এক
শেষ পর্যন্ত গাঁয়ের মাতব্বর পাঁচজনের বৈঠকেও এই সাব্যস্ত হল বিয়েটা তা’হলে করেই ফেলুক আমিন, যা কেলেঙ্কারী হবার হয়েছে।
সর্দার গহর আলী মেম্বারও মাথা নেড়ে সায় দিল ওদের মতামতে – না কইরাই তা উপায়ডা কি কও। ছিঃ ছিঃ আমিন্যাডা যে এই রকম কাণ্ড করব বুঝছিলাম না।
আকবর আলী ডাবাটা মুখ থেকে নামিয়ে বল্লো, কিন্তুক তোমরা যে বিয়া বিয়া করতাছ, হের বাইয়ে ছাড়ছে নি বউ, ছোড বাইয়ে যে করব?
গহর আলী বল্লো – আর ছাড়াছাড়ি কি বাহি রইল। যে বউ আর একজনের লগে হুইত পারছে, তারে আবার ছাড়া আর ছাড়ি। আর ছাড়ান আনবাই বা কেমনে? হে তো আসাম গিয়া পইড়া রইছে আইজ তিন বছর – খোঁজও তো নেয় না। কিন্তুক যাই কও তোমরা, আমিনরা বাই দুইডা বড় বালা মানুষ। ঐ বউডাই খানকী। দেহ না শালী আইসমারে সব্বের লগে। যা হউক ক’দিন পরে তাইরে ছাইড়া গাঁয়ের বার করলেই অইব।
আমিন ঘরের এক কোণে বসেছিল মশার মত। দীর্ঘ কালো বলিষ্ঠ দেহটা কুঁকড়ে মাথা নীচু করে বসেছিল সে এতক্ষণ। এবার মশার মতই গুন গুন করে বলে উঠলো – এত কেলেঙ্কারী কইরা বিয়াই করতাম পারমু তাইলে ছাড়ুম কেন? ঐ কথা কইওনা গহর বাই। হেতাইর দোষ কি? দোষ সব আমার।
গহর আলী বড় বড় বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকাল। তুই কস কি আমিন্যা। পীরিতির চোডে কি লাজ-শরমও খুয়াইছস। তোর বালার লাইগাই এই বিচার করছি। বেশি যদি পডর পডর করছ তো দুইডারে মাতাত মাডা ডাইল্লা গাঁয়ের বার কইরাম। মাতা গরম করিছ না। একটা বদ মাইয়া লোক লইয়া বাইয়ে বাইয়ে গোলমালডা কি বালা অইব। করিম্নায় আইলে দুই বাইয়ে আবার বালা গরে বিয়া করিছ। আমি নিজে করাইয়া দিমু। এইডা দেখতেও সোন্দর শুনতেও সোন্দর অইব। অহন একটা কলমা পইড়া হেতাইরে জায়েজ কইরা লা।
আমিন গুন গুন ক’রে আবার কি যেন বলতে গেল। তার আগেই মাতব্বরেরা বল্লো – তাইলে আইজই কলমাডা অইয়া যাউক।
– অহন অইলে তো বালা। ঐ সোলমান মিয়াই তো বিয়া পড়াইতে পারব। কি কসরে আমিন্যা? – গহর আলী বল্লো। মাথা নেড়ে সায় দিল আমিন।
চৌকি ছেড়ে উঠে ভিতরের দিকের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গহর আলী ডাকলো – কৈ গো চাচী তোমার বউ-এরে আন।
ভেতর ঘর থেকে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে আমিনের মা বল্লো – আনি বাবা। কৈ লো শতেক-খাকী খানকী, বাইর অইয়া আয়।
মনের সমস্ত তিক্ততা ও বিষ ঝেড়ে বৌকে ডাকলো আমিনের মা।
আমিন বটগাছের গুঁড়ির মত বসে রইল স্থির হয়ে, কালো দেহটা আলকাতরা মাখা বেড়ার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে। গহর আলী জায়গায় এসে বসল। তামাকের গুড় গুড় ছাড়া সবাই চুপ। বেশ কিছুক্ষণ।
আমিনের মা বেড়ার ও-পাশ থেকে কথা ছুঁড়ে পাঠালো।
– ঐ শতেকখাকী আইয়ে না বাবা। কত কইরা কইলাম, কয়, ছাইড়াই যদি দিমু তয় বিয়ার ছং-এর কাম কি। আমি এইবার বাপের বাইত যাইমুগা।
ব্যঙ্গ কণ্ঠে বলে উঠলো গহর আলী – হের বুদ্ধি লইয়া আমাগো চলতে অইব নাহি। কতা হুন্লে গা জ¦লে। এইবায় গেলে আমাগো গাঁয়ের ইজ্জত থাকব?
