নোয়াখালি : ১৯৪৬
সুহাসিনী দাস
888sport live football প্রকাশ
888sport app, ২০০৪
দাম : ৮০ টাকা
সব থেকে অন্ধকার নেমে এল সেদিন দুপুরে।
আকাশে দাউদাউ সূর্য যথাশক্তি আলো ছড়াচ্ছিল,
মেঘের ইশারা কিছু ছিল নাকো আবহবার্তায়।
কিন্তু শোনা গেল ফের দাঙ্গা শুরু হয়েছে প্রবল।
– অরুণকুমার সরকার
সুহাসিনী দাসের নোয়াখালি : ১৯৪৬ দাঙ্গার ইতিহাস নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক কোনো বই নয়। কোনো ধরনের পাণ্ডিত্যপূর্ণ বাগবিস্তারের ধারপাশ দিয়েই যায়নি বইটি। এই বই পড়া শুরু করলে সুগভীর এক আর্তিতে, এক দিগন্তবিস্তৃত করুণায় বারবার কেঁপে ওঠে হাত। ইতিহাসের জানালার দিকে ঢুকে পড়া হাওয়ায় ফরফর করে খুলতে থাকে তিন মাসে একটানা লিখে-চলা এই দিনপঞ্জিটির পাতা। ১৯৪৬-এর ২৩ ডিসেম্বর শুরু হয়ে ২৭ মার্চ ১৯৪৭-এ সমাপ্তি। পাতা ওলটাতে ওলটাতে কেবলই দেখা হয় ‘মানুষ’ পরিচয়ের পরিবেশটি দুর্বৃত্তদের হাতে কী অমানুষিকভাবে বিনষ্ট হয়েছে – যে ক্ষতির ক্ষত সহজে সারবার নয়। তবু দিন যায়, কথা থাকে; মানুষ যায়, নাম থাকে; আর ক্ষত শুকায়, দাগ থাকে। নোয়াখালি : ১৯৪৬ সেই শুকনো ক্ষতের দাগওয়ালা বই। দিনের কথা, মানুষের নাম আর ক্ষতের দাগ – এই তিনের সহজ মিশেল ঘটেছে এই বইটিতে। আশ্চর্য করুণাকাতর এক মিশ্রণ। এত সহজ, আর সহজই তো হবে। আপাতভাবে যাকে মনে হবে স্রেফ একটি দিনপঞ্জি।
নোয়াখালিতে ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মনে স্বস্তি,
শান্তি, নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে গান্ধীজিকে আসতে হয়েছিল। এসেছিলেন বিভিন্ন স্থান থেকে আরো অনেক সমাজকর্মী।
এমনি একজন সমাজকর্মী হিসেবে সিলেটের সুহাসিনী দাস নোয়াখালিতে এসেছিলেন। দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকার উদ্দেশে গান্ধীজি সফর শুরু করতে ৭ নভেম্বর পৌঁছান চৌমুহনীতে। সেদিন থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের ২ মার্চ পর্যন্ত প্রায় চারমাস তিনি নোয়াখালিতে কাজ করেছিলেন। কাদাপানি অগ্রাহ্য করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে বেড়িয়েছিলেন। গ্রামের পর গ্রাম হেঁটেছেন শান্তির অন্বেষায়। গান্ধীর সাথে এসেছিলেন সেই সময়ের আরো অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আভা গান্ধী থেকে জওহরলাল নেহেরু পর্যন্ত আরো অনেকে। বোঝাই যাচ্ছে এই সময়ে স্থানীয়, অস্থানীয় কংগ্রেসের নেতাকর্মীরা বিপুলভাবে তৎপর হবেন, হয়েও ছিলেন তাই। তবে কংগ্রেস ছাড়াও আজাদ হিন্দ্ ফৌজ, ভারত সেবা সংঘ, হিন্দু মহাসভা, আর্য সমাজ, গীতা প্রেস সংঘ, কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে বহু ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল, যেখান থেকে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নিঃস্বার্থ মানবিক কাজ চলেছিল।
