সাহারার চাঁদ ঘুমায় মরুর জোছনায়

 

কাজী  রাফি

আমি মরিভো হাশিমি। জন্ম বর্তমান নাইজার আর মালির উত্তরাংশ সাহারা মরুভূমিতে। খনি থেকে সাম্রাজ্যবাদীদের ইউরেনিয়াম সংগ্রহের কর্মযজ্ঞের কারণে তার রেডিয়েশনের প্রভাবে তেতাল্লি­শ বছর বয়সেও আমি তেরো বছর বয়সের এক কিশোর হয়ে আছি। আমি জন্মেছি সেই ভূমিতে, যেখানে আমার দাদার দাদা, তার দাদার দাদা হয়ে শত শত বছর ধরে আমার পূর্বপুরুষরা বাস করতেন। আমার পিতৃ অথবা মাতৃভূমিতে জন্মানো নিয়ে কোনো অসংগতি নেই। যেমন অসংগতি নেই আজ যে-শিশু জন্মেছে ইউরোপ অথবা আমেরিকায়। তবে অসামঞ্জস্য যেটুকু, তা হলো – আমি তাদের মতো সৌভাগ্যবান নই, কেননা তাদের রয়েছে রক্ত আর অর্থপিপাসু সেনাবাহিনী, যারা সারা পৃথিবীর সম্পদ চুরি করে, আমাদের অঞ্চলের শিশুদের শরীরে রেডিয়েশন ছড়িয়ে আজন্ম পঙ্গু অথবা হত্যা করে হলেও তাদের শিশুর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করেছে।

তেরো বছর বয়সের পর আমার শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি থেমে গেলেও আমার রয়েছে স্বাভাবিক ক্ষুধা আর যৌন-কামনা। আমার শরীরে বাসা বেঁধে আছে এমন এক রোগ, যে-রোগের কারণে সেই কামনার কাছে সমর্পিত হলেই আমার যৌনাঙ্গ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরে। তবে আমার মাথার পেছন থেকে উত্থিত অঙ্গটি স্নায়বিক অনুভূতিসম্পন্ন হলেও তা কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে। শরীরের অদ্ভুত এ-অংশটি দেখে বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত, স্বপ্নাকুল 888sport promo codeকুল চরম উত্তেজনা আর শিহরণে শিহরিত হবে বলে আমাদের প্রতিবেশী ওমর ঠাট্টা করলেও আমি মরিভো হাশিমি; আমার দুচোখ অপমান আর লজ্জায় ছলছল করে ওঠে।

মায়ের গর্ভ যে-শিশুকে নিরাপত্তা দিতে পারে না, তেমন ভয়ংকর পৃথিবীতে মানুষের মতো হাত-পা নিয়ে জন্মানোর চেয়ে মানবেতর আর কী হতে পারে? আমার মাথার পেছনে, যেখানে মানুষের শরীরের সর্বাধিক স্নায়ুতন্ত্রের বাস, ঠিক সেখান থেকে মুখ বের করা লেজের মতো এক অদ্ভুত অঙ্গ নিয়ে আমি জন্মেছিলাম, যা দেখতে পৌরুষত্বে ভরপুর পুরুষাঙ্গের মতো। ওমর অঙ্গটা ধরেই ইংরেজিতে বলত, It’s a symbol of screwing humanity…

১৯৬০ সালে সাহারা মরুভূমির উঁচু-নিচু বালু আর কঙ্করের বিসত্মৃত প্রান্তরে ছিল আমার দাদা ফারুকীর ছোট্ট এক ছনের ঘর। ঘরটা একদিন প্রচ-ভাবে কেঁপে উঠল এবং সেখানে বাস করা মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরল। তারা ধরেই নিল সাগরের মধ্যে আফ্রিকা প্রচণ্ড শব্দ করে তলিয়ে যাচ্ছে। অথবা সূর্য নিজেই মরুভূমির কোথাও আছড়ে পড়ে তৈরি করেছে এমন এক মহাগহবর, যার মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী! তাদের পায়ের নিচে মাটি কেঁপে যাচ্ছিল। যেন পৃথিবীর সেই ভাঙনের সুরে আর তালে পড়ে কোনো এক মহাদানব ভূমির নিচে শত শত কিলোমিটার ধরে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আকাশ বিষণ্ণ হয়ে কালো মেঘে ঢেকে গেল। এর আগে কেউ-ই এতো কালো মেঘ এ-অঞ্চলে কখনো দেখেনি। বাতাসে যেন গ্যাস ছড়ানো, সেই গ্যাসে মাঝে মাঝেই আগুন ঝিলিক দিয়ে মরীচিকার মতো মিলিয়ে যাচ্ছিল।

সেই বিকেলে আসন্ন মরুঝড়ের আগে আমার দাদার পরিবারের সদস্যদের মনে হলো, আজ মাইলের পর মাইল বালুর মধ্যে স্রষ্টা স্বয়ং আলো-আঁধারির খেলায় মেতেছেন। ঝড়ে তার ঘরটি ল-ভ-। সংগ্রহ করে রাখা জল তাদের নিঃশেষ হয়ে এলো। সেখানে বাস করা কয়েকটি পরিবারের একমাত্র জলের উৎস তাদের কূপটাও ধসে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। সামান্য জল একেকজনের ভাগে ফেলে জলের জন্য তারা হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াল। আমার বাবা তখন তার ছোট দুই ভাইকে নিয়ে ‘সাহারার মরীচিকা’ নামক পানির খোঁজে হন্যে হয়ে ছুটছেন এক কুয়া থেকে আরেক কুয়ায়। বালুধসে জলের সব উৎসমুখ বন্ধ হয়ে গেছে।

