আহমেদ মুনির
হাফসাকে নিয়ে মাঝে মাঝে সমস্যায় পড়ি আমি। ওর সঙ্গে কোন অভিজ্ঞতাটা বাস্তবে ঘটেছে আর কোনটা স্বপ্নে, সেটা গুলিয়ে ফেলি। যেমন জেলরোডের ঘটনাটা বাস্তবে ঘটেছিল কিনা আমি নিশ্চিত নই। বছরখানেক আগে হবে। এক সন্ধ্যায় পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বেরিয়েছি। ফুটপাতের এক কোণে ভ্যানের ওপর তালের ডাবের স্তূপ। নিপুণ দক্ষতায় তালশাঁস কেটে দিচ্ছিল ভ্যানওয়ালা। পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, – বুকিং ক্লার্ক মশায়, তালশাঁস খাওয়া হোক।
ফিরে দেখি হাফসা। তালশাঁস খেতে-খেতে মনে হলো, আজ সন্ধ্যার এলোমেলো বাতাস কোথাও আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে। হাফসার পরনে একটা হালকা নীল শাড়ি। কাঁধে কলেজের ব্যাগ। বাতাস ওর আলগা হয়ে থাকা চুলগুলো মুখের ওপর আছড়ে ফেলছিল বারবার। একটুর জন্য চুলের ডগাগুলো আমার মুখ স্পর্শ করল না। চুলের স্পর্শ পাওয়ার লোভে আমার আরেকটু কাছে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে হলো; কিন্তু সেটা করলাম না।
যেমন ছিলাম তেমনি দাঁড়িয়ে রইলাম। হাফসা আমার এই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে বলল, পায়ে শেকড় গজাবে, চলো হাঁটি।
সিনেমা প্যালেস, কে সি দে রোড, সোনালী ব্যাংক ফেলে আমরা ঢুকে পড়ি জেলরোডে। ডানে জেলখানার উঁচু পাঁচিল আর বাঁয়ে আমানত শাহের মাজার। আরেকটু এগোলে সারি সারি আতরের দোকান। একটার সাইনবোর্ডে লেখা – এক নম্বর মেশকাম্বর আতর পাওয়া যায়।
হাফসা আমাকে বলে, আজ কী সুন্দর বাতাস, ইচ্ছে হচ্ছে তোমাকে কিছু দিতে। কিছু একটা চাও।
আমি বললাম, বাতাসের সঙ্গে কিছু দেওয়ার সম্পর্ক কোথায়?
আছে। এমন বাতাসে আমার পূর্বাপর ভাবনা উড়ে যায়, তাই। তবে আবৃত্তি শুনতে চেয়ো না প্লিজ।
একশিশি মেশকাম্বর, আমি হাফসার দিকে ফিরে বললাম।
হাফসা অবাক হয়। সেটা কী?
আমি সাইনবোর্ড দেখিয়ে বলি, আতর।
হাফসা হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়ে সামনের দিকে। কানে আতরের তুলা গুঁজবে?
আমি বলি, হ্যাঁ, গুঁজব। খাঁটি এক নম্বর মেশকাম্বর আতর।
ফিরে দেখি হাফসা নেই। আতর কিনতে গেল না তো!
ওকে খুঁজতে আতরের দোকানগুলোতে ঢুঁ মারি। একটা দোকানে ঢুকে দেখি, কালো আলখাল্লাপরা এক লোক টুলের ওপর বসে বড় শিশি থেকে ছোট শিশিতে আতর ঢালছিল। মাথায় সুন্দর করে পাগড়ি বাঁধা। দেখে আমাকে ডাকল, আয়।
আমি কাছে যেতেই লোকটা একহাত আমার কাঁধের ওপর রাখল। তারপর বিড়বিড় করে কী যেন আওড়াতে লাগল। আমার মনে হলো লোকটা বলছে, ‘প্রেমরস কাব্যকথা সুগন্ধি শীতল/ শরীর ভাঙিয়া দেখি অন্তর নির্মল’। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এই দরবেশের মুখে মধ্যযুগের কবি মোহাম্মদ মুকিমের পয়ার!
দরবেশ আমাকে ইশারায় আরো কাছে আসতে বলে।
সে কী করে আমার মনের কথা পড়ল তা জানি না। বলল, মোহাম্মদ মুকিম আমি পড়ি নাই। একবার সাদা কাগজে মেশকাম্বর আতর ছলকাইয়া পড়ছে। দেখি, আতরে ভিজ্যা কাগজে এই লাইন দুইটা ভাইসা উঠসে। সেই আতর দেখবি?
