শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী তিথি। বৃক্ষায়ুর্বেদবিদ্যা পাঠ শেষে ভানুমতী পিতার জন্য ঘৃতান্নসমেত নালিতা শাকের বন্দোবস্ত করতে বসে গেল। প্রভাতের আগেই তিনি বিহার রওনা হবেন। ভানুমতীর বড় ইচ্ছা সেও একবার বিহারযাত্রা করবে পিতার সঙ্গে। কিন্তু সে এক দীর্ঘ ক্লান্তিকর পথ। কত দূর-দূরান্ত থেকে শাস্ত্রজ্ঞান নিতে আসছে মানুষ! গল্প শোনে আর মুগ্ধ হয়ে তারা মায়ের নামে সংকল্প ব্যক্ত করে, একদিন যাবেই সোমপুর মহাবিহার। ভীষণ তেজোদীপ্ত চোখ আর বিচারবুদ্ধিতে চৌকস সে, দিনে দিনে সাত গাঁয়ের মধ্যে সুনাম ছাড়িয়ে গান্ধার অবধি পৌঁছাতে শুরু করেছে তার নাম। তাই নিয়ে পিতার মনে দারুণ ভক্তি উদগ্র। সাক্ষাৎ তারা মা-র বাস যেন কুটিরে।
শান্ত হাওয়া বইছে গিরিগ্রামের হস্তীশালে। আর দু-মাস পরেই সন্তান প্রসব করবে পালের মা-হাতিটি। টানা আঠারো মাস পেটে যে শাবক তার বুঝি তর সইছে না। পূর্ণিমার রাত বা দিনে ধরার মুখ দর্শন করে – এই চাইছে মনে মনে মা হাতি। সে যখন পূর্ণ যৌবনে তার গর্ভে এলো চাঁদের কণা, জলাভূমির ঘাস চিবাতে চিবাতে একদিন পায়ের তলায় কী যেন এক ব্যথা। নিরাময়ের কোনো নাম-নিশানা নেই। দলের সঙ্গী-সাথিরা ততক্ষণে সামনে অগ্রসরমান। মা বসুমতীর কৃপায় সেই পথে দেখা মেলে ভানুমতীর। ভানুর দৃষ্টি তখন জলায় ফুটে থাকা পদ্মসারির দিকে। তারা মায়ের পূজার ফুল সে নিজে সংগ্রহ করে। আজ সখী শুক্লাম্বরী সঙ্গী হয়নি। বেলা মেঘের আড়াল খানিকক্ষণ, জলাভূমির একপাশে শিমুল বৃক্ষরাজি, তাতে রক্তাভ ঊর্ধ্ব কুসুম। ভানুমতীর মন চপলা চঞ্চল হলো তাই দেখে। এই বিস্তৃত শ্যামল সবুজ স্থানে যতবার এসেছে ও, ততবার নিজেকে খুইয়ে ফেলে কোথায় যেন। পিতার কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে চেয়েছে বহুবার, কেন তার ভেতর হাহাকার ধ্বনির সঞ্চার হয়?
ভাবনা তার থমকে যায়, আহত প্রাণীটিকে দেখে। দুজনায় চেয়ে থাকে দুজনার দিকে ক্ষণপল। পূর্বজ্ঞান অনুযায়ী সে-চোখের ভাষা চকিতে বুঝে নেয় ভানুমতী। মুহূর্তে ছুটে যায় হাতিশালে, হস্তীমাহুত দ্রুত ব্যবস্থা নিতেই জলা থেকে মা হাতিকে তোলা হয়। কিন্তু পায়ে তার গভীর ক্ষত। দলের অন্য হাতিরা সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে। ভানুমতী তার সমস্ত শাস্ত্রবিদ্যা কাজে লাগাতে শুরু করে। আরামে বিশাল নধর দেহটি এলিয়ে পড়ে ঘাসে। বহুবার গজদলটি স্থান পরিবর্তন করতে চাইলেও মা হাতিটি আগ্রহ প্রকাশ না করায় গোটা পরিবার গোত্র রয়ে যায় গিরিগ্রামে। রাজা ধর্মপালের সেনাপতি একবার বিশ্রাম-আহারাদি গ্রহণ করার জন্য বিশাল গজবাহিনী নিয়ে সপ্তাহ অন্ত ছিলেন
এ-স্থানে। হাতির খাদ্যপানীয়র সুব্যবস্থা থাকায় একটা হস্তীশালা নির্মাণ করেন তিনি। সেই থেকে মহাবিহার যাত্রাপথে ভিক্ষুদের বিশ্রামের একটা বন্দোবস্ত গড়ে উঠেছে গ্রামের সীমাপথে। ভানুমতীর পিতা আচার্য নারায়ণ মহাবিহারের পণ্ডিত। তাঁর অগুনতি শিষ্যছাত্র। বনপথে বিশ্রামের সময় কেউ কেউ গিরিগ্রাম হয়ে মহাবিহার যাত্রা করে। ফলে কিশোরী বালা ভানুমতীর জ্ঞান নিয়মিত হারে বেড়েই চলেছে।
মা হাতিটির আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস, আস্থা ও প্রেম লতাগুল্মের মতো গাঢ় সবুজ ভানুমতীর প্রতি। সে অপেক্ষা করে আছে তার শাবক ভূমিষ্ট হওয়ার জন্য। সমস্ত চরাচর, বৃক্ষরাজি, দিঘির গভীর জল, শস্যদানা সবই এখানে বোধিগ্রস্ত। একদিন খবর আসে আচার্য নারায়ণ পণ্ডিতের নিকট – জলের বড় সংকট রাঢ়দেশে। অজয় নদের অঞ্চল থেকে আসা জনাকয়েক ভিক্ষু তাই আজ যাত্রা করবেন সেদিকে। কোষাগার থেকে ব্যয়ের অর্থ তুলে দিলেন আচার্য তাঁদের। বেশ ক-মাস হলো তিনি কন্যাকে দেখেন না। আষাঢ় মাসে কার্যদিবস থেকে ছুটি মিলবে। তাই কন্যার জন্য একটি চিত্রকর্ম নরম তুলায় মুড়িয়ে বাঁশের লম্বা কোঠরে পুরে শিষ্যের হাতে দিলেন। চিত্রটি এঁকেছে অতিপ্রিয় ছাত্র তিব্বত থেকে আগত এক কিশোর যুবা। সে মনে ভারি নরম, কিন্তু সাধনায় প্রবল দৃপ্ত, ন্যায়নিষ্ঠ। কন্যার গল্প প্রায়ই করেন আচার্য উদ্যানে হাঁটতে হাঁটতে। মন্দির প্রাঙ্গণে সেই কিশোর বয়স থেকে নানা প্রকারের ফুল যত্নের সঙ্গে লাগিয়ে এসেছেন। তারও কিছু বীজ কন্যার জন্য পাঠালেন।