প্রায় দুই সপ্তাহের দাঙ্গা, কিন্তু এর প্রাথমিক ক্ষত শুকাতে সময় লেগেছিল তিন মাস। আর তিন মাসে নোয়াখালিতে সেবা-কর্মকাণ্ডের প্রতিদিনের কথা লিখে রেখেছিলেন সুহাসিনী দাস। নোয়াখালির বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, জোরপূর্বক বিয়ে, ধর্মান্তরিতকরণের অনেক কথা বলতে গিয়ে সুহাসিনী দাস এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করেছেন
‘দুর্বৃত্ত’ বলে। দিনপঞ্জির সর্বত্র দাঙ্গাকারীদের বিশেষণ এ-ই। অথচ সবার জানা, দাঙ্গা করেছিল একদল জঙ্গি উগ্রবাদী মুসলিম নামধারী ব্যক্তি। কিন্তু আদতে এরা তো মুসলিম নামের যোগ্য নয়। এরা কোনো ধর্মের, জাতির, বর্ণের, গোত্রের নয়। এদের পরিচয় একটাই, এরা ‘দুর্বৃত্ত’। সুহাসিনী দাস পুরানো বানানরীতিতে লিখেছেন ‘দুর্ব্বৃত্ত’। একই সঙ্গে লক্ষণীয় যে, একদিকে দুর্বৃত্তের আক্রমণ যখন হচ্ছে, এই সময় যদি কোনো মুসলমানের সহযোগিতায় কোনো হিন্দু ব্যক্তির প্রাণে রক্ষা কী ধনসম্পত্তি রক্ষা পাচ্ছে, সেখানে তিনি তাকে মুসলমান বলেই উল্লেখ করছেন। যেমন তিনি লিখেছেন, “মান্দারতলী বলে একটি গ্রামে ‘সিংহ-বাড়ি’ বলে একটি বড় বাড়ি ছিল। বাড়িতে অনেক পরিবার ছিল। প্রায় ৪৬/৪৭ খানা পাকা ঘর-দালান এই বাড়িতে ছিল – সব শেষ হইয়াছে। বাড়িটি বিকাল বেলা প্রায় হাজার লোক আক্রমণ করে। ননী সিংহ নামে একটি ছেলে তাহার বাড়ির যুবতী মেয়েদের নিয়া বাড়ির পিছন দিকে একখানি ছোট দালানে ঢুকিয়া পড়ে। দুর্ব্বৃত্তরা মেয়েদের খোঁজিয়া সেই দালানে ঢুকিতে চায়। তখন ননী সিংহ একখানা রামদার সাহায্যে ইহাদের বাধা দিতে থাকেন। একটিমাত্র দরজার মুখে ননীবাবু দাঁড়াইয়াছিলেন। পরপর পাঁচটি লোককে সে রামদা দিয়ে ভীষণভাবে কুপ দেয়, একটি লোকের গলা প্রায় আগলিয়া (বিচ্ছিন্ন হইয়া) যায় – তখন এতবড় জনতা পালাইয়া যায় – ধনসম্পত্তি কিছুই নেয় নাই। রাত্রে একজন মুসলমান লোকের সাহায্যে তাহারা শুধু প্রাণ নিয়া পলায়ন করে। লোকটি তাহার নিজের নৌকা দিয়া তাহাদের চাঁদপুর পৌঁছাইয়া দেয় এবং বাড়ির সামান্য কিছু জিনিসও তাহার নিজের বাড়িতে রাখিয়াছিল। লোকটির সঙ্গে আমরা দেখা করিয়াছিলাম। পরদিন ভোরে প্রায় ৪/৫ হাজার লোক আসে এবং বাড়ি ধ্বংস করিয়া দেয়।” (পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫)
সুহাসিনী এই দিনপঞ্জিতে বলতে গেলে দুটি ভূমিকা লিখেছেন। প্রথম ভূমিকা ‘আমার নোয়াখালির ডায়েরি’ শিরোনামে। তিনি কলকাতার দাঙ্গার সূত্র ধরে ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য আদতে সবাইকে দায়ী করেছেন; লিখেছেন, ‘দানবশক্তির দ্বারা সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক ঘটনার গভীরে যে (ব্রিটিশের) ম্যারপ্যাঁচ ছিল তাহাও বুঝিয়াছিলাম। পরে বুঝিয়াছিলাম কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মকাণ্ড ছিল বহুলাংশে ধর্মভিত্তিক। উপরের নেতাকর্মীদের অনেকেই চেতনে-অবচেতনে ধর্মের ব্যবহার আনিয়াছিলেন রাজনীতির মধ্যে।’ আরো লিখেছেন সাম্প্রদায়িকতার কিছু অনুষঙ্গ। লিখেছেন নোয়াখালি-যাত্রার পূর্বাপর থেকে এই দিনপঞ্জি লেখা এবং কী করে তা দীপংকর মোহান্তের মাধ্যমে সম্পাদিত হলো তার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত। আরেকটি ভূমিকা লিখেছেন ডায়েরি সূচনার আগে ‘ডায়েরি’ শিরোনামে। নোয়াখালিতে দাঙ্গার সংক্ষিপ্তসার উঠে এসেছে এই ভূমিকায়।
