রাতের রবীন্দ্রনাথ

রাত যখন নেমে আসে, তখন পৃথিবী তার সমস্ত কোলাহল গুটিয়ে নেয়। তখন যেন ভাষার ভেতর থেকে ঝরে পড়ে গোপন কোনো জ্যোৎস্না, শূন্য আকাশে বাজে অশ্রম্নত বীণা। ঠিক তখনই রবীন্দ্রনাথকে অন্যরকমভাবে পাওয়া যায় – দিনের আলোকিত জনসমক্ষ নয়, রাতের গভীর নির্জনতায়। সেই রাতের রবীন্দ্রনাথ, যিনি কোনো রাজনৈতিক সভায় বক্তা নন, কোনো সমাজসংস্কারক নন, কোনো কবিদের গুরু নন, বরং যিনি নিভৃত ঘরে বসে নিজের অন্তরকে শোনেন। সেই শোনার অনুরণন গেয়ে ওঠে গানের আকারে, ছড়িয়ে পড়ে আর আমাদের ভেতরের গোপন ঘরে গিয়ে টোকা মারে। রবীন্দ্রনাথের রাতপর্যায়ের যে গানগুলো – কখনো ভৈরবীর শূন্য রাত, কখনো পরজের নিবিড় অন্ধকার, কখনো মল্লারের ঝড়ভেজা প্রহর, কখনো বেহাগের নিশীথ নির্জনতা – এগুলো আসলে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত আত্ম-আলাপ। যাকে আমরা গান বলি, আসলে তা তাঁর আত্মর্নিবিষ্ট আর্তি, তাঁর অন্তর্নিহিত বিশ্বাস, তাঁর অনিবার্য স্বীকারোক্তি। রাতের প্রহরে যখন মানুষের কণ্ঠ নিস্তব্ধ, প্রকৃতির কোলাহল স্তিমিত, তখন তাঁর ভেতরের মানুষ – যে মানবপ্রেমে কাতর, বন্ধুহীনতায় দগ্ধ, আধ্যাত্মিকতায় তৃষ্ণার্ত – সে এসে বসে। আর তখন যে-রবীন্দ্রনাথকে দেখা যায়, তিনি অনেকটা শিশুর মতো, অরক্ষত, ভীত, অথচ আশ্রয়প্রার্থী নয়, বরং আশ্রয়দাতা, আলোকবাহী।

এরকম একটি গানে দেখি : ‘কাল রাতের বেলা গান এল মোর মনে, তখন তুমি ছিলে না মোর সনে।’ এখানে অনুপস্থিতির ভেতর দিয়ে ধরা দেয় তাঁর সৃষ্টির তৃষ্ণা। যে-কথা কাউকে বলা যায় না, সেই কথাই উঠে আসে গানে। যেন রাত তাঁর কাছে শুধু নৈঃশব্দ্যের সময় নয়, এক সৃষ্টির হোমকুণ্ড যে হোমকুণ্ড ব্যথা-অভিমান-অপূরণ ধীরে ধীরে রূপ নেয় সুরে। এই রূপান্তরই তো কবিত্বের মহিমা – অন্ধকার থেকে আলো তৈরি করা, ব্যক্তিগত ব্যথা থেকে সর্বজনীন সংগীত সৃষ্টি করা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শুধু প্রেমিকের কণ্ঠে গান গেয়েই থেমে যান না। তাঁর রাত আসলে ধ্যানের রাত, জিজ্ঞাসার রাত। ‘ডাকো মোরে আজি এ নিশীথে’ – এ-গান শুধু প্রেমিকার প্রতি আহ্বান নয়, এ হলো নীরব প্রার্থনা, এক আত্মিক ডাক। এখানে ঈশ্বর, প্রেমিক, সঙ্গী – সব একই সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। রাতের প্রহরে তিনি যে কণ্ঠে ‘ডাকো’ বলেন, তা নিছক আবেগ নয়, বরং আত্মাকে জাগ্রত করার, গোপন ঘরে আলো জ্বালানোর আর্তি। রাতের অন্ধকারের ভেতরেও তিনি দীপ চান, অমৃত চান। তাই রবীন্দ্রনাথের নিশীথরাত্রি আসলে এক আধ্যাত্মিক সংলাপ – যেখানে তিনি নিজের চেতনার কাছে বারবার ফিরে আসেন, প্রশ্ন করেন, সাড়া পান, আবার নিঃশব্দে থেমে যান।

