শাঁওলী মিত্র : তাঁর অভিনয়

প্রাক্কথন

বাংলা নাটকের ঐতিহ্য ও গতিশীলতায় শাঁওলী মিত্র এক স্বতন্ত্র অধ্যায়। আধুনিক বাংলা নাটকের ইতিহাস যদি ১৮৬০- ৭০-এ রচিত নীলদর্পণ, সধবার একাদশী, শর্মিষ্ঠা, একেই কি বলে সভ্যতা ইত্যাদির মধ্যে নিহিত দেখি, অথবা ১৮৭২-এ গিরিশ চন্দ্র ঘোষের নীলদর্পণ অভিনয়ের পেশাদারিত্ব দিয়েই বিবেচনা করি, এর গতিজাড্য প্রায় এক শতাব্দী পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। আমরা জানি, ১৭৯৫-এর ২৭শে নভেম্বর স্তিফেন গেরাসিম লেবেদেফের কাল্পনিক সংবদল দিয়ে বাংলা নাটকের যাত্রারম্ভ। ১৮৩৫-এ প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দু থিয়েটার’, সে-ই বছরেই শ্যামবাজারে নবীনচন্দ্র বসুর বাড়িতে রঙ্গমঞ্চের সূচনার ইতিহাসও জানা আমাদের। ১৭৫৭তে রামনারায়ণ তর্করত্নের লেখা নাটক কুলীনকুলসর্বস্ব অভিনীত হয়েছিল রামজয় বসাকের বাড়িতে, আর ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ-রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহের বাগানবাড়িতে অভিনীত হয় মাইকেল মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা। এসবই বাংলা নাটকের অহংকারী ইতিবৃত্ত। পাশাপাশি বাঙালির লেখা বাংলা নাটকটি লিখলেন তারাচরণ শিকদার, ১৮৫২তে। এটি একটি কমেডি। বাংলা ট্র্যাজেডি নাটকের সূচনাও ওই বছর, যোগেন্দ্রচন্দ্র গুপ্তের কীর্তিবিলাস। পরের বছর এলো 888sport app download apk latest version নাটক। শেক্সপিয়রের নাটকের 888sport app download apk latest version করলেন হরচন্দ্র ঘোষ, ভানুমতী চিত্তবিলাস। এটি শেক্সপিয়রের

The Merchant of Venice-এর বঙ্গীকরণ।

শাঁওলী মিত্র : প্রথম পর্ব

শাঁওলী মিত্রের জন্ম ১৯৪৮-এ। ঠিক সে-বছরেই কলকাতায় ‘বহুরূপী’ নাট্যদলের প্রতিষ্ঠা, যে-দল গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের পথিকৃৎ। তার আগে বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন নাটক যদিও দিশারীর ভূমিকা নিয়েছিল, তবু ভালো নাটক ভালোভাবে করার সঙ্কল্প নিয়ে, পেশাদারি নাটকের ব্যবসায়ী মনোভাব আর স্টারসিস্টেমকে বর্জন করে প্রকৃত নান্দনিকতাকে জাগরূক করার দায়বদ্ধতা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল ‘বহুরূপী’। রমা রলাঁর People’s Theater এবং সেইসঙ্গে চীন ও স্পেনের নবনাটকের ধারাবাহিকতায় এর উদ্ভব। শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্র দম্পতি প্রায় সারাজীবন সক্রিয় ছিলেন এই নাট্য-আদর্শের সঙ্গে, এবং কন্যা শাঁওলীকেও দীক্ষিত করে গেছেন নাট্যবিষয়ে তাঁদের ভাবনাচিন্তা ও প্রয়োগে।

 খুব ছোটবেলা থেকেই শাঁওলি নাট্য-আবহে মানুষ। 888sport appয় রামেন্দু মজুমদার-ফেরদৌসী মজুমদার-ত্রপা, অথবা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু-শিমূল ইউসুফ-এষা যেমন, পরবর্তীকালে, তেমনি শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্র-শাঁওলী মিত্র।

