কুন্তলা পাল নিজের বুকে ছুরি মেরে আত্মহত্যা করেছে – এই খবর শোনামাত্র; আমার গগনবিদারী চিৎকার দেওয়ার কথা, চিৎকার করে বলার কথা – না, না; এটা হতে পারে না, কুন্তলা কেন আত্মহত্যা করবে, কে ছড়াল এই মিথ্যে খবর – এসবের কিছুই হলো না; হলো কী, খবরটা শোনার পর তাৎক্ষণিকভাবে আমার মনে হলো – কুন্তলা নিশ্চয়ই ছুরির মুখে বিষ মেখে নিয়েছিল। বিষলক্ষার ছুরি বুকে মেরে সে আত্মহত্যা করেছে…।
কদিন আগে কুন্তলা পাল আমার কাছ থেকেই জেনেছে – বিষলক্ষার ছুরি কী জিনিস…!
কুন্তলা পাল আমার সহকর্মী। আমরা টিপিএলে (টার্নিং পয়েন্ট অব লাইফ) কাজ করি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, ক্রেডিট – টিপিএল নানা ধরনের কাজ করে। আমরা দুজনেই স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করি। মাঠ পর্যায়ে, মা ও শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষার কাজ আমাদের। ইউনিয়নে কুন্তলার মতো আরো দুটি মেয়ে কাজ করে। মমতা আর শায়লা। আমি তিনজনের কাজই দেখাশোনা করি। আমরা সাত বছর ধরে একসঙ্গে কাজ করছি। কুন্তলা পাল আমার চেয়ে অন্তত দশ বছরের ছোট। আমার চল্লিশ হলে ওর ত্রিশ। তাই হবে। কুন্তলা বিবাহিত। দশ বছরের একটি ছেলে আছে – সুবর্ণ পাল। কুন্তলার স্বামী অনিশ পাল জাত-ব্যবসা অর্থাৎ মাটির কাজ করে। ওদের গ্রামটি, সোনাপুর, মৃৎ888sport live chat-অধ্যুষিত গ্রাম। সব বাড়ি থেকে সারাদিন মাটি পেটানোর শব্দ কানে আসে – ঢপ, ঢপ, ঢপ…।
এই গল্পে কুন্তলা পালের রূপ বর্ণনা করব না। কারণ প্রথম যেদিন, সেটা বোধহয় ২০১০ সালের ৮ মে, টিপিএলের উপজেলা ম্যানেজার আমিনুল হক কুন্তলা, মমতা ও শায়লাকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, বললেন – ওরা তিনজন সোনাপুর ইউনিয়নে কাজ করবে, আপনাকে সোনাপুরের দায়িত্ব দেওয়া হলো; আপনি ওদের দেখাশোনা করবেন; সেদিনই কুন্তলা পালকে দেখে দ্বিজকানাই-প্রণীত মহুয়া পালার ‘মহুয়া’ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল – ‘বাইদ্যা বাইদ্যা করে লোকে বাইদ্যা কেমন জনা/ আন্দাইর ঘরে থুইলে কন্যা জ্বলে কাঞ্চা সোনা/ হাট্টিয়া না যাইতে কন্যার পায়ে পড়ে চুল/ মুখেতে ফুট্ট্যা উঠে কনক চাম্পার ফুল…।’
শুরুতে, সুযোগ পেলে, আমরা দুজন সোনাপুরের কোনো রাসত্মায় হয়তো হাঁটছি, উদাস-দুপুর, রাসত্মায় কোনো লোকজন নেই; কিংবা নির্জন কোনো হালট – ধারেকাছে তো নয়ই, যদ্দূর চোখ যায়, কোথাও জনমনুষ্যি নেই, আমি চারশো বছর আগে রচিত দ্বিজবাবুর এ-888sport app download apk আবৃত্তি করতাম। কুন্তলা কিছুই বুঝত না। মুখ ফুটে বলতও না কিছু। কখনো কখনো ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। এখন কুন্তলা সবকিছু বোঝে। নির্জন রাসত্মা কি হালটে আমি কুন্তলার মুখের দিকে একটু বাঁকা চোখে তাকালেই ও আবৃত্তি করে – ‘লজ্জা নাই নির্লজ্জ ঠাকুর লজ্জা নাইরে তর/ গলায় কলসি বাইন্দা জলে ডুববা মর…।’ আমি তখন কুন্তলার হাত ধরে বলি – ‘কোথায় পাব কলসি কন্যা কোথায় পাব দড়ি/ তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুববা মরি…।’
সাত বছর একসঙ্গে কাজ করলে নিজেদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। চেনাজানারও কিছু বাকি থাকে না। আমি কুন্তলাকে চিনি, কুন্তলার ঘর-উঠান, অন্দর-বাহির, সুখ-দুঃখ, মর্মজ্বালা – সবকিছুই চিনি। কুন্তলা মোবাইল ফোনে কথা বলে – আমি ওর শরীরের ঘ্রাণ পাই। কুন্তলাও আমার সদর-অন্দর চিনে ফেলেছে, অর্থাৎ আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কিন্তু কী সেই সম্পর্ক, তা বুঝি জেলেনির মাছের ঝাঁকার ঢাকনা খুলে পথচারীকে মাছ দেখানোর মতো খুলে দেখানোর কিছু নেই। আমাদের যে-সম্পর্ক, এটা একটু একটু করে এমনিতেই আপনাদের চোখের সামনে খুলে যাবে…।