দরবেশ একটা শিশি খুলে আমার নাকের সামনে ধরে।
সেই গন্ধ কিছুটা হাফসার গায়ের, কিছুটা পুরনো বইয়ের, কিছুটা সন্ধ্যামালতীর, কিছুটা আমি জানি না এমন কিছুর।
আমার মাথা ঝিমঝিম করে। চোখ বন্ধ করে সেই গন্ধের ভেতরে হারিয়ে যাই। এরপর কী ঘটেছিল আমার আর কিছু মনে নেই।
দুই
হাফসার সিলেবাস বদলে গেছে। গত দুই বছর শেক্সপিয়র পড়িয়েছে। এখন তাকে পড়াতে হবে টি এস এলিয়ট। দুদিন বাদেই ক্লাস। প্রথমে 888sport app download apk, এরপর এলিয়টের সমালোচনা-888sport live football। সেজন্যই ফোন। কবিরাজ ভবনে তলব। বলল, প্রুফক তো তোমার খুব প্রিয়। একবার আসবে, 888sport app download apkটা সম্পর্কে তোমার ভাবনা বলবে?
আমি ইংরেজির ছাত্র নই। মাসকয়েক আগে ফেসবুকে প্রুফকের প্রেমগীতি তুলে দিয়ে বলেছিলাম, প্রুফকের গান আজো কেন আমার ভেতরে বাজে? তাতেই কি হাফসার মনে হলো আমার কাছ থেকে ক্লাসে আলোচনার জন্য রসদ পাবে? কিন্তু আমি রাজি হলাম অন্য কারণে। হাফসাকে নিয়ে নতুন একটা স্বপ্ন দেখেছি। সেই স্বপ্নের কথাটা বলতে ইচ্ছে করছে। এবার ঠিক করেছি সত্যি-সত্যি যা দেখেছি তাই বলব।
ফিরিঙ্গিবাজারের মোড়ে শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবন নামের যে পুরনো বিল্ডিংটায় হাফসা থাকে সেখানে অনেককাল ধরেই আমার যাতায়াত। অবশ্য সেটা কবি শাহিদ আনোয়ারের কারণে; কিন্তু আশ্চর্য, প্রতিবেশী হলেও হাফসা তার নাম শোনেনি। আমি হাফসাকে প্রায়ই বলতাম, দোতলার যে-ঘরে থাকো তার কয়েক ঘর পরেই শাহিদ আনোয়ার থাকতেন। তার দুটো লাইনও আওড়াতাম। ‘চাঁদ বড় মুক্ত হস্ত, তাই/ এ ভবনে প্রত্যেকে এক ফালি জোছনা পেতে পারে।’ শুনে হাফসা কেবল ভ্রƒ-যুগল ওপরে তুলে বলত, ‘ও তাই!’
আমি হাফসার মুখে যত কথা শুনেছি, তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত হয়েছে। তাই বলে এটাকে ঠিক তাচ্ছিল্যও বলা যাবে না। ‘ও তাই’ যেন হাফসার চারদিকে এক সুরক্ষার দেয়াল। সেই দেয়াল ডিঙিয়ে আমি কখনো তাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলোর কথা বলতে পারিনি। বললেও বলেছি পরিমার্জন করে। অথচ কয়েক বছর ধরে আমি প্রায় প্রতিরাতেই হাফসাকে নিয়ে নানা ধরনের স্বপ্ন দেখছি। বেশিরভাগ স্বপ্নই যেমন হয়, এলোমেলো, মনে থাকে না। তাই হিজিবিজি সেসব পরম্পরাহীন দৃশ্য ছাপিয়ে কেবল স্বপ্ন দেখার অভিজ্ঞতাই স্থায়ী হয়। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি কেবল এটুকু মনে করতে পারি, হাফসাকে নিয়ে আরো একটা স্বপ্ন দেখলাম।
তবে মাঝে মাঝে সিনেমার এক-একটা দৃশ্যের মতো পুরো স্বপ্ন ধরা দেয়। মনে থাকে আগাগোড়া। তখন মনে হয়, এটা ওকে বলতেই হবে। কিন্তু বলতে গেলেই সেই দেয়াল। আমি দেয়ালের অন্য পাশ থেকেই হাফসাকে বলি, একটা স্বপ্ন দেখেছি। সে যথারীতি ভ্রƒ-যুগল ওপরে তোলে, আর বলে, ‘ও তাই!’ সেখানেই সেই কথার ইতি। আমিও বলি না। আর হাফসাও জানতে চায় না। কিন্তু স্বপ্ন দেখা তো থেমে নেই, নিয়ম করেই কয়েক রাত অন্তর স্বপ্নগুলো আসে। এমনও হয়েছে কয়েকটা রাত স্বপ্নহীন কেটে গেছে। তখন ঘুম থেকে উঠে নিজেকে শূন্য-রিক্ত মনে হয়েছে। কত রাতে বিছানায় শুয়ে প্রার্থনা করেছি, আজ অন্তত যেন স্বপ্ন দেখি।