ভিক্ষুর দল চলে গেলে 888sport app পণ্ডিত আচার্যের সঙ্গে সভাগৃহে নারায়ণ বিহারের এবং পাল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় বসেন। খবরাখবর যা আসছে তাতে চিন্তার কালো রেখা ক্রমান্বয়ে সকলের মনে গেড়ে বসছে। বৌদ্ধবৈরী পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে কূট রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক গোল ধেয়ে আসছে মহাবিহারের দিকে যেন। পুঁথির গোছা হাতে নিয়ে অনেকটা বিমর্ষ মলিন দৃষ্টিতে মহাচার্য মশাই সকলের দিকে একপলক দেখে নিয়ে জানালেন, আমাদের বিদ্যা মানুষের ক্ষতি করে না। আমাদের ক্ষতি তাই কোনো বহির্শত্রু বা কোনো চর কেন করবে? এতো না ভেবে বরং কর্মে মনোনিবেশ করি সকলে মিলে। জলের অভাব এদিকেও হতে পারে। এবার আষাঢ় মাসে বৃষ্টি তুলনামূলকভাবে কম হবে। গণনার ফল সেটাই বলছে। মৃগয়া বরাহ আর মহিষ গোচারণভূমির জন্য আলাদা জলের বন্দোবস্ত রাখতে হবে, যাতে অতিথিশালার কোনো অসুবিধা না হয়।
আগামী মাসে জাভা ভূমি থেকে বিশেষ পণ্ডিতবর্গ আসবেন। এ-অঞ্চলের কৃষিবিদ্যায় জ্ঞাত হতে। আমাদের সেই মতো প্রস্তুতি নিতে হবে। নারায়ণের মনে অদ্ভুত চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হতে শুরু করলো। এ তাঁর পুরনো অভ্যাস।
পিতা-পিতামহের আমল থেকে এই মহাবিহারে তাদের যোগসূত্র। রাজা ধর্মপাল স্বয়ং তাঁর প্রপিতামহকে গুরু আজ্ঞা দিয়েছিলেন বিদ্যার্থীদের জন্য আবাসস্থল নকশা করার জন্য। সেই গুণ তো রক্তের ধারা অনুযায়ী কন্যা ভানুমতীও বহন করছে। তাই এতো দুশ্চিন্তা নারায়ণের মনে। এতো বিদুষী কন্যার সৎপাত্র তিনি কোথায় পান!
সখী শুক্লাম্বরীর বিবাহতিথি আজ। পাড়ার গৃহে গৃহে গীতবাদ্য, ফুল-চন্দন সুবাস হাওয়ায় ভেসে ম-ম করছে। কদিন আগেই মা হাতিটি একটি পুত্রশাবক জন্ম দিয়েছে। ভানুমতীর পানে এমনভাবে তাকায় চন্দ্রভান যেন হাতি নয়,
ও-ই ওর মা। শুক্লাম্বরী আর ভানুমতী মিলে ঠিক করে শাবকের নাম। চন্দ্রভান! তারা দেবীর কুল চরণে পরম ভক্তিতে পদ্ম সঁপে মায়ের কাছে মানত করেছে – এ হাতিশালে যেন আরো শিশু জন্মায়। ভানুমতী ওদের পুরো দেখভাল শিখে ফেলছে ধীরে ধীরে। তবু বিশেষ দরকারে হস্তীবাহিনী যখন রাজ্য অতিক্রম করতে যায় দূর রাজ্যে মনে ওর শঙ্কা জাগে। কোনো হাতি ফিরে না এলে খুব বাকবিতণ্ডা করে নগরপতির সঙ্গে। আদরের ভানুমতীর ভেষজবিদ্যার চর্চাগুণে এ-তল্লাটে পশুরোগ নেই বললেই চলে। মানুষের তো এক প্রকার আরোগ্যকুটির গড়ে উঠেছে উত্তরপ্রান্তে অশোকের তলায়।
দক্ষিণ প্রান্তের মঠে ঘোড়ায় চেপে শুক্লাম্বরীর বর আসবে আজ। চাপা লাজে গৃহের বধূদের মন আশোক ফুলের মতো রাঙা। তারাও 888sport sign up bonusর আতশকাচে নিজেদের বিবাহের দিনটি প্রত্যক্ষ করে নিচ্ছে যে যার মতো। নাভিতে চন্দনের তিলক দিতে দিতে কেউ একজন শুক্লাম্বরীর বুকের ভেতর বেল ফুল গুঁজে দিলো। বর তো যে সে নয়, মহাপণ্ডিত, বিক্রমশীলা থেকে প্রৌঢ় আদর্শে দীক্ষায় দীক্ষিত সেই সঙ্গে চিত্রকলা ও 888sport live footballে সুনাম এ-রাজ্য থেকে সে-রাজ্যে সমাদৃত। শুক্লাম্বরীও কম কিছুতে নয়। রন্ধনশালার যাবতীয় মশলা জ্ঞান, তুলা চাষ জ্ঞান, এমনকি পোড়ামাটির ফলক জ্ঞানেও সে সমান দক্ষ। মৃগ মাংস, ঘৃতান্ন, ঘন সরের পাক মিঠাই, কলাপাতায় পরিবেশন শেষে সকলে মঠ অভিমুখে যাত্রা করলো। সেখানেই যজ্ঞ মন্ত্র পাঠে কন্যাদান হবে। যাওয়ার আগে মা হাতির আশীর্বাদ নিল শুক্লাম্বরী। বুকের ভেতর কেমন হু-হু করে উঠল তার। শাবকপুত্রটি ঘুমে অচেতন। তবু তার লম্বা ক্ষুদ্র নাকে চুম্বন করলো ও। মায়ের কোলে সোনা বাচ্চা হয়ে থেকো চন্দ্রভান। পিতার বাড়ি থেকে বিদায় নিতেই আকাশ জমকালো মেঘে ছেয়ে এলো। সহসা ভানুমতী কীসব মন্ত্র উচ্চারণ করলো। মেঘ মৃদু গর্জন করেই যাচ্ছে যদিও। দূরে বিশেষ নয় মঠ, তবুও বৃষ্টি নেমে এলে অসুবিধায় পড়তে হবে বইকি।
