শওকত আলীর দক্ষিণায়নের দিন

সময় বিমূর্ত, প্রবহমান। বিমূর্ত সময়ের বস্ত্তগত চেহারা প্রতিবিম্বিত হয় কেবল ব্যক্তিমানুষের ভেতর দিয়েই। ব্যক্তির ওপর দিয়েই সময় বয়ে যায়। অনুকূল বা প্রতিকূল সবরকম পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করে ব্যক্তিমানুষ জীবনযাপন করে। সময়ে, চাপে বা তাপে ব্যক্তিমানুষের ক্ষয়, বিকাশ বা বিনাশ ঘটে। সময়ের প্রবহমানতায় ব্যক্তির বিশ্বাস, মূল্যবোধ, চিমত্মা-চেতনারও রূপান্তর হয়। ব্যক্তির বদলে যাওয়া এই স্বরূপের মধ্যে আমরা সময়ের বস্ত্তগত চেহারার বিচিত্র মুখশ্রী অবলোকন করতে পারি। ষাটের দশকে, বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত মানসের আর্থ-সামাজিক, রাজনীতির স্বপ্নময় আকাঙক্ষা ও আশাভঙ্গের বেদনা, যাতনা নিয়ে রচিত হয়েছে শওকত আলীর সুবৃহৎ 888sport alternative linkত্রয়ী বা ট্রিলজি – দক্ষিণায়নের দিন (১৯৮৫), কুলায় কালস্রোত (১৯৮৬) এবং পূর্বরাত্রি পূর্বদিন (১৯৮৬)। শওকত আলীর 888sport live chatসত্তার মৌলিক প্রবণতা হচ্ছে ইতিহাস ও সময়নিষ্ঠতা। সময়ের প্রবহমান অভিঘাতে ব্যক্তিমানুষ কীভাবে পর্যুদসত্ম হয়, সমাজ ও রাজনীতির দ্বন্দ্বময় সংঘাতে অসিত্মত্ব-সংকটে পড়ে তার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে শওকত আলীর 888sport alternative linkত্রয়ী বা ট্রিলজিতে। A trilogy is a series of three connected literary works, may it be fiction, drama or any other branch of creative arts। অর্থাৎ ট্রিলজি (trilogy) বলতে এমন একটি সৃষ্টিশীল 888sport live footballকর্মকে বোঝায়, যার মধ্যে আখ্যানগত পারস্পরিক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। হতে পারে তা 888sport alternative link (fiction), নাটক (drama) বা অন্য 888sport live footballাঙ্গিক। ট্রিলজি বলতে তাই তিন খ– রচিত ধারাবাহিক কাহিনির বিশেষ ধরনের 888sport alternative link বোঝায়। ইংরেজি এবং রুশ 888sport live footballে ট্রিলজির প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। বাংলা 888sport live footballে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৪-১৯৫০) পথের পাঁচালী (১৯২৯), অপরাজিত (১৯৩১), কাজল; গোপাল হালদারের (১৯০২-৯৩) একদা (১৯৩৯), অন্যদিন (১৯৫০), আর একদিন (১৯৫১); আশাপূর্ণা দেবীর (১৯০৯-৯৫) প্রথম প্রতিশ্রম্নতি (১৯৬৪), সুবর্ণলতা (১৯৬৬), বকুল কথা (১৯৭৩) ইত্যাদি সার্থক ট্রিলজি রচনার উদাহরণ রয়েছে। ট্রিলজি রচনার একটা বিশেষ সুবিধা হচ্ছে, সময়ের বিসত্মৃত প্রেক্ষাপটকে ব্যক্তিমানুষের চরিত্রের ভেতর দিয়ে প্রতিমূর্তি দান করা যায়। সমাজ-সচেতন কথা888sport live chatী শওকত আলী তাঁর ট্রিলজি দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত, পূর্বরাত্রি পূর্বদিন 888sport alternative linkেও কাহিনি-বর্ণনায়, চরিত্র-সৃষ্টিতে রাজনৈতিক জীবনজিজ্ঞাসাকে সচেতনভাবে শৈল্পিক পরিচর্যা দিয়েছেন। সময় যেন এ-888sport alternative linkের অন্যতম চরিত্র। কু-লায়িত সময়ের অস্থির দ্বন্দ্বময় চালচিত্র বিনির্মাণে শওকত আলী যথেষ্ট যত্নশীল ও স্বতঃস্ফূর্ত। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো আত্মবিচ্ছিন্ন, আত্মীয়বিচ্ছিন্ন, সমাজের নির্ধারিত ছাঁচে খাপ-না-খাওয়া, বিচ্ছিন্নতা নিয়ে ক্ষয়িত, পর্যুদসত্ম, তবু তারা জীবনজিজ্ঞাসায় অসিত্মত্ববান, চলিষ্ণু।

ক. রাখী, এবার কী করবে?

এই এক নিদারুণ প্রশ্ন। কেবলই ঘুরেফিরে আসছে। আববা, বুবু, হাসান ভাই এরাও দু-একবার প্রশ্নটা তুলেছেন, কিন্তু ঐ প্রশ্ন পর্যন্ত – প্রসঙ্গটা আর বেশিদূর
এগোয়নি। কেমন করে এগোবে, উত্তরটা কারো জানা থাকলে তো। রাখী এবার নিজেকে শুধায়, রাখী কী করবি তুই এবার?

(দ. দি., পৃ ২৯)

খ. বন্ধ ঘরে চাপা আর্তনাদের মতো ওর গলা শোনা যেত, বিশ্বাস কাকে বলে? কেন বিশ্বাস করবো আমি, বলতে পারো? প্রতারণাকে সত্য বলে চালাবে শুধু বিশ্বাসের জোরে?

