ভাষান্তর : ওয়াহিদা নূর আফজা
গ্রাসিয়া ডেলেড্ডার জন্ম ১৮৭১ সালে ২৭শে সেপ্টেম্বর ইতালির সার্ডিনিয়ার নুওরোতে। তাঁর মৃত্যু ১৯৩৬ সালের ১৫ই রোমে।
ডেলেড্ডার জন্ম এক সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারে। তাঁর বাড়ির বৈঠকখানায় বসতো গল্পের আসর। কিশোরী গ্রাসিয়া উৎসাহ নিয়ে তা শুনতেন। সে-সময়ের ইতালির নিয়মানুযায়ী মেয়ে হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেয়েছিলেন চার বছরের। বাড়িতে গৃহশিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় মাত্র ১৩ বছর বয়সে পত্রিকায় প্রথম লেখা পাঠান। সহমর্মিতা এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি তাঁকে পারিপার্শ্বিক সামাজিক পরিবেশ এবং মানুষের অনুভূতি বুঝতে সাহায্য করেছে।
ডেলেড্ডা 888sport live footballে নোবেল 888sport app download bd পান ১৯২৬ সালে। ‘Mentre soffia il levante’ গল্পটি ১৯০৫ সালের দিকে লেখা। এটি পরে ইংরেজিতে ‘While the East Wind
Blows’ নামে 888sport app download apk latest version করেন অ্যান্ডার্স হ্যালেনগ্রেন।
প্রাচীন এক সার্ডিনিয়ান কিংবদন্তি অনুসারে, যারা বড়দিনের আগের দিন জন্মেছে, তাদের দেহ ধুলোয় মিশে যাবে না, বরং সময়ের শেষ পর্যন্ত অক্ষত থাকবে।
এমন বিষয় নিয়ে কথা বলাটা দিদ্দিনু ফ্রাউর বাড়িতে স্বাভাবিক একটি বিষয় ছিল। দিদ্দিনুকে সবাই চাচা বলে ডাকত। তবে এ কথায় আপত্তি জানালো তাঁর মেয়ের প্রেমিক প্রেদু তাসকা।
সে বলল, ‘কিন্তু কোন উদ্দেশ্যে? মরে গেলে এ-শরীরের আর কী প্রয়োজন আছে?’
‘হুম’, দিদ্দিনু বললেন, ‘শেষ বিচারের দিন ভাঙাচোরা অবস্থার থেকে একেবারে অক্ষত দেহে থাকতে পারাটা কী বেশি সম্মানের নয়?’
প্রেদুর ছিল তারুণ্যের অহংকার। দিদ্দিনুর কথাকে অতো আমল দেবে কেন সে? প্রেদু বলল, ‘এটি কী সত্যিই তেমন বড় কিছু?’
‘জামাই, চলো আমরা এই বিষয় নিয়ে একটা কবিগানের আসর বসাই।’
দিদ্দিনু একজন বেশ ভালো কবিয়াল। বংশানুক্রমিকভাবে বাপ-দাদার আমল থেকে এই পরিবারে কবিয়ালের প্রতিভা বইছে। প্রতিভা সবসময় প্রকাশের সুযোগ খোঁজে। তাই দিদ্দিনু একটা অজুহাত পেলেই কবিগানের আসর বসাতে চান। বিশেষ করে যখন দেখেন যে আশপাশে তাঁর থেকে আর তেমন ভালো কবিয়াল নেই।
মারিয়া ফ্রান্জিসকা এতোক্ষণ চুপ করে সব দেখছিল। এবার তার হবু বরের পক্ষে বলল, ‘এরকম একটা মন খারাপ-করা-বিষয় নিয়ে গান না করলে হয় না?’
