মোহন আলী বেলুন হাউজ

হাউজের সামনে শিশু দাঁড়ায়। চোখেমুখে আনন্দ এবং বিলাস। তার থেকে বড়ো সঙ্গী হাত ধরে টানে। শিশুর দুটো পা ফুটপাতকে খামচে ধরে। জিদে পা আছড়ায়। জুতো বা স্যান্ডেল শু মিউজিকঅলা হলে বাজতে থাকে। সঙ্গী বেলুন কিনে দেবে না। শিশুর চোখ ছলছল। কষ্টতাড়িত। সঙ্গী কিনে দেয়। শিশুর হাতে গ্যাসবেলুনের দড়ি, ছুটে গেলে রঙিন পৃথিবী শূন্য। দড়ি মুঠোতে। বেলুন মাথার ওপর দুলছে। আনন্দের পৃথিবী চোখের ভিতর।

কখনো কখনো শিশুর হাত লেগে বেলুন ফেটে যায়। শব্দে চোখেমুখে ভয়, আতঙ্ক। সঙ্গী বলে, ‘দাম দিয়ে দিচ্ছি।’ মোহন আলী হাসেন। পান খাওয়া লাল দাঁত দেখা যায়। হাত নেড়ে বোঝান, দিতে হবে না।

দাম না নিতে চাওয়ার ব্যাপার একটা ব্যবসায়িক বুদ্ধি। দেখা গেছে, বেশিরভাগ সময় শিশুর সঙ্গী তখন একটা নয়, দুটো বেলুন কেনে। তার মধ্যে একটা ফেটে যাওয়ার শোধ।    

একজন তরুণ দু-তিনদিন পরপর সঙ্গের তরুণীকে দুটো বেলুন কিনে দেয়। তরুণীর পছন্দের রং লাল ও নীল। তরুণী দুটো বেলুনের গায়ে পারমানেন্ট কালিতে কী যেন লেখে। হাতে ধরা সুতো আলগা করে। দুজন হাসে। ‘বেলুন চাঁদে যাবেই’, তরুণীর কথাটি মোহন আলীর কানে একবার এসেছিল।

এই একই তরুণ ও তরুণী অন্য তরুণী ও তরুণের সঙ্গে অন্যদিন বেলুন কিনতে এসেছিল। মোহন আলীর দরকার বেলুন বিক্রি। কে বন্ধু বা প্রেমিক-প্রেমিকা বদল করে বেলুন কিনতে এলো তা নিয়ে ভাবনার সময় তার নেই। 

যে-তরুণী কদিন আগে কিছু একটা লিখে ‘বেলুন চাঁদে যাবেই’ বলেছিল, সে নতুন তরুণের সঙ্গে একই কাজ করলো দেখে মোহন আলীর ভাবনায় খটকা লাগে। ভাবনা উড়ে গেলে দুঃখের হাসি তার চোখেমুখে ভেসে উঠলো।  

মোহন আলী বেলুনব্যবসায়ের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছেন – অভিজ্ঞতার বয়সও পঁচিশের কাছাকাছি – শিশুদের পছন্দ লাল বেলুন, তরুণীদের নীল বা লাল এবং বয়সীদের সাদা বা হলুদ। সব ক্রেতা দামাদামি করে না। ক্রেতার মুখ দেখে, কথা শুনে মোহন আলী বোঝেন, ক্রেতা দরকষাকষি করলেও কতটা করবে। একটার জন্যে এক দাম। অনেক কিনলে দামে কিছু ছাড় দেন। 

২.

ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। সময় রাত সাড়ে আটটা। কোনো ক্রেতা নেই। হাউজের ঝাঁপ ফেলার জন্যে মোহন আলী বসা থেকে – প্লাস্টিকের চেয়ার থেকে, পাছায় লুঙ্গিটা সেঁটে ছিল, আলগা করে – উঠে দাঁড়িয়েছেন। একটা কালো গাড়ি এসে থামলো। নামলেন একজন পুরুষ। বয়স হবে পঁয়ষট্টির কাছাকাছি। পরনে কালো পাঞ্জাবি ও জিন্সের ট্রাউজার। চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা। আকার গোল। দাড়ি ফ্রেঞ্চকাট। শরীর থেকে সুগন্ধ আসছে। প্রতিদিন গ্যাসের গন্ধ পাওয়া মোহন আলীর নাক সুখেই কেঁপে উঠলো। 

মোহন আলী ছাতা নিয়ে ক্রেতার মাথার ওপর ধরতে গেলেন। হাতের ইশারায় তিনি বোঝান, প্রয়োজন নেই। ‘আই এনজয় ড্রিজলিং।’ মোহন আলী ড্রিজলিং-এর অর্থ জানেন না। ‘প্রবলেম’, ‘ডিসটার্ব’, ‘ইমপসিবল’, ‘ফাংশনাল’, ‘স্ট্যাটাস’ ইত্যাদি শব্দের অর্থ তাঁর জানা আছে।

বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি চার রঙের – লাল, কালো, সাদা ও হলুদ – চারটি গ্যাসবেলুন নিলেন। মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করার সময় গাড়ির ভেতর থেকে একটা 888sport promo codeকণ্ঠ, স্বর সুরেলা, বললো, ‘আরো চারটে না-ফোলানো বেলুন নাও।’ 888sport promo codeর মুখ স্পষ্ট দেখা যায়নি।

বেলুনগুলির সুতোতে একটা কাঠের টুকরো বেঁধে পেছনের সিটে রাখা হলো। পরামর্শটা ছিল ক্রেতার। 

দাম দেওয়ার সময় ক্রেতা বললেন, ‘আপনিই মোহন আলী?’ 

