জীবনের শেষ বছর অর্থাৎ ১৯৪১ সালে শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ ‘জন্মদিনে’ নামক অসামান্য 888sport app download apkটি রচনা করেন। বিপুলা পৃথিবীর কতটুকুই বা জানেন তিনি, এই আক্ষেপ ব্যক্ত করার পর কবি ঘোষণা করেন, ‘আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি/ আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি’। সমগ্র জীবনের বিস্ময়কর 888sport live footballসাধনায় রবীন্দ্রনাথ এই ঘোষণার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। জীবদ্দশায় ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্ত, প্লেগ, দুর্ভিক্ষের মতো প্রাণঘাতী বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। তাঁর 888sport live footballকর্মে এসব মহামারির জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে। এর বাইরে একজন সক্রিয় জনস্বাস্থ্যকর্মী হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। সাম্প্রতিক করোনা-সংকটে তাই লড়াইয়ের প্রেরণা হতে পারেন রবীন্দ্রনাথ।
১৮৯৮ থেকে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ভারতে প্লেগ বিরাট আকার ধারণ করে। কলকাতায় এর প্রভাব মারাত্মক হয়ে ওঠে। আতঙ্কের নানা খবরে কলকাতায় তুমুল শোরগোল পড়ে গিয়েছিল।
১৮৯৮-এর অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশ পায় এমনই একটি 888sport world cup rate – ‘আতঙ্কের রূপ অদৃষ্টপূর্ব। আর কখনো কলকাতার বিপুল জন888sport free bet এইরকম প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়নি। যেসব জেনানার মুখ ‘সূর্যও দেখেনি’, তাঁরাও শহরের পথের উপর দিয়ে দৌড়েছেন, বা ট্রামে-চড়ে পালাতে চেয়েছেন। … গত কয়েকদিনের বিপুলসংখ্যক মানুষের পলায়ন, সেইসঙ্গে দোকানপাট বন্ধ এবং পথে গাড়ি-ঘোড়ার অনুপস্থিতি – সব মিলিয়ে কলকাতা পরিত্যক্ত নগরীর চেহারা ধরেছিল।’
প্লেগ ঠেকাতে ব্রিটিশ সরকার টিকা দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু তীব্র ইংরেজ-বিদ্বেষ, গুজব, রোগ-ভীতি, পর্দানসিন সাধারণের অন্দরমহলে বাইরের লোকের প্রবেশ ইত্যাদি নানা কারণে সাধারণ মানুষ ক্ষেপে উঠেছিল। এমনকি রামকৃষ্ণ মিশন থেকে এ-বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারপত্র বিলি করা হলে মঠের সন্ন্যাসীদের ওপর আক্রমণও হয়। স্বামী বিবেকানন্দ যেদিন দার্জিলিং থেকে ব্যাগপত্র নিয়ে কলকাতায় আসেন, রাস্তার মানুষ তাঁর প্রতিও মারমুখী হয়ে ওঠে। স্বামীজির ব্যাগে নাকি প্লেগের টিকা আছে। অবশেষে হাত জোড় করে স্বামীজিকে বলতে হয় যে, তিনি ফকির মানুষ, বিদেশ থেকে ফিরছেন।
কলকাতার নাগরিকদের সচেতন করতে রবীন্দ্রনাথও উদ্যোগী হয়েছিলেন। ঠাকুরবাড়ির প্রায় সকল সদস্যই তাতে অংশ নেন। ক্যালকাটা নোটসে ভগিনি নিবেদিতা লিখেছেন, ‘কিছু মহৎ হিন্দু পরিবার বিশেষত ঠাকুরবাড়ি গণউত্তেজনা প্রশমনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিল।’ ঠাকুরবাড়ি যখন প্লেগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, সে-সময়েই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশুকন্যা প্লেগ-আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
