সংগীতসাধিকা গিরিজা দেবী

স্বপন সোম

বয়স নববইয়ের কাছাকাছি; কিন্তু কণ্ঠে সুর ফুরোয়নি। তাই এখনো এই আটাশি বছর বয়সেও তাঁকে শুনতে পাওয়া যায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। এই চলে গেল যে-অক্টোবর তার শেষদিকেও তাঁর অনুষ্ঠান করার কথা ছিল দু-জায়গায়। কিন্তু বিধি বাম। তার আগেই ঠুংরি-সম্রাজ্ঞী গিরিজা দেবী চলে গেলেন সব ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত ২৪ অক্টোবর তাঁর কণ্ঠ স্তব্ধ হলো বটে, কিন্তু রয়ে গেল তাঁর অসংখ্য অসামান্য গান। ঠুংরিতেই তাঁর সবিশেষ খ্যাতি তবে খেয়াল, টপ্পা, দাদরা, কাজরি প্রভৃতি নানা ধরনের গানেই ছিল তাঁর সহজ সিদ্ধি। সংগীত তাঁর ভালোবাসা, সংগীত তাঁর প্রাণ, সংগীত তাঁর জীবন। তিনি সর্বার্থেই এক সংগীতসাধিকা।

১৯২৯-এর ৮ মে এক ব্রাহ্মণ জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম উত্তর প্রদেশের এক গ্রামে। বড় দুই বোন ও বাবা-মায়ের সঙ্গে সেখানে শৈশবের কিছুটা কাটানোর পর দু-বছর বয়সে বেনারস আসেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, বেনারসে তাঁদের বাসস্থানের কাছেই ছিল ‘কবীর চৌরা’, যেখানে সব ওস্তাদণ্ড888sport live chatীর বসবাস যথা – কণ্ঠে মহারাজ, কিষণ মহারাজ, হনুমান প্রসাদ, বড়ে রামদাস, সহায় রাজন-সাজন মিশ্র। বাবা রামদেও রাই ভালো হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন, গানের প্রতি তাঁর একটা ভালোবাসা ছিল। আরো নানাদিকে রামদেওর আগ্রহ ছিল। তিনি ছোট গিরিজাকে ঘোড়ায় চড়া শিখিয়েছিলেন। ছোট বয়সেই গিরিজা সাঁতার কাটা শিখেছিলেন। গঙ্গার ধারে ধারে তাঁর জীবন আবর্তিত। তাঁর মাছ ধরাও ভালো লাগত। পুতুলের শখ গিরিজার বরাবর (পরিণত বয়সের জন্মদিনেও তাঁকে অনেকে পুতুল উপহার দিতেন)। ছোট বয়সেই একবার গিরিজার মুখে পুতুলের বিয়ের গান শুনে বাবা রামদেওর খুব ভালো লাগল। গিরিজার গানবাজনার প্রতি টান সে-সময় থেকেই। এসব দেখেশুনে রামদেও মেয়েকে খেয়াল, টপ্পা ইত্যাদি শেখানোর জন্য কণ্ঠ888sport live chatী ও সারেঙ্গীবাদক সরযূপ্রসাদ মিশ্রের কাছে নিয়ে গেলেন। গিরিজার বয়স তখন চার। শুরু হলো তালিম। ন-বছর বয়সে গিরিজা একটি live chat 888sportেও (ইয়াদ রহে) কাজ করেন। সরযূপ্রসাদ মিশ্র মারা যাওয়ার পর শ্রীচাঁদ মিশ্রের কাছে তালিম নিতে শুরু করেন। তবে বাড়িতে বাবা ছাড়া আর কেউ গানের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না। মাত্র পনেরো বছর বয়সে গিরিজার বিয়ে হয়ে যায় মধুসূদন জৈন নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। সুখের কথা, মধুসূদন ব্যবসায়ী হলেও গান, 888sport app download apk ভালোবাসতেন। স্ত্রীর সংগীতচর্চা অতএব অব্যাহত রইল। এক বছর পর তাঁদের এক কন্যাসন্তান জন্মাল। এর কিছু পরপরই গিরিজা অনুভব করলেন যে, মেয়ে-সংসার সামলে গানের রেওয়াজ, চর্চা ঠিকমতো হচ্ছে না। গিরিজার সংগীতচর্চা নিয়ে মধুসূদন খুবই উৎসাহী ছিলেন। তাই ঠিক হলো বেনারসের কাছে সারনাথে গিরিজা চলে যাবেন শুধুই সংগীতানুশীলনের জন্য। এক বছর সেখানে ছিলেন গিরিজা কাজের এক মেয়েকে নিয়ে। মেয়ে রইল গিরিজার মায়ের জিম্মায়। সারনাথে প্রতি সন্ধ্যায় স্বামী মধুসূদন ও সংগীতগুরু শ্রীচাঁদ মিশ্র আসতেন। নিবিড় তালিম ও চর্চা চলল এক বছর। তারপর সংগীত-সম্পর্কে এক আশ্চর্য বোধ নিয়ে বেনারস ফিরলেন গিরিজা।

