শঙ্খ ঘোষ : কিছুটা ব্যক্তিগত অনুষঙ্গে

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। মফস্বলের শহর থেকে সোজা রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে। কলাভবনে ছবি আঁকার পাঠ নিতে এসেছি। আমার কাছে এ একেবারে অন্যভুবন, বড় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে সময়। প্রথম বর্ষের পাঠশেষে কখন যে দ্বিতীয় ধাপে উঠে পড়েছি কে জানে! তাহলে আমরা একটু সিনিয়র, এবারে আরেক রকমের অপেক্ষা। নতুন ছেলেমেয়েরা ভর্তি হবে – এই ভেবে মনের মধ্যে প্রবল ছটফটানি। প্রতীক্ষার পর নতুনেরাও এলো। আর স্বাভাবিকভাবে তাদের মধ্যে একটি মেয়ে আমার হৃদয়কোণে রক্তচিহ্ন এঁকে দিলো, তার দোলায়িত দীর্ঘ বেণি আর আয়ত চোখের আকর্ষণে। কিন্তু শুধু যে দূর থেকে দেখা, বন্ধুত্ব দূরস্থান, কোনোরকম কথাই এগোতে চায় না। অবশেষে ঠিক করেছি পুজোর ছুটির ঠিক পূর্বমুহূর্তে ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠানের মায়াবী সন্ধ্যায় একটা উপহার দিয়ে কথা শুরু করতে হবে। কী বিশেষ উপহার দেওয়া যায় তাকে? কোথা থেকেই বা জোগাড় করি সেই অমূল্য রতন! তবে বই ছাড়া আর কিছুই যে হতে পারে না, সে-ব্যাপারে নিশ্চিত। কিন্তু সে-গ্রন্থবিপণি কোথায়? শান্তিনিকেতনের পুরনো পান্থশালায় ইন্দ্রদার ‘সুবর্ণরেখা’ তখনো উদ্বোধন হয়নি। অতঃপর বোলপুরের ‘বর্ণপরিচয়’ থেকে কিনেছি একটা 888sport app download apkর বই। ছিমছাম মলাটের ছোটখাটো বই। একগুচ্ছ 888sport app download apkয় সাজানো সে-বইয়ের নাম ভিখারি বানাও তুমি তো তেমন গৌরী নও। বলে দিতে হবে না, শঙ্খ ঘোষের কাব্যগ্রন্থ। তারিখের দিকে তাকিয়ে দেখি, প্রায় সদ্য প্রকাশিত। বইয়ের শিরোনামটাই আমাকে কিনতে বাধ্য করলে। বেশ তাৎপর্যময় নাম তো ভিখারী বানাও তুমি তো তেমন  গৌরী নও – প্রেমের উপহার হিসেবে একেবারে যথাযথ। মুচকি হেসে বইটা নিলাম। তখনো পর্যন্ত শঙ্খ ঘোষের 888sport app download apkর সঙ্গে আমার তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না (এখন হয়েছে তাও নয়)! তাঁর 888sport app download apkর আলগোছে কয়েকটা ছত্রের সঙ্গে পরিচয় ছিল মাত্র। তবে সেদিন দোকানের তাকে সাজানো বইয়ের মধ্যে বইয়ের শিরোনামের সঙ্গে প্রচ্ছদও আমাকে টেনেছিল। দ্রুত প্যাস্টেল-রেখায় তৈরি বইয়ের অপূর্ব মুখচ্ছবিটি পূর্ণেন্দু পত্রীর আঁকা।

যাই হোক, উপহার সংগ্রহের কাজ সারা। ভেতরের পাতায় প্রাপক আর প্রেরকের নাম লিখে একেবারে তৈরি হয়ে আছি। এখন সেই আলোকিত মুহূর্তের অপেক্ষা। কিন্তু এমন নিপুণ প্রস্তুতির পরেও বইটা আর তার হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। বিফলে গেল আমার সমস্ত হোমওয়ার্ক। গত কয়েক বছর ধরে ঠাঁইবদল করতে করতে সে আজো রয়ে গেছে আমার কাছে। বইয়ের তাকের কোনো ফাঁক-ফোকরে এখনো লুকিয়ে আছে সে-বই আমার ব্যর্থপ্রেমের চিহ্ন 888sport app download for android করে। ভাবি, তবে কি শুরু থেকেই শঙ্খদার 888sport app download apkর সঙ্গে আমার জীবনের কোনো ব্যর্থতা জড়িয়ে রইল? পরক্ষণে মনে হয়, ওই মেয়েটি কি সত্যিই আমাকে ভিখারি বানাতে পেরেছিল? না, হয়তো পারেনি। কেবল শঙ্খ ঘোষের 888sport app download apkর বইয়ের সঙ্গে মিশে রইল তার ছায়া-অবয়ব। আর নয়। এবারে, সেই কবির দিকে চোখ ফেরাই, যিনি আমার ভাবনাকে তীব্রভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যাবেন একদিন।

