রন্ধ্রপথের জীবনদৃষ্টি

মহি মুহাম্মদ

 

বিশ্বজিৎ চৌধুরীর 888sport alternative link ফুটো শুরু হয়েছে অন্ধকার নির্জন কারাকক্ষে এক টুকরো আলোর বর্ণনা দিয়ে। দেয়ালের একটি ফুটো দিয়ে সেই আলো এসে মোমিনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। ইচ্ছা করলে মোমিন এ-যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পেতে পারে; কিন্তু সেটা কোনো ব্যাপার নয়! সে একজন সন্দেহভাজন খুনি। অপরাধী হিসেবে কারাগারে বন্দি। তার মামলা বিচারাধীন। যেভাবে তার মামলাটি এগোচ্ছে, তাতে সন্দেহ হয়, যে-কোনো দিন ফাঁসির আদেশ হয়ে যাবে। কিন্তু তার আগেই জেলখানায় ‘দামি’ কয়েদি সেলিমের হাতে নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছিল সে। বিনা প্রতিবাদে সেলিমের জোর-জুলুম মেনে নিচ্ছিল বলে মোমিনুলের ‘খুনি’ পরিচয়টা কয়েদিদের কাছে সংশয়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে একদিন দুপুরে খাবার দিতে আসা কারারক্ষীদের হাত থেকে আচমকা লম্বা হাতলওয়ালা চামচটি কেড়ে নিয়ে এর আগায় বড়সড় বাটিসদৃশ লোহার পাত্রটি সজোরে বসিয়ে দিয়েছিল সেলিমের মাথায়। এতে সেলিমের মৃত্যুও হতে পারত, হয়নি। তারপর থেকে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে ‘ড্যাঞ্জারাস’ বলে আলাদা কক্ষে সরিয়ে নিল।

নির্জন কারাপ্রকোষ্ঠে দেয়ালের ফুটো দিয়ে একফালি আলোর উপস্থিতি দিয়ে যে-888sport alternative linkটির শুরু, পরে আমরা দেখতে পাব, সেই ছোট্ট ফুটোর বড় তাৎপর্য আছে আখ্যানে বা এর মূল চরিত্র মোমিনুলের জীবনে।

একটি খুনের দায় কেন নিতে হলো মোমিনকে, সেটি ঘটনা-পরম্পরায় প্রায় গোয়েন্দা কাহিনির মতো টানটান। তবে শুধু কাহিনি-বর্ণনাই লেখকের অভিপ্রায় নয়, একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে তার চারপাশের সময় ও সমাজ উঠে আসে এখানে। আশির দশকের চট্টগ্রাম শহরের একটি টিপিক্যাল মহল্লার জীবনযাত্রা, হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির ছবি যেমন, তেমনি সন্দেহ-অবিশ্বাস-বিভেদের সম্পর্কগুলোও শনাক্ত করার চেষ্টা করেছেন লেখক। পাশাপাশি সে-সময়টায় দেশ জুড়ে যে রাজনৈতিক ডামাডোল, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাপ, তার আঁচও লাগে পাঠকের মনে। মোমিনুলের বন্ধু ছাত্রলীগ নেতা অলোক রাহার খুন হয়ে যাওয়ার ঘটনা থেকে ছাত্ররাজনীতির অন্তর্কোন্দল বা ওপরের সারির নেতাদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ছাত্রদের ব্যবহৃত হওয়ার বাস্তবতাও সাংবাদিকের অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে তুলে আনেন বিশ্বজিৎ।

আলকরণের মোহাম্মদ আলী চেয়ারম্যান ও গুলনাহারের ছেলে মোমিনুল। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। বড়ভাই প্রবাসী।

কলহ-জর্জর পরিবারের সৎভাই ও মাকে ঘর ছেড়ে দিয়ে ভাড়া বাসায় উঠে এলো মোমিনুল। সে-বাসায় এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় দেয়ালে একটা ফুটো আবিষ্কার করে মোমিনুল। সেই ফুটোতে চোখ রেখে সে বিস্মিত। পাশের বাসায় থাকে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান খ্রিষ্টান পরিবার। ডেভিড, তার স্ত্রী অ্যাঞ্জেলিনা আর শ্যালিকা মেরি। মোমিন তার জীবনের নিদারুণ কষ্টের মধ্যে ফুটোতে চোখ রেখে এক পশলা শান্তির পরশ পায় যেন। মেরির তারুণ্যভরা সৌন্দর্য দেখে আপ্লুত হয় সে। শুধু তাই নয়, আড়াল থেকে মোমিন দুটো অস্বাভাবিক ঘটনার সাক্ষী হয়। এ-দৃশ্য বাকি জীবনে ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না তার।