এরই মধ্যে একদিন ভোরে বৃষ্টি হলো। এই প্রথম মানুষ বৃষ্টি আর জল যে এক জিনিস নয়, তা জেনে বিস্মিত হলো। সেই বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন ঝরে পড়ছিল মাত্র খুন হওয়া কোনো লাশের গা বেয়ে বেয়ে। বৃষ্টিতে অমন পানসে রক্ত দেখে খাবারের জন্য জোগাড় করে পিপাসায় কাতর মানুষগুলো তা ফেলে দিতে গিয়েও দ্বিধান্বিত হলো। তারা বুঝল না, এ কী আশীর্বাদের না অভিশাপের জল। কী জানি, সেই অভিশাপের পদচিহ্ন ধরেই কিম্ভূতকিমাকার এক বস্ত্ত এলো কিনা! (বস্ত্তত যা ছিল আসলে একটা সামরিক ট্যাঙ্ক) তার গর্জনে আমার দাদার পরিবার হকচকিত হলো। সেই যন্ত্রকে কোনোদিন না-দেখা আমার দাদার পরিবার ভাবল, বৃষ্টিশেষে স্রষ্টা বুঝি নিজেই এলো! তারা হতভম্ব অথচ আনন্দিত আর বিস্মিত চোখে সেই যন্ত্রদানবটার দিকে তাকাল। কিন্তু না, কোনো স্রষ্টা নন, যন্ত্রদানবের ভেতর থেকে একটা মানবমুখ বের হলো। সেনারা কোনো দ্বিরুক্তি ছাড়াই ট্যাঙ্কটা তাদের শরীরের ওপর চালিয়ে দিলো। তাদের শরীর পিষ্ট করে চলে গেলেও আমার বাবা আর চাচারা দুই বালতি পানি জোগাড় করে এসে দেখল যে, আমার দাদি কোমরের নিচ থেকে থেঁতলে যাওয়া শরীর নিয়ে তখনো বেঁচে আছে। ছেলেদের হাতে জলের বালতি দেখে তার রক্তাক্ত শরীর আর হতভম্ব চেহারায় পরিতৃপ্তির ভাব ফিরে এলো। মৃত্যুর আগে তপ্ত সাহারার এই নির্জন প্রান্তরে বুকফাটা পিপাসা মেটানোর সৌভাগ্য কজন মানুষের ভাগ্যে জোটে! জল পান করে সবিস্তারে সব বলার আগে তার মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তিনি বললেন,

তোমরা পালিয়ে যাও, কখনো ওদের চোখের সামনে পড়ো না। হাজার হাজার বছর আগে, সেই মুসার (আ.) সময় থেকে সিনাই উপত্যকা পেরিয়ে নীল নদ হয়ে এই সাহারা পর্যন্ত আজতক পালিয়ে বেড়ানোই আমাদের ভাগ্যে আল্লাহতায়ালা লিখে রেখেছেন…

আসলে যা হয়েছিল তা হলো, ফ্রান্স সাহারা মরুভূমিতে তাদের প্রথম নিউক্লিয়ার টেস্ট তখন সম্পন্ন করেছে। তাদের সেই নিউক্লিয়ার টেস্ট ছিল হিরোশিমা-নাগাসাকিতে ফেলা অ্যাটম বোমার চেয়ে চারগুণ বড় এবং শক্তিশালী। জাপানে নিউক্লিয়ার বোমা ফেলার অভিজ্ঞতা থেকে তারা শিখেছিল যে, এই টেস্টে আশপাশের কয়েকশো কিলোমিটার অঞ্চলে যারা মারা যায়নি, তারা ইতিহাস হয়ে তাদের অপকর্মের সাক্ষী হয়ে থাকে। কোনো আদিবাসীর ভূমি থেকে তাদের উৎখাত না করে সেখান থেকে তাদের চোখের সামনেই পৃথিবীর সবচেয়ে দামি সম্পদ নিয়ে যাওয়া মানে তাদের একসময় তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে প্রস্ত্তত করা। সুতরাং অপকর্মের চিহ্ন মুছে ফেলতে সবাইকে নিশ্চিহ্ন করে দাও।

তখন আমার বয়স সাড়ে বারো বছর। আমার বাবা হাসিবি জানেন না যে, আমার কী হয়েছে। জন্ম থেকে আমার মাথার পেছনে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম, যেখানে মেরুদ- বেয়ে সোজা নিচের দিকে নেমে গেছে, সেখান থেকে উত্থিত পুরুষাঙ্গের মতো লেজটি দিন দিন বড় হচ্ছিল। অন্যের কাছে ওটা আমার একটা অঙ্গ হলেও আমার কাছে তা একটা বস্ত্তই বটে এবং সে-বস্ত্তটা আমার মেরুদ- বরাবর নিচের দিকে এক পুরুষাঙ্গের আকৃতি ধারণ করে ঝুলে থাকত।

ফরাসিরা তখন ব্যাপকভাবে ইউরেনিয়াম সংগ্রহের জন্য হাজার হাজার টন ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ মাটি ভূমির নিচ থেকে তোলায় ব্যস্ত। কিন্তু জন্মের পর থেকে আমি দিন দিন নার্ভাস সিস্টেমে দুর্বলতার পাশাপাশি অকল্পনীয় কিছু ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠছিলাম। কোনো মানুষের ছবি দেখলে তার বর্তমান পারিপার্শ্বিক অবস্থা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠত। খনি থেকে উত্তোলিত যে বিলিয়ন টন নিউক্লিয়ার ওয়াক্স তারা পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রেখেছিল তা  ছিল রেডিও অ্যাকটিভ। সেই রেডিও অ্যাকটিভিটির কারণে রেডিয়েশন আমার মাথার স্নায়ুতন্ত্রে কীভাবে প্রভাব ফেলেছিল, তা আমি জানি না। আধুনিক চিকিৎসা888sport apk আমার এই অতীন্দ্রিয় বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করবে হয়তো। বিস্ময়কর শোনালেও সত্য যে, আমি একজন মানুষের পেছন থেকে তার সামনে চলে যাওয়ার দিকে নিবিড়ভাবে তাকিয়ে থাকলে বুঝতে পারতাম সে কোথায় যাবে! তার আগাম বিপদ এমনকি কখনো কখনো তার পিছু পিছু ধাওয়া করা মৃত্যুকেও আমি দেখতে পেতাম।

 

দুই

সায়রা আর আমি, বাবা-মায়ের অনেক সন্তানের মাঝে আমরা দুই ভাইবোন, ছিলাম পিঠাপিঠি। এক উঁচু টিলার নিচে অসংখ্য কাঁটা আর ঝাউগাছে ভরা স্থানটা আমাদের দুজনের প্রিয় ছিল। আমাদের ছাগল আর উটগুলোও আমাদের প্রিয় এ-স্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। ঘুরেফিরে তারাও এখানে এসে শুয়ে থাকত। সেখানে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে আমি আর সায়রা খুব খেলতাম। বালুতে লেখা লেখা খেলা, উট-ঘোড়ায় সওয়ার হওয়ার খেলা। একদিন আকাশে মেঘ করল। সায়রা আর আমি মক্তবের পাঠ এবং কাঠের সেস্নটে হরফগুলো হাতে লেখা শেষ করে দৌড়ে গেলাম সেখানে।