তিনিই মোহন আলী।

ক্রেতা নেমকার্ড দিয়ে বললেন, ‘আমার নাম হাফিজ আহমেদ চৌধুরী, আপনার ফোন নাম্বারটা দিন।’

প্রতিদিন হরেকরকম মানুষকে দেখা, তাদের সঙ্গে সহজ-কঠিন কথা বলা মোহন আলীর মনে হলো, মানুষটা ভদ্রগোছের। 

গাড়ি বাড়ির দিকে যাচ্ছে। মিসেস চৌধুরীকে হাফিজ বললেন, ‘দোকানের নামটা মোহন আলীর বেলুন হাউজ হবে না?’

‘ঠিক আছে। নামটাই অ্যাডজেকটিভ হয়ে গেছে।’

‘তার মানে মোহন আলী কথা বলা, খিদে পাওয়া, কষ্ট না পাওয়া একটা বেলুন।’

দুজনই হাসলেন।

পেছন থেকে একজন ট্রাফিক সার্জেন্টের আবছা ভাবে, ভাব হালকা কুয়াশার কাছাকাছি – কাচ বৃষ্টিভেজা, হেলমেটের প্রটেকটরও – চোখে পড়লো সামনের গাড়ির পেছনের সিটে চার রঙের চারটি মাথা ডানে-বাঁয়ে দুলছে। ‘লোকগুলি আর চালকও কি মাতাল?’ দ্রুত মোটরসাইকেল চালিয়ে চৌধুরীর গাড়ির সামনে গিয়ে হাত তুলে থামতে ইঙ্গিত দিলেন।

থামার পর সার্জেন্ট গাড়ির পাশে এসে কাচে টোকা দেওয়ার আগেই চৌধুরী কাচ নামিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কী ব্যাপার?’

সার্জেন্ট গাড়ির পেছনে তাকিয়ে বেলুন দেখে বললেন, ‘স্যরি স্যার। আমার ভুল হয়েছে।’

‘কী ভুল হয়েছে?’

‘স্যার স্যরি।’ বলে সার্জেন্ট দ্রুত চলে গেলেন।  

৩.

বিশ্ববিদ্যালয়ে হাফিজের বিষয় ছিল ইতিহাস, সহেলীর সমাজ888sport apk। দুজনেরই সাবসিডিয়ারি ছিল ইংরেজি। ওই ক্লাসেই পরিচয়। পরে ধীরে ধীরে, একসময় ধীরগতি দ্রুত হলো, বাড়লো সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা।

একটা চিঠিতে সহেলীর বাক্য ছিল : ‘প্রেম কখনো বিয়ে করে না। কুৎসিত কিছু না ঘটলে দুজন একসাথে থাকতে পারে।’

হাফিজের চিঠিতে উত্তর : ‘এই সমাজ, এই দেশ তোমার পোয়েটিক স্টেটমেন্ট মানবে না। এই দেশে এই সময়ে, মানে আটের দশকে আমরা দুজন কীভাবে সিমো ও সার্ত্রে হবো? একদিন এই দেশেও লিভ টুগেদার শুরু হবে, তখন আমরা বুড়োবুড়ি অথবা কবরে।’

সহেলীর উত্তর : ‘তুমি বোঝনি। বিয়ে করবো কিন্তু প্রেম … ডটগুলি বুঝতে হবে।’

‘তোমার ভাষাজ্ঞান শহীদুল্লাহ্ সাহেবের কাছাকাছি। ডটগুলির অর্থ তোমার হাত হাতে নিয়ে বুঝতে হবে।’ হাফিজের দীর্ঘ চিঠির একটা বাক্য।

হাফিজ-সহেলীর সন্তান নেই। এ নিয়ে তাদের আফসোস নেই। বিয়ের এক বছর পর সন্দেহ হলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কেউই পরীক্ষা করাবেন না। কার ডিম্বানু নেই, কার শুক্রাণু নেই – এই পরীক্ষায় যাওয়ার দরকার কী? দুজন মানুষ একসঙ্গে চড়াই-উতরাই ভেঙে থাকছেন, জীবনকে বহুমাত্রায় নেড়েচেড়ে উপভোগ করাটা আনন্দের, ভালোবাসতে হবে মানুষকে – এই দর্শনে দুজন বিশ্বাসী।

দুজনের মা-বাপ, আত্মীয়জন ও বন্ধুদের পরামর্শ ছিল, একটা শিশুকে পালক নিতে।

দুজন সবাইকে, কথার মারপ্যাঁচে না থেকে, বলেছিলেন, ‘একজন আউটসাইডার বাড়িতে বড়ো হবে। মা-বাবা বলে ডাকবে। মিথ্যে সঙ্গটা আনন্দের নয়।’

দশজন গরিব, মেধাবী ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনার – প্রথম শ্রেণি থেকে এম.এ পর্যন্ত – সমস্ত খরচ তারা বহন করেন। দশজনের মধ্যে একজন, দুজনের বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষ হলে, বা পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই বিশেষ প্রয়োজনে পড়াশোনা কনটিনিউ না করলে, শূন্যস্থান পূরণ করা হয়। এবং যতদিন হাফিজ-সহেলী বেঁচে থাকবেন, এই সহযোগিতা চলবে। 

বড়ো ব্যবসায়ী হাফিজ দুজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার নামে গ্রামে স্কুল ও ইউনিয়নে কলেজ করেছেন। শিক্ষকদের বেতনের পঞ্চাশ শতাংশ যায় তার ব্যাংক-অ্যাকাউন্ট থেকে। 

৪.