চেংড়া গোছের মাতব্বর রহিম ভুঁইয়া হেসে বল্লে – যা আমিন তুই যা। তুই না গেলে আইত নারে। দু’জনে অজুও কইরা আইছ।
আমিন উঠল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে।
নিঃশ^াস ফেলে ঠোঁট বাঁকিয়ে ছমিন মিয়া বলে – আইজ কালকার পোলাপানগুলার লাজ-শরমও আল্লা দিছে না।
খুঁজে পেতে খিড়কীর দিকের খালের ঘাটে এসে জোহরার নাগাল গেল আমিন। খালের দিকে চেয়ে একলা পা ছড়িয়ে বসে আছে জোহরা। কাছে গিয়ে দাঁড়াল আমিন। বল্ল – বল, ওগো মার ডাহে যাইতাছ না কেন?
– না, যাইতাম না। এইডা কি খেইল পাইছ তোমরা? দৃঢ় কণ্ঠে বল্লো জোহরা।
আমিন আরও কাছ ঘেঁসে দাঁড়ালো তার। বল্লো – দোষ করছি তোমার কাছে, কিন্তুক তার প্রাইচিত্তও করতাম দিতা না আমারে? হেতারার কথা তুমি বিশ্বাস করতাছ। বিয়াডা অইয়া যাইক না তারপর দেহা যাইব আমার বউ আমি ছাড়ি না তারা ছাড়ে। এহন চল।
বড় বড় চোখ দু’টি তুলে আমিনের কালো মুখটা ছুঁলো জোহরা। নোনা পানিতে টলটল করে উঠলো সে-চোখ। সহসা আমিনের পা দু’টি জড়িয়ে কেঁদে উঠলো জোহরা – সত্যি কইতাছ, সত্যিই ছাড়তানা আমারে? তা অইলে চল।
আমিন টেনে তুললো তাকে। বল্লো – না জীবন গেলেও ছাড়তাম না তোমারে। দোষ যা করছি একবারই করছি, আরবার করতাম চাই না। ডরাইও না।
গভীর কৃতজ্ঞতা মাখা চোখ দু’টি মেলে আবার চাইলো জোহরা। বল্লো – কিন্তুক তোমার ভাই আইয়া যদি কোনদিন কয় ছাইড়া দিতা, তহন কি করবা?
আমিনের মুখ কঠিন হয়ে উঠলো – ধুৎতুরির বাই। হেতে বিয়া করছে আর একটা আসাম – নইলে আইজ এত বচ্ছরে একটা খোঁজও ত নিল না তোমার। আমার বউ মানষের কতায় ছাড়ুম এত বেকুব ঠাওরাইও না আমারে।
তবুও জোহরা তার ফ্যাকাসে হাতটা প্রসারিত করে দিল আমিনের দিকে – আমারে ছুঁইয়া কও – ছাড়তা না, তা নইলে বিয়ার কাম নাই।
আমিন কিছুটা বিরক্ত হয়ে বল্লো – এই ছুইয়াই কইতাছি। অহন চল।
দুই
বিয়ে হয়ে গেল আমিন আর জোহরার। গাঁয়ের মেয়েরা প্রদর্শনীর মত দেখতে আসে জোহরাকে। এত সুন্দর মেয়েটা কি কেলেঙ্কারীটাই করল। স্বামী থাকতেও দেবরের সঙ্গে কেলেঙ্কারী করে বিয়া। ছিঃ ছিঃ। জোহরা চুপ করে থাকে। স্থির হ’য়ে থাকে ছবির মত। কিছু বলবার নেই। বলবার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। মেয়েরা ফুস্ ফুস্ গুজ্ গুজ্ করে তাকে শুনিয়েই। কেউ কেউ সামনে আসে, বক্রদৃষ্টিতে চেয়ে দেখে দেহের দিকে – কয় মাস গো বাউজ? আট মাস বুঝি? বিয়া তো অইল তিন মাস। হেসে তার সামনেই কুটি কুটি হয় ওরা। পাথরের চোখ দিয়ে চেয়ে থাকে জোহরা।