তবে রাত সবসময় ধ্যানের শান্তি নিয়ে আসে না। কখনো সে আসে ঝড় হয়ে, দিগ্বিদিক আঘাত করে। ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ – এই গানে তেমনই এক ভাবের প্রকাশ। এখানে রাত যেন ভয়াবহ, অন্ধকারে 888sport app, প্রলয়ের মতো। অথচ সেই রাতেই তিনি অপেক্ষা করেন প্রিয়জনের জন্য, দরজা খুলে বসে থাকেন। এই অপেক্ষা প্রেমিকেরও হতে পারে, আবার ঈশ্বরপ্রত্যাশী ভক্তেরও হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের কবিত্বের বিশেষত্বই হলো এই দ্ব্যর্থতা, যা একাধারে ব্যক্তিগত প্রেম ও সর্বজনীন ভক্তির রূপে ধরা দেয়। আর ঝড়ের রাতেও তিনি যে আসার সম্ভাবনা রাখেন, সেটিই তাঁর অটল বিশ্বাসের প্রকাশ।

এই বিশ্বাস রাতের গহিনে এক নতুন আলো হয়ে ওঠে। যেমন ‘আজি বিজন ঘরে নিশীথরাতে আসবে যদি শূন্য হাতে’ – এখানে কণ্ঠে কোনো ভয়ের সুর নেই। বরং তিনি নির্ভীক। জানেন, যিনি আসবেন, তিনি হাতে কিছু না আনলেও, তাঁর হাতে আছে আশ্রয়। এই আত্মসমর্পণ, এই আস্থার গভীরতা রাতের নৈঃশব্দ্যের ভেতরেই জন্ম নেয়। দিনমানের কোলাহল মানুষকে ব্যস্ক রাখে, কিন্তু রাত মানুষকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করায়। সেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ যে প্রেমের হাত ধরেন, তা আসলে মৃত্যুকেও অস্বীকার করে। রাত তাঁর কাছে আবার উৎসবও। যেমন দীপালিকার গান : ‘হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে হেমমিত্মকা করল গোপন আঁচল ঘিরে।’ এখানে রাত শীতল, আঁধারঘেরা, তবু মানুষের হাতে আলো। সেই আলোয় পৃথিবী ভরে ওঠে আনন্দে। রবীন্দ্রনাথের রাত কখনো নিস্তব্ধ অন্ধকার নয়, বরং মানুষের নিজের আলোয় জয় করা অন্ধকার। এই জয়ই তাঁর অন্তর্বিশ্বাস – অন্ধকার চিরন্তন হলেও মানুষের হাতে রয়েছে প্রদীপ, মানুষের অন্তরে রয়েছে গান। কিন্তু রাতকে তিনি সবসময় বাহ্যিক ঘটনায় সীমাবদ্ধ রাখেন না। তিনি রাতকে আত্মার প্রতীক করে তোলেন। ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’ – এখানে একা থাকা, নির্জন কোণে বসে থাকা, প্রিয়জনের অপেক্ষা – সব মিলিয়ে রাত যেন আত্মার পরীক্ষা। জ্যোৎস্নার আলো বাইরে ভরে যায়, কিন্তু তাঁর ঘর একা, তাঁর অন্তর একা। আর সেই একাকিত্বে তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন অপেক্ষায়। এ-অপেক্ষাই তাঁর বিশ্বাসকে উজ্জ্বল করে – হয়তো আসবে, হয়তো আসবেই।

