সাদা কুকুর

888sport app আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টের প্যাসেঞ্জার রিসিভিং করিডোর। নিজ নিজ যাত্রীর জন্যে অপেক্ষমাণ 888sport app মানুষের সঙ্গে অপেক্ষা করছে পাবনার সাধুপাড়ার দক্ষিণে কোশাখালি চর থেকে আসা দুজন মানুষ, একজন পুরুষ ও একজন মহিলা। সকলের অন্বেষণরত চোখ ভেতরের দিকে দেখার চেষ্টা করছে বিদেশবিভুঁই থেকে আসা আত্মীয়-পরিজনকে অথবা বন্ধুকে। কেউ কেউ ধোপদুরস্ত কাপড় পরে হাতে ইংরেজিতে অতিথির নাম লেখা ছোট ছোট প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো বিদেশী কাছে এলেই দেখাবার চেষ্টা করছে প্ল্যাকার্ড।

কখনো ইমিগ্রেশন কাউন্টার পয়েন্টের বা কখনো লাগেজ বেল্টের দিকে তাকিয়ে সরু চোখে মাথা উঁচু করে সালেহাকে দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, চোখে মাইনাস থ্রি পয়েন্ট ভাইভ জিরো পাওয়ারের কালো ফ্রেমের চশমা ও শাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা, ছাপ্পান্ন বছর বয়সী কোশাখালি থেকে আসা তার বাবা। সালেহার বাবার পাশে পাবনার তাঁতের শাড়ি, হালকা আকাশি রং, পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ বছর বয়সের মাঝামাঝি তার মা, উচ্চতা পাঁচ ফুট হবে, তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক, চোখে বিস¥য়, কত রকমের রঙিন মানুষ। সালেহার বড় ভাই, বাবার মতো প্রায় ছয় ফুট লম্বা, চুলের সিঁথি ডানে, গ্যাবার্ডিন কাপড়ের অফ হোয়াইট প্যান্ট ও নীল শার্ট পরনে, আমজাদ করিডোরের অন্য জায়গা থেকে দেখার চেষ্টা করছে। কে সালেহাকে আগে দেখেছিল, চিনতে পেরেছিল, এই নিয়ে তার বাবা, মা আর ভাই, যে-বর্ণনা কোশাখালির মানুষদের কাছে দিয়েছিল তা  পরী-দেখা গল্পের মতো।

পাবনা বাজারের বিসমিল্লাহ বস্ত্রালয়ের মালিক মুহম্মদ নায়েবউদ্দিনের ছোট মেয়ে সালেহাকে ছোটবেলায় তার পড়শিরা বলত পরী। রোদের মধ্যে সালেহা ৪/৫ মিনিট দৌড়াদৌড়ি করলে মুখ হয়ে যেত রুজ-মাখা। সেই ছোটকালেই পড়শিদের কেউ কেউ হেসে হেসে, সালেহার মার গায়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে, পানে চুন লাগাতে লাগাতে বলত, ‘বু, এই মিয়েক বেটার বৌ করবই’। সালেহা যত বড় হতে লাগল, গ্রামের তরুণদের সালেহাদের বাড়ির আশেপাশে হাঁটাচলা, বাঁশি বাজানো, শিস দেওয়া বাড়তে থাকে। এস এস সি পাশ করবার পরেই নায়েবউদ্দিন সালেহাকে পাবনা শহরে তার ভাই আরেফউদ্দিনের কাছে পাঠিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য, ছেলেদের উৎপাত থেকে বাঁচানো আর কলেজে পড়া। টাকা-পয়সার অভাবে নায়েবউদ্দিন বেশিদূর লেখাপড়া করতে না পারলেও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাবার ব্যাপারে টাকা-পয়সা খরচ করতে কখনো পিছপা হয়নি। পাবনা মহিলা কলেজে সালেহা মাত্র ছমাস পড়বার সুযোগ পেয়েছিল। এর মধ্যে তার চাচা আরেফউদ্দিন মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। ছেলে আসছে আমেরিকা থেকে মাত্র দুমাসের জন্য, ছেলের কোনো চাওয়া নেই, পাবনার ছেলে, শুধু মেয়ে সুন্দরী হলেই চলবে, বিয়ের ছমাসের মধ্যেই মেয়েকে নিয়ে যাবে। টমটমের চাকায়, ঘোড়ার খুরে চরের ধুলোবালি উড়িয়ে একদিন নতুন বরসহ সালেহা পাবনা শহর থেকে কোশাখালি আসে, থাকে দুদিন। তৃতীয় দিন আবার ধুলোবালি উড়িয়ে, পড়শি তরুণদের শিস আর বাঁশি বাজানো থামিয়ে দিয়ে নতুন বরকে আমেরিকার উদ্দেশে প্লেনে তুলে দিতে সালেহা 888sport appয় যায়। 888sport appয় সালেহা তার বরের বোনের বাসায় কিছুদিন ছিল। সালেহার বর তার বোনকে বলেছিল, সালেহাকে একটু স¥ার্ট করে দিতে এবং দু-চারটি ইংরেজি কথা শেখাতে। আমেরিকায় যাওয়ার আগে সালেহা কদিন ছিল কোশাখালি। নায়েবউদ্দিন মোট তিনবার এয়ারপোর্টে আসে। প্রথমবার আসে নতুন জামাইকে তুলে দিতে, দ্বিতীয়বার মেয়েকে এবং তৃতীয়বার পাঁচ বছর পর আসে মেয়ে সালেহাকে রিসিভ করতে।