শুধু প্লেগ নয়, কলেরা বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো মহামারিতেও রবীন্দ্রনাথ সক্রিয় ভূমিকা নেন। ১৯১৫ সালে বাংলায় কলেরা মারাত্মক আকার ধারণ করে। এর কয়েক বছর পরে যখন ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির আকার নেয় তখন রবীন্দ্রনাথ কবিরাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। শান্তিনিকেতনে এই ফ্লু যাতে না ছড়াতে পারে, সেজন্য তিনি ‘পঞ্চতিক্ত’ পাচন খাইয়েছিলেন প্রত্যেককে। বন্ধু জগদীশচন্দ্রকে এই পাচনের কথা জানিয়ে তিনি একটি পত্রে লিখেছিলেন, ‘বৌমার খুব কঠিন রকম ন্যুমোনিয়া হয়েছিল। অনেক দিন লড়াই করে কাল থেকে ভাল বোধ হচ্ছে। … কিন্তু ছেলেদের মধ্যে একটিরও ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়নি। আমার বিশ্বাস, তার কারণ, আমি ওদের বরাবর পঞ্চতিক্ত পাঁচন খাইয়ে আস্চি। … আমার এখানে প্রায় দুশো লোক, অথচ হাসপাতাল প্রায়ই শূন্য পড়ে আছে – এমন কখনও হয় না – তাই মনে ভাবচি এটা নিশ্চয়ই পাঁচনের গুণে হয়েচে।’ এই পাঁচন ছিল নিম, গুলঞ্চ, বাসক, পলতা ও কন্টিকারির মিশ্রণ।
১৯২৯ সালে এক চিঠিতে তিনি প্রশান্ত মহলানবিশকে লিখেছিলেন, ‘তুমি তো জান আমি চিকিৎসাবায়ুগ্রস্ত।’ বহু ডাক্তারি বই তিনি খুঁটিয়ে পড়েছেন, আর নিজের ওপরে ও আত্মীয়-বন্ধুর ওপরে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি করা তাঁর প্রায় নেশাই ছিল। শান্তিনিকেতনের ছাত্র ও গ্রামের গরিব মানুষদের ওপরেও নিয়মিতভাবেই ডাক্তারি করেছেন এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের সচেতন করেছেন।
কুম্ভমেলা আর পুরীর রথযাত্রাকে কলেরার বড় উৎস ভাবতেন ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিরা। তাই ১৯১৪ সাল নাগাদ কলেরার টিকা নিয়ে জোরজবরদস্তি শুরু হলে এই দুটো অনুষ্ঠান বাধাগ্রস্ত হয়। ১৯৩০-এর এলাহাবাদ কুম্ভমেলা থেকে কলেরা রোগী ও টিকাবিহীনদের আলাদা করে সরিয়ে রাখার জন্য কঠোরতা শুরু হয়। আবার গুটিবসন্তের ক্ষেত্রেও দেশীয় মানুষের সঙ্গে সরকারের সংঘাত বাধে। সরকার জেনার প্রবর্তিত টিকা দেওয়ার আগে দেশীয়রা, বিশেষ করে হিন্দুরা, একরকম দেশীয় টিকা দিতেন। টিকাদারেরা মানুষের গুটিবসন্তের রস ও মামড়ি শুকিয়ে সেটাকেই টিকা হিসেবে ব্যবহার করতেন। অনেক সময় শীতলাপূজা বা অন্যরকম ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করে দেশীয় টিকা দেওয়া হতো। জেনারের টিকার সঙ্গে এই পুরনো টিকার সংঘাত বাধল। এসবই ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়।
প্লেগের ব্যাপারে সরকারি দমননীতির সবচেয়ে উগ্র প্রকাশ দেখা গিয়েছিল। ১৮৯৭ সালে সরকার সারা ভারতে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত এক ভয়ংকর আইন জারি করে। রবীন্দ্রনাথ তখন মধ্য-তিরিশে। রোগ সন্দেহে পৃথকীকরণ, রোগে দূষিত সম্পত্তি নষ্ট করা, সন্দেহ হলেই সড়ক, রেল, এমনকি বাড়ি গিয়ে খানাতল্লাশি করা, এমনকি বাড়ি ভেঙে ফেলা – সরকারি কর্মচারীদের এসব অধিকার দেওয়া হয়। স্বভাবতই দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়। কলকাতা শহরেও মেথর, মজুর ও ভিস্তিওয়ালারা ধর্মঘট করে। শহর নরক হয়ে ওঠে, দলে দলে লোক পালাতে থাকে। প্লেগের চাইতে সরকারি ‘পিলেগ-গাড়ি’র শব্দ মানুষের মনে বেশি আতঙ্ক সৃষ্টি করতে থাকে।
ব্রিটিশ শাসনেই প্রথম আধুনিক অর্থে জনস্বাস্থ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়; কিন্তু সত্যিকারের ‘জন’কে যথাসম্ভব দূরে সরিয়ে রেখে সেই ‘জনস্বাস্থ্য’ গড়ে তোলা হয়। ভারতের নাগরিক তখনো কেউ ছিল না, ছিল মহারানির দুর্ভাগা প্রজা। এই ‘জনস্বাস্থ্যে’ তারা ছিল বহিরাগত। শান্তিনিকেতনে, বিশেষ করে শ্রীনিকেতনে, তিনি পল্লীগঠনের যে-কাজে হাত দিয়েছিলেন তার মধ্যে তাঁর স্বাস্থ্যবিষয়ক, বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিন্তাভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পল্লী-উন্নয়নের মডেলে স্বাস্থ্য উন্নয়ন একটি মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে ছিল। এই মডেলটি আলোচনা করলে দেখা যাবে তাঁর পরিকল্পনার একটা মৌলিক এলাকা ছিল স্বাস্থ্য। জনস্বাস্থ্য কথাটা তখনো এমন চালু হয়নি, হলে হয়তো রবীন্দ্রনাথ ওই কথাটাই ব্যবহার করতেন। পল্লী উন্নয়নের গোড়াতেই কয়েকটি ক্ষেত্রে কাজ করা দরকার বলে তিনি ভেবেছিলেন ও পরিকল্পনা করেছিলেন। তার মধ্যে রয়েছে আর্থিক উন্নয়ন, শিক্ষা, তথ্য আদান-প্রদান, স্বাস্থ্য, পল্লী সংগঠন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কাজের যে-জায়গাগুলো আলাদা করে তৈরি করা হয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়া বিতাড়ন, স্যানিটারি ক্ষেত্রে উন্নতি, প্রসব (মা ও শিশুর যত্ন), কুষ্ঠরোগের বিরুদ্ধে কার্যক্রম। প্রশিক্ষণের মধ্যে ছিল ধাত্রী-প্রশিক্ষণ।
রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, মহামারিপীড়িত গ্রামকে বাঁচাতে শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনায় কাজ হবে না। ১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনের কাছে ম্যালেরিয়াগ্রস্ত জনপদে পথে নামলেন, ধারাবাহিক প্রচেষ্টার জোরে গ্রামবাসীর মনে গেঁথে দিলেন সাহস ও বিশ্বাস। ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, দেশি-বিদেশি ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী নিয়ে গ্রামে গ্রামে খোলা হলো সেবাকেন্দ্র। ম্যালেরিয়া আক্রান্ত গ্রামকে সুস্থ করতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী হলেন দক্ষ জীবাণু বিশেষজ্ঞ, দ্য সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া সোসাইটির সেক্রেটারি গোপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও আমেরিকার রকফেলার ফাউন্ডেশনের ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় পরিদর্শক ডাক্তার জে এফ কেন্ড্রিক। অ্যান্টি ম্যালেরিয়া সোসাইটির সভায় সভাপতির বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘গোপালবাবু যে কাজে প্রবৃত্ত হয়েছেন তাতে লোকে এই কথা বুঝতে পারবে যে, পাশের লোকের বাড়ির ডোবায় যে মশা জন্মায় তারা বিনা পক্ষপাতে আমারও রক্ত শোষণ করে, অতএব তার ডোবায় সংস্কার করা আমারও কাজ।’
রবীন্দ্রনাথের কাছে (জন) স্বাস্থ্য চিন্তার আসল উপাদান এই নয় যে, ঠিক কতটা উপকার করা গেল। আসল কথা হলো, সেটা সমাজের নিজস্ব বস্তু হয়ে উঠল কি না, সমাজ সত্যি সেই শিক্ষাটা নিতে পারল কি না। শিক্ষা গ্রহণের পরে সেটা নিজেই নিজের কাজে লাগানোর জন্য সমাজের তৈরি হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একই সভায় রবীন্দ্রনাথ আরো বলেন, ‘আমাদের মাননীয় বন্ধু ডাক্তার গোপালচন্দ্র চ্যাটার্জী যে কাজে প্রবৃত্ত হয়েছেন এ যদি শুধু মশা মারার কাজ হত তা হলে আমি একে বড় ব্যাপার বলে মনে করতুম না। দেশে মশা আছে এটা বড়ো সমস্যা নয়, বড়ো কথা এই – লোকের মনে জড়তা আছে। সেটা আমাদের দোষ, বড়োরকমের দুঃখ-বিপদের মূল কারণ সেখানে। ওঁরা এ কাজ হাতে নিয়েছেন, সেজন্য ওঁদের কাজ সবচেয়ে বড়ো বলে মনে করি। গোপালবাবু উপকার করবেন বলে কোমর বেঁধে আসেন নি।’