চল্লিশ বছর বয়সী – মুখে বসন্তের দাগ, চোয়ালের দুই মাড়ি স্পষ্ট, হতে পারে ফুঁ দিয়ে বেলুন ফোলানোর ফল – মোহন আলীর পরিবার থাকে গ্রামে। কোনো কোনো রাতে বাসায় ফেরার আগে তিন রঙের – লাল, নীল, সবুজ – তিনটে বেলুন বাসায় নিয়ে যান। বউকে ভিডিওকল করেন। ঘরের দরজা-জানালা আটকে আট বছরের মেয়ে নাফিসা ও বউ দিলারাকে দেখান উড়ন্ত বেলুন। বেলুনের দড়ি ধরে টেনে মেঝেতে নামান এবং ছেড়ে দেন। নাফিসা হাসে। হাসে বউ। দুজন একটা কথা বারবার বলে, ‘কবে আসবা।’ ‘আসবো।’ উত্তরে জোর নেই। ফাঁপা।

৫.

সকালে হাফিজ আহমেদ চৌধুরীর ফোন এলো। ‘ওই যে এক সপ্তাহ আগে বৃষ্টি হচ্ছিল, তখন আমি কালো গাড়ি থেকে নেমে আটটা বেলুন কিনলাম, মনে আছে? চারটে ছিল গ্যাসভরা।’

‘জি স্যার মনে আছে। আপনে হাফিজ আহমেদ চৌধুরী।’

‘ঠিক বলেছেন। আজ রাত নয়টার দিকে আমি আপনার দোকানে যাবো। অনেকরকম রঙের, বিভিন্ন ছবিঅলা – যেমন বাঘ, হরিণের দল, মেঘ আর বৃষ্টি, নদী ও নৌকা, সমুদ্রে জাহাজ, বড়ো বড়ো বিল্ডিং, পাখি, ঘুড়ি, গাড়ি, ফসল বুনছে মানুষ, প্রজাপতি, নতুন বউ, হাসিমুখের একদল শিশু, মুখোমুখি তরুণ-তরুণী – ভালো বেলুন লাগবে। তিনশো। বাড়িতে এসে ফোলাতে হবে। দেড়শো গ্যাসের, বাকি দেড়শো হবে বাতাসের। দরকার হলে একজনকে সঙ্গে আনতে পারেন। পারবেন তো?’

‘স্যার যেসব ছবির কথা বললেন সবই করা যাবি, আমাক একদিন সুময় দিতি হবি।’

‘তা হলে পরশু রাতে। শনিবারে।’

‘পারবো স্যার।’

‘অ্যাডভান্স করতে হবে?’

‘না স্যার।’

ফুঁ দিয়ে বেলুন ফোলানোর জন্যে মোহন আলী অন্য লোক নেবেন না। টাকার ভাগ কমে যাবে।

যেসব বেলুন বিক্রেতা তার কাছ থেকে প্রতিদিন বেলুন নিয়ে যায়, পথে পথে বিক্রি করে, টাকা বাকি রাখে। তাদের প্রত্যেকেই সপ্তাহে দু-তিনদিন বলবেই, ‘আজ চারটা, আজ ছয়টা বেলুন তো ফাটছে। মোহন ভাই সব টাকা দিতি পারবো না।’

৬.

সকাল থেকে সারাদিন থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝিরঝির। বিরক্তিকর। এরকম দিনে বেলুন বিক্রি কম হয়।  

মোহন আলীর হিসাব মিলছে না। ‘কোনো শিশু নয়, অনেক তরুণ-তরুণী, কাপড়চোপড় দেখলেই বোঝা যায় দেশের বিশিষ্ট মানুষ আর বয়সীরা গ্যাসবেলুন এবং না-ফোলানো বেলুন আজ কিনতেছে ক্যান। দ্যাশে কিছু হইছে?’

তার সন্দেহ হলো, ‘আজকে কি আন্তর্জাতিক বেলুন দিবস? উড়ায়ে, বাতাস ফাটায়ে শব্দ শুনে লোকজন হাসপি নাকি? দ্যাশে যে কতকিছু হয়।’

মোহন আলীর চোখ আকাশে। হালকা মেঘ। বৃষ্টি নেই। মনে হলো, যারা বেলুন কিনে নিয়ে গেছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ উড়ায়ে দেছে কি না।

আকাশে কোনো বেলুন নেই। নিজেকে বোকা ভেবে হাসলেন।    

চলমান গাড়ির লালচে ও রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের সাদা আলোর ভেতর মোহন আলীর চোখে স্বপ্ন ভর করে। আশপাশের সবকিছু – বেলুন হাউজের বিপরীতে বারডেম, সামনে রমনা পার্ক, 888sport app ক্লাব, ক্লাবের দেয়ালে টেরাকোটায় করা 888sport appsের মানুষের জীবনচর্চাভিত্তিক সংস্কৃতি, ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণরূপ, বাঁপাশে ফুলের দোকান, পেছনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ – আনন্দে উড়ছে। সবকিছুর মাথায়, পায়ে, হাতে বিভিন্ন রঙের গ্যাসবেলুন লাগানো। 

একজন ক্রেতা বললেন, ‘চোখে কিছু পড়ছে? ডলছেন কেন? চোখে পানি দিন। আমি দশটা বেলুন নেব। পাঁচটা গ্যাসঅলা।’ 

ক্রেতাকে মোহন আলীর প্রশ্ন, ‘ভাই শহরে কি বেলুন-উড়ানো উৎসব হতিছে?’ 

ক্রেতা জানেন না।

মোহন আলী ফুলের দোকানে গিয়ে –  গোলাপ + গাঁদা + রজনীগন্ধা দিয়ে বানানো – পাঁচটা মালা কিনে হাউজে এসে পাঁচ রঙের পাঁচটা বেলুনের দড়ির সঙ্গে মালা বেঁধে উড়িয়ে দিলেন। চোখেমুখে হাসি।

৭.

শনিবার। মোহন আলী কিছুক্ষণ পরপর মোবাইলে সময় দেখছেন। ‘আজকে নয়টা বাজতি দেরি হচ্ছে ক্যা? চৌধুরী আসপি তো? একটা ফোন করবো নাকি?’

