শব্দ-হরিণ

কিন্নর রায়
অন্ধচোখে জল, বালি, আকাশ – কোনো কিছুকেই আলাদা করে বোঝা যায় না। অথচ স্পর্শে জল অথবা বালি – সবটাই আলাদা করে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না দৃষ্টিহীনের। এমনকি যদি বৃষ্টিও নামে, সেই আকাশজল ছুঁতে-ছুঁতে কী এক অলীক শিহর, মাথায়, গায়ে, ঠোঁটে – সর্বত্র জলেরই ছিটে। স্বাদ।
বর্ধমান থেকে গো-গাড়িতে বীরভূম আসতে গেলে অজয় পেরোতে হয়। শীতের  নদ তেমন করে হাত-পায়ে ছড়িয়ে নেই। অথচ বাতাসের শীতলতা জলের সঙ্গে মিলে গিয়ে কী এক আশ্চর্য মায়া তৈরি করে ফেলতে পারে। এই হিম ঋতুতে জলধারা এমনিতেই স্বভাব-ক্ষীণ। যদিও পৌষসংক্রান্তির ভোরে স্বয়ং মা গঙ্গা এসে নাকি লাগেন অজয়ের বুকে, এমনই কাহিনিকথা চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। ফলে পৌষ মাসের শেষ দিনে অন্য-অন্য দিনের তুলনায় অজয় বেশ খানিকটা জলময়।
আকাশের ছায়া জলে ভেঙে পড়লে তার রূপ স্বতন্ত্র। আর সূর্য যখন ভোর-ভোর স্বয়ং ঘুম ভেঙে গা মোড়ামুড়ি দিতে থাকে গগনপটে, তখন তার আলো সোনার পিলসুজ হয়ে তীরের বালিতে। মাঘ মাস শুরু হওয়ার ঠিক আগের দিনটিতে অজয়ের তীরে মহামেলা। সেখানে আউল, বাউল, সাঁই, দরবেশরা গান গায় – গুরুর নামে, মুর্শেদের সম্মানে। ফকির, বোষ্টম, ভিখিরি, সাধু – ভিড় করে তারাও। ভেকধারী সাধু, জোচ্চর, বদমাশ, ফেরেববাজ – তাদেরও ভিড় তো কিছু কম নয় মেলাতে।
পূর্ণমাধব এতসব সাত-সতেরো চোখে দেখতে না পারলেও বুঝতে পারে। এ সবকিছু অনুভব করতে-করতে তার মনে হতে থাকে, দুনিয়া বড় মজাদার খেলাধুলোর জায়গা। অজয় থেকে খানিকটা সরে এসে  সাদা বালির ওপর বিছানো বাবলা-কাঁটায় যে কালোকুলো রোগা লোকটা, একেবারে কিছুই গায়ে মাথায় না দিয়ে দিব্যি শুয়ে থাকে, তাকে গায়ে হাত দিয়ে-দিয়ে অনুভব করতে ইচ্ছে হয় পূর্ণমাধবের। লোকটা ঠিক কেমন? তার মাথায় কি জটা আছে? নাকি ফণাধর এলোমেলো চুল মাথাভর্তি? অথবা এসব কিছুই নয় আদতে, স্রেফ ন্যাড়া একজন, শূন্য চোখে তাকিয়ে আকাশের দিকে। অথবা তার দুচোখই বোজা, একদম বন্ধ।
এই লোক যে বালিতে বিছানো বাবলা-কাঁটার ওপর শোয়া, তা তাকে বলেছে বিষ্ণুকান্ত। পূর্ণমাধবের থেকে বেশ অনেকটা কম বয়েসি বিষ্ণুকান্ত এই মেলাতে, তার সঙ্গে-সঙ্গে। তিন রাতের মেলা কেন্দুবিল্বতে। লোকমুখে যা কেঁদুলী। কবি জয়দেব আর তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতী, তাঁদের 888sport app download for androidেই তো এই বাউল-সমাবেশ।
গরুগাড়িতে অজয় পেরোনোর সময় গাড়ির চাকা মাঝেমাঝেই ফেঁসে গেছে বালির বুকে। জল যেখানে প্রায় নেই, সেখান দিয়েই অভ্যাসে পারাপার সারে গাড়োয়ানেরা। এই পথ চেনা তাদের বহু বছর ধরে। শেষরাতে হালকা হালকা কুয়াশায় চারপাশ কেমন যেন অন্যরকম ছিল। হাত দিয়ে কুয়াশার অস্তিত্ব বুঝে নিতে পারে পূর্ণমাধব। যেমন অঙুল বাড়িয়ে-বাড়িয়ে জ্যোৎস্না ছুঁয়ে ফেলে জীবনের নানা কথা ভাবতে-ভাবতে নতুন করে অন্য কোনো চিন্তার ভেতর ঢুকে যায় পূর্ণমাধব।
কালবসন্তে দুচোখের মণিই গলে গেল।
অন্ধকার নেমে এলো সামনে। দৃষ্টিহীনতার বেড়াজালে আটকে পড়ল পূর্ণমাধব।
গো-গাড়িচালক সহদেব পূর্ণমাধবেরই বয়েসি। তার পেটানো স্বাস্থ্য। মাথায় ঝাঁকড়া বাবরি। পূর্ণমাধব সহদেবকে দেখে বিষ্ণুর চোখ দিয়ে। আবার বিষ্ণুকান্ত ঠিক কেমন দেখতে আসলে, তা জানতে পারে সহদেব বা এরকম কারও সঙ্গে কথা বলে। নিজেদের গোগাড়ি, নৌকো – সবই আছে পূর্ণমাধবদের। একটা নয়, একাধিক।
তাগড়া বলদ দুটোকে জোয়াল খুলে ঘাস-জলের ব্যবস্থা করবে সহদেব। শুধু ঘাস-জল বললে ভুল বলা হবে। খোল, চুনি, ভুসি – আসলে এদের যা খাদ্য-খাবার, তাই তো দিতে হবে পেটপুরে। এখন ভোর গড়িয়ে সকালের দিকে যাচ্ছে দিন।
পূর্ণ এর আগে কখনো কেন্দ্রবিল্বের বাউলমেলায় আসেনি। সহদেব এসেছে গাড়ি নিয়ে, বলদ ঠেঙিয়ে বধ্ধোমান থেকে এত ক্রোশ রাস্তা, সে তো দূরত্ব খুব কম নয়। তারপর পথে কোথাও-কোথাও ডাকাতের ভয় আছে। কোম্পানির রাজত্বে সেই ভয় সবটা দূর হলো কোথায়?