(কু. কা., পৃ ১৭৮)

এই ক্রমজিজ্ঞাসা ও জীবনার্থ সন্ধানের মূলে রয়েছে সময়ের অন্তর্গূঢ় ক্রিয়াশীলতা। ফলে, সময় এই 888sport alternative linkে মৌল নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। সময়ের স্বভাব ফুটে উঠেছে বিভিন্ন চরিত্রের প্রতিবিম্বনে।

শওকত আলীর 888sport live chatমানসের অপূর্ব সৃষ্টি প্রদোষে প্রাকৃতজন (১৯৮৪), দক্ষিণায়নের দিন (অখ-, ১৯৮৫-৮৬), ওয়ারিশ (১৯৮৯), উত্তরের খেপ (১৯৯১), দলিল (২০০০), নাঢ়াই (২০০৩) ইত্যাদি 888sport alternative linkে সময় ও ইতিহাসনিষ্ঠতার পরিচয় পাওয়া যায়।

শওকত আলীর জন্ম ১৯৩৬ সালে। অবিভক্ত বাংলার পশ্চিম দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি সপরিবারে চলে আসেন 888sport appsের দিনাজপুরে। তাঁর কৈশোর কেটেছে নিদারুণ দাঙ্গা ও উন্মূল যাতনায়। তিনি দেখেছেন, ভূমি থেকে বিতাড়িত মানুষের যন্ত্রণা এবং দেশভাগের মূলে রয়েছে রাজনীতি। দক্ষিণায়নের দিন 888sport alternative linkে সময়তাড়িত চরিত্রগুলোর জীবন তাই রাজনীতি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের মানসে যে ক্রমমুক্তির প্রত্যাশা, সেই চেতনাই তাঁকে রাজনীতি-সচেতন করে তোলে। বিশেষত, ষাটের দশকে বামপন্থী রাজনীতির যে স্বপ্নময় আকাঙক্ষা তরুণদের জাগ্রত করেছিল, তা বুর্জোয়া রাজনীতির কাছে অচিরেই মার খায়। তাছাড়া বামপন্থী রাজনীতি ধারার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও দ্বিধাবিভক্তিতে অজস্র মেধাবী তরুণের জীবনে নেমে আসে ব্যর্থতা, হতাশা এবং মৃত্যু। দক্ষিণায়নের দিন 888sport alternative linkে রাখীর ভাই মনি এবং সেজানের মৃত্যু সে দ্বন্দ্ব-দীর্ণ রাজনীতিরই ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত উদাহরণ। সেজানের অভিব্যক্তিতে তা উঠে আসে এভাবে :

ক. বইপড়া তত্ত্ব দিয়ে রাজনীতি হলে অধ্যাপকরা বড় রাজনীতিবিদ হতেন। তোমাদের কাছে এখন ব্রডবেস্ড্ ইউনিটির কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বুর্জোয়া পার্টিগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করে কাজ করার জন্য – তাতেই নাকি বিপস্নব হবে। এসব কথা ভাঁওতাবাজি ছাড়া কিছু নয়। কেননা বলা হচ্ছে যে, সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী বুর্জোয়াদের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে জাতীয় ধনতন্ত্রের বিকাশ হলে, দেশে 888sport live chatায়ন হবে এবং তখনই সম্ভব সুস্থ সবল শ্রমিকশ্রেণি গড়ে ওঠা এবং তাদের নেতৃত্বে হবে সমাজতান্ত্রিক বিপস্নব।

(দ. দি., পৃ ৯৫)

ছেলেবেলা থেকে রাজনীতির প্রতি সচেতন মনি। অনার্স ফাইনাল দেওয়ার আগেই চলে যায় আন্ডারগ্রাউন্ডে। হুলিয়া বাতিল হলে বের হয় এক বছর পর। পরের বার পরীক্ষার আগেই ধরা পড়ে গেল। জেলে কাটল দেড় বছর – মনি তারপর বেরিয়ে এসে হঠাৎ রাজনীতি ছেড়ে দেয়। ওই সময় কেমন যেন নিঃসঙ্গ আর একাকী হয়ে পড়েছিল মনি। বামপন্থী রাজনীতির অমত্মঃদ্বন্দ্বে জর্জরিত অসুস্থ মনি সারারাত ঘুমাত না। ওই সময় চোখ বন্ধ করে মনি প্রলাপের মতো বাবাকে প্রশ্ন করে – ‘আববা, বিশ্বাস কেমন করে জন্মায়? কেন আমি বিশ্বাস করতে পারি না?’

(দ. দি., পৃ ৩১)

এই অবিশ্বাস বা বিশ্বাস ভেঙে চূর্ণ হয়ে যাওয়া হতাশাই মনিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। আবেগপ্রবণ মনি জীবন এবং রাজনীতির মধ্যে সংগতি বিধান করতে না পেরে মৃত্যুকেই বরণ করে নেয়। সময়ের অভিঘাত ব্যক্তিকে এভাবে অজগরের মতো গিলে খায়। শওকত আলী রাজনীতি-আক্রান্ত মানুষের ক্ষয় এবং আত্মবিনাশকে এভাবে
888sport live chat-অভীপ্সায় তুলে ধরেন।

888sport alternative linkের শিরোনাম দক্ষিণায়নের দিন কথাটির মধ্যে ব্যাপক অর্থ-ব্যঞ্জনা রয়েছে। রাজনীতিতে বামধারার রাজনীতি দক্ষিণপন্থী হিসেবে পরিচিত। ষাটের দশকে 888sport appsের রাজনীতিতে এমন একটি স্রোত-আবর্ত তৈরি হয়েছিল যে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত ছাত্র-যুবকরা সমাজতান্ত্রিক বিপস্নবের স্বপ্নময় আকাঙক্ষা নিয়ে প্রবলভাবে মার্কসীয় সাম্যবাদী আদর্শের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল। দক্ষিণায়নের দিন শব্দটির মধ্যে রাজনীতির সেই ‘দক্ষিণায়নের’ তাৎপর্যসহ ইঙ্গিত রয়েছে। আভিধানিক অর্থে বিষুবরেখা থেকে সূর্যের দক্ষিণগতি (২১ জুন থেকে ২২ ডিসেম্বর) অর্থাৎ সূর্যের দক্ষিণ দিকে গমনকালকে বোঝায়।ট্রিলজির প্রথম খ- দক্ষিণায়নের দিনের ঘটনাকাল ওই সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন।