নয়টা বাজার দশ মিনিট আগে চৌধুরীর কালো গাড়ি নয়, লাল গাড়ি এলো। আজ গাড়ির চালক ড্রাইভার।

সবকিছু প্রস্তুত ছিল। বেলুন, গ্যাস সিলিন্ডার, কাঁচি, বেলুনের মুখ বাঁধার ও ওড়াবার জন্যে সুতো। 

মোহন আলী ও চৌধুরী বসলেন গাড়ির পেছনে। মোহনের পরনে লুঙ্গি নেই, সাদা পায়জামা ও পাঞ্জাবি।

চৌধুরী বললেন, ‘বেলুন ফোলানো আর ফোটানোর উৎসব শেষ করতে রাত হবে, আপনাকে গাড়ি পৌঁছে দেবে। কোন এলাকায় বাসা?’

‘আজিমপুরে।’ ‘ফাটাবেন ক্যান?’ প্রশ্নটি করলেন না।  

৮. 

888sport app শহরের সবচেয়ে দামি এলাকায় দশ কাঠা জমির মধ্যে চার কাঠার ওপর চৌধুরীর ডুপ্লেক্স বাড়ি। সামনে ও বাড়ির দুই পাশে বাগান। বাগানের মধ্যে কংক্রিটে বানানো একটা বড়ো ছাতা। নিচে কাঠের দুটো চেয়ার। একটা ছোট টেবিল। পাশে জ্বলন্ত বাল্বের নিচে চারকোনা চৌবাচ্চায় পদ্মপাতা ভাসছে। মিসেস চৌধুরীর প্রিয় ফুল পদ্ম। 

গাড়ির হর্ন বাজতেই ‘বসবাস’ নামের বাড়ির স্টেইনলেস স্টিলের বড়ো গেইট খুললো দারোয়ান।

গাড়ি এসে সিঁড়ির সামনে থামলো। তরুণ ড্রাইভার নেমে গাড়ির দুদিকেরই দরজা – আচরণ বিনয়ী – খুলে দাঁড়ালো। আচরণ রোবটের।

সিঁড়ির দরজায় একজন মহিলা, হাফিজের সমবয়সী, মোহন আলীকে বললেন, ‘আপনি কেমন আছেন?’ (গাড়ি থেকে নেমে এরকম কোনো বয়সী পুরুষ বা মহিলা যখন তার হাউজ থেকে বেলুন কিনেছেন, তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া সবাই তাকে বলেছেন তুমি, কেউ কেউ, তোর বেলুনের দাম কত?)

খুব ভালো আছে। থাকারই কথা।

মহিলার কণ্ঠস্বর শুনে মোহন আলীর মনে হলো, এক সপ্তাহ আগে কালো গাড়ি থেকে ইনিই আরো চারটে না-ফোলানো বেলুন নিতে বলেছিলেন। 

গাড়ি থেকে নামা, নিচতলার ড্রয়িংরুমে ঢোকা ইত্যাদির স্টিল ছবি তোলায় দুজন এবং ভিডিও করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনজন ক্যামেরা পারসন।  

মোহন আলীকে কেউ কোনোদিন এতো সম্মান করেনি। বিহ্বলতা তাকে ধাক্কা মারে। সাবধানী মানুষ। স্বাভাবিক হতে দুই হাত কচলালেন।

এরকম বড়ো বড়ো বাড়ির বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে বেলুন বিক্রি ও দেয়ালে, সিলিংয়ে লাগানোর কাজে গিয়ে – এক একজনের এক একরকম নির্দেশনা, কেউ বলে চার দেয়ালে হবে চার রঙের, সিলিংয়ে হবে চার সারি চার রঙের, কেউ বলে সব রঙের মিশিয়ে দিতে হবে, বেলুন লাগানোর পর কতদিন যে তাকে খুলতে হয়েছে – সবসময় তার ভালো অভিজ্ঞতা হয়নি। 

চারপাশে জায়গা রেখে ড্রয়িংরুমে একটা টেনিস কোর্ট বানানো যাবে। মাথার ওপর ঝুলছে তিনটি ঝাড়বাতি। তিনটিতে তিন রকমের – নীল, লালচে, সবুজ – আলো। একটা তিল কার্পেটের ওপর পড়লেও – এতো আলো – খুঁজে পাওয়া যাবে।

বেলুন, গ্যাসসিলিন্ডার এবং প্রয়োজনীয় 888sport app জিনিস আনা হলো ড্রয়িংরুমে। মোহন আলীকে চৌধুরী  বললেন, ‘মনে আছে তো, দেড়শো গ্যাসভরা আর বাকিটা, মানে দেড়শো ফুঁ দিয়ে ফোলাতে হবে আপনাকে, মোট কত নেবেন?’

‘স্যার সেদিন আটটা বেলুনের দাম আপনি একশ টাকা দিছিলেন। আমি আপনারে পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিছলাম। আপনে টাকা নেন নাই। আপনি যা দেন আমি কিছুই কবো না।’ কথার মধ্যে ‘কিছুই’ শব্দটির ওপর বিশেষ জোর ছিল।

চৌধুরী তর্জনী তুলে দেখিয়ে দিলেন, মোহন আলীকে বেলুন ফোলানোর জন্যে ড্রয়িংরুমের মাঝখানে বসতে হবে। বসার জায়গায় যাওয়ার সময় চোখে পড়লো ডানদিকে, দুটো চেয়ারের সামনে ছোট টেবিল, টপ সাদা পাথরের, উপরে কালো রিভলবার এবং পাশে দুটো বড়ো মোবাইল।

চৌধুরী বললেন, ‘ভয় নেই। আপনাকে গুলি করবো না।’