আমিনেরও তাই। যেখানে যায় একই প্রসঙ্গ ওকে অস্থির করে। বিব্রত হয়ে ওঠে সে, লজ্জিত হয়। মাঝে মাঝে ক্ষেপে আগুন হয়। ছেলেরা টিট্কারী দেয় – সুর দিয়ে ওর প্রসঙ্গ নিয়ে গান গেয়ে ওঠে। ভাল মানুষের মত মুখ করে কাছে এসে শুধায় – কেমন আছ আমিন বাই? বাউজ লইয়া ঘর করতে কেমন লাগতাছে? পোলা অইছে নি? ইত্যাদি। আমিন ক্ষেপে যায়। কালো দেহের ভেতর উষ্ণ লাল রক্ত টগবগ করে মাথায় ওঠে। চিৎকার করে – হারামজাদারা…।
বাড়ী ফেরে দ্রুত পায়ে। ছেঁড়া-কাঁথা বিছানো শয্যায় শুয়ে পড়ে অসহায়ের মত। এ-পাশ ও-পাশ করে নিষ্ফল আক্রোশে। কিন্তু কার উপরে সে নিজেই বোঝে না।
চৌকাঠের উপর বসে-থাকা জোহরা উঠে আসে স্বামীর কাছে। রক্তহীন ফ্যাকাসে মুখে শুধায় – কি অইছে, এই রহম করতাছ কেন?
আমিন মনের সমস্ত জমাট বাঁধা আক্রোশ ঝেড়ে দেয় তার উপরই – দূর হ হারামজাদী। জ¦ালাইস না আর। হাত দিয়ে ঠেলে দেয় জোহরার হাত।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে খালের পাড়ে আমগাছটার তলায় বসে জোহরা। সন্ধ্যা বেলায় গাছতলায় আসতে নেই – এই সময় জ¦ীন পরীর কুদৃষ্টি পড়ে, একথা ছেলেবেলা থেকেই জানে জোহরা। কিন্তু উঠে ঘরে যেতে কিছুতেই ইচ্ছে করে না ওর। রুক্ষু চুলগুলি হাত দিয়ে জড়িয়ে বাঁধে জোহরা। মলিন ডুরে শাড়ীর আঁচলটা মাথায় তুলে দেয়। মনে মনে ‘আয়তুল কুরসী’ পড়ে বুকে পেটে ফুঁ দেয় জোহরা। তারপর বসে থাকে স্থির হয়ে। শরতের সন্ধ্যা। খালটা কুলে কুলে ভরা। মৃদু বাতাসে ঢেউ উঠছে ছোট ছোট। খালটাকে সব সময় আপন মনে হয় জোহরার। এই খাল বেয়েই বাপের বাড়ীর দেশ ছেড়ে তিন বছর আগে এই দেশে এসেছে জোহরা। এর মাঝে একবার মাত্র গিয়েছিল বাপের বাড়ী, তারপর যাওয়া হয়ে ওঠে নি। হয়ত আর জীবনেও যাওয়া হবে না। ক’দিন আগে বাবা এসেছিল। সমস্ত কাণ্ড শুনে আগুন হয়ে চলে গেছে। যাবার আগে বলে গেছে – আমার মাইয়া মইরা গেছে মনে করুম। তোর মুখ আর দেখতাম চাই না হারামজাদী। কচু গাছে ফাঁসি দিয়া মর। আমার বংশের কলঙ্ক, দেশের কলঙ্ক ছিঃ ছিঃ ছিঃ।
কিছু বলে নি জোহরা। কাঁদেও নি। বাপের পিছু পিছু খালের ঘাটে এসে এই আমগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে চেয়েছিল নিষ্পলক। শাশুড়ী বলে বেশরম, আর তা না অইলে বেকুফ, এত কিছুতেই রা করে না। পাড়া প্রতিবেশী ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে – আসলে হেতাই খানকী। এমনকি আমিনও বলে – তোমার সহ্যি গুণ আছে। কেমনে এত কতা হুন মাইনষ্যের আমার ত মাথায় রক্ত উট্টা যায় চন্ চন্ কইরা। তবুও জোহরা চুপ করে থাকে। কি বলবে সে? বলবার মত মুখ কোথায়। আর বললেই কি বিশ্বাস করবে কেউ? ভাল কি হতে পারবে ওদের চোখে? আমিনকেও দোষ দেয় না জোহরা। আমিন দিনে দিনে কাছে এসেছে। বৃদ্ধা শাশুড়ী বোঝে নি কিছু; কিন্তু জোহরার গা ছমছম করেছে। আমিনের চোখের দৃষ্টি, মুখের হাসিকে ভয় করেছে জোহরা – কিন্তু কেমন এক অনাস্বাদিত ভালও লেগেছে – আর সে ভাল লাগার সুতো বেয়ে আমিন তার বুকের ভেতর এসে আসন নিয়েছে। স্বামী কাছে থাকলে এমনটি হত না হয়ত – কিন্তু ঘোমটা তুলে তার মুখটুকু দেখবার আগেই তো সে পালিয়েছে। থাক গে এ-সব ভেবে কি হবে। আমিনই তো তার স্বামী। কিন্তু আমিনের কথাও আর ভাবে না জোহরা। সমস্তক্ষণ এক অনাগত অবাঞ্ছিত জীবনের পদধ্বনি শোনে কান পেতে। এরই জন্যে এত। একে সরাবার জন্য কত চেষ্টা শাশুড়ীর। শাশুড়ী বলেছিল – কাক পক্ষীও টের পাইত না। একটা অসুধ আইন্না দেই – খাইয়ালা। আপদ পইড়া যাউক পাঁচ কান অওনের আগে।
আমিন পায়ে পর্যন্ত ধরেছে ওর – দুনিয়াত আইয়া লাবডা কী অর। তার চেয়ে অওনের আগে মাইরালাওইন বাল। কিন্তু শত অত্যাচারেও রাজী হয় নি জোহরা। আমিনের জন্যে, শাশুড়ীর জন্যে, সমাজের জন্যে এই অনাগত শিশু হয়ত পাপ হতে পারে; কিন্তু জোহরার যে সে সন্তান, জোহরার রক্তের বিন্দু। সমস্ত পাপ-পুণ্যের ঊর্ধ্বে তার সঙ্গে জোহরার সম্পর্ক। কেমন ক’রে এত নিষ্ঠুর হবে জোহরা। না কিছুতেই না। তাই শেষ পর্যন্ত পাঁচ কান হল – পঞ্চায়েত বসল, বিয়ে হল। এখন নিশ্চিন্ত জোহরা – শান্ত।
শুকনো পাতার মচমচ শব্দ শুনে চমকে উঠল জোহরা। পেছন ফিরে দেখলো আমিন আসছে। এতক্ষণে খেয়াল হলো জোহরার বেশ রাত হয়েছে। আকাশে সাদা মেঘের ফাঁকে চাঁদ উঠে এসেছে অনেক দূর।
আমিন কাছে এসে মোলায়েম কণ্ঠে বল্লে – গোসা করছ? হাঁজের বেলা এমন নিরালা জাগাত আয়ে নি মাইনষ্যে এমন শরীল লইয়া? তোমার এত গোসা কের লাইগ্যা কও দেহি? মেজাজডা বালা আছিল না হাছা – চলো গরে চলো।
উঠে দাঁড়িয়ে জোহরা বল্লো – না গোসা কইরাম কেরে। এমনে বইয়া আছিলাম ঠান্ডা জাগাডাত।
– চলো বুক লাগছে।
দু’জনে উঠে এলো রান্না ঘরে। জোহরা পিঁড়ি পেতে শাশুড়ীকে ডাকল।
তিন
দ্বিতীয়বার শেয়াল ডাকল পাটক্ষেতে। ঘরের পেছনে তেঁতুল গাছটায় পেঁচা ডেকে উঠল গম্ভীর স্বরে। জোহরা উঠে বসলো। ব্যথায় মুচড়ে উঠছে তার সর্বাঙ্গ। অসহ্য যন্ত্রণা মাঝে মাঝে চেপে ধরছে তার পা দুটো। ঝাপ খুলে কয়েকবার ঘর-বার হল জোহরা। নাঃ আর সহ্য হচ্ছে না। আমিনকে ডাকতে হয়। কিন্তু কেমন এক লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে উঠছে জোহরা। কি শান্ত ঘুম দিয়েছে বেচারী। ঘুমটা ভেঙ্গে দিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। উঃ আবার যন্ত্রণা। অস্ফুট কুঁকিয়ে উঠল জোহরা। ব্যথাটা কিছু কমতেই বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। হাত দিয়ে ঠেলে দিল আমিনের নগ্ন পিঠ। ধড়মড় করে উঠে বসল আমিন। ভাঙ্গা চৌকিটা শব্দ করে উঠল কাচ কাচ। ঘুমভাঙ্গা লাল চোখ দুটি মেলে জিজ্ঞাসা করল – কি অইল, হুইতাছ না। আইজ?
