বৈচিত্র্যময় পর্তুগাল আলগার্ভ অঞ্চলের সৌন্দর্য

আলগার্ভ অঞ্চলের সঙ্গে পরিচয়

ছোটবেলায় ভূগোলে পড়েছিলাম পর্তুগিজ অভিযাত্রী ভাস্কো-দা-গামার কথা, যিনি পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে জলপথে ভারতের পশ্চিম উপকূলে এসেছিলেন। পুরোপুরিভাবে উপনিবেশ স্থাপন না করলেও ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে পর্তুগিজরা তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। আর তার প্রভাব 888sport appsের চট্টগ্রাম পর্যন্ত এসেছিল। সেই ভাস্কো দা গামার দেশ পর্তুগাল। আর সে ধরনের দুঃসাহসী মানুষের দেশেও ‘ফাদো’ সংগীতে শোনা যায় দুঃখ আর হতাশার কথা-সুর। এরকম বৈচিত্র্যের দেশ পর্তুগাল। আমার ‘যেতে হবে’ তালিকায় না থাকলেও কন্যা-জামাতা শমী আর ফারাজের উৎসাহে সেই দেশই ছিল ২০২৫ সালের গ্রীষ্মের প্রথম গন্তব্য ।

পর্তুগালের দক্ষিণাংশে আলগার্ভ অঞ্চলে ভূমধ্যসাগরের পাড়ে ছোট্ট শহর ফারো ছিল আমাদের প্রথম স্টপ। জেনেভা থেকে সরাসরি ফ্লাইট বলে সুবিধা। স্পেনের দক্ষিণ উপকূলের মতো এটিও পর্যটকদের খুব প্রিয়। সান-স্যান্ড-সি এই তিন এস-এর সম্মিলনে এসব অঞ্চল আকর্ষণীয়। তবে গত কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ ইউরোপে গ্রীষ্মকালে গরম পড়ে খুব। এবারো তার ব্যতিক্রম ছিল না। আর তা শুরু হলো জুনের গোড়া থেকেই। স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স এসব দেশে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দাবদাহের বিপদসংকেত চলছিল। সবাইকে বলা হচ্ছিল সতর্কতা অবলম্বন করতে। একই সময় বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে নেমেছিল অতিপর্যটনের বিরুদ্ধে। এটিও সাম্প্রতিককালে নিয়মিত হয়ে উঠেছে। আর হবে না কেন! একদিকে জনপ্রিয় সব গন্তব্যে মানুষের উপচেপড়া ভিড়, অন্যদিকে কিছু কিছু টুরিস্টের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। এরকম পরিস্থিতিতে 888sport slot gameে বের হলে একটু অস্বস্তি যে হয় না তা নয়।

মাঝারি সাইজের এয়ারপোর্ট ফারো। কিন্তু যাত্রীর ভিড় ছিল যথেষ্ট। পেস্নন থেকে নামার পর যাত্রীদের হেঁটে যেতে হলো টার্মিনাল বিল্ডিং পর্যন্ত। ৩৪ ডিগ্রি তাপ আর প্রচণ্ড রোদে অনেকেই হাঁসফাঁস করছিল। লাগেজ পেতে অবশ্য দেরি হলো না। তবে লাঞ্চের সময় পার হয়ে যাচ্ছিল এবং আমাদের পেটও জানান দিচ্ছিল সে-কথা। সুতরাং লাগেজ নিয়ে বের হয়েই আমরা একটি ক্যাফেতে বসে খেয়ে নিলাম।

উবারের গাড়ি এসে গেল বুক করার দু-মিনিটের মধ্যে। চালক ভারতীয়, পাঞ্জাব অঞ্চলের। ফারোতে যতবার উবারের গাড়ি ব্যবহার করেছি প্রতিবারই চালক ছিল সেই একই এলাকার মানুষ। পরে দেখলাম, সেখানে ভারতীয় পাঞ্জাবিদের বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁ ও দোকানপাট রয়েছে। অনুমান করলাম, সেখানে ওই অঞ্চলের অনেক মানুষের বসবাস।