সহদেব লাঠি খেলতে পারে খুব ভালো। সড়কি, বল্লম, বর্শা বিষয়েও তার অগাধ জ্ঞান। সহদেবের হাতে ঘুরতে থাকা তেল-জল খাওয়া পাকা বাঁশের লাঠির হাওয়া কাটার শব্দ পেতে-পেতে পূর্ণমাধব বুঝতে পারে ঠিক কতটা জোরে সহদেবের হাতের লাঠিটি ঘুরছে।
শীত-ছোঁয়া হাওয়ায় জিলিপি ভাজার গন্ধ মিশে আছে।
বিষ্ণু বলছে, পাকা কলারা এসেছে মেলায়। মাটির ঢিবি করে, ঠিক ঢিবি বললে ভুল বলা হবে, কাদার প্রলেপ দিয়ে রাখা হয়েছে আধপাকা কলার কাঁদিদের, যাতে তারা দ্রুত পেকে ওঠে, সেই জন্য।
বিষ্ণুকান্ত পূর্ণমাধবের গা ঘেঁষে হাঁটতে-হাঁটতে-হাঁটতে যেসব কথা বলে যেতে থাকে, তা শুনতে-শুনতে পূর্ণর  কখনো কখনো মনে হয় মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্রের বিবরণী শোনাচ্ছে সঞ্জয়। অথচ এই যে প্রাচীন কেন্দুবিল্ব জনপদ, তার গা-লাগোয়া অজয়, পৌষ মাসের এক বিশেষ দিনে তার হঠাৎ বেড়ে ওঠা সব মিলিয়ে নানা ধরনের আলো, রং, গন্ধ – সবকিছুকে একসঙ্গে মিলিয়ে-জুলিয়ে নতুন কিছু একটা বানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা পূর্ণমাধবের।
আসলে আলোর ভেতর লুকিয়ে থাকা অন্য এক আলোবাহার, রঙের মধ্যে জেগে থাকা অন্যতর কোনো রং, গন্ধের গভীরে থেকে যাওয়া আরো কোনো ঘ্রাণ – সবকিছু কেমন যেন উতরোল করে দিতে থাকে পূর্ণমাধবকে। তার ভেতর থেকে দশ আঙুলে খুঁড়ে-খুঁড়ে কত কী বের করে আনে পূর্ণ।
সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার চরাচর ঢেকে দিলে কখনো কখনো নিশিলাগা মনে মঞ্জীর ঘরে মঞ্জীরই খোলা পিঠের ওপর জোনাকিদের নাচ,  একটি, দুটি, তিনটি, চারটি – গুনতে-গুনতে আরো অনেক বেশি, যেন কোনো প্রস্তরবেদিতে প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছে কেউ। সেই লক্ষদীপের আলোয়, তাপে অন্ধকার তো কাটেই। সেই সঙ্গে চলকে ওঠে জীবনতরঙ্গ।
খুব বড়-বড় মিষ্টি তৈরি হয় এখানে। নাকি হয় না! বিষ্ণুকান্ত কী যে বলে, আর কী যে বলে না – সবটা মন দিয়ে ধরে ফেলতে চায় না পূর্ণমাধব। সে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে একটা চালু, নয়তো স্থির দৃশ্যপট, রঙের নানা কারুকাজ সাজিয়ে নিতে থাকে ভেতরে-ভেতরে।
কী মিষ্টি তৈরি হচ্ছে বড়-বড় লোহার কড়াইয়ে? বালুসাই, গজা, বোঁদে? মোটা রসের মাল থাকবে অনেক দিন। সেইসব ঘন রসের মিষ্টি পেতলের মাজা, চকচকে পরাতে সাজিয়ে রাখলে বোলতারা এসে হাজির হয়, পাশাপাশি মৌমাছিরাও। এইসব ছবি পরপর সাজিয়ে নিতে থাকে পূর্ণমাধব। বিষ্ণুকান্তর চোখ দিয়ে অন্ধ কবি দেখে মাটি ল্যাপা আধপাকা কাঁঠালি কলার কাঁদির ওপর শীতের রোদ্দুর বেড়াল ছানা হয়ে লাফিয়ে পড়েছে। সেই সূর্যসম্ভারের ভেতর ঢুকে পড়েছে আরো একটা রোদ। আর তাদের সঙ্গে তাল রেখে বা না রেখে একটি, দুটি, তিনটি নয়তো চারটি প্রজাপতি নিজেদের ডানা কেরদানি দেখাতে-দেখাতে মিশে যেতে চাইছে রোদের সঙ্গে।
কাল সারারাত বাউল গান হয়েছে। আউল, সাঁই, দরবেশদের একতারা, দোতারা আর গুপিযন্ত্রে মুগ্ধ হয়ে থেকেছে কেন্দুবিল্বর আকাশ। জয়দেব পদ্মাবতীর পোড়ামাটির কাজঘেরা মন্দিরে ভোরে প্রথম আলো অজয়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই গড়িয়ে-গড়িয়ে লেগে গেছে।
‘দেহী পদপল্লব মুদারম’ – গীতগোবিন্দের এই আশ্চর্য পঙ্ক্তিটি পদকর্তা পূর্ণমাধবের মাথার ভেতর বসে যাচ্ছে পেরেক-ঠোকা হয়ে। মাঠে-মাঠে ধান কেটে নেওয়া খড়েদের ধারালো গোড়া যেমন করে জেগে আছে এই শেষ পৌষে, তেমন করেই মনের ভেতর যেন লক্ষ-কোটি জিজ্ঞাসা হইহই হাততালি দিতে-দিতে চলে আসতে চায় সামনে। কে, কে লিখল, অথবা লিখে দিয়ে গেল এমন পদটি? কে লিখল? কাব্যের আত্মাকে ছুঁয়ে ফেলল পদকর্তা কেমন করে?