এই মরুর তপ্ততায় মেঘলা আকাশ অথবা বৃষ্টির মুহূর্ত কত স্বর্গীয়, তা এমন ঊষর প্রান্তরে বাস না করলে কেউ অনুভব করতে পারবে না; কিন্তু বৃষ্টি নামার স্বর্গীয় ক্ষণেই ঘটল সেই অদ্ভুত ঘটনা। বালুতে হাঁটু গেড়ে আর দুহাত রেখে আমি ঘোড়া সেজেছি। সায়রা খিলখিল করে হাসতে হাসতে দৌড়ে এসে অন্যদের মতো আমার পিঠে দুহাত স্পর্শ করে লাফ দিয়ে পার হলো। কিন্তু আমাকে অতিক্রম করে মাটিতে পা রাখার পর তার হাসি থেমে গেল। আমি আড়চোখে বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি বালুর ওপর কয়েক ফোঁটা বারিবিন্দু মাত্র ঝরেছে। ভাবলাম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কিন্তু আমি পেশাবের তীব্র গন্ধ পেলাম। দেখলাম সায়রা ধীরপায়ে পায়ের দিকে তাকাতে তাকাতে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে একটা ঝোপের পাশে গিয়ে বসে পড়ল। আমি দেখলাম, গোলাকৃতি এক ছায়া তার পেছন পেছন সায়রাকে অনুসরণ করছে। ছায়াটা একসময় মানুষের দ্বিগুণ কঙ্কালাকৃতি ধারণ করল। ব্যাপারটা সেই প্রথম আমার কাছে চোখের ভুল অথবা মরুভূমিতে পানি খোঁজার মতো মরীচিকা মনে হলেও সময়ের সঙ্গে আমি স্পষ্ট বুঝতে শিখেছি, সেই মনুষ্য-কঙ্কালের ভাসা ভাসা অবয়বটুকু কারো পিছু পিছু যাওয়া মানে তার মৃত্যুর বিষণ্ণ এক ছায়া ছাড়া আর কিছু নয়। কাছে গিয়ে আমার বোনটার পাশে আমি বসলাম। হাত ধরে বললাম,

কী হয়েছে?

আমার প্রশ্নে সে হতভম্ব চোখে আমার দিকে তাকাল। তার গোলাপি গালগুলোতে রক্তাভা আর চোখদুটো লাল হয়ে উঠল। সে তার পায়জামার দিকে তাকাল। দেখলাম, তার ঊরুর কাছে কাপড় ভিজে গেছে। আমি হেসে বললাম,

আমাকে বললেই তোমাকে আমি…

আমার কোনো চাপ নেই, অথচ…। আমার দেখাদেখি অন্য ছেলেমেয়েরাও খেলায় ভঙ্গ দিয়ে সায়রার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সায়রা তখনো তার জামাতেই পেশাব করে দিচ্ছে দেখে অবাক হয়েও কেউ কেউ যখন হাসাহাসি শুরু করল এটা না জেনেই যে, সায়রাকে দিয়ে শুরু হলেও তাদের অনেককে একই পরিণতি ভোগ করতে হবে; তখন সায়রা বিমর্ষ আর লজ্জিত কান্নায় মুখ লুকাল। আমরা তার কাছ থেকে আর কিছু শোনার আগেই সে দৌড়ে বাড়ি চলে গেল। সেদিনই ছিল সায়রার, আমার প্রিয় খেলার সাথি, সায়রা আমার প্রিয় বোন আর বন্ধুর খেলার শেষ দিন।

সায়রার ফোঁটায় ফোঁটায় প্রস্রাব পড়ার এ-রোগের জন্য আমাকেই দায়ী করা হলো। মনুষ্য সন্তান দিয়ে এই অভিনব ঘোড়া-খেলা আবিষ্কার করার জন্য মা আমাকে শুধু অভিশাপই দিলেন না, চুলার জ্বালে অর্ধ-ব্যবহৃত কাঁটাগাছের ডাল দিয়ে বেদম প্রহার করলেন। তিনি আমাকে অসভ্য এবং মাথার পেছনে বেহায়া টাইপের যৌনাঙ্গসদৃশ এক অঙ্গ নিয়ে তার মাতৃজঠরে বেড়ে ওঠার জন্য তার সাতজন্মকেও অভিশপ্ত করার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করলেন। আমার মাথায় যত না বুদ্ধি তার চেয়েও বেশি নারকীয় বুদ্ধি নাকি আমার সেই অতিরিক্ত বিকৃত অঙ্গটিতে! মা হাতে দা নিয়ে আমাকে তাড়া করলেন। তিনি হয়তো তার মাতৃজঠরকে অভিশাপমুক্ত করতে আমার শরীর থেকে বিকৃত অঙ্গটাকে সেদিন কেটে ফেলে দিতেন। তার তাড়া খেয়ে, আমি বাড়ি থেকে দূরে, অনেক দূরে পালিয়ে গেলাম।

পিপাসায় আমার বুক তখন ফেটে যাচ্ছে। দূরে একটা বড় প্রাচীরঘেরা কিছু ঘরবাড়ি। জলের নেশায় ছুটলাম সেখানে। সেখানে প্রবেশপথে প্রহরী দেখে ভয় পেলাম। আমি কোনোদিন ইংরেজি বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত হইনি। তবে ইংরেজিতে লেখা ছোটদের একটা গল্পের বই বংশপরম্পরায় আমাদের বাড়িতে ছিল। ওমর  যখন গল্পগুলো পড়ত, আমি মনোযোগ দিয়ে পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে সিনেমার দৃশ্যের মতো গল্পগুলোকে চলমান দেখতাম। আশ্চর্য, বাড়িটার ফটকের অক্ষরগুলো না চিনেও আমি আজ বুঝলাম, দেয়ালে সেঁটে দেওয়া ব্যানারে বড় করে লেখা আছে ‘হাসপাতাল’। যা হোক, প্রহরীর ভয়ে, পিপাসাকাতর আমি হাসপাতালের মূল প্রবেশপথের উলটোদিকে, হাসপাতালের পেছনে দেয়ালের ছায়ায় চুপ করে বসে আছি। আমার মাথার ওপরে ছিল একটা ঘর। ঘরের জানালা দিয়ে নিচে বসে থাকা মরিভোকে অনেকক্ষণ ধরে দেখছিল ওই হাসপাতালে কর্মরত একজন ফরাসি নার্স। ঠিক মরিভোকে নয়, সে দেখেছিল তার মাথার পেছনের বিকৃত অঙ্গটাকে। তাকে না দেখেও আমি বুঝতে পারছিলাম, মরিভো কারো দৃষ্টিতে আটকে গেছে। সেদিন প্রথম অনুভব করেছিলাম, পেছন থেকে কেউ অমন দৃষ্টিতে আমাকে দেখলে মরিভোর বিশেষ এ-অঙ্গটা শিরশির করে। চোখের কামনা, মনের বাসনার সঙ্গে আমার এই অঙ্গটার সেন্সরে কোন কোন স্পর্শানুভূতি এসে ধরা দেয়, আমি জানি না।