আমজাদের দাবি সে-ই প্রথমে সালেহাকে দেখে। সালেহা দাঁড়িয়েছিল লাগেজ বেল্টের পাশে, ওর পায়ের কাছে একটা সাদা ছোট কুকুর লেজ নাড়ছিল আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। আমজাদ ভেবেছিল কুকুরটা কোনো সাহেবের হবে। কেননা ছয় ফুটের মতো ল¤¦া এক সাহেব সালেহার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সালেহা ওই সাহেবের সাথে দু-একবার কথাও বলেছে। রিসিভ করতে আসা অপেক্ষমাণ মানুষের দিকে সালেহা কয়েকবার তাকিয়েছিল, খুঁজেছে, কে তাকে নিতে এসেছে। আমজাদের মাথাতেই আসেনি যে, তার বোন আমেরিকা থেকে কুকুর নিয়ে আসবে। সালেহার পরনে জি›েসর প্যান্ট, সিল্কের শার্ট আর বুকের দু-পাশ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া খয়েরি রঙের ওড়না দেখে তার প্রথমে খটকা লাগে। যে-বোন পাঁচ বছর আগে হালকা নীল সালোয়ার, কামিজ ও সাদা ওড়না পরে দেশ ছেড়েছিল সেই বোনের পোশাক ছেলেদের মতো হবে, আমজাদ ভাবতে পারেনি।

গোল হয়ে বসা পড়শি মহিলাদের কোনো একজনের দিকে পানে চুন লাগিয়ে এগিয়ে দিতে দিতে সালেহার মা হাসে আর বলে, ‘কি কব বু, মিয়েক তো ফাক তেন দেখে চিনবেরই পারি নাই, আরো ধলা হয়ছে, চুলগুলা ফুরফুর করতেছিল, ছোটকালে তুমরা ওরে পরী কইতে না? চোখে নীল চশমা, আগে তো ও চশমা পরতে না, তুমাকও পান দিচ্ছি বু, খর দেব? মাঝখানে কাচ, পরথমে মনে হইলো আমার সালিহাই, কিন্তু ওরে বড় বড় লাগে, ও তো অত দিঙলে না, উয়ের বাপেক কলেম ওই-তো আমারে মিয়ে, উয়ের বাপ কয় উডা না, উডা না, পরে মিয়ে যখন কট কট হাইটে কাছে আইসলে দেখি কি উঁচে এক জুতে পরেছে, আমজাদরে কয় হাই, আমি হাসি, কি কইল বুঝলাম না, কয়, কাম বান্টি, আমি তো অবাক, কুত্তাটা উয়ের কোলে উটপের চায়, আর ও কোলে লেয়, আমার ঘিন্না হয়, কুত্তেক আবার কোলে লেয় কিডা, কুত্তের পাছায় বাঁধা।’ সমবেত পড়শিরা হাসে, কেউ কেউ মাথা ঘুরিয়ে ডোয়ার পাশে পানের পিক ফ্যালে, মাটি লাল হয়ে যায়।

