস্তৃত না করে জলিলের বয়ানে আমাদের জানিয়ে দেন আফসান চৌধুরী। কীভাবে সেটা জানতে পারি? শহরের অচেনা-এক পতিতাকে জলিল বলে – ‘জানিস আমরা কেন গেছিলাম? বিশ্বাস করছিলাম ভাত পামু, খাওন পামু, সব পামু। এতে জান গেলে আর এমন কী! শহর থন মানুষ আইছে না, হেরা মরতাছে না? কামলার জান আর সাহেবগো পোলার জান কি এক? হেরা মরতাছে না, হেরা সারা রাত ঘরের মাচায় থাকতাছে না, মুড়ি খাইয়া দিনের পর দিন? লোটার মধ্যে মুতে সারা দিন, হেইটাই মুহের কাছে রাহে, রাত্রে নাইমা পায়খানায় যায়, ভাত খায়। হেরপর আমাগো লগে যুদ্ধে যায়। আমরা ওইটুকু পারুম না?’ আবারো প্রশ্ন ওঠে, কোন যুদ্ধ? একাত্তরের স্বাধীনতার যুদ্ধ কি ছিল সেইটা? না, জলিল বলে, ‘দেশ স্বাধীন যথেষ্ট না, মানুষ স্বাধীন করতে অইবো। হেই যুদ্ধে গেছিলাম।’ যুদ্ধে তো মানুষ মরে, সে শত্রুই হোক আর মিত্রই হোক। কিন্তু জলিলের হিসাব ভিন্ন। সে বলে, ‘মানুষ মারি নাই বেটি, শত্রু মারছি যুদ্ধে।’ আর সেই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছিল যে ‘ভাতের যুদ্ধ সাংঘাতিক যুদ্ধ, পেটের যুদ্ধ শেষ যুদ্ধ। কিন্তু তখন বুঝি নাই – ভাতের এত দারোয়ান, ধানের এত পাহারাদার! মানুষ, পুলিশ, মেলেটারি, লাইঠ্যাল সবাই আমাদের মারলো। পারলাম না।’ কামলাদের সেই বিপ্লব ব্যর্থ হয়, যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়। তারপরেই শুরু হয় প্রতিপক্ষের হাতে মার খাওয়া। জলিলের মুখ থেকেই জানতে পারি – ‘হগলেই মারছে, পুলিশ মারছে, জোতদারে লাইঠাল মারছে। আমার বউরে যে লইয়া গেছে সেও মারছে। কামলারে সবাই পিটায়।’ এমনকি তার দ্বিতীয় স্ত্রী মর্জিনা, যে কি না মস্তান গাজীর একমাত্র মেয়ে, সে-ও জলিলকে ছেড়ে জমিদারের বনেদি লাঠিয়াল, প্রতাপশালী আমানের ঘরে চলে যায়। ক্ষুধা আর অপমানের মধ্যে বাস করতে-করতে মেয়েটি তার নিজের হতদরিদ্র দশাকেই যেন একসময় তীব্র ঘৃণা করতে থাকে। তার ঘৃণা শুধু নিজের বাপ মস্তান গাজী কিংবা স্বামী জলিলকেই নয়। ঔপন্যাসিক জানাচ্ছেন, ‘মেয়েটা কিছুতেই ভুখা থাকবে না। কেন থাকবে? যার ঘরেই যাব না কেন, খাওয়া চাই, কাপড় চাই। এখানকার কেউ এই যুদ্ধে জেতেনি, আমার বাবা পারেনি, আমার দাদা না, আমার দাদার দাদা না, আমার বাবার বয়সী বুড়ো ভেদাইমা কামলা জলিলও না। যেখানে ভাত আছে, সেখানেই আমার ঠিকানা।’ এখানে ঔপন্যাসিকের কণ্ঠস্বর আর মর্জিনার কণ্ঠস্বর যেন আমরা একলয়ে শুনতে পাই। পুরো 888sport alternative link জুড়েই এরকম গঠন-ক্রিয়া ঔপন্যাসিক বজায় রেখেছেন। এই 888sport alternative linkে আঙ্গিকের অভিনবত্বের কথা যদি কিছু বলতেই হয় তা হচ্ছে এই চরিত্রের স্বরের সঙ্গে লেখকের স্বরের এক অসাধারণ যুগ্মতা। তাদের ঐক্য-সংস্থান। মর্জিনা শেষ পর্যন্ত আমানের সঙ্গেই চলে যায়। চলে যায়, কেননা ঔপন্যাসিক আরো খানিকটা খোলাসা করে মর্জিনার মনের ভেতরের গ্রন্থিটা খুলে পাঠককে জানান – ‘এতদিন পর ঘৃণা আর বিদ্রোহের স্রোতে ক্ষুধার বাঁধের কারণে বাধা পেয়ে শ্রান্ত। সেখানে পরাজিত জলের বসবাস, সেখানে মেনে নেওয়ার শান্তি সেখানে সাধারণ মানুষের সাধারণ আকাক্সক্ষার বিজয়। মর্জিনা তাই তার সাথেই থাকতে চায়। ওখানে মানুষেরা রাতে চলে যায় না অন্য কারো ধানের খবর নিতে। এখানে মানুষেরা জোয়ান বউদের সাথে সহবাস করে, ভালোবাসে, সংসার করে।’ মর্জিনা তাই জলিলের বদলে আমানকেই বেছে নেয়। পরাজিত, হেরে-যাওয়া জলিলকে সে গ্রহণ করতে নারাজ। জলিলও স্বীকার করে, ‘যুদ্ধে আমরা হাইরা গেছি। আর যারা আমাগো যুদ্ধে যাইতে কইছিলো হেরা কয়ডা মরছে, বাকিরা বেবাক চইলা গেছে। … শিক্ষিত মানুষ, শহরের মানুষ। যেহান থন আইছিলো হেয়ানেই ফেরত গেছে।’
তিন
কেন ফেরত গেছে, কেন শহর আর গ্রামের মিলিত মানুষের ধান দখলের এই যুদ্ধে তাদের হার হলো আর ভুলটা কার কোথায় কিংবা কিসে? এত সব প্রশ্ন জলিলের মাথায় ভর করলেও এর কোনো যথার্থ উত্তর তার জানা নেই। আর জানা নেই বলেই সে অবসন্ন বোধ করে। ঔপন্যাসিকের ভাষায় – ‘অনেক সময় সে আজকাল চলতে পারে না, গ্রামের পথে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। তারপর বহুক্ষণ শুয়ে থাকে। এখন কেউ তাকে খুব একটা কাজে ডাকে না। তাতে জলিলের কষ্ট নেই। তার না খেলে চলবে।’ কারণ সে জানে যে ‘খাবার, ভাত, ক্ষুধা, পেট – এইসবই তো আসলে শ্লোগান।’ যে-স্লোগানে ভর দিয়েই তারা একদিন যুদ্ধে গিয়েছিল, ধান কাটার যুদ্ধে। যুদ্ধজয়ের পরে মুখস্থ স্লোগানের বদলে জলিল তার নিজস্ব স্লোগানে রাতের অন্ধকার আকাশ কাঁপিয়ে বলে উঠেছিল : ‘ভাত দেও, ভাত দেও, শালার ব্যাটা ভাত দেও।’ তার মতো একজন কামলার এর চেয়ে বেশি আর কী-ই-বা চাওয়ার থাকতে পারে! শুধুই কি তার নিজের একার স্লোগান ছিল সেটা। আমরা জেনে যাই, জলিলের সেই অভিনব স্লোগান শুনে একসময় তার নিজের দলের লোকেরা ‘সবাই প্রথমে খুব হেসেছিল, তারপরে সবাই গলা মিলিয়েছিল। কথাগুলো ভেতর থেকে যেন উঠে আসা তাদের সকলের আত্মার ভাষা।’ সেই আত্মার ভাষাকেই যেন রূপ দান করতে পেরেছেন আফসান চৌধুরী। নেশাসক্ত, পরাজিত জলিল যখন রাস্তায় শুয়ে পড়ে গোঙায়, তখনো সে তাদের সেই আত্মার ভাষায় গোঙাতে-গোঙাতে বলে ওঠে, ‘ভাত দেও, ভাত দেও, শালার ব্যাটা ভাত দেও।’ ঔপন্যাসিক আমাদের কাছে তুলে ধরেন যে, এ-যেন শুধুই জলিলের একার গোঙানি নয়, এ হলো মানবচৈতন্যের এক আলোড়ন। সেই আলোড়নটুকু এই 888sport alternative linkকে প্রতি মুহূর্তে যেন জীবন্ত এক আখ্যানে রূপান্তরিত করে চলে। আর সেই সূত্র ধরেই আমরা সামাদের সন্ধান পাই। শহর থেকে যে-শিক্ষিত মানুষগুলো গ্রামে গিয়ে মস্তান গাজী আর জলিলদের মতো মানুষদের নিয়ে দেশ স্বাধীন যথেষ্ট নয় বলেই মানুষকে স্বাধীন করবার যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদেরই একজন এই সামাদ।