কিছুক্ষণ পর নার্স মেয়েটি বাইরে এলো এবং তার নিজের ঘরে আমাকে নিয়ে গেল। আমাকে স্নেহভরে জল খাওয়াল। পেটপুরে খাবার খাওয়ানোর পর সে আমাকে যখন সুন্দর এক বিছানায় ঘুমাতে বলল, দেখলাম তার শরীরে দাউ দাউ আগুনের ছায়া খেলা করছে। সে মিষ্টি হেসে বলল,

আমার নাম পার্নিলা।

সে আমাকে পাশ ফিরে শুইয়ে দিলো এবং ক্ষুধা-পিপাসামুক্ত মরিভো হাশিমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। যখন ঘুম ভাঙল দেখি পার্নিলা পুরো নগ্ন হয়ে আমার মাথাটা তার দুই ঊরুর মাঝে নিয়ে ছন্দময় তালে ওঠানামা করছে। আমি জেগে ব্যথায় ককালেও তার ভ্রূক্ষেপ নেই। আমি জোর করে নিজেকে মুক্ত করতে চাইলে সে আমাকে লাথি মেরে ভাঙা ভাঙা স্বরে কোনো এক ভাষায় কিছু বলল। আশ্চর্য, আমি কখনো সে-ভাষার সংস্পর্শে না এসেও বুঝলাম তা ফরাসি ভাষা এবং তার অর্থটুকুও আমি বুঝলাম।

সে ততক্ষণ আমার মাথাটাকে দলিত-মথিত করে চলল, যতক্ষণ না আমার মাথার চুলগুলো আঠা আঠা হলো এবং ভয়াল আঁশটে গন্ধে আমার প্রায় বমি এলো। মায়ের হাতের বেদম প্রহারে কান্না না করলেও গোসল করতে গিয়ে মরিভো হাশিমি বমির চেয়েও বেশি কান্না করল। জীবনের প্রথম কান্না তার ধুয়ে গেল সামান্য জলে। ওই সময় শিহরণের আতিশয্যে পার্নিলার মুখ থেকে আর কোনো বাক্য বের না হলেও বাড়ি আসার আগে বিস্কুটের প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে মেয়েটি আমাকে বলল,

আমাদের এখানে সব খাবার আর জল আসে হেলিকপ্টারে… তবু তুমি এলে আমার ভাগ থেকে এসবের কিছু অংশ তোমার জন্য বরাদ্দ থাকবে। তোমরা যে পানি খাও তাতে আণবিক বোমার প্রভাব এখনো আছে। আশা করি, তুমি বুঝবে।

মরিভোর মনে হলো, সে তার মায়ের জঠরকে কলঙ্কিত করার অভিশাপে অভিশপ্ত। সে মাথার পেছনের বস্ত্তটাকে কেটে ফেলার পরিকল্পনা করতে গিয়ে চোখের সামনে তার রক্তাক্ত মাথাটা দেখল। হাসপাতাল থেকে যখন ফিরলাম, তখন আমার নিম্নাঙ্গে প্রচ- ব্যথা। নিজেদের বাড়ি নামক আস্তানায় যাওয়ার আগে প্যান্ট খুললাম। পেশাব করার চেষ্টা করতেই সেই তীব্র যন্ত্রণার সঙ্গে খেয়াল করলাম যে, পেশাব নয়, একফোঁটা রক্ত এসে জমেছে আমার মূত্রনালির মুখে!

সেই ঘটনার পর থেকে ভয়ে মেয়েদের ঘোড়া-লাফ খেলাটা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে আশপাশের অঞ্চলের আরো কয়েকজন একই রোগে আক্রান্ত হলে মরিভোর কারণে নয়, অন্য কোনো কারণে এই রোগ ছড়াচ্ছে বলেই সবার অনুমেয় হলো। অথচ সেই অদৃশ্য কারণের রহস্য উদ্ঘাটিত হলো না সহজে, যতক্ষণ না ওমর লিবিয়া থেকে ফিরে এলো।

ভোগের জগৎ দেখে আসা ওমর ঘটনা জানার পর রোগের কারণ উদ্ঘাটনের চেয়ে আমার কাছ থেকে সেই নার্সের গল্প শুনে নার্সের প্রতি তার সব মনোনিবেশ করল। কিন্তু ওমর কোনোভাবেই মেয়েটার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারল না। অবশেষে সে পার্নিলাকে একদিন বলল যে, সে মরিভোর ঘটনাটা জানে এবং প্রয়োজনে সে মাঝে মাঝে মরিভোকে ঘুষ হিসেবে তাকে দেওয়ার প্রস্তাব করায় কাজ হলো। বস্ত্তত, নার্স মেয়েটি না জানলেও খনি-হাসপাতালে কাজ করা পুরুষদের স্নায়বিক সমস্যা যত বাড়ছিল, নার্স মেয়েটার ক্ষেত্রে ঘটছিল তার বিপরীত ঘটনা। তার প্রবল কামনা এতো প্রবলতর হয়ে উঠছিল যে, স্নায়বিক সমস্যায় ভোগা পুরুষদের তুলনায় তাকে তা চরিতার্থের জন্য সব অস্বাভাবিক পথ আবিষ্কার করতে হয়েছিল। মরিভো ছিল তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ পন্থা। পার্নিলাকে স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা এবং প্রচুর অর্থের হাসপাতালে কাজ করার প্রলোভন দেখিয়ে প্রলোভিত করলেও এবং তার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া শারীরিক চাহিদাকে সে সুস্বাস্থ্য এবং যৌবনপ্রাপ্তির লক্ষণ ভাবলেও তা ছিল একধরনের শারীরিক অসুস্থতা। সে যেন বর্তমান সভ্যতার এক প্রতিবিম্ব! কিন্তু অসুস্থ মানুষ যখন তার অসুস্থতাকে উপভোগ করে, তখন আত্মিক আর মানবিক ব্যাপারগুলো নিয়ে সে হয়ে ওঠে খুবই নির্বিকার।