রথের ঘোড়া বারদুয়েক আপত্তি জানালো শরীরী ভাষায়, সামান্য চোখ বড় করে আবার শান্ত হলো। বিবাহের রীতিসমূহ সারা হলে ভানুমতী সখীকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুপাত করলো। আগত অনেকের চোখই জলে ভেজা। পিতৃগৃহে আর তো ফেরা হবে না কুমারী শুক্লাম্বরীর। সে এখন কিছুদিন উত্তরের রামপুরে বসবাস করবে। পিতা তাই মাতৃঘরের একমুঠো মৃত্তিকা সমেত বীজ দানা দিয়ে নববধূ-বরকে আশীর্বাদ করলেন। একে একে সকলে মঙ্গলমন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে ঘোড়ার দল বিদ্রোহ ঘোষণা করলো যেন, তারা কিছুতেই মঠপ্রাঙ্গণ ছাড়তে চাইছে না। বরপক্ষের রথ ঘোড়া তো আরো অনড় হয়ে রইলো। পশ্চিমাকাশের নিচে মেঘ জমে স্থির। বায়ুর গতি সুবিধাজনক নয়। তাই দেখে ভানুমতী তড়িৎগতিতে নববিবাহিত দম্পতির চারদিকে আর রথের ঘোড়াকে ঘিরে এক বৃত্ত তৈরি করলো। সকলকে নির্দেশ দিলো এই বৃত্তের বাইরে কেউ যেন পা না ফেলে। যত বড় ঝড়ই আসুক না কেন!
কয়েক মুহূর্ত মাত্র, এরপরই সাতশো রাগ-রাগিনী উন্মত্ত বেগে ঝড় বইয়ে দিতে লাগলো ধরাধামে। কিন্তু ওদের গায়ে ঝড়-বৃষ্টির কোনো আঁচই লাগলো না। ভানুমতীর এই বায়ুবিদ্যাশাস্ত্র দেখে উপস্থিত পণ্ডিত ঋষিগণ প্রণাম ঠুকতে লাগলো। সদ্য নববর বধূর কানে কানে জিজ্ঞেস করলো,
– এ কে?
আশ্চর্য শান্তস্বরে সে জানালো,
– সখী ভানুমতী, পণ্ডিত আচার্য নারায়ণের কন্যা। যার মাথায় বর আছে তারা মায়ের।
প্রায় ঘণ্টা পর ঝড় থামলো যখন চারদিক লণ্ডভণ্ড। সবুজ সুষমা কেউ যেন রাগে ক্ষোভে ছত্রখান করে দিয়ে গেছে। পক্ষিকুলের পর্যন্ত কোনো সাড়া নেই। যেন পৃথিবীর আদি প্রহর এক্ষুনি শুরু হলো এতো নিস্তব্ধ। বৃত্তের গণ্ডিতে থাকা সকলে বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে ভানুমতীকে দেখছে আর নিজেদের স্পর্শ করে বুঝতে চাইছে, একি ভ্রম, নাকি স্বপ্ন! ভানুমতী পরদিন প্রত্যুষে আবিষ্কার করে কুটিরের বাইরে কয়েকজন ভিক্ষু এসে পৌঁছেছেন। তাঁদের মুণ্ডিত মস্তকে সকালের রবিকিরণ ঝলমল করছে। জলাহার করতে যাওয়ার আগে তাঁরা ভানুমতীকে আচার্যের পাঠানো কিছু জিনিসপত্র দিতে এসেছেন। কুশলাদি বিনিময়ের পরে পুনরায় যাত্রা শুরু করেন ভিক্ষুর দল। বাঁশের মুখ খুলে অসামান্য চিত্র888sport live chat পায় সে। এমন চিত্র খুব একটা দেখেনি এর আগে, পিতার মুখে শুনেছে সেখানে একজন এসেছে খুব ভক্তিভরে চিত্র আঁকে নাকি। এ কী তবে তারই আঁকা – মনে মনে ভাবে ভানুমতী। চন্দ্রভান সকাল সকাল মায়ের সঙ্গে চলে এসেছে বাগিচার উঠানে। সারাদিনের চরালিতে যাবে ওরা এখন পরিবারের সঙ্গে। কিন্তু তার আগে এ-মুখে একবার আসা চাই। ভানুমতী খুব কচলে দিলো ওদের। কপট ছল করে কাঁদো স্বরে চন্দ্রভানকে বললো,
– বেশিদূর যেও না মাতাকে ছাড়া। মাসি-পিসির কথা মেনে চলো।
ময়ূর ডেকে উঠলো আম্রডালে। কপোতের দল উড়ে এক পাক নামলো জবার তলায়। ভানুমতীর মনটা পিতার জন্য কেমন করে উঠলো যেন। জানে না কেন কী এক অশুভ হিম সারাক্ষণ ওর বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম করে চলেছে। চিড়ে ধান রোদে দিয়ে একটা পুঁথি নিয়ে বসলো। কত কত পৌরাণিক জ্ঞান আর বিদ্যা যত জানছে তত ভানুমতী শিউরে শিউরে উঠছে। কিন্তু পিতা এর আগের বার এসে কেমন যেন প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়েছেন, গাঁয়ে নতুন কেউ এলে ভানু যেন পুঁথি সরিয়ে রাখে। ভয় কি তা সে জানে না। গভীর অন্ধকারেও প্রসূতির বাড়ি চলে যায় মাথায় প্রদীপ রেখে। সে তো বালার দাওয়াই নিয়ে নিত্য কাজ করে। তাকে কত জঙ্গলে যেতে হয় হাতির পিঠে করে লতাপাতার খোঁজে। সে কী করে জানবে কে নতুন চর, কে বা ভিক্ষু নয়। মানুষের বিপদে তাকে তো যেতেই হবে। সেই তো পরম আজ্ঞা!