সামাদের জীবনের একটা অংশ ‘গোধূলী’ গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এই গ্রামেই সে বিপ্লব করার জন্যে এসেছিল। গ্রামের সবচাইতে দাপুটে লোক হচ্ছে মফিজ উদ্দীন পাটোয়ারী। তার লোকজনের হাতে কান্তি নামে জব্বার কামলার কিশোরী মেয়েটি ধর্ষিত হয়। শুধু তা-ই নয়, ধর্ষণশেষে কান্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। লেখকের বিবরণে পাচ্ছি – ‘মেয়েটি মুখ উল্টে পড়ে ছিল। তার শরীরে জখমের দাগগুলোও লুকোতে পারেনি প্রায় যৌবনা দেহের চিহ্নগুলো। লাশের পাশে বসে কান্তির মা একটানা কেঁদেই চলছে, যেন তার শরীরে অজস্র এবং অসম্ভব শক্তি রয়েছে এই কান্নাকে ধরে রাখার। যেন সারা দিন, সারা রাত, সারা জীবন সে কাঁদতে পারবে। তার কান্নার কোনো অভিযোগ নেই, কোনো প্রতিশোধের ইচ্ছা নেই। শুধু যন্ত্রণা আছে, শোক আছে। সে শোকের যেন কোনো চিহ্ন, সীমানা কিছুই নেই, প্রায় জান্তব, প্রায় অজানা, নিজের দেহের ভেতর সন্তান ধারণের অভিজ্ঞতার সাথে মিল খাওয়া বিকট এক উচ্চারণ।’ এই বাক্য-কটির মধ্যে দিয়ে কান্তির মায়ের জীবনের নিদারুণ বাস্তবতা, অসহায়ত্ব, ঘটনার প্রতিকারের অসমর্থতা – সবকিছুই স্তরে স্তরে একইসঙ্গে যেন পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে। আর তার রেশ গিয়ে শেষ হয় গ্রামের অসহায় মানুষগুলোর মনে শোকের মেঘ জাগিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে। ঔপন্যাসিকের বয়ানে সেসব লিপিবদ্ধ হয় এভাবে : ‘মানুষগুলো কিছুই করছিল না। এতগুলো পুরুষ, তবুও একটি মেয়েমানুষের বিলাপের সামনে তারা অসম্ভব রকম অসহায়।’ শোক কাটিয়ে উঠে গ্রামের মানুষগুলো যখন কান্তির জানাজার জন্যে প্রস্তুতি নেয়, তখনই এলাকার ইমাম সাহেব শরিয়তের প্রসঙ্গ তুলে সবাইকে জানিয়ে দেন যে, কান্তির নামাজে জানাজা হবে না। তিনি প্রশ্ন তোলেন, মেয়েমানুষ হয়েও কেন কান্তি অত সকালে ঘরের বাইরে গিয়েছিল? ‘আমাদের মেয়েরা তো ঘরের বাইরে যায় না।’ অসহায় মানুষগুলো সবাই চুপ থাকে, একমাত্র জলিলই বিড়বিড় করে বলতে পারে – ‘বেটা পাটোয়ারীর টাকা খাইছে।’ কিন্তু সে-উচ্চারণ এতই আস্তে যে তাতে কোনো অভিঘাত তৈরি হয় না। কান্তির জানাজার সূত্র ধরে অতীতের নানা ঘটনার টুকরো গ্রামের মানুষের সম্মিলিত মনের মধ্যে যেন নানাভাবে তরঙ্গায়িত হয়ে ওঠে : ‘যে-ই মরুক মুসলমানের লাশ হলে ঠিকই কবর হয়েছে, জানাজা হয়েছে, এমনকি গণ্ডগোলের বছর যখন বাইরে থেকে এসে মানুষ মেরেছে, সবাইকে মুসলমান কিনা – জিগ্যেস করেছে, লুঙ্গি খুলে দেখেছে, তখনো দু’রাকাত শেষকৃত্য বাদ পড়েনি। এমনকি প্রাণের ভয়ে মরণ চন্দ্র নাপিত যখন মুসলমান হলো, কিন্তু তবুও খান সেনার গুলি খেল, অসহায় শেষ মুহূর্তে কলমা পড়তে পড়তে মরল, যেন বেঁচে যেতেও পারে, এইভাবে শেষ ভরসায়, তারও কবর হয়েছে। কিন্তু কান্তির লাশের কী হবে?’ তার পরেও মানুষগুলোর চিন্তাস্রোত যেন থেমে থাকে না – ‘এটা তো দুর্ভিক্ষের বছর নয় যে, নিজের মানুষের লাশ পেছনে ফেলে শহরের রাস্তার দিকে এগিয়ে যাওয়াই একমাত্র কাজ, লাশের গন্ধের ভিড় ঠেলে একটু এগোনো মানেই একটু বেশিক্ষণ বেঁচে থাকা।’ মানুষগুলোর আপাত এলোমেলো চিন্তার মধ্যে নিপুণভাবেই ঔপন্যাসিক অতীতে ঘটে-যাওয়া নানা ঘটনার বুনন করেছেন। তাঁর এই কৃতিত্বটা একেবারেই ফেলনা নয়। অবশেষে স্কুলের হেডমাস্টার শাহাবউদ্দীন নিজে জানাজা পড়াতে রাজি হলে গ্রামের মানুষগুলোর মধ্যে একটা ‘আনন্দের উৎসব’-এর ঢেউ বয়ে যায়। ঔপন্যাসিক আমাদের জানাতে ভোলেন না যে, এই হেডমাস্টারও শহরের মানুষ, কিন্তু স্কুলের চাকরি নেওয়ার পরে আর শহরে ফিরে যাননি। গোধূলীতে হানু সওদাগরের মসজিদকে কেন্দ্র করে যে-গল্প আমাদের শোনান আফসান চৌধুরী, তা যেন গ্রামীণ জাদুবাস্তবতার এক অনন্য কথকতা। এই মসজিদ বানানোর সময় তিন-তিনবার করে ভেঙে পড়ে। মসজিদ ভাঙার দোষ প্রথমে গিয়ে পড়ল এলাকার হিন্দুদের ওপর। সন্দেহ করা হলো এই হিন্দুদের কেউ-কেউ জাদু করেছে। আর তাতে করে ‘বেশ কিছু হিন্দু মরল, ঘরবাড়ি পুড়ল … হিন্দুরা পালাইতে লাগল।’ তার পরে স্বপ্নে দেখে জানা গেল হিন্দুদের কোনো দোষ নেই। ‘দোষ হানু মিঞার ট্যাকার। হারামের ট্যাকা, ব্ল্যাকের ট্যাকা, কালোবাজারির ট্যাকার। … হেই পয়সায় কি আর মসজিদ হয়?’ এরকম একটা গ্রামই কি না শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীদের হাতে ‘মুক্ত এলাকা’ হিসেবে গড়ে ওঠে। আখলাক, শফিক, সারোয়ার, জয়নাল, বোরহান – সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন-দেখা এরকম কিছু মানুষ একত্রিত হয়। প্রত্যন্ত গ্রাম – আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গ্রামটি পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে। এলাকার সবচাইতে বড় ভূস্বামী মিঞাবাড়ির আফতাব জঙ্গের বড় ছেলে নেওয়াজও এই দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তাতে দলটির জন্যে একটি বাড়তি সুবিধা যোগ হয়। ঔপন্যাসিক জানাচ্ছেন – ‘শহরে গিয়েছিল গ্রাম থেকে একটা অবুঝ কিন্তু মেধাবী কিশোর ছেলে, ফিরে আসে একজন মাওবাদী কমিউনিস্ট হয়ে। বাবার মৃত্যুর পর সে-ই বাড়ির প্রধান হয়। তার জন্যই পার্টি এত সমর্থন পাচ্ছে।’ তল্লাটের বড়ো ভূস্বামীর ছেলে হয়েও নেওয়াজ বিশ্বাস করে যে, পার্টিই হচ্ছে একজন বিপ্লবীর আসল পরিবার। আর অন্যদিকে বাড়ির অপরাপর ‘শরিকরা অপেক্ষায় আছে, কবে পুলিশ তাকে বাঁধবে। কবে তারা কর্তৃত্ব ফিরে পাবে। যদিও নেওয়াজ তার চাচাদের কোনো কিছুতে বাগড়া দেয়নি; তবু একটা ছোকরা, একটা বেয়াদব, বাড়ির মুরুব্বি হবে – এটা কেউ মেনে নেয়নি।’
চার
পার্টির সাংগঠনিক কাজকর্ম আর তার তৎপরতার কথা বলতে গিয়ে ঔপন্যাসিক জানিয়েছেন : ‘গোধূলী আঞ্চলিক কেন্দ্র, আশ্রয়স্থল, মুক্ত এলাকা। যদিও মিঞাবাড়ির বিত্ত আছে, এলাকায় দাপট আছে কিন্তু তবু গোপনীয়তা পালন করা হয় যতটা সম্ভব। আফতাব মেমোরিয়াল স্কুলকে কেন্দ্র করেই তাদের কাজ। স্কুল আর দল দুটোই একসাথে চলছে। অনেক শিক্ষক পার্টির ক্যাডার, তাতে মানুষের সন্দেহ একটু কম হয়। বাকিটা “বিপ্লবের অনিবার্য প্রয়োজনের তাগিদে বিপদের বোঝা” সবাই মেনে নিয়েছে।’ সামাদ তার দলের কর্মীদের জানায় : ‘জনতার বিজয় সুনিশ্চিত ছিল ’৭১-এর সবুজ আষাঢ়ে, আজ আর তা মনে হয় না। বিভিন্ন দলের নেতারা ধরা পড়েছে, জেলে গেছে, মারা গেছে। কোনো কোনো দলে দলাদলি এত বেশি যে, তারা সারাক্ষণ শত্রুর চেয়ে নিজেদের সাথে যুদ্ধ করতে বেশি ব্যস্ত। অন্যেরা তার কথায় সায় দেই।’ সামাদ দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। সে-কারণেই হয়তো-বা কিংবা তার স্বভাবের কারণেই কারো সঙ্গেই সে ‘কোনো তর্কে যায় না, নিজের পার্টি নিয়ে কিছুই বলে না। এমন কিছু বলে না, যাতে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে।’ মাঝে মাঝে মনে হয়েছে আফসান চৌধুরী এই বিপ্লবী রাজনীতির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খুব বেশি সরলীকরণ করেছেন। এটা তাঁর এই 888sport alternative linkের দুর্বলতার একটি লক্ষণও বটে। একজন নেতা দলের অন্য নেতাকর্মীদের সঙ্গে কোনো তর্কবিতর্ক করবেন না, নিজের দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে, এমনকি ইতিবাচক দিকগুলো নিয়েও কিছুই বলবেন না – ব্যাপারটি অস্বাভাবিক মনে হয়। সামাদ তো বিপ্লবী – মুখচোরা, লাজুক কোনো প্রেমিকপুরুষ নয়। আর বিপ্লব তো নিছক প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপার নয় যে ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কায় সবকিছু শেষমেশ বুঝে-শুনেও চুপ করে থাকতে হবে। কমরেড মাও সে তুং তো বলেইছিলেন যে, ‘বিপ্লব কোনো ভোজসভা নয়।’ ঔপন্যাসিকের ভাষায় : ‘পার্টি ও রাজনীতির জন্য এটা জটিল সময়। চারদিকে নানাভাবে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, খুনখারাবি লেগে আছে। অনেকে বলে, রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা নেই বলেই এইসব ঝুটঝামেলা। সেই কারণেই এতসব তর্ক-বিতর্কের জন্ম। সব সত্যই একটা সত্য, সব দলই একটা দল।’ রাজনীতি সম্পর্কে কাদের কোনো ধারণা নেই – ওই মাওবাদীদের? তারা একসময় যে নানা দল-উপদলে খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছিলেন সেটা কি শুধুই নিছক রাজনীতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণার অভাব ছিল তা-ই? মাওবাদীদের সম্পর্কে এত বড়ো মিথ্যে অপবাদ তাদের চরম শত্রুরাও দিতে পারবে বলে মনে হয় না – তবে আফসান চৌধুরী দিয়েছেন। আর এটাও বুঝতে কষ্ট হয় যে ‘সব সত্যই একটা সত্য, সব দলই একটা দল।’ তাহলে তো বলতে হয় ইস্ট পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী), পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী), পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি, এমনকি জাসদের গণবাহিনী কি মণি সিংহদের কমিউনিস্ট পার্টি – সব এক পার্টি! মাঝে মাঝে মনে হয়েছে বাম-মতবাদ বিশেষ করে ‘মাওবাদ’ সম্পর্কে ঔপন্যাসিকের চরম বিতৃষ্ণার প্রকাশ এসবের ভেতর দিয়ে। যদিও কখনো কখনো নিজের সপক্ষে একটা ব্যাখ্যাও তিনি দাঁড় করাতে চেয়েছেন : ‘লোকে বলে, পৃথিবীতে একটাই সত্য হতে পারে, একটা সঠিক লাইন। সাচ্চা কমিউনিস্ট দল কেবল একটা দলই হবে, একটাই থাকে। তারাই সর্বহারা শ্রেণির প্রতিনিধি। বিপ্লব সংগঠিত করার দায়িত্ব ও অধিকার কেবল তাদেরই। এই অবধারিত মার্ক্সীয় সত্য সবাই মেনে নিয়েছে, অতএব প্রত্যেকেই সঠিক। তাই সবাই অন্যের শত্রু হতে বাধ্য। তত্ত্ব তাদের নিয়ে গেছে হননের, সংঘাতের অবধারিত পথে। শত্রুতা, এমনকি পার্টির অভ্যন্তরীণ অবস্থা, এইসব নিয়ে অনেক দূরে গড়িয়েছে। এই ‘অবধারিত’ যুক্তি আর কৌশল প্রয়োগের ফলে অনেক ছেলের প্রাণ গেছে, যাবে আরো।’ অথচ অবাক করার মতো ব্যাপার এই যে, গোটা 888sport alternative linkে কিন্তু আমরা একবারের জন্যেও তত্ত্ব নিয়ে, পার্টির রাজনৈতিক বা সামরিক কৌশল নিয়ে কোনো প্রকার হনন বা সংঘাত দেখতে পাই না। দলের লাইন নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়েছে, সে-ও খুব সামান্য। যে-সামাদকে আমরা খতমের লাইনের তীব্র বিরোধিতা করতে দেখি, সেই সামাদই আবার পাটোয়ারীকে খতম করার পরিকল্পনা করতে গিয়ে ‘এক অদ্ভুত বেদনামিশ্রিত আনন্দ’ অনুভব করে। বলা যায়, পরিস্থিতি পূর্বাপর পর্যালোচনা না-করেই পাটোয়ারীকে হত্যা করার যে-সিদ্ধান্ত সামাদ নিয়েছিল, তার প্রতিক্রিয়াতেই পাটোয়ারীর শহরে-থাকা ছেলেরা আর তাদের লোকজন সেইসঙ্গে সশস্ত্র পুলিশ এসে পুরো ‘গোধূলী’ গ্রামটা তছনছ করে দেয়। গ্রামের যারা বিপ্লবী দলের সঙ্গে জড়িত ছিল তারা ধরা পড়ে, মার খায় অথবা শেষ পর্যন্ত মারা পড়ে। জোতদারের লোকজনের হাতে আটক জব্বারের এই উপলব্ধি হয় যে, ‘ক্ষুধার সাথে লড়াইতে
কোনো দিন জেতা যায় না … তার বাবা জেনেছিল … তারও বাবা, যতদূর তাকানো যায় কেবল ক্ষুধা আর জন্মের বিলাপ।’ বিলাপের সুর এই 888sport alternative linkে কখনো কখনো খুবই উচ্চগ্রামে বেজেছে। তাতে করে 888sport alternative linkের সাংগীতিক দ্যোতনা মাঝে মাঝেই যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছে। আর পাঠক হিসেবেও এইখানে এসে মাঝে মাঝে চরম হতাশ হতে হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে নিজের কর্মকাণ্ডের সামগ্রিক পর্যালোচনা করতে গিয়ে সামাদের মনোজাগতিক কেন্দ্রে সংঘটিত আলোড়ন-বিলোড়নের যে-পরিচয় দিয়েছেন ঔপন্যাসিক, তাতে করে তাঁর বিশ্লেষণ ক্ষমতার পরিধিটি বুঝতে পারা যায়। যে-কারণে আফসান চৌধুরীকে একজন সফল ঔপন্যাসিকের মর্যাদাটা দিতেই হয়। তিনি লিখেছেন : ‘সে যে পরাজিত হয়েছে, সেটা সামাদ বোঝে। এটাই স্বাভাবিক ছিল। যেমন আজ মনে হয় পাটোয়ারীকে হত্যা করার রেইডের পরিকল্পনা কোনো রাজনৈতিক ইচ্ছা থেকে জন্ম নেয়নি, জন্ম নিয়েছে তার অহংকার আর অভিমান থেকে।’ তার মানে সোজা ভাষায় বলা যায়, পাটোয়ারী-হত্যাকাণ্ডটি ছিল সামাদের দিক থেকে একটি ব্যক্তিগত হঠকারিতা। যার মূল্য তাকে দিতে হয়েছে, তার সহযোদ্ধারা দিয়েছে, দিয়েছে তাদের সংগঠিত পার্টিও। কাজেই তার তো মনেই হওয়া স্বাভাবিক যে, সে পরাজিত হয়েছে। ঔপন্যাসিক আরো জানাচ্ছেন, ‘তার (সামাদের) কিছুই বোঝা হলো না। শেষ পর্যন্ত পার্টির সাথে আর বিপ্লবের পথ এক কি না, সেটাও জানা হলো না; বিপ্লবের পথ আর মুক্তির পথ এক কি না, সেটা তো নয়ই। এইসব প্রশ্নের উত্তরের আশঙ্কায় সে সন্ত্রস্ত। তার চেয়ে সংসারের জগৎ অনেক নিরাপদ।’ পার্টি থেকে পদত্যাগ করে সামাদ শেষ পর্যন্ত সংসারেই ফিরে যায়; তার আর অন্য কোনো উপায় থাকে না। 888sport appয় গিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে প্রেসের ব্যবসায় যুক্ত হয়।