 

আমার সাত বছর বয়সী ছোট বোন সায়রার সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণে তার স্নায়ুগুলো পুরোপুরি অকার্যকর। সারাক্ষণ সে জামা ভিজিয়ে ফেলছে। একদিন আমার হতভাগ্য বোন সায়রাকে (পেশাব নিয়ন্ত্রণের অসমর্থতার কারণে যার অসম্ভব সুন্দর চোখদুটিতে সারাক্ষণ লজ্জাবোধ আর বিব্রতের ভাষা তাকে নিরীহ করে তুলত) কয়েক কিলোমিটার দূরে চিকিৎসার জন্য ফরাসিদের অ্যাভেরার মাইন হাসপাতালে নেওয়া হলো। হাসপাতালের দেয়ালের লেখা ওমর পড়ে শোনাল – Avera’s mining Hospital provides free medical care to local people. The impact of the mining activities on the local population is very closely monitored and checked. The added dose limit of 1mSv a year set by Nigerien regulations is respected around Avera’s mines, guarantying there is no impact on health.

 

ওমর বারো বছর বয়সে লিবিয়ায় চলে যায়। সেখানে সে ধনাঢ্য এক ব্যক্তির পরিবারে পরিচারকের কাজ করত। সে এক দয়ালু ব্যক্তির সঙ্গে ছিল, যিনি তাকে লেখাপড়ার সুযোগ দিয়েছিলেন বলে তার পরিবারের দুর্ভোগময় জীবন তাকে হতাশায় নিমজ্জিত করেছিল। এ এমন এক হতাশা, যা যে-কোনো মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে তার নিজের অপারগতার বিরুদ্ধে। কিন্তু অবারিত বালুরাশি আর মাঝে মাঝে কঙ্করের সত্মূপের মাঝে নিজের শৈশব খোঁজার চেয়ে হতাশাজনক পৃথিবীতে আর মনে হয় কিছু নেই। সেই হতাশা মরুর শনশন বাতাস হয়ে তার হৃদয়ে ঝড় তুলল। খোলা আকাশের নিচের উদার প্রান্তরে যে-মানবসন্তান এমনকি মরুভূমির বাতাসও গায়ে লাগিয়েছে, তার জীবনের আসন্ন মৃত্যুর পর এই প্রকৃতিরই সঙ্গে মিশে যাওয়ার স্বপ্নকে যে গচ্ছিত রেখেছে, রাতের তারা আর চাঁদের আলোয় যে-মানবসন্তান তার আত্মার সঙ্গে প্রকৃতির কাছে ফিসফিস স্বরে কথা বলার অভ্যাস রপ্ত করতে শিখিয়েছে – তার অনুভূতিকে তুমি যদি আধুনিক বিশ্বের ইন্দ্রিয়পরতন্ত্রতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত সভ্যতার লেবাস পরা ইন্দ্রিয়সেবী মানুষের অনুভূতি নামে বস্ত্তত উপলব্ধিহীনতার সঙ্গে তুলনা করো, তাহলে স্বয়ং স্রষ্টা বিষণ্ণ হয়ে উঠবেন। ওমরের শিক্ষার আলোটুকু দিয়ে সে তার মানুষদের নিয়ে একটু ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিল বলে ইউরোপ-আমেরিকার বাঘা বাঘা গোয়েন্দা সংস্থা নিজেদের নজিরবিহীন সাফল্য পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করল। তা আর কিছু নয়, সামান্য ইংরেজি পড়ার সামর্থ্যের কারণে সাহারায় ওমর নামের এক ভয়াবহ সন্ত্রাসীর উত্থানের যোগসূত্র তারা খুঁজে পেল। আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তর ওমরকে গাদ্দাফির ঘনিষ্ঠতম সহযোগী এবং অর্থায়নে মদদপুষ্ট জানিয়ে বিবৃতি দিলো।

ওমর! একজন মানুষ, মরুর তপ্ত রোদ থেকে বাঁচার জন্য যার মাথার ওপর ছাদটুকু নেই, পানি সংগ্রহ করতে ‘জল’ নামক মরীচিকার পেছনে ছুটতে যার জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে আসে, বিশ্বের সামনে তাকে জুজু বানিয়ে, ক্যামেরা নামক বস্ত্তটি তার নিয়ন্ত্রকদের দিয়ে হাজার হাজার পর্দায় সেই খবর ছড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ ক্যামেরাটা কখনো ওমরের জীবনের আর্তির ওপর তাক করা হয়নি। অন্তরে অন্তরে ক্যামেরা ছড়ায় ঘৃণা-ভয়-অবিশ্বাস। ভয় থেকে বাঁচার নামে, অন্যকে বাঁচানোর নামে বস্ত্তত মহান রাষ্ট্রগুলো লুট করে সব ইউরেনিয়াম। বিসত্মৃত হয় উপনিবেশ। কিন্তু ক্যামেরা দেখাল যে, সাহারায় স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিভূ এলো, যারা পৃথিবীর মানুষের শাস্তির জন্য নিজের জীবন ওমরদের সামনে বিপন্ন করছে! হায়, ওমর! সে তখন হয়তো, কোনো এক নির্জন বিকেল অথবা সন্ধ্যায় অ্যাভেরার মাইন হাসপাতালের কামুকতার রোগে আক্রান্ত নার্সটার সঙ্গে ক্যামেরার অন্তরালে তুমুল দেহলীলা সাঙ্গ করছে।

যা হোক, যা বলছিলাম। চারদিকে বালু আর কঙ্করের উঁচু-নিচু বিস্তারের মাঝে অ্যাভেরার হাসপাতালে বাবা আমার সঙ্গে আমার ছোট বোনকে আবার সেখানে নিয়ে এলে আমি ভয় পেয়ে বললাম,

আমি হাসপাতালে ভর্তি হতে চাই না। বাবা বিরক্ত হলেও পার্নিলার আগ্রহটুকু ওমরের চোখ পড়ে নিল। আমার হাতে চাপ দিয়ে সে বলল,

আমি থাকব, তোমার সঙ্গে। ভয়ের কারণ নেই।

 

