রূপকল্প : রবীন্দ্রনাথের গান

আনন্দ ঘোষ হাজরা

তাঁরই গানের ভেতর দিয়ে তাঁর সৃষ্টির ভুবন দেখবার চেষ্টাই বোধহয় তাঁকে ঠিকমতো চেনবার বা জানবার পথ। কিন্তু গানের বহিরঙ্গ বাদ দিয়ে অন্তরে প্রবেশ করে তার রসের ধারায় বা রূপের রেখায় নিজের সীমা একেবারে হারিয়ে ফেলতে না পারলে কি তাঁকে জানতে পারা যায়? রসের ধারার মধ্যে দিয়ে, অন্তরঙ্গে প্রবেশ করা আর রূপের রেখার মধ্য দিয়ে তাঁর বহির্জগৎকে অবলোকন করা। ‘বাহির’ মানেই তো ছন্দ অলংকার ইত্যাদি। এবং অলংকার মানেই আমরা বুঝি কেয়ূর কঙ্কণ ইত্যাদি আভরণ। ‘অলম্’ শব্দটির মূল অর্থ ব্যাপ্তি, বিস্তৃতি গভীরতা ইত্যাদি – যদিও শব্দটি ‘নিবারণ করা’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। অলংকরণ হচ্ছে, যে-বস্তুটিকে অলংকৃত করা হচ্ছে তার ব্যাপ্তি বিস্তৃতি ঘটানো, গভীর তলে তাকে স্পর্শ করা। আমাদের আলংকারিকেরা তাই প্রচলিত অর্থের মতো অলংকার বলতে শুধু ছন্দ ইত্যাদি বহিরাবরণ বোঝাতেন না। তাঁরা যেমন উপমা, রূপক উৎপ্রেক্ষা সমাসোক্তি ইত্যাদি নানা বহিরাঙ্গিক অলংকারের আলোচনাও করেছেন, আবার ভাব ও রসকে অলংকারের মধ্যেই ফেলেছেন, ধ্বনিকেও, যদিও এগুলি 888sport app download apkর অন্তরঙ্গস্তর। কোনো কোনো আলংকারিক তো ওই ধ্বনি, ভাব, রসকেই গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করতেন। আবার কেউ কেউ বহিরাবরণকেই গ্রাহ্য করে, এমনকি যেসব 888sport app download apkয় কোনো আভরণ বা আবরণই নেই, শুধু বিবরণধর্মী, সেগুলিকেও স্বভাবোক্তি অলংকারের মধ্যে ফেলতেন। অবশ্য ইংরেজি মতে রসের ভাবের বা ধ্বনির কথা নেই, তবু ‘সিমিলি’, ‘মেটাফোর’ ইত্যাদি অলংকরণের কথা আছে। এরকম ‘সিমিলি’ বা ‘মেটাফোর’ অত্যন্ত ঘনবদ্ধ হয়ে উপমান বা উপমেয়ের সঙ্গে প্রায় একাঙ্গী বা একাত্ম হয়ে ‘সিম্বলের’ সৃষ্টি করে, যাকে বাংলায় প্রতীক বলা হয়। ‘সিম্বল’ থেকে ধীরে ধীরে রসে, বা ভাবে না পৌঁছালেও নন্দনতাত্ত্বিকরা ‘ইমেজে’ চলে যেতে পারেন, যা থেকে ওই ‘রস’ এবং নানা প্রকার ইন্দ্রিয়ানুভূতি নির্গত হয়।
এতক্ষণ শিবের গীত গাইছি এই জন্যই যে, রবীন্দ্রনাথের গানের অন্দরমহলে প্রবেশযোগ্যতা এই অর্বাচীন কবির কতটা আছে – এই সন্দেহ-শায়ক থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। নিবন্ধটিতে কিছু গানের – উদাহরণস্বরূপ মাত্র কয়েকটি গানের – ‘ইমেজ’ নিয়েই শুধু আলোচনা করতে চাই। এই আলোচনা, সুতরাং একান্তভাবে আংশিক। হয়তো ভবিষ্যতে কেউ বড় আকারে করবেন, কিন্তু আলোচনা তো শুরু করা যেতেই পারে। আমার অন্য একটি সমস্যাও আছে। রবীন্দ্রনাথের গান সম্বন্ধে বলতে গেলে আমি ‘ইমেজ’ বা ‘ইমেজারি’ শব্দের বাংলা কী করবো? বর্তমানে নন্দনতত্ত্বের আলোচনায় এই ইংরেজি শব্দটির মোটামুটি তিনটি অর্থ প্রচলিত আছে – চিত্রকল্প, বাকপ্রতিমা এবং রূপকল্প। এই নিবন্ধে রূপকল্প শব্দটিকেই গ্রহণ করা হয়েছে। কেন তা একটু বলে নেওয়া দরকার বোধহয়। ‘চিত্রকল্প’ শব্দটি আবু সয়ীদ আইয়ুবের মতে, তিনিই প্রথম ‘ইমেজারি’র বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন। প্রচলিত ধারণা-অনুযায়ী সুধীন্দ্রনাথ নন। বরং সৈয়দ জানাচ্ছেন, সুধীন্দ্রনাথ শব্দটি পছন্দ করতেন না। যে যা-ই হোক, শব্দটি গ্রহণযোগ্য। 888sport app download apkয় প্রাথমিকভাবে একটা চিত্র ফুটে ওঠে এবং সেই চিত্রটি থেকে বা চিত্রপ্রায় চিত্রটি থেকে সে রস নিঃসৃত হয় তাই পঞ্চেন্দ্রিয়ের অনুভূতির মাধ্যমে পাঠকের অন্তরে প্রবেশ করে। ‘কল্প’ শব্দটির এখানে অর্থ ‘প্রায়’। কিন্তু ‘প্রায়’ কেন? না, সেটা প্রকৃত রেখায় অঙ্কিত চিত্র নয়, চিত্রটি যেন আভাসিত শুধু পাঠকের মনে সঞ্চারিত হবার জন্য। ‘ইমেজিস্ট’ আন্দোলনের নেতারা – আমি লোয়েল, এজরা পাউন্ড, টি ই হিউম প্রমুখ কবি – এরকমই মনে করতেন। মনে করতেন, একটা পরিষ্কার ছবি 888sport app download apkর পক্ষে প্রয়োজনীয়। তাঁরা মনে করতেন, 888sport app download apk মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার্য ভাষা ব্যবহার করবে এবং সে-ভাষা যে-বস্তুর ছবি আঁকবে, তা পঞ্চেন্দ্রিয়ের অনুভূতির প্রতিনিধিত্ব করবে বা বলা ভালো, ইন্দ্রিয়ানুভূতি দ্বারা গ্রাহ্য হবে। ‘ইমেজিস্ট’ ভাবনার প্রতিফলন হিসেবেই বাংলা 888sport app download apkর আলোচনায় ‘চিত্রকল্প’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলায় ব্যাপারটি যে একেবারে নতুন তা নয়। সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র থেকেই পাওয়া। বিখ্যাত উদাহরণ কালিদাসের ‘এবং বাদিনি’ ইত্যাদি শ্লোক।
এবং বাদিনি দেবর্ষৌ পার্শ্বে পিতুরধোমুখী
লীলা কমলপত্রাণি-গণয়ামাস পার্বতী।
নারদ হিমালয়ের কাছে মহাদেবের সঙ্গে পার্বতীর বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। পার্বতী শুনছেন আর অধোমুখে পিতার পাশে বসে লীলাকমলের পত্র গণনা করছেন। এই স্পষ্ট চিত্রটি থেকে ফুটে উঠছে পার্বতীর লজ্জা ও হর্ষ। দর্শনেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যেন পাঠক লজ্জা ও হর্ষের অনুভূতি উপভোগ করছেন। রসটি ‘মধুর’। বাচ্যার্থ ছাড়িয়ে অর্থান্তরে যাচ্ছে চিত্রটি। একে ‘ইমেজ’ না বলে ‘ধ্বনি’ বলা হতো। উদাহরণটি সকলের জানা যদিও, তবু পুনরুল্লেখ করা হলো এজন্যে যে ‘ধ্বনি’ শব্দটি বাংলায় আর এভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ইংরেজি sound শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবেই এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। ‘ইমেজ’ বা ‘ইমেজারি’র বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘চিত্রকল্প’ শব্দটি প্রচলিত হয়ে গেছে। তবু, আমি রূপকল্প শব্দটিই ব্যবহার করছি। পরে এ-নিয়ে আমার বক্তব্য জানাবো। তার আগে ‘বাকপ্রতিমা’ শব্দটি সম্বন্ধে দু-চারটি কথা। অমলেন্দু বসু রবীন্দ্র-888sport app download apkবিষয়ক একটি চমৎকার 888sport liveে ‘বাকপ্রতিমা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যে-অর্থে উপরে ‘চিত্রকল্প’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সেই অর্থেই। এই শব্দটিও শ্র“তিমাধুর্যে এবং ‘পোয়েটিক ইমেজে’র প্রতিশব্দ হিসেবে গ্রহণ করার কোনো বাধা নেই, তবু ‘রূপকল্প’ শব্দটি ব্যবহার করে জগদীশ ভট্টাচার্য একটি 888sport liveে লিখলেন, ‘অভিধাটি অনবদ্য হয়েছে। কাব্যের অলৌকিক মায়ার জগতে বাকপ্রতিমা নির্মাণই 888sport live chatীর পরাকৃত্য। কিন্তু কবির কাব্যলোকে পুতুল গড়ার কাজে সব পুতুলই প্রতিমা হয়ে ওঠে না। তাছাড়া প্রতিমা গড়ার কাজ যেমন আছে, তেমনি ভাঙার কাজও বিস্তর খুঁজে পাওয়া যায়। কাজেই কবির 888sport live chatশালায় বিচিত্র রূপনির্মাণের কথা চিন্তা করে আপাতত ‘রূপকল্প’ শব্দটিই ‌‌‌’poetic image’অর্থে গৃহীত হলো। ‘বাকপ্রতিমা’র সঙ্গে ‘ফিগার অব স্পিচে’র সাযুজ্য রয়েছে। অলংকারচন্দ্রিকাকার বলেছিলেন, বাঙ্মূর্তি।’
‘বাকপ্রতিমা’ শব্দটি বর্জন করার প্রসঙ্গে জগদীশ ভট্টাচার্যের উপরোক্ত বক্তব্যের সমগ্রটাই গ্রহণযোগ্য কিনা জানি না, তবে, ‘কবির 888sport live chatশালায় বিচিত্র রূপনির্মাণের কথা’ বলে যা বলতে চেয়েছেন বলে আমার মনে হয়েছে, সে-বিষয়টি চিন্তা করেই এই নিবন্ধে ‘বাকপ্রতিমা’ শব্দটি গ্রহণ করা হয়নি।