তিন
‘বুনো মহিষের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে গেলে লরি/ বুকের পাঁজরাসহ কেঁপে ওঠে আমাদের পুরোনো ভবন।/ কখনো স্বপ্ন দেখি, এ ভবন ধসে পড়ে ভেঙে চুরমার/ কেউ বেঁচে নেই শুধু আমি একা/ দুহাতে সরিয়ে ধস পানকৌড়ির মতো ঘাড় তুলে চাইছি বেরোতে।’
শাহিদ আনোয়ারের ‘শ্রী শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবন’ নামের এই 888sport app download apk প্রায় বিশ বছর আগে প্রথমবার পড়েছি। এতদিন ধরে 888sport app download apkটা আমার ভেতর থাকতে-থাকতে যেন পুরনো ইমারতের চেহারা পেয়েছে। আমি চোখ বন্ধ করলেই কবিরাজ ভবন দেখতে পাই। দেখি, গভীর রাতে এক মাতাল কবিরাজ ভবনের সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। উঠতে-উঠতে গুনগুনিয়ে আস্কর আলী প-িতের গান গাইছে। রাস্তা কাঁপিয়ে ঝনঝন করে ট্রাক চলে গেলেও সুরটা চাপা পড়ছে না। আমি শুনি, ‘ডাইলেতে লড়ি চড়ি বইয়ো চাতকির ময়না রে, গাইলে বৈরাগীর গীত গাইও।’ শাহিদ আনোয়ার ভবনটা ছেড়ে চলে গেলেও এই সুরটা শোনার জন্য আমাকে নিয়মিত সেখানে যেতেই হয়। ব্যাপারটা এমন যে, কবিরাজ ভবনে যাতায়াত করাটা আমার জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভবনের নিচতলার পুরনো ছাপাখানাটা এখন বন্ধ। তবু যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকি তখন ছাপার কালি, কেপিএম কাগজ আর সোডার ঝাঁজাল গন্ধ নাকে এসে লাগে। আর প্রিন্টিং মেশিনের ঘটাং ঘটাং শব্দটা সিঁড়িঘরের দেয়ালে বাড়ি খেতে-খেতে একটা ছন্দও তৈরি করে। তার তালে-তালে পা ফেলে আমি ওপরে উঠে যাই। ওপরে উঠে বারান্দায় পায়চারি করতে-করতে শাহিদভাইয়ের বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াই। তারপর সে-দরজা পেরিয়ে বারান্দার শেষ মাথা পর্যন্ত হেঁটে আসি। চুন-সুরকির নকশা করা জাফরিকাটা রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বাইরের রাস্তার দিকে দেখি। ভাড়াটিয়ারা সবাই চলে যাওয়ার পর সুনসান বাড়িটাতে দারোয়ান হরিপদ ছাড়া কোনো জীবিত লোক দেখিনি বহুদিন। মাঝে মাঝে হরিপদের সঙ্গেই আড্ডা দিই। তার কাছ থেকে সস্তা রমনা সিগারেট চেয়ে নিয়ে দু-একটা টান দিয়ে পুরনো দিনের কথা শুনি। পুরনো দিনের কথা মানে হরিপদের বাবার গল্প। হুগলি আর কলকাতা থেকে জাহাজ এসে ভিড়লে মটকায় করে খাবার পানি সাপ্লাই দিত তার বাবা কৃষ্ণপদ। মাটির দশাসই মটকাগুলোতে আস্ত একজন মানুষ এঁটে যাবে। এমন কত মটকা তাদের ঘরের আঙিনায় পড়ে থাকতে দেখেছে। শহরের মগঘাট যে সময়টায় ব্যস্ত বন্দর ছিল। এখন এলাকাটাকে লোকে ডবলমুরিং বলে। সে-এলাকায় একনামে সবাই চিনত কৃষ্ণপদকে। কিন্তু হরিপদ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে পরিবারের ভালো অবস্থা কখনো দেখেনি। পানি সাপ্লাইয়ের ব্যবসা নাকি কবেই উঠে গিয়েছিল। বাবাকেও বেশিরভাগ সময় ঘরেই দেখত সে। অবশ্য বাবার অবস্থা পড়ে যাওয়ার পেছনে আফিমেরও অবদান কম ছিল না। এক সাহেবের কাছ থেকে নাকি এক কৌটা আফিম পেয়েছিল। সেই আফিম বাবা আর ছাড়তে পারেনি। না-হয় সদরঘাটে কি ফিরিঙ্গিবাজারে এমন বিল্ডিং থাকত তাদেরও।
