আজকাল রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে যে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে, যাকে অনেকে বিনির্মাণ বলে দাবি করছেন, তাতে অনেক সময়ে নিজস্বতা হারিয়ে এই গান অন্যরূপে হাজির হচ্ছে শ্রোতাদের সামনে। এটা নতুন কোনো ব্যাপার নয়। রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই নানাজনে নানাভাবে রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন। কে মল্লিকের গাওয়া ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে’ কিংবা, আঙ্গুরবালার ‘তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে, তুমি ধন্য ধন্য হে’ গানদুটি শুনলেই আমার এই কথার যথার্থতা অনুভব করা যাবে। তখনো বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড তৈরি হয়নি, পরবর্তীকালে যাদের অনুমোদন ছাড়া কোনো রেকর্ড প্রকাশিত হতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সব সৃষ্টির মধ্যে গানকে সমধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে গানই যে স্থায়ী হবে – এমন কথা তিনি তাঁর লেখায় একাধিকবার উল্লেখও করেছেন। আরেকটা ব্যাপার হলো, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সবদিক থেকে একজন শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সংহত মানুষ। তাই তাঁর গান দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ও ইন্দিরা দেবীচৌধুরানীকে শিখিয়েছেন অন্যদের শেখানোর জন্য। সেসব শেখানো গান তিনি নিজে শুনেছেন, অনুমোদন করেছেন, মতামত দিয়েছেন। জীবিতকালেই শান্তিনিকেতনে নির্মাণ করেছেন সংগীতভবন। সংগীতভবনের প্রয়াসে ক্রমে ক্রমে বহু ছাত্র ও শিক্ষক তথা গায়ক-গায়িকা তৈরি হয়েছে। আরো পরে, তাঁর প্রয়াণের পরে, গঠিত হয়েছে মিউজিক বোর্ড এবং সর্বোপরি তৈরি হয়েছে রবীন্দ্রগানের সমঝদার শ্রোতা ও সমালোচক। এসব কথায় পরে আসছি।
রেকর্ড কোম্পানির রমরমার যুগে বিভিন্ন গুণী 888sport live chatী নানা আঙ্গিকের গান রেকর্ড করে বৃহত্তর শ্রোতার কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রগানের কথা ও সুরমাধুর্যে আকৃষ্ট হয়ে অনেক 888sport live chatীই গান গাইবার আবেদন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হয়েছেন। এর মধ্যে সবাই কিন্তু অনুমতি পাননি। সে-যুগের বিখ্যাত 888sport live chatী ইন্দুবালাকে তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন স্বনামখ্যাত দিলীপকুমার রায় এবং জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীকে। তাঁরা চেয়েছিলেন নানারকম তান বিস্তারে ও অলংকরণে নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে রবীন্দ্রনাথের গানে অন্য মাত্রা যোগ করতে। রবীন্দ্রনাথ তাঁদেরও অনুমতি দেননি। বলেছেন, ‘আমার গানে তো কোনো ফাঁক রাখিনি।’ দিলীপকুমার রায় সেই অভিমানে কোনোদিন গুরুদেবের গান করেননি। জ্ঞানেন্দ্রবাবু নিরাশ হলেও দমে যাননি। তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘অল্প লইয়া থাকি তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়’ গানটির সুরে নজরুলের ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর ফিরে আয় ফিরে আয়’ গানটি রেকর্ড করেছিলেন। গানের মধ্যে আপন ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিলেন। গানের সুরবিস্তারে কে মল্লিকের ‘আমার মাথা নত করে দাও’ রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন পায়নি। যদিও ওই গানটি সে-সময়ে প্রভূত জনপ্রিয় হয়েছিল। এমনকি শুদ্ধসুরে গাওয়া দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওই গানের রেকর্ডের চেয়েও। কিন্তু কালস্রোতে কে মল্লিকের গান হারিয়ে গেছে, বেঁচে আছেন স্বমহিমায় দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের মতো অসাধারণ স্রষ্টার হাতে যেসব কালজয়ী গানের জন্ম হয়েছে, তা কিন্তু তাঁর জন্মলগ্নেই জনপ্রিয় হয়নি। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা এসব গানের অন্তঃসার বুঝতে যথার্থ সমঝদারের জন্ম হয়েছে অনেক অনেক পরে। তাঁর গানগুলির জন্মক্ষণের মাহেন্দ্র মুহূর্তগুলি 888sport app download for android করলেই বোঝা যায় কোথা থেকে কোন মহান অনুভবের জন্ম হয়েছে। উন্মত্ত পদ্মার বুকে দোলায়মান বোটে বসে তিনি লিখেছেন ‘যদি বারণ করো তবে গাহিব না’, আবার চীন-সমুদ্রের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ পটভূমিতে তিনি রচনা করেছেন ‘ভুবনজোড়া আসনখানি’। বোধের এই মহাউন্মীলন একজন মহান 888sport live chatীর পক্ষেই সম্ভব।
সারাজীবন অসংখ্য কাজকর্মের ফাঁকে মোটামুটি দু হাজারের বেশি গান যিনি রচনা করেছেন তার মধ্যে মাত্র দু-তিনশো গানই কিন্তু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এখন গাওয়া হয়ে থাকে। রবীন্দ্রসংগীতের অসংখ্য রেকর্ড, সিডি পরীক্ষা করে দেখলেই এ-কথার সত্যতা প্রমাণ হয়ে যাবে। আর অনুষ্ঠানে গীত গানগুলির 888sport free bet অপেক্ষাকৃত অনেক কম। তারপর সময় ও অনুষ্ঠানের মেজাজের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গান বাছতে গিয়ে 888sport live chatীদের নির্বাচন নিতান্ত সীমাবদ্ধ হতে বাধ্য। তবু শ্রোতারা এই গানগুলিই বারবার শুনতে শুনতে এক ধরনের সমঝদার শ্রোতা হয়ে গেছেন। তাই কোথাও কোনো বিচ্যুতি দেখলে তাঁরা প্রতিবাদ করেন। বর্ষার দিনে শীতের গান গাইলে হাসেন, বসন্তকালে ‘হে নূতন’ গাইলে অবাক হয়ে যান। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমার আনন্দ 888sport app download bdপ্রাপ্তি অনুষ্ঠানে অজয় চক্রবর্তীর পরিবেশনায় রবীন্দ্রসংগীত কিন্তু অনেকেই পছন্দ করেননি। এক সময়ে আনন্দ 888sport app download bd প্রদান অনুষ্ঠানের সূচনা হতো ধ্রুপদী গানের 888sport live chatীদের রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। এভাবেই এক এক করে ভীমসেন যোশী, বালমুরলী কৃষ্ণ, শোভা গুর্তু প্রমুখ 888sport live chatী গেয়েছেন রবীন্দ্রসংগীত। অবশ্যই তাঁদের মতো করে। অচিরেই উদ্যোক্তারা বুঝেছেন এই আয়োজনের মধ্যে চমক ছাড়া আর কিছু নেই। তাই এক সময় থেকে ওই অনুষ্ঠানের সূচনাসংগীত ব্যাপারটাই উঠে যায়। রবীন্দ্রসংগীতের শুদ্ধতার প্রশ্নে এর চেয়ে বড় বাস্তব উদাহরণ আর কীই-বা হতে পারে? টিকে থাকা বা না থাকার প্রশ্নে সময়ের বড় বিচারক আর কী আছে?