‘চিত্রকল্প’ সবসময়ে যে একমাত্রিক হবে তার তো কোনো মানে নেই। কিন্তু এযাবৎকাল ‘চিত্রকল্প’ ও ‘রূপকল্প’ শব্দ দুটির দ্যোতনায় একমাত্রিকতার দিকেই ঝোঁক বেশি। ‘ইমেজিস্ট’রা স্পষ্ট করে বলেননি। কিন্তু তাঁরাও মূলত এটাই চেয়েছিলেন। ছবি আঁকা হবে 888sport app download apkর ভাষায় এবং তা পঞ্চেন্দ্রিয়ের দ্বারা আস্বাদিত হবে। এ যাবৎকাল প্রায় সকলেই 888sport app download apkর একাধিক মাত্রার দিকে মনোযোগ না দিয়ে, শুধু চিত্রটি থেকে, একমাত্রিকভাবে যে অনুভূতির আস্বাদন সম্ভব সেই অনুভূতিটুকুর দিকেই নজর রাখেন। ব্যতিক্রম বোধহয় সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি ‘রবীন্দ্রনাথের চিত্রকল্প ও প্রতীক’ নামে একটি 888sport liveে প্রতীক ব্যবহারের দিকে যে শুধু জোর দিয়েছেন তাই নয়, কোনো একটি 888sport app download apkর কোনো কোনো অংশে ব্যবহৃত প্রতীকী চিত্রকল্পের কথা না ভেবে 888sport app download apkর সামগ্রিক আবেদনের কথা বলেছেন। 888sport app download apkয় সামগ্রিকভাবে যে-চিত্রকল্প আভাসিত হচ্ছে তার দিকেই বেশি নজর দিয়েছেন। ‘দুঃসময়’ 888sport app download apkটিকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। বর্তমান নিবন্ধটি যতোই অগ্রসর হবে, ততোই আমার বক্তব্য পরিষ্কার হবে বলে আমার বিশ্বাস। চিত্রকল্পের একমাত্রিকতার দিকে ঝোঁকের অর্থ এই নয় যে, সেটি যথার্থ আলোচনা নয়। বৈষ্ণব 888sport app download apkয় চিত্রকল্প নামক একটি পুস্তকের কথা এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। এই বইটিতে মালবিকা দাশ চিত্রকল্প বা রূপকল্পকে এভাবেই গ্রহণ করলেন এবং বৈষ্ণব 888sport app download apkয় তার প্রয়োগ দেখালেন। কিন্তু কোনো 888sport app download apkর ছবিতে যদি একাধিক মাত্রা সংযোজিত হয় তখন? তখন আমরা ‘চিত্রকল্প’ শব্দটি ব্যবহার করবো, না ‘রূপকল্প’? মালবিকা দাশ একমাত্রিক চিত্রকল্পের ক্ষেত্রেই ‘রূপকল্প’ শব্দটি ব্যবহার করছেন। ‘মাত্রা’ বলতে বর্তমান নিবন্ধকার কী বোঝাতে চাইছেন, তাও একটু পরেই পরিষ্কার হবে হয়তো।
‘ইমেজিস্ট’ আন্দোলন বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের আন্দোলন। এর প্রাথমিক ভিত্তি রচিত হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে, বোদলেয়র, মালার্মে, ভ্যালেরি প্রমুখ কবির ‘সিম্বলিজম’ বা ‘প্রতীকবাদ’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এই আন্দোলনের মূল কথাটি বলা হয়েছে বোদলেয়রের ‘করেসপন্ডেন্স’ নামক 888sport app download apkটিতে। 888sport app download apk latest versionে মোটামুটি এরকম :
প্রকৃতি এক মন্দির যার সজীব স্তম্ভগুলির মধ্য থেকে মাঝে মাঝে শৃঙ্খলাহীন শব্দ উচ্চারিত হয়। মানুষ প্রতীকের অরণ্যের মধ্য দিয়ে তাকে অতিক্রম করে যায়। এইসব প্রতীক পরিচিত চোখে মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকে। বহুদূরে অন্ধকারের মতো বিশাল, আলোকের মতো বিরাট অনচ্ছ এবং গভীর একটা ঐক্যে বিলীয়মান দীর্ঘ প্রতিধ্বনির মতো শব্দে, সৌরভ, ধ্বনি এবং বর্ণ পরস্পরকে সম্ভাষণ করে। এমন সৌরভ সেখানে আছে যা শিশুর দেহের মতো তাজা এবং ঠান্ডা, বাজনার মতো কোমল, মাঠের মতো সবুজ। এমন সৌরভও আছে যা বিকৃতস্বভাব, ঋদ্ধ এবং গর্বোদ্ধত, সীমাহীন বস্তুর বিস্তৃতিতে যার অবস্থিতি। সেইসব বস্তু – অম্বর, মৃগনাভি, ধূপ অথবা প্রিয়তম শিশুর নামে যাদের নাম।
অর্থাৎ সুইডেনবার্গীয় দর্শনে বিশ্বাসী বোদলেয়র মনে করতেন, যে বাস্তবিক পৃথিবীটা আমরা দেখছি, সেই পৃথিবী – রং-রূপ-গন্ধসহ তার সমস্ত বস্তুই বহন করে আনছে অন্য এক পৃথিবীর সংবাদ। আমাদের পৃথিবী ও বস্তুগুলি যার প্রতিনিধি। এই পৃথিবী, অন্য এক পৃথিবীর প্রতিনিধি। 888sport app download apkর প্রাথমিক চিত্ররেখা অন্য এক চিত্রের বা বস্তুর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। বোদলেয়রের জীবনবোধ জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া নয়, কিন্তু মালার্মে এরকম প্রতীকী ছবির থেকে দূরে আরো দূরে অন্য বস্তুর কথা ভাবতে গিয়ে ব্যক্তিগত ধ্যানমগ্নতায় চলে যেতে চাইলেন এবং এই ব্যক্তিগত বোধ বা অনুভূতিকেই প্রধান করে তুলে 888sport app download apkয় সঞ্চারিত করতে চাইলেন। একটি 888sport app download apkয় মালার্মে বলেছেন – ‘গোধূলির রথ থেকে যেমন বিলীয়মান রং বিচ্ছুরিত হয়, ধাবমান চাকা থেকে আগুনের পুঞ্জপুঞ্জ গোলা বিচ্ছুরিত হতে দেখে আমার কী যে আনন্দ হচ্ছে। আমি – যার চক্রনাভিতে বজ্র ও পদ্মরাগমণির সমারোহ।’
888sport app download apkটির অর্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়েছে অনেক। কেউ কেউ ভেবেছেন যে, কবি একটি গাড়ি করে যাচ্ছেন, যে-গাড়ির চাকাগুলি অস্তগামী সূর্যের আভায় লাল, কেউ কেউ ভেবেছেন কবি কোনো বাজি পোড়ানোর সময়ে জ্বলন্ত চাকার কথা উল্লেখ করেছেন। হয়তো এসব কিছুই নয়। কবি শুধু সেই মানসিকতার বর্ণনা দিয়েছেন, যা কৃতকার্যতার আনন্দে উৎফুল্ল ও রঙিন। আসলে অর্থ নয়, মালার্মে শুধু কোনো এক প্রকার অনুভূতিকে সঞ্চারিত করতে চাইলেন। মালার্মে পেরেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু 888sport app download apk এ-ধরনের বিমূর্তবাদকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারেনি, পারেও না বোধহয়। আদৌ পারে কি? তাই ফরাসি দেশে ভ্যালেরি, জার্মানিতে রিলকে এই বিশুদ্ধ বিমূর্ততার থিওরি থেকে কিঞ্চিদধিক সরে যেতে চেয়েছিলেন। পরে বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে পাউন্ড, এলিয়ট, ইয়েটস প্রমুখ ইংরেজ কবি এই প্রতীকী ভাবনাচিন্তাকে বিমূর্ততা থেকে সরিয়ে নিলেন। তাঁরা কী ভাবছিলেন, তা আমরা দেখেছি। চিত্র থেকে অনুভূতি। কিন্তু তাঁরা একটা ব্যাপারে জোর দিলেন, সেটা হচ্ছে, প্রতীক থেকে যে-অন্য ছবির সৃষ্টি হয় বা অন্য বস্তুর কথা বলা হয়, অনুভূতিটা সেই অন্য বস্তু থেকে নির্গত হবে। এখানে স্যোসুরীয় অর্থে শব্দকেই ‘সাইন’ বা প্রতীক বলে ভাবা হচ্ছে না। বরং শব্দ বা শব্দসমষ্টি যে-অন্য বস্তুর প্রতীক হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে তাকেই বোঝাতে চাইছে। প্রতীকবাদকে এইভাবে তাঁরা আরো উন্নত করলেন। বললেন যে, প্রতীক যেমন নির্দিষ্ট অর্থ প্রতিফলিত করতে পারে, চিত্রকল্প সেখানে অনির্দিষ্ট অর্থ বহন করে। একটা উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে। পাউন্ডের দুলাইনের একটি  888sport app download apkংশ :
The apparition of these faces in the crowd
Petals on a wet black bough এই দুই লাইনে যে-ছবি, তা বাংলায় উপমা, রূপক, ইংরেজিতে সিমিলি, মেটাফোর, যা-ই বলা হোক, তা এতোই ঘনবদ্ধ যে দুটি প্রতীকের ব্যবহারে অন্য একটি চিত্রের – চিত্রকল্পের জন্ম দিচ্ছে ‘Petal’ এবং ‘black bough’। Petal শিশুদের মুখের প্রতীক এবং ভিজে কালো গাছের শাখা, আমাদের অন্ধকারময় সমাজ হয়তো। অন্য যে-চিত্র দাঁড়িয়ে যায় তা আশাবাদে সমুজ্জ্বল। অন্ধকারময় সমাজে উৎফুল্ল শিশুদের মুখ। একেবারে প্রথম লাইনটির একমাত্রার চিত্র, এমনকি দ্বিতীয় লাইনটির প্রাথমিক একমাত্রার চিত্র নিমেষে বদলে গিয়ে একাধিক মাত্রায় সঞ্চারিত হলো। এলিয়টের বা ইয়েটসের উদাহরণে আর গেলাম না। এসব উদাহরণ সকলেরই জানা। এই 888sport liveের উদ্দেশ্যও অন্য।
