রবীন্দ্রনাথ ও দীনেশচন্দ্র সেন

অভিজিৎ দাশগুপ্ত

 

১৯৩৮ সালের মার্চ শেষের একটি সকাল। উত্তরায়ণে চায়ের আসর। রবীন্দ্রনাথের অতিথি হয়ে উপস্থিত কবিদম্পতি বুদ্ধদেব বসু – প্রতিভা বসু, তাঁদের কন্যা মীনাক্ষী বা মিমি, সঙ্গে কামাক্ষিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এবং সমর সেন। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথ নাকি নিজে বুদ্ধদেবকে জানান যে, তাঁর আমন্ত্রণ যেন সমর সেনকে জানিয়ে দেওয়া হয়। বুদ্ধদেবরা যদি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারেন, তাহলে তিনি ভারি খুশি হবেন। আর সমর ইচ্ছা করলে তাঁর কোনো কবিবন্ধুকেও এ-কয়দিনের সহযাত্রী করে নিতে পারেন। তাই কামাক্ষেপ্রসাদের আগমন।

ঠোঁটকাটা সমর সেন 888sport live footballের তুখোড় ছাত্র। 888sport app download apkয় তুলে আনছেন অসহিষ্ণু সময়ের শব্দ, বাক্য। শুরম্নতেই 888sport live footballমহলে ফেলে দিয়েছেন সাড়া। অতঃকিম্! রবীন্দ্রনাথের নিমন্ত্রণ।

মনে সন্দেহ জাগে, বিষয়টি এত সহজ! বিশেষত 888sport app download apk-ভাবনার ক্ষেত্রে ২২ বছরের যুবক সমরের ভেতর পরিণত সমরের ছায়া যে ছিল না, তা পাঠক মাত্রেই বুঝতে পারবেন। তবে, কী এমন রসায়ন ছিল, যা দুই কবির সাক্ষাতে সেতুর কাজ করেছিল।

আসুন আমরা ফিরে যাই বিশ শতকের শুরম্নর সময়ে। অথবা তারও কয়েক বছর পেছনে।

 

দুই

‘উপসংহারকালে আমি ত্রিপুরেশ্বর স্বর্গীয় বীরচন্দ্র মাণিক্য মহোদয়ের মৃত্যুতে গভীর পরিতাপ প্রকাশ করিতেছি। তিনি এ পুসত্মকের প্রথম সংস্করণের ব্যয়ভার বহন করিয়াছিলেন। আমার নানারূপ বিপদের মধ্যে ৪ বৎসর পূর্বে তাঁহার আকস্মিক মৃত্যুও অন্যতম বলিয়া গণ্য করিতেছি। তাঁহার মৃত্যুশয্যার একপ্রামেত্ম আমার এই সামান্য পুসত্মকখানি পরিদৃষ্ট হইয়াছিল।’

বঙ্গভাষা ও 888sport live football, দ্বিতীয় সংস্করণ – ভূমিকা

খ্যাতনামা ইতিহাসকার, গবেষক ও প–ত দীনেশচন্দ্র সেনের বঙ্গভাষা ও 888sport live football গ্রন্থটি ত্রিপুরার মহারাজাধিরাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের অর্থানুকূল্যে ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি প্রকাশের পরপরেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অপরিচিত দীনেশচন্দ্র সেনের পরিচয় ঘটে। উদ্যোগ নিয়েছিলেন স্বয়ং কবি। পত্র লিখে অভিনন্দিত করেন কুমিলস্না ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক এই মানুষটিকে।

বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত চিঠিপত্রে (১০)

রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম চিঠির সন তারিখ ১৮৯৮, ২৩ জুন। যদিও তার দু-বছর চার মাস পূর্বেই (১৮৯৬, ৮ জানুয়ারি) দীনেশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে একটি পত্র লেখেন। রবীন্দ্রনাথের পত্রটি পড়লেই পাঠক বুঝতে পারবেন যে, ইতিপূর্বে আরো দু-চারটি চিঠি চালাচালি হয়েছিল। ‘দীর্ঘকাল হইল ত্রিপুরায় পত্র লিখিয়াও এ পর্য্যমত্ম যখন কোন উত্তর পাওয়া গেল না তখন সেখানকার আশা একপ্রকার পরিত্যাগ করিতে হয়।’ প্রথম চিঠিতেই রবীন্দ্রনাথ এই যে ত্রিপুরায় পত্র লেখার কথা বলেছেন, তার বিশেষ কারণ রয়েছে। কিন্তু আগে একটু পুরোনো কাসন্দি ঘাঁটার ইচ্ছে আছে। মহারাজাধিরাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর ১১ ডিসেম্বর, শুক্রবার (১৮৯৬) কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। 888sport live football-888sport live chatের রসিক ত্রিপুরারাজ বীরচন্দ্র ইতিপূর্বে প্রথমা মহিষী ভানুমতী দেবীর মৃত্যুতে (১৮৮২) কাতর হয়ে পড়েছিলেন। বিচ্ছেদ-বেদনায় অসহায় রাজার হাতে আসে 888sport appsের কিশোর কবির কাব্য ভগ্নহৃদয় (১৮৮১)। শুরম্ন হলো দুই অসমবয়সীর (প্রায় ২৫ বছরের ব্যবধান) পথচলা। পনেরো বছরের রাজত্বকালে (১৮৮২-৯৬) রাজা বীরচন্দ্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। রাজার নিজেরও ছিল অসামান্য কবি-প্রতিভা। ফলে সম্পর্ক উজ্জীবিত হতে সময় লাগেনি।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ দীনেশচন্দ্রকে প্রথম পত্রে (চিঠিপত্র ১০ অনুযায়ী) যে-সমস্যার কথা লিখেছেন তার প্রেক্ষিত অন্য। সঠিক সময়ে তার আলোচনা করা যাবে। অন্যপক্ষে দীনেশচন্দ্রের পত্রটি পড়লেই বুঝতে পারি যে, সেটি প্রথম পরিচয় লাভের প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ। ‘বহুদিনের ইচ্ছা ছিল, আপনার নিকট একখানি পত্র লিখি; যেদিন ‘সাধনা আর বাহির হইবে না’ এই দুঃখকর সংবাদ পড়িলাম, সেইদিন পত্র লিখিতে বড় ইচ্ছা হইয়াছিল কিন্তু লিখি নাই; মনের নিভৃতে যে পূজা দিবার প্রবৃত্তি হয়, সাধক তাহা গোপন করেন, আমিও আপনার প্রতি 888sport apk download apk latest versionভক্তির কথা লিখিতে কুণ্ঠিত ছিলাম।’ মনে হয় এই 888sport apk download apk latest version, বিনয়, কুণ্ঠা দীনেশচন্দ্রকে প্রাথমিকভাবে বাধা দিয়েছে।

ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মধ্যে সাধনা বিশেষ একটি কারণে 888sport live footballমহলে অর্জন করে নিয়েছে তার স্থান। অগ্রহায়ণ ১২৯৮ থেকে কার্তিক ১৩০২ বঙ্গাব্দ পর্যমত্ম প্রকাশিত সাধনার চতুর্থ বছরে সম্পাদক হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পূর্বে তত্ত্ববোধিনী, ভারতী বা বালকের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সাধনাই ছিল কবির একামত্ম নিজের 888sport live football-সাময়িকী। কার্তিক ১৩০২-এর সাপ্তাহিক সঞ্জীবনী পত্রিকায় দুবার বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হয় যে, ‘সাধনা আর বাহির হইবে না।’ দীনেশচন্দ্রের কাছে সাধনার অবসান দুঃখজনক হলেও তাঁর কাছে এই পত্রিকার লেখক (রবীন্দ্রনাথ) বর্তমান, ‘ঈশ্বর তাহার আয়ু যশঃ লেখনী অক্ষয় করম্নন,’ এমনটা তিনি পত্রশেষে প্রকাশ করেন।