শাঁওলী মিত্র : দ্বিতীয় পর্ব

অনিবার্য কারণে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি ও শাওলী বহুরূপী ছাড়তে বাধ্য হন। এসময়ে তৃপ্তি মিত্র একটি নতুন দল গঠন করেন, ‘আরব্ধ নাট্য নিকেতন’। শাঁওলী বেশ কয়েক বছর নাটকের থেকে বিযুক্ত থেকে পরে নিজে আলাদা একটি নাট্যদল গড়েন, ‘পঞ্চম বৈদিক’ নামে। ঋক্, সাম, যজুঃ ও অথর্ব – এই চার বেদের পর নাটককে বলা হয় পঞ্চম বেদ। সেজন্যেই ওরকম নামকরণ।

এই পর্যায়ে তিনি প্রথমদিকে বহুরূপীর পুরনো প্রযোজনা  পুতুলখেলা এবং একটি রাজনৈতিক হত্যা (আগে নাম ছিল নিন্দাপঙ্কে) দিয়ে যাত্রা শুরু করে অতঃপর নিজের লেখা নাটক নাথবতী অনাথবৎ এবং কথা অমৃতসমান দিয়ে মঞ্চজগতে বিস্ময় সৃষ্টি করেন। পাশাপাশি ‘থিয়েটার সেন্টার’-প্রযোজিত ও তরুণ রায়-পরিচালিত চার অধ্যায় নাটকে এলার চরিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। বহুরূপী যখন নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিল, তখন এলা সাজতেন তৃপ্তি মিত্র আর অতীতের ভূমিকায় থাকতেন শম্ভু মিত্র।

মহাভারতকেন্দ্রিক নাটকদুটি তুমুল দর্শকনন্দিত হয়। বিশেষ করে নাথবতী-তে একই সঙ্গে একাধিক চরিত্রের হাসির যে বিস্ময়কর কোলাজ এনেছিলেন তিনি, তা তাঁর অভিনয় প্রতিভার দিকনির্দেশক হয়ে থাকবে চিরদিন।

শাঁওলীর রবীন্দ্র নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করা পৃথক একটি 888sport liveের বিষয় হতে পারে। রাজা নাটকে যেমন সুরঙ্গমা, তেমনি ঘরে বাইরেতে বিমলা। তৃপ্তি মিত্র ও শাঁওলী চার অধ্যায় নাটকে যে অভিনয় করেছেন, তাতে বৈপরীত্য ও মেধার দুই স্বাতন্ত্র্যের প্রমাণ মেলে।

জার্মান পরিচালক বেনভিৎসের অধীনে কলকাতা প্রত্যক্ষ করে ব্রেখটের গ্যালিলিও। সেই নাটকে গ্যালিলিওর ভূমিকায় শম্ভু মিত্র আর তাঁর মেয়ের ভূমিকায় শাঁওলী। দর্শকদের জন্য সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা, দুই প্রজন্মের অভিনয় প্রত্যক্ষ করা।

শাঁওলী শিশু-কিশোরদের দিয়ে করিয়েছেন সুকুমার রায়ের হযবরল আর লীলা মজুমদারের লঙ্কাদহন পালা।

শাঁওলীর 888sport app download bdপ্রাপ্তির তালিকায় রয়েছে পদ্মশ্রী, সঙ্গীত নাটক একাডেমি, দীনবন্ধু ও বঙ্গবিভূষণ। শম্ভু মিত্র এবং