এপারে দাঁড়ালে ওপারে শ্যামারূপার গড়-ইছাই ঘোষের ভাঙাচোরা দেউলে যাওয়ার অস্পষ্ট রাস্তা নাকি চোখে পড়ে। বড়যোদ্ধা ইছাই ঘোষ লাউসেন – সেনাপতি, বীর লাউসেন ধর্মমঙ্গল কাব্য – ‘শনিবার সপ্তমী সম্মুখে বার বেলা/ আজি যুদ্ধে যাইওনা ইছাই গোয়ালা…,’ একসঙ্গে সব কেমন ঝড়েওড়া ঝরাপাতা হয়ে উড়ে-উড়ে এসে যায় সামনে। আদতে এই দেখা-না-দেখার মধ্যে দাঁড়ানো, শোয়া অথবা ভেসে থাকা শূন্যতা কোনো এক বর্ণহীন অলীক ঘোর হয়ে এসে যায় কাছে, দূরে। তখন জীবন নিয়ে তৈরি হতে থাকে নানা জিজ্ঞাসা। প্রশ্নের ধারাবর্ষণ। মঞ্জী যখন তার বাসি চুল মেলে দেয় হাওয়ায়, সেই কেশভারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নারকেল তেল, নয়তো সাজিমাটির গন্ধ, অথবা ঘাম কিংবা সরষের খোলের চাপা নয়তো তীব্র বাস মঞ্জীর একটি পটচিত্র তৈরি করতে সাহায্য করে। নিয়তিকে কে-ই বা দেখতে পায়? কে-ই বা স্পর্শ করতে পারে? অথচ তার শরীর গভীরে, খাঁজে কখনো কখনো চেনা, অথবা অচেনা মৃত্যুগন্ধ পেতে থাকে পূর্ণমাধব।
মৃত্যু কি কারও খুব চেনা হয়? অথবা চিরচেনা! নাকি সে কোনো দিনই পরিচিত নয় কারও কাছে? কেবল কোনো কুয়াশা ঘোরের আড়ালে থেকে যায় মৃত্যুপ্রতিমা, যেমন কিনা আজ শেষরাতে মাথার ওপর মধুভাণ্ড হয়ে ঝুলে থাকা চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে, এখানে একটা কথা একটু বলে নেওয়া ভালো, আকাশে জেগে থাকা চন্দ্রবাহার আদপেই মধুভাণ্ড ছিল কিনা, তা তো প্রকৃতিই একমাত্র বলতে পারে। কিন্তু মধুর ভাণ্ড হয়ে জাগা চাঁদকে গভীর শীতের ভেতর অনুভব করতে-করতে পূর্ণমাধবের মনে হয়েছিল কুয়াশার ঘেরাটোপের ওপারে আরো যেন না-দেখা কিছু আছে।
গাড়ি চালাতে-চালাতে মুখ দিয়ে নানা রকম গাড়োয়ানি চিৎকার বার করতে-করতে সহদেব মাঝেমাঝেই একদম চুপ হয়ে যাচ্ছিল। বাইরে তখন জোনাকির মেলা বসা পৃথিবী। বলদদের ল্যাজ মুচড়ে দিতে-দিতে নরমে-গরমে নানা রকম কথা বলছিল। তারপর একসময়-সময় চরাচর নৈঃশব্দ্যের গভীরতায় একটু-একটু করে ডুবে যেতে থাকলে, তখন কিরকম করে যেন গানের দুএকটা কলি খুব  আবছা, হয়তো খানিকটা বেসুর, বেতালেও উঠে আসছিল সহদেবের গলায়।
সেই সব গানের কলি ঠিকঠাক ঠাওর করতে পারছিল না পূর্ণমাধব। তবু গান তো গানই। হয়তো তাতে রাধামাধব বিষয়ক কোনো তরল উচ্চারণ ছিল।
সহদেব কি কৃষ্ণ-রাধার প্রেমার্তিকে ফুটিয়ে তুলতে চাইছিল নিজস্ব কণ্ঠমাধুরীতে! আর তার এই গুনগুনানিকে আদপেই কি বলা যাবে কণ্ঠমাধুর্য অথবা কণ্ঠমাধুরী! কে জানে! কাব্যকার কি সব জান্তা নাকি? সমস্ত কিছুই জেনে ফেলতে হবে তাকে? সময়ে, অসময়ে যাবতীয় তথ্যের ভার মাথায় নিয়ে করে যেতে হবে বিবিধ মন্তব্য!
মঞ্জী মাঝেমাঝে (পূর্ণমাধবের লেখা শুনে) বলে ওঠে, কী-কী যে সব লেখ, ঠিকঠাক বুঝতে পারি না। কিংবা সদ্য – সবে লেখা নতুন কোনো এক পঙ্ক্তি, দুপঙ্ক্তি তার সামনে অভ্যাসে বলে উঠলে, যেমন কিনা গাছ, পাথর, নয়তো নদীকে শোনানো হচ্ছে তার পদ, পূর্ণমাধব শুনতে পায় – এসব  তুমি নিজে-নিজে লেখো! মন থেকে? সব তোমার লেখা?