কুন্তলা জানে, আমি গল্প-888sport app download apk লিখি। ওকে নিয়েও একটা 888sport app download apk লিখেছি – ‘কুন্তলার বুকে চাঁদ’। একদিন বেতবাড়ি যাচ্ছি। নির্জন হালট। হালটের দুপাশে সারি সারি বেতক্ষেত। বেতের গাঢ়-সবুজ চিরল পাতা বাতাসে সরসর শব্দ তুলছে। আমরা দুজনে পাশাপাশি হাঁটছি। রেললাইনের মতো। পাশাপাশি, কিন্তু ছোঁয়াছুঁয়ি নেই। কুন্তলা হঠাৎ মুখে ব্যথার ‘উহ্’ শব্দ তুলে একটু উবু হলো। পায়ে কাঁটা ফুটেছিল বোধহয়। আমি ওর দিকে তাকাতেই আমার চোখ পড়ল ওর বুকে। দুটি চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। ওর বস্নvউজের হুক হয়তো খুলে গেছিল, চাঁদদুটির কিছু অংশ বেরিয়ে পড়েছিল। কুন্তলা সোজা হয়ে দাঁড়াতেই নিমেষে মিলিয়ে গেল সেই চাঁদ। এই যে কুন্তলার বুকের চাঁদ দেখা, এটা আমি কোনোমতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছিলাম না। একটা অসহ্য ঘোরের মধ্যে ছিলাম সারাদিন। বুঝতে পারছিলাম – কুন্তলার বুকের চাঁদ আমার করোটির ভেতর কাব্য-সৃজন করছে। এই কাব্য-সৃজনের যে আনন্দ ও বেদনা, উন্মাদনা ও যন্ত্রণা, এটিই আমার মধ্যে প্রবল একটা ঘোর তৈরি করে; ঘোর কাটে পরবর্তী মধ্যরাতে, ‘কুন্তলার বুকে চাঁদ’ – লিখে ফেলার পর…।
888sport app download apk, এযাবতকালে যা লিখেছি, ঘোরের মধ্যে থেকে একটানেই লিখে ফেলেছি। কুন্তলা পালের বুকের উজ্জ্বল চাঁদ দেখে, 888sport app download apk-সৃজনের যে-ঘোর তৈরি হয়েছিল, একটানেই লিখে ফেলেছি – ‘কুন্তলার বুকে চাঁদ’। 888sport app download apkটি কুন্তলা পালও পড়েছে। আমিই পড়তে দিয়েছিলাম। 888sport app download apkটি পড়ে ও কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে, প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত তো করবেই; করাই উচিত; মেয়েটি সরল-সাধারণ এক 888sport promo code, 888sport app download apkর অতল-তল ছুঁয়ে কাব্য-সুষমা উপভোগ করবে – হয়তো সে-সামর্থ্যও নেই। কুন্তলা কপট রাগ দেখিয়ে বলল – এসব কী লিখেছেন কমলদা? এসব আজেবাজে কথাকে 888sport app download apk বলে? ছিঃ…!
কুন্তলা পাল মুখে রাগ দেখাচ্ছিল, কিন্তু আমি দেখছিলাম – ওর চোখে রাগ নেই, চোখে জ্বলজ্বল করছে আনন্দ; ওর ভুরুতে রাগ নেই, ভুরু নাচছে; ওর বুকে রাগ নেই, বুকের ভেতর বাজছে রবীন্দ্রসংগীত – আমারও পরান যাহা চায় তুমি।/ তাই, তুমি তাই গো…। 888sport app download apkটি যদি আপনারা শুনতে চান, পড়ে শোনাই – ‘কুন্তলা পালের বুকে দুটো অলৌকিক চাঁদ/ চাঁদদুটো প্রবারণা পূর্ণিমা কিংবা দেবী দুর্গার/ চোখের মতো জ্বলজ্বল করে;/ একটি চাঁদ বিতরণ করে মায়াবী জোছনা – সৃজন করে/ রবীন্দ্রসংগীতের মতো মুগ্ধ নদী;/ আরেকটি চাঁদ ঐশ্বর্যের আধার; নিবারণ/ করে শতকোটি সমত্মানের ক্ষুধা-তৃষ্ণা…।’
‘কুন্তলার বুকে চাঁদ’ যখন লিখি, তখন ছমাস গেছে, কুন্তলা পালের সঙ্গে কাজ করছি। দিনে দিনে, দিন যত গেছে, কুন্তলা পাল আমার কাছে খুলে গেছে, পুরোটাই; এখন তো কুন্তলা পাল আমার কাছে নিরাভরণ। আমিও আর, এই এতদিনে কুন্তলা পালের কাছে অপাঠ্য থাকিনি, আমাকে পুরোটাই পাঠ করে ফেলেছে। আমার পুরোটাই ওর মুখস্থ, আত্মস্থ। আমরা দুজন, কাজের ফাঁকে, ‘একাকী’ হলেই আমাদের মধ্যে নিজেদের কথা ওঠে। আমাদের তো কথার শেষ নেই। এতদিনে দুজনেই জেনে গেছি – আমরা দুটি প্রাণীই দুঃখ-নদে ডুবন্ত মানুষ। আমার ঘরসংসার নেই, মানে হয়নি; তাই আমি একা। নিঃসঙ্গ। কুন্তলা পালের ঘর-বর-সংসার সবই আছে, তারপরও একা। সুখ-দুঃখের দুটো কথা বলার মতো কোনো মানুষ নেই। তাই আমরা নিঃসঙ্গ দুটো মানুষ কোনো নির্জন হালটে পাশাপাশি হাঁটলে কিংবা কারো বাড়িতে উঠোন-বৈঠক শেষে একটু ফুরসত পেলে কথা বলার জন্য পাগল হয়ে উঠি। দুঃখ-নদে সাঁতার কেটে কূল পাওয়ার চেষ্টা করি। তখন, কখনো কখনো, কুন্তলা জিজ্ঞেস করে, নতুন কি লিখছেন কমলদা? বড়দির খবর কী? এর মধ্যে দিদির সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে কিছু…?