প্রথম পত্রের পরে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত। দ্বিতীয় পত্রটির তারিখ ১৮৯৯, ১৪ ডিসেম্বর। ১৯০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ভেতর আরো চারটি চিঠি দীনেশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে সেপ্টেম্বর ১০ মাসের মধ্যে পাঁচটি পত্র। ৬-সংখ্যক পত্রটিকে বাদ দিলে ২ থেকে ৫-সংখ্যক পত্রে দীনেশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন কাব্যের প্রশংসাসূচক আলোচনাই করেছেন। কণিকা, কথা, কাহিনী, ক্ষণিকা উপহারস্বরূপ কবি তাঁকে দিয়েছেন। সে-সমসত্ম অমূল্য উপহার দীনেশচন্দ্র কী 888sport apk download apk latest version ও ভালোবাসায় গ্রহণ করেন তা যে-কোনো একটি চিঠির কিয়দংশ তুলে ধরলে পাঠক বুঝতে পারবেন। কথা কাব্যের মধ্যে যে নৈতিক মাধুর্য্য আছে, তাহাতে কবির কাব্য বলার শ্রেষ্ঠ পরিণতি প্রদর্শিত হইয়াছে। কোশল রাজের শত্রম্নশিবিরে মহান আত্মসমর্পণ একটি পূজার প্রদীপের ন্যায় শ্রীমতী দাসীর বৌদ্ধসত্মূপমূলে জীবন নিবর্বাণ, বিগত-সৌন্দর্য্য অনাথিনীর গৃহে উপগুপ্তের অপরূপ প্রতিশ্রম্নতিপালন, প্রজাদুঃখকাতর রাজার অভিনব প্রণালীর দ- দ্বারা মহিষীকে দুঃখীর দুঃখ বুঝাইবার চেষ্টা, … প্রভৃতি ভাবের সমসত্ম গল্পই নৈতিক জগতের সুন্দর ও অদ্ভুত কথা।’ (পত্র-৩)। দীনেশচন্দ্র এই 888sport app download apkগুলির পাঠ-মুহূর্ত তুলে ধরেছেন ওই একই পত্রে। ‘অনেকগুলি গল্পই কাঁদিতে কাঁদিতে পড়িতে হইয়াছে, এই অশ্রম্নতে ক্ষণেকের তরে যেন মনের সমসত্ম গস্নানি মুছিয়া গিয়াছে ও কামনাহীন সততার সৌন্দর্য্যে আত্মহারা হইয়া পড়িয়াছি।’

এদিকে বঙ্গভাষা ও 888sport live footballের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলে কবি বঙ্গদর্শন পত্রিকায় (নবপর্যায়, ১৩০৯ শ্রাবণ) দীর্ঘ সমালোচনা প্রকাশ করেন। এমনকি এক সময়ে রবীন্দ্রনাথ নবপর্যায়ের বঙ্গদর্শনের সম্পাদনার ভার দিতে চেয়েছিলেন তাঁকে। আবার রবীন্দ্রনাথের উৎসাহেই দীনেশচন্দ্র ঘরের কথা ও যুগ 888sport live football নামে আত্মজীবনী রচনা করেন। (রবীন্দ্রপত্র ১০/২৫)।

৬-সংখ্যক পত্রের পর ৭-সংখ্যক পত্রটির তারিখ ১৯১৮, ডিসেম্বর মাস। ১৮ বছরের ব্যবধানে দীনেশচন্দ্র কবিকে আর কোনো চিঠি লেখেননি, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ এই সময়সীমার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ প্রায় একান্নটি পত্র লিখেছেন। কোনো বছর সাতটি (১৯১০), তো কোনো বছর ১৪টি (১৯০৪)। নিশ্চয়ই এই চিঠিগুলির উত্তর দীনেশচন্দ্র দিয়েছিলেন, কিন্তু হাতে না থাকায় সে-সম্বন্ধে মমত্মব্য করা সমীচীন নয়। রবীন্দ্রনাথের পত্রগুলিতে তাঁর লেখালেখি থেকে ব্রহ্মচর্যাশ্রম, ত্রিপুরা প্রসঙ্গ, দীনেশপুত্র অরম্নণচন্দ্র ইত্যাদি প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে। বন্ধুর আর্থিক অবস্থা জানা ছিল, তাই লিখেছেন, ‘পাথেয়ের ভার সম্পূর্ণ আমার উপর দিবেন – …রিক্তহসেত্ম আসিবেন।’ (পত্র, ১০/৪) অথবা ‘পত্রে আপনার অর্থের অভাব ও শরীর মনের অবসাদের কথা পড়িয়া কষ্টবোধ করিলাম।’ (পত্র, ১০/১৮)। কবির প্রতিদিনের কাজে কর্মেও যে দীনেশচন্দ্রের নামটি জড়িয়ে ছিল, তা ২৩-সংখ্যক পত্রে স্পষ্ট। ‘এই মজুমদার লাইব্রেরির জাল ছিন্ন করিতে পারিলে আমি কতকটা সুস্থ হইতে পারিব। আপনি আমার এই যে উদ্ধারব্রত গ্রহণ করিয়াছেন তাহাতে কৃতকার্য্য হউন, বা না হউন, আমার কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়া থাকিবেন’ (প্রসঙ্গত জানাই যে, দীনেশচন্দ্র এক্ষেত্রে কৃতকার্য হতে পারেননি)। অন্য একটি পত্রে (১০/৩৮) চারিত্রপূজা গ্রন্থটির বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, ‘কেবল আপনার সহায়তা প্রার্থনা করি মাত্র। এবং আপনিও বই কাট্তির সম্ভাবনা সম্বন্ধে কিরূপ অনুমান করেন তাহাই জানিতে ইচ্ছা করি। এ বিষয়ে আপনি আমার চেয়ে বোঝেন ভাল – এ সম্বন্ধে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও আছে – সেই জন্যই আপনার শরণাগত হইয়াছি ইহাতে আমার প্রতি বিরক্তিবোধ করিবেন না’ (এ বিষয়ে দীনেশচন্দ্র কৃতকার্য হয়েছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে ‘অনাবৃষ্টির কালে মেঘোদয়ের মত’ একটি চেক পাঠিয়েছিলেন)। বোলপুর, শিলাইদহ, জোড়াসাঁকো, মজঃফরপুর, গিরিডি যখন যেখানে কবি এই সময়সীমার মধ্যে গেছেন, সেখান থেকেই দীনেশচন্দ্রকে পত্র লিখতে চেষ্টা করেছেন। বন্ধুত্বের এই গাঢ়তার নিদর্শন কথা কাব্যটি প্রমাণ করে। এর প্রকাশ ১৯০০, ১৪ জানুয়ারি। আর দীনেশচন্দ্র সেটি হাতে পাচ্ছেন ২১ জানুয়ারি, ১৯০০। এক সপ্তাহের ভেতর প্রিয় মানুষটির হাতে সদ্য প্রকাশিত বই পৌঁছে দিয়ে কবি নিশ্চিমত্ম হতে চেয়েছেন। কখনো সাবধান করেছেন 888sport live footballক্ষেত্রে শত্রম্নর কুশের কাঁটা বিষয়ে (পত্র-৩), আবার ১০-১২ টাকা ভাড়ায় বন্ধুপ্রতিমের জন্য শামিত্মনিকেতন থেকে মাইলখানেক তফাতে একটি বাসাবাড়ির সন্ধানও দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ (পত্র-১০/৫)।

এখানে বলার কথা যেটি, দুই সমমনস্ক বন্ধু একে অপরকে বুদ্ধি, মেধা দ্বারা পরিচালিত করেছেন। অতিরিক্ত মোহ সেই সম্পর্কের ওপর ছায়াপাত করেনি। দীনেশচন্দ্রের ক্ষেত্রে সামান্য দুর্বলতা দেখা গেলেও রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত বন্ধুর মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন সূচনাপর্বে। ২৩-সংখ্যক পত্রে দীনেশচন্দ্রের গল্পের বই তিন বন্ধু পাওয়ার জন্য উৎসুক কবি একমাস ষোলো দিন পর চিঠির মাধ্যমে নিজেই জানাচ্ছেন, – ‘তিন বন্ধু’ সম্বন্ধে আপনাকে যিনি যতই উৎসাহিত করম্নন আপনার এই বর্ত্তমান পত্রলেখক বন্ধুটি সায় দিতে পারিতেছেন না – ।’ (পত্র ১০/২৫)।