ঋতুবৈচিত্র্যের দিক থেকে দেখলে এই সময়টা ঝঞ্ঝামুখর, বর্ষাভাসা জোয়ারের পানিতে থইথই অবস্থা। প্রকৃতির বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে মানুষকে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। দক্ষিণায়নের দিন নামকরণের মধ্যে প্রকৃতির সেই ক্রামিত্মকালের প্রতীকী তাৎপর্য অভিব্যঞ্জিত হয়েছে। এছাড়া 888sport alternative linkের প্রধান চরিত্র রোকেয়া আহমেদ রাখীর ব্যক্তিগত জীবনের রিক্ততা, রাজনীতির ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ ষাটের দশক, রাষ্ট্রীয় স্বৈরশাসন, আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তাল বাংলার সে-সময়কার মধ্যবিত্ত মানসের সামগ্রিক জীবনের রূপান্বিত রূপক ফুটে উঠেছে দক্ষিণায়নের দিন নামকরণের মধ্যে। যেমন –

আকাশে ইতসত্মত মেঘ ছিল। দুপুরবেলা হঠাৎ মেঘের ডাক   শোনা গেল। রাখী হাঁটছিল, হঠাৎ দেখে, সামনে টুকরো কাগজ, ধুলো, খড়কুটো সব যেন কেউ শূন্যে উড়িয়ে দিয়েছে।

 

888sport alternative link শুরুর কয়েকটি বাক্যে ‘আকাশে মেঘ’, ‘হঠাৎ মেঘের ডাক’, ‘খড়কুটো, কাগজ, শূন্যে উড়া’ এসবের মধ্যে রাখীর ব্যক্তিগত জীবন এবং ষাটের দশকের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ রাজনীতির সমূহ পরিস্থিতির আভাস পাওয়া যায়।

888sport alternative linkের কাহিনি : দক্ষিণায়নের দিন

দক্ষিণায়নের দিন 888sport alternative linkের মূল কাহিনি আবর্তিত হয়েছে রোকেয়া আহমেদ রাখীকে কেন্দ্র করে। তাকে ঘিরেই অন্য চরিত্রগুলোর বিকাশ এবং বিলয় ঘটেছে। তার পিতা সরকারি চাকরিজীবী রাশেদ আহমেদ, বোন বিলকিস আহমেদ, বড়ভাই বাম রাজনৈতিক কর্মী মনি। পার্শ্বচরিত্র হিসেবে এসেছে মনির বন্ধু বাম রাজনৈতিক কর্মী সেজান আহমদ, বিলকিস আহমেদ বুলুর স্বামী হাসান, ট্রাভেল এজেন্সির মালিক মাজহার, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পরবর্তী সময়ে রাখীর স্বামী জামান, রাখীর বান্ধবী ডাক্তার সুমিতা, পারভীন, জাহানারা, দেবতোষ প্রমুখ চরিত্র 888sport alternative linkের ঘটনাপ্রবাহে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

ট্রিলজির প্রথম আখ্যানের ঘটনাপ্রবাহে দেখা যায়, রাখীর পিতা রাশেদ আহমেদের পারিবারিক জীবন। ষাটের দশকে, তৎকালীন সমাজবাসত্মবতায় একজন পিতা যে-মূল্যবোধকে ধারণ করে সুস্থ-সুন্দর জীবন আকাঙক্ষা করে, রাশেদ আহমেদ তার মূর্তপ্রতীক। ইতিবাচক মূল্যবোধকে ধারণা করে তিনি সময়ের যোগ্য প্রতিনিধি।

ক. সেই উনিশ শো পঁয়ত্রিশের রাশেদ আহমেদ, উনিশ বছরের তরুণ রাশেদ, সায়ীদাবাদ থেকে ফিরছিলেন বুকের ভেতর কষ্টের ভার নিয়ে। কাউকে বলার উপায় ছিল না। কোনো প্রতিকারের আশা ছিল না। প্রাচীন আভিজাত্য আর কঠিন শাসনের দেয়াল ভেদ করে বুকের কথা মুখ ফুটে বলবার ক্ষমতা কারুর ছিল না। হ্যাঁ, সেই উনিশ শো পঁয়তিরিশেও। বুদ্ধদেব বসুর ‘রজনী হলো উতলা’ লিখে ফেলেছেন, নজরুল যখন প্রেমের বন্দনা গান করছেন – তখনো বাঙালি মুসলমান ঝিমুচ্ছে।

888sport appর নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবন যাপন করতে এসেও তিনি প্রাচীন মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হননি। হায়দার, মীজানের ছেলেরা ঠিকাদারি করে গাড়ি-বাড়ি করে ফেলেছে। মীজান, হায়দার ছেলেদের সাফল্যের কথা গর্বের সঙ্গে বলে। রাশেদ সাহেব তার মনিকে সে-জায়গায় দেখতে চান না।