আমি কি আছি এই সব ছড়াকাটায়? মঞ্জী এভাবেও তো জানতে চায় কখনো-কখনো। তখন পূর্ণমাধব ভেতরে-ভেতরে হাসে। কথা বলে। নিজের ওপরই কিরকম যেন করুণা হয় তার। কখনো রাগও হয়। মঞ্জীর খোলা পিঠে বসা জোনাকিরা কখনো কখনো এতটাই তাপ ছড়াতে থাকে, হাত দিয়ে দিয়ে তাদের সেই উত্তাপ ছুঁয়ে নিতে পারে পূর্ণমাধব।
কাল সারারাত ধরে গরুর গাড়িতে আসতে-আসতে ভারি কাঠের চাকার ক্যাঁচকোঁচ, বলদদের নিজস্ব গন্ধ, শব্দ, শীতের প্রবল হাহাকার, তারই মধ্যে চাঁদলাগা দুধেল কুয়াশা – দূরে-দূরে আবছা গাছেরা, নদের পাড়, জল – সব মিলিয়ে-মিশিয়ে যেন একটার পর একটা নতুন-নতুন পদ গুঁতো মারতে থাকে পূর্ণমাধবের মনে।
গো-যানে চক্রময় যেমত জীবন
সুখ-দুঃখ দুটি পাখি করে আলাপন…
না, না ঠিক হলো না। দর্শনের গভীরতার ভেতর দিয়ে দেখা হলো না জীবনকে। এই আয়ুর পরতে-পরতে কত না মজার খেলা। লোক-দেখানিয়া সময়-সুযোগকে কাটিয়ে পাশে রেখে বয়ে চলেছে জীবনরেখার উনিশ-বিশ।
এমন পদ কি লিখে যেতে পারব কোনো দিন যা কিনা রামনিধি গুপ্ত, নীলকণ্ঠ ঘোষাল, গোপাল উড়েদের পাশাপাশি উচ্চারিত হবে! লোকে আমার পঙ্ক্তি থেকে অক্ষর, শব্দ, বাক্য তুলে এনে উপমা হিসেবে ব্যবহার করবে কথা বলার সময়! আদৌ হবে কী এমন দিন?
রোদ যখন চরাচরে ছড়ায়, তার উত্তাপেই তো মালুম পাওয়া যায় সব।
কাছাকাছি মানুষ অনেক। সকলেই স্নানার্থী। পুণ্যার্থী।
বিষ্ণুকান্ত জানতে চাইল পূর্ণমাধব অজয়ে গা ডোবাবে কিনা।
পূর্ণমাধব ঘাড় নাড়ল – ডোবাবে। তবে আরো-আরো পরে।
সহদেব গোগাড়ি রাখার নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি রেখেছে। বলদ বাঁধার জায়গাটিতে বেঁধে দিয়েছে জোড়াবলদ। চানের ব্যাপারে তার মহাউৎসাহ। সংক্রান্তির এই পুণ্যস্নানে নাকি কেটে যায় সব পাপ-তাপ। পেষসংক্রান্তির দিনে স্বয়ং পাপহারিণী মা গঙ্গা নেমে আসেন অজয়ে। ফলে এদিনের চানের মাহাত্ম্যই অন্য। সংক্রান্তির এই দিনটাতে গেরস্থের ঘরে-ঘরে ছ্যাঁক-ছোঁক – পিঠে-পানা। পায়েস রান্নার গন্ধ। ফুটেওঠা দুধ, নতুন চাল আর নতুন গুড় – সবমিলিয়ে সে তো যাকে বলা যেতে পারে এক মহাউৎসব ঘ্রাণ। সকালে চানটান তো হোক আগে। ভাবতে-ভাবতে সহদেব আবারও গুনগুন গুনগুন করে উঠল।
পূর্ণমাধব কিছুতেই সেই সুরমাখা পদের কারিকুরি ধরতে পারল না। কী বলতে চায় সহদেব? আদৌ কিছু বলতে চায় কি? নাকি আসলে যত কথা, যত ভাব – সবই সেই পদকর্তার, যিনি মনকে বসিয়েছেন কলমের ডগায়। ভাবকে এনে ফেলেছেন কথার ফাঁদে।
পূর্ণমাধব চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
তার বারবার মনে হয় এই অজয়, নদ রেখা, মেলা, কবি জয়দেব, সাধিকা পদ্মাবতী, কদমখণ্ডীর মহাশ্মশান, জয়দেব পদ্মাবতীদের মন্দির, জয়দেবের সাধনপীঠ সবই তো একটি টানা কাব্যভাবনার আলাদা-আলাদা পঙ্ক্তি। সেই সব পঙ্ক্তি তুলে ধরে, মেজে-ঘষে, জীবনের তাপে সেঁকে এগিয়ে চলাই একজন কবির কাজ।
ময়রার ভিয়েনে গাওয়া ঘিয়ের ময়ানে বালুসাই বানাবার প্রস্তুতি চলেছে, এমনটি দেখতে পেল বিষ্ণুকান্ত। বড়-বড় মাছি, মৌমাছি, বোলতা – সবই ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই মিষ্টি কারিগর আর রসের কড়াই, গামলাদের ঘিরে। এরা আর কী কী মেঠাই বানায়, জানতে বড় ইচ্ছে হলো বিষ্ণুকান্তর।
পূর্ণমাধব শূন্যচোখে তাকিয়ে রইল অজয়ের দিকে। মাথার ওপর শীতের রোদ চিলপাক দিতে দিতে উঠে আসছে। একটা হলুদ প্রজাপতি কখন, কোন অজান্তে পূর্ণমাধবের ঘাড় ছুঁয়ে হয়তো অজয়, নয়তো কদমখণ্ডীর মহাশ্মশানের দিকে চলে গেল। পূর্ণমাধব হয়তো টের পেল তাকে।
হয়তো পেল না।
প্রজাপতি-পাখায় কি গুঁড়ো রং থাকে? না হলে ডানা থেকে লেগে যাওয়া রং-চূর্ণ কেমন করে অনুভব করতে পারে পূর্ণমাধব। কীভাবে পারে বুঝে নিতে পাখনার বর্ণসুষমা। পূর্ণমাধব তার দৃষ্টিশূন্য চোখে দেখতে থাকে কদমখণ্ডীর ধোঁয়াওঠা শ্মশানের দিকে উড়ে যাচ্ছে শত-শত প্রজাপতি। সেইসব ডানামেলা রংপতঙ্গরা উড়তে-উড়তে-উড়তে ভরিয়ে তুলছে আকাশের মুখ, বুক। তবু মৃত্যু থাকে। জীবনকে ছাপিয়ে কখনও কখনও উঠে আসতে চায় মরণের তুমুল নান্দীরোল। সেই চিহ্নিত কলরোলের মধ্যেই মিশে যেতে থাকে জীবনের অতি-আশ্চর্য বিভা।