বন্ধুত্বের প্রতি সর্বদা সচেতন রবীন্দ্রনাথ সময়ের ব্যবধানে ওভাবেই কখনো প্রিয়নাথ, কখনো জগদীশচন্দ্র, কখনো বা দীনেশচন্দ্রের জন্য নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠতেন।

নানা বিষয়ে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশটা বছর (১৯১০, মে মাস পর্যমত্ম) দুই মনীষীর চিমত্মাভাবনা, চেতনাও এই সূত্রে বাঁধা ছিল। ছোটখাটো কত-কত ঘটনায় একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। 888sport live football পরিষদের সভাপতি হওয়া প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর আপত্তির কারণ জানান। ‘আমি আর আমার চিমত্মা ও চেষ্টাকে নানা দিকে বিক্ষিপ্ত হইতে দিব না। কর্ত্তব্য সঙ্কোচ না  করিলে কর্ত্তব্য পালন করা যায় না কেবল বৃথা ভ্রাম্যমাণ হইতে হয়’  (১০/১২)। এই প্রতিষ্ঠানের সূচনা থেকে কয়েক দফায় সহকারী সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। নিজের বিদ্যালয়, বঙ্গদর্শন, পরিবার ইত্যাদি নিয়ে এতটাই ব্যসত্ম হয়ে উঠেছিলেন কবি যে অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ তখন তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না।

২২-সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই বন্ধুটিকে ফ্রান্সের উদাহরণ উলেস্নখ করে একটি নতুন প্রস্তাব দিচ্ছেন। দুজনে মিলে গল্প লেখার চেষ্টা। একবারের জন্য এই প্রণালী পরীক্ষা করে দেখার ইচ্ছা ছিল কবির।

কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবীর (দশ বছর সাত মাস) বিবাহের পাত্র বিষয়ে দীনেশচন্দ্রের সঙ্গে কবি আলোচনা করতে চেয়েছেন। অথবা রথীন্দ্রনাথের নামে ১৫ বৎসর মুদ্দতে ৪০,০০০ টাকার ইনসিওর করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ৩ মাস অমত্মর তাঁকে ৬৫০ টাকা হিসেবে দিতে হতো। এর জন্য দীনেশচন্দ্রকে রথীন্দ্রনাথের জন্মতারিখ জানিয়ে কবি যে-চিঠি দেন তা ৪০ এবং ৪১-সংখ্যক পত্রে লক্ষণীয়। City of Glasgow Life Company-র এজেন্ট ছিলেন দীনেশচন্দ্র।

 

সব থেকে বড় বিষয়টি হলো, মহর্ষি সম্বন্ধে এমন একটি খবর দীনেশচন্দ্র কবিকে জানিয়েছিলেন, যা চলিস্নশোর্ধ্ব কবির কাছে বিস্ময়ের ছিল। ‘আমার পিতা সংস্কৃত ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন সে সংবাদ আপনার কাছে এই প্রথম পাওয়া গেল। এই বইখানি সন্ধান করতে হবে। আপনি গগনদেরও একবার জিজ্ঞাসা করে দেখবেন।’ (১০/৩৯)।

ওই একই চিঠিতে দীনেশচন্দ্রের একটি প্রস্তাবকে রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করে লিখছেন, ‘আমার পিতার সমসত্ম রচনা ছাপাবার যে প্রস্তাব করেছেন সেটা আলোচনা করে দেখব। এবার কলকাতায় গিয়ে সে-সম্বন্ধে সন্ধান করা যাবে।’

দীনেশচন্দ্রের এই দানের প্রতিদান রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন অন্যভাবে। ‘আশু মুখুজ্জে মশায়কে প্রাচীন বাংলা গদ্যপ্রকাশ সম্বন্ধে অনুরোধ জানিয়ে পত্র লিখে পাঠাব।’ পরবর্তী সময়ে আশুতোষের কাছে প্রস্তাবটি তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই প্রস্তাব উত্থাপনের সময় দীনেশচন্দ্র সেখানে ছিলেন। আশুতোষ-888sport sign up bonusকথায় এমনটাই জানাচ্ছেন তিনি। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, দীনেশচন্দ্রের ওপরে রবীন্দ্রনাথের প্রগাঢ় আস্থা ছিল। শুধু গদ্যপ্রকাশের ক্ষেত্রেই নয়, প্রাচীন 888sport app download apk সংগ্রহের জন্য দীনেশচন্দ্রকে তিনি যোগ্য ব্যক্তি মনে করেছিলেন। এমনকি অর্থসাহায্যের বিষয়টিও ভাবনার মধ্যে ছিল। কিন্তু বিদ্যালয় নিয়ে জেরবার কবি তা করে উঠতে পারেননি। তাই সখেদে বলেছেন, ‘আমার মত অক্ষমের কেবলমাত্র সাধ আছে কিন্তু সাধ্য নাই।’ (১০/৩৫)।

 

তিন

‘আমি আমার যমজ ভগিনী মগ্নময়ী দেবীকে লইয়া মাতুলালয় [888sport app জেলার] বগজুড়ী গ্রামে এক আম্রবৃক্ষতলে আতুড়ঘরে অবতীর্ণ হইয়াছিলাম।… আমার জন্মের পূর্বে নয়টি কন্যা হইয়াছিল। তাহাদের ছয়টি শৈশবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।’ ঘরের কথা ও  যুগ888sport live football (দ্বিতীয় মুদ্রণ) গ্রন্থে দীনেশচন্দ্র এভাবেই আত্মপরিচয় দিয়েছেন। জন্ম ৩ নভেম্বর ১৮৬৬ (জন্মসাল বিষয়ে দীনেশচন্দ্র ঘরের কথা ও যুগ888sport live football গ্রন্থে দুরকম তথ্য পেশ করেছেন। ‘পিতৃদেবের কথা’ – বিভাগে তিনি জানাচ্ছেন, ‘কার্তিক মাসের ১৭ই, শক ১৭৮৮ শুক্রবার, রাত্রি ৪ দ- বাকী আছে।’ অর্থাৎ খ্রীষ্টাব্দ ১৮৬৬। কিন্তু ‘888sport live footballিক বন্ধুগণ, বিপদ ও গৃহত্যাগ’ – বিভাগে পাচ্ছি অন্য তথ্য।’ ‘আমি ১৮ বৎসর বয়সে ১৮৮৭ সনে হবিগঞ্জে রওনা হইলাম।’ হিসেব বলছে, তাঁর তখন ২১ বছর।), বাবা – ঈশ্বরচন্দ্র সেন, মা – রূপলতা দেবী। 888sport appর সুয়াপুর অঞ্চলে বসবাস। সাত বছর বয়সে তিনি পয়ার ছন্দে সরস্বতীর এক সত্মব লিখেছিলেন। পরবর্তীকালে খ্যাতনাম ইতিহাসকার, গবেষক, সংগ্রাহক হওয়া সত্ত্বেও 888sport app download apk-চর্চা ছাড়েননি। সেকেন্ড ইয়ার ক্লাশে পড়ার সময় নিজের নোটবুকে লিখেছিলেন, ‘বাঙ্গালার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হইব, …।’ আলোচনা সাপেক্ষে জানাতেই হচ্ছে, তাঁর সে-ইচ্ছা পূরণ হয়নি সত্য। কিন্তু ‘বাঙ্গালার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি’র সঙ্গে তাঁর সখ্য গভীরতর হয়ে উঠেছিল সময়ের ব্যবধানে, যদিও তরম্নণ বয়সের এই কাব্যানুরাগের কৃতিত্ব দীনেশচন্দ্র দিদি দিগ্বসনী দেবীকে দিয়েছেন।

 