তবু রাতের গভীরতায় কখনো আসে সমাধান, শামিত্ম। ‘গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে’ – এই গানে রাত আর নিছক অন্ধকার নয়, তা এক অসীম মঙ্গলের সঙ্গে মাধুরীর মিলন। বাহ্যিক চপলতা স্তব্ধ হয়, অন্তরে বাজে শাস্তি – শান্তি – শান্তি। এ-শান্তি রাতেরই দান, কারণ রাতই মানুষকে শেখায় নিজের ভেতরে প্রবেশ করতে, নিজের হৃদয়ের প্রদীপ দেখতে। কিন্তু রাত শুধু শান্তির নয়, বিস্ময়েরও। ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’ – এখানে রাত এক অজানা শক্তির প্রতীক। ঝড় এলো, ভেঙে দিলো, অন্ধকারে সব হারালেন। অথচ সকালবেলা দেখলেন – যিনি আসার, তিনি এসেছেন। এ যেন মৃত্যুর ভেতর দিয়ে জীবনের সাক্ষাৎ, শূন্যতার ভেতর দিয়ে পূর্ণতার আগমন। রবীন্দ্রনাথের রাত এখানে ধ্বংসের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির পথ খুলে দেয়।

এভাবেই আমরা দেখি, রাত রবীন্দ্রনাথের কাছে কেবল সময় নয়, এক আত্মিক প্রতীক। তা প্রেমের, তা ভক্তির, তা ভয়াবহতার, তা শান্তির, তা আলোর উৎসবের। নিশীথরাতে তিনি একদিকে নিজের নিভৃত অন্তরের সঙ্গে কথা বলেন, আরেকদিকে মানুষের চিরন্তন আশা ও ভয়ের গল্পও শোনান। তাঁর গানগুলো আমাদের শেখায় – অন্ধকার কখনো চূড়ান্ত নয়, রাত কখনো কেবল ভয় নয়, বরং রাতই জন্ম দেয় নতুন ভোরকে।

দুই

রাতের মধ্যে এক আশ্চর্য দ্বন্দ্ব আছে – একদিকে নিস্তব্ধতা, অন্যদিকে ঝড়ের গর্জন। একদিকে সমস্ত জগৎ ঘুমিয়ে পড়ে, অন্যদিকে অশান্ত হৃদয় জেগে থাকে। এই দ্বন্দ্বই রবীন্দ্রনাথের নিশীথকে আলাদা করে তোলে। তাঁর ভেতরের মানুষ কখনো প্রলয়ের অন্ধকারে কাঁপে, কখনো নিজেকে আশ্রয় দেয় শান্তির বেদিতে। সেই ওঠাপড়া, সেই ঢেউয়ের মতো গতি তাঁর গানে সঞ্চারিত হয়। ভাবুন, ‘নিদ্রাহারা রাতের এ গান বাঁধব আমি কেমন সুরে’ – এই পঙ্ক্তির মধ্যে কত নিঃসঙ্গতা লুকিয়ে আছে। যখন চারদিক ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন তিনি জেগে আছেন, আর নিজের জেগে থাকা নিয়েই দ্বিধায় পড়েছেন। কোন সুরে গাঁথা যায় এই নির্ঘুম রাতের গান? এ-প্রশ্ন নিছক সংগীতের প্রশ্ন নয়, এ হলো সৃষ্টির দ্বিধা, জীবনের দ্বিধা। রজনীগন্ধার ঘ্রাণ, করবীর রক্তিম রং, শিশিরভেজা পথ – সব মিলিয়ে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন এক অদৃশ্য সুর। যেন রাত তাঁকে শুধু নিঃসঙ্গ করেনি, তাঁকে কাব্যের সন্ধানীও করেছে। রবীন্দ্রনাথের নিশীথে তাই শুধু প্রার্থনা নয়, শুধু প্রেমও নয়, এখানে আছে স্রষ্টার অন্তহীন অনুসন্ধান। এই অনুসন্ধান তাঁকে একদিকে ভেঙে দেয়, অন্যদিকে গড়ে তোলে। হয়তো সে-কারণেই তিনি লিখতে পারেন : ‘আমার নিশীথরাতের বাদলধারা, এসো হে গোপনে।’ এখানে রাত মানে শুধু অন্ধকার নয়, বর্ষার মৃদু শব্দ, নিঃশব্দ সঙ্গী। বাদলের সঙ্গে কথা বলা মানে প্রকৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গতা, আর এই অন্তরঙ্গতার ভেতর দিয়েই আসে নতুন সৃষ্টির বীজ।