আমি মাঝে-মাঝে ফিরিঙ্গিবাজারের ব্রিজ ঘাট, মাঝির ঘাট আর স্ট্র্যান্ড রোড ধরে হাঁটতে-হাঁটতে হরিপদের বাবার সময়টাকে মেলানোর চেষ্টা করি। আশি বছরের হরিপদ বাবার যৌবনের সময়কালটা কি ১৯০০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে হবে! ভাবতে-ভাবতে কখনো-কখনো হংকং রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার পর্যন্ত এসে থেমে যাই। হাফসার কথা মনে পড়ে। সব ভাবনা ছেড়ে তখন শ্যামাচরণ ভবনের দিকেই হাঁটতে থাকি।
কিন্তু হাফসাদের পরিবার যে ওই বিল্ডিংয়ে রয়ে গেছে সে-কথা হরিপদ আমাকে বলেনি। সেটা আমারই আবিষ্কার। এক বিকেলে সাধুর দোকান থেকে কড়া করে চিনি দেওয়া বিস্বাদ চা খেয়ে একটা মিষ্টিপান মুখে দিয়েছি। পানে খয়ের ছিল, এটা বুঝতে পারলাম রাস্তার ওপর আমার মুখ থেকে ফেলা পিক দেখে। দ্রুত সাধুর দোকানের শোকেসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম নিজের অবস্থা দেখতে।
হায় আল্লাহ! এ আমি, নাকি রেলওয়ের কোনো বুকিং ক্লার্ক!
শৈশবে রেলওয়ের বহু টিকিট বুকিং ক্লার্ককে দেখেছি পানের লাল রস ঠোঁটের দুই প্রান্ত দিয়ে গড়িয়ে পড়তে। 888sport sign up bonusটা মনে পড়ায় চায়ের বাজে স্বাদটা ভোলা গেল। চনমনে ভাব নিয়ে আমি হাঁটতে-হাঁটতে সোজা কবিরাজ ভবনের দোতলায়। অভ্যাসমতো বারান্দায় পায়চারি করতে-করতে সিগ্রেট ধরিয়েছি সবে, হঠাৎ কোনার দিকের একটা দরজা খুলে যায়। বিস্ময়ের ঘোর ভাঙার আগেই কখন যে খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি! ভেতর থেকে কেউ ‘আপনি?’ বলে না উঠলে হয়তো ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতাম। হালকা রঙের সুতির শাড়ি, লম্বাটে মুখ, কপালে একটা ছোট্ট টিপ। বেতের সোফায় বসা, এক হাতে আধখোলা বইটা ধরা। হাফসাকে প্রথম ওভাবেই আবিষ্কার করি আমি। এখনো যতবার যাই ঢুকেই দেখি হাফসা ওভাবেই বসে রয়েছে। বেতের সোফার এক প্রান্তে, হাতলের ওপর হাত রেখে।
হাফসার প্রশ্নে আমি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। কী বলব ভাবতে-ভাবতে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, বুকিং ক্লার্ক কথাটি। বললাম, আমি রেলওয়েতে চাকরি করি। বুকিং ক্লার্ক।
শুনে হাফসা হেসে গড়িয়ে পড়ল। নির্দোষ মিথ্যা কথা শুনে যে-ভঙ্গিতে লোকে হাসে, অনেকটা তেমনি। বলল, তা বুকিং ক্লার্ক সাহেবের ভেতরে আসা হোক।
চার
কয়েকদিন আগের কথা। পরীর পাহাড় থেকে নেমে হাঁটতে-হাঁটতে আলকরণের মোড়ে এসেছি। খানিক গেলেই কবিরাজ ভবন। দুপুরের তীব্র রোদে ঝলসাচ্ছে পথঘাট। সেখানেই দেখা শাহিদ আনোয়ারের সঙ্গে। সাধুর দোকানের সামনে ভ্যানে রাখা তরমুজের কাটা ফালিগুলোর দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে-ভাবতে ঘাম মুছছিলেন তিনি। আমি হাঁটার গতি কমিয়ে দিই। মনে-মনে তার ভাবনাটা পড়ার চেষ্টা করি। পলিথিনে 888sport app তরমুজের ফালিগুলো মাংসের টুকরোর মতো মনে হচ্ছে তার! নিচে রক্তের মতো জমেছে তরমুজের রস। কেমন নৃশংস। আমিও চমকে উঠে তার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো। আরে, শাহিদ তুমি! শাহিদ আনোয়ার আমাকে ডাকলেন ইশারায়।
আমি কাছে যেতেই বললেন, লোকে কেন জেনেশুনে এসব দূষিত খাবার খায় জানো?
