‘মানুষ এমুন ক্যানে লালু?’ চোখভরা জল নিয়ে হিল্লি প্রশ্নটা করে ওকে।
উত্তরটা লালুর জানা নেই। সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে হিল্লির দিকে। নারকীয় দৃশ্যগুলো এ-সময় চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। সেদিকে মুহ্যমান লালুর হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। মনে মনে সে-ও হিল্লির মতো কাকে যেন অসহায়ের মতো একই প্রশ্ন করে, ‘মানুষ এমুন ক্যানে?’
ভূতি লালুর কেউ নয়। যেতে-আসতে মাঝেমধ্যে রাস্তায় দেখা হতো, এই যা। প্রচণ্ড বকবক করার বাই ওর। স্বামী-সন্তান কেউ নেই। বনিবনা হয় না, সামান্যতেই এটা-ওটা নিয়ে বেধে যায়। হয়তো এ-কারণেই কারো সঙ্গে একত্রে থাকা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এখন বয়সটাও পড়ে গেছে। গা-গতরে আগেকার চটক নেই, কেবলি গাছতলায় বসে ঝিমোয় আর পরিচিত কাউকে পেলে বকর-বকর করতে শুরু করে। বেশিরভাগ পুরনো কথা, শুরু হলে কিছুতেই আর থামতে চায় না।
এ-কারণে দূর থেকে দেখলে অন্যরা পালিয়ে জান বাঁচায়, কিছুতেই কাছে ঘেঁষতে চায় না। শুধু হিল্লি ওকে মাঝেমধ্যে মুরগির নাড়িভুঁড়ি খেতে দেয়। ওর দূরসম্পর্কের আত্মীয়া, হয়তো সেজন্যে। অগত্যা লালুও মাথা নুয়ে, মনোযোগী শ্রোতা সেজে চুপচাপ সব কথা ওর শুনে যেত। তাতেই ভূতি মহাখুশি। মুখে বলত, ‘তুমি অইলা আমার মুরুব্বি বন্ধু। আগে য্যান কেন দেখা অইলো না।’ বলে প্রায়ই আফসোস করত। উত্তরে লালু কিছু না বললেও মনে মনে বলত, ‘বিরক্তিকর মুরুব্বি বান্ধবী। ছ্যা!’
সহ্য-ধৈর্যও নেহায়েত কম ছিল ভূতির। প্রায়ই অকারণে খ্যাকানি করার স্বভাব ওর। এজন্য পাড়ার ছেলেমেয়ে, এমন কি মুরুব্বিরা পর্যন্ত ওর ওপর খুব চটা। চোখের সামনে পড়লে মহাবিরক্ত; আপনা-আপনি ভুরু কুঁচকে যেত তাদের। বাচ্চারা ওর অকারণ ঘেউ-ঘেউর কারণে সারাক্ষণ ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত। তাই ভালোবেসে ডেকে নিয়ে ওকে খেতে দেওয়ার কেউ ছিল না পাড়া-মহল্লায়। বরং দেখামাত্র ওকে এড়িয়ে যেতে পারলেই যেন সবাই বাঁচে।
সেই ভূতি করোনাকালের অসহ্য ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারেনি; ভুল করে সাপ্তাহিক পিকনিকের জন্য কিশোর গ্যাংয়ের চুরি করে রাখা একটি মুরগি খেয়ে ফেলেছিল। এই হলো ভূতির অপরাধ। তাই ক্ষিপ্ত হয়ে কচিমুখের হিংস্র ছেলেগুলো কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলো ওর শরীরে।
বাজারের প্রতিটি মানুষ দাঁড়িয়ে-বসে, পান চিবোতে-চিবোতে, সিগারেট-বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে সেই অপরূপ দৃশ্য আয়েশ করে উপভোগ করল, যেন বিনা টিকিটে নতুন একটা বাংলা সিনেমা দেখার সুযোগ নিচ্ছে তারা। এমনি উচ্ছল আর প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল মাতোয়ারা মানুষগুলোকে তখন।
পোড়া শরীর নিয়ে ছটফট করতে করতে বিকালের দিকে স্তব্ধ হয়ে গেল ভূতি। নিষ্ঠুরগুলো ভূতির মুখে বোতল সেঁটে রেখেছিল; প্রাণখুলে ঘেউ বলাও সম্ভব ছিল না ওর পক্ষে। হয়তো নিশ্বাস বন্ধ হয়েই দমটা গেছে বেচারীর!