আমাদের থাকার জায়গা ছিল সমুদ্রের পাড়ে একটি রিসোর্ট ধরনের হোটেলে। এয়ারপোর্ট এবং ফারো শহর থেকে কিছুটা দূরে সেই জায়গা; যেতে লেগে গেল প্রায় ৪০ মিনিট। ওই দেশে আমার প্রথম যাওয়া। সুতরাং চোখ রাখলাম পথের দুপাশে, যাতে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় দেশটির প্রকৃতি আর পরিবেশ সম্পর্কে। তবে এর আগে স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলে গিয়েছি বলে তেমন অপরিচিত মনে হলো না। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলোতে গাছপালায় সবুজের কিছুটা অভাব। মাঝে মাঝে জলপাই আর কমলালেবু ধরনের ফলের বাগান।

আমাদের হোটেলটি আলবুফেইরা নামে একটি ছোট শহরতলির মতো জায়গায়। বাড়িগুলোর চেহারা দেখে বোঝা গেল সেখানে অবস্থাপন্ন লোকের বাস। আর দেশটির আধুনিক স্থাপত্য সম্পর্কেও একটু ধারণা পাওয়া গেল : অনেক বাড়িতে সাদা বা ক্রিম রঙের দেয়াল আর চালাঘরের মতো ছাদে কমলা রং। তবে বহুতল দালানের দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের হালকা রঙের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। কোথাও কোথাও হালকা নীল, কমলা, বেগুনি ইত্যাদি রঙের এমন সুন্দর সমাহার যে একত্র হয়ে একটা রূপকথার মতো আবহ তৈরি করে। কথাটি বিশেষভাবে মনে হয়েছে পরদিন সমুদ্রে নৌকা888sport slot gameের জন্য যেখানে গিয়েছি সেখানকার একটি এলাকা দেখে। সে-কথায় আসছি একটু পরে।

হোটেলের এলাকায় ঢোকার গেট থেকে রিসেপশন বেশ খানিকটা দূরে। রাস্তার দু-পাশে আরো ছোট ছোট রাস্তা

এদিক-সেদিক চলে গেছে আর তাদের দু’ধারে বিভিন্ন আকারের বাড়ি। পুরো এলাকাটিকে একটি ছোটখাটো গ্রামের মতো মনে হলো। এরকম রিসোর্ট দেখেছিলাম বাহামা গিয়ে। এসব রিসোর্ট কোনো ডেভেলপার তৈরি করে, যাতে শুধু হোটেল নয়, বিক্রি বা ভাড়ার জন্য বাড়িও থাকে।

আমাদের হোটেলে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়ল ব্যতিক্রমধর্মী প্রবেশদ্বার, যা অনেকটা মুর স্থাপত্যের আদলে তৈরি। তবে ইসলামি এবং উত্তর আফ্রিকার স্থাপত্যের আরো পরিষ্কার প্রভাব লক্ষ করলাম রিসেপশন এলাকার অন্য পাশে একটি আঙিনায়। আয়তাকার আঙিনাটি একেবারে যেন উত্তর আফ্রিকার কোনো বাড়ির আঙিনা। আর দেয়ালে টাইলের ব্যবহার দেখে মনে পড়ল স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের কথা। তবে আমি খুব অবাক হলাম না এই কারণে যে, জায়গাটি দক্ষিণ-পশ্চিম স্পেনের লাগোয়া। ওই অঞ্চলে মুসলমানরা পৌঁছে গিয়েছিল সপ্তদশ শতকেই এবং প্রায় ৫০০ বছর আন্দালুসিয়া ও পর্তুগালের অনেক এলাকায় তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। স্থাপত্যে তাদের প্রভাব কিছুটা হলেও এখনো রয়ে গেছে।

আমাদের রিসোর্টটির নিজস্ব এলাকাই এত বড় যে বিকেলে তার ভেতরেই কিছুক্ষণ হাঁটলাম। আর তখন দেখলাম যে, পুরো এলাকা সাগরের পাড়ে খাড়া উঁচু পাহাড়ের ওপর। দক্ষিণ প্রান্তে গিয়ে নিচের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে, গিরিখাদের একেবারে কিনারে দাঁড়িয়ে আছি। আর পাশ থেকে তাকালে দেখা যায় পাহাড়ের লালচে-খয়েরি রং ও রুক্ষ ভাব। আশেপাশের পুরো এলাকায় সৈকতের গা-ঘেঁষেই উঠে গিয়েছে এ-ধরনের পাহাড়। সাধারণত পাহাড়ের গায়ে দেখি ঘন বন বা দীর্ঘকায় পাইনের সারি। তাই পাথুরে সবুজবিহীন পাহাড় আমার কাছে নতুন। গিরিখাদের কিনারে দাঁড়িয়ে তাকালে পটভূমিতে দেখা যায় সাগর। রঙের জন্যই হোক বা পটভূমিতে সাগরের নীল থাকাতেই হোক, রুক্ষতার মধ্যেও এক ধরনের সৌন্দর্য দেখতে পেলাম।