আমরা যখন রাতকে ভাবি, তখন তাকে কেবল ঘুম, নিদ্রা বা ভয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ রাতকে মানবহৃদয়ের এক বিশেষক্ষেত্র করে তুলেছেন। রাত তাঁর কাছে পরীক্ষা – কে আসবে, কে আসবে না, কে আলো জ্বালাবে, কে আঁধার বাড়াবে।

আবার রাত তাঁর কাছে উপহারও – আত্মসমর্পণের, নিভৃত ভালোবাসার, অপ্রকাশিত আকাঙ্ক্ষার। রাতপর্যায়ের গানগুলির মধ্যে তাই আমরা একরকম আত্মজীবনী পাই, যদিও তা সরাসরি আত্মজীবনী নয়। কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজেকে ব্যক্তিগত ব্যথায় সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁর ব্যক্তিগত রাত ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে আমাদের সবার রাত হয়ে। তাঁর ঝড় আমাদের ঝড়, তাঁর দীপালিকা আমাদের আলোর উৎসব, তাঁর নীরব নিশীথ আমাদের নির্জন ধ্যান। অথচ লক্ষ করলে দেখা যায়, এই রাতের গানগুলোতে একধরনের নাটকীয়তা আছে। কখনো দরজা খুলে বসে থাকা, কখনো প্রদীপ জ্বালানো, কখনো বাতাসে কাঁপতে থাকা – সবই যেন দৃশ্যমান। মনে হয় আমরা একটা নাট্যমঞ্চে দাঁড়িয়ে আছি, আর সেখানে অদৃশ্য অথচ উপস্থিত কোনো প্রিয়জনের প্রতীক্ষা চলছে। এই নাটকীয়তাই রবীন্দ্রনাথকে জীবন্ত করে তোলে – তাঁর রাত শুধু বিমূর্ত নয়, দৃশ্যমানও। রাতের কবি রবীন্দ্রনাথ তাই কখনো নিস্তব্ধ সন্ন্যাসী, কখনো ব্যাকুল প্রেমিক, কখনো আশ্চর্য শিশুর মতো বিস্ময়াকুল। তিনি একা বসে থেকে প্রশ্ন করেন, আবার উত্তরও শোনেন নিজের ভেতর থেকে। তাঁর সৃষ্টিশীলতা যেন এক অন্তহীন সংলাপ – কখনো ঈশ্বরের সঙ্গে, কখনো প্রেমিকার সঙ্গে, কখনো নিজের সঙ্গেই। কিন্তু এই সংলাপ কেবল অন্তরালে সীমাবদ্ধ নয়, ব্যক্তিগত নয়; সমষ্টিগত। তাই তাঁর নিশীথের গান একাধারে আধ্যাত্মিক ও মানবিক। তাঁর নিশীথ তাই আমাদের নিশীথ। রাতের মধ্যে লুকিয়ে থাকে মৃত্যু888sport sign up bonus। নিশীথ তাঁর কাছে কখনো জীবনের দোলায়ন, কখনো মৃত্যুর ডাক। কিন্তু আশ্চর্য যে, তিনি কখনো ভয় পান না। ‘এখন জীবন মরণ দুদিক দিয়ে নেবে আমায় টানি’ – এখানে কোনো শঙ্কা নেই, আছে সমর্পণ। তিনি জানেন, মৃত্যুও যদি আসে, তবে তা হবে প্রেমেরই বাহন। এ-সমর্পণই রবীন্দ্রনাথকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। যেখানে আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই, তিনি সেখানে প্রেমিকের হাত খুঁজে পান। রাত তাই তাঁর কাছে কেবল এক সময় নয়, এক দার্শনিক পরিসর। এখানে প্রশ্ন ওঠে, উত্তর মেলে, আবার উত্তর মিলেও ফুরোয় না। নিশীথ তাঁকে বারবার মনে করিয়ে দেয় – মানুষ একা, তবু একা নয়; মানুষ আঁধারে, তবু আলোর সম্ভাবনা আছে; মানুষ মৃত্যুর দিকে এগোয়, তবু প্রেমের মধ্যে অমরত্ব খুঁজে পায়।