উপরোক্ত পরিপ্রেক্ষিতের ভূমিতে দাঁড়িয়ে আমার মূল বক্তব্যটি হলো, ‘চিত্রকল্প’ বা ‘রূপকল্প’, তাকে যে-নামেই ডাকা হোক না কেন, তা একমাত্রারও হতে পারে, একাধিক মাত্রারও হতে পারে। চিত্র888sport live chatেও ছবির একাধিক ‘ডাইমেনশন’ থাকে। অতএব চিত্রকল্প বা রূপকল্প বিচার করতে গেলে শুধু এক নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একাধিক ‘ডাইমেনশনে’র কথা ভাবতে হয়। অর্থাৎ চিত্রের থেকে 888sport app download apkর রূপের কথাই আমরা বোধহয় বেশি ভাবছি। কারণ এই বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকেই শুরু হয় এই ‘ইমেজিস্ট’ বা শুধু ‘ফর্মালিস্ট’ মতবাদও, যা অবয়ববাদ থেকে ক্রমশ উত্তর-অবয়ববাদে পৌঁছে যায়, শুধু 888sport app download apkর বা রূপনির্মিতির ভাবনায়। সে-আলোচনা অন্য ক্ষেত্রের।
বর্তমান নিবেদক শুধু এ-কারণেই ‘রূপকল্প’ শব্দটি ব্যবহারের পক্ষপাতী। রবীন্দ্রসংগীতের কথা বলার সময়ে রূপকল্পের একমাত্রার চিত্রও যেমন থাকবে, তেমনি একাধিক মাত্রার চিত্রও আলোচনায় আসবে। নিবেদকের মনে হয়েছে, একাধিক মাত্রার রূপকল্পগুলি ক্রমশ কবির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের 888sport app download apkয় বা গানে আরো পরিণত হয়েছে। 888sport app download apkতেও যেমন গানেও তেমনি, তিনি একাধিক মাত্রার রূপকল্প ব্যবহারের প্রতি ক্রমশ হয়তো নিজের অজ্ঞাতসারেই এগিয়ে গেছেন। তাছাড়া কোনো একটি গানের অংশবিশেষ নিয়ে, সেই চিত্রটির কী অর্থ হচ্ছে এবং তা কী অনুভূতি জাগাচ্ছে, এরকম কোনো আলোচনার স্পষ্টত কোনো অর্থ হয় না, এ-কারণে যে, হয়তো ওই চিত্রটি বা গানের মধ্যে আরো দু-একটি অন্য চিত্র একত্রে মিলিত হয়ে, সামগ্রিকভাবে গানটিকে অন্য স্তরের অর্থে বা ব্যঞ্জনায় নিয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের গানে এরকম ব্যবহার অনেক পাওয়া যাবে। এরকম ক্ষেত্রে উত্তর-অবয়ববাদীরা চিত্রগুলিকে ‘আইসোটোপি’ বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের গানে এরকম ‘আইসোটোপিক’ রূপকল্পের উদাহরণ আলোচনার সময়ে আসতেই পারে। এ-ধরনের রূপকল্পগুলির প্রতিটিকে বাংলায় ‘সমভাবাপন্ন’ বলা যেতে পারে মনে হয়। এবং যেহেতু গানের কথাই আমরা আলোচনা করবো, সেহেতু তাঁর গান কতটা মালার্মে-কথিত অর্থহীন বোধ বা অনুভূতি-জগৎকে সুরে সুরে ছুঁতে পেরেছে, সে-বিষয়টিকেও স্পর্শ করার চেষ্টা করা যেতে পারে, যদিও তা বিমূর্তবাদকেই প্রশ্রয় দেবে। শাস্ত্রীয় সংগীতে এমন বিমূর্ততা আসতেই পারে, কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতে? শঙ্খ ঘোষ রবীন্দ্রসংগীতে কথা ও সুরের সম্বন্ধ নিয়ে ভাবনাঋদ্ধ নিবন্ধ রচনা করেছেন ঠিকই, কিন্তু এই নিবন্ধটির শেষ পর্যায়ে ভাবনাটিকে আর একটু বিস্তৃত করা যায় কি না দেখা যেতে পারে। উলটোভাবে কি ভাবা যায় না? বিমূর্তভাবনা থেকে                বস্তু ভাবনায় আসা যায় না কী?

দুই
কবি বললেন, ‘আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলংকার।’ তিনি তো বললেন ‘ছেড়েছে’, কিন্তু প্রকৃতই ছেড়েছে কি? রূপকল্পও তো অলংকার, কারণ রূপকল্প গান ও 888sport app download apkকে বিস্তৃতি, ব্যাপকতা আর গভীরতা দান করে। শব্দের উচ্চারণের নামই তো ধ্বনি (ব্যঙ্গার্থে নয়)। ধ্বনিকে বাদ দিয়ে গান হবে কী করে? সুতরাং ছাড়াবো বললেই কি ছাড়ানো যায়? অনেক সময়ে ছাড়ানো তো যায়ই না, বরং সংঘাতের সৃষ্টি হয় – ধ্বনির সঙ্গে রূপকল্পের বা অর্থেরও আবার। এসব সংঘাত থেকেই, সংঘর্ষ থেকেই, জন্ম নেয় আলোক বিচ্ছুরণ। কখনো মনে হবে ‘ধ্বনি’ জয়লাভ করলো, কখনো মনে হবে ‘রূপকল্প’। আবার 888sport app download apkর ক্ষেত্রে বিশেষ করে অর্থেরই ‘জয়’ দেখতে অভ্যস্ত আমরা। ‘জয়’ অর্থে এখানে অন্য ধারণা। অর্থ যেন ছন্দ, ধ্বনি, রূপকল্প, অলংকার সবকিছুকেই সংঘর্ষের মধ্যে নিয়ে যেতে যেতে আত্মীকরণ করে ফেললো। তখন আর বোঝার উপায় নেই পৃথকভাবে কোনটি অর্থের সঙ্গে সংলগ্ন নয়। গানের ক্ষেত্রে সংঘর্ষটাই আসল কথা। ‘আজি শ্রাবণ ঘন গহন মোহে/ গোপন তব চরণ ফেলে/ নিশার মত নীরব ওহে/ সবার দিঠি এড়ায়ে এলে।’ রূপকল্পটি প্রেমিকের অভিসার প্রেমিকার কাছে। সে আসছে শ্রাবণের মেঘান্ধকার পার হয়ে নীরবে একাকী সবার দৃষ্টি এড়িয়ে। কিন্তু এই চিত্রের সঙ্গে প্রথমে ‘অ’ ধ্বনির ও ‘ন’ ধ্বনির বারবার ঝংকার যে-সংঘাতের সৃষ্টি করছে, তার থেকে বের হয়ে আসছে প্রাথমিক সুরের আদলটুকু। যেন আলাদা করে ভাবতে হবে না সুরের জন্য। এই সংঘাতের ফলেই গানটি অন্তত অর্ধেকের বেশি হয়ে উঠলো। সুতরাং ধ্বনি বা সুর নয়, এমনকি হয়তো অর্থও নয় ততোটা, যতোটা ‘রূপকল্প’ গানে তার স্থানটি নিশ্চিতভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে। এখানেই রবীন্দ্রনাথের গানের রূপকল্প আলোচনার সার্থকতা। তিনি বললে কি হবে যে, ‘এ মণিহার’ তাঁকে সাজে না। মণিহার তিনি অন্য কাউকে পরাতে চান। কিন্তু মণিহার তো তাঁকে ছাড়বে না। তিনি যদি একলা ঘরে বসে বসে সুর বাজান, তাও সে-সুর হাওয়ায় ছড়িয়ে যায় আমাদের সকলের জন্য, সব ধ্বনি, সব ঝংকার, সব রূপকল্প নিয়ে। যে-তিনটি গান কথাচ্ছলে চলে এলো সে-তিনটি গানের মধ্যে – ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’ গানটি হচ্ছে, ইংল্যান্ডের গুণীজন যে প্রশংসার মালা রবীন্দ্রনাথকে পরিয়েছিলেন তার গান। শঙ্খ ঘোষ জানাচ্ছেন অজিত চক্রবর্তীর উদ্ধৃতি দিয়ে। তা যদি হয়, তাহলে সম্পূর্ণ গানটির ছবি একমাত্রার, যদিও নোবেল 888sport app download bdকে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। যে-ছবি আমাদের সামনে চলে আসছে তা ওই একটাই। প্রতীক এখানে ঘনবদ্ধ উপমা। ঘনবদ্ধ উপমাও অবশ্য, বরং উপমাই অবশ্য রূপকল্পের কাজ করে। আমি বলতে চাইছি যে, কোনো বিশেষ লাইনে বা কয়েকটি লাইনে অলংকার ব্যবহার করা হলেই যে রূপকল্প হয়ে উঠবে বা উঠলেও মাত্রাধিক্য অর্জন করবে, এমন কোনো কথা নয়। কাজেই, লাইন বা পঙ্ক্তি উদ্ধার করে রূপকল্পের উদাহরণ দেওয়ার প্রবণতা থেকে যতোটা বিরত থাকা যায় ততোই ভালো। 888sport app download apkর ক্ষেত্রে যদিও বা সম্ভব, গানের ক্ষেত্রে এ-প্রবণতা অবশ্যই বর্জনীয়। গানে সামগ্রিক ছবি, সামগ্রিক আবেদনই বিচার্য। তবু কি গানটি প্রকৃতই একমাত্রিক রূপকল্পের? যদি আমরা নোবেল প্রাইজের ব্যাপারটা মনে না রাখি (এবং সেটাই বোধহয় সংগত) তাহলে সমগ্র গানটি থেকে যে চিত্ররূপ বের হয়ে আসে তা প্রেমিক-প্রেমিকার কথাচিত্র। এই গানটি শুনলে ঈশ্বরের কথা আমার মনে হয় না। কাজেই গানটির রূপকল্প একমাত্রিকেই থেকে যায় সেক্ষেত্রেও। কিন্তু ‘তুমি একলা ঘরে বসে বসে’ গানটি শুনলে তিনটি চিত্র মনে আসতে পারে।
১। কেউ একলা ঘরে বসে বসে সুর বাজাচ্ছে। এই চিত্রটির সঙ্গে ‘আমার জীবনে’ শব্দ দুটি যোগ করে দেওয়ায় ‘জীবন’ শব্দটি প্রতীকী দ্যোতনা পেয়ে যাচ্ছে। সে-দ্যোতনা কি বাদ্যযন্ত্রের? আমার আত্মসত্তাই বাদ্যযন্ত্রের মতো কাজ করছে তাঁর হাতে, এরকম মনে হবে না কি?