বড়দিটা আবার কে – যদি জানতে চান, বলতেই হবে। বড়দি মানে – সুনন্দা। আমার সৌরজগৎ। কুন্তলা পালের সঙ্গে যখন কথা বলি, সুনন্দার প্রসঙ্গ উঠলে; তখন বলি বড় সুনন্দা। কারণ, এতদিনে কুন্তলা পাল আমার ছোট সুনন্দা হয়ে উঠেছে। হায়! আসলে, আমি কিন্তু মাঝে মাঝে বুঝি, মানে – বোধোদয় ঘটে আমার – বড় সুনন্দা, ছোট সুনন্দা বলে এই জগতে কেউ নেই আমার, সবই মোহ, মরীচিকা; তারপরও কেন যে সুনন্দা-ঘোর কাটে না, কে জানে…!
সেদিন, আমরা উত্তর সোনাপুরের হাওয়া খালার বাড়িতে উঠোন-বৈঠক শেষে ঝালমুড়ি খাচ্ছি; হাওয়া খালা ঘানিভাঙা সরিষার তেল, কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজ মেখে মুড়ি খেতে দিয়েছে; এখন তো ঘানিভাঙা তেল বলতে গেলে পাওয়াই যায় না, বড় বড় কোম্পানির বোতলজাত তেল কিনে খেতে হয়; সেই তেলে না-আছে কোনো গন্ধ, না-আছে ঝাঁজ, তাই হাওয়া খালার ঘানিভাঙা তেলমাখা মুড়ির স্বাদই আলাদা, এই স্বাদ অনেকদিন মুখে লেগে থাকে; তো বৈঠক শেষে মজা করে ঝালমুড়ি খাচ্ছি; কুন্তলা পাল মুড়ি চিবুতে চিবুতেই জিজ্ঞেস করল – কমলদা কি নতুন কোনো গল্প লিখছেন এখন…?
লিখছি…।
জানি, কুন্তলা এখন জিজ্ঞেস করবে – নাম কী গল্পের। কাহিনি কী…?
এই হয়েছে মুশকিল। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে – তা সে কুন্তলা পালই হোক কি কোনো পত্রিকার সম্পাদক – গল্পটি কী নিয়ে লিখছেন দাদা, বিষয়বস্ত্ত কী – আমি ঠিকঠাক মতো বলতে পারি না। বলব কী বলুন, আগে থেকে তো আমার জানাই থাকে না, কী নিয়ে লিখব। লেখা শুরু করলে, তখন লেখা আসে। এমনও হয়, যৎসামান্য ভেবে, সেইমতো লেখা শুরু করেছি; লেখা শেষ হলে দেখি – তার কিছুই নেই। সম্পূর্ণ নতুন একটি গল্প সৃজিত হয়েছে। তখন আগে থেকে ভেবে রাখা গল্পের নামটি পর্যন্ত বদলাতে হয়। তারপরও কুন্তলা পাল জিজ্ঞেস করলে কিছু একটা বলি। জানি তো, কিছু একটা না-বললে ও ছাড়বে না। বলবে – তাই হয় নাকি? আগে থেকে কিছুই না-ভেবে লেখা শুরু করেন? যা গাঁজাখুরি কথা বলতে পারে লেখকরা…!
তখন, আমি বলি – লেখকরা শুধু গাঁজাখুরি কথাই বলে না, যা লেখে তাও গাঁজাখুরি…।
তাই নাকি! আপনার গল্প পড়লে তো মনে হয় সত্য ঘটনা অবলম্বন করে লেখা…।
না। কিছুটা সত্য হয়তো থাকে। পুরোটা কখনো না। কোনো সৃজনকর্ম যখন গল্প হয়ে ওঠে, বুঝতে হবে – তার কিছুটা সত্য, কিছুটা মিথ্যা, আর বাকিটা বানানো…।
আমার কথা শুনে, তখন কী বলবে কুন্তলা পাল? আসলে, তখন, ওর বলার কিছুই থাকে না। কচুপাতার ওপর বসা রঙিন ফড়িং দেখে কিশোরীরা যেরকম মুগ্ধ হয়, কুন্তলা পালও সেরকম মুগ্ধ-কিশোরীর মতো চোখ তুলে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে…।
নতুন গল্প লিখছি – ‘বিষলক্ষার ছুরি…’।
বিষলক্ষার ছুরি! এবার কুন্তলা পাল অবাক-কিশোরীর চোখ তুলে বলল – ছুরি তো চিনি। কিন্তু বিষলক্ষার ছুরি আবার কী জিনিস…?
এটাও ছুরিই। সাধারণ ছুরির মতো লোহা দিয়েই তৈরি…।
তাহলে…?
ধারালো কোনো ছুরির মুখে বিষ মাখানো হলে সেই ছুরি আর সাধারণ কোনো ছুরি থাকে না। হয়ে ওঠে অসাধারণ এক ছুরি। সেই ছুরির নামও পালটে যায়। ছুরির নাম হয় বিষলক্ষার ছুরি…।
সাংঘাতিক ব্যাপার…!
হ্যাঁ, তাই। মৃত্যু নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করতেই ছুরির মুখে, তীরের মুখে বিষ মাখানো হয়। প্রাচীনকাল থেকেই ছুরি বা তীরের মুখে বিষের ব্যবহার চলে আসছে…।
তাই নাকি…?