সাধারণের জন্য তাঁর প্রথম অনুষ্ঠান ১৯৪৯-এ এলাহাবাদ রেডিওতে। আর প্রথম উন্মুক্ত অনুষ্ঠান সম্ভবত ১৯৫১-তে বিহারের আরায়। তারপর গিরিজা ভারতের নানা জায়গায় বিভিন্ন সংগীত-সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। তবে কোনো ব্যক্তিগত মেহফিলে তথা কনসার্টে তিনি কখনো অংশ নেননি, কেননা স্বামী মধুসূদন তা একেবারেই পছন্দ করতেন না। বিভিন্ন সংগীত-সম্মেলনে গাইতে গিয়ে তাঁর পরিচয় হলো প–ত রবিশংকর, ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ, প–ত কিষণ মহারাজ প্রমুখের সঙ্গে। এঁরা ছিলেন তাঁর বিশেষ সুহৃদ।

১৯৭৫-এ স্বামী মারা গেলেন। সংগীতপ্রেমী স্বামীর মৃত্যুতে গিরিজা খুবই মর্মাহত হলেন। গানবাজনা আর করতে ভালো লাগছিল না। সংসারের সব দায়িত্বও এসে পড়ল গিরিজার ওপর। প্রায় এক বছর সংগীতচর্চা বন্ধ রইল। তারপর বন্ধুবান্ধব-শুভার্থীদের কথায় আবার গানে ফেরা। আমৃত্যু সংগীতে নিবেদিত রইলেন এই সংগীতসাধিকা।

খেয়াল, দাদরা, টপ্পা, চৈতি, কাজরি গাইলেও তাঁর সমধিক প্রসিদ্ধি ঠুংরিতে। পূরব অঙ্গের ঠুংরি। তার মেজাজই আলাদা। ঠুংরি নিয়ে নানারকম চিন্তাভাবনা ছিল গিরিজা দেবীর। নিজেও কিছু ঠুংরি তৈরি করেছিলেন। ঠুংরিতে একটা নতুনত্ব আনার প্রয়াস করেছিলেন তিনি। লোকসংগীত থেকেও তিনি ঠুংরির উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, ঠুংরিতে প্রকাশ করা যায় সেই ভালোবাসা, যা কখনো কামনা, কখনো ডিভোশন (devotion)। ঠুংরির কথা তথা কাব্যমূল্য সম্পর্কেও গিরিজা বিশেষ সচেতন ছিলেন। ফলে তাঁর রেওয়াজি কণ্ঠে, নিজস্ব অনুভবে ঠুংরি এক অপরূপ মাত্রা পেয়েছিল। সেখানে নাটকীয়তা আছে, কিন্তু তার বাড়াবাড়ি নেই। গিরিজা দেবীর ঠুংরির ‘রস’, মেজাজই স্বতন্ত্র। তাঁর কণ্ঠে বিশেষভাবে 888sport app download for androidীয় ভৈরবী ঠুংরি – ‘রসকে ভরে তোরে নয়না’। তাঁর অন্য কিছু উল্লেখযোগ্য গান : ‘বরষণ লাগি’, ‘রুমা ঝুম’, দাদরা – ‘হামসে করনা বাহানা’ ইত্যাদি।

888sport live chatী হিসেবে অগণিত শ্রোতার ভালোবাসা পেয়েছেন গিরিজা দেবী। কিছু প্রাতিষ্ঠানিক 888sport app download bdও পেয়েছেন। যেমন : পদ্মশ্রী (১৯৭২), সংগীত নাটক আকাদেমি 888sport app download bd (১৯৭৭), পদ্মভূষণ (১৯৮৯), পদ্মবিভূষণ (২০১৬); তা ছাড়া তানসেন সম্মান, ডোভার লেন সংগীতসম্মান। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তাঁকে ‘সংগীত মহাসম্মান’ (২০১২) এবং ‘বঙ্গবিভূষণ’ (২০১৬) উপাধি প্রদান করে।

গানবাজনার পর তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্ত্ত ছিল বোধহয় পান। সারাদিনই তিনি পান খেতেন। আর একটি ভালোবাসার জিনিস ছিল – সিনেমা।

নির্মল রঙ্গ-রসিকতার জন্য গিরিজা দেবী আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধবের খুবই প্রিয় ছিলেন। তাছাড়া তাঁর হৃদয়টি ছিল স্নেহ-মমতায় ভরা, যার পরিচয় সংশিস্নষ্ট অনেকেই পেয়েছেন। কলকাতায় আইটিসি সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তার সঙ্গে যুক্ত। সেখানেই থাকতেন। আর সেখানেই মহাপ্রয়াণ।

কালের নিয়মে মানুষকে চলে যেতে হয়, কিন্তু থেকে যায় তার কৃতি। সংগীতসাধিকা গিরিজা দেবী বেঁচে থাকবেন তাঁর গানের মধ্যে। গান শুধু চিরদিন থাকে। r