সেবার যখন মৌসুমি বায়ু এসেছিল

দেবেশ রায়

পাঁচ

কলকাতার সেই কমবয়েসি মন্ত্রী ধরলেন ফোন। বাগনানের মন্ত্রীর কাছ থেকে খবর শুনে তিনি বললেন, ‘সে কী? আমি তো কিছুই জানি না। কিন্তু সিএমকে তো ফোন করা যাবে না। আমাদের গোলাপদাকে ডাকা যায়। দাঁড়ান, আমি রমাপদদাকে ফোন করছি।’

‘উনি কি ধরবেন?’

‘না। আমি পবিত্রদাকে বলছি ওঁকে ডেকে দিতে। নইলে তো উনিই বলবেন – কী করে তোমরা খবর না দিয়ে পারলে?’

‘তাহলে আমি কী করব?’

‘আপনি চলে আসুন। ওখানে বসে থেকে কী হবে?’

‘না। এতটা রাস্তা। না জেনে -’

‘ও। না, তেমন কিছু তো মনে হচ্ছে না। আচ্ছা দাঁড়ান, আপনি মিনিট পনেরো পরে আমার ফোন পেয়ে রওনা দেবেন, এসকর্ট নিয়ে -’

ওই কলকাতার কমবয়েসি মন্ত্রীর কাছ থেকে রমাপদবাবু খবর জানার পর পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জেগে উঠল ও আধঘণ্টার মধ্যেই তাঁরা বুঝলেন যে, এই খবরটা বাকি রাতটুকু না-জানলেই ভালো হতো। তাঁদের অনেককেই এখনই মিডিয়াকে ফোন করতে হবে। অথচ ফোন করে বলবেনটা কী?

ফোনে খবরটা পেয়ে রমাপদ ফোনের পাশের কাঠের চেয়ারটাতেই বসে থাকলেন – এখন আরো ফোন আসবে, কী করতে হবে জানতে চেয়ে, জেলাগুলি থেকেও, দিল্লি থেকেও। সিএম-ও করতে পারে। বা, হয়তো পার্টি অফিসেই মিট করতে হবে।

রমাপদ এখন প্রবীণ নেতা। তাঁর চলাফেরা, জীবনযাপন ও কাজকর্মের ধাঁচটা তাঁর বয়সের চাইতেও পুরনো। বিয়ে করেননি, থাকেন এক প্রাচীন পার্টিকর্মীর দু-কামরার ফ্ল্যাটের একটি ঘরে। সকাল ও রাতের খাওয়া ওঁদের সঙ্গে, দুপুরে খাওয়া কলকাতায় থাকলে পার্টি-অফিসে। তাঁর গড়নের যেন একটা ঐতিহাসিক মডেল আছে। আমাদের উনিশ শতকের কোনো-কোনো নেতাকে সে-মডেলে পাওয়া যেতে পারে – একটু নজর করে খুঁজলে। বা, হয়তো মডেল নয়। রমাপদ যেন বিশ্বাস করেন – ক্ষমতা খুঁড়ে আনতে হয়, মাটির তলা থেকে, খনির গভীর থেকে। ক্ষমতা মানে আকাঁড়া খনিজ – ছুঁলে খনির ভিতরের আঁচ পাওয়া যায় বা খনির ভিতরের জলে হাত ভিজে যায় বা খনির ভিতরের শীতে শিহর লাগে। ক্ষমতা – পাথুরে, অগুনতি কোনাচে, চমকানো উজ্জ্বল, বন্ধুর অন্ধকার। ভোটে জেতাটা ও জিততে থাকাও একটা ক্ষমতা ও সে-ক্ষমতাও তৈরি করে তুলতে হয়, সংগঠিত করতে হয়।

এগুলো রমাপদ সম্পর্কে কিছু আন্দাজ। এর কোনো সত্যি-মিথ্যে নেই। মানে, হয় না। যাঁরা দেশকে স্বাধীন করতে একা গিয়ে কোনো সাহেবকে খুন করেছেন বা এক হাজার লোকের কোনো অভিযান গড়েছেন, বিশ্বাস ছিল তাঁদের শরীরের সক্রিয় ইন্দ্রিয়ের মতো। রমাপদ এখন কাঠের চেয়ারে একা-একা ফোনের পাশে বসে মোটেই ভাবছেন না যে, পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বসংক্রান্ত এত জরুরি একটা খবর এলো কী না বাগনান থেকে ফোনে? তাও এক ভারী মন্ত্রীর ফোনে – যে-মন্ত্রী নিজেকে হালকা করে নিয়েছেন? তাও তিনি কোনো আত্মীয়ের গৃহপ্রবেশের নিমন্ত্রণে বাগনান গিয়েছিলেন বলে? হঠাৎ ভয় পেয়েছিলেন বলে? কলকাতার এক জুনিয়র মন্ত্রীর স্ত্রীকে পরীক্ষার খাতা দেখতে একটু রাত-জাগতে হচ্ছে বলে? না, এসব কথা রমাপদর মনেই আসেনি। কিন্তু কতকগুলি জিজ্ঞাসা এক একটা পরিস্থিতির সঙ্গে মিশে থাকে। চবিবশ ঘণ্টা নিরাপত্তা-নিরাপত্তা করতে করতে এই সময় ভয় ধরে।