বাজারঘেঁষা বস্তির লোকগুলো দাঁত কেলিয়ে উপভোগ করল সেই দৃশ্য। অনেকদিন পর লকডাউনের ভেতর মাস্তিভরা আনন্দে গা ভাসাল নিরীহ, অসহায়, গোবেচারা মানুষগুলো – কী আরাম, কী আনন্দ! কারো করুণ মৃত্যু যে এদের আনন্দ জোগাতে পারে তা চোখে না দেখলে সত্যি বোঝা দায়!
এর ঠিক কয়েক মিনিট পরই থানার সামনে শোরগোল। লালু সেখানে ছুটে গিয়ে দেখতে পেল ইকবাল দিনে-দুপুরে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। মুখে-বুকে শুকিয়ে রয়েছে থকথকে গ্যাঁজলা। লোকটার মালিক ভেজাল কনডেন্সড দুধের ব্যবসা ফেঁদে বসেছিল। পুলিশের চোখে ধরা পড়ে গেলে ওর মতো অসহায় কর্মচারীকে সবকিছুর হোতা বানিয়ে পুরো ফাঁসিয়ে দিলো। অথচ এসবের কিছুই ওর জানা ছিল না। সেদিন গাছতলায় দাঁড়িয়ে আইসক্রিম চুষতে চুষতে উদ্ভ্রান্তের মতো সেসব দুঃখের কথাগুলোই সে ওকে বলতে চেয়েছে। কিন্তু জীবনের কষ্টগুলো সামলে চলতে না পেরে সে যে নিজের জানটাই দিয়ে দেবে – তা ওর জানা ছিল না।
লালুর বুকটা ভারি হয়ে রইল সারারাত। মাঝরাতে চুপিচুপি ডেরা থেকে বের হয়ে ভূতি যেখানে কাঠকয়লা হয়ে পড়ে রয়েছে, সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। ওর অস্তিত্ব টের পেয়ে কটা নেংটি ইঁদুর গর্তের ভেতর পালিয়ে গেল। জীবদ্দশায় যার ভয়ে ওরা নিজেদের লুকিয়ে রাখত এখন ওরাই ভূতির পোড়া শরীরটা খুবলে খেয়ে উদরপূর্তি করছে।
একাকী লালু হেঁটে হেঁটে থানার সামনে কড়ই গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। ইকবালের কথা খুব করে মনে পড়ল এ-সময়। মানুষ হয়ে শেষ পর্যন্ত মানুষের দেওয়া যন্ত্রণা সইতে না পেরে আত্মাহুতি দিলো সহজ-সরল গোবেচারা মানুষটা। তাতে কী-ই বা যায়-আসে? কেউ একদণ্ড মাথাও ঘামাবে না। বরং আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে স্বস্তি খোঁজার চেষ্টা করবে। এই যে এতো বড় একটা ভাইরাস তছনছ করে দিচ্ছে সবকিছু, কই, মানুষের স্বভাবে কি কিছু পরিবর্তন এলো? সেই কেড়ে খাওয়া, সবাইকে বিতাড়িত করে মেরে-ধরে নিজের শক্তি প্রদর্শন করা – সব তো আগের মতোই রয়েছে। তাহলে?