মেরির প্রতি দুর্মর এক আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল মোমিনুলের; কিন্তু চমকটা ছিল আরো পরে। একসময় সে আবিষ্কার করল, সে আর মেরি একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। অফিসের বড় সাহেবের পিএস তার প্রতিবেশী মেরি, ম্যারিয়েন ডি কস্টা। মেরির প্রতি তার ঊর্ধ্বতনের এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব বা দুর্বলতা রয়েছে বলে চালু ধারণা আছে অফিসের কর্মীদের মধ্যে। অফিসে মেরির সঙ্গে মোমিনের পরিচয় হওয়ার পর প্রায়ই বাড়ি ফেরার পথে তারা একসঙ্গে আসে।  নানা বিষয় নিয়ে কথা বলে। ব্রিজঘাটায় গিয়ে বসে। মেরির সহজ-স্বচ্ছন্দ আচরণ মোমিনের আড়ষ্টতা কাটিয়ে দেয়। এরকম আলাপচারিতার একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করা যেতে

পারে –

‘জানো তো, এই অফিসে দু-একটা দরকারি কাজ ছাড়া আমার সঙ্গে কেউ কথা বলে না। কথা বলা দূরে থাক, ভালো করে তাকায় না পর্যন্ত, চোখে চোখ পড়লে এমনভাবে সরিয়ে নেয়, যেন আমার দিকে তাকানোটা বিরাট একটা অন্যায়।’

মোমিন হাসে, ‘আসলে নার্ভাসনেস। তোমার মতো সুন্দরী স্মার্ট মেয়ের সঙ্গে কথা বলবে কি, তাকাতেই নার্ভাস লাগে।’

‘যাহ্, ইউ আর জাস্ট ফ্লার্টিং মোমিন, আমি এমন কিছু সুন্দরী না যে তাকাতে নার্ভাস লাগবে। তোমার লাগে?’ মহাবিপদে পড়ে গেল মোমিন। মেয়েটার প্রগলভতা সত্যি তাকে বিব্রত করে দেয়।

‘কাম অন লুক অ্যাট মি।’

মোমিন চোখ তুলে তাকাতেই সোল্লাসে মেরি বলে উঠল, ‘আরে তাই তো, তোমাকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছে। আই মাস্ট বি প্রিটি দেন।’

এভাবে প্রতিবেশী বা সহকর্মীর পরিচিতি ছাপিয়ে দুজনের সম্পর্কটা প্রায় বন্ধুত্বে রূপ নেয়। এসব দেখে মোমিনুলের এক কলিগ বলে বসে, সে অনেকদূর যাবে। কারণ অফিসের সবচেয়ে ‘পাওয়ারফুল’ মানুষের সঙ্গে তার ভাব রয়েছে। মোমিনুলের ক্ষেত্রে কাকতালীয়ভাবে ঘটেও তাই। এক বছরের মাথায় তার প্রমোশন আর বেতন দ্বিগুণ হয়ে যায়। মেরির সঙ্গে ধীরে ধীরে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়তেই থাকে, মেরিকে ঘিরে একটা স্বপ্নকল্পনারও বিস্তৃতি ঘটে মোমিনের মনে। আসলে মেরির কথাবার্তা ও আচরণের মধ্যেই ছিল তার প্ররোচনা।

‘… জানো তো, খ্রিষ্টান আর মুসলমানের বিয়ে হলে কনভার্ট হতে হয় না।’

‘তাই নাকি, কেন?’

‘যেসব ধর্মের আসমানি কিতাব আছে, তাদের ইন্টার-রিলিজিয়ন ম্যারেজে ধর্মান্তরিত হতে হয় না।’

আশ্চর্য, কত কিছু জানে মেরি, কী করে যে জানে আল্লাহ মালুম। কিন্তু এসব কথা তাকে বলছে কেন?