ছাত্রজীবনে কৃতিত্বের পরিচয় দিলেও তাঁর মানসিক গঠনটি কিছু ভিন্নভাবে গড়ে উঠেছিল। সিলেবাসের বাইরে ইংরেজি 888sport app download apk ও বৈষ্ণব পদ পড়া এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, কারো পক্ষে তাঁর সঙ্গে এঁটে ওঠা সম্ভব ছিল না। ১৫ বছর বয়সে ‘পূজার কুসুম’ 888sport app download apkটি নবজীবন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

তরম্নণ বয়সেই দীনেশচন্দ্রের জীবনে বিয়োগ-বেদনা পরপর আসে। দুই বোন মৃণ্ময়ী ও কাদম্বিনী, বাবা, মা একে-একে চিরবিদায় নেন। এবং ‘বাতব্যাধি রোগে দক্ষিণাঙ্গ হীনবল হওয়ায়’ তিনিও শয্যাগ্রহণ করেন। সাভারের বিখ্যাত গুরম্নচরণ কবিরাজ তাঁর চিকিৎসা করেছিলেন।

সে-সময় কলকাতার পিস্ অ্যাসোসিয়েশন বঙ্গভাষা ও 888sport live football সম্বন্ধে একটি 888sport live প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। তরম্নণ দীনেশচন্দ্র বঙ্গের প্রাচীন 888sport live football নিয়েই ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন। ফলে 888sport liveটি তিনি সানন্দে লিখেছেন। শেষে তাঁর 888sport liveই বিচারকদ্বয় (চন্দ্রনাথ বসু ও রজনীকামত্ম গুপ্ত) 888sport app download bdযোগ্য বিবেচনা করেন। এই 888sport liveের সূত্র ধরেই দীনেশচন্দ্র বঙ্গভাষা ও 888sport live footballের ইতিহাস লিখতে শুরম্ন করেন। এবং এ-বইয়ের (বঙ্গভাষা ও 888sport live football) প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয় ২ ডিসেম্বর, ১৯৯৬ সালে। সহায়তা করেছিলেন ত্রিপুরারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য। পাকা জহুরির মতো রবীন্দ্রনাথও খুঁজে নেন বঙ্গদেশের রত্নটিকে।

গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের সময় রবীন্দ্রনাথের অর্থসংগ্রহের চেষ্টার ত্রম্নটি ছিল না। মহারাজা বীরচন্দ্র মারা যাওয়ায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন রাজা রাধাকিশোর মাণিক্য (১৮৯৭-১৯০৯)। ৫ মার্চ সিংহাসনে বসার পর নানা সংকটে বিব্রত হয়ে পড়েন রাজা। একদিকে শূন্য রাজকোষ, অন্যদিকে পারিবারিক নানা জটিলতা-গৃহবিবাদ-রাজ্যের দাবিতে মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। রাজ্যাভিষেকের সাত দিনের মধ্যে প্রবল ভূমিকম্পে ত্রিপুরা রাজপ্রাসাদের অনেকটাই ভেঙে পড়ে। এই বিচিত্র সমস্যায় জেরবার রাজা রাধাকিশোর মাণিক্য রবীন্দ্রনাথের  সঙ্গে এই সময়ে কোনো যোগাযোগ করে উঠতে পারেননি। তাই রবীন্দ্রনাথ দীনেশচন্দ্রকে পত্রে (১০/১) ত্রিপুরায় পত্র পাঠিয়েও উত্তর না পাওয়ার প্রসঙ্গটি উলেস্নখ করেছিলেন। পরবর্তীকালে রাজা রাধাকিশোর কবি হেমচন্দ্রের সঙ্গে দীনেশচন্দ্রকেও আজীবন মাসিক ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। দীনেশচন্দ্রের ভাতার পরিমাণ ছিল পঁচিশ টাকা। অন্যত্র এমন প্রাপ্তি সম্বন্ধে নিজেই বলেছেন, ‘মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র, গগনবাবু, কালীকৃষ্ণ ঠাকুর, প্রমথনাথ রায়চৌধুরী, রাজা মন্মথ রায়চৌধুরী, ত্রিপুরেশ্বর এবং শরৎকুমার রায় এক সময়ে আমাকে মাসিক বৃত্তি দিয়াছিলেন।’

(ঘরের কথা ও যুগ888sport live football)

রবীন্দ্রনাথের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার শুরম্ন এই পর্বেই। বয়সের তফাৎ সামান্যই। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধান নিয়ে দীনেশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের প্রীতি-সম্বন্ধের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। কবি চোখের বালি রচনার সময় তাঁকে ‘বিনোদিনীর রহস্য নিকেতনে’ প্রবেশের অধিকার দিয়েছিলেন। পরে নৌকাডুবি, গোরা ইত্যাদিও ‘রবিবাবুর মুখে’ই শুনেছিলেন দীনেশচন্দ্র।

পত্র-পত্রিকাগুলি রবীন্দ্রনাথের বিরম্নদ্ধে 888sport live football-তর্ক শুরম্ন করলে দীনেশচন্দ্র বন্ধুর পক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁর যোগ্য জবাব দিয়েছেন। চোখের বালি প্রসঙ্গে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৬৬-১৯২৩) রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সৃষ্ট ‘বিধবা বিনোদিনী’র সমালোচনা করেন। রবীন্দ্রনাথকে ‘সিদ্ধ লম্পট’ আখ্যা দিয়ে পাঁচকুড়িবাবু সিদ্ধামেত্ম পৌঁছান – ‘রবিবাবু প্রকৃত প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন বটে; কিন্তু আমাদের রম্নচির উপযোগী হয় নাই। ইংরেজি নভেল বাঙ্গালা ভাষায় লেখা হইয়াছে। But it is a Master Piece.’

দীনেশচন্দ্র বাক্চাতুর্যের মাধ্যমে লিখেছেন – ‘কোন এক লোকের নাম ছিল – কয়েকটি কড়ি, বোধহয় তিনকড়ি টিনকড়ি হইবে, সেই ব্যক্তির মতামত লইয়া কথা হইতেছিল, কেহ কেহ তাহার মতটির উপর বেশী মূল্য দিতেছিলেন। রবিবাবু বলিলেন, ‘উঁহার বাপ মায়ের চাইতেও কি আপনারা উঁহাকে বেশী জানেন? তাঁহারা তো উহার প্রকৃত মূল্য ধার্য করিয়া রাখিয়াছেন।’ এই তিনকড়ি/ টিনকড়ি যে আদতে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় তা অনুমান করা অসাধ্য নয়।

প্রাচীন বঙ্গের কাব্যসমূহ থেকে বঙ্গভাষার ইতিহাস ইংরেজিতে লেখা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ দীনেশচন্দ্রকে প্রয়োজনীয় পথনির্দেশে সাহায্য করেছিল। ১৯০৫ থেকে ১৯৩২ পর্যমত্ম প্রথমে পরীক্ষক (বি.এ. পরীক্ষার বাংলা ভাষা), পরে ‘রীডার’ ও রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলোশিপ’ পদ গ্রহণ করে দীনেশচন্দ্র কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পা–ত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ডি. লিট. উপাধি (১৯২১) এবং বাংলা 888sport live footballে বিশিষ্ট অবদানের জন্য ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ (১৯৩১) প্রদান করে। প্রসঙ্গত বলতেই হচ্ছে, ১৯১০-এর পরে দীনেশচন্দ্রের সঙ্গে ভাইস-চ্যান্সেলার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সখ্য কিছু বেশি রকমের লক্ষ করা যায়। পরে এ-বিষয়ে আলোকপাত করা যাবে। তাঁর গবেষণা-গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম বঙ্গ-888sport live football-পরিচয় (দ্বিতীয় খ-), মৈমনসিংহ গীতিকাপূর্ববঙ্গ গীতিকা, চৈতন্য অ্যা- হিজ কম্প্যানিয়ন্স, রামায়ণী কথা, চৈতন্য অ্যা- হিজ এজ, বৃহৎ বঙ্গ, সতী, খুলস্নরা, বেহুলা প্রভৃতি। দীনেশচন্দ্রই প্রথম 888sport apkসম্মত পদ্ধতিতে বাংলা 888sport live footballের গবেষণা শুরম্ন করেন। তাঁর অমরকীর্তি বঙ্গভাষা ও 888sport live football। ১৯৩৯ সালে ১১ নভেম্বর দীর্ঘ রোগভোগের পর তিনি অমর্ত্যলোকের উদ্দেশে যাত্রা করেন।