মনিকে একদিন দেখেছিলেন তোপখানার রাসত্মায় – বোধহয় ৬২-এর সেপ্টেম্বরে। মিছিলের সামনে, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে ছুঁড়ে শেস্নাগান দিচ্ছিল। শুকনো চুল বাতাসে উড়ছে,  ঘাড়ের কাছে শার্টে রক্তের দাগ – বোধহয় আহত কাউকে  রাসত্মা থেকে সরিয়েছিল কাউকে। রাশেদ সাহেব দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন।… মনির ওই রোদজ্বলা ধারালো মুখ। ওই মুখ তিনি ভুলতে পারবেন না। ওইরকম মুখ না হয়ে মনির মুখ হবে পালিশ করা, বিগলিত হাসিতে মাখামাখি, দুচোখে লোভের চটচটে আঠালো দৃষ্টি ল্যাপ্টানো – নাহ্ অসম্ভব।

সমাজ ও রাষ্ট্রের ইতিবাচক রূপান্তর ছিল রাশেদ সাহেবের কাম্য। কিন্তু জীবনের পর্বে পর্বে ঘটনা-দুর্ঘটনায় নিজের অজামেত্মই রাশেদ সাহেব যেন ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন। কলোনিশাসিত তৎকালীন পূর্ববাংলার মধ্যবিত্তের বিকাশ ছিল সিত্মমিত। ক্ষমতাকেন্দ্রিক, আপসকামী, পাকিসত্মানপন্থী, একটি শ্রেণি শর্টকাট পথে বড়লোক হওয়ার নেশায় ঠিকাদারি, উমেদারি, টোটক ব্যবসায় উন্মত্ত। বড় মেয়ের স্বামী হাসান যখন চাকরি ছেড়ে ব্যবসার কথা বলে, তখন রাশেদ সাহেব বলেন –

আসলে একটা ঠিকাদারী সোসাইটি গড়ে উঠেছে এদেশে। ব্যবসা, ইন্ডাস্ট্রি, চাকরি সর্বত্র ঐ ঠিকাদারী মনোভাব দেখা যাচ্ছে। শর্টকাট পথে বড় হবার পাগলামিতে পেয়ে বসেছে সবাইকে। চাকরি ছেড়ে দেওয়াটাকে যদি তুমি নিজের ক্যারিয়ারের জন্য ভালো মনে করো, তাহলে নিশ্চয় তুমি চাকরি ছেড়ে দেবে। তবে আমার কথা হলো, যা করবে, ভেবে-চিমেত্ম করবে।

ভবিষ্যৎ নিয়ে রাশেদ সাহেবের আশঙ্কা, সংশয়, হতাশার মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্তের উপায়হীন অসহায়ত্বের চেহারা ফুটে উঠেছে। পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলায় অভ্যসত্ম নন রাশেদ সাহেব। যদিও তিনি সমাজের সদর্থক রূপান্তর প্রত্যাশা করেন, তবু তার সংসারের ওপর বয়ে যাওয়া ঝড়ের অভিঘাতে রাশেদ সাহেব পর্যুদসত্ম। বড় ছেলে মনি রাজনীতি করতে গিয়ে নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে অন্যদের মেলাতে না পেরে অন্তর্দ্বন্দ্বে রক্তাক্ত হয়ে মারা যায়। বুলু তার স্বামী হাসানের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সন্দেহ, অবিশ্বাসের অন্তর্দ্বন্দ্বে পাগল হয়ে যায়। ছোট মেয়ে রাখীর বিয়ে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জামানের সঙ্গে। খুব অনাড়ম্বরভাবেই রাখীর বিয়ে সম্পন্ন হয়। রাখী স্বামীর ঘরে যাত্রার মধ্য দিয়ে ট্রিলজি 888sport alternative link দক্ষিণায়নের দিন প্রথম আখ্যানের কাহিনি শেষ হয়। রাশেদ সাহেবের পারিবারিক কাহিনি একসময় বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের তাবৎ পরিস্থিতি নিয়ে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়। সেখানে রাশেদ সাহেবের ছোট সমত্মান রোকেয়া আহমেদ রাখী হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় চরিত্র। রাখীর ব্যক্তিগত জীবন এবং সমাজ-পরিস্থিতির প্রবাহিত স্রোত অভিন্ন। আখ্যানটি শুরু হয়েছিল এভাবে –

আকাশে ইতসত্মত মেঘ ছিল। দুপুরবেলা হঠাৎ মেঘের ডাক শোনা গেল। রাখী হাঁটছিল… রাখীকে সামনের দিকেই পা চালাতে হল।

শেষ হয়েছে এভাবে –

না, ঠাট্টা নয় পারভীন, হাসানের গলার স্বর হঠাৎ কেমন বদলে যায়।

…আমার কেমন ভয় হয়, দ্যাখো  রাখী শেষ পর্যন্ত পসত্মাবে।

…শিউলি পাতায় শিশির ঝরার শব্দ হচ্ছে। রাখী, অস্ফুট ডাকল বুলুর মনের ভেতরে, রাখী শোন, তুই সুখী হোস, ভুল করিস না তুই।

এই ‘মেঘ’, মেঘের ‘ডাক’ দক্ষিণায়নের দিনের মেঘের ডাক। রাখীর পথচলা শুরু হয়েছিল এই মেঘডাকা দিনের ভেতর দিয়ে। শেষ হয় ‘শিশির ঝরার শব্দে’ এবং হাসানের আশঙ্কা ‘রাখী শেষ পর্যন্ত পসত্মাবে’র মধ্যে। রাখীর জীবন এবং প্রকৃতি সমান্তরালভাবে সংকেতায়িত হয়েছে। দক্ষিণায়নের দিন আখ্যানে উলিস্নখিত ঘটনাসমূহ মোট বিশটি পরিচ্ছদে বর্ণিত হয়েছে।