এই ‘কেন’টাই বিভ্রান্ত করেছিল মোমিনকে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আশাহত হয় মোমিন। কারণ একপর্যায়ে মেরি নিজের মুখেই কাজিন এলেন রিবেরুর সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছে। এবং এক রোববার চার্চে আসতে বলেছে; মোমিনুলকে পরিচয় করিয়ে দেবে এলেনের সঙ্গে। এরপর মোমিন বিমর্ষ সাক্ষী হয়েছে মেরি ও রিবেরুর প্রেমের। মেরি তখন টগবগ করে ফুটছে এলেনের প্রেমে। সেখানে কোনো কোনো দিন কাবাবের মধ্যে হাড্ডি হওয়ার জন্য জোর করে মোমিনকে নিয়ে গেছে মেরি। মোমিন ভেবে পায় না, এটাকে সে কী বলবে? এটা কি মেরির বিকৃত কোনো ইচ্ছা? তাকে নিয়ে রিবেরুর বাসায় যাওয়া, তাকে বসিয়ে রেখে অন্যঘরে রিবেরুর সঙ্গে হাসি-তামাশার নাম কী? তাই একদিন মোমিনুল খেপে গিয়ে বলেই ফেলেছিল – ‘আমার কাজ আছে কি নেই সবই তুমি জানো? তা ছাড়া কাজ না থাকলে আমি বিছানায় গড়াগড়ি দেব, পথে পথে ঘুরব… তোমার সঙ্গে যেতে হবে কেন?’

হতভম্ব হয়ে পড়েছিল মেরি। লেখকের মন্তব্য, ‘পোষাপাখি বেসুরো গাইলে যা হয় আর কী!’ কিন্তু মোমিন যেমন আকস্মিক উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, তেমনি আবার দ্রুত সামলেও নিয়েছে। মেরির সঙ্গে অন্তত সান্নিধ্যের তাৎক্ষণিক প্রাপ্তিটুকু উপেক্ষা করতে পারেনি। অন্যদিকে ক্যারিয়ার নিয়ে এলেনের হতাশা, মাদকাসক্ত হয়ে পড়া ইত্যাদি ঘটনা-পরম্পরা মেরির সঙ্গে তার প্রেমিকের সম্পর্কে ফাটল ধরে। পুনরায় তার একমাত্র আশ্রয় হয়ে ওঠে মোমিন।

মেরি ও মোমিনের সম্পর্কসূত্রে পাঠকের কাছে এদেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের, বিশেষত অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের, জীবন সংবেদনশীলতার সঙ্গে তুলে ধরেন লেখক। এদেশে পর্তুগিজদের আগমন, দস্যুতা বা ধর্মপ্রচার, স্থানীয়দের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে উত্তরসূরি সম্প্রদায়ের বিকাশের দিকগুলো উঠে আসে 888sport alternative linkে; কিন্তু ইতিহাসের তথ্য কখনো ভারাক্রান্ত করে না আখ্যানের গতি। বরং ঝরঝরে, কিন্তু ব্যঞ্জনাময় ভাষা পাঠকের আগ্রহ ও কৌতূহলকে সজীব রাখে পরিণতি পর্যন্ত।

মেরি খুন হয়। সন্দেহের তির ছোটে মোমিনুলের দিকে, এলেনও থাকে সন্দেহের তালিকায়। কিন্তু আসল খুনি ধরা পড়ে না। মোমিনুল জেল খাটে। মুক্তি পায়। সে আসল খুনিকে খোঁজে। সেখানেও মোমিনুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, মেরিকে আসলেই কে খুন করেছে। রহস্যের অন্তর্জালে শুধু মোমিন নয়, জড়িয়ে যাবেন পাঠকও। বোধ ও বোধের ঘরে বাস্তবতার মুখোমুখি একা মোমিন নয়, তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে যাবেন পাঠকও। এই দুইয়ের ঘেরাটোপে যার যার মতো করে গন্তব্য খুঁজে নিতে হবে।

বিশ্বজিৎ চৌধুরীর নার্গিস (২০১৪), বাসন্তী, তোমার পুুরুষ কোথায়? (২০১৫), হে চন্দনা পাখি (২০১৬), দূর-সম্পর্ক (২০১৭) 888sport alternative linkগুলো বহুল পঠিত। তাঁর অপরাপর 888sport alternative linkের মতো আলোচ্য 888sport alternative linkটিও পাঠকের হৃদয় হরণ করবে। মোদ্দা কথা, ফুটোতে চোখ রেখেও চেনা সমাজ ও চেনা মানুষকে অন্যভাবে চেনার অভিজ্ঞতা লাভ করবেন পাঠক।

এই 888sport alternative linkে উঠে এসেছে আদি চট্টগ্রামের ইতিকথা, এর পুরনো ও সমকালীন জীবনধারা, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতা আর নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। এ সবকিছু মিলেমিশে 888sport alternative linkের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিরেট সময় ও সমাজবাস্তবতা নয়, 888sport alternative linkের মূল উপজীব্য প্রেম। এই প্রেমই গভীর অন্ধকারে আলো ফেলে তুলে আনে মানুষের মনস্তত্ত্ব। ফুটোর মনস্তত্ত্ব পাঠককে ভাবাবে আর পাঠশেষে অনুভূতিশূন্য করে দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবে এক নতুন উপলব্ধির মুখোমুখি।