হ্যাঁ। টিভিতে মহাভারত দেখেছ তো। অর্জুন চৌকস তিরন্দাজ। নিশানা কখনো ভুল হয় না। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের তিরের মুখে বিষ-মাখানো ছিল। এতেই তো অর্জুন যুদ্ধে বাজিমাত করে। আর আমি যে-বিষলক্ষার ছুরি নিয়ে গল্প লিখছি, যে-ছুরি নিজের বুকে আমূল বসিয়ে দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল মহুয়া – এই আখ্যানের বয়সও চারশো বছরের বেশি। লিখেছেন দ্বিজকানাই…।
অনেকদিন ধরেই, আমরা দুজন ‘একাকী’ হলে কুন্তলা পাল কখনো কখনো আমাকে তুমি সম্বোধন করে। নাম ধরে ডাকে। আমি তখন আর ওর বস থাকি না। পরমপুরুষ হয়ে উঠি। কুন্তলা পালও তখন আর ‘কুন্তলা পাল’ থাকে না, হয়ে ওঠে জীবনানন্দ দাশের 888sport app download apk। আমরা একসঙ্গে কাজ শুরুর দুবছরের মধ্যেই আমাদের এই নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে। আমি আগে থেকেই টের পাই – কুন্তলা কবে, কখন আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করবে। এই তো, কুন্তলা এখনই বলবে – তোমার বিষলক্ষার ছুরির পুরো গল্পটা শোনাও না কমলদা…।
ভাটির দেশের মেয়ে মহুয়া, যার চোখ আসমানের তারার মতো আগল-ডাগল, তিলেকমাত্র দেখলে যাকে বি888sport app download for android হওয়া যায় না; যার রূপ দেখে টলে মুনি-ঋষির মন, সেই মহুয়া নিজের বুকে বিষলক্ষার ছুরি মেরে আত্মবিসর্জন দিয়েছিল, তো, মহুয়ার গল্প শোনাতে গেলে – মহুয়ার জনক ভাটির দেশের সুসমত্মান দ্বিজকানাই এবং হারিয়ে যাওয়া মহুয়াকে তিনশো বছর পর আইথর গ্রামের যে-লোকটি খুঁজে বের করে, সেই চন্দ্রকুমারের খানিকটা গল্পও শোনাতে হয়…।
ব্রাহ্মণপুত্র দ্বিজকানাই ভাটির দেশের ছেলে, খালিয়াজুড়ি কি রহমতপুর কি কাঞ্চনপুর কি বামনকান্দি কি উলুয়াকান্দি কি মসকা কি গোড়ালি কি সান্দিকোনা – ঠিক কোন গ্রামে, কার ঘরে এই ক্ষণজন্মা কবির জন্ম, আমরা তা জানি না। হয়তো দীনেশচন্দ্র সেন কিংবা কেদারনাথ মজুমদারও জানতেন না। আমাদের বিশ্বাস – তারা কেউ জানলে – দ্বিজকানাই কবিরের ঠিকুজি তাদের মাধ্যমে ঠিকই আমাদের কাছে এসে যেত। কবির ঠিকানা না পাই, ক্ষতি কী – ‘মহুয়া’ তো আমরা পেয়েছি। দীনেশবাবু অনুমান করেছেন, আমরা তার অনুমানকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছি; ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে কি তার কিছুকাল আগে, আমরা যে-গ্রামগুলো চিনেছি; এসব গ্রামের কোনো একটিতে দ্বিজকানাই এক ব্রাহ্মণঘরে জন্ম নেন। বামুনের ছেলে, যৌবনে প্রেমে পড়েন নমশূদ্র-সমাজের অতিহীনকূল-জাত এক সুন্দরী 888sport promo codeর। বামুনপুত্র নমঃশূদ্রকন্যার প্রেমে পড়েছে – ঢিঢি পড়ে যায় দেশে। ধর্মের বাধা, সমাজপতি-পুরোহিতদের বাধা – কৈলাস পর্বতের মতো ভারী বাধা ঠেলতে ঠেলতে উন্মাদ হয়ে ওঠেন দ্বিজকানাই। আর মেয়েটি কী করে তখন? সেও তো কানাইয়ের প্রেমে পাগলিনী। সে ভাবে – তাদের মিলন অসম্ভব। তার চেয়ে নিজের ভবলীলা সাঙ্গ করে দেওয়াই শ্রেয়। এক রাতে নিজের বুকে বসিয়ে দেয় বিষলক্ষার ছুরি…।
এখনো ঘটে, আমরা দেখি, ব্যর্থ প্রেমিকরা কবি হয়ে ওঠেন; তখনো তাই ঘটত। মনের মানুষকে হারিয়ে দ্বিজকানাইও কবি হয়ে ওঠেন, মত্ত হন কাব্যসুধা সৃষ্টি ও ভোগে। মনপ্রাণ ঢেলে রচনা করেন ‘মহুয়া’র পালা। দীনেশ বাবুর অনুমান – এটা ১৬২০ কি ১৬২১ খ্রিষ্টাব্দ হবে…।
মহুয়ার পালা তখন ভাটি অঞ্চলের ঘরে ঘরে গীত ও অভিনীত হতো। গান শুনতে শুনতে দ্বিজকানাই, মহুয়া ও নদের চাঁদকে মনে করে কেঁদে-কেটে চোখের জলে বুক ভাসাত মানুষ। রাত নামলেই ভেসে আসত কানে – ‘কাঞ্চনপুর নামে তথা আচিল গেরাম/ তথায় বসতি করতো বির্দ্দ এক বরাম্মন/ ছয় মাসের শিশুকন্যা পরমা সুন্দরী/ রাত্রি নিশাকালে হুমরা তারে করলো চুরি…।’
