হাজি মোহাম্মাদ ত্বকীউল্লাহ তরফদার হাসি হাসি মুখ করে বসে আছেন। তার পাশে সাদা কাচের মগে কফি রাখা। ১৯ ডিগ্রি এসির বাতাসে তা অনেক আগেই ঠান্ডা হয়ে গেছে। সেই অখাদ্য ঠান্ডা কফিই তিনি স্মিতহাস্যে পান করছেন।
‘তো স্যার, যে ডেটা আপনাকে দেখালাম, তাতে এটা পরিষ্কার যে, গত ছয় বছরের মধ্যে শিরীষপুর উপজেলায় হেন কোনো নির্বাচন হয় নাই, যেখানে বোবার চা কোনো ভূমিকা পালন করে নাই। ইউনিয়ন নির্বাচন থেকে শুরু করে পৌরসভা – সবখানেই যেসব প্রার্থী এই চা মুখে নিতে পারে নাই, তারা গোহারা হারছে। আর হারবেই না বা কেন বলেন – এই এলাকায় এখন বিয়েশাদিও হয় এই চা খাওয়ায়ে। এইটাকে অনেকটা টি টেস্ট বলতে পারেন। বোবার চা কেউ খেতে পারলে পাশ, নয়তো ফেল।’
২৭ নম্বর সøাইড শেষ করে থামলো ছায়েদুল। হাতে থাকা টিস্যু পেপার দিয়ে হালকা করে কপালটা মুছলো। পুকুরে জাল ফেলে পাকা কাতলা ধরার পর তাকে দেখতে যেমন লাগে, এই মুহূর্তে ছায়েদুলকে ঠিক সেরকমই লাগছে। ত্বকীউল্লাহ সাহেবের খানিকটা মায়াই হলো। একটু আগেই যে ছেলেটাকে কষে চড় দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা হচ্ছিল, সেটিও কিছুটা কমলো।
ছায়েদুল আবারো তার কাতলা মাছের মতো বিরাট মুখটা খোলার আগেই তাকে হাত দিয়ে থামালেন ত্বকীউল্লাহ সাহেব।
‘তাহলে তুমি বলতে চাইছো, এই বোবা টি না খেলে আমার ইলেকশন জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই?’
‘স্যার, আমার ডেটা বলতিছে, না জেতার চান্সই বেশি।’ মরা মাছের নিষ্পলক দৃষ্টি নিয়ে বললো ছায়েদুল।
‘দেখো, তোমার ডেটা কিন্তু তোমাকেই কন্ট্রাডিক্ট করছে। ৬ নম্বর স্লাইডে তুমি দেখালে গত ছয় বছরে এই এলাকায় যারা যারা ইলেকশনে জিতেছে তাদের নাম ও ছবি। পরের দুই স্লাইড জুড়ে দেখালে যারা হেরেছে তাদের। এই স্লাইডগুলোতে দুজনের নাম কমন আছে। ওসমান আখতার আর ইসমত জাহান আলেয়া।’
‘স্যার, ওসমান সাহেব আর আলেয়া আপার ক্ষেত্রে যেটা হইছে, সেটা খুবই দুঃখজনক। এনারা দুইজনেই প্রথমবারে কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই টি টেস্টে পাশ করছেন। ফলাফল – ইলেকশনে জেতা। কিন্তু পরেরবারের ইলেকশনের আগে দিয়ে যখন ওই একই চা আবার খাইতে গেলেন, তখনই ধরাটা খাইছেন। আলেয়া আপা চা খেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই বমি করা শুরু করলেন। ওসমান সাহেব তো চা মুখেই দিতে পারলেন না। তার আগেই চা উনার সাদা পাঞ্জাবিতে পড়ে গিয়ে একাকার অবস্থা। আর ওইটুকু চায়ের গরমেই উনার হাতে থার্ড ডিগ্রি বার্ন হয়ে গেল। ইলেকশনের পুরা সময়টাতে তার হাতে ব্যান্ডেজ!’