পাঁচ
জীবন যখন এভাবেই চলে যেতে থাকে, তখন একদিন সে খবর পায় যে সদ্য জেল থেকে বেরুনো পার্টি নেতা ‘রহমান ভাই’ তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সামাদ প্রথমে বলে ঠিকই ‘আমার সাথে কী কথা? আমার সাথে কী আলাপ থাকতে পারে? আমি তো ওইসব অনেক দিন ছেড়ে দিয়েছি। আমার সাথে আবার কী কাজ?’ কিন্তু অবাক হয়ে খেয়াল করতে হয় যে সামাদ শেষ পর্যন্ত ঠিকই রহমানভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে। এটাকে কি পার্টি আর তার নেতৃত্বের প্রতি তার পুরনো আনুগত্যের রেশ বলে ধরে নিতে হবে? রহমানভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে সামাদ তাঁকেও প্রথমেই জানিয়ে দেয়, ‘আমি আর কোনো দিন রাজনীতিতে যাব না।’ এটা সে বলে ঠিকই, কিন্তু যখন রহমানভাইয়ের কাছ থেকে তার এককালের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা শফিকের বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানতে পারে, তখন তাকে শেষ পর্যন্ত ঠিকই খতমের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আসলে সামাদ চরিত্রটি নিয়ে শুধু এই 888sport alternative linkের পাঠকরাই নয়, স্বয়ং ঔপন্যাসিকও যেন নানা ধরনের বেকায়দায় পড়েছেন। চরিত্রটির কোনো-একটা পরিপূর্ণ আদল দিতে তিনি পারেননি। নাকি তিনি আদল দিতে চানওনি – ঠিক বুঝতে পারা যায় না। সামাদের চোখে ‘বিশ্বাসঘাতক তো তারাই, যারা কথা দিয়ে কথা রাখে না। যারা কিছুদিনের জন্য বিশ্বাস করে, কিন্তু অনেকের পথ সারা জীবনের জন্য বন্ধ করে দেয়।’ শফিকের সন্ধানও যে পেয়ে যায়, আর তাকে খতম করতে গিয়ে নিজেই খতম হয়ে যায় – ‘আততায়ীর শিকার হয়ে যায়।’ তাদের বিপ্লব তো ব্যর্থ হয়েছিল আর সেই বিপ্লবের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদেরও নানাভাবে ব্যর্থতাকেই গ্রহণ করে নিতে হয়।
শেষ পর্যন্ত বিপ্লব তাদের কী দিলো – এই প্রশ্নের কোনো সুরাহা হয় না। সুরাহার পরিবর্তে আমরা পেয়ে যাই তোরাব আলীকে। সামাদ-শফিক-রহমান-জলিলদের উত্তরাধিকার। বিপ্লব ব্যর্থ হয়, কিন্তু বিপ্লবী মতবাদের মৃত্যু নেই। সে তার মতো করে এগিয়ে যায়, তোরাবও এগোয়। তার ভাবনা : ‘মানুষ কেন ভুখা যায়, কবে মানুষ ভাতের অধিকার ফিরে পাবে?’ আর সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই তার এগিয়ে যাওয়া, তাদের সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাওয়া। যেভাবে নদী এগিয়ে যায়। ঔপন্যাসিকের ভাষায় : ‘এ বছর যদি না হয়, আগামীতে যদি না হয়, কোনো দিন যদি না হয় তাহলেও যাবে। তার করার কিছুই নেই। সে, তারা যাবেই। যাবে, নদীর মতো।’
ছয়