অনেক নিচে সৈকত, যেখানে সাগরের ঢেউ এসে ভেঙে পড়ছে। হোটেলের তথ্যানুযায়ী সাত মিনিটের হাঁটা পথ। তবে ক্লিফের নিচে নামার জন্য রয়েছে একটি লিফট। লিফট থেকে বের হলে আরো নিচে নামার জন্য কাঠের বাঁধানো রাসত্মা। ব্যবস্থা ভালো কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয় দিন বিকেলে সেই পথে নেমে গেলাম সৈকতে। বিচটি আমাদের রিসোর্টের নিজস্ব। তা সত্ত্বেও মানুষের ভিড় কম ছিল না। আর তা থেকে বুঝলাম কত বড় এই রিসোর্ট আর কত মানুষ সেখানে ছিল। আমাদের মতো জ্যেষ্ঠ কম হলেও একেবারে যে ছিল না তা নয়।

সৈকতে একেবারে বালুর ওপর একটি ছোট ক্যাফে। ভেবেছিলাম কোনো কোল্ড ড্রিংক নিয়ে সেখানে বসবো আর সাগরপাড়ের দৃশ্য দেখব। পাড়ের কথা বলছি এই কারণে যে, সেখানেই ওই এলাকার বিশেষত্ব। প্রস্থে সৈকত কিছুটা সংকীর্ণ, আর সেখান থেকেই উঠে গিয়েছে খয়েরি রঙের খাড়া পাহাড়। কিন্তু বিকেল ৫টা বাজতেই ক্যাফেটি বন্ধ হয়ে গেল। অথচ তখনো স্নানার্থীর ভিড় ছিল। আর ছিল ছাতার তলায় আরাম কেদারায় রোদ পোহানো ও বই পড়া (বা বই সামনে রাখা) মানুষেরা। ৩৪ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রোদ পোহানোর কোনো ইচ্ছা আমাদের ছিল না। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে, পানিতে পা ভিজিয়ে আর ছবি তুলে আমরা ফেরার পথে পা বাড়ালাম।

ডিনারের জন্য টেবিল বুক করতে গিয়ে আবার বুঝতে পারলাম কত মানুষ এই রিসোর্টে। সর্বমোট আটটি রেসেত্মারাঁ, কিন্তু সাতটিতেই সব টেবিল বুক করা হয়ে গিয়েছে। একটিতে কোনো অ্যাডভান্স বুকিং নেওয়া হয় না। সেটিতে বুফের ব্যবস্থা; আর সেদিনের বিশেষ থিম ছিল মেডিটারেনিয়ান। সহজেই টেবিল পাওয়া গেল সেখানে। খোলা জায়গার কিছুটা নিয়ে বিশাল সেই রেসেত্মারাঁ। তৈরি খাবার ছাড়াও দোনার কাবাব আর মাছের গ্রিলের জন্য ছিল আলাদা স্টেশন, যেখানে অর্ডার অনুযায়ী খাবার তৈরি করে দেওয়া হচ্ছিল। মাছের স্টেশনে ছিল টাটকা সারডিন, সি ব্যাস আর সি ব্রিম। ম্যারিনেট করা মাছ কয়লার চুলায় গ্রিল করে খাওয়া। আমি তৈরি খাবার থেকে কয়েক পদ নিয়ে সঙ্গে নিলাম গ্রিল করা সারডিন আর সি ব্রিম। পর্তুগিজ খাবারের মধ্যে নিলাম বলের মতো করে ভাজা ম্যাশ করা কড মাছ আর শ্রিম্প রিজোল (বলা যায় চিংড়ি মাছের বড়া – ময়দা দিয়ে তৈরি ত্রিকোণ পিঠার ভেতর ম্যাশ করা চিংড়ি মাছ)। স্টার্টার হিসেবে দুটোই বেশ ভালো লাগলো।