 

চার

এই পর্বে পৌঁছে সূচনায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে জাগল। নিশ্চই তার কারণ কিছু আছে। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গী রূপে সমর সেনের সেই প্রথম শামিত্মনিকেতনে আগমন। সমর সেন আসলে কবির দীর্ঘদিনের সুহৃদ দীনেশচন্দ্র সেনের নাতি। সমরের পিতা দীনেশচন্দ্রের দ্বিতীয় পুত্র অরম্নণচন্দ্র সেন। এই অরম্নণকে নিয়েই দীনেশচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের মনকষাকষির সূত্রপাত। পরবর্তী অধ্যায়ে তার আলোচনা করা যাবে।

পরের দিন সকালে চায়ের আসরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সকলের পরিচয় পর্ব চলতে-চলতে দীনেশপৌত্র সমরের উদ্দেশে কবির সৌজন্যমূলক জিজ্ঞাসা ছিল, ‘রাত্তিরে কেমন ঘুম হল।’ ঠোঁটকাটা সমর সেন ভারিক্কি চালে বলে ওঠেন, ‘আপনাদের শামিত্মনিকেতনে রাত্তিরে এত কোকিল ডাকে যে, কার সাধ্য ঘুমোয়!’ স্বভাবতই বাইশ বছরের তরম্নণের মুখে সত্তরোর্ধ্ব কবির উদ্দেশে এমন উক্তি শুনে সকলে যখন মাথা ঝোঁকাতে শুরম্ন করেছেন, তখন রবীন্দ্রনাথই উত্তরদাতার প্রতি প্রত্যাঘাত করলেন তাঁর রসিক মনকে সামনে রেখে। ‘হ্যাঁ, তোমরা কবি-টবি মানুষ, কোকিলের ডাকে তোমাদের নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটে, আমরা ছাপোষা গেরসত্ম, আমাদের ঘুম আসে না মশার কামড়ে।’

সেই মুহূর্তে তরম্নণের বীরত্ব ভূলুণ্ঠিত। আর আমরা পেতে চলেছি দীনেশচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কিছু মুহূর্ত। সমর সেনের এই উত্তর এবং সঙ্গে-সঙ্গে গুরম্নদেবের প্রত্যাঘাত যেন ভবিতব্যই। প্রায় ২৮ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৯১০ সালের পরে যার সূত্রপাত এবং আমৃত্যু তার ভার বহন করে যেতে হয়েছে দীনেশচন্দ্রকে। হয়তো কিছু ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকেও।

 

পাঁচ

অরম্নণচন্দ্র সেন (১৮৯২-৭৪) দীনেশচন্দ্রের দ্বিতীয় পুত্র। ‘888sport app পুত্ররা হলেন বিনয়চন্দ্র, শ্রীচন্দ্র, কিরণচন্দ্র, বিনোদচন্দ্র এবং সুধীরচন্দ্র। তাঁদের মা বিনোদিনী সেন। ১৯০২ থেকে ১৯০৬ শামিত্মনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম যুগের ছাত্র। অজিত কুমার চক্রবর্তী ব্রহ্মবিদ্যালয় পুসত্মকে ১৩০৮ থেকে ১৩১৮ – এই সময়সীমার মধ্যে থাকা আশ্রমের ছাত্রদের তালিকা তুলে দিয়েছেন। ১৩২ জন ছাত্রের নাম পাওয়া যাচ্ছে তাতে। অনুমান করি এঁদের অনেকেই অরম্নণচন্দ্রের বন্ধু এবং সহপাঠী। কবিপুত্র শমীন্দ্রনাথ বা পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীর উপাচার্য সধীরঞ্জন দাস তাঁর সময়কালে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ছাত্র। আমাদের শামিত্মনিকেতন গ্রন্থে সুধীরঞ্জন এই পুরনো বন্ধু সম্বন্ধে জানাচ্ছেন, ‘সুপ্রসিদ্ধ 888sport live footballিক ও ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের ছেলে অরম্নণচন্দ্রও ছিলেন আশ্রমে। অরম্নণদার চেহারা ছিল লম্বা রোগা। তাঁর কাপড়-চোপড়ের দিকে বিশেষ খেয়াল ছিল না। পড়াশোনায় ভালো বলেই খ্যাতি ছিল।’

অরম্নণচন্দ্রকে শামিত্মনিকেতন বিদ্যালয়ে ভর্তি করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ১৯০২, ৯ এপ্রিল দীনেশচন্দ্রকে একটি পত্র লেখেন। যেখানে তিনি পরিষ্কার করে দেন ভর্তির নিয়ম-কানুন। ‘ছেলে লওয়া সম্বন্ধে আমাদের নিয়ম এই যে, দশ বৎসরের অধিক বয়স্ক ছেলেদের আমরা বিদ্যালয়ে লই না।… আপনার ছেলেটির বয়স যদি অধিক না হয় তবে তাহাকে একবার দেখিতে ইচ্ছা করি।’ ১৮৯২-তে জন্ম অরম্নণচন্দ্রের ওই সনেই দশ বছর পূর্ণ হওয়ার কথা। এপ্রিল মাসেই হয়তো দীনেশচন্দ্রের সম্মতিপত্র পান রবীন্দ্রনাথ।

অরম্নণ যে এর পরপরই শামিত্মনিকেতনে ছাত্র হিসেবে এসেছে, তার প্রমাণ ১০-সংখ্যক পত্রটি। ‘অরম্নণ বেশ ভালই আছে। সে আপনার প্রেরিত গরম কাপড় ব্যবহার করিতেছে।’ ইতিপূর্বে সুহৃদকে আশ্বসত্ম করেছেন এই বলে, ‘ছেলেটিকে আমার সঙ্গেই পাঠাবেন – তাড়া নাই।’ (১০/৯ – ২৬ মে, ১৯০২)।

শামিত্মনিকেতন বিদ্যালয়ের ছাত্রদের শরীর-স্বাস্থ্য-পড়াশোনা ইত্যাদির প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি ছিল তীক্ষন। ১৯০৩, ১২ মার্চ সপরিবারে হাজারিবাগের উদ্দেশে কবি রওনা হন। উপলক্ষ, যক্ষ্মারোগে আক্রামত্ম কন্যা রেনুকার বায়ু পরিবর্তন। ২ এপ্রিল চিঠিতে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রামত্ম কবি অরম্নণ-পিতা দীনেশচন্দ্রকে
যে-পত্র দেন, তাতে ছাত্রদের সম্বন্ধে তাঁর সর্বক্ষণের চিমত্মাই প্রকাশ পেয়েছে। কলকাতায় পেস্নগের উপদ্রব, তাই অরম্নণকে সেখানে না পাঠিয়ে গরমের অবকাশে আশ্রমে রেখে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এমনকি তাঁকে পুরনো পাঠাভ্যাস করাবেন বলেও কথা দেন রবীন্দ্রনাথ। এ-সময়ের প্রায় প্রতিটি চিঠিতেই অরম্নণের কথা লিখতে ভোলেননি তিনি। ‘অরম্নণ বেশ ভালই আছে।’ (১০/১০)। ‘অরম্নণ বেশ ভালই আছে – তাহার জন্য চিমিত্মত হইবেন না।’ (১০/১১)। ‘অরম্নণকে যদি হোমিওপ্যাথি দেখাইতে পারিতেন ভাল করিতেন।’ (১০/২০) ‘অরম্নণ ভাল আছে – ওজনে বাড়িতেছে।’ (১০/২৫)। ‘অরম্নণ বেশ ভাল আছে। এরূপ সুস্থ তাহাকে অনেক কাল দেখি নাই।’ (১০/২৬)। এভাবে প্রায় প্রতিটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ অপর পিতৃহৃদয়কে আশ্বসত্ম করেছেন প্রবাসী পুত্র সম্বন্ধে।