লালু এমনিতে ঝামেলা পছন্দ করে না। মানুষের অনুগত হয়ে ওদের খেদমত করার ভেতর যে আনন্দ তা-ই সে চেটেপুটে খেতে চায় সারাজীবন। নিজেকে রাখতে চায় নির্বিরোধ-নির্ঝঞ্ঝাট। তবু চোখের সামনে ঘটতে থাকা একটার পর একটা ঘটনা যেন ওকে অন্যদিকে ঠেলে দিতে চাইছে আজকাল। ওর ভাবনার যে-চাকাগুলো একজায়গায় দীর্ঘদিন স্থির হয়ে মরচে পড়ে যাচ্ছিল, সেগুলো আবারো বাঘার মতো, হিল্লির মতো চলতে চাইছে সামনের দিকে।
ডেরায় ফিরে এসে সে চুপচাপ শুয়ে থাকে। ভোরের দিকে বাঘার গলা শুনে ওর ঘুম ভেঙে গেল। লালুর ছোটভাই ভীমরু এখন বাঘার দেহরক্ষী হয়ে কাজ করে। মুগদা-সবুজবাগের দিকে ওদের আস্তানা।
লালুর বউ হিল্লি ছুটে গিয়ে বাঘাকে প্রশ্ন করল, ‘কাইল যে আইলা না বাঘা? ভূতির যে কত কষ্ট অইছে মরতে, আহারে!’ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে ওর গলা। এককালে হিল্লির জীবনে বাঘা ছিল লালুর জায়গায়। বনিবনা না হওয়ায় ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে বহুদিন। তবু এখনো বাঘাকে চোখের সামনে পেলেই মনের ভেতরকার লুকানো সব কথা উগড়ে চলে আসতে চায়। একটা অন্যরকম চনমনে ভাব ফিরে পায় ওর সমস্ত শরীর-মন জুড়ে।
‘কাইলই খবর পাইছি। কিন্তুক কী করুম, আমি তো মরতে মরতে বাঁইচা গেছি। ভীমরু জানে।’ ইশারায় হিল্লির দেবরকে দেখিয়ে দেয় বাঘা।
‘কী কও?’ পাশে দাঁড়ানো লালু চমকে উঠে প্রশ্ন করে। হিল্লির চোখে অপার বিস্ময় ও উৎকণ্ঠা।
‘একটা বুইড়া বেডা। আদর কইরা বাঘাভাইরে কাছে ডাকল। বিস্কুট দিলো মুহে। হেরপরই কারেন্টের তার লাগাইয়া দিলো ভাইর শরীরে। কুনুরকমে পালাইয়া আইছে। আরেকটু অইলে জানডা গেছিল আর কী।’
‘বুইড়া লোক অতো শয়তান অয়?’ হিল্লি বিশ্বাস করতে পারছে না। প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়তে চাইছে যেন সে।
‘লোকটা পাগল। নইলে বাঘাভাইর কষ্ট দেইখা লোকটা হাসতে হাসতে মরে?’ ভীমরু মন্তব্য করে।
এবার খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে উঠল বাঘা। হাসি থামিয়ে জানাল, ‘ঠিকই ধরছস ভীমরু। লোকটা পাগলই। সারাজীবন ঘুষের ট্যাকায় সয়-সম্পত্তি বানাইছে। অহন পোলা আর পোলার বউ পাতে খাওন তুইলা দেয় না। নিজের বউডাও গত বছর অক্কা পাইছে। অহন বাড়ির কেয়ারটেকার যে ঘরে থাহে, হেই ঘরের এককোনায় হের জাগা অইছে। মাইনষের কাছ থেইকা চাইয়া-মাইগা খায় আর ঘুষের ট্যাকায় করা ছয়তলার দিকে চাইয়া যারে কাছে পায় তারেই ডাইক্যা আইনা কয়, এ্যাইডা আমি করছি, আমি রাজা, আমার পুত কেউ না। তুমরা হের বিচার কর। হেই বদমাইসেই নিজের পুংটা রাগডা আমার উপরে ফলাইছে। বুজলা?’
‘আইচ্ছা বাঘাভাই, হের ঘরের সামনে দুইজনে মিইলা হাইগা দিয়া আইলে কেমন অয়? হারামজাদা ভোরবেলায় বাইর অয় না? বাইর অইতেই পাওডা পড়ব গুর উপর। হিহিহি। কি কও বস?’ ভীমরুর চোখেমুখে প্রতিহিংসার হাসি।
বাঘা ওকে মাঝখানে থামায়। গম্ভীরমুখে উত্তর দেয়, ‘এইভাবে খোঁচাখুঁচি কইরা কি কোনোকিছুর সমাধান অয়? এই পৃথিবীডা কি শুধুই মানুষের? আমরার না?’ ওর চোখেমুখে তীব্র ক্ষোভ আর জেদ। ধোঁয়ার মতো বেড়ে আকাশ ছুঁতে চাইছে।
হিল্লি কথা ঘুরিয়ে ফেলল। অনেকদিন ঘোরাঘুরি হয় না। আজ একবার সবাই মিলে বেরুলে কেমন হয়?