প্রজাপতির পাখনা থেকে উঠে আসা আলগা রঙেরা পূর্ণমাধবের ডান হাতের তর্জনী, মধ্যমায় জড়িয়ে যায়। আসলে বুকের ওপর, নাকি ঘাড়ে, কাঁধেও – হয়তো ঘাড়ে আগে বসল, তারপর কাঁধে, পরে নতুন করে বুকের ওপর, প্রজাপতি – প্রজাপতিরা শ্মশান-ধোঁয়া, কাঠজ্বলা, মাংসপোড়া গন্ধকে সরিয়ে দিয়ে দিব্যি উঠে গেল।

শমনে ব্যাদান দেয় মরণেরই ভয়
‘শমনে ব্যাদান দেয় মরণেরই ভয়’ – মনের মধ্যে এই পদটুকু নিয়ে গেন্ডুয়া খেলতে লাগল পদকর্তা পূর্ণমাধব। নাহ, ঠিকঠাক পদটি ভেসে উঠছে না মনের ভেতর। এই ফোটা, না-ফোটার মাঝামাঝি সময়টা বড়ই যন্ত্রণার। কষ্টেরও তো বটেই।
শমনে ব্যাদান করে মরণেরই ভয়
মহাকাল কালকুম্ভ সদাই ভরায়
মরণেতে ডর নাহি মহিষ বাহন
কৃতান্ত সম্মুখে এলে মুদিব নয়ন…
এই তো জীবন, এটুকুই ধুকপুকুনি, সে যেন এক চড়াই-আয়ু নিয়ে  এ-ঘর ও-ঘর, সে-দুয়ার, এ-দুয়ার করে চলেছে অনবরত। মঞ্জী কি বোঝে এসব দর্শন কূটকচালি? বোঝে কি মায়া? আদৌ বুঝতে চায়? নিজের গরু, গোয়াল, দুধের গাহক, দুধ-ব্যবসা নিয়ে দিব্যি আছে মঞ্জী। অন্তত বাইরে থেকে দেখে তো তার কোনো উনিশ-বিশ বোঝার উপায়ই নেই।
মায়া ব্যস্ত ঘরসংসারে। সন্তান পালনে। তারই মাঝে জীবন কেমন তরতরিয়ে বহে চলে।
চলতে থাকে। দুই 888sport promo code দুটি প্রান্তে বহে যাওয়া নদী।
মনেতে মঞ্জীর মায়া চিত্ত উচাটন
ঘন ঘন মলয়ানল চতুর পবন
মনেতে সন্দেহবিষ ভোগ কামনায়
সদা সুখী হাস্যমুখী দেখিবারে চায়…
মঞ্জী মঞ্জী মঞ্জী।
মনের মধ্যে ঢেউ তোলে পূর্ণমাধব।
মায়া। মায়া। মায়া।
পদকর্তা তার চোখের সামনে নিজের বিয়ে করা পরিবারটিকে দেখতে পায়।
এই পৌষসংক্রান্তির সকালে কেঁদুলীর কদমখণ্ডী মহাশ্মশানের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মহামাংস পুড়ে যাওয়া কটু গন্ধ নাকে ঠোনা মারে পূর্ণমাধবের। হাওয়ায়-হাওয়ায় ভেসে থাকা প্রজাপতিরা কখন যেন বাতাসেই লীন হয়ে গেছে দেহতত্ত্বের গান যেভাবে জীবনে মিশে যায়, অনেকটা তেমন কায়দাতেই।
লক্ষ-কোটি প্রজাপতি ভরিয়ে তুলছে পূর্ণমাধবের অন্ধ আকাশ। সেখানে সময়ের চতুর বর্ণালি যেন লেখা হয়ে যাচ্ছে কোনো অলক্ষে। শীতবাতাস মেখে কেমন যেন আরো একটু বেশি জবুথবু মনে হচ্ছে নিজেকে, হঠাৎই।
খিচুড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আপনি কি চানে যাবেন? বিষ্ণুকান্তর গলা শুনে ঠিকঠাক যেন  ধাতে ফিরল পূর্ণমাধব। তারপর একটু থেমে বলল, যাবো তো। অজয়ে চান করবো।
রোদ মেখে বেলা ১০টা-১১টার অজয় তখন বালিভূমির কাছাকাছি সোনার তবক-মোড়া পায়েসের বড় থালা হয়ে পড়ে আছে। এ দর্শন পূর্ণমাধবের নয়নে-নয়নে নয়, মনে-মনে। পূর্ণমাধব জানে তেল, গামছা, কাপড় – সবকিছুরই ঠিকঠাক ব্যবস্থা করবে  বিষ্ণুকান্ত। এসব কথা নিয়ে নিজের ভেতর নাড়াচাড়া করতে-করতেই সহদেবের কথা মনে এলো। সেই বীর পালোয়ানটি এখন ঠিক কী করছে বা করতে চাইছে জানার ভয়ঙ্কর ইচ্ছে হলো পূর্ণমাধবের। বিষ্ণুকান্তকে তখনই এ-ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও কোথায় যেন তার গলা আটকে এলো।
শেষ পৌষের রৌদ্রযাপনে শিশির ভেজা হলুদ-হলুদ খড়েরা  এখন কেন জানি না অনেক-অনেক বেশি  শান্ত, নিরুদ্বেগ। হয়তো রাত-ফুরনো বেলায় হিম-সৌন্দর্য একটু আগেও তাদের ছুঁয়ে ছিল প্রকৃতির অশ্রুজল হয়ে, একান্তই।
সময় গড়িয়ে গেলে 888sport sign up bonus থাকে।
তারপর একসময় সেইসব 888sport sign up bonusময়তা, 888sport sign up bonusকাতরতার ওপর চেপে-চেপে বসে নতুন-নতুন অভিজ্ঞতা। সময়ের চাপ। যেমন কিনা মঞ্জীর স্তন-ঐশ্বর্যের ওপর একটি কালো – কৃষ্ণকালো ভ্রমর, যেমন কিনা ঘুমঘোরে, নিছকই স্বপ্নের ভেতর তারপরই হয়তো জেগে ওঠে কোনো যাত্রীবিহীন, দাঁড়ি-মাঝিশূন্য একক নৌকো, সেই নাওয়ের ওপর জল উঠে আছে। ছল-ছলাৎ-ছল স্রোত। কেবলই ঘূর্ণিপাক। নৌকো ডোবে। ডুবে যায়।
এই যে স্বপ্ন গভীরের মায়াঞ্জন রেখা, যাকে ঘিরে মঞ্জী জাগে, জেগে থাকে মায়া অথবা অন্য অন্য 888sport promo code – রমণী শরীর, মঞ্জীর শরীর থেকে আলো বেরোয় কি? সত্যি বেরিয়ে আসে আলোকরেখা?
