মুনতাসীর মামুন
মারুফ আমার যৌবনের বন্ধু। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মারুফ চারুকলার। আমরা যাঁরা লেখালেখি করতাম, যারা ছবি অাঁকত, যাঁরা অভিনয় করত, তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। প্রবাসী পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৭৫। আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি। একসঙ্গে একটি রাষ্ট্রের জন্য সংগ্রাম করেছি, একটি রাষ্ট্রের জন্ম দেখেছি, রাষ্ট্রটি বিকশিত হতেও দেখেছি। এক জীবনের এতকিছু, এত অভিজ্ঞতা, সত্যিই আমাদের জেনারেশন ভাগ্যবান।
১৯৭২ সালে বিধ্বস্ত দেশ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও আমাদের সাংস্কৃতিক সজীবতা অক্ষুণ্ণ ছিল। সংস্কৃতির সব শাখায় নতুন কিছু করার জন্য সাড়া পড়ে গেল। মারুফ তখনই বন্ধুদের মধ্যে খ্যাতিমান অভিনেতা এবং বেতার888sport live chatী হিসেবে। তাঁর বাবা ছিলেন শক্তিমান অভিনেতা ইনাম আহমেদ। হ্যাঁ, চারুকলার ছাত্রও ছিলেন তখন, কিন্তু সে-পরিচয়টা ছিল যেন গৌণ। জীবনের একসময় সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সত্যিই জীবনটা নিয়ে আমি কী করতে চাই। চারুকলার পাঠশেষে মারুফও সে-জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, চারুকলাই হবে তাঁর জীবনের ধ্যানজ্ঞান। জার্মানি পাড়ি দিলেন তিনি। ইতোমধ্যে তাঁর দুই বন্ধুর সঙ্গে জলরঙের একটি প্রদর্শনীও করলেন।
সেই সময় আরো অনেক তরুণ 888sport live chatকলা ও রুটি-রোজগারের খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সবাই যেতে চায় প্যারিস, তিনি কেন গেলেন জার্মানি, জানি না। প্রায় দেড় যুগ নাকি এক যুগ আগে জার্মানির তৎকালীন রাজধানী বনে মারুফের সঙ্গে দেখা। আমি একটু অবাক হই, বনে রাইনের তীরে তার ছিমছাম ফ্ল্যাট, কোলনে বিশাল স্টুডিও দেখে। আরো অবাক হই যে, বনের মতো শহরে ছবি এঁকেই তিনি জীবন নির্বাহ করছেন। মুক্তিযুদ্ধের সেই যে স্পিরিট হার-না-মানা, তা তখনো অটুট। মনে রাখতে হবে, এক বাঙালি তরুণ সহায়-সম্বলহীনভাবে জার্মানি পৌঁছে শুধু ছবি এঁকে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, একটি 888sport live chatকলার প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনাও করছেন। কোলনে তাঁর দুরকমের ছবিই দেখেছি। কিছু ফিগারেটিভ, কিছু দেশজ নিসর্গের ক্যানভাস, তারপর বিমূর্তায়নের ঝোঁক এবং সবশেষে শুধু অনুভব, বিমূর্ত। এর পরপরই ১৯৯৮ সালে 888sport live chatকলায় মারুফের এক বিশাল প্রদর্শনী হয়। 888sport apps থেকে জার্মানি যাওয়ার পর এটিই ছিল দেশে তাঁর প্রথম প্রদর্শনী।
পনেরো বছর পর বেঙ্গল 888sport live chatালয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো মারুফের একক প্রদর্শনী (২০১২)। এ-প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে তাঁর গত এক দশকের চিত্রকর্ম। মারুফ যেভাবে অাঁকছিলেন তা থেকে কতটা এগোলেন।
একটি বিষয় বলে নেওয়া ভালো। আমাদের এখানে যাঁরা প্রথিতযশা 888sport live chatী তাঁদের ছবিতে বিষয়, উপস্থাপন, মাধ্যমের পরিবর্তন আছে। যাঁরা নিয়মিত ছবি দেখেন, তাঁদের কাছে এই বদলগুলো স্পষ্ট। তাঁদের অধিকাংশের নিজস্ব এক নির্মাণশৈলী গড়ে উঠেছে, যা তাঁদের স্বকীয়তা নিশ্চিত করেছে। যাঁরা প্রবাসে, তাঁদের কাজে সামগ্রিকভাবে সে-পরিবর্তনগুলো ঘটেনি, ঘটলেও তা সুপ্ত বা অনুপস্থিত। এর কারণ আমার জানা নেই। তবে বাজার একটি কারণ হতে পারে।