নায়েবউদ্দিনের উচ্চতা ছয় ফুটের কাছাকাছি। তার কথা অনুযায়ী যাত্রীদের জন্যে যারা কাচের দেয়ালের এই পাশে অপেক্ষা করছিল তাদের মধ্যে সে-ই ছিল সবার থেকে মাথায় উঁচু। ফলে সেই প্রথমে দ্যাখে সালেহাকে। সালেহার কোমরে চামড়ার চারকোণা ব্যাগ বেল্ট দিয়ে বাঁধা ছিল, টাকার থলে। সালেহা যখন ইমিগ্রেশন কাউন্টার থেকে বের হয়ে লাগেজ বেল্টের দিকে হেঁটে আসে তখনই তাকে নায়েবউদ্দিন দেখেছিল। কিন্তু একটু খটকা লাগায় তার বৌকে সে তখন বলেনি। সালেহার পায়ের কাছে সাদা, ছোট, অনেক পশমঅলা, চঞ্চল একটা কুকুর দেখে নায়েবউদ্দিন ভেবেছিল, সালেহার পাশে পাশে হেঁটে-আসা মেম সাহেবের কুকুর হবে। কেননা ওই মেম সাহেব একবার কুকুরটাকে কোলে নেয়। সালেহা আর মেম সাহেব কিছুদূর পাশাপাশি একসঙ্গে লাগেজ বেল্টের কাছে এসে যখন আলাদা হয়ে যায় এবং কুকুরটা রয়ে যায় সালেহার কাছে তখন নায়েবউদ্দিন চোখ সরু করে, দুই চোখের মাঝখানে কপালে রেখা পড়ে, মেয়ে কি আমেরিকা থেকে কুকুর আনছে?‘মিয়েক কি দেখিছ্যাও’ সালেহার মায়ের প্রশ্নে নায়েবউদ্দিন কোনো জবাব দেয়নি। তার মাথার মধ্যে তখন একটি কথাই ঘুুরছিল, সত্যি ওই কুকুর যদি সালেহার হয় তাহলে কোশাখালির লোকজন কী বলবে?

সালেহা আসবার পর তাকে দেখার জন্য কোশাখালির লোকজনের যত না কৌতূহল, তার থেকে অনেক বেশি কৌতূহল ও কথা তার কুকুরকে নিয়ে। এই কুকুরের খাদ্য কী, কত ডলার দাম, ঘরে থাকে না রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে, কুকুর আর সালেহারা আমেরিকায় একই ঘরে ঘুমায় কি-না, সালেহা সেই নামাজ ঘরে পড়ে কি-না ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সালেহা বিরক্ত হয়ে যায়। সালেহা আমেরিকা গিয়ে নামাজ পড়া ছেড়ে দিয়েছে, এ-কথা কোশাখালির মানুষ জানে না।