‘তুমি এখানে কী করছ? যাও ভেতরে যাও।’ মারিয়ার বাবার কণ্ঠস্বর যথেষ্টই রুক্ষ ছিল।
একজন কবিয়াল হলেও দিদ্দিনু ছিল বুনো স্বভাবের, পরিবারে, বিশেষ করে তাঁর মেয়েদের সঙ্গে তাঁর আচরণ ছিল দয়ামায়াহীন। তাঁর পরিবার তাঁকে সম্মান করত, কিন্তু সবাই তাঁকে ভয়ও পেত। বাবার সামনে বাবার সামনে মারিয়া ফ্রান্জিসকা তার প্রিয় প্রেদুর কাছ ঘেঁষে বসার সাহসই করত না। একটা সামাজিক রীতি অনুযায়ী বাগদান হয়েছে এমন প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে কিছুটা দূরত্ব যেহেতু রাখতে হয় মারিয়া তাই একটু দূরেই বসেছিল। তবে নানা কামনাজাগানিয়া দেহভঙ্গিমায় সে প্রেদুকে আকর্ষণ করে যাচ্ছিল। মারিয়ার সবুজাভ-নীল কাঠবাদামের মতো চোখ ছিল মোহবিস্তারী। সেইসঙ্গে ছিল ফুলের কাজ করা গাঢ় লাল লেস-শোভিত কটি। তার মুখ সে ঢেকে রেখেছিল লেসের ঘোমটায়, নিজেকে প্রেদুর কাছে আরো রহস্যময়ী করে তোলার জন্য।
সময়টা ছিল বড়দিনের আগের সন্ধ্যাবেলা। বয়ে যাচ্ছিল মৃদুমন্দ পূবালী হাওয়া। সেই বাতাসে যেন মিশে ছিল একই সঙ্গে মরুভূমির উষ্ণতা আর সাগরের আর্দ্রতা।
উপত্যকার কাজুবাদামের গাছগুলি পূবালী হাওয়ায় ক্রমাগত দুলছে। তার থেকে খসে পড়ছিল আধফোটা কলির কিছু সাদা পাপড়ি। সেসব আবার দূরের পাহাড়ের সবুজ ঢালে ভেসে বেড়ান কুয়াশার মধ্যে মিশে এমন এক সুপ্ত আগুন কুণ্ডুলীর আবহ তৈরি করছিল যার ধোঁয়া তখনো দেখা যায়নি, কিন্তু উষ্ণতা অনুভব করা যাচ্ছিল। পাহাড়ের মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে মেঘেদের মেলা। তারা যেন পাখা মেলে দিয়েছিল আকাশ জুড়ে। ঠিক যেন সেই অদৃশ্য আগুনের ধোঁয়া।
শহরে তখন ভোজের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। লেভেন্টাইন বাতাসের মতো মানুষ জড়ো হচ্ছিল পথে-পথে, বাড়িতে-বাড়িতে – খ্রিষ্টের জন্মতিথি উদ্যাপনের উদ্দেশ্যে। পরিবারগুলির মধ্যে উপহারবিনিময় শুরু হয়ে গেছে। তারা পানাহারে মেতে উঠেছে শূকর ভাজা, ভেড়ার মাংস, মিষ্টি, কেক আর শুকনো ফলের সমাহারে। গোয়ালারা নিয়ে এসেছে তাদের গাভীর প্রথম দুধ। একটা প্রবাদ আছে, খালি পাত্র আদান-প্রদানে গাভীদের অমঙ্গল হয়। তাই গৃহিণীরা দুধ ঢেলে সেসব খালি পাত্র শাকসবজি বা অন্যকিছু দিয়ে ভরে দিচ্ছে।