আরো অনেক তরুণের মতো মারুফ অ্যাকাডেমিক পরিবেশে এগিয়েছেন। অ্যাকাডেমিক চর্চাটা জরুরি নয়, তবে তার খানিকটা সীমাবদ্ধতা আছে। মারুফ জার্মানিতে গিয়েও অ্যাকাডেমিক পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন; কিন্তু সে-পরিবেশে নিজেকে সমর্পণ করেননি। প্রথমে ফিগারেটিভ ছবি দিয়েই যাত্রা শুরু, 888sport appsের বিষয়, তারপর দেখা যায় ফিগার বিলীয়মান, ইউরোপের মনন প্রভাবিত করছে তাঁকে, স্বাভাবিকভাবেই এবং একসময় তাঁর ক্যানভাসে শুধু বিমূর্তায়নের চর্চা।
নির্বস্ত্তক ছবি বোঝার চেষ্টা কখনো করি না। 888sport live chatী কী বলতে চেয়েছেন তাও বোঝার চেষ্টা করি না। 888sport live chatীর অনুভবেরটা অনুভব করতে পারি কিনা সেটাই হয়ে ওঠে বিবেচ্য।
মারুফ যখন তাঁর ক্যানভাসের স্পেস ভরাটে সচেষ্ট হন, তখন মূলত রংই প্রধান হয়ে ওঠে। রংই যেন সৃষ্টি করে ফর্ম। স্পেস মূলত নিয়ন্ত্রণ করতে চান রং দিয়ে। আমি আমার বন্ধু সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে একমত যে, মারুফের ছবি মানেই ‘ডায়নামিক ফর্ম, উজ্জ্বল রং, স্পেসের অন্তর্মুখী বিস্তার, রেখার সীমাহীন স্থিতিস্থাপকতা’। এটিই সারাৎসার। এই বক্তব্য আরো দীর্ঘায়িত করা যায়। কিন্তু মূলত কথা সেই একই থেকে যায়।
অন্তর্মুখী মারুফের মনে এক দ্বন্দ্ব এখনো কাজ করছে যা উপস্থিত তাঁর ছবিতে। দেশ ছেড়ে চলে গেছেন বটে, কিন্তু এখন জেনারেশনের অভিবাসীর মতো, দেশ সবসময় সঙ্গে থাকে। শাহাবুদ্দিন এক চমৎকার উদাহরণ। কিন্তু দীর্ঘদিন ইউরোপে থাকলে তার একটা প্রভাবও পড়ে, সেই মননে অনেকে আচ্ছন্ন হয়ে যান, যেমন মনিরুল ইসলাম। তিনি আত্মস্থ করেছেন ইউরোপীয় সংস্কৃতি। মারুফের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। ফলে তাঁর ক্যানভাসজুড়ে মোটা দাগে রঙের প্রপাত। তাঁর ছবির সামনে দাঁড়ালে মনে হয়, রঙের প্রপাতের সঙ্গে দাঁড়িয়ে, শোনা যায় সেই প্রপাতের নিনাদ এবং তা একসময় আচ্ছন্ন করে ফেলে সত্তা। তাঁর রং এক অর্থে দেশীয়। যেমন, এদেশের প্রাথমিক রঙের পাশাপাশি অবস্থান। মারুফের উপস্থাপনে এভাবে দেশের নির্যাস আর ইউরোপীয় মননে তৈরি হয় টেক্সচার, ফর্ম, রেখা।
এই দ্বন্দ্ব প্রতিফলিত হয় ক্যানভাসে, তাঁর ছবি আপাত স্থিত নয়, অস্থির। আবার সম্পূর্ণ বিমূর্তায়নে থাকবেন, নাকি পুরনো ফিগারেটিভে ফিরবেন – সে-দ্বন্দ্বও পরিস্ফুট অনেক চিত্রে, যখন দেখি বিমূর্তায়নেও ফিগারেটিভের অস্পষ্ট ছায়া। মারুফ যখন রঙের পর রং প্রতিস্থাপন করেন, তখন তিনি দেখার চেষ্টা করেন তাঁর প্রতিক্রিয়া বা ক্রিয়া। এবং সেই গতিই তাঁকে টেনে নিয়ে যায়, অন্যকিছু গৌণ হয়ে পড়ে।
এক যুগ আগে মারুফের যে-প্রদর্শনী হয়েছে তা থেকে এ-প্রদর্শনী একেবারে ব্যতিক্রমী কিছু নয়। প্রবাসী 888sport live chatী যাঁরা কিছুদিন পরপর এখানে প্রদর্শনী করেন, তাঁদের ছবিতে একধরনের সাযুজ্য আছে। একটি পর্যায়ে এসে তাঁরা স্থিত, খানিকটা ব্যতিক্রম হয়তো থাকে কখনো কখনো। এদিক থেকে যাঁরা দেশেই আছেন, তাঁরা নিয়ত ভাঙছেন, গড়ছেন, পালটাচ্ছেন। সৃজনশীলতার চর্চাটা বেশি। মারুফ খুব পালটেছেন এক যুগে তা বলব না। তবে খানিকটা পালটেছেন। সেটি পরিস্ফুট আবার রঙের বিন্যাস ও ব্যবহারের দিকে। প্রাথমিক রঙের পাশাপাশি হালকা নীলঘেঁষা ফিরোজা বারবার উঁকি দেয়, ক্যানভাসটিকে খানিকটা পেলব করে দেওয়ার জন্যই বোধহয়।
একজন চিত্রকরের ক্যানভাসের অনেক সমালোচনা করা যায়। আমি তার মধ্যে যাব না। ভালো ছবির একটি মাপকাঠি হলেও হতে পারে, ছবিটির সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি কিনা ক্ষণিক। মারুফের ছবির সামনে আমি দাঁড়াই ক্ষণিক, দেখি রঙের প্রপাত, সেই প্রপাতের নিনাদে আচ্ছন্ন হই।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.