– লজ্জিত কণ্ঠে জোহরা বল্লে – বড় বেদনা অইতাছে, মায়েরে ডাক দেও। ব্যথায় আবার ছটফট করে উঠল সে।
লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামল আমিন। সহস্র ভাবনা কিলবিল করে উঠল অসংখ্য পোকার মত ওর মাথার মধ্যে। কি করা যায়? কি করা যায়?
পরশুদিন ডেকে নিয়ে ছিল তাকে গহর আলী। বলেছে বাচ্চাটাকে যেন সরিয়ে ফেলা হয়। আমিন চমকে উঠেছিল প্রথমে – না গহর বাই, বিয়া যদি না হইত তাহলে না হয় করতাম; কিন্তুক বিয়া তো অইয়াই গেছে অহন একটা জান মাইরা লাভ কি?
শান্ত গলায় গহর আলী বলেছে, আমিন তোর বুদ্ধি লইয়া যদি চলতাম তাইলে সর্দার অইতাম পারতাম না। বহুত দেকলাম। বিয়া অইলেও ঐডা পাপই। বিয়ার আগেই অইছে। তাছাড়া যেইডা অইব হেইডার বাইচ্চা থাইক্কা লাভডা কি? যহন সমাজের সক্কলে আঙুল দিয়া দেহাইয়া কইব – ‘ঐ হেতে বেজন্মা।’ হেইডা কি বালা অইব? তোর কি হে সময় মাতা উঁচা অইব। তোর তো আরও বহুত বাকী জীবনের। সমাজ লইয়া চলন তো লাগবো। আমার কতাডা হোন। তোরে আদর করি দেইখ্যাই এইডা কইতাছি। এতে কোন পাপ অইত না। কিন্তুক চুপে চুপে করিস কেউ যেন না জানতে পারে – নইলে তো আবার… বুজ্জছ না?
কিছু আর বলেনি আমিন। এই দু’দিন বিস্তর ভেবেছে। গহর আলী অন্যায় বলেনি কিছু। তখন ছোট হলেও বেশ মনে আছে তার, করিমনের পিতৃ-পরিচয়হীন ছেলেটাকে শেষ পর্যন্ত গলায় দড়ি দিতে হয়েছিল সমবয়সীদের তাচ্ছিল্যের যন্ত্রণায় – সমাজের সব জায়গা থেকে আঘাত খেয়ে খেয়ে। তাই যদি হয় শেষ পর্যন্ত তবে এখন মেরে ফেলাই সঙ্গত নয় কি? তাছাড়া তাকেও তো সমাজে চলতে হবে, বিয়ে নিয়েই মুখ দেখাতে পারছে না – তারপরে…। ভাবতে পারেনি আর আমিন। মাথার শিরাগুলো দপ দপ করে উঠেছে অব্যক্ত যন্ত্রণায়। যদি গাঁয়ে থাকতে হয়, যদি সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে হয় তবে এ-কাঁটাকে কিছুতেই বাড়তে দেওয়া যাবে না। তাছাড়া গহর আলীর কথা না শুনলে সে কি ছাড়বে ওকে? গহর আলীর ক্ষেত বর্গা চষেই তো এই তিনটি প্রাণী জীবন ধারণ করছে। যদি আগামীতে জমি না দেয় গহর আলী? আমিন অনেক ভেবেছে। ভেবে ভেবে একমাত্র এই পথই দেখেছে – জোহরাকে কিছু বলেনি। জানে, বললে কাজ হবে না। নিষ্ঠুর হতে হবে তাকে। মা’কে বলে বুঝিয়ে রেখেছে। মা রাজী হয়েছে। আর আল্লার মেহেরবাণী বলতে হবে। ব্যথাটা উঠেছে রাতেই। মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠল আমিন। নিষ্পলক চেয়ে রইল কিছুক্ষণ জোহরার মুখের দিকে। অসহ্য যন্ত্রণায় বার বার কুঁকড়ে উঠতে লাগলো জোহরা। ক্ষীণ কণ্ঠে বল্লো – কৈ যাও না। মায়েরে ডাইক্কা আন।
– হ্যাঁ যাই। ঝাঁপ ঠেলে মাতালের মতন বেরিয়ে এলো আমিন। রান্না ঘর থেকে মাকে ডেকে নিয়ে নিঃশব্দে উঠানে নেমে এল আবার দু’জনে। আমিনের পেশীতে পেশীতে এসেছে কাঠিন্য। চেহারাটা হয়ে উঠেছে হিংস্র জানোয়ারের মত উদ্ভ্রান্ত কিন্তু দৃঢ়তায় তীক্ষ্ণ। মা চমকে উঠল ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে – না হয় থাউকরে আমিন, যা অয় অইব। ভয়ে ভয়ে বল্ল মা।
দৃঢ়কণ্ঠে আমিন বল্লো – না।
মা কাঁপা কাঁপা স্বরে বল্লে – ঘরে অইব নাকি?