খুব স্বাভাবিকভাবেই সাধুভাষায় ডায়েরিটি লেখা, প্রাঞ্জল, অজটিল বাক্যবিন্যাসে এবং বর্ণনার পরম্পরা মেনে নিয়ে। চৌমুহনী, রামগঞ্জ, শ্রীরামপুর দিয়ে তাদের সেবা-কার্যক্রম এবং দাঙ্গার ক্ষতি ও ক্ষত দেখার পালা শুরু হয়। তারা হেঁটে চলেন কাজিরখিল, চণ্ডীপুর, মাছিমপুর, সোনাপুর, নন্দনপুর, মধুপুর হতে পাইকপাড়া, জয়শ্রী, আইটপাড়া, তাম্রশাসন, আষ্টা, করইতলী, কুমারপাড়া, বড়গাঁও, সাইসাঙ্গা, ষোলদানা, বৈচাতলী, খাজুরিয়া, বিওরবন্দ, মান্দারতলী, সাইচাখালী, শাসিয়ালী, লামচর, চররাঘবপুর, গোবিন্দপুর, চরকুমিরা, ভাটিয়ালপুর, গাবদের-গাঁও, রূপসা, বড়ালী, চরমুরগা, পোয়ারচর, ফর্নীদুর্গাপুর, বালুঘোরা, গড়িয়ানা, সানকিসাইর, গোবরচিত্রা, আলোনীয়া, দেবীপুর প্রভৃতি স্থান। গ্রাম থেকে গ্রামে কাজ চলেছে গান্ধীজির প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণায়। সুহাসিনী গান্ধীজিকে ৭/৮ বার মতো দেখেছিলেন। আর এর মধ্যে তিনি জলবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এমনি নানান অসুখে আক্রান্ত আরো অনেকজন। কিন্তু কোনোকিছু সেবাকর্মকাণ্ডকে অবদমিত করতে পারেনি। সব মিলিয়ে সুহাসিনী দাসের দিনপঞ্জির শব্দরেখা ধরে দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালিতে আমাদেরও এক পরি888sport slot game সম্পন্ন হয়।
ডায়েরিতে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কার্যক্রমের বর্ণনার চেয়ে বেশি এসেছে সহকর্মীদের কর্মকাণ্ড আর দাঙ্গার রোমহর্ষক সব কাহিনী। মানুষের নির্মমতা, অশ্লীলতা, তা-ও স্রেফ জাতের বিচারে – শুধুমাত্র ধর্মের পরিচয়ে কী পর্যায়ে পৌঁছেছিল তার অনেকগুলোর একটি হলো দেবীপুরের চিত্তবাবুর বাড়ির ঘটনা। তিনি এই ঘটনাটি দুবার লিখেছেন। একবার লিখেছেন ৩৬ পৃষ্ঠায়, এটি মূলত নোয়াখালির দাঙ্গার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতে গিয়ে, পরে লিখেছেন ৬৩ পৃষ্ঠায়। ডায়েরির দিনপঞ্জির পাতায় তখন ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭। ঘটনাটি যে-কোনো পাঠকের জন্য, সুস্থ মানুষের জন্য মর্মবিদারক।
সুহাসিনী লিখেছেন, ‘চিত্তবাবুর পিতামহ প্যারীবাবু শ্রীহট্টের লোক ছিলেন বলিয়া শুনিলাম। চিত্তবাবুর বিরাট মহালবাড়ি। প্রায় ৮/১০ হাজার লোক বাড়িটি আক্রমণ করিয়াছিল। চিত্তবাবু তাহার মাতা ও পূজারী একজন বন্ধুসহ তিন তালার ছাদে উঠিয়া পড়েন এবং ৮টা হইতে বেলা দুইটা পর্যন্ত লড়াই করিয়া থাকেন। ইট ছুড়িয়া, সোডার বোতল-বন্দুক দিয়া লড়াই করিতে থাকেন। ৬ ঘণ্টা অবিশ্রান্ত লড়াই করিয়া সহস্র সহস্র দুর্ব্বৃত্তদের (দুর্বৃত্ত) হঠাইয়া রাখার পর অবশেষে নিচের আগুনে যখন দালানের ছাদ ধসিয়া পড়িতে লাগিল – তখন বন্দুকের টোটা ফুরাইয়া আসিল। তখন নিজ হাতে নিজের মাকে কাটিয়া আগুনে ফেলিয়া দিলেন এবং নিজের বক্ষে