ভাটির হাওরে জল বাড়ে, জল কমে। এই জল ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে ঢেউয়ের প্রকৃতিতেও পরিবর্তন ঘটে। ঢেউ তখন কারো কথা শোনে না। আর এই ঢেউ যখন কথার অবাধ্য হয়, বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তখন ভাটির দেশের মানুষকে ঘুমরোগে ধরে। দিন-মাস-বছর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তারা পার করে। এই সুযোগে ব্রাহ্মণ্য-ধর্ম তখন চেপে বসে তাদের বুকের ওপর। ঠাকুর-পুরোহিতরা দ্বিজকানাই-প্রণীত প্রেমকাহিনি – মহুয়ার পালা শোনা, দেখা, অভিনয় করাকে পাপপূর্ণ কাজ বলে ঘোষণা করে…।
হায় ভগবান! তোমার লীলা বোঝা ভার। কেন তুমি দ্বিজকানাইকে দিয়ে মহুয়ার পালা রচনা করালে, আর তাঁর উত্তরকালে কেনই-বা ঠাকুর-পুরোহিতদের মুখে তুলে দিলে – মহুয়ার পালা তোমরা বর্জন করো। তা না-করলে নরকবাসী হবে…।
পাপের ভয়ে মহুয়ার গীত দিনে দিনে মানুষের মুখ থেকে হারিয়ে যেতে থাকল। গীত মুখে মুখে না থাকলে একদিন তা মনের মুকুরেও থাকে না। মহুয়ার পালারও হলো সেই দশা। রাত নামলে কোথাও আর শোনা যায় না – ‘চন্দ্রসূর্য্য সাক্ষী সই সাক্ষী হইও তুমি/ নদ্যার ঠাকুর হইল আমার প্রাণের সোয়ামি…।’
আমরা দুজন, আমি আর কুন্তলা পাল, তখন হাওয়া খালার উঠোনের উত্তরপাশে কামরাঙা গাছের স্বল্প-ছায়ায় বসে মুড়ি খেতে খেতে গল্প করছিলাম; মানে কুন্তলাকে দ্বিজকানাই-প্রণীত মহুয়ার গল্প শোনাচ্ছিলাম। মহুয়ার গল্প হৃদয়বিদারক। নদের চাঁদের সঙ্গে ঘর হবে না, সংসার হবে না; নিজের পিতা (!) বিষলক্ষার ছুরি হাতে ধরিয়ে দিয়েছে, নদের চাঁদের বুকে মারতে হবে; মহুয়া ছুরি হাতে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু নদের চাঁদের বুকে ছুরি না-মেরে বসিয়ে দিলো নিজের বুকে – এই গল্প শুনে কুন্তলা পাল জারজার করে কাঁদছে, যেন ওর হাতে এখন একটি ছুরি থাকলে ও ঘরসংসার নিয়েই বেঁচে আছে তা ঠিক, তারপরও ছুরি বসিয়ে দিত নিজের বুকে; তা না-মেরে আমার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে…।
গ্রামে গ্রামে মমতা কিংবা শায়লার সঙ্গে যখন উঠোন-বৈঠক করি, আমার মনে পড়ে না – কোনো বাড়িতে কোনো মহিলা, বৈঠক শেষে, বিস্কুট-চানাচুর কিংবা মুড়ি; কেউ কিছু খেতে দিয়েছে। এক্ষেত্রে এক নম্বর ওয়ার্ডের হাওয়া খালা ব্যতিক্রম; তার বাড়িতে মাসে কি দুমাসে – যেদিনই উঠোন-বৈঠক করি – আমি কিংবা কুন্তলা পাল – আমরা দুজনে বৈঠক করলে, কিংবা আমাদের ঊর্ধ্বতন কোনো বস বৈঠকে এলে – শসা, বাঙ্গি, কলা – ক্ষেতের কোনো না কিছু কিংবা নিদেনপক্ষে সরিষার তেল ও পেঁয়াজ-মরিচ মেখে মুড়ি খেতে দেবেই। সেদিনও হাওয়া খালা, সেই ঘামঝরা দুপুরে, আমাদের সরিষার তেল মেখে মুড়ি খেতে দিয়েছিল। আগেও লক্ষ করেছি, সেদিনও দেখলাম; হাওয়া খালা আমাদের মুড়ি খেতে দিয়েই নিরুদ্দেশ…!
সোনাপুরের তিনদিকেই নদী। এখন অবশ্য নদী ঠিক বলা যায় না, বলতে হয় – খাল। ঠিক খালও না। মরা খাল। বর্ষার এক-দুমাস জল থাকে কি থাকে না, স্রোতের তো দেখাই মেলে না; তারপরও এই নদীর পাড়ে প্রচুর ঘাস – গরু-ছাগল চরানোর খুব সুবিধা; আর মরা খালে কোথাও কোথাও সামান্য যা জল আছে, সেখানে প্রচুর শামুক, বাড়ির হাঁসগুলো ছেড়ে দিলে ওরা শামুক খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলে; তাই হয়তো হাওয়া খালা আমাদের মুড়ি খেতে দিয়ে, এতদিনে হাওয়া খালা বুঝে ফেলেছে – আমরা মুড়ি খাব একটু সময় নিয়েই; গল্প করতে করতে; খালা গরু-ছাগল কিংবা হাঁস নিয়ে নদীর পাড়ে চলে যায়। তখন আমাদের গল্প-কথকতা আর মুখে মুখে থাকে না, হঠাৎ কোনোদিন, কখনো কখনো খুব কড়া রোদ উঠলে কিংবা ঢল বৃষ্টি নামলে; গল্প-কথকতা সামান্য শারীরিক হয়ে ওঠে। এই যে শারীরিকভাবে গল্প বলা – হাওয়া খালা ঠিক কীভাবে নেয় তা জানি না, অনুমানও করতে পারি না; তারপরও খালাকে প্রণতি জানাই, খালা হয়তো আমাদের সম্পর্কটা বোঝে, হয়তো অনুমানটা করতে পারে; তাই আমাদের গল্প করার সুযোগ তৈরি করে দেয়…।
আমি কুন্তলা পালকে মহুয়ার গল্প শোনাচ্ছিলাম। সেদিন ভাবিনি, পড়ন্ত দুপুরবেলায়, হাওয়া খালার উঠোনে বসেই, আমার কল্পনায়ও ছিল না, কুন্তলা মহুয়ার গল্প শুনতে শুনতে অঝোরে কান্না শুরু করবে; আমার হাত চেপে ধরে বলবে – ‘কমলদা, নদের চাঁদ আর মহুয়া কি বিয়ে করেছিল? ওরা দুজনে ঘর বাঁধতে পেরেছিল…?’