এগুলো রমাপদর ভাবনা নয়, মুখ্যমন্ত্রীর ভাবনা নয়, বা গোলাপদা, যিনি পার্টি-সেক্রেটারি তাঁরও ভাবনা নয়। বাগনানের মন্ত্রী, জুনিয়র মন্ত্রী, তাঁদের সমতুল্যদের ভাবনা হতেও পারে। না-হতেও পারে। ভাবনাটা ওখানে আছে। যার যখন দরকার, সে ভাবনাটা থেকে দরকারি অংশ তুলে নেয় – খুব একটা  বাছাবাছি না করেই

এই ভাবনাগুলিকে খুব ভাগ-ভাগ করে লেবেল সাঁটা যায় না।

এক ভাবনা থেকে আরেক ভাবনা জন্মাতে থাকে ভাইরাসের মতো। আক্রমণকারী আততায়ী অর্থে ভাইরাস নয়। এক প্রাণাণু থেকে আরেক প্রাণাণুতে বদলে যাওয়া, স্বভাব বদলে যাওয়া অথচ এক বিরতিহীন ট্রান্সমিউটেশন, জীবনের পরিচয় বদলে-বদলে যাওয়া।

এই যেমন – এই ভাবনায় কোনো এক আক্রমণকারীকে বিশ্বাস না করলে ভাবনাটা তৈরিই হবে না। ভারতের বুর্জোয়া শ্রেণি হোক, ইন্দিরা গান্ধীর মতো কোনো নেতা হোন, বিশ্ব ধনতন্ত্র নামের কোনো অচেনা ব্যবস্থা হোক, আর আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদই হোক – আক্রমণ করার জন্য কেউ তাগ বাগিয়ে আছে। পারছে না যে সে শুধু এখানে আমাদের রাজনৈতিক ভিতের জন্য। বছরের পর বছর, ভোটের পর ভোট জিতে আমাদের রাজনৈতিক ভিত তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক এই ভিত মজবুত করা,  অটুট রাখা আমাদের প্রধানতম রাজনৈতিক কর্তব্য।

এই যেমন – আক্রমণের কথা এমন করে ভাবলে আক্রান্ত হওয়ার  অভ্যাসটাও তৈরি হয়ে যায়। পুলিশ-পাহারা, হুটার লাগানো গাড়ি, লাল-আলো জ্বালা-নেভা গাড়ি, কপাটহীন দরজার চৌকাঠ – আমাদের আক্রান্ত হওয়ার কল্পনাকে সম্ভাব্য বাস্তবই করে তোলে।

আবার যেমন এই ভাবনায় আমরা ক্ষমতা পেলাম কী করে, সেটা যত স্পষ্ট, আমরা কী ক্ষমতা পেলাম সেটা একেবারেই স্পষ্ট নয়। ভোটে জিতলে যে-কেউই তো সেই সব ক্ষমতা পায়। ইংরেজ আমলের ভারত শাসন ও ভারতরক্ষা আইনে কেন্দ্র, প্রদেশ এই সবের যা ভাগাভাগি তাই আছে, অসংশোধিত। প্রাদেশিক আইনসভার মতোই কতকগুলি বিষয়ে আমরা প্রাদেশিক আইন চালাতে পারি। সেটা খাটিয়ে অনেক ক্যাটেগরির অনেক ভিআইপি বানাতে পারি। যে-কোনো একটা সমাবেশে যদি ওই অজস্র ক্যাটেগরির কোনো ভিআইপি থাকেন – সে জনাদশেক লোকের মিটিংই হোক, কোনো হোটেলে, কোনো বিয়েবাড়িই হোক, কোনো এয়ারপোর্ট হোক বা হাওড়া-শিয়ালদার মতো কোনো স্টেশনই হোক, তাহলেই সব মানুষকে বাধ্য করা হবে ওই একটা কপাটহীন, দেয়ালহীন দরজার ফ্রেম ঘাড় নিচু করে পেরুতে আর নিজের সমস্ত প্রাইভেসি অস্বীকার করতে? কেন? ও-ই বা নিজে একজন ভিআইপিকে সম্ভাব্য আততায়ীর হাত থেকে বাঁচাতে। কেন? উনি বা আমি জনপ্রতিনিধি। কেন? উনি ভোটে জিতেছেন, বা আমি ভোটে জিতে নেতা ও মন্ত্রী হয়েছেন বা হয়েছি, দেশের লোক তাই চায়। কেন? আমরাই তো দেশ, ওঁরাই তো দেশ – তাই।