২। কোনো এক রাত্রির স্বপ্নের মধ্যে চুপিচুপি ঢুকে আমার আত্মসত্তাকেই পরশরতন দিয়ে সেই ব্যক্তি সাজিয়ে গেছেন। ছবিটা ‘মিস্টিক’ (সুংঃরপ) একটু, সম্পূর্ণভাবে কল্পনাশ্রয়ী। তবু এটাই তো অর্থ তার।
৩। সব শেষের ছবিটি হচ্ছে দুয়ার খোলা পাওয়ার চিত্র। সার্থকতার তোরণ? যে-গানে আত্মসত্তাকে ভরিয়ে নেওয়া হয়েছে সেই গান গেয়ে গেয়েই হয়তো। ঠিক এই চিত্রটির আগে চারটি লাইন এরকম আভাস দেয়।
এই ছবিগুল ‘আইসোটোপি’র মতো কাজ করে, একত্র হয়ে, নির্দেশ করছে একটাই রূপাবয়ব সামগ্রিকভাবে। এই সামগ্রিক অর্থটি হলো – ‘তুমি আমার হৃদয়তন্ত্রীতে যে সুর বাজিয়ে গেছ, আমি সারাজীবন নানাভাবে তাই গাইছি, একদিন সার্থকতার তোরণ আমার সামনে খুলে যাবে এই আশায়।’ এসব কথা কোনো সংগীতসাধক তাঁর গুরুকে উদ্দেশ করে বলতে পারেন। গুরুকে বাদ দিয়ে ঈশ্বরের ছবি আঁকাও বিচিত্র নয়। একটা শান্তরসাশ্রিত সমভাবের অনুভূতি সঞ্চারিত হয় পাঠকের মনে। একাধিক মাত্রার রূপকল্পিত গান বলা যায় বোধহয়।
‘আজি শ্রাবণ ঘন গহন মোহে’তেও সামগ্রিকভাবে একটাই চিত্র। প্রকৃতিচিত্র। সেইজন্যই বোধহয় একে প্রকৃতি পর্যায়েই ফেলা হয়েছে। নিবিড় মেঘে 888sport app অন্ধকারময় পথ। প্রভাত হলেও প্রভাত আঁখি বন্ধ করে আছে। সব দরোজা বন্ধ। একাকী চলেছে পথিক কূজনহীন কাননভূমি পার হয়ে। পথে আর কোনো পথিক নেই। শেষে খুব ছোট একটি চিত্র – দরোজা খুলে সেই পথিকের জন্য কেউ প্রতীক্ষা করছে। চিত্রটি কি বাস্তবিক প্রকৃতি পর্যায়ের? পথিকহীন পথের পরে যে-পথিকের যাত্রা, সে তো তার প্রেমিকার কাছে যাত্রা, যে তার দরোজা খুলে তার জন্য প্রতীক্ষা করছে। এ-চিত্রও অভিসারের, নাকি ঈশ্বরের? একটু সন্দেহের দোলায় দুলতে থাকেন পাঠক। অল্প একটু রহস্যময়তার আলোছায়ায়? ঈশ্বর কি এভাবেই আসেন নাকি? সবার দৃষ্টি এড়িয়ে, নিবিড় মেঘে ছাওয়া ভোরবেলার আলো-আঁধারিতে নির্জন পথ বেয়ে। ছবিটাই তো স্বপ্নিল। ঈশ্বর এলেও আসতে পারেন বোধহয় ওভাবেও। তখন নিবিড় মেঘে ছায়া প্রত্যুষের অন্ধকার, জীবনের আলোছায়ার, জীবনারম্ভের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। ঈশ্বর হয়তো সেখানেই যাচ্ছেন যেখানে তাঁর ভক্ত প্রেমিকা মগ্ন আছেন তাঁরই ধ্যানে অন্তর-দুয়ার খোলা রেখে। কিন্তু আশঙ্কা আছে, তিনি সেখানে নাও যেতে পারেন। এই বন্ধুপ্রতিম ঈশ্বর নিষ্ঠুর, নিঠুর দরদি। আমাকে হেলায় ঠেলে চলেও যেতে পারেন (যেমন যেতে পারেন প্রেমিকও)। গীতাঞ্জলি-পর্বের গান বলে এরকম ঐশ্বরিক ব্যাখ্যা চলতেও পারে। কিন্তু বর্তমান নিবেদকের মন একেবারেই সায় দেয় না। এই চিত্রটিকে প্রেমিক-প্রেমিকার অভিসারচিত্রের ছবি হিসেবে গ্রহণ করলে (খানিকটা স্বপ্নময়তা থাকলেও) ভালো লাগে। বরং ওই স্বপ্নময়তা গানটিতে অন্য মাধুর্য দান করে। সে যা-ই হোক, পাঠক, এমনি একাধিক মাত্রার অস্থির চিত্রের সংঘর্ষে বা দোলাচলের মধ্যে থাকেন বলে, গানটিকে একাধিক মাত্রার রূপকল্পিক গান বলে মনে করা যেতে পারে অবশ্যই। কিন্তু বর্তমান নিবেদকের ভালো লাগে একমাত্রার রূপকল্পের কথা, ভালোবাসার কথাই ভাবতে।
ঠিক এইরকমই, একই ভাবানুষঙ্গের, প্রায় একই চিত্রের একটি গান রয়েছে এই গীতাঞ্জলি-পর্বেই, পূর্বোক্ত গানের একটিমাত্র গান পরেই। ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ গানটিও পথিকের যাত্রার গান। এবারের পথচলা কিন্তু ঝড়ের রাতে। অভিসারেই যাচ্ছে সে, কিন্তু কোথায়? দুয়ার খুলে একজন যদিও বারে বারে বাইরে দিশাহীন অন্ধকারের দিকে ব্যর্থ অবলোকনের চেষ্টা করছে। তবু প্রকৃতপক্ষে পথিক কি সেখানে যাচ্ছে? আগের গানে যেমন পথিক কূজনহীন কাননভূমি অতিক্রম করছিল, এবারেও সে গভীর অন্ধকারে সুদূরে কোনো গহন বনের ধারে প্রবাহিত নদীর তীররেখায় অন্ধকারময় পথ বেয়ে আসছে। অবশ্যই, প্রেমিক আসছে প্রেমিকার কাছে। কিন্তু পূর্বোল্লিখিত গানে, তবু, প্রেমিকার খোলা দরোজায় প্রবেশ করার সম্ভাবনা ছিল, এবারে নিশ্চিতভাবে তাও নেই। সে কেবল আসছেই…। অফুরান তার আগমন, অশেষ তার পথ। প্রেমিকা তো বিপ্রলব্ধাই থেকে যাবে। এ-চিত্রটিই চমৎকার চিত্র। শুধু এ-চিত্রটির কথা ভাবলে একমাত্রিক রূপকল্পিক গান হতে পারে এটি। হতে পারে কেন, তাই হওয়া উচিত। কিন্তু কেউ যদি আঁধার ঝড়ের রাতকে অন্ধকার জীবনের প্রতীক মনে করেন এবং হতাশসম আকাশের ক্রন্দনকে ভাবা যায় জীবনের অনন্ত হতাশার প্রতীক, তখন কাছে কখনো পৌঁছবে না জেনেও ঈশ্বরই যদি আশ্রয় হয় মানুষের (অর্থাৎ ওই পথিক যদি ঈশ্বরের প্রতীকী রূপ হয়) তাহলেও সেটা গ্রাহ্য হবে বোধহয়। আর তখনই গানটির রূপকল্প একাধিক মাত্রা প্রাপ্ত হয়।
ওই গীতাঞ্জলি-পর্বের আরো কয়েকটি গানের পরেই এইরকমই আবার পথিকের আগমনদৃশ্য ভেসে ওঠে – ‘আমার মিলন লাগি তুমি’ গানটিতে। তখন পথিক আর অবশ্যই প্রেমিক বা বন্ধু বা পরানসখা থাকে না। অথচ এই গানটিই যে পর্যায়-ভাগকালে কী করে বিরহ পর্যায়ের গান হয়ে যায়, বুঝতে পারি না এবং যেখানে পরিষ্কার অভিসারের কথা বলা আছে (অর্থাৎ ‘ঝড়ের রাতে’ গানটিতে) সেখানে সেটি কী করে যে প্রকৃতি পর্যায়ে চলে যায় তাও আবার বোঝা যায় না। যাঁরা পর্যায় বিভাজন করেছেন তাঁরা কি গানের প্রধান ভাব বা প্রধান রূপকল্পটির প্রতি দৃষ্টি দেননি? রবীন্দ্রসংগীতবিশারদরা হয়তো এর কারণ জানেন। গানটিকে সম্পূর্ণভাবেই উদ্ধার করছি :
আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে! তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায় রাখবে কোথায় ঢেকে? কত কালের সকাল-সাঁঝে তোমার চরণধ্বনি বাজে, তোমার দূত হৃদয়-মাঝে গেছে আমায় ডেকে ॥ ওগো পথিক, আজকে আমার সকল পরাণ ব্যেপে থেকে থেকে হরষ যেন উঠছে কেঁপে কেঁপে। যেন সময় এসেছে আজ ফুরালো মোর যা ছিল কাজ – বাতাস আসে, হে মহারাজ, তোমার গন্ধ মেখে ॥