প্রেদু তাসকারের ছিল একপাল শূকর। রীতি অনুযায়ী সে তার সবচেয়ে ভালো শূকরটি জবাই করে একটি ঝুড়িতে ভরেছে। তারপর সেই ঝুড়িটি আবার শূকরের রক্ত দিয়ে রঞ্জিত করে লিলি ফুল দিয়ে সাজিয়ে তার বাগদত্তাকে ভেট হিসেবে পাঠিয়েছে। বিনিময়ে মারিয়া সে-ঝুড়ি ফেরত পাঠিয়েছিল মধু আর বাদামের কেক বানিয়ে। সেইসঙ্গে যে-মহিলা এই ঝুড়িটি নিয়ে এসেছিল তাকে পারিতোষিক হিসেবে দিয়েছে পাঁচ লিরা মূল্যমানের রৌপ্যমুদ্রা।
সন্ধ্যার দিকে ফ্রাউর বাড়িতে এসে প্রেদু মারিয়ার হাত নিজের প্রশস্ত হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো। একঝলক বিদ্যুৎ তরঙ্গ যেন আবিষ্ট করল মারিয়াকে। সে শিহরিত হলো, আবার লজ্জাও পেল। খুব দ্রুত প্রেদুর হাতের বন্ধন থেকে নিজের হাত দুটো ছাড়িয়ে নিল মারিয়া। তারপরও সেই অবশ-করা স্পর্শ তাকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখলো। এখানেই শেষ নয়, তার জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। প্রেদু ইতোমধ্যে তার হাতে একটি স্বর্ণমুদ্রা গুঁজে দিয়েছে। এরপর মারিয়া সেখানে আর থাকেনি। সে ব্যস্ত হয়ে উঠলো অন্দরমহলের সবাইকে তার সদ্য পাওয়া উপহারটি দেখাতে।
বাইরে তখন ঘণ্টাধ্বনির ঐকতান। পুবের হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেল যেন ধাতব শব্দ। ভেঙে দিলো উষ্ণ ও বিষণ্ন সন্ধ্যার নিস্তব্ধতাকে।
প্রেদু পরেছিল ওই এলাকার জাতীয় পোশাক। সেই মধ্যযুগ থেকে এটি প্রচলিত। নীল মখমলের বেষ্টনী, সূক্ষ্ম কারুকার্যময় কালো উলেন কোট, কোমরে অলংকৃত চামড়ার বেল্ট এবং সঙ্গে সোনার তারের বোতাম। জলপাই তেল দিয়ে সযত্নে আঁচড়ান লম্বা কালো চুলে সে তার কান ঢেকে রেখেছিল এবং যেহেতু ইতিমধ্যে সে কিছুটা ওয়াইন পান করেছিল – তার চোখদুটি ছিল মদির, কালো দাড়ির মধ্যে লাল ঠোঁটগুলি যেন জ্বলছিল। ভরাট কণ্ঠস্বরের সুদর্শন প্রেদুকে অনেকটা স্থানীয় কোনো দেবতা বলেই মনে হচ্ছিল তখন।
‘বোনাস তারদাস’ আগুন-পোহানোর মেঝেতে, যেখানে তখনো একটি কাঠের গুঁড়ি জ্বলছিল, শ্বশুরের কাছাকাছি বসে প্রেদু বলল, ‘প্রভু আপনাকে আরো একশটি ক্রিসমাস উপহার দিক! কেমন আছেন?’
‘সেই বৃদ্ধ শকুনের মতো, যার থাবার আর কোনো জোর নেই’, বুনো বয়স্ক কৃষকের উত্তরটি ছিল এমনই। এরপর তিনি সেই বিখ্যাত শ্লোকটি বললেন : ‘বৃদ্ধ হয়ে গেলে মানুষ অদরকারি হয়ে পড়ে।’
এরকম টুকরো টুকরো কথাবার্তার মধ্যে দিয়েই তারা একসময় বড়দিনের আগের সন্ধ্যায় জন্মগ্রহণকারীদের অক্ষত দেহের সেই কিংবদন্তি গল্পে এসে পৌঁছেন।
‘চলো সমাবেশের দিকে যাই’, দিদ্দিনু বললেন। ‘ফিরে আসার পর, প্রথমে সবাই মিলে ভোজ উপভোগ করব, তারপর আমরা গান গাইবো!’