এই ভাবনায় মনে আসে আমাদের যে দেশ মানবার কথা ছিল না, জাতি মানবার কথা ছিল না। উলটে, আমাদেরই দেশ আর জাতি বানিয়ে দিলো? আমরা কি শুধু এইটুকুই জানতাম – মানুষের মনের জোরে অ্যাসেম্বলি আর রাইটার্সের দখল নিচ্ছি। আমরা কি এখনো এটুকু জানিনি – অ্যাসেম্বলি আর রাইটার্সেরও একটা আলাদা শক্তি আছে, আমাদেরই দখল করে ফেলার?

নইলে, সবাই এত ভয় পেয়ে গেল কেন, ঘুমের ভিতরই? কেউ খবরটা জানতে চাইছে না কেন? এ ওকে ডাকছে না, কেন? সবাই রাস্তায় নেমে পড়েনি, কেন? ভয়ে ও শুধুই ভয়ে? তাহলে কি সিআরপি, সিআইএসএফ, ইন্দো-টিবেটান, র‌্যাফ – সব নামিয়ে দিয়েছে? রাজ্যের তো থাকার মধ্যে পুলিশ আর হোমগার্ড। তাহলে, শক্তির লড়াইয়ে আমাদের প্রথমেই নিরস্ত্র করে ফেলা হয়েছে? কারা করল – কেন্দ্রে যাদের সরকার তারা যে এরকম হতে পারে,  তা তো আমরা অহোরাত্রি বলে থাকি। তারা হতে পারে – এটা কি আমরা বলতাম, কিন্তু বিশ্বাস করতাম না? বা, তাদেরও হয়তো ক্ষমতাচ্যুত করে ফেলা হয়ে গিয়েছে! সরকার ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প ক্ষমতা-উৎস নেই!

কতকগুলি ছবি মনের মধ্যে খোদাই হয়ে আছে। একটা মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে লেনিন বক্তৃতা করছেন আর সেই আবেগে মঞ্চের বেড়া ডিঙিয়ে এগিয়ে দিয়েছেন কোমরের ওপরটা।

আর কী আশ্চর্য, ছবিটা এখন চোখের সামনে নেই, বহুদিন নেই, শুধু 888sport sign up bonusতে আছে, সেই 888sport sign up bonusতে দেখা যায়, ছবিটার সেই অবাস্তবটুকু যা ছবিটিকে এমন জাদুময় করে তুলেছে। স্পষ্টই লেনিন একটা ডায়াসে দাঁড়ানো আর যারা তাঁর কথা শুনছে তাদের পায়ের তলায় কোনো মঞ্চ নেই। অথচ তারা মাথায় লেনিনের সমান হয়ে আছে। এখন, 888sport sign up bonusতে, রমাপদ দেখলেন কেউ-কেউ যেন লেনিনকে ছাড়িয়ে উঠছে কাঁধে, মাথায়।