তিন

এরপর মরিভো এমন করে গল্প বলা শুরু করল, যেন সে নিজে মরিভো হাশিমি নয়, মরিভো হাশিমি তার দেখা কোনো এক চরিত্রের নাম –

হাসপাতালের মেয়েদের ওয়ার্ডে ভর্তি করা হলো সায়রাকে। দক্ষিণপ্রান্তের ছোট্ট এক ওয়ার্ডে দুজন বয়োবৃদ্ধ মানুষের সঙ্গে মরিভো। মরিভোর মতো এক রোগী আসায় হাসপাতালে সর্বসাকল্যে তিনজন ডাক্তারের সবাই তাকে দেখতে এলেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, সায়রা আর মরিভোর রোগ দুটো একেবারেই আলাদা। ডাক্তার বাবাকে যা বললেন ওমর তা ইংরেজিতে 888sport app download apk latest version করে বোঝাল,

সায়রার রোগটা জন্মগত নয়। তবে মরিভোর রোগটা স্রেফ জন্মগত ত্রম্নটি। আমাদের খুব বেশি কিছু করার নেই। তবে, ওকে আমরা কয়েকদিন হাসপাতালে রাখতে চাই।

মরিভো বুঝল, তাকে নিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের অধ্যয়নপর্ব শুরু হতে চলেছে। পৃথিবীর অন্য অংশে মেঘে 888sport app চাঁদের আবছা আঁধারী আলো, শীতের ময়দামাখা চাঁদনি অথবা গ্রীষ্মে সাগরের ফেনামাখা জোছনালোক, আর শরতে কুয়াশার ধোঁয়াশামাখা জোছনা – এসব বিশেষণের বিলাস থাকলেও আফ্রিকার মরুভূমির মানুষের কাছে ওসব বিশেষণ ভাবালুতা ছাড়া আর কী? বয়সী মানুষটার বাথরুম থেকে ধীরপায়ে ফিরে আসার পথে এবং বিছানায় বেদনাক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেওয়ার সময় মরিভো স্পষ্ট দেখতে পেল চাঁদের ভুতুড়ে রহস্যময় সেই আলো। হাঁটার সময় মানুষটার পেছন পেছন এবং ঘুমানোর সময় তার সঙ্গে একটা ছায়াকে সে অনুসরণ করতে দেখল। মরিভো গভীরভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগে পাশে বসা ওমরকে বলল,

তার আত্মাকে সে নিতে এসেছে। ওমর অবাক এবং ভয় পাওয়া চোখে বলল,

আত্মা? কী বলছ, মরিভো?

মরিভো লোকটার বিছানার দিকে নখ নির্দেশ করে বলল,

ওনার আত্মাকে আজ চাঁদের আলোর রূপ ধরে কেউ একজন নিতে এসে লুকিয়ে আছে এই হাসপাতালে।

মরিভোর কথায় ভয় না পেলেও ওমর এবার সত্যি ভয় পেল, যখন ভোরে ঘুম ভাঙার পর দেখল, দুজন কর্মচারী বৃদ্ধকে কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে নিয়েছে এবং পাশের স্ট্রেচারে তোলার প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করেছে। ওমর আরো আশ্চর্যান্বিত হলো, যখন তার দৃষ্টিতে অভূতপূর্ব সেই দৃশ্য ভেসে উঠল। সে দেখল, মরিভো লম্বা করিডরের এক মাথায় লোহার গ্রিলে মাথা রেখে খুব মগ্ন হয়ে কোনো কিছু দেখার চেষ্টা করছে অথচ তার সামনে কয়েকটা ঝুপড়ি আর কাঁটাজাতীয় গাছ ছাড়া আর কিছু নেই। ওমর দ্রুত তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মরিভো একটা ‘শি’ গাছ দেখিয়ে বলল,

ওই যে, ওই পথে, ওই গাছটার পাশ দিয়ে ওরা তার আত্মাটা নিয়ে চলে যাচ্ছে।

মরিভোর সান্নিধ্যটুকু ওমরের কাছে আর তত মধুর থাকল না। পার্নিলাই পরিশেষে ওমরের হাসপাতালে থাকার ভরসা হয়ে উঠল। তবে তা সহজে হলো না। দ্বিতীয় ব্যক্তির মৃত্যুর আগে যেদিন মরিভো পুনরায় তার অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অপব্যবহার করল সেদিন মরিভোর ভবিষ্যদ্বাণী সমর্থন না করেও পার্নিলা মনে মনে চাইল যেন তার কথা সত্যি হয়। তাহলে ওমরকে ভাগিয়ে দিয়ে মরিভোর অঙ্গটার দারুণ ব্যবহারের আনন্দ-কল্পনাটুকু বাস্তবে সে পরিণত করতে পারে।

পরের দিন দ্বিতীয় প্রবীণ ব্যক্তির মৃত্যুর জন্য পার্নিলা তার অন্তর্লোকের কাছে তো নয়ই, বরং সমর্পিত হলো শরীরের কাছে। সে ওমরের কাছে সহজে ধরা না দিলেও লাশ বহনকারীরা চলে যাওয়ার পর অন্ধকার নেমে এলে সেই অন্ধকারে নিজের দেহসুখকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগের মাধ্যমে ভুলেই গেল যে, মরিভো অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী, নাকি মানুষরূপী কোনো প্রেতাত্মা! পার্নিলা ইন্দ্রিয়সুখের চোরাগলিতে ডুবে ভুলেই গেল মরিভো নয়, সে নিজেই মানুষরূপী এক অসুস্থ প্রেতাত্মা। সায়রা আর মরিভোর কথা ভুলে তারা পরিত্যক্ত ঘরটার এতো সদ্ব্যবহার করল যে, তাদের দাপাদাপিতে ঘরের সব তেলাপোকা আর ইঁদুর নতুন আস্তানার খোঁজে বিদায় নিল।

এক সন্ধ্যায় চুপিচুপি মরিভো সায়রার বিছানার কাছে গিয়ে বসল। তার মুখটা কয়দিনে আরো ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। মরিভোকে দেখে তার মলিনমুখে ক্লান্ত হাসি ফুটে উঠল। সায়রা তার অক্ষিগোলককে বারবার ঘুরিয়ে এমন করে তাকাল যেন কতদিন পর সে তার হারিয়ে যাওয়া ভাইকে ফিরে পেয়েছে। সে বালিশের তলায় হাতড়ে হাতের মুঠির মধ্যে কী যেন পুরে মরিভোর হাতের প্রতীক্ষায় থাকল। বোনের হাত থেকে সে তা নেওয়ার জন্য হাত পাতল। আলতো করে সায়রা তার মুঠ খুলল,

তোমার কাছে রেখো!