আষাঢ়, শ্রাবণ অতিক্রম করেছে, পিতা আসেননি গৃহে। মহাবিহারে বিশেষ দায়িত্ব অর্পণ করাতে এক্ষুনি আসতে পারছেন না আচার্য। গুরুকুলে তার পিতার সমাদর বাড়ছে জেনে ভানুমতী স্থিরচিত্ত হয় কিছুটা; কিন্তু মন তার কু ডাকে। আশ্বিনের এক দুপুরে পাতা পিষছিল ভানু, হঠাৎ এক অশ্বারোহী আপাদমস্তক ঢেকে ওর বাগিচার বাইরে ‘জল’ ‘জল’ করে সামান্য চেঁচায়। শ্বেতবস্ত্রখণ্ডে জল ভিজিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল সে। আরোহী তখন ভূমিতে লুটিয়ে পড়ছে। ঘোড়ার মুখ থেকে ফেনা ঝরে পড়ছে। বিদুষী ভানুমতী তার স্বভাবজাত বিদ্যা কাজে লাগাতে শুরু করে দিলো সহসা। কিন্তু একি! সারা পিঠময় লোহিত রঙ শুকিয়ে এসেছে প্রায়। ভানু চোখে-মুখে জল চিপে দিতেই অস্ফুট স্বরে যুবক – ‘ওঁ মণিপদ্ম হুম!’ উচ্চারণ করতে লাগলো।
এ তো সংকেত!
চমকে উঠলো ভানু।
– এ যে পিতার সেই অমোঘ মন্ত্র জপ।
ঘাড় বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল তার। কোনোক্রমে বুদ্ধিনাশ করা চলবে না এখন। পাঁজরের ভেতর থেকে একখানা পত্র বের করে দিলো আগন্তুক। সবিস্তারে পাঠ না করেই ভানুমতী সুশ্রূষায় মন দিলো।
– মহাবিহার আক্রান্ত!
এ যেন যমের ভাষায় লেখা পত্র! সন্ধে নাগাদ পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে এলো যুবকের। মুণ্ডিত মস্তকের নিচে তীক্ষè অচেনা চোখ। পশমের সোনালি সরু রেখা ঠোঁটের উপরিভাগে আর চামড়া যেন স্বচ্ছ কনকচাঁপা। কিন্তু জ্ঞান ফিরলেও জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তার। ভানুমতী পিঠের ক্ষতের কথা জানতে চাইলো। অতিরিক্ত জখম নয়, তবু রক্তক্ষরণ হয়েছে বেশ।
বিশুদ্ধ জল পান করালো। এরপর শামুকে করে ঘন রস পান করালো। জানালো, প্রভাতের আগেই জ্বরের বেগ কমে যাবে। কিন্তু সে কথা বলবেই। দু-কথা বলতে গিয়ে জিভ জড়িয়ে আসে তার। ভানু আর ঘুমায় না। দৌড়ে হাতিশালে গিয়ে চন্দ্রভানের মাকে ধরে কানে কানে কী সব জানায়। বিপদ এলে কী করতে হবে জানে সব বুদ্ধিমতির দল। পাড়ার দিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। প্রদীপ জ্বলছে না। ভানু তারা দেবীর মন্দিরে গিয়ে আনত হলো।
– কেন এতো রাজ্য চাই সকলের মা! কী অপরাধ করেছি বোধিজ্ঞানে দীক্ষা নিয়ে মা, মা গো পিতাদের তুমি রক্ষা করো!
এই মিনতিতে ফেটে পড়ে ভানুমতী!