গানটিতে একাধিক মাত্রা যোজনা করা আছে হয়তো। কিন্তু এটি কি ভাবনাকে, কি অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেয়? তা কি প্রেমিক-প্রেমিকার বিরহানুভূতি? কখনোই নয়। তৃতীয় লাইনটিতে তো বলাই আছে, ‘তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়/ রাখবে কোথায় ঢেকে’। সুতরাং এটা কখনই মানবিক বিরহাভিসার হতেই পারে না। তাছাড়া শেষ লাইনে ‘ফুরালো মোর যা ছিল কাজ’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ কখনই কোনো বিরহভারাতুর রমণীকে ইঙ্গিত করে না। বিরহভারাতুর রমণী কি সমস্ত কাজ সাঙ্গ করে তারপর বিরহবেদনা জানাতে বসবে, অভিনয়ের ঢঙে? যাত্রার ঢঙে? বরং ‘ঈশ্বর-বিরহ’ হওয়া সম্ভব অবশ্য। অথবা ঈশ্বর না ভেবে আরেক শক্তির কথাও ভাবা যায়। সৃষ্টিশক্তি। যে-শক্তি এই চন্দ্রতারকাগ্রহসমন্বিত মহাজগৎকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি যেন আমার মিলনের জন্যই আমার কাছে চিরদিন ধরে আসছেন। সেই মহারাজ সম্পূর্ণভাবে তাঁর কাছে দেখা দেবেন কি কোনোদিন? নাকি তাঁর গায়ের গন্ধমাখা বাতাসই আসবে চিরকাল? এই শক্তিরই কণামাত্র হয়তো পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কখনো এই শক্তির স্বরূপ সম্পূর্ণভাবে জানবো, এই আশায়, এই ভরসায়, আমার সমস্ত কাজ সাঙ্গ করে বসে থাকা এবং এই আশাতেই আমার আনন্দ, আমার হর্ষ। কিন্তু যদি মৃত্যুর কথা ভাবা যায়? সব কাজ শেষ করে তার আশাতেই তো বসে থাকা। তা যদি হয়, তাহলে সে কেমন মৃত্যু, যার গন্ধ পেলে হর্ষ হয়?  জীবন-মৃত্যু একাকার হয়ে যায় না কি? ‘আমার মিলন লাগি তুমি’ – রবীন্দ্রনাথের গানের এই তুমির কথা ভাবতে গিয়ে শঙ্খ ঘোষ আরেক মাত্রার কথা চিন্তা করেছেন রবীন্দ্রসংগীতের রূপকল্পে। তিনি ভাবছেন, এই ‘তুমি’ কি রবীন্দ্রনাথের নিজেরই আত্মসত্তা? ‘এই ‘তুমি’কে স্পর্শ করার মুহূর্তই হলো নিজেকে জানতে পাওয়ার মুহূর্ত। আমার তো মনে হয় সমস্ত 888sport live chatই এই নিজেকে জানার 888sport live chat’ – তিনি বললেন। এই ভাবনার সূত্র ধরে আমাদের মনে হতে পারে নিজেকে জানার এই বিশেষ মুহূর্ত বা চরম মুহূর্ত, যা আমার ‘তুমি’তে এসে পৌঁছানো, তা কি কখনো স্পর্শ করা সম্ভব? কখনো কখনো স্পর্শ করা গেলেও সে ‘তুমি’ ছেড়ে যায়। তখন বিরহ-বেদনা। প্রভু/ ভগবান/ ঈশ্বর/ প্রেমিক – এসব কিছুই নয় হয়তো। এই ‘তুমি’র দিকে যাওয়ার অভিসার বড় কষ্টকর, বড় সংকট, বেদনাদায়ক – ঝড়ের রাতে, গহনবনের মধ্যে দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের গানের রূপকল্পের বিভিন্ন মাত্রা বা স্তর নিয়ে ভাবতে গেলে এরকম পর্যায়-বিভাগ নিয়ে সন্দেহ মাথাচাড়া দেবেই। ‘রাজপুরীতে বাজায় বাঁশি’ পূজা-পর্যায়ে না গিয়ে প্রেম-পর্যায়ে কেন যাবে না, এটা বুদ্ধদেব বসুর প্রশ্ন ছিল। অথবা এও মনে হতে পারে, ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’ নামক প্রকৃতি পর্যায়ের গানটিকে কেনইবা প্রেম-পর্যায়ে ফেলা যাবে না। বর্তমান নিবেদকের ব্যক্তিগত ধারণা, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি-পর্ব থেকে (গীতিমাল্য ও গীতালিকে ধরে) অর্থাৎ পঁয়তাল্লিশ থেকে তিপ্পান্ন বছরের মধ্যে লেখা গানগুলো থেকে রূপকল্প একাধিক মাত্রা গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছে এবং এই প্রবণতা শেষ বয়সের যাত্রাপথে ক্রমশ বেড়ে গেছে বোধহয়। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, মধ্যবয়স থেকে শেষ বয়সের মধ্যে একমাত্রিক রূপকল্প সমন্বিত গান লেখেননি। সমস্ত ব্যাপারটি গবেষণাসাপেক্ষ, কারণ তাঁর দুহাজারের অধিক গানকে বা অন্তত তার অর্ধেক গানকেও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন হবে সেক্ষেত্রে। কোনো অনুসন্ধিৎসু গবেষক চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
প্রথম যৌবনে একমাত্রিক রূপকল্পের গান লেখা অবশ্য স্বাভাবিক এবং সেগুলো প্রেমের গান হওয়াই উচিত হয়তো। কতকগুলি বহুলপ্রচলিত গানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে,  যেমন – ১. বিদায় করেছ যারে নয়নজলে (২৫ বছর) ২. দুজনে দেখা হলো    (২৪ বছর), ৩. মরি লো মরি আমায় (২৩ বছর), ৪. সখি ওই বুঝি বাঁশি বাজে (২৩ বছর) ৫. আমি চিনি গো চিনি তোমারে (৩৪ বছর), ৬. ভালো যদি বাস সখি (২২ বছর), ৭. যামিনী না যেতে জাগালে না (৩৪ বছর) ইত্যাদি। কিন্তু এই বয়সে পূজা-পর্যায়ের গানও আছে। যেমন, ‘এ কি সুগন্ধ হিল্লোল বহিল’ (২৩ বছর)। তবু, গীতাঞ্জলি-পর্বের আগে যে একাধিক মাত্রাযুক্ত রূপকল্পের গান নেই তা নয়, যেমন ১. মহাবিশ্বের মহাকাশে (৩৫ বছর), ২. ঝরঝর বরিষে বারিধারা (৩৪ বছর), ৩. এ পরবাসে রবে কে হায় (২৩ বছর), ৪. তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না (৩১ বছর) ইত্যাদি। এর মধ্যে একটি গানের রূপকল্পের কথা একটু ভেবে দেখা যেতে পারে। পূজা-পর্যায়ের গান ‘এ পরবাসে রবে কে হায়’। খুবই ছোট চার লাইনের গান।
এ পরবাসে রবে কে হায়!
কে রবে এ সংশয়ে সন্তাপে শোকে।
হেথা কে রাখিবে দুঃখ ভয় সংকটে –
তেমন আপন কেহ নাহি এ প্রান্তরে হায়রে।
কোনো কোনো ছান্দসিক একে দলবৃত্ত ছন্দের মধ্যে ফেলেছেন। আমার যদিও তা মনে হয় না, তবু ছান্দসিকরা যদি বলেন তাহলে হতেও পারে। আমার বক্তব্য হলো, সুর ছাড়া এ-গানটির অস্তিত্ব আমরা ভাবতেই পারি না, ছন্দের কথাও না। বিষয়টি আবার যথাস্থানে উঠে আসবে। সুর ছাড়া গানটির একাধিক মাত্রার রূপকল্পও প্রাধান্য পায় না, তবু ব্যবহৃত রূপকল্পটিতে একাধিক মাত্রা পাওয়া সম্ভব। একটি প্রাথমিক ছবি, – বিদেশে বসবাসকারী কোনো ব্যক্তি হয়তো কোনো বিপদে পড়েছে, তখন তার এই উক্তিটি জানিয়ে দিচ্ছে যে, সে কত অসহায়। হয়তো সে সন্তপ্ত, শোকার্ত, ঘনিষ্ঠ কোনো পরিজনের মৃত্যুতে ভীতও। দ্বিতীয় ছবি জীবনকেই অসহনীয় মনে করা। পরবাস এবং প্রান্তর শোকসন্তপ্ত হতাশ ব্যক্তির জীবনের প্রতীক হতে পারে। জীবন এতোই অসহনীয় হয়ে উঠেছে যে, তাকেই পরবাস ও প্রান্তর মনে হচ্ছে। এই দ্বিতীয় ছবিটি স্থায়িত্ব  পায়। কারণ আমরা জানি যে, বছরখানেক আগে কাদম্বরী বউঠান মারা গেছেন, যাঁর কথা রবীন্দ্রনাথ সারাজীবনে ভোলেননি। এই দুটি মাত্রার সঙ্গে যোগ হয়েছে আর একটি মাত্রা – সেটা হচ্ছে গানের সুর। বিষয়টি পরবর্তী পরিচ্ছেদে বলার চেষ্টা করা যাবে।
পরবাসে প্রান্তরে শোকে তাপে মুহ্যমান কোনো একাকী ব্যক্তির কথা ভাবতে গিয়ে, নিবেদকের আরেক একাকী ব্যক্তির কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু তার পরিবেশ ভিন্ন। সে বর্ষার অসীম প্রান্তরে গতিহীন ভয়বিহ্বল অবস্থায় দাঁড়িয়ে। ‘ঝরঝর বরিষে বারিধারা’ গানটির কথা ভাবছি। এও প্রথম যৌবনে চৌত্রিশ বছর বয়সে লেখা। কিন্তু গানটি একাধিক মাত্রার রূপকল্প-সমন্বিত। প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে, একটাই তো ছবি। অন্ধকার নিশীথে বর্ষায় অসীম    প্রান্তরে পথহারা গৃহহীন, গতিহীন, এক বিহ্বল ভয়াকুল ব্যক্তি দাঁড়িয়ে। কিন্তু ভাবলে, আমরা কি আর একটি ছবিও পাই না? জীবনের অসীম সংকটে, দুর্যোগে, নিরাশ্রয়, নির্বান্ধব হতাশ মানুষের ছবি কি এটা নয়? এক্ষেত্রে বর্ষাধারা, অধীর যমুনা, বায়ুর হা-হা ধ্বনি, সবই সেই ব্যক্তির অসহায়তাকে তীব্র করে তুলছে প্রতীকী অর্থপ্রাপ্ত হয়ে। আসলে কতগুলি প্রতীক পরস্পর লগ্ন হয়ে রূপকল্পটিকেই সামগ্রিকভাবে প্রতীকী করে তুলেছে।