– না, এখান থাইকা চিল্লাচিল্লি হুনা যাইত্ পারে ঐ সরদার বাড়ী পর্যন্ত। পিছ দুয়ারের আম বাগানে চল। আমি অরে ডাইকা আনি।
দৃঢ় পদক্ষেপে ঘরে এল আমিন। জোহরা তখন অসহ্য যন্ত্রণায় মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। আমিনের জ¦লজ¦লে চোখের দিকে তাকিয়ে এত যন্ত্রণার মাঝেও আতংকিত হয়ে উঠল সে। কুঁকিয়ে কুঁকিয়ে বল্লে – কৈ মারে আনলা না? আর তো সয় না।
– তুমি চল। বল্লে আমিন।
– কোন্ হানে? আর্তনাদের মত বল্লো জোহরা। ফিস ফিস ক’রে আমিন বল্লে – আস্তে। রা কইর না ওডো।
জোহরার দু’চোখের অশ্রু মাটিতে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা। ভিজে গেল মৃত্তিকার কঠিন বুক। তবুও আমিন স্থির। ইস্পাতের মত কঠিন তার কণ্ঠস্বর। কৈ ওডো। আরো কয়েক ফোঁটা অশ্রু মাটিকে উপহার দিল জোহরা।
বুজানো কণ্ঠে বল্লো – আমি যে উঠতাম পারতাছি না গো।
– চুপ, আমি নিতাছি।
কঠিন লোহার মত কালো হাত দুটি প্রসারিত করে জবাই করা মুরগীর মত নরম ছটফটে জোহরাকে বুকে তুলে নিল আমিন। জোহরা ক্ষীণ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল – আমারে কৈ নিতাছ গো। ওঃ মাগো।
– এই চুপ। গলা টিপ্যা ধরুম তাঐলে।
চাপা কণ্ঠে ধমকে উঠল আমিন। চিৎকার করবার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেল্লো জোহরা। তার অসহ্য যন্ত্রণার নদী দুচোখ বেয়ে গলে গলে আমিনের কালো লোমশ বুক ভিজে যেতে লাগল। ভেজা বুকের তলায় হৃদপিণ্ডটাও দুলে উঠল আমিনের। হাতগুলো কেঁপে উঠল থর থর ক’রে। আরও জোরে চেপে ধরলো সে জোহরাকে। কিন্তু নয়, দুর্বল হলে হবে না। তার ভবিষ্যৎ তার ইজ্জত অন্য সব নির্ভর করছে ঐ নিষ্ঠুরতার ভিত্তির উপর। নিজেকে সংযত করল আমিন। দৃঢ় প্রত্যয় ফুটে উঠল তার চোখে মুখে। শুকনো পাতার মচ্মচ্ শব্দ তুলে আম বাগানে একটা গাছের তলায় জোহরাকে শুইয়ে দিল সে।
সমস্ত দেহ বার বার অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছে জোহরার। কথা বলবার বা কি হচ্ছে, কি হলো ভাববার ক্ষমতা নেই – শুধু দুঃসহ যন্ত্রণা শুধু মনে হচ্ছে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরা। তবু সে নিস্তেজ গলায় চেঁচিয়ে উঠলো – উঃ মা গো। মইরা গেলাম গো। মাইরালাইলো গো।
কোমর থেকে গামছাটা খুলে মাকে এগিয়ে দিল আমিন। বল্লো – মুখটা বাইন্দা দাও মা। চিল্লাইতাছে।
– তুই বান্দ।
নিঃশব্দে তার মুখটা বেঁধে দিল আমিন। এতটুকু প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারলো না জোহরা।