কুলায় কালস্রোত দ্বিতীয় পর্বের আখ্যানের শিরোনাম। ‘কুলায়’ শব্দের আভিধানিক অর্থ নীড়, পাখির বাসা, বাসস্থান। ‘কালস্রোত’ মানে বৈরী হাওয়া, কূলভাঙা স্রোত। আখ্যানভাগের ঘটনাংশের সঙ্গে কুলায় কালস্রোত নামকরণের সার্থকতা রয়েছে। কারণ, এ-পর্বে রাখী বিয়ের মাধ্যমে জামানের সঙ্গে যে-নীড়
বেঁধেছিল, তা অচিরেই ভেঙে যায়। জামানের স্বার্থপরতা, দেহসর্বস্ব ভোগলিপ্সা, এমনকি ক্যারিয়ারের জন্য সমত্মান নষ্ট করতেও যে দ্বিধা করে না, এমন বুর্জোয়া মানসিকতায় রাখীর দাম্পত্য জীবনে ফাটল দেখা দেয়। জামানের সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবন সুখের হয় না। জামানের অহেতুক সন্দেহবোধ রাখীকে আরো ক্ষতবিক্ষত করে। স্বপ্নময় আকাঙক্ষা নিয়ে নীড় বাঁধা রাখী নিজেকে গুটিয়ে নেয়। জামানের উপলব্ধিতেও তা স্পষ্ট হয় –

এক সময় তার মনে হয়েছে – রাখীকে সে পুরোপুরি পায়নি – কখনো রাখী নিজেকে দেয় না। নিজেকে সে আড়াল করে রাখে। শরীর ভেসে যায় ঠিকই, আবেগ উচ্ছ্বসিত হয় ঠিকই, কিন্তু সে তো রাখী নয় – রাখীর শরীর শুধু।

জামানের দেহসর্বস্ব সম্ভোগ, সমত্মানে অনীহা, নীতিহীন উন্নতির আকাঙক্ষা রাখীর চেতনালোকে এক অদৃশ্য ফাটল তৈরি করেছিল। ‘বুলু লক্ষ করে, রাখী আগের মতোই ধীর-শান্ত। বিয়ে হয়ে যাবার পর যে পরিবর্তন আসে মেয়েদের, রাখীর মধ্যে সে পরিবর্তন আসেনি? তার চিমত্মা হয়।’ হৃদয়বৃত্তির চেয়ে শারীরিক কামনা যেখানে প্রাধান্য পায়, সেটাই হয়ে ওঠে রাখীর যন্ত্রণার মূল উৎস।

রাতে বিছানায় স্বামীর সঙ্গে শোবার চরম মুহূর্তটিতে মনের

কোনো গর্ত থেকে যেন লাফিয়ে ওঠে ঘেন্নার সাপ।

শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, আত্মমর্যাদাশীল রাখীর ব্যক্তিগত ভূগোল চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। রাখীর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া মনোলোকের সঙ্গে ষাটের দশকে সমাজতান্ত্রিক বিপস্নবের সম্ভাবনায় স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়ার একটি প্রতীকী মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অমত্মঃবাসত্মবতা ও বহিঃবাসত্মবতার এই কৌশলী কাহিনি বিন্যাস কুলায় কালস্রোত 888sport alternative linkটিকে নতুন অর্থ-ব্যঞ্জনা দান করেছে।

রাখীর জীবনভাবনা 888sport promo codeর সহজাত চিমত্মার বিপরীত নয়। ধারণা ছিল, ‘মেয়েরা বড় হয়, লেখাপড়া শেখে, তাদের প্রেম হয়, শেষে ছেলেপুলে নিয়ে সংসার পাতে। জীবনের মোটামুটি চেহারা এই।  এ-রকমেরই একটা স্রোতের মতো জীবন বয়ে যায়। সবার জীবন এমনই।’ বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যে তার উপলব্ধি হয় ভিন্ন। একদিন পুরনো পিলের কৌটো ফেলে দিতে গিয়ে জামান দেখে কৌটোর তলায় তিন-চারটা পিল রয়ে গেছে। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকায় জামান। রাখী শান্ত স্বরে বলে, ‘ওসবের আর দরকার হবে না।’ জামানের চেহারা তখন ভয়ানক ক্ষুব্ধ। সে বলে –

স্কলারশিপের ব্যবস্থা প্রায় হয়ে এসেছে, কোথায় বিদেশে গিয়ে ডিগ্রি আনব, মাঝখান থেকে এই ফ্যাসাদ বেধে গেল।

রাখী তখনো আহত হয়নি। বরং জামানের দুঃখে কিছুটা বিচলিত হয়েছে। বান্ধবী সুমিতার কাছে গিয়ে অ্যাবরশনের কথা বলতেই, সুমি চোখ কপালে তুলে বলে – ‘তুই কি পাগল হয়েছিস? এখন বাচ্চা না হলে আর কখন হবে।’ শেষ পর্যন্ত রাখী বাচ্চা নষ্ট করার চিমত্মা বাদ দিয়েছে। জামানকে জানিয়ে দেয়, বাচ্চাটা তার হওয়া দরকার; কিন্তু জামান তা কোনোক্রমেই মেনে নিতে পারে না। দুর্ঘটনায় সিঁড়ি থেকে পড়ে রাখীর বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। নিজের উন্নতির পথে যে-স্বামী গর্ভজাত সমত্মানকে বাধা মনে করে, তার সঙ্গে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে শারীরিক বন্ধন টিকিয়ে রাখা হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। সমত্মান নষ্টের পর, হাসপাতালের বেডে যখন জামানকে ডাকার কথা বলে, তখন রাখী বলে ওঠে, ‘জামান, কোন জামান?’ রাখীর এই প্রত্যাখ্যানে ধর্মের আরোপিত বন্ধন শিথিল হয়ে যায়। প্রেম, বিশ্বাস, শরীর, ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে হয় রাখীকে। সমান্তরালভাবে দেখা যায়, ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিসত্মানের একাংশ পূর্ববাংলার জনজীবন ছিল দুঃসহ। শোষণ, নির্যাতন আর জবরদসিত্ম চলছিল সর্বত্র। ধর্মের সেই বন্ধনকে অস্বীকার করে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া বাঙালি জাতিসত্তা টিকিয়ে রাখা ছিল কঠিন। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতীকী চরিত্র হয়ে উঠেছে রাখী।