গীতাঞ্জলি-পর্বে একাধিক মাত্রার রূপকল্প আমরা দেখেছি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের রচিত গানে, একাধিক মাত্রায় চিত্রকল্প বেশি দেখা গেছে বলে মনে হচ্ছে নিবেদকের। যেমন – ১. বিজনঘরে নিশীথ রাতে (৫৬ বছর), ২. জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে (৫৮ বছর) – এরকম বহু গান। আরো উদাহরণ দেওয়া যায় – ১. একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে (৭৮ বছর), ২. সমুখে শান্তিপারাবার (৭৮ বছর), ৩. বাণী মোর নাহি (৭৮ বছর), ৪ সঘন গহন রাত্রি (৭৮ বছর), ৫. শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে (৭৮ বছর) ইত্যাদি।
অবশ্য, আমার বক্তব্যের পুনরুল্লেখ করে বলছি যে, অসংখ্য গানের মধ্যে কয়েকটি গানের উল্লেখ থেকে আমার অনুমানের ভিত্তি গঠন করা সংগত হবে না। এর জন্য গবেষণার প্রয়োজন। শেষ বয়সে একমাত্রিক রূপকল্পের গানও রয়েছে অনেক, যেমন – ১. কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা (৭৯ বছর), ২. এসেছিলে তবু আস নাই (৭৮ বছর), ৩. মনে হলো যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ (৭৮ বছর) ইত্যাদি। আমার মূল বক্তব্য অবশ্য দুটি, ‘ইমেজ’ বা রূপকল্প রচনা তাঁর কাছে নতুন কথা ছিল না। তাঁর স্বভাবেই ছিল। কোনো পাশ্চাত্য মতবাদের আগমনের প্রয়োজন ছিল না। তাঁর কবিস্বভাবেই ছিল। অবশ্য ‘ইমেজিস্ট’রা অসুন্দরের রূপকল্পকেও সমান গুরুত্ব দিতেন বা অধিক গুরুত্ব দিতেন। রবীন্দ্রনাথের কবিস্বভাবে সুন্দরের প্রতি পক্ষপাত ছিল, অসুন্দরের প্রতি নয়। তফাৎ শুধু এটুকুই। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ একমাত্রার রূপকল্পও যেমন এঁকেছেন, একাধিক মাত্রার রূপকল্পও তেমনি এঁকেছেন। আমার দ্বিতীয় বক্তব্য প্রশ্নাকারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একাধিক মাত্রার রূপকল্পই কি তিনি বেশি এঁকেছেন? এটা যদি নিতান্তই অনুমান হয়, তাহলে রবীন্দ্রসংগীতের রূপকল্প পাঠ করার একটা প্রক্রিয়াও ধরে নেওয়া যেতে পারে রূপকল্পের মাত্রা বা স্তরভাবনার পদ্ধতিকে। এখানে একটা স্পষ্ট কথা কবুল করে নেওয়া ভালো, আমি একাধিক মাত্রার রূপকল্পকেই প্রকৃত রূপকল্প বলে মনে করি ‘ইমেজিজমের’ অর্থে। একমাত্রার ছবিকে চিত্রকল্প বললেও চলে যেতে পারে। অবয়ববাদী বা উত্তর-অবয়ববাদীদের সব অনুপুঙ্খের আলোচনা প্রাসঙ্গিক না হলেও 888sport app download apkয় ‘আইসোটোপিক’ রূপাবয়ব তৈরির ধারণাটি রূপকল্পের আলোচনায় গ্রহণযোগ্য। একটি 888sport app download apk একটি সামগ্রিক অবয়ব সৃষ্টি করতে পারে। অনেক সময়ে সেই অবয়বটি গঠিত হয় অনেকগুলি সমভাবাপন্ন সঞ্চরমান রূপকল্পের সংশ্লেষে এসে পৌঁছানোর পরে। একেকটি রূপকল্প অনেক সময়ে 888sport app রূপকল্প, ধ্বনি, ছন্দ, রূপক, উপমা ইত্যাদির সঙ্গে কখনো সংঘর্ষে, কখনো আশ্লেষের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হতে হতে এমন একটা উজ্জ্বলতম বিন্দুতে এসে পৌঁছায় যেখানে 888sport app download apkটির সামগ্রিক অবয়বটি জ্বলে ওঠে, সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। 888sport app download apkর মধ্যে ব্যবহৃত এই রূপকল্পগুলিকেই অবয়ববাদী বা উত্তর-অবয়ববাদীরা বলছেন ‘আইসোটোপি’। আগে এ-সম্বন্ধে কিছু বলা হয়েছে। উলটোদিক থেকে দেখলে মনে হবে, এই উজ্জ্বলতম বিন্দুটি থেকে 888sport app রূপকল্প বিচ্ছুরিত হচ্ছে। ডিলান টমাস একে বলতেন, ‘Sun-burst effect’| রবীন্দ্রনাথের গানে এরকম আইসোটোপিক রূপকল্পের ব্যবহার অনেক। এখানে দুটি গানকে বেছে নেওয়া হলো। অন্য একটি গানের কথা পূর্বেই প্রসঙ্গক্রমে বলা হয়েছে। প্রথম গানটি গীতিমাল্যের ৩৯ নম্বর গান – ‘বাজাও আমারে বাজাও’।
বাজাও আমারে বাজাও।
বাজালে যে সুরে প্রভাত-আলোরে
সেই সুরে মোরে বাজাও
যে সুর ভরিলে ভাষাভোলা গীতে
শিশুর নবীন জীবনবাঁশিতে
জননীর মুখ-তাকানো হাসিতে –
সেই সুরে মোরে বাজাও।
সাজাও আমারে সাজাও।
যে সাজে সাজালে ধরার ধূলিরে
সেই সাজে মোরে সাজাও।
সন্ধ্যামালতি সাজে যে ছন্দে
শুধু আপনারই গোপন গন্ধে
যে সাজ নিজেরে ভোলে আনন্দে –
সেই সাজে মোরে সাজাও ॥

প্রথম স্তবকটিতেই একেকটি লাইনে একেকটি রূপকল্প নির্মিত হচ্ছে। একজন 888sport live chatী যন্ত্রসংগীতে মূর্ছনা তুলছেন। আমাকেও বাজাচ্ছেন। প্রভাত-আলোকেও বাজাচ্ছেন, শিশুর জীবন-বাঁশি এবং মায়ের মুখের হাসি সবকিছুই সুরে বাজিয়ে নিচ্ছেন – একই সুরে। প্রতীক, উপমা, রূপক বা সমাসোক্তি, যে-অলংকারই থাকুক না কেন, প্রতিটি রূপকল্পই যেন একই আশ্লেষে পৌঁছে বেজে উঠছে এবং সেই আশ্লেষ উজ্জ্বলতম রূপকল্পকে সামগ্রিকভাবে গড়ে তুলছে, যেখানে এক যন্ত্রী অনেক যন্ত্রকে নিয়ে একই সুরে বাজিয়ে আনন্দিত-মুহূর্তের সৃষ্টি করছেন। প্রতিটি চিত্ররূপই একেকটি ‘আইসোটোপি’ বা সমভাবাপন্ন রূপকল্প। কিন্তু এই যন্ত্রীর যন্ত্রবাদনের পূর্ণ আনন্দঘন মুহূর্তটি নিজেও একটি আইসোটোপিক রূপকল্প। দ্বিতীয় স্তবকে আবার সাজানোর চিত্র। এক সজ্জাকর আমাকে সাজাচ্ছে, ধরার ধূলিকে সাজাচ্ছে, সন্ধ্যামালতিকে সাজাচ্ছে। (সন্ধ্যামালতি অবশ্য নিজেই সাজছে তার গন্ধ নিয়ে, তবু সেই গন্ধ বোধহয় সজ্জাকরেরই দেওয়া।) কিন্তু কোনো রঙে নয় গন্ধে হয়তো, আবার রঙেও হয়তো, যেভাবেই হোক যে-অলংকারেই হোক, একেকটি সাজানো রূপকল্প একত্রে মিশে গেছে সেই সব-ভোলানো সজ্জাকরের আনন্দের সাজঘরে। সুতরাং এটিও একটি ‘আইসোটোপি’। দুটি বড় আইসোটোপিক রূপকল্প আবার পুনরায় আশ্লেষে লগ্ন হয়ে অন্য আরেকটি রূপকল্পের নির্মাণ ঘটাচ্ছে। যেখানে সংগীতকার আর সংগীতকার থাকে না। সজ্জাকর আর আর সজ্জাকর থাকে না। দুজনেই মিলিত হয়ে বিশাল এক সৃষ্টিশক্তির রূপকল্পে পরিণত হয়, যে-সৃষ্টির খেলাঘরে শুধু গান, সুর আর সৃষ্টির চমৎকারিত্বের সাজসজ্জা। পাঠক অকস্মাৎ এক অবর্ণনীয় সুর-মূর্ছনার মধ্যে, আনন্দঘন গন্ধবহ ভাষাভোলা মুহূর্তের মধ্যে, ঢুকে পড়েন, যেখানে অপরূপ মাধুর্যের বিমূর্ত রূপটি প্রধান হয়ে উঠছে।
অন্য গানটি হলো গীতিমাল্যের ১০৩ নম্বর গান :
এই তো তোমার আলোকধেনু
সূর্য তারা দলে দলে
কোথা ব’সে বাজাও বেণু,
চরাও মহাগগনতলে ॥
তৃণের সারি তুলছে মাথা,
তরুর শাখে শ্যামল পাতা –
আলোয়-চরা ধেনু এরা
ভিড় করেছে ফুলে ফলে ॥
সকালবেলা দূরে দূরে
উড়িয়ে ধূলি কোথায় ছোটে,
আঁধার হলে সাঁজের সুরে
ফিরিয়ে আন আপন গোঠে।
আশা তৃষা আমার যত’
ঘুরে বেড়ায় কোথায় কত –
মোর জীবনের রাখাল ওগো
ডাক দেবে কি সন্ধ্যা হলে?