বুঝলাম প্রশ্নটা একটা ভূমিকা। কিছু একটা বলতে চান হয়তো তিনি। তাই বললাম, না, ঠিক বলতে পারব না।
শাহিদভাই বললেন, আসলে মানুষের মধ্যে একটা আত্মধ্বংসের প্রবণতা আছে। জীবনটাই তো একটা ট্রমা, তাই না? সেই ট্রমার ভেতরে আবার বিচ্ছেদ, ব্যর্থতার ছোট-ছোট ট্রমা আছে। মানুষ সচেতনভাবে এসব না জানলেও ট্রমার ঘোরের মধ্যে থাকে বলে নিজের ক্ষতি করে সে।
ইয়ুঙের ট্রমাতত্ত্ব শাহিদভাইয়ের প্রিয় প্রসঙ্গগুলোর একটি। বহুবার তার মুখে এ-কথা শুনেছি। এই গরমে এখন আবার এ-বিষয়ে আলাপ শুরু হলে আধ ঘণ্টার আগে শেষ হবে না। আমি তাই প্রসঙ্গ পালটাতে চেষ্টা করি। তার আগেই দেখি শাহিদভাই নিউমার্কেটের দিকে হাঁটা শুরু করেছেন। ঘোরের মধ্যে হাঁটছেন না তো! ১৫ বছর আগে একবার এরকম ঘোরের মধ্যে হাঁটতে-হাঁটতে শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ফতেয়াবাদ চলে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে পৌঁছে ঘোর ভাঙে তার। কেন সেখানে গিয়েছিলেন আজো বলতে পারেন না। তবে এত বছরেও সেরকম ঘটনা আর দ্বিতীয়বার ঘটেনি। আমার তবু খানিকটা দুশ্চিন্তাই হলো। সেটা কেবল এ-কারণে নয় যে, আমি তার স্নেহধন্য ভক্ত-পাঠক। বরং গত কয়েক বছরে কবি-পাঠকের গ-ি ছাপিয়ে অন্য মাত্রা পেয়েছে আমাদের সম্পর্ক। হয়তো আমার নামের কারণেই এটা হয়েছে। আমাদের দুজনের একই নাম।
প্রথম পরিচয়ের দিন শাহিদ ভেবেছেন আমি ইয়ার্কি করছি। ’৯৫-৯৬ সালের কথা। সে-সময় পুরনো বইয়ের দোকান – অমর বইঘর থেকে অচিরা পত্রিকার কয়েকটা কপি সংগ্রহ করি। সেখানেই পড়েছি শাহিদ আনোয়ারের ‘ধাত্রী’, ‘নার্স’, ‘ক্রমাগত আটচল্লিশ ঘণ্টা হরতালের পর’ 888sport app download apkগুলো। হঠাৎ এমন আবিষ্কারের পর শাহিদকে খুঁজতে শুরু করলাম। খবর পেলাম, দৈনিক পূর্বকোণে সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করেন। একদিন সেখানেই হাজির হলাম। বার্তাকক্ষে লম্বা টেবিলের দুই প্রান্তে দশজনের মতো লোক কাজ করছিলেন। তাদের মধ্যে শাহিদ আনোয়ারকে খুঁজে পেতে বেশ সময় লাগল। মাঝের একটা চেয়ারে অনেকটা আত্মগোপন করে ছিলেন যেন। কাছে গিয়ে বললাম, একটু কথা আছে। প্রথমে মাথা তুললেন না। তারপর অনেকদূর থেকে যেন তাকালেন আমার দিকে।
আপনি?
কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, আমি শাহিদ, শাহিদ আনোয়ার।
পত্রিকা অফিসের নিচে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দিতে-দিতে দুপাশে মাথা নাড়ছিলেন তিনি। বলেছিলেন, তা কী করে হয়?
আমি বললাম, কেন নয়? একনামে দুজন থাকতে পারে না?
তাই বলে শাহিদ আনোয়ার, শাহিদ আলম বা শাহেদুল ইসলাম নয়!