শঙ্খ ঘোষকে প্রথম দেখি সত্তরের দশকের শেষদিকে, ভিজিটিং ফেলো হিসেবে তিনি তখন অনেকদিন ছিলেন শান্তিনিকেতনে। কোনো একটা সভায় তাঁকে প্রথম দেখেছিলাম। পরে একাধিকবার দেখেছি রবীন্দ্রভবনের অলিন্দে, সেখানকার পড়ার টেবিলে, দোতলায় পুবের খোলা বারান্দায় দূরের উদাস চাহনিতে। আবার কখনো তাঁকে লাইব্রেরির সিঁড়ি দিয়ে ধীরপায়ে উঠতে দেখেছি। সর্বদা লক্ষ করেছি এক সতেজ টানটান ভঙ্গি। তাঁর শ্যামল ঋজু চেহারায়, শুভ্র ধুতিপাঞ্জাবি জড়ানো অবয়বের ভাস্কর্যসুলভ জ্যামিতিক ড্রেপারিতে কিংবা স্মিতহাসির সঙ্গে মিশে থাকা কী এক দৃঢ় প্রত্যয়ে। গভীর ক্ষুরধার ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তাঁর চারপাশে অলিখিত প্রাচীর গড়ে তোলেননি। আমাদের মতো অর্বাচীনের দল কাজে-অকাজে যে-কোনো সময়ে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, প্রশান্ত হাসির রেশ টেনে কথা শুরু করতে দেরি হয়নি একটুও। তবে আরো স্পষ্ট করে চিনলাম রবীন্দ্রভবনের অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি যখন আশির দশকের শেষে ফিরে এলেন। এই নতুন রকমের ফেরায় আমাদের মনে একটু আশঙ্কা দেখা দিলো। কবি শঙ্খ ঘোষকে দূর থেকে জানলেও অধ্যক্ষ শঙ্খ ঘোষ কেমন হবেন জানি না! কিন্তু খুব সহজে সবার সঙ্গে মিশে গেলেন, কাজ শুরু করে দিলেন কত অনায়াসে। নিয়মমাফিক কাজের বাইরে অন্যদিকেও তাঁর সমান উৎসাহ। আমাদের তরুণ বাহিনীকে দিলেন কিছু নতুন কাজের ভার। কিছুকাল বন্ধ হয়ে যাওয়া, শিবনারায়ণ রায়-প্রবর্তিত বিশেষ ‘আলোচনা সভা’কে আবার শুরু করলেন প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায়, উদয়নের ঘরে। প্রথমবারের আমন্ত্রণপত্রে জানালেন সেই 888sport live footballসভা প্রবর্তনায় শিবনারায়ণের ভূমিকা, হয়তো তেমন প্রয়োজন ছিল না – তবু। সেই অনুষ্ঠানের সর্বত্র তাঁর সজাগ দৃষ্টি, সেখানে যে সমস্ত আশ্রমবাসীর আমন্ত্রণ। কোনো খুঁত না ঘটে যেন। অথচ তিনি রয়েছেন সবার আড়ালে। সভার সূচনা থেকে শেষ পর্বে ধন্যবাদজ্ঞাপন, পরের সভার বিষয় ঘোষণার মতো গুরুতর কাজের ভারও আমাদের মতো বালখিল্যের ওপরে। সেই আলোচনা সভার কার্ড তৈরি, প্রতিটি খামের ওপর নাম লেখা ও আশ্রমের সবার বাড়িতে পৌঁছে দিতেও তৈরি আমাদের দল। এমনও হয়েছে, অন্যদের হাতে কাজ রয়েছে দেখে প্রতিটি আমন্ত্রণপত্রের খামের ওপর তিনি নিজেই প্রাপকের নাম লিখেছেন। ক্রমে শান্তিনিকেতনের প্রায় সমস্ত বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছে কবি শঙ্খ ঘোষের আকর্ষণীয় হাতের লেখার আমন্ত্রণ চিঠি। আজ মনে হয়, ‘রাজার চিঠি’র চেয়ে সে কি কোনো অংশে কম?

একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে চিনতে আরো কত যে সময় লেগে যায়! সেইটেই স্বাভাবিক। ততদিনে বুঝতে পেরেছি রবীন্দ্রভবন অধ্যক্ষের প্রশ্রয়টুকু সব নয়, সামান্য হলেও তাঁর ভাবনার স্তর যদি স্পর্শ করতেই না-পারি – তাহলে তাঁর সান্নিধ্যের অধিকার পুরোটাই মিথ্যে। তবে মাথা নিচু করে স্বীকার করি, তাঁর 888sport app download apkর নির্যাস আজো সেভাবে আমার নেওয়া হয়নি। পড়ার ঘরের তাকে সাজানো রয়েছে দোকান থেকে সংগ্রহ করা বা উপহার পাওয়া কিছু বই। সকালবেলার আলো, সুপুরিবনের সারি, দিনগুলি রাতগুলি থেকে বাবরের প্রার্থনা – এরা রয়েছে আমার আলমারির তাক আলো করে। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে নেশার মতো টানে যে-আশ্চর্য বই, তার নাম 888sport app download apkর মুহূর্ত, অবসেশনের মতো আকর্ষণ তার। যদিও আমার সমগ্র সত্তাকে অধিকার করে আছে অন্য এক গ্রন্থ, তার নাম নির্মাণ আর সৃষ্টি। এমন ভাবনাজাগানো বই আমার আর পড়া হয়নি। বলতে বাধা নেই, প্রথম প্রকাশের সময় আমি কলাভবনের ছাত্র, বইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে পারেনি। আমার শিক্ষক 888sport live chatী কে. জি. সুব্রহ্মণ্যন এর প্রচ্ছদ করেছিলেন, সেটাই তখন আমার আকর্ষণের প্রধান জায়গা। বাংলা গ্রন্থের মুখচ্ছবিতে সে-ছবি একেবারে ভিন্ন স্বাদ এনে দিয়েছিল। অদ্ভুত এক বাদামি-সবুজ বর্ণবিভায় মাখানো পটের গায়ে কালো পেপার-কাটের জ্যামিতিক আকারে কিছু ফ্লোরাল প্যাটার্ন। মাঝখানে ওভাল শেপের মধ্যে রামকিঙ্করের সেই বিতর্কিত রবীন্দ্রপ্রতিকৃতি। সবমিলে একটা চাপা বর্ণছায়ার মাঝে বইয়ের শিরোনাম ও লেখকের নামের অংশে বিদ্যুচ্চমকের মতো একঝলক শুভ্র আলোকরেখা। এই দরজাতেই থেমেছি, প্রচ্ছদের সেই পর্দা সরিয়ে বইয়ের অন্দরে প্রবেশ ঘটেছে অনেক পরে। আবার ভেতরে ঢুকেও গোড়ায় থামতে হয়েছে, হোঁচট খেয়েছি – আমার সীমাবদ্ধ রবীন্দ্রজ্ঞান পিছু টেনেছে। প্রথম অধ্যায় ‘আমি’ থেকে দ্রুত চোখ সরিয়েছি পরের পর্ব ‘ছবি’র দিকে। হয়তো এই শিরোনামের সঙ্গে আমার কলাভবনের পাঠচর্চার যে-যোগ, তাকে অবলম্বন করে চৌকাঠ পেরোনোর চেষ্টা চলেছে। অথচ ক্রমে এই বই-ই আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে দীর্ঘকাল। পড়তে গিয়ে তীব্র আন্দোলন ঘটেছে ভেতরে। বারবার আগের কোনো প্যারাগ্রাফের শেষে পুনরায় ফিরেছি পুরনো পাঠে। আমাদের বিশেষ পরিচিত রবীন্দ্রনাথের এক আত্মপ্রতিকৃতি ঘিরে এ-লেখার শুরু।

রবীন্দ্রনাথের কোনো চেনা ছবির মধ্যে এমনতর পথ পরিক্রমায় এর আগে কখনো ফিরেছি বলে মনে পরে না। ‘পত্রপুটে’র একটি 888sport app download apkর সঙ্গে লেখক যেভাবে রবীন্দ্রমুখের এই ছবিকে মিলিয়েছেন – তা অভাবনীয়!