অন্ধ পূর্ণমাধব বুঝতে পারে না ঠিকঠাক। অন্ধের স্বপ্নে কি নদী আসে, তীব্র – খরস্রোতা নদী! সেই জলপ্রবাহের ভেতরই একটি নৌকো। সেই তরী ডুবে যায়। তখন উপরিতলে থাকে কিছু জলবিম্ব, জলবুদ্বুদ। জলের স্বর। জলেরই হাহাকার।
কেন 888sport promo codeর জন্য থাকে এত-এত হাহাকার! আর্তি! ক্রন্দন! লিপ্সা! কেন? কেন? কেন? কেনই বা অন্ধনয়নে থাকে জল! জলের নিজস্ব রেখা। স্রোতময় লবণরেখায় কষ্ট। মনের একান্ত বিষাদ।
মঞ্জীর স্তনবৃন্ত থেকে কাজলকৃষ্ণ ভ্রমরটি উড়ে যায় কোন অজানা অলক্ষে – আচম্বিতেই। কোনো এক না-জানা টানে সে হারায় কোনো দূর-আলোকে।
সহদেব কি এইসব জীবনপ্যাঁচ-পয়জার বোঝে? বুঝতে পারে কি বিষ্ণুকান্ত! কে জানে? কেই-বা বলতে পারে এসব রহস্যলেখা! সহদেব যখন আগে, পিছে – পিছে, আগে করাতে থাকে তার সড়কি যেন সাপের চেরা জিভ সেই সড়কির ফলা, যা দিয়ে মুহূর্তে ফুঁড়ে দেওয়া যায় বাতাস। সেই সঙ্গে-সঙ্গে হাওয়ার ঠিক গাঘেঁষে দাঁড়ানো বিপক্ষকে। সেই বিপরীত শক্তি কেমন করে যে সামলায় সেই সড়কির মার, কে জানে!
কাজল ভ্রমর রেখা চুচুক উপরে
কবি চায় সর্বসুখ কাব্য পরিসরে
স্বপনে কৃষ্ণকীট অতীব নিঠুর
রাধার কলসি যেমন…
‘রাধার?’ নাকি শ্রীমতীর? নাকি বৃষভানু কন্যার, অথবা ‘বৃষ্ণভানুনন্দিনীর’?
‘শ্রীমতীর’? নাকি রাধার? না, না – ‘বৃষভানু কন্যা’ বা ‘নন্দিনী’ হবে না কিছুতেই। ছন্দপতন হবে।
অঙ্গেতে সঙ্গ পায় ভোমরা মূরতি
পরশেতে তৃপ্ত হয় শ্রীমতীর রতি
কৃষ্ণকালা দিবে জ্বালা হৃদকমল মাঝে
রাধিকা শ্রীঅঙ্গে দেখ বীণ সদা বাজে
‘বীন’, নাকি মুরলী?
‘মুরলী’, নাকি বীন?
মনে-মনে শব্দ নিয়ে কাড়াকাড়ি করে পূর্ণমাধব। ঘষাঘষি করতে থাকে। সহদেব যখন লাঠি খেলে বা সড়কি, তার সেই লাঠিবাজি, সড়কিবাজির বিবরণ দিতে থাকে বিষ্ণুকান্ত। অবলীলায় বলে যেতে থাকে। সে যেন এখানে সঞ্জয়। মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র হয়ে তার সামনে বসে রয়েছে পদকর্তা পূর্ণমাধব।
দৃষ্টিশক্তি থাকলেই কি দেখতে পায় মানুষ?
পূর্ণ দৃষ্টি দিতে পারে সবের ওপর?
অথচ বিষ্ণুকান্তর বর্ণনায় দিব্যি তো দেখতে থাকে পূর্ণমাধব। তার সামনে লাঠিয়াল সহদেব হা-হা-হা রবে খেলাতে থাকে তেলে-জলে পাকানো বাঁশের যষ্ঠী। সেই তাগড়া বলিষ্ঠ লাঠি কখন যে অনায়াসে বাতাস চিরে দিয়ে কারও মাথা করে দবে দোফাঁক, বলা খুবই মুশকিল তা!