বসার জায়গায় যাওয়ার আগেই ট্রলিতে একজন তরুণ – পরনে সাদা টি-শার্ট ও নীল জিন্সের ট্রাউজার – ডমেস্টিক ওয়ার্কার নিঃশব্দে, প্রায় যন্ত্রচালিত ধরনে দামি কেক, বিস্কুট, স্যানডুইচ, সমুচা ও রসমালাই নিয়ে এসে একটা পুরু গদিঅলা চেয়ারের সামনে ছোট টেবিলের ওপর রাখলো।   

মিসেস চৌধুরী বললেন, স্বর বিনয়ী, ভদ্র, ‘ভাই ওখানে বসুন। খেয়ে নিন। চা না কফি দেবে? রাতে কিন্তু ডিনার করে যেতে হবে।’

মোহন আলী ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকালেন। চেহারা সুন্দর। বড়ো চোখ। কলপ দেওয়া চুল। কপালে নীল টিপ। বড়ো। পরনে হালকা সবুজ দামি শিফন-শাড়ি। নখে খয়েরি নেইলপলিশ। ঠোঁটে ন্যাচারাল লিপস্টিক। বাঁ হাতে সোনালি চেইনের ঘড়ি। একটা সাজানো মানুষ।

মোহন আলীর প্রিয় কেক ও রসমালাই। চা ছাড়া অন্য কিছু খাননি।  

নরম কার্পেটের ওপর বসে আরাম লাগলো। মোহন আলী কাজে হাত দিলেন। ‘খুঁত রাখা যাবে না।’ কাজ শেষ হওয়ার পর তাঁর জিনিসপত্র নিয়ে চলে যেতে হবে রুমের ডানদিকের একটা কোনায়। সেখানে গদিঅলা একটা চেয়ার আছে। 

মিস্টার ও মিসেস চৌধুরী পাশাপাশি বসেছেন। হাফিজের পরনে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির হাতা গোটানো। চুল সাদা-পাকা। হাতে ঘড়ি নেই।

ওপর থেকে সরাসরি একটা একমুখী নীল আলো এসে পড়েছে দুজনের মাথার ওপর। সুখী চেহারায় নীল উজ্জ্বলতা উদ্ভাসিত।  

ক্যামেরা পারসনদের বলা হয়েছে, বেলুন ফোলানো, ড্রয়িংরুমেই ওড়ানো এবং মিস্টার ও মিসেস চৌধুরী যা যা করবেন, বলবেন তার একটা ছবি ও কথাও যেন বাদ না পড়ে।

হাফিজ ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন বলে জানেন, কাজের ডকুমেন্ট রাখতে হয়। ক্লাসে স্যারেরা বলতেন, ব্রিটিশরা কলোনিগুলিতে যা যা করেছে, কলোনির লোকরা যা যা করেছে সবকিছুর ডকুমেন্ট রাখতো। কলোনি ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু তাদের শাসনকালের ভালোমন্দ ইতিহাসের জন্যে ইংল্যান্ডে যেতে হবেই। যে জাতি ডকুমেন্টেশনের মূল্য বোঝে না, সেই জাতি এগোতে পারে না।    

ক্যামেরা পারসন এবং বাড়ির অন্যরা – বাড়ির প্রধান দুজন ছাড়া – কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না। সবাই নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছে।

সারাদিন ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলা মোহন আলীও চুপচাপ। ‘কী একটা ফাঁপরে যে পড়লেম।’ কথা বলার জন্যে মনটা হাঁসফাঁস করছে। 

রিং হয়নি। পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে, স্বর ফিসফিস – ‘নাফিসা কী দরকার? কাজে আছি। তোর মা ভালো আছে। ফোন দিবনে।’ অভিনয় মোহন আলীকে করতেই হলো।

৯.

গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে দেড়শো বেলুন ফোলাতে বেশি সময় লাগেনি। গ্যাস ভরা শেষ হতেই বেলুনের মুখ বেঁধে – যেমন বলেছিলেন চৌধুরী – মোহন আলী উড়িয়ে দিচ্ছিলেন। সিলিংয়ের দিকে উড়ে যাওয়ার দৃশ্যে – চোখমুখ বলছে – রুমের সবাই পুলকিত।    

বাকি বেলুনগুলি ফুঁ দিয়ে ফোলাতে বেশ সময় লাগলো। ফোলানোর সময় পাঁচটা ফেটে যায়। শব্দে মৃদু হাসলেন মিস্টার ও মিসেস চৌধুরী। 

হতে পারে দুজনেরই মনে পড়েছে, অনেকদিন আগে এক পয়লা বৈশাখের বিকালে রমনা পার্কে এয়ারগান দিয়ে বোর্ডে আটকানো বেলুনে গুলি করা আর ফাটার শব্দ। গুলি করার আগে ‘আমরা দুজনই ফোটাবো লাল, নীল, সবুজ আর কালো’, বলেছিলেন। দশটা গুলির মধ্যে সহেলীর নিশানায় দুটো লাল, একটা নীল, একটা হলুদ, একটা সাদা, মোট পাঁচটা; এবং হাফিজের নিশানায় সবুজ, হলুদ, কালো ও সাদা, মোট চারটা গুলি বেলুনে লেগেছিল।   

মোহন আলীর কাছে কুড়িটা বেলুন বেশি আছে। আরো পাঁচটা ফেটে গেলেও পূরণ করতে অসুবিধে হতো না। 