সালেহার জন্মের অনেক আগে কোশাখালির মানুষরা ছোট পদ¥া পার হয়ে পাবনা শহরে আসত। এখন নদীর কোনো চিহ্ন নেই। শহরের মানুষেরা যদি কোশাখালির মানুষকে বলে চরের মানুষ, কোশাখালির মানুষরা প্রতিবাদ করে। পাঁচ বছর আগে কোশাখালিতে বিদ্যুৎ ছিল না। পল্লী বিদ্যুতের কল্যাণে কোশাখালির অনেক বাড়ি, মসজিদ রাত্রিতে এখন আলোয় জ্বলজ্বল করে। সালেহা আমেরিকা যাওয়ার কিছুদিন পর তার বাবা-মাকে চিঠি লিখেছিল, কোশাখালিতে ‘কারেন্ট’ না এলে টিনের বাড়িতে এসে থাকা তার এবং তার বরের পক্ষে সম্ভব হবে না, গরম একদম সহ্য হয় না তার, প্রয়োজনে, যদি সে আসে, একটা জেনারেটর কিনতে হবে। আমেরিকা থেকে আসবার কিছুদিন আগে সালেহা তার বাপকে জেনারেটর কেনার জন্যে টাকা পাঠায়। তখন চিঠিতে লিখেছিল, সে শুনেছে, পল্লী বিদ্যুৎ যখন-তখন যায়-আসে, ভরসা নেই। আরো লিখেছিল, উঁচু কমোডসহ পাকা নতুন পায়খানা বসাতে হবে। মেয়ের চিঠির এই অংশের কথা কোশাখালিতে ছড়িয়ে পড়ে। আলিমের দোকানে নায়েবউদ্দিন গেলে তার এক বন্ধু হাসতে হাসতে বলে, ‘শুনলেম তুমার মিয়ের হাগার জন্যি কমোড না কী বোলে লাগবি, আরে হাগা চাপলি দিকনিশানা ঠিক থাকে না-কি, ওসব করবের যায়ে না, খামাখা ট্যাকা খরচ।’ নায়েবউদ্দিন মাথা নিচু করে ছিল, কিছুই বলতে পারেনি। আমেরিকায় গিয়ে মেয়েটার কী হলো, এই কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।

বিসমিল্লাহ বস্ত্রালয়ের পাশের মনোহারী দোকান থেকে আমজাদ নবজাত শিশু যে-মশারি ব্যবহার করে, কিনলো। চেনা দোকানি হেসে হেসে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমারে বাড়িত কার বাচ্চা হইলে?’ আমজাদ মিথ্যে জবাব দেয়। তার বলতে লজ্জা করে, সালেহার কুকুরের জন্য সে মশারি কিনছে। দোকানিকে মিথ্যা বলে আমজাদ পার পেয়েছিল কিন্তু আলিমের দোকানের সামনে দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় মসজিদের ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমজাদ মশারি কার জন্যি, সালেহার বাচ্চার জন্যি, ছোট নাকি?’ সালেহা যে পাঁচ বছরেও বাচ্চা নেয়নি, এ-খবর ইমাম সাহেব জানতেন না। আমজাদ উত্তরে বলে, ‘মশারির কাম আছে, আমি আসি।’ ইমাম সাহেব আমজাদের তড়িঘড়ি করে চলে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারেন না।

এই কুকুরের ডাক অন্যরকম। জোরে জোরে ঘেউ ঘেউ করে না। সাদা বড় বড় নরম পশমে সারা শরীর 888sport app। চলাফেরার সময় তার পশম দোলে, চোখকে আরাম দেয়। যে-শব্দ তার গোলাকার মুখ থেকে ‘প্রয়োজনে’ বের হয় সে-ধ্বনি বাংলার পথে-ঘাটে, গ্রামে-গঞ্জে, রান্নাঘর আর খুবই সাধারণ মানের হোটেলের আশপাশে দেখতে পাওয়া কুকুরের ডাকের মতো নয়। এই কুকুর আদব-কায়দা জানে, ‘ও ডিয়ার কাম’ন’, ‘ডোন্ট ডু সিলি’, ‘নাউ গো টু বেড’, – এইসব ভাষা বোঝে এবং সেইমতো আচরণ করে, মশারির নিচে নরম এক নির্দিষ্ট বিছানায় ঘুমায়, বিশেষ রকমের শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করে, ঘরের বাইরে নেওয়ার সময় তার ছোট পাছায় পরানো হয় ডায়াপার, ঠান্ডা দুধ খেতে পছন্দ করে, সুন্দর সুন্দর টিনের কৌটার খাবার আর ছোট-ছোট বেশ শক্ত একরকমের বিস্কুট খায়, ঘুমায় ফ্যানের নিচে; গরম একদম সহ্য করতে পারে না; তেলাপোকা, ইঁদুর দেখে বেশ বিরক্ত হয়েছিল, কালো বড় হুলো বেড়াল দেখে ভয়ও পেয়েছিল। যখন-তখন দৌড়ে এসে সালেহার কোলের ওপর বসে। সালেহা ‘ও বান্টি, ডিয়ার’ বলে কুকুরের মাথায় দু-তিন বার হাত বুলিয়ে আদর করে দেওয়ার পর ঘন পশম-888sport app লেজ দোলাতে দোলাতে কোল থেকে নেমে যায়। এই দৃশ্য দেখে অবাক মানে। কেউ কেউ সালেহাকে বলে, ‘তোর কি ঘেন্না নেই, ছোটকালে কুত্তে দেইখে কি ভয় পাতু!’ সালেহা এসব কথা শোনে আর হাসে।