বললাম, হ্যাঁ, হতেই পারে। হলো তো।
বানিয়ে বলছ না তো! ওই একবারই কেবল সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন তিনি। তবে এরপর এ-নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করেননি কখনো। কেবল শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবনে গেলে বলতেন, শাহিদ আনোয়ার এসেছে শাহিদ আনোয়ারের বাড়ি। কিন্তু এখন তো শাহিদ ভাই শ্যামাচরণ ভবন ছেড়ে হালিশহরে গিয়ে উঠেছেন। ওই বিল্ডিংটা ভেঙে ফেলার জন্য সিডিএ নোটিশ দিয়েছে। বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াদের সে-কথা জানানোর দুই মাসের মধ্যে প্রায় সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কেবল হাফসার পরিবার ছাড়া। এ নিয়ে হাফসার মধ্যে আমি কোনো দুশ্চিন্তার ভাবও লক্ষ করিনি। এ-বাড়িতে কে থাকবে না থাকবে তাতে তার কিছুই যেন যায় আসে না। আর সে তো নিজের প্রতিবেশীদের দিকেও ভালো করে তাকিয়ে দেখেনি কখনো। শাহিদভাইয়েরা যে এ-বাসায় থাকত সে-নিয়েও ওর কোনো আগ্রহ নেই। কেন নেই, আমি জানি না। মনে হয়েছে হাফসা এমনই।
পাঁচ
‘লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফক’ আমার প্রিয় 888sport app download apk নয়। আদৌ এ-888sport app download apk পুরোপুরি আমি বুঝতে পেরেছি এমনও নয়। তবে নানা কারণেই 888sport app download apkটি আমার 888sport sign up bonusর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কলেজে পড়ার সময় গ্রীষ্মের দুপুরে প্রায়ই চলে যেতাম লালদিঘির পাড়ে। দিঘির পাশেই একটা সাদা দালানে ছিল ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি। সেই একানব্বই-বিরানব্বই সালে চাটগাঁ শহরে আর কোথাও এমন সস্তায় এসির ঠান্ডা বাতাস মিলত না। লাইব্রেরিতে ঢুকলেই গা জুড়িয়ে যেত। সেখানে ঢুকে মোটা একটা বই বেছে নিয়ে চেয়ার দখল করাই ছিল আমার প্রথম কাজ। তেমনি একটা মোটা বই ছিল টি এস এলিয়টের রচনাসমগ্র। আমি বইটা খুলে প্রায় সময় ওই অদ্ভুত 888sport app download apkটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ভাবতাম জে আলফ্রেড প্রুফক লোকটা কে? কেনই বা তার প্রেমগীতি লেখা হলো? ভাবতে-ভাবতে আমি ঝুঁকে পড়তাম টেবিলের ওপর। খোলা বইয়ের মাঝের পাতাগুলো বিছানার চাদরের মতো সরল-সুন্দর মনে হতো। কখন ঘুমিয়ে পড়তাম টেরই পেতাম না। ঘুমাতাম যতক্ষণ না আকাশি শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা কাউন্সিলের কর্মকর্তা টেবিলে টোকা দিয়ে জাগিয়ে দিত আমাকে। সাপের মতো হিসহিসিয়ে লোকটি বলত, ইউ শুড নট সিøপ হিয়ার।
কিন্তু হাফসাকে এসব কে বোঝাবে। তা ছাড়া প্রুফক নিয়ে কথা বলতে আমি তো নিজে থেকেই রাজি হয়েছি। এই সুযোগে হাফসাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের কথাগুলো বলতে পারব এই ভেবে।
প্রুফক নিয়ে আলাপের সময়টা পার হয়ে যাচ্ছিল। হাফসার ক্লাস শুরুর আগেই আমার যাওয়া উচিত; কিন্তু চেষ্টা করেও পারছিলাম না। ফিরিঙ্গিবাজারের ফলের আড়ত পার হয়ে একটু সামনে এগোলে দোভাষদের বাড়ির ঠিক উলটো দিকেই কবিরাজ ভবন। ঠিকানাটা আমার মুখস্থ। তবু বারবার পথ হারাচ্ছিলাম আমি। কালীবাড়ির মোড়, ফলের আড়ত ফেলে দোভাষদের বাড়ির সামনে এসে উলটোদিকে তাকিয়ে কবিরাজ ভবন দেখতে পাচ্ছিলাম না আমি। আশপাশের দোকানগুলোতে জিজ্ঞেস করলে তাদের
কেউ-কেউ অবাক হয়ে তাকিয়েছে। আর কয়েকজন যেদিকে দেখিয়ে দিয়েছে সেখানে কবিরাজ ভবনের বদলে দাঁড়িয়েছিল আস্ত নতুন একটা দালান।
আসলে আমি ভেবে দেখেছি কবিরাজ ভবন খুঁজে পাওয়া নির্ভর করে আমার ইচ্ছাশক্তির ওপর। অনেকের বিশ্বাস নাও হতে পারে, তবু আমার ক্ষেত্রে এটা ঘটে। আমি মনেপ্রাণে না চাইলে বা তীব্র ইচ্ছা পোষণ না করলে ঠিকঠাক জায়গামতো পৌঁছাতে পারি না কখনো। এমনও হয়েছে, আমি টাইগারপাস যাব বলে বেরিয়েও দেওয়ানহাট চলে গেছি।
তবে একদিন সন্ধ্যার ঠিক পরে কবিরাজ ভবন খুঁজে পাই আমি। গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখি হরিপদ টুলে বসে ঝিমাচ্ছে। গেট খোলার শব্দে হরিপদ জেগে ওঠে। আমাকে দেখে ইশারায় টুলের ওপর বসতে বলে। বুঝতে পারি, হরি আজ আবার গল্প বলবে। আমি সিগ্রেট ধরিয়ে অপেক্ষা করি। কিন্তু হরিপদের হাবভাবে গল্প বলার কোনো লক্ষণ নাই।
ফস করে সিগ্রেট ধরিয়ে সে আমাকে প্রশ্ন করে, কেন আস এইখানে?