ত্বকীউল্লাহ সাহেব চুপ হয়ে গেলেন। ফোনটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করলেন। তারপর চশমা খুলে আবার স্ক্রিনের দিকে তাকালেন।
শিরীষপুর উপজেলার পাটুইদিয়া থানার নয়াপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। নেহাতই চাঁছাছোলা এক কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসেছেন তিনি। এই গ্রাম থেকে যে কেউ তাঁর আগে অনার্স-মাস্টার্স করে শহরে এসে নাম করেনি, তা নয়। কিন্তু তিনি শুধু উচ্চশিক্ষা আর 888sport appর ভালো বেতনের চাকরিতেই আটকে থাকেননি। নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন তরফদার গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ, যারা ঢেউটিন থেকে শুরু করে মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিনও খুব সফলভাবে তৈরি করে আসছে গত ৩৪ বছর ধরে।
ত্বকীউল্লাহ সাহেবের কোনো দরকারই ছিল না ৬৮ বছর বয়সে এমপি ইলেকশনের এই ঝামেলায় এসে পড়ার। গত ১৮ বছর ধরেই তিনি দেশের বাইরে স্থায়ী হয়েছেন। তাঁকে এই গাড্ডার মধ্যে পড়তে হয়েছে তাঁর বড় মেয়ে শোভনা টি খানের অনুরোধে। তার একটা এনজিও আছে। তাঁর তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে একমাত্র এই মেয়েটাকেই তিনি একটু পছন্দ করেন। সেই এনজিওতে গত পাঁচ বছর ধরে বহু টাকা ঢালার পরও খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না। তাঁর মেয়ের কথা, এই দেশে কিছু করতে হলে টাকার সঙ্গে ক্ষমতা থাকাও জরুরি। আর সেজন্যেই তাঁর বাবাকে নির্বাচনে দাঁড়াতে হবে।
‘কিন্তু, ছায়েদুল, কারেক্ট মি ইফ অ্যাই অ্যাম রং, হাউ ডিড আ ভিলেজ হ্যাগ লাইক হার গট টু এস্টাব্লিশ আ বোবা টি স্টল? এই জিনিসটা তো শহরেই দেখেছি, কোনো মফস্বলে তো দেখিনি!’
ছায়েদুল একটু হেসে বললো, ‘স্যরি স্যার, ভুলটা আসলে আমারই। এই বোবা সেই বোবা না। বোবা, মানে আক্ষরিক অর্থেই বোবা – অর্থাৎ কথা বলতে পারে না। এটা ওই শহরের কালা বিচির চা না। যেই বুড়িকে দেখতিছেন, উনারে গত ছয় বছরে কেউ কথা কইতে শুনে নাই। চা-টা উনিই বানান, কিন্তু বাকি সব কাজ করে ছোলায়মান নামে এই পোলাডা। সে-ই কথা কয় সক্কলের লগে। বুড়িরে কোনো কথা কইতে হয় না। আর এই জন্যিই হের দোকানের নাম হয়া গেছে বোবার চা।’
ত্বকীউল্লাহ সাহেব এবার একটু নড়েচড়ে বসলেন। বোবা বুড়ি চায়ের দোকান চালাচ্ছে, আর তার চা না খেয়ে কেউ নির্বাচনে পাশ করতে পারছে না – বিষয়টা আসলেই ইন্টারেস্টিং। তাঁর নির্বাচনী প্রচারে ব্যাপারটা অনেকভাবেই কাজে লাগানো যেতে পারে।
বড় স্যারের মুখ প্রসন্ন দেখে খানিকটা আশার আলো দেখা দিলো ছায়েদুলের মনে। ভয়ে ভয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে স্যার একটা ডেট ফিক্স কইরে ফেলাই? মিডিয়ার লোকজনরেও ডাকাডাকির ব্যাপার আছে। এইগুলা নিয়া আগে থাকতি আগানো ভালো।’
ত্বকীউল্লাহ সাহেব আবারো হাসিমুখে ছায়েদুলের দিকে তাকালেন। তারপর তাকে এবং ১৯ ডিগ্রির এসিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে সিগারেট ধরিয়ে ফের চুমুক দিলেন ঠান্ডা কফির মগে।
দুই
– বাবা, তুমি একবার ভিডিওগুলো গো থ্রু করো! ফর গডস সেক, দিস ইস দ্য ফোরথ টাইম আই’ভ সেন্ট ইউ দ্য ভিডিওজ। একবার খুলেও তো দেখোনি!