কোশাখালির আলিমের চায়ের দোকানে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বিবিসি শুনতে-আসা মানুষগুলোর আলোচনার বিষয় আজ বিবিসির দু-একটি বিশেষ খবর নয়। হাসিনা, খালেদা, দ্রব্যমূল্য, হরতাল, ইরাক, সাদ্দাম-বুশ-লাদেন নয়। ‘কুত্তাটা ছোট’, ‘যা-ই কও ভাই, দেখতি কিন্তু সুন্দের, গায় কত লোম’, ‘কুত্তে কুত্তেই, ও বালের আর সুন্দের কী’ (এই মন্তব্যে কেউ কেউ মাথা ঝাঁকায়), ‘সালেহার কোলে বসে, ও বোলে কুত্তের মুখে চুমুও খায়’, ‘মিয়ের কি ডাঁট হয়ছে দেখিছ্যাও, আইজকাল আমিরিকা কেউ যায় না না-কি’, ‘কয় কী ড্যালাসে থাকে, ওই নামে কোনো জাগা আমিরিকায় আছে না-কি?’ ‘বান্টি, বান্টি করে ডাকে, বান্টি মানে কীরে?’ দোকানের উপস্থিত কেউই বান্টি শব্দের মানে কী, জানে না। ‘আমিরিকার তেন কুত্তে আনিছেও, নাম বুশ রাইখে দেও, সালেহা কয় কী, যেহেনে সেহেনে বোলে পা তুলে মোতে না, হাগে না।’ কোনো একজনের এই মন্তব্যে হারিকেনের অল্প আলোর মধ্যে বাঁশের বেঞ্চিতে বসা, কেউ কেউ দাঁড়ানো, মানুষগুলো সশব্দে হেসে ওঠে। হাসি থামলে, একজন তরুণ, নীল হাফহাতা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা, একসময়ে সালেহার যাতায়াতের পথে বাঁশি বাজাত, বলে, ‘এই জাতের নাম না-কি পিকিনসি, চিনের জাত, প্যাট ডগ না চ্যাট ডগ, সালেহা কী জিনি কইলে’, আবার হাসি। আরেকজন বলে, ‘কুত্তে বলে ইংলিশ বোঝে’। এই কথা শুনে কোশাখালি প্রাইমারি স্কুলের এক মাস্টার মুহম্মদ জয়নাল খন্দকার সমবেত মানুষদের জানায়, সে কুকুরের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলবে। তার এই কথা শুনে কেউ কেউ বলে, ‘ছার, এখনি চলেন।’ ‘খবর না দিয়ে যাই কেমনি কইরে’ মাস্টারের কথা শেষ হতেই একজন বলে, ‘আমি সালেহারে বাড়িত যায়ে কচ্ছি আপনি আসতিছেন’।