আমি উত্তর দিতে পারি না। হাফসার কথাও বলতে ইচ্ছে হয় না। অনেকক্ষণ পর হরিপদ বলতে শুরু করে –
হালিশহর বালামিপাড়ার কালিপদ মিস্ত্রি ছিলেন তার বড় জ্যাঠা। দোভাষদের জন্য তার কালিপদ দুটি বড়সড় অর্থাৎ পালের জাহাজ বানিয়েছিলেন। নাম ‘আমেনা খাতুন’ আর ‘জামেনা খাতুন’।
এই পর্যন্ত বলে হরিপদ থামে। আমি ভাবতে থাকি, আমেনা আর জামেনা নামের কাঠের জাহাজের সঙ্গে আমার এখানে আসার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা? আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। হরিপদ আবারো বলতে শুরু করে। ওই দুটি জাহাজের একটাতে পানি সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব পড়ে তার বাবা কৃষ্ণপদের ওপর। জাহাজে মালবোঝাই হওয়ার পর কাপ্তান নসু মালুম খুশি হয়ে তার বাবাকে এক শিশি আতর উপহার দিয়েছিল। সেই আতরের এমন খুশবু যে, গায়ে মাখতে হতো না। একবার ছিপি খুললে এক সপ্তাহ পর্যন্ত গন্ধ থাকত সারা ঘরে। কোনো কারণে আফিমের নেশায় আচ্ছন্ন কৃষ্ণপদ সেই আতর আর ব্যবহার করেনি। কৃষ্ণপদের মৃত্যুর পর হরিপদ সেই আতরের শিশি পায়। কিন্তু কী কাজে লাগবে, এটা ভেবে না পেয়ে এই বাড়ির কর্তা শ্যামাচরণ কবিরাজকে দিয়েছিল শিশিটা। শ্যামাচরণ উদার মানুষ। সেই তিপ্পান্ন সালে তাকে দশ টাকা বকশিশ দিয়েছিল।
এটুকু বলে হরি আবারো থামে। আমার দিকে তাকিয়ে একদিন পূর্ণিমার সময় আসতে বলে। পূর্ণিমার রাতে জোরে বাতাস দিলে এখনো পুরনো বিল্ডিংয়ের ইট-পাথর থেকে এই ঘ্রাণ ওঠে নাকি পাক খেয়ে। বিল্ডিংয়ের মানুষজনও বিষয়টা জানত। সে-সময় সবাই কেমন দিশেহারা বোধ করত। কেউ বেহুদা কান্না জুড়ে দিত আর কেউ বা জোরে-জোরে আঙুর বালার রেকর্ড বাজাত।
ছয়
সেদিন পূর্ণিমার রাত ছিল। জোরে বাতাসও বইছিল। কোনো ভুল না করে আমি কবিরাজ ভবনে সিঁড়িঘরে এসে পড়েছিলাম। অনেকগুলো ভিন্ন-ভিন্ন সিঁড়ি দোতলার সামনের ও পেছনের অংশের সঙ্গে লাগানো। কোনোটা সামনের দিকের ফ্ল্যাটগুলোর সদর দরজা দিয়ে ঢোকার আর কোনোটা পেছনের অন্দরমহলে যাওয়ার জন্য। গোলাকৃতি ভবনটার মাঝখানে বড় আঙিনায় পূজার ঘর, আর কুয়া ছিল একসময়। এখন সেখানে জঙ্গল। পেছনের ফ্ল্যাটগুলো থেকে বাসিন্দারা চলে যাওয়ায় সেদিকটা গাঢ় অন্ধকারে ডুবে আছে। কেবল হাফসাদের অংশে অর্থাৎ সামনের বারান্দায় চাঁদের দুধভরা বাটি কেউ যেন উলটে দিয়েছে। ভেজা আলো মাড়িয়ে হাফসার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। ঘরের আলো নেভানো, নাকি বিদ্যুৎ নেই কে জানে। বসার ঘরে হাফসাও নেই। কর্ণফুলীর বাতাসে জানালার পর্দাদুটো হাত-ধরাধরি করে হাঁটতে-থাকা দুই মাতালের মতো বারবার হোঁচট খেয়ে পড়ছে গ্রিলগুলোর ওপর।
বাতি জ্বালাব? হাফসা কখন এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ করিনি। বললাম, না দরকার নেই।
আমরা পেছনের বারান্দায় এসে বসলাম। সিমেন্টের আসনে পা ঝুলিয়ে জঙ্গলে-ছাওয়া আঙিনা দেখছিলাম। আমি জোরে নিশ্বাস নিলাম, কিন্তু কোনো ঘ্রাণ পেলাম না। তবে কি হরিপদের কথাগুলো কেবলই গালগল্প?