নদের চাঁদ-মহুয়ার বিয়ে হয়েছিল কিনা – যদি বলি; ওরা বিয়ে করেছিল, ঘর-সংসার করেছিল, সুখেই কাটছিল ওদের দিন; জানি, আমার কথা শুনে কুন্তলা পাল খুশি হবে; কিন্তু দ্বিজকানাইয়ের আখ্যানে ঘটনা তো সেভাবে ঘটেনি, নদের চাঁদ আর মহুয়ার মিলন হয়নি; ওরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। হুমরা বেদের হাতে যখন ধরা পড়ল ওরা দুজনে, বেদে মহুয়ার হাতে তুলে দিলো বিষলক্ষার ছুরি, বলল – ‘প্রাণে যদি বাঁচো কন্যা আমার কথা ধরো/ বিষলক্ষের ছুরি দিয়া দুষ্মনেরে মারো…।’
কিন্তু কুন্তলাকে আমি কী বলব! সত্যি কথাটাই বলে ফেলব, নাকি মিথ্যা বলব? শেষ পর্যন্ত সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে দুলতে দুলতে সত্য কথাটাই বললাম – ‘ওদের বিয়ে হয়নি, বিয়ে করার সুযোগই ওরা পায়নি…।’
তাহলে…!
তাহলে কী…?
মহুয়া যে বলল – ‘নদ্যার ঠাকুর হইল আমার প্রাণের সোয়ামি…।’
আমরা, মানে – আমি আর তুমি – এই যে তুমি আমার হাত ধরে কাঁদছ, তোমার স্বামী আছে, সমত্মান আছে; জন্মগত সংস্কার আছে; তাহলে আমাদের মধ্যে এ-ধরনের ঘটনা কী করে ঘটছে, তুমি কীভাবে আমার হাত ধরে কাঁদছ, কোন সাহসে…?
কুন্তলা পাল তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেই। মুখে কোনো কথা নেই…। আমি বললাম – ‘কুন্তলা, অনিশ পালের বউকে আমি কি কখনো কখনো বউ বলে ডাকি না? কুন্তলা পাল কি আমার সেই ডাকে সাড়া দেয় না…?’
কুন্তলার বয়স যখন কেবল তেরো, ক্লাস নাইনে পড়ে; একদিন হঠাৎ, কোনো কথাবার্তা নেই, জানাশোনা নেই, কুন্তলার বিয়ে হয়ে গেল। অনিশ পালের বয়স কুন্তলার বয়সের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি, অর্থাৎ কুন্তলার তেরো, অনিশের ছাবিবশ নয়, ত্রিশ। তখনো বিয়েটিয়ের ব্যাপারে মেয়েদের মতামতের কোনো মূল্য ছিল না, এখনো নেই; সাতপাক ঘুরে কিশোরী মেয়েটি রাতদুপুরে অনিশ পালের ঘরে গেল এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই পড়ল এক মানুষখেকো হিংস্র বাঘের মুখে। মেয়েটির জরায়ু, যোনি, স্তন ফেটে রক্ত ঝরতে ঝরতে রক্তাক্ত প্রান্তর হয়ে গেল বাসরশয্যা…।
এই কৈশোরক কষ্ট-কাহিনি কুন্তলা পাল একদিন, কেন জানি না, কাঁদতে কাঁদতে নিজে থেকেই আমাকে বলেছে। বাঘটি যে উপর্যুপরি অতিরিক্ত খেতে খেতে, অতিরিক্ত খেলে বদহজম হবেই, বদহজমের কারণে এখন আর খেতে পারে না; খেতে গেলেই তার বমির উদ্রেক ঘটে; এসবও কুন্তলা পাল বলেছে আমাকে। শেষপর্যন্ত বলেছে – তার স্বামী আছে, একটি পুত্রসমত্মান আছে; চাকরি আছে, বাড়িতে কাঁচামাটির সত্মূপ আছে, পুন আছে, পোড়া হাঁড়ি-পাতিলের টুংটাং শব্দ আছে; তারপরও সে একা, নিঃসঙ্গ…!
মহুয়ার গল্প মৃত্যুমুখে পতিত, এখন আর ভাটির কোনো গাঁয়ে – কারো বাড়ির উঠোনে কি গাঙে-ভাসানো নৌকায়, চাঁদনী রাতে গানের আসর বসে না, গীত হয় না নদের চাঁদের প্রেমবিলাপ ধ্বনি – ‘মাও ছাড়ছি বাপ ছাড়ছি – ছাড়ছি জাতিকুল/ ভ্রমর হইলাম আমি তুমি বনের ফুল…।’ দেখতে দেখতে, এরই মধ্যে কী করে যেন তিনশো বছর কেটে গেছে। হায় বিধাতা! এত দ্রম্নত পড়ে তোমার চোখের পলক!