– তোর মেসেজ সিন করিনি বটে, কিন্তু ভিডিওগুলো দেখেছি। ওই গবেটটা আমাকে বাধ্য করেছে সবকিছু গো থ্রু করতে।
– গবেট কাকে বলছো?
– ওই যে, ছায়েদুল না ফায়েদুল – কী যেন নাম ছেলেটার!
– ফর গডস সেক বাবা, হি হ্যাজ টু গড ড্যাম মাস্টার্স ডিগ্রিজ!
– কথা শুনে তো তা মনে হলো না। গ্রাম্য ভাষায় কথা বলছে ফর্মাল একটা মিটিংয়ে!
– দিস ইজ টোয়েন্টি টোয়েন্টি ফোর বাবা! এখনো তুমি মানুষের ভাষা দিয়ে তাকে জাজ করবে?
– কিছু কিছু জিনিস কখনোই বদলায় না শোভা, ওয়ার্কপ্লেস এটিকেট তার মধ্যে অন্যতম।
– কিন্তু বাবা।
– শোভা, বি অ্যা ডল অ্যান্ড শাটআপ ফর নাও! এখন এসব কথা থাক, আমাকে একটা লোকাল রিপোর্টারের সঙ্গে বসতে হবে। তুই জানিস, আই হেইট টু বি লেইট ফর অ্যানিথিং!
শোভনার সঙ্গে কথা শেষ করে ত্বকীউল্লাহ সাহেব যাকে ঘরে ঢোকার অনুমতি দিলেন, তার বয়স কম করে হলেও ৫০ হবে। মাথায় অদ্ভুত একটা ধূসর রঙের চে ক্যাপ, সম্ভবত বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পড়তে থাকা টাক 888sport appরই একটা ছেলেমানুষি চেষ্টা। মুখটা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি লম্বা। গাল দুটো সে-কারণেই হয়তো একটু বেশি তোবড়ানো। বাদামি রঙের শার্টটা রং-ওঠা জিন্সের ভেতর ইন করার কোনো দরকার ছিল না। শুকনো শরীরটার সঙ্গে বেমানান ভুঁড়িটা এর ফলে বেসামালভাবে বের হয়ে পড়েছে।
ত্বকীউল্লাহ উঠে দাঁড়িয়ে নিজের হাতটা বাড়ালেন হ্যান্ডশেকের জন্য।
‘বসুন মিস্টার বাশার, খাদেমুল বাশার রাইট? আমি ভেবেছিলাম আরো ইয়াং কেউ আসবে হয়তো। আপনাদের পত্রিকা তো দেখছি ছোটখাটো রিপোর্টের জন্যও ভেটেরানদের পাঠায়!’
খাদেমুল বাশার বিনীতভাবে তাঁর হাত দুটো গুটিয়ে বললেন, ‘দুঃখিত স্যার! আমি আসলে কারো সঙ্গে হ্যান্ডশেক করি না। ছোটবেলা থেকেই আমার হাত ঘামে। এই বিশ্রী রোগটা দূর করতে অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েছি। ফলাফল শূন্য। একবার আমাদের এলাকায় মাননীয় রাষ্ট্রপতি ভিজিটে এসেছিলেন। সেবারও তার সঙ্গে হাত মেলাতে পারিনি।’
‘রাষ্ট্রপতিও আপনার হাতের স্পর্শসুখ পাননি, আর আমি তো কোন ছার …। হা হা হা! … আচ্ছা কী খাবেন বলুন? চা দিতে বলি?’