যদিও সাধারণত আমি একটি মেইন ডিশ খাই, সেদিন লোভী হয়ে চিকেন দোনার কাবাব একটু খেয়ে পরে গেলাম মাছের স্টেশনে। গ্রিল করা সারডিন আর সি ব্রিম মাছ সত্যিই খুব ভালো ছিল।

পর্তুগিজ খাবারে ডেজার্ট বেশ কয়েক রকম। তার মধ্যে পেস্তা-বাদামসমৃদ্ধ হালুয়া (কিছুটা বরফির মতো আকার করা) খেতে গিয়ে আমাদের দেশের হালুয়ার কথা মনে পড়ল। তবে সেদেশের বিশেষ কিছুর নাম করতে হলে বলতে হবে ‘পাসেত্মল দ্য নাতা’র কথা। ছোট্ট গোলাকৃতি কাস্টার্ড ধরনের জিনিস, যার তলায় ময়দা থাকাতে কিছুটা টার্ট ধরনের। কোথাও কোথাও তার সঙ্গে একটু আইসক্রিম পাশে দিয়ে সুন্দর করে পরিবেশন করা হয়।

বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁতে একটি পর্তুগিজ খাবার পেয়েছিলাম : ভাতের সঙ্গে সি ফুড মিশিয়ে কিছুটা ইতালিয়ান রিজোট্টোর মতো। কিন্তু তাতে যে-সস ব্যবহার করা হয়েছিল সেটিই তার বৈশিষ্ট্য; আর তাতেই ছিল স্বাদ। প্রথমবার যেখানে এটা খাই সেখানে ওয়েটারের বর্ণনা শুনে আমরা বলেছিলাম, এটা তাহলে স্প্যানিশ পায়েয়ার মতো। তখন সে প্রতিবাদ করে বলেছিল, না, এটা একেবারেই আলাদা। এক রেস্তোরাঁতে যখন দুটোই নিয়ে একটু একটু করে খেলাম তখন বুঝলাম যে, দুটো সত্যিই আলাদা ধরনের খাবার। 

রিসোর্টের রেস্তোরাঁয় আমাদের টেবিলে যে তরুণ সার্ভ করছিল তার জন্ম ভারতের পাঞ্জাবে। সে জানালো, সেখানে তার এক বাঙালি সহকর্মী আছে। তার সঙ্গেও আলাপ হয়ে গেল। 888sport appর মিরপুরে মা থাকেন আর এক বোন বার্সেলোনাতে। সে নিজে ফারোতে বছরে ছ-মাস কাজ করে আর বাকি সময়ের কিছুটা বার্সেলোনা আর কিছুটা 888sport appয় মায়ের সঙ্গে কাটায়। পর্তুগালের পাসপোর্ট পাওয়া নাকি স্পেনের তুলনায় সহজ। সে-কারণে সে এখানে কাজ নিয়েছে।

পরে লিসবন গিয়ে শুনলাম, সেখানে অনেক 888sport appsি আছেন। বিভিন্ন জায়গায় কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। তাঁরা সকলেই নানা ধরনের ব্যবসায় নিয়োজিত। লিসবনের এক দোকানে স্যুভেনির কিনতে গিয়ে এরকম একজনের কাছ থেকে দামে ছাড়ও পেয়ে গেলাম। লিসবন থেকে একটু দূরে কাসকাইস নামে এক ছোট শহরে গিয়ে পেলাম পাশাপাশি কয়েকটি দোকান যেখানে 888sport appsের মানুষ কাজ করছেন। একটি রেস্তোরাঁর মালিকই 888sport appsের।

নৌকা থেকে ডলফিন আর বেনাগিলের গুহা দেখা আলগার্ভ অঞ্চলের প্রধান আকর্ষণ শুধু সৈকত আর সাগরপাড়ের পাহাড় নয়; কোথাও কোথাও উপকূলে দেখা যায় বিভিন্ন আকার ও আকৃতির পাথুরে দ্বীপ আর গুহা। দেখতে হলে আলবুফেইরা থেকে নৌকায় যেতে হবে বেনাগিল নামে এক গ্রামের কাছে। আর সে-যাত্রায় সাগরের বুকে ডলফিনেরও দেখা পাওয়া যেতে পারে।