শঙ্খ ঘোষের শব্দমালায় মনের মধ্যে আলৌকিক ইন্দ্রজাল রচিত হতে থাকে। কি এক অমোঘ টানে পাঠক আচ্ছন্নের মতো এগিয়ে চলে। ক্রমে সে এমন এক স্তরে পৌঁছায় যেখানে ভাবনার ঢেউগুলো পাঠকের মর্মস্থলে শুধু জোরালো অভিঘাত তৈরি করে না, চিন্তার অজস্র সূত্র উজিয়ে আরো নতুন প্রশ্নমালার সামনে ঠেলে দেয়। এ-অবস্থায় কোনোমতে পৃষ্ঠার মাঝে পেজ-মার্ক গুঁজে লেখা ছেড়ে উঠে যাওয়া চলে না। এটাই শঙ্খ ঘোষের বলার নিজস্ব ধরন। মনে হয়, কী আশ্চর্য, এভাবে তো ভেবে দেখিনি! পরক্ষণেই লেখক সেই উজিয়ে ওঠা প্রশ্নমালার বিপরীতে হেঁটে সম্ভাব্য উত্তরগুলো সাজিয়ে দিতে থাকেন। লেখার প্রবাহ এগিয়ে চলে, লেখকের ভাবনাজড়িত পাঠক নিভৃত স্বগতোক্তির মতো নিজের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। ভাবনার এই গ্রন্থিবন্ধন আর গ্রন্থিমোচনের পারস্পরিক টানাপড়েনে লেখার যে-প্রতিমা নির্মিত হয়, তা নেহায়েত দ্বিমাত্রিক নয়, ভাস্কর্যের ঘনতায় ভরা, তাকে একটা স্কাল্পচারের মতো চারদিকে ঘুরে দেখতে হয়। রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে নির্মাণ আর সৃষ্টির পাতায় পাতায় লেখক বুনে দিয়েছেন ভাবনার এমন অসংখ্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম  জাফরির কাজ। যেখানে বারংবার আমাদের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নতুন করে আলাপ হয়। ‘ছবি’র স্তবকে স্তবকেও এমন অজস্র বাঁক, চিন্তার বিচিত্র স্ফুলিঙ্গ। লেখার শুরু যে আত্মপ্রতিকৃতিকে ঘিরে, সে-ছবি রবীন্দ্রভারতীর সংগ্রহে রক্ষিত। কালো আর গাঢ় বাদামি রঙের আস্তরণে ঢালা ছবিটি সকলেরই চেনা, কিন্তু লেখার সঙ্গে মিলিয়ে পড়ার সময় আবার যেন নতুন করে তাকাতে হয় তার দিকে। রবীন্দ্রনাথের পঁচাত্তর বছর বয়সে আঁকা নিজের মুখাবয়বের সঙ্গে শঙ্খ ঘোষ যখন মিশিয়ে দেন ‘পত্রপুটে’র সেই ছত্র – ‘বিরহের কালো গুহা ক্ষুধিত গহ্বর থেকে/ ঢেলে দিয়েছে ক্ষুভিত সুরের ঝর্ণা রাত্রিদিন’ – তখন চমকে উঠতে হয়। ঘন কালির আস্তরণ মাখানো কবির মুখের ছবি দেখে লেখকের মনে হয় ‘কোনো কালো গুহার ক্ষুধিত গহ্বরের কথা, আগুনের হলকায় ওখানেও যেন নেমে আসছে কোনো ক্ষুভিত ঝর্ণাই।’ 888sport app download apkর বিস্তার লেখককে আরো কিছু বলে, যার একদিকে রয়েছে ‘রুদ্রমানবের আত্মপরিচয়’ আর অন্যদিকে ‘ক্ষীণ পাণ্ডুর আমি’ ইত্যাদি। এমনকি ‘বঞ্চিত জীবন’ আর ‘সার্থক’ শব্দ দুটির পাশাপাশি অবস্থানে ‘বৈপরীত্যের সামঞ্জস্য তৈরি করছিল’ বলেও মনে হয় লেখকের। এখন ছবি দেখতে গিয়ে আমাদের মনে হয় সত্যিই তো, ‘পত্রপুটে’র 888sport app download apkর সঙ্গে এই ছবিকে পাশাপাশি মিলিয়ে একবারও দেখা হয়নি। এই ভাবনা জাগানো লেখা কি তাহলে রবীন্দ্র-চিত্রকলার ক্ষেত্রেও এক নতুন পাঠ নিয়ে এলো? আর শুধুই কি ‘ছবি’? ‘চালচিত্র’ অধ্যায়ের দিকে এগোতে