‘জি। কড়া লিকার, চিনি ছাড়া। ডায়াবেটিস এখন ৬-এ। এর বেশি বাড়াতে ওয়াইফের কঠিন নিষেধ আছে হে হে …’ বলতে বলতে চেয়ারে বসলেন খাদেমুল। বেশ সুন্দর গদিওয়ালা চেয়ার। এরকম চেয়ারের কথা তার পত্রিকার সম্পাদককে বহুবার বলা হয়েছে। কিন্তু তাতে কেউ কর্ণপাত করেনি।
‘এদিকে সবাই দেখি চায়ের ব্যপারে বেশ পার্টিকুলার! অবশ্য বোবার চায়ের দেশে এটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা’, হাসতে হাসতে বললেন ত্বকীউল্লাহ সাহেব।
খাদেমুলও কিছু না বলে শুধু হাসলেন।
‘আপনাদের এই বোবার চায়ের ক্রেইজের ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। সেদিন একটা ভিডিও দেখলাম, এক তরুণী তার হবু স্বামীকে চড় মারলো বোবার চা খেতে না পারার কারণে। চড়ের ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে গেছে মনে হয়, কারণ চড় মারার দৃশ্যটি নিয়ে বেশ কয়েকটি মিমও দেখে ফেললাম।’
‘আসলে স্যার, এই অঞ্চলে এটাই একমাত্র আলোচিত বিষয়। বোবার চায়ের আগে এই শিরীষপুর উপজেলাকে কে চিনতো বলেন? এই চায়ের কল্যাণেই এই এলাকার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। আপনি ওই দেশি কাপলটার কথা বলছেন, বিদেশি অনেক ভলগারও এখানে এসে ঘুরে গেছে।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি ম্যাস ডেইলির ভিডিওটাও দেখছি। অনেকে তো বলেছে, আইলিনের সঙ্গে ওর ব্রেকআপের মূলেও আছে ওই চা!’
‘এইগুলা আসলে গুজব! ওই ছেলে তো ভয়ে চায়ে মুখই দেয় নাই। অন্যদের দিয়ে ভিডিও করেছে। বিতর্কটা অবশ্য এটা নিয়েই। কেন খেল না চা – ছেলেটা কি ভয় পেয়েছে?’
‘এটাই তো ব্যাপার! এত এত ব্লগিং হয়েছে যে, সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়িয়ে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে চলে এসেছে। এই আপনারাই তো কিছুদিন আগে নতুন একটা নিউজ করলেন। স্থানীয় নেতার গুন্ডারা বোবার দোকান ভাঙতে এসে নাকি দেখে দোকানই গায়েব! এই বুড়ি চাওয়ালি কথা বলতে পারে না বলে তাকে একেবারে পীর-ফকিরের স্ট্যাটাস দিয়ে দিলেন আপনারা?’
খাদেমুলের চা চলে এসেছে। লিকার যেমন কড়া, চিনিও ঠিক ততটাই কড়া। এক চুমুক খেয়ে খাদেমুল কাপটি নামিয়ে রাখলেন।
‘স্যার, ঘটনাটা মিথ্যে নয়। সরেজমিন তদন্তে আমি নিজে গিয়েছিলাম। ওই রাস্তায় সিসি টিভি ক্যামেরাও আছে। ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, যেদিন রাতে দোকান ভাঙতে এসেছিল, সেদিন আসলেই সেখানে কয়েকটা বাঁশের খুঁটি ছাড়া কিছু ছিল না। তার আগে পরের ফুটেজ অবশ্য গায়েব হয়ে গেছে। পরদিন সকালে যথাসময়ে দোকান খুলেছে। চাচি নিয়মমাফিক চা বানিয়েছেন, ছোলায়মান কাস্টমারদের সামলেছে।’
ত্বকীউল্লাহ সাহেব এবার চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা, বুড়ি চা-ওয়ালিকে আপনি চাচি ডাকেন?’