ছোটবেলায় স্কুলে রচনা লিখতে দেওয়া হতো নৌকা888sport slot game সম্পর্কে। তখন 888sport app থেকে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সময় নৌকা চড়ার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু লিখতাম। কিন্তু ভূমধ্যসাগরে নৌকা888sport slot game! মাঝিদের পেশি ব্যবহার করে বাওয়া ডিঙি নৌকা আর যান্ত্রিক নৌকার মধ্যে পার্থক্য অনেক। কিন্তু ছোট একটি নৌকায় প্রায় ষাটজন মানুষ নিয়ে সাগরের বুকে ডলফিনের দর্শন পাওয়ার অপেক্ষার মধ্যে একটি রোমাঞ্চ আছে বইকি। 

আলবুফেইরার মেরিনা আমাদের রিসোর্ট থেকে ট্যাক্সিতে প্রায় আধঘণ্টা। পৌঁছে দেখলাম পোতাশ্রয়ে বিভিন্ন টুর কোম্পানির সারি সারি নৌকা। সাগরের পাড়ে প্রশস্ত হাঁটার রাসত্মা, যার একপাশে দোকানপাট, রেস্তোরাঁ আর টুর কোম্পানিগুলোর অফিস আর সাগরের দিকে অনেক রেস্তোরাঁয় বসার ব্যবস্থা। দালানগুলোর দেয়াল হালকা নীল, বেগুনি, কমলা ইত্যাদি রঙে রঙিন। স্বাভাবিক গ্রীষ্মে এই মেরিনাতে হাঁটতে ভালো লাগত নিশ্চয়। কিন্তু সেদিন তাপমাত্রা ৩৪-এ উঠে গিয়েছিল। তাই এত সুন্দর পরিবেশেও আমরা হাঁসফাঁস করছিলাম।

নৌকাগুলোর প্রায় কোনোটিরই ওপরে ছাউনি ছিল না। সেই রোদে খোলা নৌকায় প্রায় দু-ঘণ্টার 888sport slot game। কেমন হবে ভাবতে ভাবতে নৌকায় উঠলাম। যাত্রা শুরুর আগে ভূমিকা; তাতে বলা হলো কী কী দেখানো হবে এই যাত্রায়। তবে এও বলা হলো যে, ডলফিন দেখাটা তাদের হাতে নেই, সৌভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। জানানো হলো কোন বাক্সে লাইফ জ্যাকেট রয়েছে। তবে সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হলো, যে-কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তখন কি সবার লাইফ-জ্যাকেট পরার সময় থাকবে! এসব কথা যখন ভাবছি তখন নৌকা ছেড়ে দিলো। সমুদ্র শান্তই ছিল, কিন্তু একটা স্বাভাবিক ঢেউ ছিল। আর সেই ঢেউয়ের তালে তালে নৌকা চলতে লাগলো। মাথার ওপরে সীমাহীন নীল আকাশ। একপাশে তটরেখা ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে। তবে দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছিল যে, উপকূলের অনুচ্চ শৈলশ্রেণি সবুজের অভাবে রুক্ষ আর তার গা আগুনবরণ।

নৌকায় চালক ছাড়া আরো দুজন কর্মী যাত্রীদের দেখাশোনায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন যাত্রার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। ভূমিকার পর তিনি ডলফিন, বিশেষ করে সে-অঞ্চলের ডলফিন সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন। তাতে তাদের আকার, ওজন ইত্যাদি সম্পর্কে একটু ধারণা পাওয়া গেল। বুঝলাম যে, প্রাপ্তবয়স্ক ডলফিন বেশ বড় আকারের (অন্তত পাঁচ থেকে সাত ফুট) হয়।