সিলিংয়ে, কার্পেটে বহুরকম রঙের, শুধু রঙের নয়, ফোলানোর পর বেলুনগুলির গোলাকার পেটে, বুকে, লম্বাটে মাথায় প্রায় জীবন্ত হয়ে উঠলো বাঘ-ভালুক-হরিণ-ময়ূর-হাসিমুখের একদল শিশু, পাশাপাশি মুখ রাখা তরুণ-তরুণী-গোলাপবাগান-নানা রকম ফুল-সমুদ্র-পাহাড়পর্বত-নায়িকার হাসি হাসি মুখ-গাছে গাছে বসতে যাওয়া উড়ন্ত পাখি – নতুন বউ – হাতি আর প্রজাপতির ছবি। ছবিগুলির সামাজিক সহাবস্থান গাদাগাদি। ঝগড়া নেই। হরিণ বাঘ দেখে পালাচ্ছে না। রুমে প্লাস্টিকে ছাপানো রঙের উৎসব। সিলিংয়ে বেলুন দুলছে না। রুমে দুটো বড়ো এসি। আবহাওয়া আরামদায়ক। 

কয়েকটা গ্যাসবেলুন আটকে গেছে ঝাড়বাতি ও চারটি ফ্যানের বারোটি পাখায়।

চৌধুরী ক্যামেরা পারসনদের ডাকলেন। নতুন কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হলো। শুয়ে ভিডিও করতে হবে। ছবি তুলতে হবে।  মিস্টার ও মিসেস দাঁড়ালেন।

ছবিতে ছবিতে সিলিংয়ের রংবেরঙের বেলুনের মধ্যে আটকে গেছে দুজন মানুষের মুখ ও মাথা।

কার্পেটের ওপর শুয়ে থাকা দেড়শো বেলুনের মাঝখানে গিয়ে বসলেন হাফিজ ও সহেলী। দুজন দুজনের হাত – কনুইয়ের ভর প্রজাপতির ছবিঅলা বেলুনের ওপর – ধরলেন। বেলুনক্ষেতের ভেতর কেবল দুজন মানুষ।

ক্যামেরা পারসনদের চারদিকে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতে হলো। 

মোহন আলী ধন্ধে পড়ে গেছেন। চুপচাপ থেকে নতুন ধরনের কর্মকাণ্ড দেখে যাওয়া ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। যে-কোনো নতুন একরকমের আনন্দ দেয়। সেই ঘেরাটোপ তাকে কিছুটা ধাক্কা দিচ্ছে এবং তার চিন্তা বলছে, ‘এখান থেকে বারায়েই আমি গ্রামে নাফিসা আর দিলারার কাছে চইলে যাবো।’ 

রুমের এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা দুজন ডমেস্টিক ওয়ার্কারের কাছে পা টিপে টিপে গেলেন মোহন আলী। ওয়াশরুমে যেতে হবে। যদিও কোনো প্রাকৃতিক চাপ নেই। অন্তত দশ মিনিটের জন্যে হলেও মুক্তি পাওয়া যাবে। বউ ও মেয়ের সঙ্গে কথা বলা যাবে।

চোখেমুখে পানি দেওয়ার পর মনে একটা শান্তিভাব এলো। আয়নায় মুখ দেখলেন। বারো মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে একজন ডমেস্টিক ওয়ার্কারকে হাতের ইশারায় বোঝালেন, পানি খাবো। 

১০.

চৌধুরী আগেই ক্যামেরা পারসনদের বলে রেখেছিলেন, বেলুনউৎসবের শেষ পর্বে কী হবে। 

কার্পেটভরা বেলুনের মাঝখানে তিনি শুয়েছেন। হাতে রিভলবার। পাশে বসেছেন মিসেস চৌধুরী।

সিলিংয়ে আটকে থাকা বেলুনে তিনি একটার পর একটা গুলি করছেন। লক্ষ্য ব্যর্থ হওয়ার কারণ নেই। মুখে সাফল্যের হাসি। গুলি কার্পেটের উপর পড়ছে। একটাও দুজনের মাথা বা গায়ের ওপর পড়েনি। ওয়ার্কার গুলি কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

‘সহেলী এবার তুমি।’ তার লক্ষ্যও ব্যর্থ হয়নি। হবে কীভাবে? বেলুনে বেলুনে, বিভিন্ন রঙে সিলিংয়ের সাদা রং ছিল 888sport app।

খেলা চলতে থাকে। হাতবদল হচ্ছে রিভলভার। দুজন গুলি করায় ব্যস্ত। গুলি ও বেলুন ফাটার শব্দ রুমে উৎসব করছে।

মোহন আলী কর্মজীবনে, কর্ম না করা জীবনে চড়াই-উতরাই পার হয়ে যত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তার কোনোটার সঙ্গে আজকের অভিজ্ঞতা মিলছে না।

১১.

দারোয়ান এসে খবর দিলো, শহরের বড়ো বড়ো কর্তা, কয়েকজন হোমরাচোমরা আর বিশিষ্টজন এসেছেন। সবাই দারোয়ানের চেনা। এই গণ্যমান্যরা মিস্টার ও মিসেস চৌধুরীর পরিচিত। সম্পর্ক গভীর। এই বাড়ির নানা রকম অনুষ্ঠানে তাঁরা নিয়মিত অতিথি। সবার নয়, কয়েকজনের পকেটে রিভলভার।

পাশের তিনটি বাড়ি থেকে বিশেষ বিশেষ জায়গায় ফোন করা হয়েছিল। বাড়ি নম্বর ৩০০০০০৩, রোড : ৫০০০০০৫, ব্লক : জেড-এ অনেক গোলাগুলি হচ্ছে।

তারা ঢুকে কিছু বলার আগেই, তাদের দেখে, কোনোরকম অস্বস্তিভাব না দেখিয়েই, ‘কী আনন্দ, সহেলী দেখ কারা এসেছেন। আমরা কী লাকি, আসুন আসুন।’ বললেন চৌধুরী।

কার্পেটে, সিলিংয়ে বেলুন আর বেলুন দেখে তারা বিস্মিত। বাড়ির গেইট যখন খোলা হচ্ছিল এবং ড্রয়িংরুমের সামনে যখন তারা ছিলেন তখনো ভেতরে চলছিল গুলি আর কিছু একটা ফাটার ঠাশ ঠাশ শব্দ। মানুষের বাঁচার আর্তনাদ কারো কানে আসেনি। 

রুমে ঢুকেই একজন বললেন, ‘হাফিজভাই এ কী?’