ছোট একটা নিশ্বাস ফেললেন খাদেমুল। এরপর সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘সবাই ডাকে। বয়স্ক মানুষ। চাচি ছাড়া আর কী-ই বা ডাকবে? সে যাই হোক, স্যার, আমি কিন্তু এসেছিলাম আপনার ইন্টারভিউ নিতে। আপনার এত বড় ব্যবসা – এটাকে এম্পায়ারই বলা যেতে পারে। সেই এম্পায়ার ফেলে আপনি হঠাৎ ইলেকশনে দাঁড়ালেন। অনেকে বলছে, এটা আপনার কালো টাকা সাদা করার প্রয়াসগুলোর একটা।’
ত্বকীউল্লাহও সোজা হয়ে বসলেন। খাদেমুলের চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘মিস্টার বাশার, আপনার হোমওয়ার্কটা ঠিক নেই বোধহয়। দেশে যে অল্প কটি গ্রুপ ১০০ ভাগ ট্যাক্স পরিশোধ করে, আমরা তার মধ্যে ১ নম্বরে।’
‘সেটা ঠিক। কাগজে-কলমে আমরা সেটাই দেখেছি। খুবই আশ্চর্যের বিষয়, আপনার দুই ছেলেই ঋণখেলাপি হয়ে এখন দেশের বাইরে আছে বেশ ক-বছর ধরে। কিন্তু আপনার নিজের লোন ক্লিয়ারেন্স রিপোর্ট খুবই ক্লিন।’
‘সেটা নিয়ে অবাক হওয়ার কী আছে? আমার চাকরি জীবনের শুরু কিন্তু আপনার মতোই পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে। ঋণখেলাপি, কালো টাকা, কালোবাজারি – এসব নিয়ে নিউজ করতে করতেই ঠিক করে ফেলেছিলাম, যদি আমি কখনো সেরকম পজিশনে পৌঁছাই, এসব থেকে নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত রাখবো।’
খাদেমুল এবারে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলেন রেকর্ডিং ঠিকমতো হচ্ছে কি না।
‘একটি দৈনিকের ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে আপনার পেশা জীবন শুরু। আপনি কি তখন থেকেই ভেবে রেখেছিলেন এরকম বড় ইন্ডাস্ট্রির মালিক হবেন?’
ত্বকীউল্লাহ সাহেব একমুহূর্ত সময় নিলেন। তারপর বললেন, ‘ছাত্রজীবনে আদর্শবাদী ছিলাম একটু বেশিই। সেই আদর্শ থেকেই সাংবাদিকতা পেশায় আসা। তবে কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গেলাম, এখানে আদর্শ টিকিয়ে রাখা সবচেয়ে কঠিন।’
খাদেমুলের চোখ চকচক করে উঠলো।
‘আপনার শেষ রিপোর্টটা নিয়ে বেশ কন্ট্রোভারসি হয়, যতদূর জানি। একটা সিরিজ অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরি হওয়ার কথা ছিল ওইসময়ের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা নিয়ে। শেষ করার আগেই চাকরি ছেড়ে দেন আপনি।’
‘সিরিজের ৩ নম্বর রিপোর্ট লেখার মধ্যেই তো কেইসের রায় হয়ে গেল। আসামি বেকসুর খালাস। এ নিয়ে আর তদন্তের বাকি রইলো কী বলুন? ততদিনে আমার ট্রেড লাইসেন্সও এসে গেছে। তখন আর এসব ডেড এন্ড চাকরিতে আটকে থেকে লাভ কি বলুন? স্যরি … আমি আসলে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে ডেড এন্ড বলতে চাইনি; আমাকে ভুল ভাববেন না প্লিজ।’
খাদেমুল হাসলেন।
‘আপনি একা নন, বেশিরভাগ মানুষ এটাই মনে করে। বাদ দিন ওসব কথা। একটা কথা বলুন। ওই কেইসে কি সত্যিই আর অনুসন্ধানের কিছু ছিল না? আপনার জার্নালিস্টিক এথিকস কী বলে?’