‘যদি আপনি চান আমরা আগেও গান গাইতে পারি।’
‘এখন নয়!’ পাথরের মেঝেতে লাঠি দিয়ে আঘাত করে দিদ্দিনু বললেন। ‘এই পবিত্র সন্ধ্যার স্থায়িত্বকালটুকুকে আমাদের সম্মান করা উচিত। এসময় মা মেরি প্রসব যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলেন, মাংস খেয়ে বা গান গেয়ে আমরা তা উদ্যাপন করতে পারি না। ওহে, শুভ সন্ধ্যা, মতিয়া পোর্তোলু! অনুগ্রহপূর্বক বসে থাকুন এবং যারা আসবেন তাদের বলুন, মারিয়া ফ্রান্জিসকা ভালো আপ্যায়ন করবে! ভেড়ার পালকে কিছু পান করতে দেওয়া হোক।’
একটু ঝুঁকে পড়ে রুবির মতো ঝকঝকে গ্লাসে মারিয়া প্রেদুকে পানীয় পরিবেশন করার সময় সে আরো মাতাল হয়ে গেল মারিয়ার হাসি আর আড়চোখের চাহনিতে। ইতিমধ্যে আরো নিমন্ত্রিত এসে পৌঁছেছেন।
আগুন পোহানোর মেঝেটা চারটি পাথর দিয়ে ঘিরে হেঁশেল থেকে আলাদা করা ছিল। এর একপাশে পুরুষেরা গল্প-গুজব করছিল আর আরেক পাশে মহিলারা নৈশভোজ তৈরিতে ব্যস্ত। প্রেদুর পাঠানো শূকরটিকে একটি বড় পাত্রে চড়িয়ে কষানো হচ্ছিল। এটির রান্না তখনো মাঝপথে। আর তাতেই ম-ম গন্ধে চারপাশের বাতাস ভরে উঠেছিল।
এবার দুজন প্রবীণ আত্মীয় এলেন। এ-দুজন ছিলেন আপন দুই ভাই, যাঁরা সম্পত্তি ভাগাভাগির ঝামেলা এড়ানোর জন্য বিয়েই করেননি। ঝাঁকড়া বাবড়ি চুল আর সফেদ দাড়িসমেত তাঁদের দেখতে গোত্রপ্রধানের মতো লাগছিল।
এরপর একজন অন্ধ তরুণ এলো। করবী গাছের সরু লাঠিতে ভর দিয়ে মেঝেতে ঠক-ঠক করে একটু একটু করে সামনে এগোতে লাগলো সে।
সেই দুই ভাইয়ের একজন মারিয়ার কোমর ধরে প্রেদুর দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে তোমাদের? স্বর্গের নক্ষত্রের মতো দুজন দুজনের থেকে এতো দূরে অবস্থান করছো কেন? একজন আরেকজনের হাত ধরো, জড়িয়ে ধরো…’
এই হবু দম্পতির মধ্যে তখন কামনার স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠলো। এ সময় দিদ্দিনু গর্জে উঠলেন :
‘বুড়ো রামছাগল! ওদের শান্তিতে
থাকতে দাও। ওদের তোমাদের পরামর্শের কোনো দরকার নেই।’
‘সেটা জানি, এবং আরো জানি যে, তাদের তোমার পরামর্শেরও কোনো দরকার নেই! ওরা নিজেরাই নিজেদের গুরু।’
‘যদি তাই হতো’, দিদ্দিনু বললেন, ‘তাহলে অনেক আগেই আমি এই যুবককে একটি ভিমরুলের মতো তাড়িয়ে দিতাম। মারিয়া ফ্রান্জিসকা, আমার গ্লাস পূর্ণ করে দাও।’
কিছুটা অপদস্তের মতো মারিয়া সেই প্রবীণের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল।
নিজের পশমের টুপিটি ঠিক করে নিয়ে হাস্যোচ্ছলে প্রেদু বলল, ‘আচ্ছা, আমরা এখন খেতে পারবো না, গান গাইতে পারবো না, এমনকি কিছুই করতে পারবো না … পান করতে তো পারবো?’
‘তুমি যা চাও তাই করতে পারো, কারণ স্রষ্টা মহিমান্বিত’, হবু জামাইয়ের পাশে বসা অন্ধ লোকটি বিড়বিড় করে বলে উঠলেন। ‘স্বর্গে ঈশ্বরের মহিমা আর পৃথিবীতে শান্তি বর্ষিত হোক সকল মহিমান্বিত মানুষের ওপর!’