নির্বাচিত যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই সময়ের করোনা-যুদ্ধে সক্রিয় কর্মীরা রবীন্দ্রভাবনারই মূর্ত রূপ যেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাইরে থেকে মানুষের প্রতিদিনের প্রয়োজন মেটানো যায় না, বরং নিজের সমস্যাকে চিনতে পারার চেতনা তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুললে সংক্রমণ সম্পর্কে অশিক্ষিত, দৈববিশ্বাসী গ্রামগুলি সচেতন হবে। গ্রামীণ জনপদে এই গণচেতনার জাগরণ ও বিস্তারে সফল হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৯ সালে শ্রীনিকেতনের আশেপাশের ১১৪টি গ্রামে ব্রতী বালকদের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ। জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রধান চিকিৎসক। তাঁর উদ্যোগে গ্রামের ৬ হাজার ৭৬০ জন মানুষ সে-বছর ওষুধ নিতে এসেছিলেন। ব্রতী বালকদের নিয়ে তিনি আর তাঁর সহযোগীরা গ্রামে গ্রামে গেছেন। স্বাস্থ্যবিধি কীভাবে মানলে রোগের প্রকোপ কমবে তা হাতে ধরে গ্রামবাসীকে বুঝিয়েছেন। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে যে-কোনো সময়ে যে-কোনো রোগ মহামারির আকার নিতে পারে। সহজ পাঠে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আজ মঙ্গলবার। জঙ্গল সাফ করার দিন।’ এটি শুধু শিশুপাঠ্য বইয়ের কথা নয়, বাস্তব জীবনেও তাঁর কাছে বিষয়টির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস, টাইফয়েড, রক্ত আমাশয়, গ্যাংগ্রিন তখন গ্রামাঞ্চলে প্রধান অসুখ। ব্রতী-বালকদের নিয়ে চিকিৎসক আর তাঁর সহযোগীরা গ্রামে গ্রামে গেছেন। স্বাস্থ্যবিধি কীভাবে মানলে রোগের প্রকোপ কমবে তা হাতে ধরে গ্রামবাসীকে বুঝিয়েছেন। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে যে-কোনো সময়ে যে-কোনো রোগ মহামারির আকার নিতে পারে। অনেক সময় ওষুধ খেয়ে রোগ কমে গেলে গ্রামবাসীর জীবনযাপনে নানা শিথিলতা দেখা যেত, ওষুধ খেতেও চাইতেন না আর। ১৯২৮-এ ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কিছু কম, তাই কুইনাইন খাওয়া বন্ধ করে দিলেন অনেকে। যাঁরা কুইনাইন খেলেন না তাঁদের মধ্যে শতকরা ৮৩ জনের ফের ম্যালেরিয়া হলো। বাঁধগোড়া গ্রামের পরিদর্শক ঊষারঞ্জন দত্ত। তাঁর রিপোর্ট থেকে জানা গেল, ১৯২৯-এ বাঁধগোড়া দক্ষিণপাড়ার মুসলমানেরা কুইনাইন খেতে চাননি। ফল ভালো হলো না। ত্রিশজন অধিবাসীর মধ্যে চারজন ম্যালেরিয়ায় জর্জরিত। শুধু ওষুধে ম্যালেরিয়া যাবে না। ভুবনডাঙায় ব্রতী-বালকেরা তাই ১৫টি ছোট ডোবা ভরাট করেন। মশার ডিপো ভরাট না করলে উপায় কী? কোথাও কোথাও ডোবাতে কেরোসিন দেওয়ারও ব্যবস্থা ছিল। বাহাদুরপুরে ৩৫টি ডোবায় কেরোসিন দেওয়া হয়েছিল। ভুবনডাঙায় ৩০০ গজ নালাও কাটা হলো যেন জল আর না জমে। পরিষ্কার করা হলো এক বিঘা জঙ্গল। এসবই হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে।
শান্তিনিকেতনে এসে তাঁর কাজ দেখে মুগ্ধ হন বিশ্ব-ম্যালেরিয়া নিবারণে সক্রিয় মার্কিন ডাক্তার জে এফ কেন্ড্রিক। সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে পরে তাঁর কাছে ‘মডেল’ হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের ভাবনা। প্রত্যন্ত গ্রামীণ স্তরে বেসরকারি উদ্যোগে মহামারি প্রতিরোধে রবীন্দ্রনাথ স্বাস্থ্য-সচেতনতার ওপর জোর দিয়েছিলেন, সক্রিয় ছিলেন বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্যকর্মী সংগ্রহেও। শান্তিনিকেতনের চারপাশে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে কাজ করেছিলেন লেনার্ড এলমহার্স্ট, ডাক্তার হ্যারি টিম্বার্স প্রমুখ। নিজেদের শ্রম ও অর্থ বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও অর্থ সংগ্রহ করে রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁরা।