‘আমার এথিক্স দিয়ে আর কী হবে বলুন? এথিক্স তো আর আদালতের ঊর্ধ্বে না!’ ছাদের দিকে তাকিয়ে বললেন ত্বকীউল্লাহ।
তারপর খাদেমুলের দিকে ঘুরে ছুড়ে দিলেন পালটা প্রশ্ন।
‘ওইসময় আপনাদের বোবা চাচি থাকলে বেশ হতো। উনার চা আসামিকে খেতে দেওয়া হতো। চা খেতে পারলে খালাস, না পারলে ফাঁসি, কী বলেন? হা হা হা হা!’
খাদেমুলও হাসিতে যোগ দিলেন কিছুক্ষণের জন্য।
তারপর হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে বললেন, ‘আসলে চাচির চা ভালো খারাপের বিচার করে – বিষয়টা এমন না। উনার চা খেয়ে একেকজনের একেক রিঅ্যাকশনের কারণ, যে-মানুষটা নিজে যেমন, তার কাছে চায়ের স্বাদ ঠিক সেরকমই লাগে। প্রশ্ন হলো, আমরা নিজেরা আসলে যা – তা কি আমাদের নিজের কাছেই ভালো লাগে?’
ত্বকীউল্লাহ সাহেব এবার তার চশমা খুলে ফেললেন।
‘আপনি তো বেশ ফিলোসফিক্যাল মানুষ, বাশার সাহেব! প্রথম দেখায় সেটি মনে হয়নি! আপনার সঙ্গে এক ঘণ্টার আলাপটা জমে উঠছিল। তবে আর সময় দিতে পারছি না বলে দুঃখিত।’
খাদেমুল উঠে দাঁড়ালেন। টিস্যু দিয়ে হাতের তালু মুছে রেকর্ডারের বাটনটি অফ করতে গেলেন।
ত্বকীউল্লাহ সাহেব ঠিক সেই মুহূর্তে তার শেষ প্রশ্নটি করলেন।
‘আচ্ছা, আপনি তো চাচির চা খেয়েছেন। আপনার কেমন লেগেছে?’
খাদেমুল তার ফোন পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন, ‘খুব কড়া এবং তিতা। ঘিনঘিনে নোংরা সত্যের মতো।’
তিন
ত্বকীউল্লাহ সাহেব গাড়ি থেকে নামলেন। ওই তো দেখা যাচ্ছে দোকানটা। সকাল ১১টাতেই এখানে মানুষ গিজগিজ করছে। ছায়েদুলকে তিনি নিষেধ করেছিলেন তার এখানে আসার খবরটা ছড়ানোর ব্যাপারে। গাধাটা শোনেনি। একেবারে তরফদার গ্রুপের পেইজ থেকে পোস্ট চলে গেছে এখানে রওনা দেওয়ার ঠিক দশ মিনিট আগে।
কম করে হলেও ছয়-সাতটা টিভি ক্যামেরা, ২০টা টিকটকার পার হয়ে দোকানের সামনে এলেন ত্বকীউল্লাহ সাহেব। খুবই সাধারণ একটা টং দোকান। সামনের কাঠের বেঞ্চটাও অতি সাধারণ। ডানদিকের সামনের পায়াটা লাল টেপ দিয়ে প্যাঁচানো। প্যাঁচের একটা পাশ আবার খুলে এসেছে। সেখানে সবুজ একটা ন্যাকড়ার অংশবিশেষ ঝুলে আছে। বেঞ্চের পাশে অলসভাবে শুয়ে আছে একটা তিন ঠ্যাংওয়ালা কুকুর। একটা পা কাটা গেছে, এমন নয়। কুকুরটাকে দেখেই বোঝা যায় ওর জন্ম থেকেই এক পা নেই।
এই কুকুরগুলো সস্তা কেকের টুকরা খেতে খুব ভালোবাসে। চায়ের কেতলির ওপরে এমন একটা কেকের প্যাকেট ঝুলছেও।
ত্বকীউল্লাহ সাহেব খুব অভ্যস্ত হাতে সেখান থেকে একটা কেকের টুকরা কুকুরটাকে খাওয়ালেন। আরো অভ্যস্ত স্বরে বলে বসলেন, ‘দামটা একবারে নিস লোকমান। চাচিরে বল একটা চা আর একটা লাল বেনসন দিতে।’
পরের কথাটি বলে নিজেই হকচকিয়ে গেলেন ত্বকীউল্লাহ সাহেব। এই লাল টেপ আর সবুজ ন্যাকড়াওয়ালা বেঞ্চ, এই তিন পাওয়ালা কুকুর আর ওই সস্তা কেক – সবকিছু এত চেনা চেনা লাগছে কেন?