গিয়ে যেন টানটান হয়ে ওঠে আমাদের মনের শিরদাঁড়া। কখনো অজান্তে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধেই মনটা বেঁকে বসতে চায়। তবে আবারো লেখক যেন ঝাঁকিয়ে দেন পাঠকের মন, মুহূর্তে শুধরে দিয়ে যান একমুখী চিন্তার স্রোতের বিপরীতে। এইভাবেই আশ্চর্য পুরু কার্পেটের মতো পরতে পরতে বোনা হয়েছে নির্মাণ আর সৃষ্টির সমস্ত লেখা, অজস্র পলেস্তারা, অসংখ্য বুনটে গাঁথা।

আর ব্যক্তিগত শঙ্খ ঘোষ, যিনি কবি আর অধ্যক্ষের মার্কা দেওয়া চাঁদোয়ার তলায় দাঁড়িয়ে নেই? কেমন সেই মানুষটা? একটু লক্ষ করে দেখি। রবীন্দ্রভবনের ভার নেবার পরে শান্তিনিকেতনে তাঁর নতুন আবাস পূর্বপল্লীর একেবারে শেষপ্রান্তে, উপাচার্য মশাইয়ের উঁচু পাঁচিলঘেরা বাড়ির উলটোদিকে। পেছনে খোয়াইয়ের গভীর দিয়ে চলেছে রেললাইন, অদূরে প্রান্তিক স্টেশন। সামনে উন্মুক্ত বাগান আর গাছপালায় ছাওয়া সেই বাড়িতে রোজকার জীবনের আয়োজন অত্যন্ত সাদামাটা, ছিমছাম। বসার ঘরে অতিথিদের জন্য এদিকে রাখা বিশ্বভারতীর কিছু সিম্পল আসবাব, কয়েকটা বেতের সোফা আর তার মাঝে চায়ের টেবিল। কিছুটা দূরে দেয়ালের ওপাশে রয়েছে খাবার জায়গা। খাবার টেবিলের আবরণে কোনো রকম শৌখিন নকশাদারি নেই, টেবিলে বিছানো এক অতিসাধারণ একরঙা প্লেইন টেবিল-ক্লথ। শান্তিনিকেতনে তিনি এসেছেন একা, প্রতিমাদি ছুটিতে মাঝে মাঝে আসেন। এদিকে কবির দুয়ারে অতিথির বিরাম নেই, সময়বোধের চূড়ান্ত অভাব থাকলেও সৌজন্যতার বশে তাদের উঠতে বলা যায় না। ফলে অধিকাংশ দিনের শুরুতে সকালবেলা তিনি অভুক্ত অবস্থায় নির্ধারিত সময়ে ভবনে চলে আসেন। এখানেও দশটার মধ্যে পৌঁছোবেন, অন্যথায় ভবনের কর্মীরা কী মনে করবে? অবশ্য এ-ভাবনা তাঁর নিজের! দফতরে এসে আবার কাজের মধ্যে। এ যেন প্রতিদিনকার রুটিনের মতো তাঁর অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে পড়ে, তিনি আসার পর বাইশে শ্রাবণের প্রদর্শনী ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’। কীভাবে হবে তার সমস্ত পরিকল্পনা তিনি ছকে নিয়েছেন, কোন কোন লেখা যাবে, দেওয়া হবে কোন চিঠি বা 888sport app download apkর টুকরো ইত্যাদি সব তিনি বলে দেবেন। তারপর সেগুলো আমাকে একটু বড় হরফে লিখে ফটোগ্রাফের পাশাপাশি বিভিন্ন পর্ববিন্যাসের সঙ্গে সাজিয়ে নিতে হবে। এটা আমার কাছে নতুন নয়, আগেও বহুবার করেছি, আমার কাজের একটা অংশ। তবে সাধারণত বিষয় নির্বাচন যিনি করেন, তিনি বইতে পেনসিলের দাগ দিয়ে বা সেই সেই পৃষ্ঠার জেরক্সের গোছা আমার হাতে ধরিয়ে দেন। আমার কাজ সমগ্র বিষয়টিকে দর্শকের সামনে মেলে ধরা, অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমি একজন ভিজুয়ালাইজার।