এখানে সাময়িক বিরতির প্রয়োজন। কারণ এরপর অরম্নণ শামিত্মনিকেতনের পাঠ চুকিয়ে পরিবারের কাছে চলে যান। তবু কী এক দুর্নিবার আকর্ষণে রবীন্দ্রনাথ ১৯০৭, ২০ মার্চ পত্রের শেষে লিখছেন – ‘অরম্নণের খবর নিশ্চই দিবেন। সে কেমন আছে কি করিতেছে এবং তাহার সম্বন্ধে আপনাদের অভিপ্রায় আমাকে জানাইবেন – কারণ, আমার তাহা জানিবার অধিকার আছে।’ (১০/৩৬)। এরপর দু-একটি চিঠিতে অরম্নণের খবর জানতে চাওয়ার কথা আছে মাত্র। কিন্তু ১৯১০, ২২ জুন থেকে দীনেশচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ – অরম্নণচন্দ্র  সম্পর্কের ভেতর আরেক রকম ঝঞ্ঝাট প্রকাশ পায়। ১৮ বছরের অরম্নণের বিবাহ স্থির করেন দীনেশচন্দ্র। কিন্তু পুত্র লেখাপড়া শেষ না করে বিবাহ করতে রাজি হয় না। আর্থিকভাবেও স্বাবলম্বী হওয়ার বিষয়টি ছিল। পিতার দারিদ্র্য অরম্নণচন্দ্রকে এই সিদ্ধামত্ম নিতে আরো সাহায্য করে বলেই মনে করি। তার জন্য গৃহত্যাগ করে তিনি চলে যান গিরিডিতে। সেখানে অরম্নণ আশ্রয় নিয়েছিলেন বন্ধুবর প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে।

অরম্নণচন্দ্রের সন্ধানে প্রথমে শামিত্মনিকেতন আসাই ঠিক মনে করেছিলেন তাঁর দাদা কিরণচন্দ্র এবং ভগ্নিপতি কুলদাকুমার সেন রায়। আসলে পশ্চাতে রয়েছেন দীনেশচন্দ্র। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, এ-ঘটনায় হাত রয়েছে রবীন্দ্রনাথের। অথচ গুরম্নদেব বেশ আমত্মরিকতার সঙ্গেই জানাচ্ছে যে, তিনি অরম্নণের পলায়নে কোনোমতেই প্রশ্রয় দেননি। এমনকি কবিগুরম্ন এমন অবস্থায় অরম্নণকে নিরসত্ম করবেন জেনেই সে সমসত্ম কথা গোপন করে গেছে। চিঠির শেষে তিনি জানাচ্ছেন, ‘আপনারা তাহাকে টানাটানি করিতে গেলে পাছে তাহার হিতে বিপরীত হয় এই জন্য আমি তাহাকে ফিরাইবার ব্যবস্থাভার নিজের উপর লইতেছি।’ (১০/৪৩)। এই পত্রে ‘হিতে বিপরীত’ কথাটি লক্ষ করার। দীনেশচন্দ্র পিতা হয়েও যে-বিষয়ে অবগত ছিলেন না, রবীন্দ্রনাথ একজন স্নেহশীল মানুষ রূপে অরম্নণের প্রকৃত স্বরূপটি খুঁজে পেয়েছিলেন। এই চিঠিতেই তাই কবি সামান্য আগে লিখছেন, ‘আপনি বোধহয় জানেন না অরম্নণ আত্মহত্যা করিবার সংকল্প করিয়াছিল। তাহার স্বভাব অত্যমত্ম বেদনাশীল। এই ঘটনার পরে যদি তাহার সম্বন্ধে অত্যমত্ম সতর্ক না হোন তবে কোন্দিন তাহাকে হারাইবেন!’

প্রথমে মনে করা হয়েছিল অরম্নণ পাটনা পালিয়েছে। তাই রবীন্দ্রনাথ অধ্যাপক যদুনাথ সরকারের কাছে কিরণচন্দ্র ও কুলদাকুমারকে প্রেরণ করেন। যদিও অরম্নণচন্দ্র টেলিগ্রাম করে জানান তাঁর অবস্থানের ঠিকানা। আর রবীন্দ্রনাথ প্রভাতকুমারকে

গিরিডিতে পাঠান দীনেশ-পুত্রকে নিয়ে আসার জন্য। রবীন্দ্রনাথের চিঠির স্বীকারোক্তি মেনে নিলেও কোথাও একটা ফাঁক অস্পষ্ট হলেও প্রকাশ পাচ্ছে। ‘আমার ছেলে অরম্নণকে তাঁহার হাতে সঁপিয়া দিয়াছিলাম। তাহাকে লইয়া রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গে আমার একটা মনামত্মর হইয়াছিল।… ইহার পর বহুবৎসর চলিয়া গেল। ঘটনাচক্রে আমি তাঁহার সঙ্গসুখ হইতে বিচ্যুত হইয়া পড়িলাম।’

(ঘরের কথা ও যুগ888sport live football)

দীনেশচন্দ্র আত্মকথায় এই ঘটনা প্রসঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করেছেন নিজের ওপর সমসত্ম দোষ টেনে নিয়েও তিনি জানাচ্ছেন, ‘দোষ হয়ত আমারই ছিল, কিন্তু কোন কোন চক্রীলোক নানা অমূলক কথা আমার সম্বন্ধে প্রচার করিয়া এই মনোমালিন্যটা বাড়াইতে চেষ্টা করেন।’ এই ‘চক্রীলোক’ কারা হতে পারে, পাঠককে ভাবতে অনুরোধ করি।

এরপর ৪৪ এবং ৪৫-সংখ্যক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ দুজনের চিত্তভারকে লাঘব করতেই সচেষ্ট হয়েছিলেন। ‘আমি অমত্মরের সহিত অরম্নণের মঙ্গল কামনা করিয়া থাকি তাহা আপনি জানেন। সে উদ্দাম হইয়া উঠিয়া আপনাদের হৃদয়ে আঘাত করে এমন পরামর্শ আমি কখনই তাহাকে দিতে পারি না।… অরম্নণের চিত্ত অতিমাত্রায় বেদনাশীল বলিয়াই মাঝে এমন একটা বিপস্নব হইয়া গিয়াছে – কিন্তু আমি দেখিয়াছি আপনাদের সেণহাকর্ষণ সূত্র তাহার চিত্তের গভীর মূলে বাঁধা আছে – অত্যমত্ম অভিমানেও সে তাহা ছিন্ন করে নাই।’ (১০/৪৪)। ১৯১০-এর জুলাই মাসের ৩ তারিখে লেখা এ-পত্রের পাঁচ দিনের মাথায় কবি ৪৫-সংখ্যক পত্রটি লেখেন অরম্নণের বিবাহের কথা জেনে। ‘অরম্নণের বিবাহ স্থির হইয়াছে এই সংবাদে আমি অত্যমত্ম আনন্দ লাভ করিয়াছি।… এই বিবাহের দ্বারা অরম্নণের জীবন পরিপূর্ণতা লাভ করম্নক এই আমি একামত্ম মনে কামনা করি।…এতদিন অরম্নণের প্রতি আমার যে আশীর্ঝাদ ছিল বধূমাতার জীবন তাহার জীবনের সহিত যুক্ত হইলে আমার সেই আশীবর্বাদ দ্বিগুণিত হইবে।’