পিঠের ক্ষত শুকিয়ে এসেছে প্রায় আগন্তুকের। তিন দিন তিন রাত অতিক্রান্ত। আলাপ তেমন কিছু হয়নি, বিপদ আসন্ন, কিন্তু কেন? ভানু বারবার নিজেকে এই প্রশ্নে বিদ্ধ করে যাচ্ছে। শস্যদানা এখনো মাঠে। কৃষক গোলায় ধান তুলবে কিছুদিন পর। ধান নিয়ে যায় নিক, গজ, ঘোড়া সব নিক; কিন্তু প্রাণের ক্ষতি যেন না হয় মা তারা! ক্ষণে ক্ষণে প্রার্থনা করে যাচ্ছে ভানুমতী।
এদিকে অমিতাভের শরীরজুড়ে শ্রান্তি আর অবসাদ। ওরা সেদিন দুপুরে বিশ্রাম নিচ্ছিলো শাস্ত্রের পাঠ শেষে যে যার কক্ষে। তারও কদিন আগে চৈনিক এক ভিক্ষুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। নিখোঁজ তো নিখোঁজ। নারায়ণ আচার্যের তখন গুরুভার পড়েছে মন্দিরের নতুন পোড়ামাটির 888sport live chatকর্ম গোছানোর। কিন্তু অমিতাভের কী মনে হতে ঘোড়ায় চেপে কয়েক ক্রোশ যায় জঙ্গলের পথ ধরে। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান মেলে না। সে ছিল বড় চুপচাপ শান্তগোছের। সদ্যই আলাপ জমতে লেগেছিল কিন্তু সে না বলে কোথায় যাবে?
জনাকয়েক বালকের বেশ জ্বর ছিল, রন্ধনশালার পাচককে কী এক মশলা দিয়ে পাতলা মিশ্রণযুক্ত আহার দিতে বালকের দল সুস্থ হয়ে উদ্যানে খেলতে পড়তে লাগলো। সেই মশলার ঘ্রাণ ভীষণ অচেনা আর তীব্র। মুখের স্বাদ ফেরাতে নাকি খুব কার্যকর ইঙ্গিত-ইশারায় বুঝিয়েছিল সে। মায়ের আদেশে সাধুধামে এসেছিল। কিন্তু গণমুখে আর দূতের বিশেষ বার্তায় বারবার উঠে আসছিল, ভেতরে ভেতরে কূটকোন্দল চালনা করা হচ্ছে। বিক্রমশীলা থেকে শুরু করে 888sport app বিহারের পণ্ডিত আচার্যের সঙ্গে রাজক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব বেড়েই চলেছে। মহাবিদ্যালয়ের সঙ্গে রাজক্ষমতার বিরোধ ছিল না বিগত শতকগুলোতে। কিন্তু পাল রাজাদের অতি বিশ্বাস আর সেনা-সামন্তের ভেতর দুর্বল নেতৃত্ব ফাটল ধরাচ্ছিল সাম্রাজ্যের। এ-কথা নারায়ণ পণ্ডিতের বুঝতে বাকি ছিল না। তাই যখনই সুযোগ পেতেন মূল্যবান জরুরি পুঁথি তিনি কন্যার কাছে হস্তান্তর করতেন।
অমিতাভের চোখ ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল, হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন আচার্য পণ্ডিত।
– ওঠো অমিতাভ, এক্ষুনি পেছনের কানন থেকে ঘোড়া নিয়ে সোজা গিরিগ্রাম যাও। সেখানে আমার কন্যার কাছে এই পত্র ও পুঁথি তুলে দেবে। আর যদি আমাদের দেখা না হয় এ-জীবনে তবে জানবে জীবনের কাছে মৃত্যু এসে পৌঁছেছে। মনে রেখো, কিছুতেই বহিঃশত্রু ও চরের হাতে ধরা পড়া যাবে না। ভানুমতীর ধরা পড়া চলবে না।
এরপর কপালে তিনি হাত স্পর্শ করলেন। ঘোড়া ছোটানোর পরপরই পেছন থেকে শুনতে পায় সে মানুষের বীভৎস চিৎকার। কিন্তু কিছুদূর যেতেই একদল সৈন্য তাকে ঘিরে ফেলে। তাদের দেখে পাল সৈন্য মনে হচ্ছিল না। গুরু আজ্ঞা পালনে মৃত্যু হলেও পত্র ভানুমতীর হাতে দিতেই হবে – এই পণে সে ঘোড়া পূর্ণবেগে ছোটাতে শুরু করে যখন পেছন থেকে ধারালো ছোরা এসে পিঠে আঘাত করে, কিন্তু তবুও দমে যায় না অমিতাভ।
জানে না কিছুই কী অবস্থা মহাবিহারের। ভানুমতীর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না প্রায়। পিতার চিন্তায় কৃষ্ণবর্ণ হয়ে আছে মুখখানা। মনে মনে আশা, রাজ্যের যা কিছুই হোক বিদ্যার্থীদের আর পণ্ডিতদের নিশ্চয়ই কিছু হবে না। এই ভেবে ভেবে দুজনেই আশায় বুক বেঁধে আছে সপ্তাহখানেক। এখন সে চন্দ্রভানের সঙ্গে খেলতে পারে। উঠে ঘোড়ার যত্ন নিতে পারছে আগের মতো। ভানু অসামান্য সব নিরামিষ আহার করাচ্ছে। একটি মৃগ সদ্য মা হয়ে ওদের বাগিচায় ঘাস খেতে আসে। তাই দেখে চিত্র আঁকতে বসে গেল অমিতাভ। ভানুমতীর গালে পলাশ রং। এমন দৃশ্য তো সে প্রায় স্বপ্নে দেখত। কিন্তু ঘুম ভাঙত কেকার ডাকে। আজ বাস্তবেই ঘটছে সে-স্বপ্নদৃশ্য। বড় বিপন্ন মনে হলো নিজেকে, পিতার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে এসেছে। তার রক্তপ্রবাহে প্রজ্ঞার যে ধারা সেই লোহিত স্রোতেই যে নতুন কল্লোল! অচেনা অথচ নিবিড় পরিচর্যার ভাষায় তারা যেটুকু চোখাচোখি করছে তাতে পরিষ্কার 888sport apk download apk latest version ও সম্মান ফুটে উঠছে।