ছুরিকাঘাত করিয়া জয়হিন্দ্ বলিয়া নিচে লাফাইয়া পড়িলেন। দুর্ব্বৃত্তরা (দুর্বৃত্ত) তাহার মাথা কাটিয়া ছিন্ন শির বাড়ির সম্মুখবর্তী এক গাছে লটকাইয়া রাখিয়াছিল। তাহার স্ত্রী এবং শিশুকন্যাকে জনৈক মুসলমান ব্যক্তি রক্ষা করিয়াছেন। বিরাট বাড়িখানি ধ্বংস¯তূপে পরিণত হইয়া আছে। কুকুর চিত্ত তোর উপযুক্ত শাস্তি হইল, …। তাহার মাতা, পূজারী ও বন্ধুকে জ্বলন্ত আগুনে ফেলিয়া দিয়াছিল। আমি ভস্মাবশেষ এক টুকরা হাড় কুড়াইয়া নিয়া আসিলাম। অতঃপর ফিরিয়া দেবীপুর আসিয়া একটু বিশ্রাম করিয়া পরে আলোনীয়া আসিলাম।’ সুহাসিনী এমনই নিরাবেগ ভাষায় বর্ণনা করেছেন এবং লক্ষণীয় এখানেও তিনি দাঙ্গাকারীদের ‘দুর্বৃত্ত’ বলেছেন, কিন্তু চিত্তবাবুর স্ত্রী-কন্যাকে রক্ষাকারী ব্যক্তিকে বলেছেন মুসলমান। আগেই বলেছি, পুরো ডায়েরিতে সর্বত্র তাঁর মনের এই ধাঁতটি দেখা গেছে। এই মনটি অসাম্প্রদায়িক মানবিক বৃত্তিসম্পন্ন একটি মন। ধর্মের নামে যারা দাঙ্গা করে তাদের কোনো ধর্মের নামে চিহ্নিত করতে তিনি রাজি নন, তাদের একটাই পরিচয়, তারা দাঙ্গাবাজ, দুর্বৃত্ত।
বিচিত্র রকমের ঘটনা ঘটেছে এই দাঙ্গার সময়। হিন্দু ব্যক্তির বাড়িতে গরু জবাই করে ভোজ খাওয়া, ধর্মান্তরিত করে প্রাণে রক্ষার নামে খুন, বাড়িঘরে আগুন দেওয়া, আর 888sport promo codeর সম্ভ্রমহানির কথা তো বলা বাহুল্য। গ্রামগুলোতে কতটি বাড়িতে কতজন লোক আক্রান্ত হয়েছে, দিনপঞ্জির বর্ণনায় তার হিসাব দেওয়া হয়েছে বহুবার। আরো একটি বিষয়ও লক্ষণীয়। দাঙ্গার পর সেবাকার্যক্রম যখন চলছে এই সময়ে আতঙ্ক কোথাও কাটেনি। পুরো ডায়েরি জুড়ে সেই আতঙ্ককর আবহের প্রমাণ মেলে। ডায়েরিতে বর্ণিত বেশির ভাগ লোকই বিষণ্ন, যে-বাক্যগুলোতে নানান ব্যক্তির কথা এসেছে, যারা সাধারণ মানুষ, তারা সবাই যেন ভীরু চোখে তাকাচ্ছে, তাদের চোখে সর্বস্ব হারানোর বিহ্বলতা, আগামী দিনগুলো নিয়ে অনিশ্চয়তা।
গান্ধীজি নোয়াখালিতে যতদিন ছিলেন ততদিন নিজে তো সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট ছিলেনই, নেতাকর্মীরাও ছিলেন উদ্যোগী, ফলে তাদের নৈতিক বল ও স্ব-ভূমি থাকায় প্রেরণা ছিল অটুট। জোর করে ধর্মান্তরিত লোকেরা ফিরে এসেছিল তাদের ধর্মে। কিন্তু তারপরের ইতিহাস ভূগোলের হাতে মার খাবার ইতিহাস। দীপংকর মোহান্ত এই গ্রন্থের সূচনার দিকে ‘পটভূমি : নোয়াখালি-১৯৪৬’ শিরোনামে গবেষণা-নিবন্ধটির এক জায়গায় লেখেন, ‘গান্ধী নোয়াখালি ছেড়ে যাবার পর তাঁর জ্বেলে যাওয়া আলোকবর্তিকার শিখা নিবু-নিবু হয়ে যায়। নতুন করে চোরাগোপ্তা হামলা, 888sport promo code নির্যাতন, ভয়-ভীতি দেখানো ঘটতে থাকে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও সে-সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আবার ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। সবকিছু ছাপিয়ে দেশভাগ ও স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী পরিণতির দিকে দ্রুত গড়ায়। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় 888sport free betলঘুরা পুনরায় অমানিশার মধ্যে হাবুডুবু খায়। সাম্প্রদায়িক বিভাজনভিত্তিক স্বাধীনতা তাদের মনোজগতকে অনেকটা বিকল করে দেশত্যাগের পথ রচনা করে। এই ক্রান্তিকালীন সময়ে বহু ক্যাম্প নোয়াখালি থেকে গুটিয়ে নেওয়া হয়। চলে যান গান্ধীবাদী বহু আত্মত্যাগী নেতাকর্মী।’
