জয়নুল আবেদিনের যে-ছবিগুলো আমার কাছে সবসময় একটা আবেদন রেখেছে, সেটা হলো দুর্ভিক্ষের ছবি। তার পরের ছবিগুলো দু-একটি ছাড়া আমাকে তেমনভাবে আকর্ষণ করতে পারেনি। প্রথমেই জানতে হবে যে, জয়নুল আবেদিন দুর্ভিক্ষের ছবি কেন আঁকলেন। জয়নুল আবেদিন গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ, জেলে, জেলেনি, কিষান-কিষানি ও খেটে-খাওয়া জনগোষ্ঠী, তাদের তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন। তাদের দুঃখ-দুর্দশা, তাদের বেদনায় তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতো। জয়নুল আবেদিন বেশিরভাগ কাজেই, নাগরিক জীবনের চেয়ে এ-দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে চিত্রিত করেছেন। এই সাধারণ মানুষ যখন তেতাল্লিশে কলকাতায় এলেন, তখন কলকাতার নাগরিকদের কাছে বা নাগরিক সমাজে যেসব 888sport live chatী বসবাস করছেন, তাঁদের দু-একজন ছাড়া বেশিরভাগ লোকের কাছে এঁরা অনেকটা পূতিময় আবর্জনার মতো – তাদের মাথায় উকুন, দুর্গন্ধ, তারা উচ্ছিষ্ট খাচ্ছে – যার জন্যে দেখা যাচ্ছে, কলকাতায় বসবাসকারী 888sport live chatীরা কিন্তু তেমনভাবে দুর্ভিক্ষের ছবি চিত্রিত করেননি; জয়নুল আবেদিন করলেন। তার কারণ আমি আগেই বলেছি যে, গ্রামবাংলায় প্রতিটি মানুষের প্রতি তাঁর একটা সহমর্মিতা ছিল। ফলে তাঁর সেই পরিচিত জেলে-জেলেনি, কিষান-কিষানি, সাধারণ মানুষ যখন হুমড়ি খেয়ে পড়ল ক্ষুধার জ্বালায় এবং খাদ্যের অন্বেষণে, তখন জয়নুল আবেদিনের মন কেঁদে উঠল। কিন্তু তিনি খুব বিত্তবান ঘর থেকে আসেননি। ফলে দেখা যায়, জয়নুল আবেদিনের তেলরঙের চিত্র অনেক কম। কারণ তেলরঙের খরচ অনেক বেশি। জীবিকার জন্য তাঁকে কলকাতায় আজাদ কিংবা মোহাম্মদীতে ইলাস্ট্রেশন বা কভার এগুলো করতে হতো। আর যেহেতু তাঁর একটা অগোছালো ভাব ছিল। ফলে হয়তো দেখা গেছে, চীনা কালিতে সেসব ইলাস্ট্রেশন করার পর ব্রাশ ধুতে ভুলে গেছেন। ফলে ব্রাশগুলো শক্ত হয়ে যেত। এটা জয়নুল আবেদিন নিজে বলেছেন, ‘আমার ব্রাশগুলো শক্ত হয়ে যেত, আমি তখন এদের দেখে যখন ছবি আঁকা শুরু করলাম, তখন ব্রাশগুলোকে আমি ইট দিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ি দিয়ে জমে শক্ত হয়ে যাওয়া কালিগুলো ছাড়াতাম।’ একটা জিনিস আমরা দেখব যে, কাগজগুলোও কিন্তু মামুলি ছিল। তিনি ডেভিক কক্স কিংবা হোয়াইট ম্যান এ-ধরনের দামি কাগজের পরিবর্তে অর্ডিনারি বোর্ড টাইপের কাগজে আঁকতেন। আমার মনে হয়, জমে-যাওয়া ব্রাশগুলো ইট দিয়ে ভাঙার ফলে তার ড্রইং ব্রাশ ইফেক্টটা আসে। অ্যাক্সিডেন্টালি এই ইফেক্টটা পায়। আমরা তাঁর পরবর্তীকালের কাজে দেখি যে, উনি বেশ সাদা লাইন ব্যবহার করেছেন, ওগুলো আমরা জানি তিনি কাগজে পরিকল্পিতভাবে মোম দিয়ে আগে একটা স্কেচের মতো করতেন তারপর যখন কালো কালি একটু পাতলা করে ওয়াশ দিতেন, তখন সেই সাদা লাইনগুলো বেরিয়ে