১৯৭৮ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আলমা-আটায় এক সম্মেলনে ঘোষণা করে, ‘জনগণের নিজস্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকল্পনা ও রূপায়ণে তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে অংশগ্রহণের অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে।’ রবীন্দ্রনাথ ‘পল্লীর উন্নতি’ 888sport liveে বলেছিলেন, ‘আজ এই কথা পল্লীকে বুঝতেই হবে যে, তোমাদের অন্নদান জলদান বিদ্যাদান স্বাস্থ্যদান কেউ করবে না। ভিক্ষার উপরে তোমাদের কল্যাণ নির্ভর করবে এতবড়ো অভিশাপ তোমাদের উপর যেন না থাকে।’ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণা ও রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের মর্মার্থ অভিন্ন। ভিক্ষার ওপর জনস্বাস্থ্য নির্ভর করবে না। জনস্বাস্থ্য জনগণের অধিকার। জনস্বাস্থ্য নিয়ে তাঁর চিন্তার মূল জায়গাটাই ছিল ‘জনে’র শিক্ষা। এমন শিক্ষা যা মানুষকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে, নিজের ভালো-মন্দ নিজে বুঝে নিতে সাহায্য করে।
করোনা ভাইরাসের মহামারির মধ্যে অর্থনীতি সংকুচিত হলেও বিশ্বজুড়ে সামরিক ব্যয় বেড়েছে। সুইডেনের স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা 888sport world cup rateে একথা বলা হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য এ-প্রবণতা অত্যন্ত বিপজ্জনক। বিস্ময়কর লাগে ভাবতে যে, সামরিক ব্যয়ের সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের উন্নতির ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক রবীন্দ্রনাথ শতবছর আগেই দেখিয়ে গেছেন। ‘ভারতবর্ষে সমবায়ের বিশিষ্টতা’ 888sport liveে তিনি লিখেছিলেন, ‘ডেনমার্কের একটি মস্ত সুবিধা এই যে, সে দেশ রণসজ্জার বিপুল ভারে পীড়িত নয়। তার সমস্ত অর্থই প্রজার বিচিত্র কল্যাণের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে নিযুক্ত হতে পারে। প্রজার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও 888sport app সম্পদের জন্যও আমাদের রাজস্বের ভারমোচন আমাদের ইচ্ছাধীন নয়।’
‘পল্লীপ্রকৃতি’ 888sport liveে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘রোগপীড়িত এই বৎসরে আজ আমরা বিশেষ করে এই ঘোষণা করছি যে, গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে হবে, অবিরোধে একব্রত সাধনার দ্বারা। রোগজীর্ণ শরীর কর্তব্য পালন করতে পারে না। এই ব্যাধি যেমন দারিদ্র্যের বাহন, তেমনি আবার দারিদ্র্যও ব্যাধিকে পালন করে। আজ নিকটবর্তী বারোটি গ্রাম একত্র করে রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। এই কাজে গ্রামবাসীর সচেষ্ট মন চাই। তারা যেন সবলে বলতে পারে, ‘আমরা পারি, রোগ দূর আমাদের অসাধ্য নয়।’ যাদের মনের তেজ আছে তারা দুঃসাধ্য রোগকে নির্মূল করতে পেরেছে, ইতিহাসে তা দেখা গেল।’ গায়ের জোরে আইন করে বাইরে থেকে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি করার প্রক্রিয়া ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। আজকের স্বীকৃত পদ্ধতি হলো, সমাজের মধ্য থেকে মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়ার মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে, সামাজিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো। রবীন্দ্রনাথের জনস্বাস্থ্য-ভাবনার এটিই মূল কথা। বিদ্যমান মহামারি করোনা মোকাবিলায় সামাজিক প্রচেষ্টাকে জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি। জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে সমাজদেহকে সক্রিয় অংশীদার করার রাবীন্দ্রিক প্রয়াসটি আজ তাত্ত্বিকভাবে পাশ্চাত্য মেডিসিনের তথা আধুনিক চিকিৎসা888sport apkের স্বীকৃত দর্শন। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা তাই এ-যুগেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.