কিন্তু এই চিঠির সাড়ে তিন মাসের ভেতর দীনেশচন্দ্রের দিক থেকে এমন কিছু ঘটেছিল, যা অনভিপ্রেত ছিল। ১৯১০, ২৯ নভেম্বর বোলপুর থেকে রবীন্দ্রনাথ যে-পত্রটি (১০/৪৬) লিখছেন তাতেই চূড়ামত্ম হয়ে যায় এই সম্পর্কের পরিণতি। ‘আপনি এতকাল আমার যে নিন্দাবাদ করিয়া আসিয়াছেন তাহা আমি নিরম্নত্তরে শিরোধার্য্য করিয়াছি।’ চিঠির শুরম্নতে ‘এতকাল’ শব্দটি মনে সন্দেহ জাগায়। তবে কি বিষয়টি তিন-সাড়ে তিন মাসের নয়? হয়তো এর সময়সীমা তিন-সাড়ে তিন বছরের হয়ে থাকবে। কারণ, কবির লেখা ৩৬-সংখ্যক পত্রটি। চিঠির শেষে তিনি স্পষ্ট জানতে চেয়েছেন অরম্নণের খবর। এবং তাঁর বিষয়ে জানবার অধিকার যে রবীন্দ্রনাথের রয়েছে সে-কথা লিখতেও ভোলেননি তিনি। তবে মনে রাখতে হবে ইতিমধ্যে অরম্নণকে শামিত্মনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে বাড়ি নিয়ে গেছেন দীনেশচন্দ্র। প্রসঙ্গত বলা, ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ের প্রতি ভাগ্নে অরবিন্দমোহন বসুর অতিরিক্ত আকর্ষণ লক্ষ করে জগদীশচন্দ্রের স্ত্রী অবলা বসুও ঘোষণা করেন, ‘এখন হইতে… তাহাকে সবর্বদা আমাদের নিকটেই রাখিব।’ এমন মমত্মব্যে রবীন্দ্রনাথ বিরক্তই হন।

কিন্তু ৩৭ থেকে ৪২-সংখ্যক পত্রে অমত্মত রবীন্দ্রভাষ্যে কোথাও সম্পর্কের শীতলতা খুঁজে পাবেন না পাঠক। এক্ষেত্রে বলা দরকার, যেহেতু দীনেশচন্দ্রের সব চিঠি পাওয়া যায়নি তাই বিচার পর্ব একদিক থেকেই সমাধা করতে হচ্ছে। শুধু একটি পত্রে সম্ভবত ১৯১৮ ডিসেম্বর লেখা, তাতে দীনেশচন্দ্র অকপটে জানাচ্ছেন ‘আমি কোন সময়ে যদি আপনার মনে কোন কষ্ট দিয়া থাকি, তজ্জন্য অনুতপ্ত আছি। তবে আমি যদি কিছু বলিয়া থাকি, তাহা ইচ্ছাকৃত নহে, সাময়িক উত্তেজনার ফলে, এবং আমি কখনও আপনার নিন্দুকের দলে মিশি নাই।’ আট বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার এই নতুন করে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি মনে অন্য প্রশ্ন তুলে দেয়।

১৯১৩ নোবেল প্রাপ্তি কবির জীবন থেকে সাময়িকভাবে অনেক কালো মেঘকে সরিয়ে দিয়েছিল।

দীনেশচন্দ্রকে লেখা (৪৬-সংখ্যক) চিঠিতে কবি অতীব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছেন, ‘… আপনি এই বিদ্যালয় সম্বন্ধে যে সকল কথা প্রচার করিতেছেন তাহা সমূলক হইলেও আপনার পক্ষে অশোভন হইত কিন্তু অমূলক কুৎসাবাদের দ্বারা আপনি নিজেকেই লাঞ্ছিত করিতেছেন।… আমার দ্বারা আপনার যে সকল অনিষ্ট আপনি কল্পনা করিয়াছেন অমত্মর্যামী জানেন আমি সে সম্বন্ধে নির্দ্দোষ।’

তারিখবিহীন ৪৭-সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথ কিছু চিত্তক্ষোভ প্রশমন করে মূল বক্তব্য প্রকাশ করেছেন দীনেশচন্দ্রের উদ্দেশে। অনুমান, ৪৬ এবং ৪৭-সংখ্যক পত্রের মাঝে দীনেশচন্দ্র কবিকে কোনো পত্র লিখে থাকতে পারেন। হয়তোবা সে-কারণেই কবি দীর্ঘ চিঠিতে তাঁর বক্তব্য পরিষ্কার করেছেন অরম্নণ সম্বন্ধে। ‘আপনার চিঠি পড়িয়া আমি অত্যমত্ম বিস্মিত হইয়াছি। আমি কোনোদিনই অরম্নণকে চির কৌমার্য্যে দীক্ষিত করি নাই।… আমার ছেলের আমি বিবাহ দিয়াছি…।… পলায়ন ব্যাপার সম্বন্ধে আমি কিছুই জানিতাম না।… অরম্নণের অসহিষ্ণুতা সম্পূর্ণই অরম্নণের নিজের – এখানকার শিক্ষায় কখনই এমন কিছুই থাকিতে পারে না যাহাতে ছাত্রদিগকে বিশেষভাবে উদ্ধত করিয়া তুলে।… আমি যে সকল ছাত্রকে এই বিদ্যালয়ে
শিক্ষা দিয়াছি আমি তাহাদের মঙ্গল চাহিয়াছি কিন্তু তাহাদিগকে চাই নাই।’ (১০/৪৭)। তারপরেই ৪৮ এবং ৪৯-সংখ্যকপত্রে তিনি ‘দেনা-পাওনা শোধ হয়ে গেছে’ এবং ‘আপনি এক্ষণে কোনো তুচ্ছ কথা লইয়া মনকে লেশমাত্র পীড়া দিবেন না’ বলে রবীন্দ্রনাথ ‘সমুদয় উদ্বেগে’র অবসান চেয়েছিলেন।

 

ছয়

১৯১০ থেকে নোবেল প্রাপ্তির পূর্ব পর্যমত্ম দীনেশচন্দ্রের রবীন্দ্র-বিরোধিতা কমবেশি অব্যাহত ছিল। নোবেল প্রাপ্তি ও তার পরের কিছু সময় সেই প্রাবল্য কমলেও স্রোত-বেগ কিন্তু মন্দীভূত হয়নি। বরং সারাজীবনে এই সমস্যার জন্ম দিয়েছে বেশ কয়েকবার।

 

৪৭-সংখ্যক চিঠিতে দীনেশচন্দ্রের কাছে একটি অভিযোগ জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। কার সম্বন্ধে সে-কথা স্পষ্ট উলেস্নখ না
থাকলেও সামগ্রিক পরিবেশকেই দায়ী করা চলে।

‘… এতকাল ধরিয়া নানা জনশ্রম্নতি শুনিয়াও কোনো কথা কহি নাই। কিন্তু এবারে বিদ্যালয়ের আশ্রিত কোনো কোনো মহিলার সম্বন্ধে এমন অমূলক নিন্দাবাদ শুনিলাম যে তাহাতেই ধৈর্য্য সম্বরণ করা আমার পক্ষে অসাধ্য হইয়া উঠিয়াছিল।’

 

ভিতরে-বাইরে নানা সমস্যায় জেরবার রবীন্দ্রনাথ নতুন এক উৎপাতের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ান। ‘কিছুদিন আগে কোনো বাংলা দৈনিক পত্রিকায় তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) দ্বিতীয় বিবাহের সংবাদ রটনা করা হয়েছিল।’ – প্রশামত্মকুমার পাল (ষষ্ঠ খ-, রবিজীবনী, পৃ ১৮৪)। একই সঙ্গে ব্রহ্মবিদ্যালয় সম্পর্কেও নানারকম সত্য-মিথ্যা খবর সংবাদপত্রগুলিতে প্রকাশ হতে থাকে। স্বভাবতই বিদ্যালয় ও নিজের সম্পর্কে বিভিন্ন রটনা কবিকে অসন্তুষ্ট করে।

 

কিছুদিন পূর্বেই অজিতকুমার ও লাবণ্যলেখার প্রেম এবং বিবাহ রবীন্দ্রনাথকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছিল। উপরন্তু সমেত্মাষচন্দ্রের সঙ্গে ‘হিরণের মত এক মেয়ে’র খবর প্রকাশ পাওয়াতেও রবীন্দ্রনাথের অস্বস্তি দ্বিগুণ হয়। আবার অজিতকুমারের স্ত্রী লাবণ্যলেখাকে সমেত্মাষচন্দ্র পড়ানো শুরম্ন করলে রবীন্দ্রনাথের কাছে তা ‘নিতামত্মই সময়ের অপব্যয়’ বলে মনে হয়েছে।

 