এ-888sport alternative linkে কোনো সুনির্দিষ্ট সমাধানহীনতা পাঠককে যেন শান্তি দেয় না, স্বস্তি দেয় না। বরং পাঠকের চেতনাজুড়ে একটা তীব্র অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে। ঔপন্যাসিক নিজেও সেটাই হয়তো-বা চেয়েছিলেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তো বলেইছিলেন : ‘888sport live footballিক তো অঙ্কের মাস্টার নয়। তাঁর কাজ বাস্তব সমস্যাকে তীব্র, মর্মস্পর্শী করে ফুটিয়ে তোলা। সেই সৃষ্টির আবেদন এমন হবে যে, পাঠক সচেতন হয়ে উঠবে এবং সমাধানের পথ খুঁজে বার করবার চেষ্টায় তৎপর হবে। খাঁটি 888sport live footballের ধর্ম অপরের মনে গভীর রেখাপাত করা। সমাধানের ধরাবাঁধা ফর্মুলা 888sport live chatীর হাতে আছে বলে আমার ধারণা নেই।’ অন্যদিকে কুন্ডেরা (Milan Kundera) বলেছিলেন, ‘the novel doesn’t answer question : it offers possibilities’। সেই সম্ভাব্যতার সূত্র ধরেই পাঠককেও অনেক কিছু বুঝে নিতে হয়। তাতে করে যে ভুল বোঝাবুঝির একটা অবকাশ থেকেই যায় – শুধু পাঠকই নয়, সমালোচকের দিক থেকেও এ-কথা সত্যি।
এই 888sport alternative linkে কোনো ধরাবাঁধা সমাধা-সমাপ্তি যেমন নেই, তেমনই নেই আদি-মধ্য-অন্ত্য সমন্বিত সুচারু কোনো গল্প। তার মানেই আবার এটা নয় যে, শুধু নানা ধরনের তত্ত্বই 888sport alternative linkটিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। শুধুই গল্পহীন নিরস তত্ত্বকথা এই 888sport alternative linkে নেই। অমিয়ভূষণ মজুমদার সেই কবে বলেছিলেন : ‘888sport alternative link তত্ত্ব নয়। এবং বোধহয় সেজন্যই 888sport alternative linkের ভাষাও বাক্যের পর বাক্য বসানো নয়। … অন্যদিকে 888sport alternative link বড় করে বলা গল্প নয় যে, কেউ চালাকি করে বলবে 888sport alternative link বড়ও বটে, গল্পও বটে। 888sport alternative linkে … গল্প যে রাখা হয়, তা গল্প বলার উদ্দেশ্যে নয়, কোনটা আগে কোনটা পরে ঘটেছে তা ধরিয়ে দিতে। 888sport alternative link প্রকৃতপক্ষে একটা থিম যা আমাদের চোখের নীচে ফুটে উঠে, একটা থিম যা হয়ে ওঠে। অর্থাৎ থিম নামে এক জীবন্ত বিষয়ের ভাব।’ আফসান চৌধুরীর বিশ্বাসঘাতকগণ 888sport alternative linkটিও শেষ পর্যন্ত সেই জীবন্ত বিষয়ের ভাব; যা আমাদের চেতনায়, চোখের নিচে ফুটে ওঠে। তাই তাঁকে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ একটা সালাম না জানিয়ে আমাদের উপায় থাকে না।
সাত
সবশেষে বলতেই হয় যে, 888sport alternative linkটি পাঠ করে শুধু ব্যর্থতাকেই একজন বিপ্লবীর ‘চূড়ান্ত’ পরিণতি হিসেবে ভাবতে পাঠকের মন যেন নানাভাবেই অস্বীকৃতি জানায়। বরং কমরেড মাও সে তুংয়ের সেই কথাটিই বারবার কোনো কোনো পাঠকের মনে যেন প্রতিধ্বনিত হতে থাকে – ‘আমাদের কমিউনিস্টদের ঝড়ঝাপটার মোকাবিলা করা ও দুনিয়ার মুখোমুখি হওয়া উচিত; এই ঝড়ঝাপটা হচ্ছে গণসংগ্রামের প্রবল ঝড়ঝাপটা এবং এ-দুনিয়া হচ্ছে গণ-সংগ্রামের মহান দুনিয়া।’ আফসান চৌধুরীর এই 888sport alternative linkে সেই গণসংগ্রামের মহান দুনিয়ারই এক অপূর্ব 888sport live chatিত অবয়ব দেখতে পাই।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.