টলে টলে চলতে চলতে আমিন বল্লে – আমি ঐ দিকে যাইতাছি না, সময় অইলে আমারে ডাইক্ক। এলোমেলো পদক্ষেপে হেঁটে কিছু দূরের অন্ধকার গাবগাছটার তলায় এসে দাঁড়ালো আমিন। সমস্ত দেহ ঘামে ভিজে গেছে। বড্ড অবসন্ন মনে হচ্ছে নিজেকে। নিষ্ঠুর জ¦লজ¦লে চোখ দুটো বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল সহসা। জোহরার ফ্যাকাশে মুখটা সে অশ্রুর মাঝে ছায়ার মত দুলে উঠল। কিন্তু দুর্বল হতে চায় না আমিন। কিছুতেই না। এতদূর এসে শেষ মুহূর্তে দুর্বল হলে ভেস্তে যাবে সমস্ত পরিকল্পনা। এতক্ষণে মনে পড়লো আমিনের, গতকাল সলিল মাঝির কাছে থেকে কিছুটা তাড়ি চেয়ে এনেছিল এমনি মুহূর্তে খাবে বলে। ধানের ডোলে ধানের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল বোতলটা।
দৌড়ে ঘরে এল আমিন। অন্ধকারেই হাতড়ে বের করলো সেটা। ছিপি খুলে মুখেই উপুড় করে দিল বোতলটা। গলাটা জ্বালা করে উঠলো, মাথাটা দপ্ দপ্ করে উঠলো। দৌড়ে আবার গাবগাছটার তলায় এসে দাঁড়ালো আমিন। ক্ষীণ একটা শব্দ উঠলো আর গাছের তলায় ওঁয়া ওঁয়া ওঁয়া। আমিন টলতে টলতে আবার ছুটলো।
চার
ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলো জোহরা। কিন্তু মনটা যেন প্রচণ্ড ঝড়ের পরে খড়ের ঘরের মত হয়ে গেছে ওর। চুপচাপ থাকতেই ভালবাসে। আমিনকে দেখলেই একটা নাম-না-জানা ঘৃণ্য অনুভূতি শিরশির করে ওঠে ওর মনে। মুখ ফিরিয়ে থাকে। ডাকলে সাড়া দেয় না। আমিন বোঝায়। আদ্যোপান্ত পরিষ্কার ক’রে বলে ওকে, তথাপি জোহরা স্থির। কুঞ্চিত ওর দৃষ্টি। আমিনের রক্ত উষ্ণ হয়ে ওঠে। রাগ ক’রে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে – মাইয়্যা লোকের এত দেমাক বালো না। পায়ের জোতা লাগলে পায়ে দিমু না লাগলে হালাইয়া দিমু তার আবার অত দেমাক। ছিঃ।
দিনে দিনে আমিনের চব্বিশ বছরের মূর্খরক্ত উষ্ণ হতে উষ্ণতর হয়ে ওঠে জোহরার অনমনীয় ব্যবহারে। তবু জোহরা অটল, ভাবলেশহীন ওর মুখ। কেবল মাঝে মাঝে অশ্রু ছলছল কণ্ঠে বলে – আমি কি দোষ করছি গো। আমারে কিয়ের লাইগ্যা একটু থির থাকতাম দেও না।
আমিন বিকৃত কণ্ঠে ধমকে ওঠে – অরে আমার রাজ কইন্যারে, অইডা চলত না কইতাছি। তারপর আবার মিষ্টি করে বোঝায় – কি ভূতে তোমারে পাইছে কও দেহি! তোমার লাইগ্যা বাই ছাড়লাম, বান্দব ছাড়লাম, ইজ্জত ছাড়লাম আর তুমি আমারে পাত্তা দিতাছ না। এ-ও কি মাইনষ্যের সয়? করুণ হয়ে ওঠে আমিনের মুখ। তবুও জোহরা বলতে পারে না – আমি তো তোমার গো। শুধু তার মুখের দিকে তাকিয়ে জোহরার 888sport sign up bonusর আয়নায় ভেসে ওঠে আমিনের সে-দিনের হিংস্র প্রতিচ্ছায়া। সেই জ¦লজ¦লে চোখ। থমকে যায় জোহরা। বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। অব্যক্ত একটা ঘৃণ্য যন্ত্রণার ঢেউ এসে আচ্ছন্ন করে ওকে, চোখ ফিরিয়ে নেয় জোহরা।