রাখীর জীবনকুলায় বয়ে যাওয়া স্রোতই কুলায় কালস্রোত নামকরণকে সার্থকতা দিয়েছে। জামানের ঘর ছেড়ে রাখী বাবার গৃহে প্রত্যাবর্তন করে, আর ফিরে যায়নি। পিতার গৃহে রাখীর রাতগুলো দীর্ঘ হয়ে ওঠে। ঘুম হয় না, 888sport sign up bonus কেবলই দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে আজকাল। বাবা, বুবু, মনিভাইয়ের কথা মনে পড়ে।

স্বামী জামানের কথাও মনে পড়ে, শেষে পড়ে নিজের নষ্ট হয়ে যাওয়া সমত্মানের কথা। নিঃসঙ্গ রাতে রাখী পাগলের মতো কাঁদে। আত্মযন্ত্রণায় দগ্ধ হয় রাখী। বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠে, কান্না পায়। মনি ভাই যেমন শেষ সময় বলত –

জীবন কাকে বলে আববা? এই কি জীবন?

এরকমই কি ঘটে থাকে সবার জীবনে?

নব্য ব্যবসায়ী, মুনাফালোভী স্বামীকে ঘরে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় ঘরের মেয়ে বিলকিস আহমেদ বুলু ঘর থেকে বের হয়। ব্যবসায়ী স্বামীর স্বার্থে বিভিন্নজনের কাছে নিজেকে বিলিয়ে অবশেষে মাদকাসক্ত হয়ে স্বামীকেও হারায়। স্বামী হাসানের সঙ্গে মামাত বোন পারভীনের সম্পর্ক জেনে বুলু হাসানকে জিজ্ঞাসা করেছিল – ‘আচ্ছা, পারভীন কি বেশি আরাম দেয় তোমাকে, বলো না গো!’ সমত্মান নেই, হওয়ার সম্ভাবনাও নেই, আবার স্বামীকেও ধরে রাখতে পারছে না, এরকম একটি ব্যর্থতা, হতাশা, অসিত্মত্ব-সংকটে পড়ে বুলু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। বুলুর ঠিকানা হয় পাবনা মানসিক হাসপাতালে এবং 888sport alternative linkের শেষে তার মর্মামিত্মক মৃত্যু হয়। জামানের ঘরে নার্গিসকে আবিষ্কার করার পর রাখী বলেছিল – ‘কেন এত অস্থির হচ্ছ, বলো তো? নার্গিসের সঙ্গে শুয়েছ বলে আমি রাগ করিনি, বিশ্বাস করো।’ উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত রুচির মেয়ে রাখী – জামান, হাসানদের এসব লাম্পট্য, স্খলন, পতন দেখে মোটেই বিচলিত হয় না। কারণ বুর্জোয়া, পুঁজিবাদী, লোলুপ-লুম্পেন চরিত্রের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে উন্মত্ত ভোগসর্বস্বতা। রাখী সেই বুর্জোয়া সমাজের ভোগের সামগ্রী হতে চায়নি। তাই সমসত্ম অচলায়তন ভেঙে, ধর্মের শৃঙ্খল চূর্ণ করে বেরিয়ে আসে। রাজনীতিতে ছয় দফা আন্দোলন তখন তুঙ্গে। পূর্ব পাকিসত্মানকে বিচ্ছিন্ন করে ‘888sport apps’ নাম দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগ তুলে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। আইয়ুব খান, মোনয়েম খানের এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে। হায়দার, হাসান, মাজহার প্রমুখ বুর্জোয়া শ্রেণির লোকের মনে তখন ভয়, আতঙ্ক।

পিতৃগৃহের একাকিত্ব, চরম নৈঃসঙ্গ্যে নিক্ষিপ্ত রাখীকে উদ্ধার করে বান্ধবী এবং ডাক্তার সুমিতা। একটা চাকরির দরখাসত্ম সামনে ধরে বলে, ‘নে সই কর একটা।’ একেবারে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারসুদ্ধ। 888sport app শহর ছেড়ে চলে যাবে এবার রাখী। তার শৈশব-কৈশোরের শহর, ক্ষতবিক্ষত হওয়া শহর, বিলাসী এই শহর ছেড়ে সে চলে যাবে। বিদায় নিল সে সবার কাছ থেকে। তবু বারবার মনে হচ্ছে, কার কাছ থেকে যেন তার বিদায় নেওয়া হয়নি। সুমিতা বলল, ‘করেছিস কী মুখপুড়ি, তোর বরকে জানাবি না?’ রাখী জামানের সঙ্গে দেখা করতে যায়; কিন্তু জামানের সঙ্গে তার দেখা হয় না। জামান তখন করাচি কি লাহোরে কনফারেন্সে। ঠাকুরগাঁওয়ে রাখী কলেজে চাকরি নিয়ে ট্রেনে যাত্রা করার মধ্য দিয়ে ট্রিলজির দ্বিতীয় পর্ব কুলায় কালস্রোতের কাহিনির সমাপ্তি ঘটে। রাখীকে ট্রেনে তুলে দিতে স্টেশনে এসে সুমিতা বলেছিল, ‘ফিরে আসতে চেষ্টা করিস।’ উত্তরে রাখী বলেছিল, ‘ফিরে আসব কোথায়?’ সুমিতা বলেছিল, ‘নিজের জায়গায়।’ ঠাকুরগাঁও মফস্বল শহরের কলেজে স্বল্পকালীন চাকরির তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে রাখী 888sport appয় ফিরে এসেছিল সেজানকে সঙ্গে নিয়ে। সেই জীবনকুলার স্রোতে ভাসা ভিন্ন এক রাখী।