তিন

রবীন্দ্রনাথের রাত কখনো কোনো বিমূর্ত স্বপ্নের ভুবন নয়, বরং স্থান-কাল-অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত। শিলাইদহের গঙ্গাপারের নিশীথরাত্রি, শান্তিনিকেতনের শীতল হাওয়া, সুরুলের নির্জনতা – সবকিছু মিশে গেছে তাঁর গানে। একেকটি স্থান যেন একেক রাত্রিকে ভিন্ন রূপ দিয়েছে।

যেমন শিলাইদহের কথা। নদীর ধারে নির্জন কুঠিবাড়ি, চারপাশে নৌকার আলো, দূরে রাতের আকাশে দিগন্তে নেমে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটেই জন্ম নিয়েছে ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার।’ গানটির ভেতরে শুধু ঝড়ের ভয়ের সুর নয়, আছে নদীর নীরব গর্জন, বনের অন্ধকার, দূরের গ্রামীণ নৌকার আলো। প্রকৃতি তাঁর নিশীথকে শুধু পরিবেশ দেয়নি, বরং তাঁর আত্মার সঙ্গেও মিশে গেছে। যেন প্রকৃতি আর কবি একই দেহে পরিণত হয়েছেন।

অন্যদিকে শান্তিনিকেতনের রাত ভিন্ন। সেখানে কোলাহল কম, আছে শিক্ষার্থীর গান, প্রার্থনা, মৃদৃ সমীরণ। সেইখানে লেখা হয় ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে।’ এই ঝড়ও বাইরের মতো যতটা না, ভেতরের ততটাই। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দেখা – অপরিচিত কেউ এসে দাঁড়িয়েছে ঘরে। এখানে রাত আত্মজিজ্ঞাসার রূপ নেয়। শান্তিনিকেতনের আকাশ তাঁর জন্য কেবল নক্ষত্রের ছাউনি নয়, আত্মার প্রতীকও।

তবু রবীন্দ্রনাথের রাত সর্বদা ভৌগোলিকভাবে সীমিত নয়। তাঁর রাত এক চিরন্তন প্রতীক, যেখানে ব্যক্তিগত প্রেম ও সর্বজনীন ভক্তি মিলেমিশে যায়। ‘আজি বিজন ঘরে নিশীথরাতে আসবে যদি শূন্য হাতে’ – এ-গানটি যদি নিছক প্রেমিকের জন্য হয়, তবে তা খুবই সরল হয়ে যেত। কিন্তু এখানে প্রেমিক মানেই যেন সর্বশক্তিমান সঙ্গী। শূন্য হাতে এলেও তাঁর উপস্থিতিই পূর্ণতা। নিশীথের নিঃসঙ্গতা তাই এক আধ্যাত্মিক ভরসায় ভরে ওঠে।