একটা পুরনো চায়নিজ স্ক্রোলে, মেদিনীপুরের পটের মতো, মাওয়ের লংমার্চের ছবিগুলি – মুক্তিবাহিনী একটা চওড়া নদী পেরোচ্ছে কাঠের ভেলায়, পাহাড় পেরোচ্ছে সারি দিয়ে, হেঁটে যাচ্ছে মাঠ দিয়ে – এক-একটা গাছ এক-এক রকম, সন্ধেবেলা আগুন ঘিরে গান গাইছে – আগুনের চাইতে ধোঁয়া বেশি। সেই যমপট প্রতিবারই খুলে খুলে পটুয়া বের করে বহু-বহু পুরনো ছবিগুলি যা একজন অন্ধও দেখে  চিনতে পারে – এক কাটা মহীরুহ, এক ছিন্ন কুড়ুল আর এক লাল পেড়ে 888sport promo codeর কোলে কোঁকড়ানো কালো চুলে তার স্বামী; যে-সাপ বাসরে ঢুকে চুল বেয়ে উঠে পুরুষটিকে দংশেছিল, ঘর থেকে বেরিয়ে সেই সাপটিই নদী হয়ে সেই মৃত স্বামী কোলে নববধূটিকে বুকে করে নিয়ে যায়; একটি মোষের পেছনে পেছনে যাচ্ছে এক কিশোর, মোষের পিঠে পেছন ফিরে বসে কুচকুচে কালো এক দেবতার কাঁধে সোনালি গদা। ওই লংমার্চের ছবিটির গল্পগুলি ছিল সব জানা – নদী পেরোনো, পাহাড় টপকানো, মাঠ ডিঙোনো, সন্ধে কাটানো, শীত তাড়ানো। রোজকার কাজ না হলে, বাচ্চাকে বুকের দুধ দেওয়া রোজকার প্রতি ঘণ্টার কাজ, ওই স্ক্রোলটিতে ছিল কাঠের ভেলায় পায়ের পাতা ডুবিয়ে এক মা তার বাচ্চাকে দুধ দিচ্ছে – ভেলার ওপর একটু নির্ঝঞ্ঝাট সময় পাওয়া গেছে, নইলে বাচ্চা জোয়ান হয়ে উঠবে কী করে, বিপ্লব গড়ে উঠবে কী করে?

ভিয়েতনাম একটা আমেরিকান প্লেন নামিয়েছিল, যেমন নামাত। তার একটা অ্যালুমিনিয়াম পাতে খোদাইয়ে হো চি মিন কিছু-একটার ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন – সেটা নদীর জলও হতে পারে, মাঠের ঘাসও হতে পারে, কিছু লেখা আছে ভিয়েতনামি ভাষায়। ‘সে যুদ্ধ কি কখনো হারা যায়, যে-যুদ্ধ লড়ছে আমাদের  নদীর জল আর মাঠের ঘাস?’

অবিকল পেত্রোগার্দ, লংমার্চ আর ভিয়েতনামই যে হবে তার কোনো মানে না থাকলেও বারবার এই সব উপমাই তো মনের আড়ালে কাজ করে যায়। বিপ্লব। বিপ্লব। কিন্তু কোথাও কি আমাদের কল্পনারও দোষ যে যা কিছু আমাদের এই রাজ্যের সরকারের দখল নিয়ে দ্বিধা তৈরি করতে পারে, তা আমরা কল্পনাও করব না। সত্য বলে তো মানবই না। সত্য বলে মানব না, যে-সংবিধানের জোরে আমরা এখানে ক্ষমতায়, সেই সংবিধানের জোরেই আমাদের শত্রুরাও দিল্লিতে ক্ষমতায়? সেই ক্ষমতার আওতায় আছে – রাষ্ট্রপতি, মিলিটারি, উচ্চতম বিচারালয়, পেনাল কোড, সম্পত্তি আইন, রাজ্যপালরা, সীমান্তগুলি – কী না! সে-ক্ষমতা এত নিরঙ্কুশ যে, মাঝরাতের একটা অর্ডিন্যান্সে একটা রাজ্য ভেঙে দু-টুকরো করা যায়। যদি উত্তরাঞ্চল হতে পারে, ঝাড়খন্ড হতে পারে, আরো আগে মেঘালয়, অরুণাচল হতে পারে, আরো আগে মিজোরাম, নাগাল্যান্ড হতে পারে, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে কলকাতাকে নিয়ে একটি ইউটি হতে পারে না? হতে পারে। আর তা হওয়ানোর জন্য কলকাতায় এই রাত্রিতে সেনাবাহিনী নেমে পড়ে থাকতে পারে, এর বিরুদ্ধে যদি পশ্চিমবঙ্গে কোনো প্রতিবাদ সংগঠিত হয়, যদি আন্দোলন তৈরি করে তোলা হয়, তাহলে আজ পর্যন্ত যারা মন্ত্রী ছিল, কাল বা পরশু সকালে তাদের সেই ভ্যানে তুলে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হবে, যে-ভ্যান আজ প্রথম রাত পর্যন্ত মন্ত্রীদের গাড়ির আগে-আগে বা পিছে-পিছে গিয়েছে। কোনো প্রস্ত্ততি নেই আমাদের। আমরা ভয় পেয়ে গেছি। সে-ভয়ও কোনো শ্রেণিভয় নয়, সে-ভয়ও কোনো সমবেত ভয় নয়। আমরা একেবারে নিজের শরীরের জন্য ভয় পেয়ে গেছি। নিজের, শুধু নিজের শরীরের ধ্বংসভয় – সে-ভয়ে নিজের পরিবারের লোককেও নিজের লোক মনে হয় না। ভয়। ভয়।