তৃপ্তি মিত্র উভয়েই কালিদাস সম্মাননা পেলেও শাঁওলী পাননি,

যদিও আমাদের ধারণা, এ-সম্মান পাওয়ার যোগ্য ছিলেন তিনি।

শাঁওলী : ঋত্বিক ঘটকের live chat 888sport যুক্তি তক্কো আর গপ্পোর বঙ্গবালা

শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র বেশ কিছু live chat 888sportে অভিনয় করলেও শাঁওলী তা করেননি। তবে ঋত্বিক ঘটকের যুক্তি তক্কো আর গপ্পো live chat 888sportে অভিনয় করে তিনি তাঁর live chat 888sportাভিনয়ের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। জন্মসূত্রে বাঙাল নন তিনি। তবু আয়াসসাধ্য পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণ কী দক্ষতার সঙ্গেই না তিনি উচ্চারণ করেছেন পুরো ছবিজুড়ে ছড়ানো তাঁর সংলাপে! কেন যে তিনি live chat 888sportে আরো বেশি করে অভিনয় করলেন না! এই একটি ছবির জন্যও live chat 888sportের দর্শক, বিশেষ করে 888sport appsের, তাঁকে  মনে রাখবে। কেননা, ১৯৭৩ সালে 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি ছবিটিতে বঙ্গবালা নামে তাঁর চরিত্রটিকে ঋত্বিক সৃষ্টি করেছিলেন 888sport appsের প্রতীক হিসেবে। অর্থাৎ বঙ্গবালা হলো Bangladesh personified। ছবিতে সমসাময়িক পশ্চিমবঙ্গের টালমাটাল অস্থিরতার কথাও তুলে ধরা হয়েছে।

শাঁওলী : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়পর্ব

১৯৮৯-৯১ – এই সময়পর্বে শাঁওলী দুবার 888sport appsে আসেন। মূলত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়ার্কশপ পরিচালনার জন্য। তাঁকে সেখানে আনার ব্যাপারে মূল উদ্যোগী ছিলেন নাট্যাচার্য ও জাহাঙ্গীরনগরের নাট্যকলা  বিভাগের শিক্ষক সেলিম আল দীন। কর্মশালায় এসে প্রথম দিনটিতে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের গদ্য-পদ্য পাঠ করে শোনান, এবং ছাত্রছাত্রীরা মুগ্ধ হন। দিন দশেকের কর্মশালায় তিনি উচ্চারণবিধি শেখাতেন, কণ্ঠের উচ্চাবচতা কীভাবে নাটকীয় পরিবেশ রচনা করে, তা দেখাতেন। পাঠ করে শোনান তাঁর লেখা নাটকের নানা জায়গা থেকে। প্রসঙ্গত, সেলিম আল দীনের নাট্যাদর্শের সঙ্গে শাঁওলীর এক জায়গায় খুব মিল ছিল। লোকনাট্যের অসীম সম্ভাবনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন দুজনেই। শাঁওলী সরকারি স্কলারশিপ নিয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে গেছেন সেখানকার নাট্যবৈচিত্র্য ও পরম্পরা জানতে। দক্ষিণ ভারতের যক্ষগণ থেকে উত্তর ভারতের রামলীলা, রাস ও তিজন বাঈয়ের  পাণ্ডবানী দেখার অভিজ্ঞতা মূর্ত শাঁওলীর মহাভারতকেন্দ্রিক নাটক রচনা ও অভিনয়ে। সেলিম আল দীনের কেরামত মঙ্গল, কিত্তনখোলাসহ বহু নাটকেই তো দেশীয় নাট্য-আঙ্গিকের সফল মঞ্চায়ন। শাঁওলী সেলিম আল দীনের চাকা, যৈবতী কইন্যার মন নাটকদুটি এসময় দেখেছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন সেসময় জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্র এবং বর্তমানে 888sport live chatকলা একাডেমী দিনাজপুরের নাট্যপ্রশিক্ষক সম্বিত সাহা। 888sport sign up bonusচারণায় তিনি আরো জানান,  শাঁওলী এসময় বুদ্ধদেব বসুর অনাম্নী অঙ্গনা, প্রথম পার্থ থেকে, শম্ভু মিত্রের চাঁদ বণিকের পালা  ও রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর থেকেও পাঠ করে শুনিয়েছেন। ১০ দিন ধরে ৬০ ঘণ্টার ক্লাস নেন তিনি এখানে।