বিষ্ণুর কথাতেই তো পদকর্তা পূর্ণমাধব দেখতে থাকে বাতাসচেরা বিদ্যুৎসম সড়কি খেলা। সড়কি এগোয় সড়কি পেছোয়। সড়কি ফুঁড়ে দিতে চায়, ভেদ করতে চায় শত্রুকে।
এইসব বিবরণে একধরনের তীব্র উত্তেজনা থাকে। সেই উত্তেজক অবস্থাকে বেশ তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করতে থাকে পূর্ণমাধব। তখন আর তাকে দৃষ্টিহীন মনে হয় না আদপেই। বরং সে তখন দিব্যি চক্ষুষ্মান। অন্য অনেকের তুলনায় তার চোখের জোর অনেক অনেক বেশি। পূর্ণমাধব জানে এই যে বিষ্ণুর  কথন স্পর্শ, যা তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে বারে-বারে, তাকে ধরে রাখাটাই যেন একটা বড় ব্যাপার। এই ছবি আসা, সামনে ফুটে ওঠা, তারপর চলে যাওয়া, কোথায় কোন নিরুদ্দেশে – আবারও সামনে ফিরে আসা নতুন করে, পূর্ণমাধব চুপ করে থাকে। তার দৃষ্টিশূন্য চোখের সামনে তখন নেচে বেড়াতে থাকে নানা ধরনের ছবি।
নিজেকে কখনো কখনো অচেনা নদীর অপরিচিত ঘাটে ডুবিয়ে রাখা নৌকো মনে হয় পূর্ণমাধবের। সেই তরীবক্ষে কাব্যের নানা টুকরো ঘর-দালান হাঁসেদের ঝাঁক হয়ে ভেসে থাকে। হয়তো এই উপমা একেবারেই সঠিক হলো না এই মুহূর্তে। বরং পুকুর ঘাটলায় ছোট নৌকোদের ডুবিয়ে রাখলে তার ওপর পাতিহাঁসেদের নিয়মিত আড্ডাবাজি খানিকটা যেন বাস্তবসম্মত ছবি। তবু কেন জানি না নদীতীরে ডুবিয়ে রাখা তরীর ওপর গেরস্থপোষা সাদা-সাদা হাঁসের চিত্রটিই সামনে ভেসে এলো পূর্ণবাধবের। কেন এলো? কেন যে এলো কে জানে?
জলে ডোবানো নৌকোদের ভেতর গেরস্তালি সাজায় মাছেরা। সেসব মাছ ধরে নিয়ে যায় গেরস্থ। তারপর সুস্বাদু ব্যাঞ্জন বানায় তার পরিবার, সেসব মাছ দিয়ে। ঝাল, ঝোল, অম্বল। পুঁটি, মৌরলার ঝাঁক ঢুকে থাকে জলবন্দি নাওয়ের ভেতর। পূর্ণমাধব এসবই জানে। মানে তাকে জানতে হয়।
সতত গভীর নীড়ে ক্রীড়ারত মীন
তরীবক্ষে থাকিলে জল…
তরীবক্ষে থাকিলে জল…
নাহ্, ঠিকঠাক আসছে পদ-ঐশ্বর্য। থাক নয়। এখন থাক। রতিসঙ্গ যেমন, পদও হয়তো তাই। মানে নব-নব পদনির্মাণ। এই পঙ্ক্তিটির পর অন্য পঙ্ক্তি আসছে না কিছুতেই। কীভাবে যে আসবে, আদৌ  আসতে পারবে কি-না, বুঝতে পারে না পূর্ণমাধব। অথচ শীতের বেলা যে দ্রুত গড়াচ্ছে তা বুক-পিঠে জড়িয়ে থাকা রৌদ্র অনুভবেই বোঝা যায়।
সততগভীর নীরে ক্রীড়ারত মীন
তরীবক্ষে নিদ্রিত জল কিঞ্চিৎহীন
নাহ, মজে যাচ্ছে না। মজানো যাচ্ছে না। হচ্ছে না কিছুতেই।
নিজে না মজলে, অন্যকে মজাবো কীভাবে? কিছুতেই মজবে না অন্যজন, যদি না আমার ভেতরটি রসে-বশে একেবারে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। তখন যে রোমাঞ্চ-জাগানো তরঙ্গমালা ভেসে বেড়ায় শরীরময়, তার নামই কী সৃষ্টির আনন্দ? সৃজনের উল্লাস! কে জানে এত-এত ভারি ভারি শব্দ বহনের উপযোগিতা কোথায়? ঠিক কোনখানে? কোনদিকে?
এবার তো শরীর খাবার চাইছে। খাদ্য। খাদ্য। অন্নকণা। যে-কল্পনারা ঝাঁকবেঁধে, অথবা এতক্ষণ একা-একা উড়ে-উড়ে বেড়িয়েছে মনের চারপাশে, সেখানে শূন্যতার গাঢ় কোনো মেঘ বুঝি এসে থানা গাড়বে এবার।
শরীর প্রাণময় – প্রাণময় কোষ।
শরীর অন্নময় – অন্নময় কোষ।
খিদের যাতনা বড় যাতনা। সমস্ত রূপমাধুরী, কাব্যকলা, কবিত্ব সুষমা – সবকিছুকেই হরণ করে নিয়ে যেতে থাকে ক্ষুধা নামের সর্বগ্রাসী রাক্ষস।
সহদেব, বিষ্ণুকান্ত ওরা নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করছে তার। সেসব ভাবনার ফাঁকে-ফাঁকে পূর্ণমাধব কেন্দুবিল্ব গ্রামের জয়দেব মেলা থেকে ওঠে আসা নানা ধরনের শব্দের পরপর, পরপর গাঁথতে-গাঁথতে একটা ছবি বানিয়ে নিতে চাইল। এ ছবি যেমন মেলাতলার, তেমনই জীবনেরও।
সেসব চঞ্চল শব্দ-হরিণেরা ছোটাছুটি করতে থাকল পূর্ণমাধবের চারপাশে। এসব শব্দ-মালিকা ক্রমেই বড় কোনো কিছু একটা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল চুপিসারে।
তাহলে কিছু কী ঘটবে?