এভাবেই তারা ক্রমাগত পান পাত্রের মদিরতায় ডুবে যাচ্ছিল।
প্রেদু তার গ্লাসে ছোট ছোট চুমুক দিতে থাকলো।
বাইরে তখন ঘণ্টা বাজছে। হাসিকান্না মিশ্রিত আনন্দের উৎফুল্লতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এগারোটার দিকে সবাই মধ্যরাতের প্রার্থনায় জড়ো হলো। বাড়িতে রইলো শুধু দাদিমা। তিনি তাঁর অল্প বয়সে জেনেছিলেন যে, এই পবিত্র সন্ধ্যায় মৃত আত্মারা তাদের আত্মীয়দের বাড়িতে ফিরে আসে। এই কারণে প্রাচীন রীতি অনুযায়ী মৃতদের জন্য একটি পাত্রে কিছু খাবার সাজালেন আর একটি মাটির জগ মদে পূর্ণ করলেন। এখন পর্যন্ত এ-নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাননি তিনি। বাড়ি খালি হওয়া মাত্রই তিনি মদপূর্ণ গ্লাস এবং খাবারের পাত্র বাড়ির বাইরে একটি সিঁড়ির ওপর রেখে এলেন। সিঁড়িটি উঠোন থেকে দোতলার কামরা পর্যন্ত উঠে দিয়েছিল।
একজন গরিব প্রতিবেশী, যিনি বৃদ্ধার এই অভ্যাসটি জানতেন, তিনি খামারবাড়িটির ঘোরানো দেয়াল বেয়ে সেই খাবার আর মদ সাবাড় করে দিলেন।
প্রার্থনা থেকে ফিরে আসার পর তরুণ-বৃদ্ধ সকলেই খুব উৎসাহ নিয়ে ভোজের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। বসলেন মেঝেতে বিছানো বড় বড় পশমের গদির ওপর। এসব গদি ঘরে বোনা কাপড় দিয়ে মোড়ান ছিল।
লাল-হলুদ মাটির পাত্রে ধূমায়িত ম্যাকারনি পরিবেশন করা হলো। প্রেদু খুব দক্ষতার সঙ্গে একটি তক্তার ওপর ভাজা শূকরটি ছড়িয়ে দিলো। সবাই মেঝেতে বিছানো মাদুর আর গদির ওপর বসে পড়লো, ঘর-উনানের প্রদীপ শিখা একে একে জ্বলে উঠলো; অতিথিদের মুখে এর লালচে আভার ঢেউ আছড়ে পড়লো; দৃশ্যটি যেন হোমারীয়। তারা এখন সুরা পানে ব্যস্ত।
ভোজের পর কর্তার ইচ্ছায় মহিলাদের অন্দরমহলে চলে যেতে হলো। পুরুষেরা এবার মেঝের চারপাশে আরাম করে বসে গাইতে শুরু করলো। তাদের মুখ ছিল রক্তিম আর চোখগুলি অবসন্ন কিন্তু দীপ্তিময়। এবার কৃষক কর্তা গানের লড়াই শুরু করলেন :
ওহে আমার হবু জামাই
বলো তো কোনটা বেশি ভালো
মাত্র তিন ছটাকের ধুলোবালি
নাকি শেষ বিচারের দিনের অক্ষত হাল?