যা হোক, ব্রাহ্মণবিধাতার রোষানলে পড়ে দ্বিজকানাই-প্রণীত মহুয়ার গল্প যখন মৃত্যুমুখে পতিত, তখন ভাটির দেশে, আইথর গ্রামে নতুন কানাই এসে গেছে – লোকটি চন্দ্রকুমার দে, ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বয়স ৩০, স্ত্রী-সমত্মানের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দেবে, সেই সংস্থান নেই লোকটির; রোগাক্রান্ত জীর্ণশীর্ণ শরীর, কিন্তু লোকটির প্রাণশক্তি অফুরন্ত; ভাটির দেশের হাওরে বাতাস উঠলে যেরকম ঢেউ ওঠে, জল-হাওরের মাথায় গোলমাল শুরু হয় – মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতীর হারিয়ে যাওয়া গল্পের কথা মনে পড়লে চন্দ্রকুমারের মাথায়ও গোলমাল শুরু হয়। লোকটি এককাপড়ে, এসব গল্পের খোঁজে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে…।
গরু-ছাগল কিংবা হাঁস নিয়ে হাওয়া খালা কোনো কোনোদিন বাড়ি থেকে এই যে বেরিয়ে যায়, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, কোনো কোনোদিন সন্ধ্যাও নেমে আসে; খালা আর ফেরার নাম করে না। এতদিনে আমরাও বুঝে ফেলেছি – খালা ইচ্ছা করেই দেরি করে বাড়ি ফেরে – যাতে আমরা নিঃসংকোচে গল্প করতে পারি, গল্প যদি সামান্য; অর্থাৎ শোভনমাত্রায় শারীরিকও হয়ে ওঠে – তাতেও যেন আমরা বাধাগ্রস্ত না হই…।
সুনন্দা আমার সৌরজগৎ অথচ আলমগীরের স্ত্রী এবং এই আলমগীর-বেটার দুই পুত্রসমত্মানের মা – এতদিনে কুন্তলা পালের এটা জানা হয়ে গেছে। কুন্তলা এ-ও জানে, সুনন্দা-বিরহে কাতর হয়েই কমল ছত্রী দেবদাসের মতো মদ খাওয়া শুরু করে। আর তা জানবে না কেন, আমাদের মধ্যে এখন তো আর কোনো দেয়াল নেই, কোনোকিছুই গোপন নেই। আমিও তো জানি, এখানে কিছুই বলব না, বললে অনিশ পালের বাড়িতে আগুন লেগে যেতে পারে – কুন্তলা পাল কেন কেঁদেকেটে কাটিয়ে দেয় সারারাত…।
একদিন, সেই বেতবাড়ির হালটে, তখন নির্জন দুপুর, আমরা দুজন পাশাপাশি হাঁটছি, কুন্তলা হঠাৎ আমার দুহাত ধরে, দাদা-টাদার কোনো বালাই নেই, আমার নাম ধরে বলল – কমল, তোমাকে মদ খাওয়া ছাড়তে হবে…।
কুন্তলার কথা শুনে আমি হতভম্ব। বলে কী মেয়েটা! কুন্তলা তো জানে – আমি কেন মদ খাই…।
কুন্তলা। তুমি তো জানো…।
জানি। জানি বলেই বলছি – বড়দির শূন্যতা আমি হয়তো কোনোদিনই পূরণ করতে পারব না; কিন্তু চেষ্টা তো করছি। তারপরও মদ খেয়ে খেয়ে কেন তোমার জীবনটা ধ্বংস করছ। বলো কমল, আর কোনোদিন মদ খাবে না…।
মদ খেয়ে আমার কখনো পা টলে না। কিন্তু তখন, কুন্তলার কথা শুনে, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার পা টলছিল। কুন্তলার চোখে তখন জল…।
কথা দাও কমল…।
আমার মুখে কোনো কথা নেই…।
কুন্তলার সাহস দেখে আমি ভয় পাচ্ছিলাম। হোক নির্জন দুপুর। নির্জন হালট। পথ তো। যে-কোনো মুহূর্তে মানুষ আসতে পারে। কেউ আমাদের এভাবে দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। আমি বললাম – কুন্তলা, এখন চলো। এ নিয়ে পরে কথা হবে…।
না। পরে না। এখনই বলো কমল – তুমি আর কখনো মদ খাবে না, বলো…।
আর মদ না-খেলে কী হবে…?
তুমি যদি কথা দাও, আর কখনো মদ খাবে না – এখনই, এই মুহূর্তে আমার স্তনে চুমু খেতে দেব…।
কুন্তলা পাল বস্নvউজের বোতাম খুলে ফেলল…।
কুন্তলার আচরণ দেখে এবার আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মেয়েটা করছে কী! তখন, সূর্যের তাপে মানুষের চোখ ঝলসে যায়, এ-কথা সবারই জানা, কুন্তলার বুকের চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় আমার চোখ ঝলসে যাচ্ছিল…।
বহুপথ হেঁটে, বিস্তর হাওরের জল ঘেঁটে – চন্দ্রকুমার দে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ভাটির দেশের মসকা গ্রামে হারিয়ে-যাওয়া মহুয়ার গল্পের খোঁজ পেল। এই গ্রামেরই প্রবীণ দুই লোক, শেখ আসক আলী ও উমেশচন্দ্র দে, এক চাঁদনী রাতে উমেশবাবুর বাড়িতে শেখ আসক আলী মহুয়ার পালা গাইছিলেন – ‘বাপের বাড়ির তাজী ঘোড়া আরে আমার মাথা খাও/ যেই দেশেতে বাপ-মাও সেই দেশেতে যাও/ বাপের আগে কইও ঘোড়া কইও মায়ের আগে/ তোমার কন্যা মহুয়ারে খাইছে জংলার বাঘে…।’