‘চল, একটু ঘুরে আসি। যাবি বাঘা?’ গলায় আব্দার হিল্লির।
সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে সে একবার লালু, একবার ভীমরুর দিকে তাকায়। তারপর মুচকি হেসে বলে উঠল, ‘মন্দ কি? চল সবাই মিলে।’ তীব্র শীতের পর একটুখানি ফাগুন হাওয়া বইছে চারদিকে। এ-সময় সকালবেলাকার রোদে মিশে থাকে মিষ্টি শীতের পরশ; চারপাশে ঝিকমিক করছে নরম হাড় চিবানোর মতো মোলায়েম একচিলতে রোদ। ওরা নিজেদের শরীরে উষ্ণ সেই রোদ মেখে রওনা দেয় সামনের দিকে।
রাস্তার ফুটপাতঘেঁষে দলবেঁধে ওরা হাঁটতে থাকে। হেঁটে হেঁটে সবাই পৌঁছে গেল মেডিক্যাল হাসপাতালের সামনে। কদিন পর 888sport cricket BPL rateে ফেব্রুয়ারি। এদেশের একঝাঁক দেশপ্রেমিক বুকের রক্ত ঝরিয়ে নিজেদের মুখের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন এই বিশেষ দিনটিতে। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির এই বিশেষ দিনে তারা শহিদ মিনারে জড়ো হয়ে এ মহান আত্মত্যাগের কথা 888sport app download for android করে। ফুল দিয়ে গভীর 888sport apk download apk latest version জানায় ভাষা-শহিদদের।
প্রয়াত গাপ্পু ছিল ওদের ভেতর সবচাইতে জ্ঞানী-গুণী একজনা। মানুষ সম্পর্কে অগাধ তার জানাশোনা। তার কাছ থেকেই বাঘা এসব গল্প জানতে পেরেছে।
এ-আয়োজনটার প্রতি গাপ্পুর বড় 888sport apk download apk latest versionবোধ। একবার কটি ছেলে 888sport cricket BPL rateে ফেব্রুয়ারির ভোরবেলায় গাছের নিচে চুপিচুপি বসে নেশা করছিল, বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে গাপ্পু তাদের দাঁত বের করে তাড়া করেছিল। গাপ্পু আংকেলের কাণ্ড দেখে বাঘার সেদিন হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গিয়েছিল।
গাপ্পু মাথা নেড়ে গম্ভীরমুখে ওকে বলেছিল, ‘এটা হাসার ব্যাপার নয় বাঘা। খুবই দুঃখের বিষয়। এরকম দিনেও মানুষ নিজেদের সংযত করতে পারে না। ছিঃ।’ সঙ্গে সঙ্গে বাঘা চুপ হয়ে পড়েছিল। তখন থেকে সে 888sport apk download apk latest version করতে শিখেছে মানুষের এসব কাজকর্ম। এখন এমন হয়েছে যে কখনো কোনোদিন ওদের ভেতর থেকে কেউ যদি বেদির আশেপাশে ঠ্যাং তুলে হিসু করতেও চায়, অমনি সে খেঁকিয়ে ওঠে, ‘ভাগ, ভাগ মূর্খ কোথাকার। জানিস জায়গাটা কত পবিত্র?’
মেডিক্যাল হাসপাতলের সামনে বেশ বড় একটা আঁস্তাকুড়। ভাগ্য ভালো থাকলে প্রায়ই সেখানে নানারকম খাবার মিলে যায়। ওরা মূলত সেই লোভেই এদিকে চলে এসেছে। ঘোরাঘুরি আর চক্কর কাটার পর খাবারটা পাওয়া গেলে মন্দ কী?