ঘোড়ার এক ছোট্ট মাটির ভাস্কর্য! মরুভূমিতে এর চেয়ে বড় 888sport live chat-সৃষ্টির ঘটনা কখনো ঘটেছে কিনা তা মরিভোর জানা নেই। মরিভো ব্যাকুল আর আকুল চোখে চোখ রাখল সায়রার চোখে। মরিভোর মনে হলো সে এক বয়সী মানুষ, যার কন্যা সায়রা খুব অসুস্থ এবং তার ছোট্ট মেয়েটার জীবনে সবচেয়ে বড় 888sport sign up bonus আর আনন্দের ঘটনা ছিল ঘোড়া-ঘোড়া খেলা। হায়! মাঠে ভেড়া আর উট চরানো, সেস্নটে মাত্র অক্ষর লিখতে শেখা কেমন অদ্ভুত 888sport sign up bonus যা তৈরি হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়! একজন বাবার হৃদয়ের মতো মরিভোর হৃদয় হাহাকার করে উঠল এবং সে সায়রার হাত জড়িয়ে ধরে বলল,

আমরা আবার খেলব, বোন। এ-বছর মনে হয় বৃষ্টি হবে। আমরা বৃষ্টিতে ভিজব।

কিন্তু এ-কথাগুলো শুনে সায়রার চোখে-মুখে হাসি ফুটে উঠল না। তার দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। টলটল নেত্রভরা জলকে ছল করে লুকানোর চেষ্টা করে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে সে ‘না’ সূচক মাথা দোলাল,

না।

কেন? মরিভোর প্রশ্নে সে এবার বয়সী মানুষের অভিব্যক্তি মুখে এনে বলল,

এই অসুখ নিয়ে ওসব খেলতে নেই! বলে সে হাসপাতাল থেকে দেওয়া কয়েকটা বাতাসার ছোট্ট আরো এক প্যাকেট মরিভোর হাতে দিয়ে বলল,

তুমি খেয়ো, ভাইয়া!

তার দুই রাত পর সায়রা চুপিচুপি কখন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে, হয়তো ঘোড়া-ঘোড়া খেলার অথবা ওই কাঁটাগাছের ছায়ার মায়ার 888sport sign up bonusর কাছে মরিভোকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেল। রেখে গেল মরিভোর কাছে ‘পিতৃসুলভ’ দারুণ এক শূন্যতা। সারাজীবন সায়রার জন্য অদৃশ্য কান্নাই ছিল মরিভোর বেঁচে থাকার অনন্য এক উপায়ও বটে। সায়রার এক বাক্য মরিভোর জীবনভর এক 888sport sign up bonusকাতরতা শুধু নয়, বরং তা হয়ে উঠল একমাত্র ওষুধ! তার যৌনাঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত রক্তকণা থামাতে মরিভো পকেট থেকে সায়রার দেওয়া ছোট্ট ঘোড়াটা বের করত। মাটির প্রায় চোখ-মুখহীন সেই ঘোড়াটাই মরিভোকে যেন সায়রার কণ্ঠে বলত,

এই অসুখ নিয়ে ওসব খেলতে নেই!

হ্যাঁ, মরিভো তোমার জন্ম হয়েছে মানবের ভাবনাশূন্য মুহূর্তকে উপভোগ না করার জন্য। তোমার জন্ম হয়েছে, ছোট্টবেলায় সামান্য এক ঘোড়া-ঘোড়া খেলার 888sport sign up bonusঘোরে আটকে পড়ার জন্য।

 

এই ফাঁকে পার্নিলা একদিন পত্রিকার পাতায় চোখ রেখে বিস্মিত হলো। তার শৈশব-কৈশোরের বান্ধবী অ্যান্দ্রিয়ার ছবি এই দেশের পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনামে ‘লেডি হেভেন আসছেন’; কিন্তু এ কি সেই অ্যান্দ্রিয়া নয়? পার্নিলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অ্যান্দ্রিয়ার ছবিটা দেখতে লাগল। সেই নাক, ডান কানের লতিতে মিশে যাওয়ার মতো এক তিল। না, এ অ্যান্দ্রিয়া না হয়ে পারেই না। সে তার মাকে ফোন করে নিশ্চিত হলো যে, অ্যান্দ্রিয়াই এখন লেডি হেভেন।

আফ্রিকার দেশগুলোর এই সহজ অথচ জটিল খেলার মধ্যে পা দিয়েছে অ্যান্দ্রিয়া! সে এখন কোনো এক দেশের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির স্ত্রী… পার্নিলা অ্যান্দ্রিয়ার মেইলে যোগাযোগ করল। আশ্চর্য, অ্যান্দ্রিয়া তাকে লেডি হেভেন হয়েও ভোলেনি বলে সে আপস্নুত হলো। অ্যান্দ্রিয়া উচ্ছ্বসিত হয়ে জানাল,

আমার জন্য একজন নার্স তো লাগতেই পারে।

বিমানবন্দরে যাকে গ্রহণের জন্য এতো সাজসজ্জা, লাল গালিচার উপচেপড়া লাল… যাকে পাহারা দিয়ে গন্তব্যে নেওয়ার জন্য এতো সমরসজ্জায় সজ্জিত ব্যতিব্যস্ত চৌকস বাহিনী এতোসব আয়োজন দেখে পার্নিলা ভেবে পাচ্ছিল না যে, অ্যান্দ্রিয়া তারই বান্ধবী ছিল। আফ্রিকার আকাশ পর্যন্ত বিসত্মৃত বায়ুম-লে, আর পানসে জীবনকে আমোদ-স্ফূর্তিতে পার করে দেওয়া মানুষগুলোর অভিব্যক্তিতে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। যেন মর্ত্য থেকে আজ প্রখর রোদকেও ঝলসে দিয়ে নেমে আসবে কোনো স্বর্গের পরী। থমথমে থমকে থাকা বাতাসে গার্ড অব অনারের সশস্ত্র সালামের প্রস্ত্ততিও বাতাসের কম্পাঙ্ককে ততটা দোলা দিলো না, যতটা দোলায় বাতাস চঞ্চল হয়ে উঠল লেডি হেভেনকে বহনকারী বিমানের দরজা খোলামাত্র।