প্রায় ৪০ মিনিট নৌকা চলার পর আমরা সমুদ্রের অনেকখানি ভেতরে চলে গিয়েছি। তখন চালক গতি কমিয়ে দিয়ে এক পর্যায়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন। আশেপাশে আরো দুটি নৌকা এভাবেই ভেসে ছিল। বোঝা গেল যে, এখানে ডলফিন দেখা যেতে পারে – সে-আশায় নৌকা থামিয়ে আওয়াজ বন্ধ করে অপেক্ষা করা হচ্ছে। মিনিট দুয়েক পর সত্যিই দুটি ডলফিন আমাদের সামনে পিঠ ভাসিয়ে ধীরগতিতে এক পাশ থেকে আরেক পাশে চলে গেল। তারপর কয়েক মিনিট আর কিছু দেখা গেল না। নৌকা আবার কিছুটা চললো এবং আরেক জায়গায় গিয়ে থেমে পড়ল। সেখানেও কয়েকটি নৌকা থেমে ছিল এবং আরো কয়েকটি এসে যোগ দিলো। আমার মনে হলো, সেখানে একসঙ্গে কয়েকশ মানুষ ডলফিন দেখার আশায় জড়ো হয়েছে। তারা কি আমাদের ভয়ে পালিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে না? ওরা কি ভাবছে না, আমাদের জগতে তোমরা হানা দিয়েছ কেন? কিন্তু না, ওরা ওখানেই ছিল। দুটি ডলফিন বেশ হেলেদুলে পিঠ ভাসিয়ে সেটা জানিয়ে গেল। বেশ বড় সাইজের একটি তো পানির ওপরে নিজেকে বেশ খানিকটা দেখিয়ে গেল। ভূমধ্যসাগরের বুকে প্রাকৃতিক পরিবেশে ডলফিন দেখা সৌভাগ্যের ব্যাপার তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কারণ অনেক সময় সেখানে গিয়েও নাকি তাদের দেখা মেলে না।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বেনাগিলের গুহা। বেনাগিল একসময় নাকি জেলেদের গ্রাম ছিল। এখন সেখানে অল্পসংখ্যক মানুষের বাস। মাছধরার পেশায় বেশি কেউ আর নেই। কারণ পর্যটন সেখানে এখন প্রধান কর্মকাণ্ড। পুরো অঞ্চলটির উপকূলে উঠে গিয়েছে চুনাপাথরের পাহাড়। ঢেউয়ের আঘাতে সে-ধরনের পাথর ক্ষয় হতে থাকে প্রতিনিয়ত। লাখ লাখ বছর ধরে চলে আসছে এই প্রক্রিয়া। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি গুহা। এই গুহাগুলির মধ্যে একটি বেশ বড়। প্রাকৃতিকভাবেই তার চূড়ার অংশে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা, যার ভেতর সরাসরি সূর্যের আলো ঢুকতে পারে। ফলে গুহার ভেতরের বেশ খানিকটা অংশ দিনের বেলা আলোকিত থাকে।

আমাদের টুর গাইড জানালেন যে, বড় গুহাটির নাম ‘ক্যাপ্টেনস কেভ’ অর্থাৎ নেতার গুহা। চালু প্রবাদ অনুযায়ী, এসব গুহা ছিল চোরাচালানিদের আড্ডাখানা। সুতরাং তাদের মধ্যে যিনি নেতা তিনি বড় গুহাটি তাঁর অধিকারে রাখবেন – এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে।

গুহা দেখতেও জড়ো হয়েছিল বেশ কয়েকটি নৌকা। তাছাড়া কায়াক (ছিপনৌকার মতো ছোট নৌকা) চালিয়ে এসেছে অনেকে। সব মিলিয়ে দেখা গেল সেখানে বেশ ভিড় জমে গিয়েছে। তবে টুরিস্টদের নৌকাগুলোর মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়া আছে বলে মনে হলো : কোনোটিই গুহার মুখ আটকে দাঁড়িয়ে পড়েনি অথবা বেশি সময় জায়গা দখল করে রাখেনি। একে অন্যকে জায়গা করে দিচ্ছিল কোনো কথাবার্তা ছাড়াই। গুহাগুলোর কাছেই দেখা গেল সাগরের বুকে জেগে ওঠা নানা আকৃতির পাথরের দ্বীপ। একটি দেখতে সাবমেরিনের মতো; তাই নাম ‘ইয়েলো সাবমেরিন’। তার এবং আশেপাশের অনেক পাহাড়ের গায়ের পাথরের রং হলুদ। সেরকম এক জায়গায় ছোট্ট একটি সৈকত, যার নাম হলুদ পাথরের বিচ। জায়গাগুলোর পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল, প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে কত কী সৃষ্টি করে! বেনাগিলের গুহা, পুরো আলগার্ভ অঞ্চলের উপকূলে নানা আকৃতির পাথুরে দ্বীপ আর সৈকতের অগ্নিবর্ণ শৈলশ্রেণি দেখলে এ-কথা মনে না হয়ে উপায় নেই।