পরপর কজনের প্রশ্ন : ‘ভাবি এ কি হচ্ছে?’ ‘কোনোদিন দেখিনি।’ ‘কেউ খুন হয়নি তো?’

তাদের চোখ চারদিকে ঘুরছে। সন্দেহভাব, বিস্ময়ভাব কাটছে না। দুজনই তো সুস্থ। পাগলামির ভাব কখনো ছিল, কেউ শোনেননি।

আগন্তুকরা এক আজগুবি ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছেন। কী বলবেন কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। রুমে গ্যাসের গন্ধ। দু-তিনজনের হাঁচি হলো। কয়েকজন বারবার নাক ডললেন। 

ফ্যানের পাখার ওপর থেকে গুলি খাওয়া বেলুনের দুটো প্লাস্টিক – হাঁ করা বাঘের ছবি, দৌড়াচ্ছে হরিণ – পড়লো একজন বড়ো কর্তার মাথার ওপর। ভয় পেয়ে মাথায় হাত দিলেন। প্লাস্টিক হাতে বাধতেই মুখে বোকা বোকা হাসি দেখা গেল।

 রুমে মাঝারি ভলিউমে বাজছে জাকির হুসেনের তবলা।

একজন বড়ো কর্তার চোখ পড়লো রুমের কোনায় একজন অতিরিক্ত হয়ে চুপচাপ বসে থাকা মোহন আলীর ওপর। এই বাড়িতে তিনি আগে যতবার এসেছেন কখনো এ রকম মানুষকে দেখেননি। পকেটের রিভলবারে হাত দিয়ে তিনি মোহন আলীর সামনে গিয়ে, চোখে সন্দেহ, প্রশ্নে সন্দেহ – ‘তোমার পরিচয়? এখানে কী করছো? কীভাবে আসছো?’ 

888sport app কর্তা, বিশিষ্ট ও হোমরাচোমরার সঙ্গে মিস্টার ও মিসেস চৌধুরী কথা ও হাসিঠাট্টায় ব্যস্ত ছিলেন বলে খেয়াল করেননি, একজন কর্তার জেরার মুখে পড়েছেন মোহন আলী।

‘আমারে হাফিজ স্যার গাড়ি দিয়া আনছেন। আমি বেলুনঅলা। স্যাররে জিগান?’ কণ্ঠে ভয়। কখনো কখনো ভয়কে তাড়াতে মানুষ জোরে জোরে কথা বলে।  

মিসেস চৌধুরীর কানে আসে মোহন আলীর কণ্ঠ। তিনি দ্রুত এগিয়ে যান। তাকে দেখেই মোহন আলী, ‘ম্যাডাম আপনারা তো আমারে গাড়ি দিয়া আনছেন না?’ বললেন।

বড়ো কর্তা মৃদু হেসে বললেন, ‘ওকে।’

অন্যদের দিকে যেতে যেতে মিসেস চৌধুরীকে বললেন, ‘এরা কিন্তু ক্রিমিনাল হয়। লোকটা চুপচাপ বসে সব মার্ক করছিল। তাকে দেখে আমার একটু সন্দেহ হলো, যার জন্যে তার সঙ্গে কথা বললাম।’  

এই বড়ো কর্তা এক বছর পর দেশ থেকে এক হাজার কোটি টাকা নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবেন। নিউজ হবে। হয়তো মোহন আলীর কান পর্যন্ত এই নিউজ আসবেই না। যদি-বা কেউ তাকে বলেও, মোহন আলীর কোনো প্রতিক্রিয়া হবে বলে মনে হয় না। বেলুন ফোলানো ও বিক্রি করা অনেক জরুরি কাজ। 

চৌধুরী সবাইকে বললেন, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মানুষকে গুলি করবো কেন? আমরা একটা ইনোসেন্ট, সিম্পল গেম খেলছি। বেলুনে গুলি করছিলাম। সিলিংয়ে অনেক বেলুন এখনো আছে। আসুন, দেখি কে কয়টা ফুটো করতে পারি। প্রতিটার জন্যে আছে বিশেষ গিফ্ট। সব বিদেশের।’

‘হোয়াট আ সেক্সি গেম।’

‘জীবনে কখনো খেলিনি। দেখিনি।’

‘নেভার আই হ্যাভ হার্ড অ্যাবাউট সাচ গেইম।’

‘লেটস এনজয়।’

দুজন হোমরাচোমরা, একজন বিশিষ্টজন ও একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্তার – জাতিকে ভাবাতে পারে, জাতিকে নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারে – মন্তব্য।

কয়েকটা রিভলবার ঘুরছে হাত থেকে হাতে। চলছে গুলি। 

সিলিং থেকে বিভিন্ন বেলুনের ছবিঅলা প্লাস্টিক হাফিজ-সহেলী ও রবাহূত অতিথিদের মাথা, কাঁধ, পেট ও পায়ের চকচকে জুতোর ওপর নিঃশব্দে পড়ছে। গুলি ও তাদের হাসির শব্দে মোহন আলীর কান ব্যথা করছে। ‘কান দ্যুডে নষ্ট হয়ে যাবি নাকি? এখেনতেন পালাবো ক্যেমনি করে?’

একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্তার টাক মাথার ওপর সিলিং থেকে রিটার্ন আসা একটা গুলি পড়লো। তার চোখেমুখে ভয়। নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে হবে। ‘রক্ত বের হয়নি তো?’