ত্রয়ী 888sport alternative linkের তৃতীয় অর্থাৎ শেষ আখ্যানের নাম পূর্বরাত্রি পূর্বদিন। শৈশব, কৈশোরের শহর, বাবা, বড় বোন বুলু, ভাই মনি, তার ব্যর্থ সংসার, সবকিছু থেকে বিদায় নিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে এসে রাখী ঘুরে দাঁড়ায়।

কলেজের কাজে নিজেকে সহজে জড়িয়ে নেয় রাখী। প্রিন্সিপাল করিম সাহেব নিজের বাড়ির লাগোয়া একটা ছোট বাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বিধবা এক মহিলা পাওয়া গেল রান্নাবান্নার জন্য। থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে সে প্রায় নিশ্চিন্ত। লাইব্রেরির দায়িত্ব, অফিসের কাজ, ছাত্রীদের খেলাধুলা, পিকনিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান – সবকিছুতে রাখী স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে যায়। কিন্তু মফস্বলের নানা সংকীর্ণতা, স্বার্থান্বেষী মহলের তৎপরতা, কলেজের গভর্নিংবডির সভাপতি এসডিও নিজামউদ্দিনের লাম্পট্য ও অনৈতিক প্রসত্মাবে রাজি না হওয়ায় রাখী জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এ-সময় বাম রাজনৈতিক কর্মী সেজান রাখীর পাশে দাঁড়ায়। সেজান ওই অঞ্চলে হাসান নামে পরিচিত। হাসানরূপী সেজান, যে মনে করে –

এদেশে সত্যিকার অর্থে প্রলেতারিয়েত যদি কেউ থাকে তো সে হলো এদেশের কিষান – ওদের সংগঠিত যদি করা না যায়, ওরা যদি নেতৃত্বে এগিয়ে না আসে, তাহলে কোনো বিপস্নবী আন্দোলনই সফল হবে না।

বাম রাজনীতির অন্তদ্বর্নদ্ব ও বিভাজনের ফলে বুর্জোয়াদের সঙ্গে হাত মেলানোর পরিবর্তে আত্মত্যাগী যুবক সেজান গ্রামে গিয়ে। কৃষকদের সংগঠিত করার প্রয়াস চালায়। তাই রাজধানীকেন্দ্রিক বুর্জোয়াপন্থী রাজনীতিকে পরিত্যাগ করে চলে যায় ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামের অভ্যন্তরে। কিষান-মজুরদের সংগঠিত করে, তাদের অধিকার আদায়ের স্বপ্ন গর্জে ওঠে সেজানের কণ্ঠে।

রাখীর প্রতি সুতীব্র আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও রাখীর কাছে নিজেকে ধরা দেয়নি। সেজানের কাছে আত্মসুখের চেয়ে পরার্থে জীবন উৎসর্গ অনেক বড়। তাই ব্যক্তিক প্রেমের কাছে পরাজিত হয়ে আর দশজনের মতো সংসারী হওয়ার কথা সে ভাবতে পারে না। ত্যাগ, দেশপ্রেম, আদর্শ ছাড়া অন্য কিছু সেজান ভাবতে পারেনি। নিজের ভবিষ্যতের কথা চিমত্মা না করে, দেশ-জনগণের কথা ভেবে নিরলসভাবে কাজ করে গেছে। গ্রামে ঘুরে ঘুরে জটিল অসুখে আক্রান্ত হয়েছে। অসুস্থতাও তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।

শারীরিকভাবে অসুস্থ, বাম রাজনীতির বিপস্নবী চরিত্র সেজানকে সেবা-ভালোবাসার মধ্য দিয়ে রাখীর জীবনের গতিপথ বদলে যায়।  ঠাকুরগাঁওয়ের কলেজের চাকরি ছেড়ে সেজানকে নিয়ে 888sport appয় এসে সুমিতার বাসায় ওঠে রাখী। নিজের সঙ্গে নিজেই বোঝাপড়া করে। নতুন এক সিদ্ধামেত্ম পৌঁছায় সে। কোনো দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই, ভয় নেই। সেজানের কাছে আত্মনিবেদন করার আগে রাখী বলে –

দ্যাখো, তুমি আমার দিকে দ্যাখো। আমার দাঁড়াবার কোনো জায়গা নেই, আমার ভাই অহেতুক মরে গিয়েছে, আমার বোন পাগল হয়ে মরার দিন গুনছে, আববার মুখের দিকে তাকানো যায় না, আমার সমত্মান এসেও এলো না। দ্যাখো, তুমি আমাকে ভালো করে দ্যাখো।

সেজান রাখীকে বলছে, রাখী আমি জানি। আমি সব জানি। …আমার মনকে পায়ের তলায় মাড়িয়েছে সবাই, আমার শরীরকে কলঙ্কিত করেছে, আমার নামে অপবাদ দিয়েছে। বলো, আমি এই জীবন নিয়ে কী করব?

বাইরে বৃষ্টি আরো তুমুল হয়। সেজান রাখীকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। চুমু খায় কপালে, চোখে, মুখে, বুকের মাঝখানে। তারপর ওই সময় ওই উত্তাল মুহূর্তগুলোতে রাখীর মনের মতো শরীরও সকল দল মেলে দেয়। ফুলের মতো ফুটে রাখী সেজানের দুই হাতের মধ্যে।