দুপুরে চন্দ্রভানকে নিয়ে খেলা করছিল মা হাতি। পালের অন্যরা হালকা ঝিমিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ অচেনা একদল লোক এসে হাতিশালে অগ্নিমশাল ছুড়ে দিলো। পশুর দল দ্রুত পেছনের জলাভূমির দিকে ছুটলো। তাদের দিকে আগুন ধেয়ে আসার উপায় তেমন ছিল না। কেননা দিন কতক আগেই শালের চারদিকে খনন করে জলের মটকা রাখা হয়েছিল। তার ওপর বাঁশের পাতলা চোখা ফেলে রাখা ছিল। বিপদ এলে পশুদের কী করতে হবে সেসব রক্ষণাবেক্ষণে যে ছিল পালিয়েছে নাকি হত্যা করা হয়েছে – কেউ বুঝতে পারছে না। চন্দ্রভান ভীত হয়ে মায়ের কোলের কাছে দাঁড়িয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখছিল দূর থেকে। চোখের ইশারার তারা এক অদ্ভুত সংকল্প এঁটে রইলো। বৃত্তের ছকে নিজেদের ভেতর শলা করে নিল, ছোটবয়সীদের একদম মধ্যখানে রেখে তারা দাঁড়িয়ে রইলো।
গিরিগ্রামের গোটা মহল্লায় কান্নার উচ্চকিত ধ্বনি। সেইসঙ্গে ঘোড়ার, মহিষের পালের ছোটাছুটির আওয়াজে ভূমি থরথর কম্পমান। আক্রমণ ঠেকানোর চাইতে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে সকলে। এদিকের উত্তরের পথসীমা বন্ধপ্রায়। বাড়ি বাড়ি লুণ্ঠন আর দস্যুতার খবর পক্ষিকুলকেও বুঝি বিচলিত করছিল। তাদের অদ্ভুত ডাকের কারণেই ভানুমতী রন্ধনশালার উনুনে জল ঢেলে দিলো। কুটিরের পশ্চিমে আয়তকার পুষ্করিণীতে আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল ও। সেখানে অমিতাভকে নিয়ে জলে সমস্ত শরীর ডুবিয়ে মাথার ওপরে কচুরিপানার কন্দ ভাসিয়ে রাখলো শুধু। কিন্তু না সারা বিকেলে কোনো আক্রমণ হলো না। নিশ্চিত মনে অমিতাভই আগে উঠে পোশাক পরিবর্তন করে নিল। ভানুমতীর মনে শংকার ছায়া সরছে না। সে কুটিরের গৃহপালিত সমস্ত পশুকে উন্মুক্ত করে দিলো। যেন তারা প্রাণে রক্ষা পায় বিপদ এলে। আসলে এদিকে ঘন বেতবন আর বাঁশের ঘন সন্নিবেশিত বন থাকায় দূর থেকে কারো নজরে আসে না কুটির সহজে। কিন্তু চেনা কেউ হলে পথ জানবে। সবে আহারের ব্যবস্থা করবে ওরা – এমন সময় ঠিক পাতার আওয়াজ, ঘোড়ার খুরের সাবধানী পদক্ষেপ চেনে ভানু। একটু বুঝতে বাকি থাকে না এ শত্রুর আগমন। ওরা লুকিয়ে পড়ে তবে খুব কাছেই।
মোট চার জনের একটা দল, প্রত্যেকেই সশস্ত্র। পশ্চিমাকাশে রবি অস্তগামী। সেই রহস্যময় আলোয় পৃথিবী লাজুক যেন। কিন্তু একজন খুব চেনা গলায় বলছে, ভানুকে খোঁজো ভালো করে। তাকে হাতছাড়া করা চলবে না। কুটিরের অন্দরে জিনিসপত্র তোলপাড়, হুলস্থূল হলো কিছুক্ষণ। অসন্তুষ্ট তাদের স্বর থেকে বিরক্তি ঝরে পড়ছে। হঠাৎ একজন ঝোলা থেকে কাটা মস্তক বের করে উঁচু করে বলে উঠলো – ভানুমতী দেখো পিতার মুখ শেষবারের মতো। বের হয়ে এসো যেখানেই থাকো। ডাকিনীপনা ছেড়ে যোগ দাও আমাদের সঙ্গে। কিচ্ছু করা হবে না তোমাকে। শুধু তোমার বজ্রযানী, বায়ুবিদ্যা, আয়ুবিদ্যা আমাদের দাও।
এই বলে তারা খণ্ডিত মস্তকটি ছুড়ে মারলো কুটিরের দ্বারে। ভানুর মুখ চেপে ধরেছিল অমিতাভ। তার গণ্ডদেশ থেকে গড়িয়ে জল পড়ছিল অনর্গল। পিতার পবিত্র মুখ এভাবে দেখতে হবে, এ তো সহ্য করা যায় না। ভানু সেই চেনা লোকটিকে চিনে ফেলে পলকে, সখী শুক্লাম্বরীর পণ্ডিত বর সে! আগুন দেবে দেবে এই সময় কেউ একজন বলে উঠলো, না প্রতুষ্যে তল্লাশি করে দেখবো, এখন চলো, ডাকিনিটা পালিয়েছে বোধহয়। এখানে থাকা যাবে না, কী বিদ্যায় আমাদের বশ করে ফেলবে ঠিক নেই। শত্রুদল চলে যাওয়ার পরও ওরা খড়ের গাদায় লুকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ভানুমতী সংজ্ঞাহীন। অমিতাভ ধীরে গুরুর মাথাটি বুকের কাছে নিয়ে প্রণাম করে একটা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নিল, এরপর ভানুর সংজ্ঞা ফেরালো জল ছিটিয়ে। বেশিক্ষণ নেই হাতে, শোক করবে নাকি পালাবে – কী করবে থিতু হতে পারছে না ভানুমতী। কিন্তু অমিতাভের দৃঢ় স্বভাব আর অবিচল সংকল্প কাজে দিলো এই মহাসংকটে।