চন্দ্রকুমার তখন সারাদিনের পথশ্রম ও ক্ষুধাতৃষ্ণায় প্রচ- কাতর। গাঁয়ের কোনো বাড়িতে কিছু খাবার ও রাতটুকুর জন্য আশ্রয় পাওয়া যায় কিনা – এই ভেবে মসকা গ্রামে ঢুকেছে। তখনই দূর থেকে ভেসে আসে মহুয়ার নাম। মহুয়ার নামটি কানে আসামাত্র চন্দ্রকুমারের শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। কীসের ক্ষুধাতৃষ্ণা, কীসের ক্লামিত্ম – গানের সুর যেদিক থেকে আসছে, সে-বাড়িটি লক্ষ করে চন্দ্র পড়ি কি মরি দৌড়াতে শুরু করল। পথে খানাখন্দ, কাঁটাঝোপ। কোনোকিছুই চন্দ্রকুমারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। সবকিছু উপেক্ষা করে চন্দ্র রক্তাক্ত পায়ে উমেশবাবুর বাড়িতে পৌঁছল। উঠোনে জমজমাট গানের আসর। শ-দুয়েক দর্শক-শ্রোতা পাটির বিছানায় বসেছে। 888sport promo code-পুরুষ দুই-ই আছে। উমেশবাবু আসরের মধ্যমণি। শেখ আসক আলী মহুয়ার পালা গাইছেন, তার দুই গ-দেশ বেয়ে চোখের জল ঝরছে; চন্দ্রকুমার যখন আসরে গিয়ে বসল, শেখ আসক তখন গাইছেন – ‘শুন শুন প্রাণপতি বলি যে তোমারে/ জন্মের মতন বিদায় দেও এই মহুয়ারে/… জন্মিয়া না দেখলাম কভু বাপ আর মায়/ কর্ম্মদোষে এতদিনে প্রাণ মোর যায়…।’
কর্মদোষে…! চোখ কপালে তুলল কুন্তলা পাল…।
কর্মদোষ নয়তো কী! মহুয়া নদের চাঁদকে ভালোবেসে তার সঙ্গে ঘর ছেড়ে ছিল। কিন্তু পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে একদিন ধরা পড়ে গেল হুমরা বেদের হাতে। নদের চাঁদ বেদের দুশমন। সে তার মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে। হুমরা মহুয়ার হাতে বিষলক্ষার ছুরি ধরিয়ে দিয়েছে…।
মহুয়া, অবলা এক 888sport promo code, হুমরা বেদে দলের সর্দার। তার কথা অমান্য করার শক্তি, সাহস, সুযোগ কোনোটাই নেই। অবলা 888sport promo code এখনো যেমন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না, নিজের অধিকারের কথা বলতে পারে না, তখনো পারত না। 888sport promo code এখনো কোনো পথ না পেয়ে বিষ খেয়ে, ফাঁস দিয়ে কিংবা চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মবিসর্জন দেয়, তখনো 888sport promo code তাই করত। মহুয়াও তাই করে – ‘কেমনে মারিব আমি পতির বুকে ছুরি/ খাড়া থাক বাপ তুমি আমি আগে মরি…।’
সেদিন দুপুরের আগে আগে কী একটা কাজে কুন্তলা পালের বাড়িতে গেছি। কুন্তলা ঝালমুড়ি বানিয়ে দিয়েছে, ওদের ঘরের বারান্দায় বসে ঝালমুড়ি খাচ্ছি। কুন্তলা রান্নাঘরে ব্যস্ত। আমাকে দুপুরে খেয়ে যেতে বলেছে। মধ্যবয়সী এক লোক এলো ওদের বাড়িতে। হাতে ভারী একটা ব্যাগ। উঠোনে এসেই লোকটি কুন্তলার নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করল – কুন্তলা কই? কুন্তলা…?
লোকটির ডাক শুনে কুন্তলা রান্নাঘর থেকে খুমিত্ম হাতেই বেরিয়ে এলো। ‘ওমা! দাদা তুমি…!’
হ্যাঁ। চলে এলাম। কতদিন আর কুন্তলাকে না-দেখে থাকা যায়, বল…?
বারান্দায় বসো। আমি ঘটিতে জল দিই। হাত-মুখ ধুয়ে নাও…।
লোকটিকে দেখে, আমি যে বারান্দায় আছি, ঝালমুড়ি খাচ্ছি – কুন্তলা বোধহয় তা ভুলে গিয়েছিল। যা-হোক, কুন্তলা জলের ঘটি হাতে কলতলা যেতেই উঠোনে নেমে আমি বললাম – কুন্তলা, আমি যাই। জরুরি কাজ আছে…।
কুন্তলা কলতলা থেকেই বলল – দুপুরে খেয়ে যাবেন তো। রান্না হয়ে এসেছে…।
না। আরেকদিন এসে খাব…।
রাতে কুন্তলাকে ফোন করলাম – লোকটি কে, কুন্তলা…?
আপনার দাদার বন্ধু। জলপাইগুড়ি থাকে। সোনাপুরেরই মানুষ…।
তোমাকে নাম ধরে ডাকে…?
তাতে কী? বন্ধুর বউকে নাম ধরে ডাকা যায় না…?
অনিশ পাল, মানে তোমার মন্ত্রপড়া স্বামী, তোমাকে নাম ধরে ডাকবে এটা তার বৈধ অধিকার, তাই আমি বহু কষ্টে তা মেনে নিচ্ছি। তাই বলে অন্য আরো একটা লোক কুন্তলা পালকে নাম ধরে ডাকবে – তা আমি মেনে নিতে পারব না। এটা আমার সাফ কথা…।
হায় ভগবান! তোমাকে নিয়ে আমি কী যে করব, কমল…?
পাদটীকা :
লোকটি চলে যাওয়ার পরদিনই কুন্তলা পাল আত্মহত্যা করে। কোনো সুইসাইড নোট সে রেখে যায়নি। সুতরাং অনিশ পাল কি পাল-দম্পতির একমাত্র পুত্র সুবর্ণ পাল কিংবা মমতা কি শায়লা, কিংবা গ্রামবাসী – কেউ কোনোদিনই জানতে পারবে না – কুন্তলা পাল কেন আত্মহত্যা করল। আমি কি জানি – কুন্তলা কেন আত্মহত্যা করেছে…?
আমি হয়তো কিছুটা জানি – কুন্তলা পাল কেন মহুয়ার মতো নিজের বুকে বিষলক্ষার ছুরি বসিয়ে দিয়েছে; কিন্তু আমি তা কাউকে জানাব না। জানাতে চাই না। মনীষীরা বলেন – কিছু কিছু কথা বুকের ভেতর গোপন করে রাখা ভালো…!


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.