এ-সময় একটা হইচইয়ের শব্দ ওদের সবার কানে যেন র্ছরা বাজি ফোটাতে শুরু করল। ইমারজেন্সির সামনে থেকেই আসছে শব্দ। সেখানে তখন চলছে তুমুল হট্টগোল।
কৌতূহল পেয়ে বসল সবাইকে। গন্ধ শুঁকে শুঁকে সবার আগে হিল্লি ঠিকই চলে এলো মেডিক্যাল কলেজের ইমারজেন্সির সামনে। সেখানে থমকে দাঁড়াতেই দৃশ্যটা চোখে পড়ল ওর।
হুইল-চেয়ারে বসে রয়েছে এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ। নিশ্বাস নিতে পারছে না, বুকের খাঁচাটা কুকুরছানার মতো ধড়ফড় করে কেবল লাফাচ্ছে। সঙ্গে অক্সিজেনের পাইপটাও থরথর করে কাঁপছে। মানুষটাকে আগলে রেখেছে দুজন 888sport promo code, সম্ভবত একজন স্ত্রী আর অন্যজন মেয়ে। অপরপাশ থেকে একটি কমবয়সী ছেলে জোরে জোরে কী যেন বলছে। মনে হচ্ছে বয়স্ক মহিলাকে শাসাচ্ছে। তাতেই মহিলা হাউমাউ করে কেঁদে উঠছে বারবার। খেটে খাওয়া শহুরে সাধারণ এক পরিবার বলেই মনে হচ্ছে, চেহারাসুরত আর আচার-আচরণে একদম স্পষ্ট, হিল্লি তা হলফ করে বলতে পারে।
পেছন পেছন বাঘা আর লালু মানুষের ভিড়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে আরো খানিকটা এগিয়ে এলো। ওদের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। বাতাসে ঘনঘন গন্ধ শুঁকছে। কত রকমের বিচিত্র গন্ধ যে নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। বোঝা মুশকিল কোনটা কীসের গন্ধ। ওরা ছেলেটার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘তুমি ট্যাকা দিবা নাকি দিবা না?’ মারমুখী হয়ে টাকা চায় মহিলার কাছে ছেলেটা। প্রথমে মনে হলো বাইরের কোনো গুণ্ডাপাণ্ডা; কিন্তু একটু বাদে ওদের ভুল ভাঙল। ছেলেটা মহিলার পেটে ধরা সন্তান। হিল্লি রীতিমতো বিস্মিত। জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে এ কী ব্যবহার! তা-ও বাবার এরকম দুঃসময়ে? ছিঃ! সে ঘোঁত ঘোঁত করতে থাকে। ফের তাকায় সেদিকে।
‘তর বাপ কাতরাইতাছে আর তুই নেশাভাংয়ের ট্যাকা চাছ্ আমার কাছে? ছিঃ! অ আল্লা গো। কেমন পুত পেডে ধরছিলাম। দেইক্যা যাও। আগে জানলে জন্মের পর মুহে লবণ দিয়া মাইরা ফেলাইতাম। অ খোদা, আমি অহন কী করতাম।’ মহিলার বিলাপে চারপাশ ভারি হয়ে ওঠে।
হিল্লির চোখ ছলছল করে ওঠে, সহ্য করতে না পেরে সে বাইরে চলে আসে। নিজের বাচ্চাদের কথা মনে পড়ে যায় তখুনি।
‘ট্যাকা দিবা কি না কও?’ ছেলেটা হাত মুঠি করে মায়ের মুখের সামনে এগিয়ে আসে। চারপাশে মানুষের জটলা তৈরি না হলে এতোক্ষণে হয়তো একটা ঘুষি লাগিয়ে দিত মায়ের মুখে!
পাশে দাঁড়ানো সতেরো-আঠারো বছরের মেয়েটা এবার রুখে দাঁড়ায়, সম্ভবত ছেলেটার বড় বোন, চেঁচিয়ে ওঠে তারস্বরে, ‘আকমল, এইখানে তুই কী শুরু করছস? তুই কি সবাইরে খুন করতে চাছ্? ভাই আমার, তর পায়ে পড়ি। আব্বারে বাঁচতে দে। তুই এইরহম করলে আব্বা বাঁচত না। খোদার দোহাই লাগে।’ বলে হাঁপাতে থাকে।
‘চুপ কর মাগি। জামাই খাইয়া বাপের বাড়িত পইড়া আছস আর আমি ট্যাকা চাইলে তরার হগলের কইলজা পুড়ে। সবডিরে আমি খুন করুম। দেহিস।’ বাঘার মনে হচ্ছিল হাতে কোনো অস্ত্র থাকলে এখুনি বোনটাকে খুন করে ফেলত সে।