আসত। জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের ছবিতে এ-দেশের মানুষের জীবনের যে দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরেছেন, তাঁর নবান্নতে আমি কিন্তু সেটা খুঁজে পাইনি। আমি এক ইঞ্চি বা দেড় ইঞ্চি কাগজ কেটে দুর্ভিক্ষের কাক, নর-888sport promo codeর চোখ, হাত, তাদের চাহনী আর নবান্নের যে মানুষ মিলিয়ে দেখেছি – সেই যে আর্তি, সেই যে যন্ত্রণা, সেটা কিন্তু আমি খুঁজে পাইনি। তার কারণ আমার যেটা মনে হয়েছে, নবান্নের কাজগুলোতে তিনি এ-দেশের জীবনযাত্রার ছবি আঁকতে চেয়েছেন। কিন্তু শহরে বসে সমাজের সব রকম কমফোর্ট নিয়ে ঠিক যন্ত্রণাটা তাঁর বুকে ছিল না। কিন্তু আমরা দেখি, মনপুরায় তিনি যে-কাজগুলো করেছেন, সেটার মধ্যে সেই দুর্ভিক্ষের মতো যন্ত্রণা রয়েছে। কারণ মনপুরায় কিন্তু তিনি ছুটে গিয়েছিলেন। ফলে হয়েছে কী যে, মনপুরার কাজে যতটা মানুষের বেদনা আমরা উপলব্ধি করতে পারি, সেটা আমরা কিন্তু তাঁর নবান্ন বিষয়ে, লম্বা স্ক্রল, সেটার মধ্যে খুঁজে পাই না। এরপরে জয়নুল আবেদিন যেসব কাজ করেছেন, আমাকে ঠিক তেমনভাবে আকৃষ্ট করেনি। জয়নুল আবেদিনের আরো কিছু কাজ আমার খুব ভালো লাগে, আমাকে খুব অ্যাপিল করেছিল। সে-কাজগুলো দেখার পর আমার নিজের আধুনিক চিত্রকলার দিকে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। সে-ছবিগুলো হলো – পেলিক্যানের (পেলিক্যানের রঙিন কালি ছিল লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি) রঙিন কালিতে ছোট ছোট কাগজে করা। সেটা ১৯৫৩ সালে, তিনি বেশকিছু কাজ করেছিলেন। যেমন ‘বাঙালি রমণী’ কিংবা ‘বেদেনি’, কিংবা এই জাতীয় বিশেষ করে বাঙালি রমণী দুটি বোন। আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, এই প্রথম তিনি বাংলার যে ফোক মোটিফ, সেটার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং এখানে বাংলার প্রবহমান লোক888sport live chat থেকেই শুধু মোটিভ নেননি, তাঁর অঞ্চলের যে মাটির পুতুল, ময়মনসিংহের যে মাটির পুতুল, সেটার আদলটা নিয়েছিলেন। ফলে জোড়া ভুরু এবং চিবুকের মধ্যে একটা অ্যাঙ্গুলার, যেটা ওই মাটির পুতুলগুলোতে দেখা যায়, তিনি ওটা থেকে অনুপ্রাণিত হন। আমরা জানি, যেমন কামরুল হাসান, তিনি শখের হাঁড়ি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, কালীঘাট থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন; কাইয়ুম চৌধুরী যেমন জামদানি শাড়ির জ্যামিতিক নকশা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন; রশিদ চৌধুরী যেমন সরাচিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। কিন্তু জয়নুল আবেদিন এই সময় যে-ছবিগুলো আঁকেন সে-ছবিগুলো একেবারে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক সেই পুতুলের। সেটা আমাকে খুবই আকৃষ্ট করেছিল।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.