আমিন উঠে এসে ওর কাছে বসে। দু’হাতে জড়িয়ে ধরতে চায় ওকে। চমকে ওঠে জোহরা। ক্ষীণ পাণ্ডুবর্ণ দেহটা কেঁপে ওঠে শুকনো পাতার মত। ছুটে সরে যায় সে। – আমারে ধইরো না গো – তোমার পা ধরি, আমারে ঐ আত দিয়া ছুঁইও না।
আবেগে প্রসারিত হাত দু’টি শিথিল হয়ে যায় আমিনের। আবেগের বদলে সে হাত হয়ে ওঠে লৌহকঠিন। গোঁয়ার স্বামিত্বের অপমানে রাগে জ্ঞান হারালো আমিন। ছুটে গেল সে জোহরার কাছে। দু’হাতে চেপে ধরলো তার চুলের মুঠি। লাথির পর লাথি দিয়ে থেতলে দিল ওর দুর্বল দেহ। চিৎকার করে বল্লো – তোরে তালাক দিলাম হারামজাদী, এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক।
তারপর ওকে পায়ে ঠেলে দিয়ে ভাঙ্গা চৌকিতে শব্দ তুলে ছেড়া কাঁথায় মুখ গুঁজে অসহায়ের মত ভেঙ্গে পড়ল আমিন। দু’চোখ নোনা পানিতে ভিজে উঠল তার।
কান্নাহীন চোখে টল্তে টল্তে জোহরা বাইরে যাচ্ছে দেখতে পেল সে; কিন্তু জমাট-বাঁধা অভিমান তাকে উঠতে দিল না। উত্তেজনার পরে ক্লান্তির ভারে আস্তে আস্তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো আমিন, নিজেও বুঝতে পারলো না।
ঘুম ভাঙলো মায়ের চিৎকারে। ভোর হয়ে গেছে তখন। লাফিয়ে উঠল আমিন। গত রাত্রের সমস্ত ছবিটা মনে পড়তেই শঙ্কিত হয়ে ছুটে বাইরে এল সে। ব্যাকুল কণ্ঠে মাকে শুধালো – তোর কি অইছে। চিল্লাইতাচ কেন?
মা চিৎকার করে উঠল – বাবারে খালের পাড়ে…। কথা শেষ না ক’রে আবার চেঁচিয়ে উঠল বুড়ি। সবটুকু শুনবার ধৈর্য তখন আমিনের নেই। লুঙ্গিটা কোমরে জড়াতে জড়াতে খালের পাড়ে দৌড়লো সে। কিছু দূর গিয়ে আম গাছের ডালে দৃষ্টি পড়তেই থমকে দাঁড়ালো আমিন। অস্থিরতা কেটে গেল তার। শূন্য দৃষ্টি মেলে ধীর পদক্ষেপে এসে দাঁড়ালো জোহরার ঝুলন্ত দেহটার কাছে। পা দু’টো ছুঁলো দু’হাতে। ঠান্ডা বরফ। তাকালো জোহরার মুখের দিকে। চোখ দু’টো ঈষৎ ঘোলা, অশ্রুর রেখা তখনও গালে। কপালে একটা শুকনো রক্তের ধারা লেপটে আছে। কাল চৌকাঠে খুব লেগেছিল বোধ হয়। বুকটা ভেঙ্গে যেতে লাগলো। হৃৎপিণ্ডের স্নায়ুগুলো যেন ছিঁড়ে যেতে লাগলো আমিনের।
ততক্ষণে গাঁয়ের অনেক লোকে ভিড় জমিয়েছে। মন্তব্য হচ্ছে নানা রকম – আহা রে, পাপে পাপেই গেল তাইর জীবন। মরাও কু-মরনি।
গহর আলী এসে দাঁড়ালো আমিনের পাশে। ওকে বল্লো – ছুঁইছ না অরে। বউ মরলে স্বামী ছোওন হারাম। সর তুই। আমরা নামাই।
নিঃশব্দে সরে গেল আমিন। ৎ
[এই গল্পটি জাহানার হাকিমের ঝুমুর মহল গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। গ্রন্থটি ১৯৬৯ সালে প্রকাশ করে সমকাল প্রকাশনী। বিস্মৃতপ্রায় কথা888sport live footballিক জাহানারা হাকিমের গল্পের সঙ্গে পাঠকদের পরিচিত করানোর উদ্দেশ্যে গল্পটি কালি ও কলম-এ পুনর্মুদ্রণ করা হলো।]


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.