ওর মা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘তুই যাঃ। বাপ মরলেও আইবি না। নে ট্যাকা নে। খাইয়া মইরা থাক রাস্তাত।’ বলে মহিলা একটা পাঁচশো টাকার নোট ছেলেটার দিকে ছুড়ে মারে, চোখে একরাশ ঘৃণা।
দিশাহারা আকমল ঠিকই টাকাটা ফ্লোর থেকে কুড়িয়ে নেয়। সহসা প্রচণ্ড রাগে ওর আব্বার মুখ থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডারের মাস্কটা টান দিয়ে খুলে ছুড়ে ফেলে দেয় দূরে। তারপর হনহন করে হেঁটে ভিড়ের ভেতর হারিয়ে যায়।
নিশ্বাস নিতে না পেরে নিমেষে নেতিয়ে পড়ে নিরীহ মানুষটা। ভয়ে-ত্রাসে মহিলা আর তার মেয়ে একসঙ্গে ‘আল্লাগো’ বলে চিল-চিৎকারে চারপাশ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
অদূরে পিপিই পরা একজন কৌতূহলী নার্স দাঁড়িয়েছিলেন। সম্ভবত কৌতূহলবশত দূর থেকে ঘটনাটা পরখ করে দেখছেন তিনি। অবস্থা বেগতিক দেখে মহিলা দ্রুত ছুটে এসে লোকটিকে ইমারজেন্সির ভেতর নিয়ে যান। যাওয়ার আগে কাকে যেন চরম ঘৃণাভরে গালি দিয়ে ওঠেন, ‘পুত, না জানোয়ার!’
লালু বাইরে এসে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। নিজের ভেতর চেপে রাখা তীব্র রাগ আর জিদে আকাশের শূন্যে মুখ তাক করে ঘেউ ঘেউ করে বলে ওঠে, ‘মানুষ এতো নিঠুর ক্যানে?’
ডেরায় ফিরে হিল্লি সবার আগে ওর বাচ্চাদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে; সবকটিকে আদরে-আদরে ভাসিয়ে দিতে থাকে, জড়াজড়ি করে বারবার মাটিতে গড়াগড়ি খায় ওরা। বাচ্চা তিনটি মাকে পেয়ে মহাখুশি, ওদের ভেতর কে আগে মায়ের বুকের দুধে মুখ দেবে তা নিয়ে চলে মিষ্টি এক প্রতিযোগিতা। আনন্দে-আতিশয্যে মাঝে মাঝে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আদুরে কুঁই-কুঁই-কুঁই।
হিল্লি এক-একটি বাচ্চার শরীরে মুখ ঘষছে, পা দিয়ে জড়িয়ে ধরছে আর স্নেহসজল চোখে বলছে, ‘বুড়াকালে আমরারে মাইনষের মতন হেলাফেলা করিছ না। একটু খেদমতও করিছ।’
এ-সময় লালু-হিল্লির আশ্রয়দাতা মুরগি ব্যাপারী ভুলু মুনশী বউ লাইলিকে নিয়ে বিয়ের দাওয়াত খেতে বাইরে বেরুচ্ছিল; চোখের সামনে এ-দৃশ্য দেখে সহসা ওরা থমকে দাঁড়ায়।
লাইলি তৃষ্ণার্ত চোখে হিল্লির দিকে তাকিয়ে বোজা গলায় মন্তব্য করে, ‘হাছা-হাছা কি যে সুন্দর, না?’ চোখ তুলে স্বামীর দিকে তাকায়।
‘তাগদা কইরা চল তো? এদিকে তাকাইয়া থাকলে দিন যাইবো?’ কণ্ঠে ঝাঁঝ; তবু কেন যে উত্তর দিতে গিয়ে ভুলু ব্যাপারীর চোখ দুটো জ্বালা করছে তা সে বুঝতে পারে না। সে দ্রুত সেখান থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
পেছনে প্রভুভক্ত লালু লেজ নেড়ে নিজের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানায়। হঠাৎ করেই ওর মনে হলো, মানুষ শুধু নিষ্ঠুর নয়, দয়ালুও বটে।
ভুলু আর লাইলি বেশ কিছুদূর এগিয়ে বিস্কুটের একটি প্যাকেট কিনে নিয়ে ফিরে আসে হিল্লির কাছে। বিস্কুটগুলো বাচ্চা তিনটির মাঝখানে ছড়িয়ে দিয়ে পলকহীন চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ক্ষণিকের জন্য ভুলে যায়, ওরা দীর্ঘদিনের নিঃসন্তান এক দম্পতি!


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.