নোয়াখালিতে দাঙ্গা হয়েছিল একচেটিয়া। ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ তারিখে কলকাতায় যেমনটা দুপক্ষের দুর্বৃত্তরা সক্রিয় ছিল, নোয়াখালিতে তা হয়নি। আবার নোয়াখালির হিন্দুদের মতো বিহারের মুসলমানরা একতরফা ক্ষতিগ্রস্ত হলো। এই দাঙ্গার বৃত্তান্ত আজও চলছে। দাঙ্গায় কেবল হিন্দু-মুসলমান না, দেশে দেশে জাতপাতের নামে, রাষ্ট্রশুদ্ধির নামে দাঙ্গা চলছে। জার্মানির নাৎসি বাহিনীর ইহুদি নিধনযজ্ঞ থেকে বর্তমানে ইসরাইলের ইহুদির হাতে প্যালেস্টাইনিদের, ইরাকে মার্কিনিদের হাতে ইরাকিদের নিধনযজ্ঞ চলছে। দাঙ্গা হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ায় খ্রিষ্টান-মুসলমান। নাইজেরিয়ায় অল্প কিছুদিন আগে হলো এই ধরনের দুর্বৃত্তদের দাঙ্গাকাহিনী। আবার গুজরাটে এতবড় দাঙ্গার পর সেই নরেন্দ্র মোদীই পুনর্বার ক্ষমতায় আসীন। এসব দেখে মনে হয় নিজের হাতে মানুষ তার নিজের মাথা কাটছে। এক ভীরু, আতঙ্কগ্রস্ত পৃথিবীর মানুষ হয়ে উঠেছি আমরা। গণতন্ত্রের ছদ্মবেশ পরে ফ্যাসিস্টরা দেশে দেশে ক্ষমতার মসনদে ফিরে আসতে তৎপর। পৃথিবীকে আমরা এ কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছি। যান্ত্রিক, পুঁজিবাদী, ভোগবাদী, মনুষত্বহীন বিশ্ব ব্যবস্থায় আমাদের কোনো ধিক্কার যেন কার্যকর হবার নয়। কিছু মানুষ তবু চেষ্টা চালায় পৃথিবীকে স্বর্গ করে তোলার জন্য। কিন্তু পৃথিবীকে তো স্বর্গ করার দরকার নেই। এই সুন্দর পৃথিবী চিরন্তন এক স্বর্গভূমি হয়েই আছে। মানুষের উচিত ছিল তার যোগ্য করে নিজেদের গড়ে তুলবার (ঔপন্যাসিক হেনরি মিলারের মন্তব্য)। কিন্তু হাতে অস্ত্র নিয়ে, মনের ভেতর খুনের জিঘাংসা নিয়ে স্বর্গের মতো হয়ে থাকা সেই পৃথিবীকে কেউ শনাক্ত করতে পারে না। তাই যা ঘটবার তা-ই ঘটছে বারবার। যা ঘটেছে নোয়াখালিতে তা-ই ঘটল গুজরাটে। সুহাসিনী লেখেন : ‘এই ঘটনার দ্বারা কি প্রমাণ পাওয়া যায় না যে আমরা সেই জায়গায়ই পড়িয়া আছি?’
সুহাসিনী দাসের নোয়াখালি : ১৯৪৬ মতো এই গ্রন্থ তো মানবসেবা ও জনকল্যাণের মূল উদ্দেশ্য বারবার লাইনচ্যুত হবার 888sport app download for androidিকাও। এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে আমাদের ব্যর্থতাকে
888sport app download for android করিয়ে দিতে, সাথে আত্মত্যাগকেও; একই উৎস থেকে অমৃত ও গরল গ্রহণের ঘটনা তো ঘটল না পৃথিবীতে। কিছু মানুষ তবু আছেন যারা সহস্র প্রতিকূলতার ভেতর মানবতার পথে অগ্রযাত্রা দৃঢ় বিশ্বাসে অব্যাহত রাখেন। নোয়াখালি : ১৯৪৬ মানুষের মানবিক হয়ে ওঠার, সেই নিরন্তর সাধনার করুণায় সিক্ত অনন্য এক দলিল।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.