সংরক্ষিত পুঁথিপত্র গর্ত করে লুকিয়ে রাখা ছিল আগে থেকেই। সেখানেই পণ্ডিত আচার্য নারায়ণের মাথাটি সমাহিত করলো দুজনে মিলে। ভানুমতীর শরীর শিথিল হলেও মনের ভেতর কঠিন এক বার্তা প্রেরণ করলো। কিছুতেই শত্রুর হাতে ধরা দেবে না ও, মরণ এলেও না। অমিতাভ সমাধির ধুলোমাটি একটি থলেতে পুরে নিল।
– সাক্ষী রাত্রির নক্ষত্র, চন্দ্র ও আঁধার তোমাকে রক্ষার গুরুভার আমৃত্যু করে যেতে পারি, এই মুহূর্ত থেকে ভানুমতী তুমি আমার প্রাণের অর্ধেশ্বরী। জ্ঞানের ও অজ্ঞানের সহযাত্রী।
নিশাচরী পক্ষিরা ওদের মাথার ওপর ছায়া ফেলে উড়ে গেল। টানা বারো মাস ভানুমতীদের সঙ্গে চন্দ্রভানের পুরো পরিবার জংলি জলাভূমি পারি দিতে দিতে বরেন্দ্রভূমিতে এসে কদিন বিশ্রাম নিচ্ছে। সঙ্গে দুটি ঘোড়া আছে, তারাও কদাচিৎ আওয়াজ করে। খানাখন্দে ভরা এই ভূমিতট, জোনাই নদীর জলের শীতল হাওয়ার জন্য বৃক্ষের পাতা যেন বেশি সবুজ। আর চারদিকে অসংখ্য কলার গাছ থাকায় হস্তী পরিবারবর্গ মনের মতো আহার করতে লেগে গেল। পালে আরো একজন হাতির পেটে সন্তান এসেছে। ভানুমতীর গর্ভেও মাস ছয়েকের সন্তান। কিন্তু পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে, কোথাও বিশ^াস করা যাচ্ছে না কাউকে। তার ওপর ভিনদেশি অমিতাভকে এই নব্য রাজ শাসনে কে আশ্রয় দেবে? লোকালয় থেকে দূরে দূরে থাকছে ওরা। সামান্য জ্বর এসেছে ভানুর। অমিতাভ আগুন জ্বালিয়ে সেই চৈনিক ভিক্ষুর দেওয়া তরল মশলা পানীয় প্রস্তুত করতে বসলো। খুব যত্ন করে রেখেছে সে মশলাদানিটি। টকটকে লাল হালকা মিশ্রণ। কে জানে কোন অঞ্চলের, কিন্তু খুব কাজে দেয় রোদে ক্লান্ত দেহে। তার বিদুষী বঁধুর সঙ্গে এই নিয়ে আলাপ করবে একদিন – মনে মনে ভাবলো সে। ভানুমতী ঘুমে আচ্ছন্ন। অমিতাভ চারদিকে দেখে এখানেই কুটির বানিয়ে বসতি গড়বে ভাবছে।
কোথাও অবশ্য শস্যক্ষেত নেই, বন্যজন্তু বলতে বরাহ আর মহিষ দেখেছে। কিন্তু আগুন আর হাতির দলের কাছে ভিড়বে না তারা। অন্ন বলতে সামান্য চাল আর কলা। জ্বরে পড়ার আগে ভানু অবশ্য খানাখন্দ থেকে কলমির লতা সংগ্রহ করেছিল। তাই একটু জলে সেদ্ধ দিলো অমিতাভ। ভানু চোখ মেলতেই গরম তরল খেতে দিলো। অচেনা ঘ্রাণ পেতেই জিজ্ঞাসা করলো পেটের দিকে তাকিয়ে – কোনো ক্ষতি হবে না তো।
অমিতাভ অভয় দিয়ে জানালো, না, খাও ক্লান্তি দূর হবে।
আগামীকাল ওকে খাদ্যের খোঁজে বেরুতেই হবে লোকালয়ের দিকে – সে-কথা জানাতেই ভয় দেখা দিলো ভানুর চোখে।
– তোমাকে চিনে ফেলবে, তোমার চোখ তুমি লুকাবে কোথায়! আমি বরং বেরুবো চন্দ্রভানের মাকে নিয়ে। তুমি কাঠের সন্ধান করো তার চাইতে। আমাদের একটা কুঁড়ে দরকার সামনে।
পরদিন সেই কথামতো ভানু বেরিয়ে পড়লো। পুঁটলির খাবার বলতে দুটি কলা। বসন্ত ঋতু চলছে। গাছে গাছে নানা কুসুমরাজি। কোকিলের ডাক। পেটে হাত রাখলো ভানু। খোকা বুঝি তার আষাঢ় মাসে জন্ম নেবে। মাঝেই মাঝেই পিতার জন্য সে কাঁদে। মহাবিহারের জন্য শোক করে। এদিকে কোথাও মঠের দেখা পেল না এ-কদিনে। মানুষের দেখা বলতে প্রায় সবাই মৎস্য শিকারে যাওয়া লোকজন। নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই চন্দ্রভানকে সঙ্গে নেয়নি, পরম যত্নে ওরা একটা দীঘল নলখাগড়ার বন পারি দিলো। দু-একটা স্বর্ণ গোধিকা দেখতে পেল।
‘সর্প ক্রূর, ক্রূর সর্পাৎ ক্রূরতর খল!’ মাথায় এলো ভানুর।
ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেয়নি সখী শুক্লাম্বরীর বর কী মহাখল এঁটেছিল মনে! সবই ভবিতব্য ভেবে মনে পাষাণ বেঁধে পথের দিকে মন দিলো। কিন্তু ওর শাস্ত্রজ্ঞান তো মানুষের জন্য, এভাবে কতদিন লোকচক্ষুর অন্তড়ালে থাকা যায় আর?