এ-ব্যাপারটা কিন্তু একদিনে ঘটেনি। এমনকি রবীন্দ্রনাথের বেঁচে থাকাকালীনও জনপ্রিয়তার এই উত্তুঙ্গতা প্রকাশ পায়নি। যদিও সিনেমার কল্যাণে পঙ্কজকুমার মল্লিক, কে এল সায়গল আর কানন দেবীর কণ্ঠমাধুর্যে প্রক্রিয়াটির শুরু হয়ে গিয়েছিল তিরিশের দশকেই। তবে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ ১৯৬১ সালে রেকর্ড কোম্পানিগুলোর বদৌলতে রবীন্দ্রগানের এক রমরমার যুগ শুরু হয়। লং প্লে রেকর্ডের কল্যাণে একসঙ্গে অনেক গান গ্রথিত করা সম্ভব হয়। সে-সময়ে রবীন্দ্রনাথের প্রায় সবগুলি নৃত্যনাট্য ও গীতিনাট্য লং প্লে রেকর্ডে পরিবেশিত হয়। ক্রমে বাঙালি শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা, বাল্মীকি-প্রতিভা, শাপমোচন, কালমৃগয়া, মায়ার খেলার মতো অনন্য সৃষ্টিগুলি। আর হেমন্ত, কণিকা, সুচিত্রা, দেবব্রত, অশোকতরু, সুবিনয়, নীলিমা, অর্ঘ্য, ঋতুসহ অসংখ্য গুণী 888sport live chatীর কণ্ঠমাধুর্যে রবীন্দ্রসংগীত ক্রমশ সজীব ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এমনকি ধনঞ্জয়, সন্ধ্যা, মান্না, মৃণাল, শ্যামল বা সুবীর সেনের মতো 888sport live chatীরাও রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড করেন। রেডিও এবং পরবর্তীকালে দূরদর্শনের কল্যাণে এই গান ছড়িয়ে যায় দিক থেকে দিগন্তে। ক্রমে হিন্দি ও ভারতীয় 888sport app ভাষায় গীত হয়ে রবীন্দ্রনাথের গান পৌঁছে যায় হাজার-লাখো শ্রোতার কাছে। এভাবেই এ-গানের একটি ধারাবাহিক ঐতিহ্য ও পরম্পরা তৈরি হয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, কপিরাইট উঠে যাওয়ার পরে রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে যে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, তার চাপে এ-গান কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর – ‘না’। কারণ কালের পরিক্রমায় রবীন্দ্রসংগীতের উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তার একটাই কারণ, এর অপরূপ সৃষ্টিমহিমা। অতুলপ্রসাদের বেশিরভাগ গানের স্বরলিপি পাওয়া যায় না। দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্তের গান সংরক্ষণের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। যে যার খুশিমতো এসব গান করেন। সবচেয়ে দুরবস্থা নজরুলগীতির। মজার কথা হচ্ছে, এসব গানের ইচ্ছাকৃত বিকৃতির জন্য কেউ প্রতিবাদ করেন না। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতে সামান্য হেরফের দেখলেই নানা প্রশ্ন ওঠে। তার কারণ এর স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ, তার কারণ বিশ্বভারতী, তার কারণ এর প্রাতিষ্ঠানিক দৃঢ়তা আর শৃঙ্খলা।
কালের পরিক্রমায় পুরনো অনেক গানই হারিয়ে যায়। স্বর্ণযুগের তকমা দিয়ে অনেক গানকে ফিরিয়ে আনার ব্যর্থ চেষ্টা হয়। মজার কথা, এই সেদিনের সুমনের গান, নচিকেতার গানকে এখনকার প্রজন্ম ততটা সমাদর করে না। রিমেকের দিনও শেষ হয়ে এলো। এখন ব্যান্ডসংগীতের জনপ্রিয়তার সময়; কিন্তু এরও মেয়াদ কতদিনের, জোর দিয়ে বলা যায় না।
কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের লয়-ক্ষয় নেই। জন্মের সার্ধশতবর্ষের পরে এবং মৃত্যুর বাহাত্তর বছর পরেও অধিকাংশ 888sport live chatীর প্রথম পছন্দ রবীন্দ্রসংগীত, শেষ পছন্দ রবীন্দ্রসংগীতই। সুতরাং সামান্য অথবা অসামান্য কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি এই গানের চলমানতাকে স্তব্ধ করতে পারবে না – এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
তার সঙ্গে অন্য কয়েকটি কথাও বিচার্য। সমস্ত প্রাক্তন বাঙালি গীত-রচয়িতার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গান যে এতখানি স্থায়িত্ব, প্রচার ও প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল তার কতগুলি স্পষ্ট কারণ আছে। প্রথম কারণ, রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনেকান্ত প্রতিভার বলে ও গণমাধ্যমের সহায়তায় বাঙালি-জীবনের সেরা আইকনে পরিণত হয়েছেন। তাঁর গান প্রচার ও প্রয়োগ হয়েছে এবং হয়ে চলেছে রেডিও-রেকর্ড-live chat 888sport-থিয়েটার-সিরিয়ালে। এ-ব্যাপারে সেই গানের কোনো বিকল্প নেই। এর সঙ্গে মনে রাখতে হবে, প্রতিবেশী 888sport apps, ভারতের নানা রাজ্যে ও বিদেশের বঙ্গভাষাভাষীদের সবচেয়ে সমাদরের বন্ধু হলো রবীন্দ্রনাথ।
দ্বিতীয় কারণ, সব রবীন্দ্রসংগীতের text পাওয়া যায় গীতবিতানে এবং নববই শতাংশ গানের স্বরলিপি ধরা আছে স্বরবিতানে। তাঁর গানগুলি কালানুক্রমে সাজানো আছে। সে-গান শেখানোর জন্য চালু আছে অজস্র সংগীতসত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত আছে রবীন্দ্রসংগীতের পাঠক্রম এমনকি গবেষণাকেন্দ্র। আছে প্রশিক্ষিত শিক্ষকমন্ডলী ও উৎসুক শিক্ষার্থীদের আগ্রহ। সবচেয়ে জাগ্রত হয়ে আছে সমঝদারদের কৌতূহল, তথ্যানুসন্ধান ও উপভোগের স্পৃহা। দূরদর্শনের একটি চ্যানেল-888sport live chatীরা নিয়মিত এই গান পরিবেশন করেন। সিডি, ডিভিডি ও ক্যাসেট কোম্পানিগুলো সদাতৎপর রবীন্দ্রনাথের প্রচারে, বাণিজ্যে ও বিপণনে, কেননা তা সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতাসমাজের বদান্যতা পায় তথা লক্ষ্মীলাভ ঘটে।
বঙ্গদেশের সবকটি নৃত্যপ্রতিষ্ঠান সারা বছর নানা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের সবকটি গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করে। ফলে তার অন্তর্গত গানগুলির চর্চা অনবরত ঘটে। তার আবেদন তাই বেড়েই চলে। সবচেয়ে বড় কারণ, রবীন্দ্রসংগীতের যাঁরা 888sport live chatী (বিশেষত 888sport appsে) তাঁদের সামাজিক সম্মান, গান গেয়ে অর্থকরী প্রতিষ্ঠা ও সচ্ছলতা এবং খ্যাতি এতটাই স্পষ্টলক্ষ্য ও নির্ভরযোগ্য যে, নতুন প্রজন্মের গায়ক-গায়িকারা রবীন্দ্রসংগীত গায়নকে তাঁদের ক্যারিয়ার গঠনে কাজে লাগাচ্ছেন।
আসলে যে-কোনো গানের সাফল্য কয়েকটি রসায়নের যোগফল। প্রথমত স্রষ্টা, তারপরে তাঁর সৃষ্টি, তারপরে তার চর্চা ও শিক্ষণগত কারণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সচলতা, তার সঙ্গে গণমাধ্যমের সচেষ্ট প্রভাবের ফলে সর্বত্র তার ব্যাপ্তি ও প্রতিষ্ঠা তথা সমঝদারদের 888sport free bet বেড়ে যাওয়া। রবীন্দ্রনাথ এখন পর্যন্ত এই সাফল্যমন্ত্রে সেরা ও প্রতিদ্বন্দ্বীহীন। r
(সুধীর চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন সুশীল সাহা।)

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.