পার্নিলার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এই-ই হয়ে উঠল যে, অ্যান্দ্রিয়া মধ্যাহ্নভোজ এবং বিশ্রামের পরই তার খোঁজ করলেন। পার্নিলা নামের তার ব্যক্তিগত সেবিকাকে দ্রুত উদ্ধারে মরিয়া প্রাসাদকর্মীরা নিজের চাকরির পারঙ্গমতা প্রদর্শন করলেন। পার্নিলাকে তারা লেডি হেভেনের কাছে পৌঁছে দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, তাকে সাজালেন অপরূপ সাজে। লেডি হেভেন তাকে পেয়ে বললেন,

উফ! তোমাকে পেয়ে বাঁচলাম। না হলে কালোভূতটা সারারাত আমাকে হয়তো চেটেপুটে খেয়েই ফেলত।

অ্যান্দ্রিয়ার অতীত ভালো করেই জানে পার্নিলা। বিছানায় কোনো পুরুষের চেয়ে সুন্দরী বান্ধবীর সঙ্গ পাওয়ার সেই বিকৃত রুচিটা আছে কিনা তা নিয়ে যখন সে সন্দিহান তখনই অ্যান্দ্রিয়া বলল,

তোমাকে পেয়ে পুরনো সেই আনন্দটা যেন ফিরে এসেছে।

কিন্তু?

আমি বছরে তিন-চারবার শুধু তার বিছানায় যাই। এটা একটা বিনিময়। পরিবর্তে দেশ কী পায় তা নিয়ে মাথা না ঘামালেও আমার ইচ্ছার ষোলোকলা তো পূরণ হয়!

পার্নিলাও তার ইচ্ছার ষোলোকলা পূরণের নেশায় একজন মরিভোর তথ্য তাকে দিলো সেই রাতেই। যে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী এবং মৃত্যুদূতকে সে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করতে সমর্থ। তা ছাড়া মরিভোর চেয়ে কোনো 888sport promo codeর বিকৃত রুচিকে পৃথিবীতে আর কে বেশি পূর্ণতা দিতে পারে!

সুতরাং সেই আনন্দের সূত্র ধরে মরিভো এখন লেডি হেভেনের একান্ত সহচর। তাকে যেন তার সৌন্দর্যের মতোই সমাজ পূত-পবিত্র ভাবে, সন্দেহ তৈরি না হয় তার জন্য একজন মরিভো হাশিমিকে তৈরি করতে উন্নত বিশ্ব না হয় ইউরেনিয়াম নিয়ে চোর-সাধু খেলায় মেতে থাকল!

মরিভোর গল্পটা অসমাপ্ত থাকুক। তবে তোমার কল্পনার খাদ্য করার জন্য একটা দৃশ্য আমি বলতে চাই। একদিন রাতে মরিভোর পাশে চেয়ারে আসীন লেডি হেভেন। তিনি জাফরানমিশ্রিত চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। তার সরু কোমরের নিচে যে ফরাসি ডিজাইনারের দামি অন্তর্বাস তার বাঁধন আলগা। মরিভোকে তিনি প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন, কোনো অশরীরী ছায়াকে সে দেখতে পায় কিনা। তার প্রশ্নে মরিভো টি-টেবিলে এলোমেলো পত্রিকাগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরাল। প্লেবয় নামের একটা ম্যাগাজিনের – প্রচ্ছদের উলঙ্গ 888sport promo codeর নিম্নাংশকে ঢেকে আছে একটা পত্রিকার হেডলাইন – ‘সন্ত্রাসীদের নির্মূলে ওয়েস্ট আফ্রিকান ইকোনমিক কমিউনিটি পাঠাচ্ছে ৩৩০০ সেনার একটি সামরিক বহর।’ ম্যাক্সিম নামের আরো একটি পত্রিকায় এক 888sport promo codeর ভয়াবহ শরীর যেন আণবিক বোমার ফুটন্ত কণার রেডিয়েশনে জ্বলতে থাকা প্রচ্ছদের পাশে দেশটির বিখ্যাত আরো এক পত্রিকা জানাচ্ছে-‘২০ ডিসেম্বর ২০১২-র রেজুলেশন অনুযায়ী জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মালি সরকারের অনুরোধে ফ্রান্স সরকারকে উত্তরের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সক্রিয় সামরিক যুদ্ধের অনুমোদন দিয়েছে।’ মরিভোর চোখ শুধু এসব হেডলাইনেই ঘুরপাক খাচ্ছিল-

‘ডেনমার্কের যানবাহন সামর্থ্য, ব্রিটেনের সি-১৭ এবং সি-৩০ হারকিউলিস এবং জার্মানির কার্গো বিমানবহর সংযুক্ত থাকবে। ইতালি, রাশিয়া, আমেরিকা, স্পেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রয়োজনীয় রসদ-খাদ্য সরবরাহ ছাড়াও তথ্যানুসন্ধান, প্রশিক্ষণ সহায়তা প্রদান করবে।’

শিরোনাম পড়ে ওমরের জন্য গর্বে মরিভোর বুক ভরে উঠল। ওমরের বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের সামান্য স্বপ্নে সমগ্র ইউরোপ-আমেরিকা কীভাবে টলে যায়। ওমরের জীবন কত অর্থবহ!

 

না, মরিভো হাশিমি নিজের পেশাবপথের রক্তকে তখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। লেডি হেভেন তার সহৃদয় হৃদয়ের ভয়াল কামনায় মরিভোর চোখে চোখ রেখে, তার গাল টিপে বললেন,

আহা! বিগ বয়, লিটল ম্যান! তুমি এখন চলে যাও। কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে শুয়ে ফ্যানের মন্থরগতির পাখাটার দিকে তাকিয়ে থাকো। সব ঠিক হয়ে যাবে।

মরিভো হাশিমি ফ্যানের মন্থরগতির দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে আলতো করে সায়রার দেওয়া খেলনা ঘোড়াটা বের করে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সময় আর স্পেস শব্দের ঘোরতর ঘোরে হারিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় তার আত্মা শরীরকে শান্ত করে তোলে। সে দেখতে পায়, আকাশভর্তি যুদ্ধবিমান। সাহারার মরুতে ঘুমন্ত জোছনায় তার ছায়াগুলো অশরীরী আত্মার মতো ধেয়ে আসছে। ব্যবসাসূত্রের নারকীয় খোরাক হয়ে ধেয়ে আসছে বিচিত্র বর্ণের অসংখ্য 888sport promo codeর নগ্নশরীর। r

Published :


Comments

Leave a Reply