নায়েবউদ্দিনের বাড়ির উঠোনে অনেক মানুষ। সালেহার ঘরের লাল শানের বারান্দায় চেয়ারে বসেছেন মাস্টার। সালেহা তার থেকে হাত তিনেক দূরে, দেয়ালে হেলান দিয়ে বান্টিকে কোলে নিয়ে বসেছে মাদুরের উপর। সালেহা ভেবেছিল সবাই কুকুর দেখতে এসেছে, জানত না, তার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক এসেছেন বান্টির সঙ্গে ইংরেজি বলতে। কোনো ভূমিকা ছাড়াই মাস্টার বান্টিকে বললেন, ‘হাও আর ইউ?’ সালেহা হেসে বলল, ‘আই’ম ফাইন।’ ‘না না তুমারে জিগ্যেশ করিনি, কুত্তেক করিছি।’ মাস্টারের কথায় সালেহা অবাক হয়ে যায়, বান্টি কান দোলায়, লেজ নাড়ে। ‘তুমার কুত্তে না-কি ইংলিশ বোঝে?’ মাস্টারের প্রশ্নে সালেহা হেসে বলে, ‘সব কথা বোঝে না স্যার, খুবই জরুরি কিছু কথা, যেমন ধরেন, ‘ও ডিয়ার কাম’ন’, ‘গো দেয়ার’, ‘ডোন্ট ডু সিলি’, ‘নাউ গো টু বেড’, এইসব আর কি’। মাস্টার মজা দেখতে-আসা মানুষদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দ্যাখ, কুত্তেও কত ইংলিশ জানে।’

পরদিন আছরের নামাজের পর ইমাম সাহেব নায়েবউদ্দিনকে বললেন, ‘নায়েব ভাই, একটু থাকেন, কথা আছে।’ নামাজশেষে কোশাখালির মাদ্রাসায় কায়দা-সিপাড়া পড়ানো মসজিদের ছোট হুজুর, ইমাম সাহেব এবং নায়েবউদ্দিন মসজিদের মধ্যে মুখোমুখি বসা। মাদবর আর নায়েবউদ্দিনের মুখের উপর জানলা দিয়ে আসা বিকালের রোদের আলো পড়েছে। নায়েবউদ্দিনকে কেন থাকতে বলা হলো সে-প্রসঙ্গ বলবার আগে ইমাম সাহেব কুকুর যে একটি নাপাক প্রাণী সে-সম্পর্কে একটা ছোটখাট বক্তৃতা দিলেন। কুুকুর যে-ঘরে থাকে সে-ঘরে নামাজ হয় না, সে-ঘরে কোরান-হাদিসের বই রাখতে নেই। এইসব বলে ইমাম সাহেব বললেন, তিনি শুনেছেন, সালেহার মার জায়নামাজের উপর সালেহার কুকুর বসেছিল, সালেহার ঘরে নেয়ামুল কোরান আছে। মাদবর বললেন, ‘নায়েব ভাই, একটা ব্যবস্থা করেন, সমাজ লিয়ে আপনেক থাকতি হবি। নায়েবউদ্দিন সব কথা শুনে বলল, আমি দেখপোনে কী করা যায়।’