হাফসা হাসল। বলল, ওভাবে নিশ্বাস নিচ্ছ কেন?
এমনি।
তাহলে প্রুফকের কথা বলবে?
না, আমি আসলে ওই 888sport app download apk কখনো ভালো করে বুঝিনি।
নিজের গলার স্বরের দৃঢ়তা দেখে নিজেই অবাক হই আমি।
তাহলে এলে যে?
হাফসা আমার পাশ থেকে উঠে গিয়ে একটা মোড়া টেনে মুখোমুখি বসে। আজ বেগুনি রঙের শাড়ি পরেছে সে। বাতাস ওর আলগা হয়ে থাকা চুলগুলো মুখের ওপর আছড়ে ফেলছিল বারবার। একটুর জন্য চুলের ডগাগুলো আমার মুখ স্পর্শ করল না।
আমি বললাম, তোমাকে নিয়ে প্রতিদিন স্বপ্ন দেখি হাফসা।
সে-কথা যেন হাফসার কানে গেল না। সে মোড়াটা আরেকটু সামনে টেনে বসল। ওর চুলগুলো তখন আমার স্পর্শের আওতায়।
হাফসা আমার দিকে আরো খানিকটা ঝুঁকে পড়ে।
কী দেখ স্বপ্নে?
বললাম, এসব দেখি।
হঠাৎ মনে হলো এটা বাস্তব না স্বপ্নদৃশ্য, সে-বিষয়টা আমি নিশ্চিত হইনি। আশঙ্কার কথাটা হাফসাকে জানালাম। বললাম, দুই বছর আগে সবাই বিল্ডিংটা ছেড়ে চলে গেছে। এতদিনে এখানে নতুন ভবন উঠে যাওয়ার কথা। অথচ এখনো এখানে আমি আসছি। আর মাঝে মাঝে বিল্ডিংটা খুঁজেও পাচ্ছি না।
হাফসা বলল, হয়তো বিল্ডিংটা নেই। আর তোমার নামও শাহিদ আনোয়ার না। হয়তো কবিরাজ ভবনেও তুমি কোনোদিন আসনি।
আমি বলি, তবে, আমি যে আসিনি এটাই কি বাস্তব?
হাফসা দুপাশে মাথা নাড়ে। বলে, না, সেটা ধরো একটা দুঃস্বপ্ন।
আঙিনা থেকে ঝপ করে একটা শব্দ উঠল। পেছনের নারিকেলগাছটা জোরে-জোরে দুলছে। বাতাসের উন্মাদনা বাড়ছিল ক্রমশ।
হাফসার চুলের ডগাগুলো আমার মুখ স্পর্শ করছিল।
মুখটা না সরিয়ে ফিসফিসিয়ে হাফসা বলে, আজ কী সুন্দর বাতাস, ইচ্ছে হচ্ছে তোমাকে কিছু দিতে। কিছু একটা চাও।
আমি এবার বাতাসের সঙ্গে কিছু দেওয়ার সম্পর্ক খুঁজলাম না; কিন্তু মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো ‘মেশকাম্বর’। হাফসা মোড়া ছেড়ে এবার ঘন হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের মাঝে প্রায় কোনো দূরত্ব না রেখেই।
পাচ্ছ ঘ্রাণ? হাফসা নিজেকে এগিয়ে দেয় আমার আরো কাছে। আমি চোখ বন্ধ করে ধীরে-ধীরে নিশ্বাস নিই। আশ্চর্য, সেই ঘ্রাণ। কিছুটা হাফসার গায়ের, কিছুটা পুরনো বইয়ের, কিছুটা সন্ধ্যামালতীর, কিছুটা আমি জানি না এমন কিছুর।
আমার মাথা ঝিমঝিম করে। তীব্র ঘ্রাণের ভেতরে তলিয়ে যেতে-যেতে আমি শুনতে পাই, দূরে কেউ যেন আঙ্গুরবালার রেকর্ড বাজাচ্ছে।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.