এই নিশীথ-রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আমরা পাই তিনটি স্তর – প্রথমত, প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ – যিনি ঝড়ের মধ্যে দরজা খুলে অপেক্ষা করেন, যিনি নিশীথ রাতে অশ্রু ফেলে সুর রচনা করেন। দ্বিতীয়ত, ভক্ত রবীন্দ্রনাথ – যিনি ডাক শোনার জন্য প্রস্তুত, যিনি অন্তরের অন্ধকারে প্রদীপ চান, যিনি শান্তির মন্ত্রে নিমগ্ন। তৃতীয়ত, দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ – যিনি মৃত্যুকেও ভয় করেন না, যিনি অন্ধকারের ভেতর দিয়ে নতুন আলোর সম্ভাবনা দেখেন।

এ-তিনটি স্তর একে অপরের বিপরীতে নয়, বরং মিলেমিশে আছে। এক নিশীথে প্রেমই তাঁর ভক্তি হয়ে ওঠে, অন্য নিশীথে দার্শনিকতা প্রেমের পরিণতি পায়। এই রূপান্তরই তাঁকে অনন্য করে। নিশীথ যদি কেবল প্রশান্তির হতো, তবে তা এত মায়াময় হতো না। নিশীথকে বিশেষ করেছে তার বৈচিত্র্য। কখনো ঝড়, কখনো দীপালিকা, কখনো প্রেমের ব্যাকুলতা, কখনো শান্তির স্নিগ্ধতা। এই বৈচিত্র্যের কারণেই তাঁর রাত এত সমৃদ্ধ, এত টানটান। একঘেয়ে নয়, বরং চিরবহমান নদীর মতো তাঁর গান হয়ে ওঠে দীর্ঘ আলাপ – প্রিয়জনের সঙ্গে, ঈশ্বরের সঙ্গে, নিজের সঙ্গেও। 

চার

রাতের যে-রবীন্দ্রনাথকে আমরা দেখি, তিনি শুধু গানের কবি নন, এক গভীর তত্ত্বেরও কবি। তাঁর নিশীথ কখনো নিছক সময়ের নাম নয়, বরং অস্তিত্বের প্রতীক। দিনের আলোর ভিড়ে আমরা যতটা বাহিরমুখী, রাত আমাদের ততটাই ভেতরের দিকে টেনে আনে। রবীন্দ্রনাথ এই টানকে 888sport app download apkয়, গানে, সুরে রূপ দিয়েছেন। তাঁর নিশীথ তাই আত্মার আয়না – যেখানে মানুষ নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায়, ভেতরের সত্যকে নিরাভরণ করে। রবীন্দ্রনাথের রাত তাই এক বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা। তা প্রেমের, ভক্তির, দার্শনিকতার, সামাজিক বিশ্বাসের। আবার তা প্রকৃতিরও – ঝড়ো হাওয়া, হেমন্তের শীত, নদীর ধারে কাশফুল, জ্যোৎস্নার আলো। নিশীথের ভেতরে তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন মানবজীবনের সমস্ত রং। আর এ-কারণেই তাঁর নিশীথ আমাদের আজো টানে, আজো মায়ায় ভরে রাখে। তাঁর নিশীথকে পড়তে পড়তে মনে হয়, তিনি যেন আমাদের সঙ্গে বসে আছেন। গভীর রাত, বাইরে নিস্তব্ধতা আর তিনি মৃদুস্বরে বলছেন – ভয় পেয়ো না, আঁধারের ভেতরেও আলো আছে; প্রিয়জন দূরে থাকলেও সে আসবেই; মৃত্যু এলে সেও শান্তিরই আরেক রূপ।  এভাবেই রবীন্দ্রনাথের নিশীথ কেবল তাঁর সৃষ্টির অংশ নয়, আমাদের অস্তিত্বের অংশও হয়ে গেছে। রাতের রবীন্দ্রনাথ মানেই অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের রবীন্দ্রনাথ, অন্তর্নিবিষ্ট কণ্ঠের রবীন্দ্রনাথ, আর অন্তর-আলোকে দীপ্ত সেই কবি, যিনি আমাদের সবার স্তব্ধতার সঙ্গী হয়ে ওঠেন।