নিজের টুপি ঠিক করে নিয়ে প্রেদু এবার উত্তর দিলো-
তারপরও আমরা গান গাই
এটি জেনেই যে-বিষয়টি খুব গভীর ভাবনার;
আমাদের নৈবেদ্য প্রেম, আনন্দ আর সৌন্দর্যের
কিংবা মাধুর্য বা নান্দনিকতার।
কৃষক কর্তা ছাড়া আর সবাই এই প্যাগান স্তবকে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। প্রবীণ কবি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ছন্দে ছন্দে জবাব দিলেন যে, তাঁর প্রতিপক্ষ উত্তর দিতে চায় না, কারণ সে নিজেকে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে মোকাবিলা করার যোগ্য বলে মনে করে না।
আবারো প্রেদু তার টুপিটি ঠিক করে নিয়ে সার্ডিনিয়ান শ্লোকে উত্তর দিলো –
ঠিক আছে, কর্তার ইচ্ছায়ই কর্ম। স্পর্শকাতর হওয়ায় এই বিষয়টি আমাকে অতোটা আকর্ষণ করে না; আজকের এই আনন্দময় সময়ে আমি জীবনের কথা ভাবছি, মৃত্যুর কথা নয়। তারপরও আপনি চাইছেন বলে বলছি : আমাদের দেহ ধূলিসাৎ হবে নাকি অক্ষত থাকবে তা আমার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। মরে গেলে আমরা আর কী? কিছুই না। অপরিহার্য হলো জীবিত দেহটিকে সুস্থ এবং সতেজ রাখা, যাতে আমরা কর্মক্ষম থাকতে পারি এবং জীবনকে উপভোগ করতে পারি। আমার আর এর থেকে বেশি কিছু চাওয়ার নেই।
প্রৌঢ় কৃষকও উল্টোদিকে তির্যক বাণ মারতে থাকলেন। প্রেদুও খুব ধীরস্থিরভাবে আনন্দের সঙ্গে তা বারবার প্রতিহত করে গেল। প্রৌঢ় দুই ভাই খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, অন্ধ লোকটিও সমর্থন জানিয়ে গেল প্রেদুকে। বাইরে বাইরে একটু রাগান্বিতের ভান করলেও নিজের হবু জামাইয়ের কবি-প্রতিভা দেখে দিদ্দিনু ভেতরে ভেতরে বেশ গর্ববোধ করতে লাগলেন। এটি এখনই বলে দেওয়া যায় যে, এই পরিবারের মহিমান্বিত ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।
দেহ আর ভোগের অসারতাকে গুরুত্ব দিলেও দিদ্দিনু চাচা নিজেও খুব পান করছিলেন আর অন্যদেরও তা করতে উৎসাহিত করছিলেন। ভোর তিনটার দিকে সবাই প্রায় নেশাগ্রস্ত,
শুধু দুজন ছাড়া। অন্ধলোকটি পান
করে না আর প্রেদু তার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়নি।
কিন্তু প্রেদু তখন গানের নেশায় বুঁদ হয়ে ছিল, সময় যতই গড়াচ্ছিল, মারিয়া ফ্রান্জিসকাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে করে ততোই সে পুলকিত বোধ করছিল। ধীরে ধীরে সব গায়কের কণ্ঠ স্তিমিত হতে থাকলো; বৃদ্ধের কণ্ঠ তো পুরোপুরি জড়ানো; যুবকেরা ঘুমের ভান করে পড়ে রইলো। অবশেষে সবাই ঘুমিয়ে গেল, শুধু অন্ধলোকটি বসে বসে তার ছড়ির মধ্যে কোথায় অসমতা আছে তা আঙুল দিয়ে পরখ করতে লাগলো।
হঠাৎ গৃহপ্রাঙ্গণ থেকে মোরগ ডেকে উঠলো। প্রেদু চোখ খুলে অন্ধলোকটিকে দেখতে পেল।
‘সে তো আর আমাকে দেখতে পাচ্ছে না’, এমনটা ভেবে নিয়ে খুব সন্তর্পণে উঠে ভেতরের দিকে চলে গেল প্রেদু।
মারিয়া ফ্রান্জিসকাও চুপিসারে মই দিয়ে নিচে নেমে এসে প্রেদুর বাহুতে নিজেকে সঁপে দিলো।
অন্ধলোকটি কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারলো কেউ একজন এখান থেকে উঠে ভেতরের দিকে গেছে এবং সেটি নিশ্চিত প্রেদু। একই জায়গায় ঠায় বসে থেকে সে শুধু বিড়বিড় করে বলল, ‘স্বর্গে ঈশ্বরের মহিমা আর পৃথিবীতে শান্তি বর্ষিত হোক সকল মহিমান্বিত মানুষের ওপর।’
বাইরে তখনো সফেদ মেঘের আড়ালে চাঁদ জেগে রয়েছে এবং এই রুপালি রাতে সাগরের ঘ্রাণ আর মরুভূমির উষ্ণতার মিশেলে পূবালী হাওয়া বয়ে চলেছে।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.