‘বাঙালির হাজার বছরের চর্চিত নাট্যপরিবেশনার ধারাকে আধুনিক জীবনবোধের সমান্তরালে স্থাপনে প্রয়াসী ছিলেন তিনি।’ মন্তব্যটি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অপর এক ছাত্র আহমেদ আমিনুল ইসলাম, শাঁওলীর মৃত্যুর 888sport sign up bonusকাতরতাপূর্ণ তাঁর ভোরের কাগজ পত্রিকায় ২৩/১/২০২২-এর লেখায়। সেই ওয়ার্কশপের অন্য এক শিক্ষার্থী নীনা নাজনীন জানিয়েছেন সেখানে শাঁওলীর ঘরোয়া পরিবেশে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময়, তাঁর গান গাওয়া, তাঁর বসার বিশেষ ভঙ্গি, কথোপকথনের পরিশুদ্ধতা। আহমেদ আমিনুল ইসলাম একটি তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন। ‘শৈশবে ‘ডাকঘর’-এ অভিনয় করাকালীন সময়ে শাঁওলী প্রায়শই অসুস্থ থাকতেন। একবার এমনকি কিছুদিনের জন্য তাঁকে হাসপাতালে ভর্তিও হতে হয়েছিল। সেখানে রোগীর পর রোগীর বেদনা, যন্ত্রণা ও অসহায়তা পরে অভিনয়ে তাঁর কাজে লেগেছিল। এইভাবে অমল চরিত্রে শাঁওলী নতুন এক মাত্রা যোগ করেছিলেন।’

শাওলী : তাঁর 888sport live chatবিশ্ব

শাঁওলীর 888sport live chatিতা যে কেবল মঞ্চ-বেতার-দূরদর্শন নাটকের অভিনেতা হিসেবেই বিকশিত হয়েছিল তা নয়। তা ছিল বহু ব্যাপক। নাটক ও আবৃত্তির পাশাপাশি শাঁওলী ছিলেন সংগীত888sport live chatীও। রীতিমতো তিনি গানের তালিম নিয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র ও অর্ঘ্য সেনের কাছে। তাঁর সংগীতের ব্যবহার দেখা যায় বিভিন্ন নাটকে তাঁর স্বকণ্ঠে গান গাইবার মুহূর্তগুলোতে।

দূরদর্শনের জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘সুভা’ গল্পের নাট্যরূপ দেন ও তা পরিচালনা করেন। এটি কলকাতা দূরদর্শন তো বটেই, দিল্লি দূরদর্শন, এমনকি সার্কভুক্ত নয়টি দেশের টিভিতেও দেখানো হয়েছিল। এটিও তাঁর তূণীরের একটি অবিনাশী সায়ক!

শাঁওলীর লেখক পরিচিতিও কম নয়। শম্ভু মিত্রর ওপর গ্রন্থ আছে তাঁর। রয়েছে 888sport liveের বই, দিদৃক্ষা, যে-গ্রন্থের জন্য তিনি আনন্দ 888sport app download bd পেয়েছিলেন।

এককথায় বহুমুখী প্রতিভা তিনি। live chat 888sportেও অভিনয় করেছেন তিনি। সেকথায় পরে আসবো আমরা।

পিতা নোহসি

উপনিষদে ঈশ্বরকে ‘পিতা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তুমি আমাদের পিতা। তোমায় পিতা বলে বলে যেন জানি ও মানি। শাঁওলীর কাছে শম্ভু মিত্র সেই ঈশ্বরপ্রতিম মানুষ। তাই শম্ভু মিত্র যখন তাঁর মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছাপত্র লিখলেন যে, মারা যাওয়ার পর লোকচক্ষুর অন্তরালেই যেন তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়, তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছিলেন কন্যা শাঁওলী। পিতার আদর্শ অনুসরণ করে শাঁওলীও একই রকম ব্যবস্থার কথা জানিয়ে যান। পিতা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন ইরাবতী কার্ভের লেখা মহাভারতের ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ গ্রন্থ যুগান্ত। সেই মহাভারত (যদিও কৃশকায়) বইটি শাঁওলীকে অনুপ্রাণিত করে ছ-ছবারের আয়াসে নাথবতী অনাথবৎ লিখতে। তাঁর পিতা তাঁর নাট্যগুরুরুই ছিলেন না কেবল, ছিলেন সার্বিক পথপ্রদর্শক। পিতার রচনাবলি তিন খণ্ডে সম্পাদনা করে তিনি তাঁর প্রতি যেমন দায়বদ্ধতা পালন করেছেন, তেমনি বাংলা নাট্যপ্রেমীদের কাছে অশেষ ধন্যবাদের পাত্র হয়েছেন। অন্তিমেও তিনি তাঁর পিতার পদাঙ্ক অনুসরণকারী যোগ্য সন্তান রয়ে গেলেন। ছবি : ইন্টারনেট