‘ব্যয়াতি বৃদ্ধিমায়াতি ক্ষয়মায়াতি চ সঞ্চায়াৎ!’
ভানুমতীর মন কত কী ভাবনায় ডুবে রইলো। পথে কোথাও ঘরবাড়ি নেই। সূর্য মাথার ওপর। সামান্য বুনো তরুলতা থেকে চেনা ফল নিল। আর এগোবে না, ফিরতি পথ ধরলো ওরা। চন্দ্রভানের মা শুঁড় তুলে মাঝেই খেয়ে নিচ্ছে। বিপদের পুরো সময় গোত্র ধরে যেভাবে ভানুমতীর পাশে দাঁড়িয়েছে তাতে মানুষের চাইতে ওদের বিচারবোধের জ্ঞান অপরিসীম। ভানু যখন পৌঁছালো বিকেল পেরিয়ে গেছে প্রায়। কিন্তু একি! অমিতাভ লুটিয়ে আছে, ওর বুকের পরে কে একজন বসে ছোরা চালাতে চাচ্ছে কিন্তু কৌশলে অমিতাভের সঙ্গে পারছে না। ভানুমতী আগের দিনের সেই ঝাঁজালো মশলাদানি থেকে মশলা ছিটিয়ে দিলো লোকটির মুখমণ্ডলে দ্রুততার সঙ্গে। মুহূর্তে ছোরা ফেলে চোখ ধরে চিৎকার করতে লাগলো সে। অমিতাভ উঠে বসে লোকটিকে আচ্ছামতো বাঁধলো। সে জল জল করে চেঁচামেচি শুরু করে দিলো। এদিকে দূরে আরো দুজন মরে পড়ে আছে। অমিতাভের ঘোড়াটিও মৃত পড়ে আছে। সব দেখে ভানুমতীর দিশেহারা অবস্থা!
এখন কী করবে ওরা এই জীবিত বন্দিকে নিয়ে। প্রাণটা ভিক্ষে চাইছে সে করজোড়ে। কিন্তু ভরসা করতে পারছে না অমিতাভ। অনাগত সন্তানের জন্যই সে লোকটিকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু মমতাময়ী ভানুর তাতে সায় নেই। সে তার শাস্ত্রের বিপরীত কিছুই করবে না। তার কাজ জীবের প্রাণ রক্ষা করা। নদীর জলে ভালোমতো লোকটির চক্ষু ধোয়ালো সে। আহারের ব্যবস্থা করলো ধীরে। দুজন মানুষ ও ঘোড়াকে সমাধিস্থ করল তিনজনে মিে মিশে। আকাশ ভেঙে জ্যোৎস্না নেমেছে চরাচরে। যেন কোথাও মৃত্যু নেই, প্রাণ সংহার নেই। ক্ষুধা নেই, নিদ্রা নেই। কেবল নিষ্পাপ চাঁদ তার মায়া আলো ফেলে বিশ্বমাতাকে প্রেমের আকুল বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। সাধারণ সৈন্য এরা সেন রাজার। এসেছিল জল খাওয়াতে ঘোড়াদের; কিন্তু বালক চন্দ্রভানকে দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। তাকে ধরা তো সহজকর্ম নয়। অমিতাভ কাঠ জোগাড় করে আসতেই বর্শা নিক্ষেপ করে একজন সৈন্য। তাতে ওর ঘোড়া মারা পড়ে। একটা অসম লড়াই ছিল বলা যায়। খান দুই বর্শা-তলোয়ারের সঙ্গে গোটা পরিবার প্রাণ দিয়ে রক্ষা করেছে তাদের পুত্রকে।
রাতের মায়াবী রূপ ধীরে অতীত হলো। সকালের রবি নদীবক্ষ থেকে উদয়রত। কিন্তু এ ভোর না হলেই বুঝি ভালো ছিল, বন্দি সৈন্যটি বাঁধন খুলে এসে ঘুমন্ত অমিতাভের গলায় কৌশলে ছোরা চালিয়ে দিয়েছে। আর ভানুমতীকে হত্যা করবে যেই মুহূর্তে, মা হাতিটি অমনি এসে শুঁড় পেঁচিয়ে শূন্যে তুলে ভূমিতে আছড়ে ফেলে পদদলিত করে ফেললো নিমিষে তাকে। হতবিহ্বল ভানু আকস্মিক ঘটনাটিতে বাকরহিতা হয়ে পড়ে রইলো। রক্তে ভেসে আছে তার জনমসখা অমিতাভ। পিতার নির্বাচিত পুরুষকে সে রক্ষা করতে পারলো না!
– এতো নীচ ছিল সৈন্যটি!
এই প্রথম মানুষের প্রতি প্রেম হারালো ভানু। অমিতাভের দেহটি সে জোনাল নদীতে ভাসিয়ে দিলো। রক্তে লাল হয়ে উঠলো সদ্য রবিস্নাত জলস্রোত। রক্তবর্ণ চোখে সে কেবল প্রতিজ্ঞা করলো, মানুষের লোভ থেকে দ্বেষ থেকে তার সন্তানকে রক্ষা করবে। গজ পরিবারটিকে নিয়ে ভানু নদীতে নেমে পড়লো যতদূর অমিতাভের দেহ ভেসে যাবে, ততদূর সেও সঙ্গী হবে। শোকে স্তব্ধ ভানুমতী চন্দ্রভানের মাতার পিঠে, বরেন্দ্রভূমিকে পেছনে ফেলে ওরা সাঁতরে এগিয়ে চলছে নাম-না-জানা অজানা কোনো ভবিষ্যতের পানে। যেখানে হত্যা নেই, ক্ষমতার চক্রান্ত নেই, নেই জ্ঞানের বিনাশ।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.