রাত বেশি হয়নি। কোশাখালির আকাশে তারা, সালেহাদের বাড়ি ছাড়া কোশাখালি অন্ধকারে ডোবা। বিদ্যুৎ চলে গেছে, কখন আসবে ঠিক নেই, পাঁচ কেভির ইয়ামাহা জেনারেটরের শব্দে বান্টি ভয়ে জড়সড় হয়ে সালেহার কোলের মধ্যে বসে আছে। বাড়ির আশপাশের সমবয়সী কয়টি মেয়ের সঙ্গে সালেহা আমেরিকার গল্প করছে। আমেরিকায় গিয়ে প্রথম কমাস সালেহাকে একা একা বাসায় থাকতে হয়েছে, ওর বর দুটি চাকরি করত, ফলে একাকীত্ব দূর করবার জন্য শুরু করে কুকুর পোষা, বুদ্ধিটি তার বর তাকে দেয়। ডালাসে বেশি বাঙালিও নেই যে তাদের সঙ্গে মেলামেশা করে সময় কাটাবে। কতক্ষণ আর টেলিভিশন দেখা যায়! কথার মধ্যে সমবয়সী মেয়েরা সালেহা কেন বাচ্চা নিচ্ছে না, জিজ্ঞেস করেছে। জীবনটাকে দুজন আরো ‘এনজয়’ করে তারপর বাচ্চা নেবে, বলেছে সালেহা। ওর কথা শুনে বিবাহিত-অবিবাহিত সমবয়সীরা ‘এনজয়’ শব্দটির অর্থ না বুঝেই হেসেছে। পাড়ার মেয়েরা গল্পসল্প করে চলে যাওয়ার পর নায়েবউদ্দিন আর তার বৌ সালেহার পাশে বসে। একথা সে-কথার পরে নায়েবউদ্দিন মেয়েকে বলে, ‘তোর কুত্তেক লিয়ে তো ঝামেলায় পইড়ে গেলেম মা’। ইমাম সাহেব আর মাদবর যা যা বলেছে সবই সালেহা শুনল। সালেহা কোনো কথা বলছে না দেখে নায়েবউদ্দিন বলল, ‘তোর কুত্তারে বারান্দায় রাততিরি খাঁচার মদ্দি আর দিনের বেলায় চেন বাঁইধে উঠেনের কুনায় রাখলি লোকে আর কথা কতে না।’ সালেহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘সব মিথ্যে কথা, কোথার থেকে কী শুনেছে তার ঠিক নেই, কে বলেছে মার জায়নামাজের উপর বান্টি বসেছে? আমার ঘর থেকে তো নেয়ামুল কোরান আমি আসার পরপরই মা মার ঘরে নিয়ে গেছে, এইসব হুজুর-টজুরদের জন্যই দেশ এগোচ্ছে না, ঠিক আছে, এতই যখন ঝামেলা তাহলে আমি না হয় কাল-পরশু      পাবনায় চলে যাবো’। নায়েবউদ্দিন মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে, ‘দেখি কী করা যায়’।

সকাল। কজন প্রতিবেশী শিশু, আমেরিকা থেকে আনা বিস্কুট কুকুর খায়, বারান্দায় বসে অবাক হয়ে দেখছে। বারান্দার পাশে, সিঁড়ির কাছে হাড় জিরজিরে একটি দেশী কুকুর লোভ আর হিংসার চোখে তাকিয়ে আছে বান্টির দিকে। বিস্কুক শেষ হলে সালেহা একটি সুন্দর কৌটো থেকে হালুয়ার মতো কী যেন বান্টিকে খেতে দিল। কুকুর খায় আর লোমশ লেজ দোলায়।

প্রাইমারি স্কুলের কোণায় আসবার আগে শিশুদুটি চুরির সাফল্যে হাসছিল। স্কুলের পেছনের তালগাছের নিচে বসে থাকা আট-দশ বছরের শিশুদুটির বমি এখন কিছুতেই থামছে না। ওয়াক-ওয়াক শব্দে তারা বমি করছে। তাদের কাছাকাছি বসে লেজ নাড়ছে একটি ন্যাড়া কুকুর। স্কুুল ছুটি হয়ে গেছে বেশ আগে। আশপাশে লোকজন নেই। বেলা তিনটের মতো হবে। বমি করতে করতে শিশুদুটি শুয়ে পড়ল। চারটি চোখ পানিতে ডুবে একাকার। ওদের চোখের সামনে বান্টির অনেক বড় জিহ্বা ঝুলছে, দুলছে কান, কৌটোর উপরে ছাপানো আমেরিকান কুকুরের মুখটি ক্রমশ বড় হচ্ছে। বমি আরো বেড়ে গেল, শিশুদুটি মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে, নিঃসাড় হয়ে পড়ছে ওরা, মাথার কাছে বান্টির একটি বিস্কুট, অর্ধেক খাওয়া রঙিন কৌটো। তাদের ভেজা ঝাপসা চোখ দেখছে, বমিতে ভেসে যাচ্ছে শান্ত কোশাখালি।  -ফাল্গুন, ১৪১০