সেজানের সমত্মান গর্ভে ধারণ করে রাখীর 888sport promo codeত্ব পূর্ণতা পায়। প্রকাশ্যে, সগৌরবে রাখী নিজের মাতৃত্বকে ঘোষণা দেয়। রাখীর শূন্য সত্তা পূর্ণ হয়ে ওঠে। জামানের সঙ্গে তার দৈহিক মিলন ছিল – বিয়ে সামাজিক শর্তাধীন। সেই মিলনের মধ্যে কেবল দৈহিক লীলাখেলা, হৃদয়বৃত্তির কোনো বিষয় ছিল না তাতে। কারণ 888sport promo code-পুরুষের জৈবিক মিলনের পরিণত ফল সমত্মান, জামান সমত্মান নিতে অনাগ্রহী ছিল; কিন্তু দৈহিক সুখভোগে ছিল ক্লামিত্মহীন। এমনকি নিজের ক্যারিয়ারের জন্য সমত্মানকে বাধা মনে করেছে। জামান, হাসান, মাজহারদের সমাজ মনুষ্যত্বহীন, বুর্জোয়া স্বার্থান্ধ, ভোগসর্বস্ব। ওই সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে রাখী, সেজানের প্রেমে, শর্তহীন, স্বার্থহীন ভিন্ন এক মানবিক বোধে উজ্জীবিত হয়। বান্ধবী সুমিতা রাখীর গর্ভের সমত্মানের পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুললে, রাখী তাই বলে –

সুমি, আমাকে তুই ওসব কি বোঝাস বল? আমার ছেলের  পরিচয় কি হবে জানিস না তুই। কী মনে করিস, আমি কিছু  লুকোব? নিজের রক্তের কাছে কিছু লুকোনো যায়? বিশ্বাসের কাছে কি ছলনা চলে? দেখিস, আমি যেমন এখন লুকোই না, তখনো লুকোব না। তোদের সংসারের নিয়মকানুন কী হল না  হল, তাতে আমার ভারী বয়ে গেল।

সেজানকে ভালোবাসা, স্বেচ্ছায় দৈহিক মিলন এবং সমত্মান ধারণের মধ্য দিয়ে প্রথাগত সমাজ ও ভোগবাদী বিমানবিক মানসিকতাকে চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে রাখী। ১৯৬৯ সালে, ঠিক এ-সময়ে, পাকিসত্মান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাঙালির চলমান আন্দোলন চূড়ান্ত বিস্ফোরণের মুখে। বাঙালির স্বাধিকার চেতনার মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। সেজান নিহত হয়। সমাজতান্ত্রিক বিপস্নবের প্রতীক চরিত্র সেজানের সমত্মান তখন রাখীর গর্ভে। সেই অনাগত সমত্মান আগামী বিপস্নবের মিছিলে শামিল হবে, এই দৃঢ়প্রত্যয় ধ্বনিত হয় রাখীর পেটের সমত্মানকে নিয়ে উচ্চারিত সংলাপে –

দ্যাখ, এখানে আমি হেঁটে ছিলাম –

তুইও হাঁটিস এখান দিয়ে, এখানে দাঁড়িয়ে আমি মিছিল দেখেছিলাম – তুইও দেখিস এখানে দাঁড়িয়ে, সেজানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল এখানে, এই গাছতলায় – এখানে তুইও দাঁড়াস, আর এই যে রাসত্মাটা, এই রাসত্মায় সেজান মিছিল নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল – তুইও এই রাসত্মা দিয়ে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাস্, হ্যাঁ রে, পারবি তো?

অনাগত সমত্মানকে সামনে রেখে রাখীর এই আত্মকথন, স্বপ্ন ও কল্পনার মধ্যে ঔপন্যাসিকের জীবনার্থ সন্ধানের চেতনা-বীজ পুষ্পিত হয়েছে। ত্রয়ী 888sport alternative linkের শেষ পর্ব পূর্বরাত্রি পূর্বদিনের আখ্যান মোট চোদ্দটি পরিচ্ছদে বর্ণিত হলেও কাহিনির এই পরিসমাপ্তি ব্যাপ্ত সময় এবং বৃহত্তর জীবনের কলস্বরকে ধারণ করেছে।

জীবনের কোনো অর্থ নেই। ঔপন্যাসিক সেই নিরর্থক জীবনকে অর্থময় করে তোলেন। নিরর্থক জীবনকে বস্ত্তময় স্থাপত্য দান করেন। শওকত আলী সেই মহান কথা888sport live chatী, যিনি একান্তভাবে ইতিহাস ও সময়নিষ্ঠ। ব্যক্তি-মানুষের যাপিত জীবন এবং সময়কে তিনি নতুন এক 888sport live chatমাত্রায় ব্যবহার করেছেন তাঁর দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত, পূর্বরাত্রি পূর্বদিন ত্রয়ী 888sport alternative linkে। এখানে ব্যক্তিসত্তা ও সমাজসত্তা প্রায় সমান্তরাল। রাশেদ সাহেব, মনি, বুলু, রাখী এবং হাসান, জামান, সেজান, মাজহার প্রমুখ চরিত্রের অন্তর্কথা যেমন উন্মোচিত হয়েছে, তেমনি সময় ও সমাজসত্তার মর্মমূলে প্রবাহিত চেতনা-বীজ দৃষ্টিকোণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রধানত বর্ণনাত্মক ভঙ্গি ব্যবহৃত হলেও কোথাও কোথাও বিশেস্নষণাত্মক পরিচর্যাও লক্ষ করা যায়। চরিত্র চিত্রণ, বাসত্মবোচিত সংলাপ ও পরিবর্তনমান সময়ের প্রেক্ষাপট নির্মাণের দক্ষতার কারণে কাহিনি সুনির্দিষ্ট পথে অগ্রসর হয়ে পরিণতি লাভ করেছে। ট্রিলজির তিনটি পর্বে পৃথক শিরোনাম থাকলেও বিষয় ও 888sport live chat-অন্বেষার দিক থেকে তা অভিন্ন। ষাটের দশকের সমাজ ও রাজনীতির সংকটদীর্ণ প্রেক্ষাপট শওকত আলীর হাতে রূপায়িত হয়েছে অসীম আকাঙক্ষার চিত্রকল্পে।