কোনো একটা কিছু ঘটে যাবে এবার সত্যি সত্যি, পূর্ণমাধব নিজেকেই নিজে শোনাতে থাকল যেন। কতখানি নির্জন, একক হয়ে গেলে মানুষ এমনটি করে থাকে! যেমন কিনা কোনো ঘন গ্রীষ্ম দুপুরে, ছায়াময় বড় গাছের সবুজ-সবুজ পাতার আড়ালে প্রবল গরমের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে চাওয়া পুরুষ বুলবুল চিয়ঁ-হাঁ-ও-চিঁ-য়ঁ-হাঁ-ও-ও বলে ডাকতে-ডাকতে বিষণœতার কোনো দূরালাপ বাতাসে ভাসিয়ে দিলে তার তৃষ্ণার বোধটুক কি ছবি হয়ে চলে আসে না বুঝদারজনের সামনে।
সেই গভীর সবুজের ভেতর থেকে উড়ে আসা চি য়ঁ – হাঁ-ও-ও-ও -। পূর্ণমাধব কতদিন, কত-কতদিন দীর্ঘ গ্রীষ্মবেলায় মন দিয়ে শুনতে চেয়েছে এই পক্ষী-আর্তি, হয়তো প্রবলতর তেষ্টার ঘোরে তার এই জলপ্রার্থনা। তাই কি! তাই কি আসলে? ঠিকঠাক বুঝতে পারে না পূর্ণমাধব। মাথার মধ্যে নানান জটিলতা পাক খেতে থাকে এক সঙ্গে।
পাখি – সেই ঘোর ছায়াময়তার ভেতর থাকা বুলবুলিটি কি এখনই ডাকল? ঠিক এখনই? এই মুহূর্তে! মনের ভেতর নিজেকে নিজে খোঁচা দিলো পূর্ণমাধব। যা! তা কেমন করে হবে? কীভাবে হতে পারে তা! মাঘের প্রথম দিনে ঘোর শীতের ভেতরে অজয় নদের পাড়ে কেমন করে উড়ে আসবে সেই জল-চাওয়া বিহঙ্গের ক্রন্দন! অথচ এই মেলার সমস্ত খুঁটিনাটি শব্দ উপেক্ষা করে কেমন করে দৌড়ে আসবে সেই পাখিগান।
বিহগ ক্রন্দন খায় তৃতীয় আকুল
সর্প স্বপনে পায় পক্ষী ছায়া শূল
শূল সম খাদ্য দেখ বৃক্ষেরই উপর
নিচেতে নির্জন ছায়া অতি মনোহর…
সাপ আর পাখির লুকোচুরি – সেও তো জীবনেরই কোনো ভাঙা ছন্দ। সেই ছন্দরেখা আরও যেন বেশি-বেশি ভঙ্গুর হতে থাকে জীবনের নিত্যচর্চায়।
এতসব কথার পিঠে আরও নতুন-নতুন কথা বুনতে-বুনতে-বুনতে পূর্ণমাধব শুনতে পেল বিষ্ণুকান্তর গলা। বিষ্ণুকান্ত খুবই কাছে এসে দাঁড়িয়েছে এখন। সেই দাঁড়ানো টুকুর আবছা গড়নও যেন নিজের সামনে টের পাচ্ছে পূর্ণমাধব। প্রয়োজনের জন কাছে এলে সেই অনুভবের ছায়া-প্রচ্ছায়া টের পাওয়া যায় সহজেই। মনের ভেতর-ভেতর চলতে থাকে কত না তরঙ্গধারা। মেলার সব ধরনের শব্দ, গন্ধ, হই-হট্টগোল ছাড়িয়ে বিষ্ণুর উপস্থিতি টের পেয়ে যাচ্ছে পূর্ণমাধব।
বাতাসে খেলা করছে কী এক উদভ্রান্ত মুহূর্ত। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ…। গোনার সঙ্গে-সঙ্গে মুহূর্তরা গড়িয়ে যেতে থাকে অনন্তের পথে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে থাকে বিচিত্র সব শব্দ-হরিণেরা! কী তাদের বর্ণমহিমা। কচি-কচি শিঙেল পুং হরিণরা হরিণীর ছন্দে-ছন্দে লাফিয়ে-লাফিয়ে চলেছে। হরিণীদের মাথায় শিং থাকে না।
পূর্ণমাধব বধ্ধোমান শহরে রাজবাড়ির চিড়িয়াখানায় এসে শিংঅলা শিংছাড়া হরিণ-হরিণদের স্পর্শ করে দেখেছে। সেই ছোঁয়ায়-ছোঁয়ায় আঙুলের ডগায় কেমন যেন একটা আধা-আধা, ধুলোটে অনুভব জড়িয়ে যায়। অথচ কত না নরম ওদের গা। আপাতত অনেক অনেক শব্দ-হরিণ পাক দিয়ে-দিয়ে ঘুরছে পূর্ণমাধবকে। তাদের যদি ধরা নাও যায় আদপে, স্পর্শ করতে পারলেই একজন পদকর্তা ধন্য হয়ে যাবেন অনেকখানি। সেই অনুভবটুকুই হয়তো সম্পূর্ণ সত্য নয়। এই অনুভূতির বাইরেও থেকে যাচ্ছে আরো আরো কোনো সূক্ষ্মতর কিছু। একজন প্রকৃত কবিই হয়তো তাকে স্পর্শ করে ধন্য হন। নতুন সৃষ্টির কথা ভাবেন।
এই বাবুটা যেন কেমন-কেমন! মনে মনে ভাবে বিষ্ণুকান্ত। কী যে আপন খেয়ালে থাকে, চলে সব সময় – খিদে-তেষ্টার বালাই পর্যন্ত নেই, নাকি! আচ্ছা পাগল যা হোক। এসব ভাবতে-ভাবতেই নিজের মনে অনেক কিছু বিড়বিড়-বিড়বিড় করতে-করতে বেশ একটু জোরেই কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল বিষ্ণু। তার মনে পড়ল, পূর্ণমাধব ভয়ংকর অপছন্দ করেন চিৎকার-চেঁচামেচি। তাই নিজেকে পূর্ণমাধবের অনেকটা কাছাকাছি এনে খুব আস্তে আস্তে দুবার গলা ঝাড়া দিলো বিষ্ণুকান্ত।
পূর্ণমাধব এবার বিষ্ণুকান্তর দিকে তাকলেন। বিষ্ণুকান্ত পূর্ণমাধবের দিকে।