আশ্রমে 888sport promo code-পুরম্নষের নৈকট্য-হেতু কবির এই স্পর্শকাতরতা, দুশ্চিমত্মার পশ্চাতে ছিল পত্রপত্রিকার বিরূপ সমালোচনা। আর কিছু মানুষের নিন্দাচর্চা। দীনেশচন্দ্র তাঁদের অন্যতম। তিনি তখন, কবির ভাষায় ‘অস্থায়ী জঞ্জালের বোঝা চাপাইয়া নিজেকে অনাবশ্যক বাধাগ্রসত্ম’-এর দলে ফেলেছিলেন।

 

সামান্য একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে দীনেশচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক দিনে দিনে জটিল আকার নেয়। দীনেশচন্দ্র নিজের সম্মান বিষয়ে যেন কিছু উদাসীন-ই ছিলেন। ‘… আপনি বাঙালি সমাজের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি এবং সকল বাঙালির সহিত যোগ দিয়া আমিও আপনাকে 888sport apk download apk latest version করিতেই ইচ্ছা করি – আপনি এই বিদ্যালয় সম্বন্ধে যে সকল কথা প্রচার করিতেছেন তাহা সমূলক হইলেও আপনার পক্ষে অশোভন হইত কিন্তু অমূলক কুৎসাবাদের দ্বারা আপনি নিজেকেই লাঞ্ছিত করিতেছেন।’ (১০/৪৬)।

দীনেশচন্দ্রের দিক থেকে এই গস্নানি মোছার চেষ্টা শুরম্ন হয় কবির নোবেল প্রাপ্তির পর। নানা সময়ে নতুন বই পাঠানো শুরম্ন হয়। বঙ্গভাষা ও 888sport live football, রামায়ণী কথা, সতী, নীলমাণিকবেহুলা, ফুলস্নরা, বৃহৎ বঙ্গ ইত্যাদি গ্রন্থ ও সময়ে-অসময়ে নানা 888sport live রবীন্দ্রনাথের মতামতের জন্য পাঠাতেন দীনেশচন্দ্র। সম্পর্কের তাপ-উত্তাপের ভেতর এই 888sport live-গল্পগ্রন্থগুলি পাঠের আগ্রহ-অনাগ্রহ লক্ষ করা যায়। বঙ্গভাষা ও 888sport live football বা, রামায়ণী কথা আগ্রহ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেন। পরবর্তীকালে সেই আগ্রহের ক্ষেত্রটি খানিক টালমাটাল হয়ে পড়ে। নীলমাণিক সম্বন্ধে ৫২-সংখ্যক পত্রে কবি লিখছেন, ‘কয়েকদিন হইল আপনার নূতন বইখানি পাইয়াছি। কিছুকাল হইতে এখানকার ছাত্রদের জন্য পাঠ্য রচনায় আমাকে এমন অধিকার করিয়াছে যে সমসত্ম দিনে স্নানাহারের সময় ছাড়া সমসত্ম সময়ই এই কাজে খাটাইতে হইয়াছে। লেখাপড়া সব বন্ধ ছিল। ইতিমধ্যে আপনার বইখানি এখানকার লাইব্রেরিতে চালান হইয়া হাতে হাতে ফিরিতেছে এইবার তাহাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া পড়িব এবং কেমন লাগিল আপনাকে লিখিব।’ (১৯১৮, ৫ ডিসেম্বর) কবির পত্রের ভাষা বুঝতে দীনেশচন্দ্রের সময় অতিবাহিত হয়নি। তাই পরের চিঠিতে তিনি লিখেছেন – ‘নীলমাণিক’ সাতদিনে লিখিত হইয়াছে, উহা আপনার পড়িবার যোগ্য হয় নাই, …।’ (১০/৮, দীনেশচন্দ্র-লিখিত)।

 

১৯৩৬-এর ৪ এপ্রিল বৃহৎ বঙ্গ বইটি প্রসঙ্গে কবি জানাচ্ছেন – ‘দীর্ঘকাল ব্যসত্ম ছিলুম এবং স্বস্থানে ছিলুম না। ফিরে এসেছি, কিঞ্চিৎ অবকাশও পেয়েছি।… গ্রন্থ সমালোচনা আমার ব্যবসা নয়, কাজটা অপ্রিয়। অভিমত প্রকাশ করতে লেশমাত্র উৎসাহ প্রকাশ করিনে। এখন আমার একামত্ম প্রয়োজন বিশ্রাম। বৃহত্তর বঙ্গ বইটি অত্যমত্ম বৃহৎ। ঐ রচনা বিচার করবার শক্তি আমার অল্প। অতএব সত্মব্ধ থাকাই শ্রেয়।’

 

বৃহৎ বঙ্গ গ্রন্থটির দুটি খ- দীনেশচন্দ্রের দশ-বারো বছরের ফসল। ‘… এই পুসত্মকের অনেক স্থলে আপনার কথা বহু সম্মানের সহিত উলেস্নখ করিয়াছি। যিনি সমসত্ম জগৎ কর্ত্তৃক অভিনন্দিত, আমার মত ব্যক্তি সেইরূপ লেখা তিনি উপেক্ষা করিতে পারেন। আমি যাহা চাহিয়াছি তাহা দাবী নহে, অনুগ্রহ, সুতরাং অনুগ্রহ প্রার্থীর কিছুতেই ক্ষুণ্ণ হইবার অধিকার নাই।’ (১০/১১, দীনেশচন্দ্র-লিখিত)।

 

সমসাময়িক হয়েও রবীন্দ্রনাথ ও দীনেশচন্দ্র – দুই সত্তা ব্যতিক্রমী মনোভাবকে (দারিদ্র্য, পত্রিকা পরিচালনা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কসবাদ, বন্ধুত্ব) সাক্ষী রেখে অসহ্য ব্যথায় কাতর হয়েছেন। আর বহু ব্যথায় ক্লামত্ম কবি পূর্বের সেই উত্তাপ হারিয়ে ফেলেছিলেন। ‘বিনোদিনীর রহস্যনিকেতনে’ যাঁর অবাধ প্রবেশ ছিল, যাঁর বঙ্গভাষা ও 888sport live football গ্রন্থখানি পুনর্বার পাঠে নতুন আনন্দ পেয়েছিলেন কবি, তিনি আজ স্বেচ্ছাপূর্বক নিজের চারিধারে অবকাশের প্রাচীর তুলে ধরতে চান। এ তাঁর ভালোবাসার অভিমান, কীর্তির বিশ্বাসযোগ্যতা।

 

গ্রন্থঋণ

১. রবীন্দ্রজীবনী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।

২. শামিত্মনিকেতন, বিশ্বভারতী, ওই।

৩. রবিজীবনী, প্রশামত্মকুমার পাল।

৪. চিঠিপত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

৫. ব্রহ্মবিদ্যালয়, অজিতকুমার চক্রবর্তী।

৬. আমাদের শামিত্মনিকেতন, সুধীরঞ্জন দাস।

৭. রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়।

৮. সব-পেয়েছির দেশে, বুদ্ধদেব বসু।

৯. আত্ম888sport sign up bonus, সজনীকামত্ম দাস।

১০. বাবুবৃত্তামত্ম ও প্রাসঙ্গিক, সমর সেন।

১১. রবীন্দ্রনাথের পলিস্নপুনর্গঠন প্রয়াস, দীক্ষিত সিংহ।

১২. রবীন্দ্র-রচিত ভূমিকা, সংকলন ও সম্পাদনা বারিদবরণ ঘোষ।

১৩. সমাজ অর্থনীতি ও রবীন্দ্রনাথ, মঞ্জুলা বসু।

১৪. জীবনের ঝরাপাতা, সরলাদেবী চৌধুরাণী।

১৫. রবীন্দ্রনাথের চিঠি ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালকে, সংকলন ও সম্পাদন গৌরচন্দ্র সাহা।

১৬. পারিবারিক 888sport sign up bonusলিপি-পুসত্মক, প্রশামত্মকুমার পাল।

১৭. বলেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, শোভন সোম।

১৮. ছিন্নপত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৯. দিনেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কের খতিয়ান, শোভন সোম।