 সেদিন সকালে প্রথমদিকেই শঙ্খদা আমাকে ডেকে পাঠালেন। হাতে দিলেন প্রদর্শনীর টেক্সট, এমনটা আগেই অনুমান করেছিলাম। কিন্তু এ কী, এখানে কোথাও এক চিলতে জেরক্সের পাতা নেই, সমগ্র প্রদর্শনীর সম্পূর্ণ টেক্সট সাদা কাগজের পাতায় তিনি নিজের হাতে লিখেছেন। বড় বড় চিঠির টুকরো, 888sport app download apk, গদ্যাংশ সমস্তটা মিলে সে যে এক ক্লিপগ্রন্থিত বড়সড় কাগজের গোছা। বিস্তৃত সেই লেখা তাঁর আগামী বইয়ের এক পাণ্ডুলিপি যেন! রাত জেগে লিখে এনেছেন আমার জন্যে – পাছে আমার কাজে কোনোরকম তাড়াহুড়ো বাধে! আমি যত না বিস্মিত তার চেয়েও বেশি আপ্লুত! একটা প্রদর্শনীর জন্য এতখানি নিষ্ঠা, ক্লান্ত শরীরের এতটা রাত্রি জাগরণের শ্রম? এমনটা আমি আর কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বলা বাহুল্য সেবারের প্রদর্শনী রবীন্দ্রভবনের এক অন্যতম কাজ হয়ে উঠেছিল। মনে ভাবি, তাঁর হাতের লেখার সেই গুচ্ছ কেন আলাদা করে সরিয়ে রাখিনি? সযত্নে ফাইলবন্দি করে রবীন্দ্রভবনের তাকেই রেখে দিয়েছিলাম। সে কি আজ আর খুঁজলে পাওয়া যাবে?

একেবারে ব্যক্তিগত কথা। দাদার ছেলের নামকরণের অনুষ্ঠান, আমি প্রবল অহংকারের সঙ্গে বাড়িতে ঘোষণা করেছি, নাম নিয়ে কাউকে কিচ্ছু ভাবতে হবে না, আমাদের নবাগতের নাম দেবেন শঙ্খদা। বাড়ির সবাই যুগপৎ বিস্মিত ও পুলকিত। এদিকে সে-নাম তো এসে পৌঁছোয় না, অথচ অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান আসন্ন। অবশেষে আর একবার দ্বিধার সঙ্গে তাঁকে মনে করিয়ে দিলাম। তারপরেই একখানা সাদা খামে উড়ে এলো তাঁর চিঠি – নামের জন্য ফরমাস এসে পৌঁছল। মাঝে মাঝে এ-রকম দাবি মেটাতে হয় বটে, কিন্তু এটাকে মনে হয় দুরূহতম কাজ। কেননা এসব বিষয়ে প্রতিটি ব্যক্তিরই এত সূক্ষ্ম রুচি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে যে সকলের পছন্দমতো নাম পাওয়া বেশ মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষত যদি সেটা পুরুষ নাম হয়।

তার ওপর আপনি আবার দাদাবৌদির নাম দুটিও জানিয়েছেন। ইঙ্গিত নিশ্চয় এই যে ওর সঙ্গে অল্পস্বল্প সংগতি যেন থাকে নতুন নামের। উদয়ন সুশোভন চার অক্ষর, দুয়েরই শেষে ন, মিতার আছে মি আর উদয়নের উ, সব মিলে চকিতে একটা নাম মনে এল ‘উন্মীলন’ – পছন্দ হয় তো বলে দিতে পারেন। পছন্দ না হলে বাতিল করতে দ্বিধা করবেন না। … সমস্যা হচ্ছে, এ-চিঠি কি সময়মতো পৌঁছবে আপনার হাতে? হ্যাঁ, শঙ্খ ঘোষ ঠিক এরকমই। বলা বাহুল্য, তাঁর পাঠানো সেই নাম আমাদের বাড়িতে পরম আদরে গৃহীত হয়েছে। এখন মনে হয়, দেশের একজন শ্রেষ্ঠ কবিকে কি অবলীলায় কি অনায়াসে আমাদের মধ্যে পেয়েছিলাম, কেবল তাই নয়, তাঁর কাছে কত অন্যায় আবদার করেছি – পেয়েছি কত অযাচিত প্রশ্রয়! বিষণ্নমনে আজ পড়ার ঘরের তাকে সাজানো তাঁর বইগুলো কেবল নেড়েচেড়ে দেখছি। কখনো-বা আমার কাছে আসা তাঁর চিঠির অমূল্য গুচ্ছ অন্যমনস্কভাবে এই খাম থেকে ওই প্যাকেটে বারবার গুছিয়ে রাখছি।