ত্বকীউল্লাহ সাহেব এখন ৩৪ বছর আগেকার ত্বকী। তার সামনে চাচির দোকান। সেই চাচি, যে ওই জাঁদরেল অফিসারের গাড়িকে এই রাস্তায় ওই রাতে দেখেছিলেন। সেই চাচি, যিনি কথা বলতে পারতেন না। তাই তার হয়ে সমস্ত কথা বলে সাক্ষী হতে প্রস্তুত ছিল তার ১৭ বছরের সহকারী লোকমান। লোকমানের জবানিতে সবকিছু বলেছিলেন চাচি। কীভাবে রাত পৌনে ১টায় বিরাট কালো পাজেরোটা সেখানে এসে দাঁড়িয়েছিল, আর ভেতর থেকে একটা সুঠাম হাত এক লিটার পানি আর দুই প্যাকেট বিস্কিট কিনে নিয়েছিল। ভেতর থেকে ভেসে আসছিল একটা মরা গোঙানি, অমন গোঙানি দেশগ্রামে কেবল মৃত শাবক জন্ম দেওয়া মাদী গাভির মুখ থেকেই শোনা যায় – এর সবকিছুর সাক্ষ্য দিতেই রাজি ছিলেন তিনি।
ত্বকীউল্লাহ সে-সময় প্রত্যক্ষ্যদর্শী হিসেবে লোকমান, তথা চাচির ইন্টারভিউ নিয়েছিল। কিন্তু শ্যামলী দেওয়ান হত্যাকাণ্ডের তৃতীয় 888sport world cup rateটি সম্পাদক আজমল ভাইকে জমা দিলে, ‘বোবা কালা মহিলার সেকেন্ড হ্যান্ড’ সাক্ষ্য যথেষ্ট নয় বলে তা বাতিল করে দিয়েছিলেন। সে-রাতেই অদ্ভুতভাবে নাই হয়ে যায় চাচি আর লোকমানের দোকান। পরদিন রেজিগনেশন লেটারটা জমা দিয়ে বাসায় ফেরার পথে পাশের নর্দমায় রেকর্ডারটা ছুড়ে ফেলে দেয় সে।
‘এই লন স্যার! এলাচওয়ালা ইস্পিশাল চা, আর লগে বেনচন। তয় স্যার একটা কথা, আমার নাম ছোলায়মান, লোকমান না।’
কাপটা তিনি হাতে নিলেন। অজস্র ক্যামেরা উপেক্ষা করে তিনি সরাসরি তাকালেন বুড়ি চা-ওয়ালির চোখের দিকে। তার চোখ দুটো স্থির। তার হাতে ধরে থাকা কাপের এলাচের সুগন্ধওয়ালা চাটুকুও স্থির।
কিন্তু ত্বকীউল্লাহ সাহেব কোনো এলাচের গন্ধ পাচ্ছেন না। তার নাকে ভেসে আসছে নর্দমার গন্ধ। ৩৪ বছরের বাসি খবরের গন্ধ। শ্যামলী দেওয়ানের গোঙানির গন্ধ। ৩৪ বছরের ত্বকীউল্লাহর তীব্র অনুশোচনার গন্ধ।
ত্বকীউল্লাহ সাহেব কাঁপা কাঁপা হাতে কাপটা আনলেন ঠোঁটের কাছে। তারপর খুব ধীরে, সাবধানে একটা ফুঁ দিয়ে চুমুক দিলেন চায়ে। ঠিক যেমন দিতেন ৩৪ বছর আগে।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.