এখানে অনেকগুলি আইসোটোপিক রূপকল্পকে আমরা লগ্ন অবস্থায় পাচ্ছি। একটি রাখালের ধেনু চরানোর রূপকল্প এবং ধেনুকে সন্ধ্যা হলে ডেকে নেওয়া রূপকল্প। এটি প্রাথমিক মাত্রার। অন্য আরো কয়েকটি রূপকল্প – ১. সৃষ্টিশক্তিকে রাখালের প্রতীকে বর্ণনা করা, ২. আকাশকে প্রাঙ্গণরূপে কল্পনা করা, ৩. সূর্য চন্দ্র তৃণ তরু ইত্যাদিকে ধেনুর প্রতীকরূপে কল্পনা করা, ৪. সমগ্র পৃথিবীকেও প্রাঙ্গণ মনে করা, ৫. আশা-তৃষার মতো বিমূর্ত ভাবনাকেও ধেনুর প্রতীক করে তোলা। ৬. নিজেকেও ধেনুর প্রতীক করে তোলা।
শেষ দুটি রূপকল্প এক অদ্ভুত রহস্যময়তা সঞ্চার করেছে গানটিতে। আমি কি রাখাল নাকি, যে আশা-তৃষারূপ ধেনুকে চরাচ্ছে? আবার আমিই কি ধেনু, যাকে সৃষ্টিশক্তি চন্দ্র-সূর্যরূপ ধেনুর মতো চরাচ্ছে? শেষে ৭ নম্বর একটি রূপকল্প আছে শেষ লাইনে, যা থেকে নির্গত হচ্ছে মৃত্যুর দ্যোতনা। কিন্তু এ-মৃত্যুচেতনা ভীতিসঞ্চারী নয়, বরং গৃহে প্রত্যাগমনের আনন্দানুভূতির সূচক। সব আইসোটোপিক রূপকল্প একত্রিত হয়ে এমন একটা মহাজাগতিক সৃষ্টিশক্তির রূপকল্পকে নির্দেশিত করছে, যেখানে হয়তো বিমূর্ত সুরের বিন্যাসের জন্য অনেকটা মৃত্যুও আনন্দময় হয়ে উঠছে।

তিন
এখন আমরা ভাবতে চেষ্টা করব রবীন্দ্রসংগীতের সুর, রূপকল্পকে অন্য কোনো বিশেষ মাত্রা দান করছে, নাকি রূপকল্পকে শুধুমাত্র আভাসিত করে, ক্রমশ বিমূর্ততা চলে যাচ্ছে।
(আলোচনার সময়ে আমি সুরসপ্তকের কোনো একটি বিশেষ সুরকে বোঝাতে ‘পর্দা’ শব্দটি ব্যবহার করব না, কারণ পর্দা শব্দটি এখন সংগীতের ক্ষেত্রে ইংরেজির ‘scale’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বরং আমি ‘সুরস্থান’ নামক শব্দবন্ধ ব্যবহার করব)
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে কথার বা রূপকল্পের কোনো মূল্য নেই, সুরই মুখ্য। শাস্ত্রকাররা একটা রাগরূপ বা রাগমূর্তি কল্পনা করেন বটে, কিন্তু সেটা প্রকৃতই কল্পনা। রবীন্দ্রনাথও এরকম রূপমূর্তির কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু কল্পনার ছবি, বিমূর্ততা থেকে মূর্তি পরিগ্রহ করার ছবি। আমাদের প্রয়াস ঠিক উলটো। রূপকল্প থেকে বিমূর্ততার দিকে যাত্রা, 888sport app download apkয় মালার্মে যেমনটি চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রসংগীত তো 888sport app download apkও। প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা। বিশিষ্ট রবীন্দ্রবিদ অরুণকুমার বসুর সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, তিনি 888sport app download apkর রূপকল্পের সঙ্গে সুরসৃষ্ট রূপমূর্তির কোনো মিশ্রণ না ঘটিয়ে সুরসৃষ্ট ভাবমূর্তিকে ‘ভাবকল্প’ রূপে দেখতে চান। তাতে রূপকল্পের আভাস থাকতে পারে। আমি কিন্তু সুরকে কাব্যিক রূপকল্পের ভাবনার সঙ্গে যুক্ত করে দেখতে চাই। তিনি অবশ্য এরকম ভাবনার বিরোধীও নন। আমার মূল ভাবনা হচ্ছে বিশেষ একটি ভাবের প্রকাশের জন্য রবীন্দ্রনাথ কোনো বিশেষ সুরকৌশলের বা নিয়মের সৃষ্টি করেছিলেন কি না। যেমন ধরা যাক ‘বিন্দু বিন্দু ঝরে জল’। যাঁরা দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে বিন্দু বিন্দু শব্দ দুটি উচ্চারিত হতে শুনেছেন তাঁরা বুঝতেই পারবেন ‘বিন্দু বিন্দু’ করে জল ঝরার চিত্রটি ওই শব্দদুটির সুরের সঙ্গে কীভাবে মিশে আছে। সুরে, ‘বিন্দু বিন্দু ঝরে জল’ উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু করে জল ঝরার রূপটি, চিত্রটি, আমার চোখের সামনে স্পষ্টতর হয়ে উঠলো। অরুণকুমার বসু হয়তো বলবেন ‘আভাসিত’ হলো। মাত্র কয়েকটি গানকে অবলম্বন করে এরকম ভাবনাকে বিস্তারিত করা উচিত কি না বলতে পারবো না, তবু, আমার এ-ধরনের চিন্তাকে অনুমান ভাবলেও যে-কোনো পাঠক বা শ্রোতা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, এভাবে ভাবতেও ভালো লাগে। রূপকল্পের ক্ষেত্র যেমন বলেছি, ভবিষ্যতে কোনো গবেষক, নিয়ম, নীতি, ফর্মুলাতে পৌঁছতেও পারেন, আবার নাও পারেন।
ধরা যাক, রবীন্দ্রসংগীতে দূরত্ব বোঝানোর ব্যাপারটি। যেখানেই দূরত্বকে রূপ দিতে চাইছেন তিনি সুরের মাধ্যমে, সেখানেই তিনি সুরসপ্তকের প্রথম তিনটি বা চারটি সুরস্থানের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে, সেই সপ্তকের উচ্চ সুরস্থানের ‘খা’ বা ‘নি’কে স্পর্শ করছেন, এমনকি হয়তো পরের সপ্তকের ‘র্সা’ এবং ‘র্রে’কেও ছুঁয়ে যাচ্ছেন। ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ গানটি, সাধারণত সুরসপ্তকের ‘সা’ থেকে ‘মা’ অথবা বড় জোর ‘পা’কে ছুঁয়ে যাওয়া হয়। শুধুমাত্র দুবার দুটি ক্ষেত্রে, বিদেশিনী অনেক দূরে থাকেন, বোঝাতে গিয়ে অর্থাৎ ‘তুমি থাকো সিন্ধুপারে’ এবং ‘অতিথি তোমারই দ্বারে’ – এই চিত্রদুটি রচনার সময়ে পরের সপ্তকের ‘র্সা’ এবং ‘র্রা’কে ছুঁয়ে ফেলছেন এবং ‘ধা’ ও কোমল ‘নি’কে ব্যবহার করে নেমে আসছেন। স্বরবিতানের সংকেতচিহ্ন এরকম :
গা    মা।
তু    মি
পা    -।    র্পসা    ।    না    -র্রা    র্সা।    স্ধা    ণা    -ধা।    পা    -।    সা
থা    -০    ক    সি    ন্    ধু    পা    ০    ০ রে    ০  ও

শুধু দূরের রূপকল্পের ইঙ্গিত দিতেই যে এমন করেছেন তা নয়, সপ্তকের উচ্চ-সুরস্থান কোনো অন্যভাবকেও প্রকাশ করতে পারে, ছবিকেও। কিন্তু দূরত্বের ইঙ্গিত দিতে তিনি এ-ধরনের সুরের ব্যবহার করেছেন বলেই প্রতীতি জন্মাচ্ছে।
শুধুমাত্র আক্ষরিক অর্থে দূরের রূপকল্প রচনাতে, দূরের বিস্তৃতির রূপ দিতে, দূরের আহ্বানের ইঙ্গিত জানাতে, তিনি যে সপ্তকের উঁচু সুরগুলিকেই বা পরের সপ্তকের কোনো কোনো সুরকে ছুঁতে চান, তার আরো একটি উদাহরণ ‘আমি চঞ্চল হে’ গানটির ‘সুদূর বিপুল সুদূর’ অংশটি। এখানে তিনি শুধু যে উচ্চ-সুরস্থানগুলিকে স্পর্শ করলেন তাই নয়, সুদূরের বাঁশরির কোমলতা বোঝাতে প্রচুর কোমল সুরস্থান গ্রহণ করলেন এবং সুরকে লম্বিত ও প্রসারিত করে বিস্তৃতি দান করলেন। শুধু একটি লাইনের উল্লেখ করছি –

।    জ্ঞা    সা    -ঋ।    ঋমজ্ঞা    জ্ঞাঋজ্ঞা    ঋ।    ঋসা    ণা    সাধা।    ঋসা    সা    র্সা।
সু-    দূ    ০         রে০        ০    ০    র    পি    য়া    ০০        সি    আ    মি

।    র্সা    -া    -া    ।    র্সর্ঋ    র্সা    ণপা।    শণা    -।    -া    ।    -দা    পা      মা।
চ    ০    ন্    চ    ০    ল ০     হে    ০    ০    ০    আ    মি

(বাঙালি শ্রোতারা রবীন্দ্রনাথের গানে এমনই মগ্ন যে এরপর আমি আর সংকেতচিহ্ন ব্যবহার না করে শুধু গানের লাইনই উল্লেখ করবো, আমার মূল বক্তব্যে পৌঁছবার জন্য। উপরের চিহ্নগুলি যদি লেখার সময়ে কোনো ভুল লেখা হয়ে থাকে, তাহলে সুধী পাঠক আমাকে ক্ষমা করবেন। শুধু মূল বক্তব্যটিকেই অনুসরণ করলেই হবে।)
দূর ও দূরের বিস্তৃতি বোঝাতে তো বটেই, যিনি ঈশ্বর সৃষ্টিস্বরূপ বা বিশ্বনাথ অথবা যিনি অপ্রাপণীয়, যাঁর অবস্থান জীবন-মৃত্যুর সীমানা পার হয়ে, তাঁর বর্ণনা রূপকল্পটিতেও উচ্চ-সুরস্থান ব্যবহার বর্ণের এবং সুরকে বিস্তার দান করে রবীন্দ্রসংগীত-শ্রোতার চিত্তে রূপকল্পটি আরো উজ্জ্বল করতে চায়। ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা তো আমার কাছ থেকে অনেক দূরেই থাকেন। ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে’ গানটির আরম্ভেই অকস্মাৎ ‘মহাবিশ্বে মহা’ পর্যন্ত শব্দদুটিতে উচ্চ-সুরস্থান ব্যবহার করে রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে নেমে আসেন; নেমে আসেন, কারণ তখন তিনি কাছে রয়েছেন, নিজের কাছে, নিজের বিস্ময়ের কাছে। কিন্তু যখনই ‘তুমি আছ বিশ্বনাথ’ অর্থাৎ দূরে বিশ্বনাথের অবস্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছেন, তখনই তিনি পরের সপ্তকের র্সা এবং র্রাকে স্পর্শ করে থাকছেন।
‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে’ গানটিতেও ‘বন্ধু’র অবস্থান অনেক দূরে। যদিও তুমি আমার হৃদয়েই রয়েছে, তবু সেখানটা তো দূরের ‘বিজন আকাশ’ কারণ সেখানে তোমার ‘মহাসন আলোকে 888sport app’ আছে। কাজেই দূর তো হতেই পারে। প্রায় অনধিগম্য। তাছাড়া সেখান থেকে গানকেও নেমে আসতে হচ্ছে, অর্থাৎ খুব দূর নয় যদি ভাবা যায়, অনেক উঁচু তো অবশ্যই। সুতরাং প্রায় সমগ্র গানটিই উচ্চগ্রামে বাঁধা এবং প্রায় সব সময়েই সুর পরের সপ্তকের ‘র্সা’কে এবং মাঝে মাঝে ‘র্রা’কেও স্পর্শ করে থাকছে। শুধু দূরের কথা নয়, হতাশা বোঝাতে, প্রিয়তমকে না-পাওয়ার বেদনা বোঝাতেও, উচ্চ-সুরস্থানের মূর্ছনা ও সুরবিস্তারের রীতিকে ব্যবহার করেছেন। শ্রোতা ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’ গানটির শেষ দুই লাইনের ‘দূরের পানে মেলে আঁখি/ কেবল আমি চেয়ে থাকি/ পরান আমার কেঁদে বেড়ায়/ দুরন্ত বাতাসে’ রূপকল্পটি মনে করতে পারেন।
সাধারণত, বর্ষার মেঘমেদুর পরিবেশ-রচনায় বা বর্ষার সজলতার বর্ণনায় তিনি নিু কোমল সুরস্থানই বেশি ব্যবহার করেছেন, কিন্তু বর্ষা-বর্ণনা হলেও, তিনি কোমল ও নিু-সুরস্থানে গান শুরু করলেও, যেখানে প্রিয়তম আসছে বা ঈশ্বর আসছেন দূর থেকে – এই ভাবনায় চলে যান এবং সেখানে যদি কিছুটা হতাশা বা নৈরাশ্যের সম্ভাবনাও থাকে, তাহলেই সেই দূরত্বের বোধ, সেই স্তার এবং ক্রমশ উচ্চ-সুরস্থানে গানের উত্তরণ ঘটে। ‘আজি শ্রাবণঘন গহন মোহে’ গানটি স্মর্তব্য। গানটির সুর ‘সা’ ‘রে’ এবং কোমল ‘জ্ঞা’কে স্পর্শ করে। এমনকি যেখানে একলা পথিক আসছেন সেখানেও, নিু-সুরস্থানে অবস্থান করছে সুর; কিন্তু যখনই চাই একাকী-পথিক প্রিয়তমাকে সম্বোধন করা শুরু হলো এবং তিনি আসবেন কি আসবেন না – এরকম নৈরাশ্যপীড়িত দোলাচলে বিরহীচিত্ত আকুল হলো, ঠিক তখনই গান ক্রমশ উচ্চ-সুরস্থানের দিকে ধাবিত হতে লাগলো।
কিন্তু যেখানে এই পথিক-প্রিয়তম ঈশ্বর বা প্রেমিক নন, অভিসারে যাচ্ছেন না, কোনো মহাসনে বসে নেই, যেখানে এই পথিক শুধু সাধারণ পথিকমাত্র, যিনি আঁধার রজনীতে ঝরঝর বর্ষণের মধ্যে পথহারা, গৃহহারা – তাঁর রূপকল্প প্রকাশের জন্যও সুর উচ্চস্থানকে স্পর্শ করতে পারে। অবশ্যই, বর্ষার গান বলে কোমল সুরও বাজতে পারে, কিন্তু হাহাকারের বিস্তৃতি বোঝাবার জন্য যে সুর প্রলম্বন, তা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যায়। প্রধানত নিচু ও কোমল সুর ব্যবহার করে –
হা    ০০    য়    পথ।    বা    ০০    সী    ০।    হা    ০০    য়    গতি।    হী    ০০০     ন০।
হা    ০    য়    গৃহ।    –
(এভাবে লম্বিত হতে হতে শেষের ‘হারা’ শব্দটি শ্রোতার কানে অনেকক্ষণ ধরে ধ্বনিত হতে থাকে – হা০০০-০০-০০। ০০০-০০-০০০। ০০-০০ রা০। এই কম্পিত ও লম্বিত সুরধ্বনির রেশ যেন ফুরোতেই চায় না।) যেহেতু বায়ু হা-হা স্বরে অসীম প্রান্তরে কাউকে ডাকছে, সেহেতু অর্থাৎ ‘ডাক’ শব্দটি থাকার জন্য ও বায়ুর হা হা স্বর বোঝাবার জন্য আবার সেই সুরের প্রলম্বন রীতি –
ফি রে বা ০ ০। য়ু ০ ০ ০। হা ০ ০ ০ ।
হা ০ ০ ০ ০। স্ব ০ ০ ০ ০ ০। রে ০ ০ ০ ০।
ডা ০ ০ ০ ০ । ০ ০ ০  কে  ০।
আঁধার রাতের বায়ুতাড়িত পরিবেশে একাকী পথিকের হাহাকারের রূপকল্পটি সুরের মাধ্যমে অন্য কোনো মাত্রাযোজিত হয়ে আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, নাকি, চিত্রটি হারিয়ে গিয়ে পথিকের বিমূর্ত হাহাকারের অনুভূতিটি শ্রোতার কানে এবং অন্তরে লম্বিত হয়ে লেগেই থাকলো, মালার্মের রীতিতে? রবীন্দ্রনাথ মালার্মের মতামত জানলেও সম্ভবত পছন্দ করতেন না, বিশেষ করে 888sport app download apkর ক্ষেত্রে। তবু, রবীন্দ্রনাথের মনে আমাদের প্রাচ্য শাস্ত্রীয় সংগীতের বিমূর্ততার বোধই কি রূপকল্পকে বিমূর্ত করে দিতে চাচ্ছে? এই জন্যই কি রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ একজন আমার কাছে ‘ভাবকল্পে’র কথা বলেছিলেন? বোঝা কঠিন। কিছুক্ষণের জন্য সুর বিমূর্তবাদকে প্রশ্রয় দিলেও, আমার মনে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত রূপকল্পটিতেই আরো অধিকমাত্রা সংযোজিত হলো।
‘কাছে ছিলে দূরে গেলে’ গানটিতে আমার বক্তব্যই প্রাধান্য পাবে। প্রতিটি শব্দকে তিনি এমনভাবে লম্বিত করেছেন যা গৃহহারা বা হাহা স্বরের মতো খুব বেশি লম্বিত হয় না, অথচ চলে যাওয়ার দোলাটি বর্তমান থাকে। সুতরাং চলে যাওয়ার রূপকল্পটিই আরো সুন্দর হয়ে ওঠে।
এ-প্রসঙ্গে ‘এ পরবাসে রবে কে হায়’ গানটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পরবাস মানেই তো অনেক দূরে থাকা। (888sport app download apkয় গানটির যে-রূপকল্প ফুটে ওঠে তা আগেই আলোচিত হয়েছে।) সেখানে যে-ব্যক্তি শোকে-সন্তাপে-সংশয়ে-হতাশায় একাকী প্রান্তরে আত্মীয়-বন্ধুহীন অবস্থায় অবস্থান করছে, তার দূরত্ব, হতাশা এবং একাকিত্বকে বর্ণনা করতে উচ্চ-সুরস্থান, বিস্তার ও প্রলম্বনের ওপর আস্থা এত স্বাভাবিক ও সুন্দর হয়ে ওঠে যে, গানটি প্রকৃতপক্ষে শ্রোতাকে সেই ব্যক্তির সন্তাপ-সংকট-হতাশার অনুভূতির মধ্যে প্রবেশ করতে বাধ্য করে। এই অনুভূতির প্রাবল্যে বর্তমান নিবেদকের এমনই মনে হয় যে, গানটির শব্দগুলির বা ছন্দের (তা সে দলবৃত্তই হোক বা যা-ই হোক) আর কোনো মূল্য নেই। বলা বাহুল্য এই অনুভূতিও আনন্দদায়ক। শ্রোতার ‘ক্যাথারসিস’ সম্পাদন করে? এই গানটির ক্ষেত্রে আমরা একেবারে স্থায়ীভাবে না হলেও, অন্তত দীর্ঘস্থায়ীভাবে মালার্মীয় বিমূর্ততাকে হোক বা প্রাচ্য শাস্ত্রীয় সংগীতের বিমূর্ততাকেই হোক, অনুভব করতে পারি।
চড়া ‘র্সা’ কোমল ‘নি’, ধা ইত্যাদি উচ্চসুরের ওপর দাঁড়িয়ে ও কম্পিত স্বরে ‘এ’ শব্দটি আর্তচিৎকারের মতো উচ্চারিত হলো এবং অল্প কিছুক্ষণ দীর্ঘায়িত হয়ে কোমল ‘নি ধা পা’তে চট করে ‘পর’ শব্দটি বেজে উঠলো। আর তারপরই ‘প’ ধ্বনিটি আরো কিছুক্ষণ মূলত কোমল গান্ধারের ওপর কম্পিত ও প্রলম্বিত হয়ে চললো। উচ্চ-সুরস্থানের ও নিু-কোমল সুরের এই কম্পিত দীর্ঘ প্রলম্বন এইভাবে সুরকে ভাসিয়ে দিয়ে রোদন ধ্বনির মতো শেষ পর্যন্ত শ্রোতার চিত্তবিস্তারে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে রইলো। এও শোনা যায় যে, শোরি মিঞার ‘ও মিঞা বেজানেওয়ালে’ নামক টপ্পা গানটির সুরের ওপর কথা বসিয়েই নাকি রবীন্দ্রনাথ এই গানটি রচনা করেছিলেন। সেজন্যেই গানটিতে সুরের প্রাধান্য। তা যদি হয়, তাহলে আমার উপরোক্ত ভাবনার পক্ষে সওয়ালটাই জোরদার হয়। কিন্তু এরকমভাবে অনেক সুরকে মনে রেখে এবং বহু বিদেশি সুরকে অবলম্বন করে তিনি প্রচুর গান রচনা করেছিলেন, যেসব গানে যদি শব্দ ও সুর দুই-ই প্রধান বা এই দুটোর মধ্যেই পেন্ডুলামের মতো শ্রোতার চিত্ত দুলতে থাকে, তাহলে? সংগীতজ্ঞ না হয়েও, যতদূর জানতে পেরেছি, শোরি মিঞার এই পাঞ্জাবি টপ্পাটি অনেকটা পাঞ্জাবি ঢঙের পুরুষালি (masculine) তানপ্রধান গান, দ্রুত লয়ে গাওয়া। কিন্তু ‘এ পরবাসে’ গানটি, আমার ধারণামতো, ঢিমে মধ্য লয়ে গাওয়া হয়। সুতরাং শোরি মিঞার টপ্পার সুরকে যদি রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেই থাকেন, তাহলে তাল নয়, গাইবার ভঙ্গি, সবকিছুকেই অনেকাংশে পরিবর্তিত করে নিলেন তিনি। হয়তো, সেজন্যে সুরের ব্যাপারটাতেই তাঁকে বেশি নজর দিতে হয়েছিল। তাহলেও গানটির শব্দগত রূপকল্পের ছবিটি কিছুতেই একেবারে হারিয়ে যায় না, বরং মাঝে মাঝে ওই সুরসংযোগের জন্যই আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এতদসত্ত্বেও নিবেদকের ধারণা, একটা বিমূর্ত অনুভূতি শ্রোতার চিত্তে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায় গানটি শোনার পর। আমার এ-ধরনের মতামত একেবারেই গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে, তবু সুরের মাধ্যমে রূপকল্প বিচারের পদ্ধতিটি নিশ্চয়ই গ্রহণযোগ্য।