তবলার তালে তালে – ভঙ্গি নাচের – কয়েকবার বড়ো ভুঁড়ির শরীর ও দুই হাত দোলাতে দোলাতে ডান হাত, যেন নাচের সময় হাতের মুদ্রা, আঘাত লাগা জায়গায় বুলিয়ে আনলেন। কর্তার আঙুলে ভেজা ভেজা কিছু লাগেনি।

দুজন হোমরাচোমরার প্যারিস থেকে আনা উইগের ওপর গুলি পড়ে আটকে রইলো, আনন্দের বন্যায় ভেসে ছিলেন জন্যে টেরই পাননি।

গুলির পর্ব শেষ হলে একজন বিশিষ্টর চোখে – বিশিষ্টদের চোখ অন্যদের থেকে সবকিছু বেশি দেখে এবং তারা বিবৃতিবিশেষজ্ঞ – পড়লো একজন হোমরাচোমরার উইগে আটকে আছে গুলি। ‘গুলি, গুলি, মাথায়, মাথায়।’ বলে বিশিষ্টজন হাসতে হাসতে হোমরাচোমরার উইগ থেকে গুলিটা ধীরে ধীরে বের করলেন। রুমে হাসির একটা উৎসবভাব বয়ে গেল।

‘উইগটা খুলে দেখেন মাথায় আঘাত লেগেছে কি না।’ মিস্টার চৌধুরীর উদ্বেগ-কথা শুনে বললেন, ‘না না মাথায় লাগেনি। লাগলে টের পেতাম।’

উইগ পরা অন্য হোমরাচোমরা নিজের মাথায় হাত দিলেন। হাতে গুলি বাধলো। ‘হা হা হা আমার মাথাতেও একটা গুলি পড়েছে। এই যে, এই যে। টেরই পাইনি।’ সবার মুখে হাসি ঝলসে উঠলো। 

মোহন আলী, ক্যামেরা পারসন এবং ডমেস্টিক ওয়ার্কার ছাড়া ড্রয়িংরুমের সবাই মাথায় হাত দিলেন। মিসেস সহেলীর খোঁপার মধ্যে একটা গুলি আটকে ছিল। টাক মাথার কর্তা তার মাথায় পড়া গুলির কথা বললেন না।

‘এবার অন্য খেলা। খেলার আগে কি ডিনার করবো? নাকি পরে?’ মিস্টার চৌধুরীর প্রস্তাব শুনে একজন কর্তা পকেটে রিভলবার রাখতে রাখতে বললেন, ‘ডিনার পরে হবে।’  

‘এবার বাতাসে ফোলানো যেসব বেলুন কার্পেটের ওপরে আছে আমরা পা দিয়ে ফাটাবো।’ মিস্টার চৌধুরীর নতুন ঘোষণা আগন্তুকদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব আনন্দ-ভাব সৃষ্টি করলো। একজন কর্তা বললেন, ‘ব্রিলিয়ান্ট।’ সঙ্গে একজন বিশিষ্টজনের কথাও শোনা গেল, ‘ইনডিড।’

উৎসাহ যতপরনাস্তি। সবার ভঙ্গি প্রায় নাচের কিন্তু ভঙ্গি বেলুনের ওপর লাফ দিয়ে পড়ার। পায়ের তলায় বেলুন ফাটতেই, আসলে বদ্ধ বাতাস মুক্তি পেতেই, এক একজন বলছেন, স্বর উঁচু, ‘ফাটছে ফাটছে।’ যেন পৃথিবীতে বেলুন প্রথম ফাটলো। 

ফেটে যাওয়ার পরও কেউ কেউ দুই পা দিয়ে – যেন জন্মের আক্রোশ – পিষছিল নরম প্লাস্টিক। আক্রোশে পিষে দেওয়ার কারণ হতে পারে, একবারেই কেন ফাটাতে পারলাম না। কোনো কোনো কর্তা, হোমরাচোমরা, বেলুনে মারতে থাকে – ফুটবল খেলছে আর কী – লাত্থি। লাত্থি খেয়ে বেলুন একটু ওপরে উঠলেই রুম শুনছে হাসির শব্দ। 

খেলার মধ্যে আবার ঘোষণা এলো। দিলেন মিসেস চৌধুরী। মুখে বিনীত হাসি। ‘সিলিংয়ে আর কার্পেটের ওপর এখনো অনেক বেলুন আছে। ফ্যান ছেড়ে দাও। উড়ন্ত বেলুনে গুলি করা যাবে না।’

‘হোয়াট আ ক্রিয়েটিভ আইডিয়া’, একজন বিশিষ্টজনের মূল্যবান উক্তি।

চারটে ফ্যান ফুল স্পিডে ঘুরছে।

বাঘ-হরিণ-মেঘ-বৃষ্টি-নদী-পাহাড়-বড়ো বড়ো বিল্ডিং-পাখি-ঘুড়ি-গাড়ি-মানুষের হাস্যরত মুখ-ফুল-নদী-ময়ূর-বনভূমি-প্রজাপতি-হাতি-নতুন বউ-শিশুদের দল-পাহাড়পর্বত-সমুদ্রের ছবি আঁকা বেলুনগুলি একরকম ঝড়ো বাতাসে উড়ছে। দিকহারা।

বাঘের কানে ময়ূর, সমুদ্রে হরিণ, পাহাড়ের নিচে নতুন বউ, হাস্যরত মুখে বিল্ডিং, তরুণ-তরুণীর মুখে মেঘ, প্রজাপতির পাখায় হাতি, শিশুদের মাথায় গাড়ি, নদীতে বনভূমি পরস্পরকে শূন্যতার ভেতর অনবরত ধাক্কা দিচ্ছে। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। শব্দ নেই। দিকহারা। 

কখনো কখনো ক্যামেরার লেন্স বুঝতে পারছে না কোনটা বেলুন, মানুষের মাথা কোনটা।