সেই ভয়ই তো মধ্যরাতের এই মুহূর্তে আমাদের সরকারি ক্ষমতাকে আমাদের নীতিগত অধিকারের বাইরে নিয়ে ফেলছে।

নিজেদের চোখে দেখা ’৬৭-তে, ক্ষমতা থেকে অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে সেই গঙ্গাবতরণের বেগ। আমরা সে-বেগ তৈরি করিনি। আমরা সত্ত্বেও সে-বেগ সংহত হয়েছে ও সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে দিয়েছে। সে-বেগ আমরা সইতে পারিনি, তাই সে-বেগকে অন্যখাতে বইয়ে দিতে চেয়েছি। দশ বছর পরে ’৭৭-এও প্রায় তেমনি কিছু ঘটেছিল। এসব থেকে আমরা একটা  জয়বোধ পেয়েছিলাম। মাত্র এক-দেড় বছরের মধ্যে সেই জয়বোধের  আত্মবিশ্বাস আমাদের ভেঙে শুধু টুকরো হয়নি, চূর্ণ হয়ে বাতাসে উড়ে গেছে। লেনিনের মূর্তি মুখ থুবড়ে পড়েছে রাস্তায়। স্তালিনের ব্রোঞ্জ-মাথা নানা চোরাপথে পাচার হতে হতে এসে পৌঁছেছে ভারতের এক বাথরুম-কন্ট্রাক্টরের হাতে। সে বিদেশি জিনিস দিয়ে বড়লোকদের বাথরুম সাজায়। এত গোপন পাচারের এত সীমান্ত সেই ব্রোঞ্জের মাথাকে পেরোতে হয়েছে যে, তার এক কান ভেঙে গেছে, একদিকের চোয়াল নড়ে গেছে। তবু সেই বাথরুম-কন্ট্রাক্টর চিনতে পেরেছিল – বাথরুম-ফিটিংসের জন্য চোরাই সেই ব্রোঞ্জ আসলে স্তালিনের মাথা।

যেন আমরা ক্ষমতা তৈরি করিনি। যেন আমরা তৈরি ক্ষমতা ভোগ করি।

অথবা সেই শত্রুমিত্র ভেদটাই আর নেই। আমরা দিল্লির শত্রু নই। বা, বন্ধুও নই। দিল্লির ক্ষমতায় যারা আছে ও এখানে আমরা যারা ক্ষমতায় আছি – তারা নিজেদের ক্ষমতার নিশ্চয়তার জন্যই কেউ কারো শত্রু নই। কোনো এমন অবস্থা তৈরিই হবে না –             যে-অবস্থায় সৈন্যবাহিনীকে লাগিয়ে এখান থেকে আমাদের সরাতে হবে। কোনো এমন  অবস্থাই হবে না – যে অবস্থায় আমাদের মানুষের ভিতর সমুদ্রের আন্দোলন তরঙ্গিত করতে হবে।

পৃথিবীতে নাকি এখন কোনো স্থানাঙ্ক নেই। এমন নাকি কোনো ঘর নেই যার ভিতরে পৃথিবী বয়ে যাচ্ছে না। অথচ, এমন পৃথিবী দিয়ে আমরা কী করব, যে-পৃথিবী তার ছোট হওয়ার চাপে আমাদের দম আটকে দিচ্ছে ও শরীর কুঁকড়ে দিচ্ছে?

মুম্বাই থেকে এক জ্যোতিষী, তিনি ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার, বলেছেন, ৫২ বছরের মধ্যে এই প্রথম বৃহস্পতি চলেছেন সূর্যের সঙ্গে ও ৩১ জুলাই সিংহরাশিতে প্রবেশ করবেন। সাধারণত গুরুপূর্ণিমা ও তুলসীপূজার বা পার্শ্বৈকাদশী বা কৃষ্ণকলঙ্কিনী ব্রতের মধ্যে কোনো বিয়ে হয় না। এই বছর সূর্য অধিষ্ঠিত সিংহরাশিতে, বৃহস্পতিও অধিষ্ঠান করবেন। সূর্য আর বৃহস্পতির সহাবস্থান বিপজ্জনক। এই সহাবস্থানকালে বিয়ে হলে, সে-বিয়ে টেকা মুশকিল, টিকলেও তার ফল ভালো হবে না। ওই ইঞ্জিনিয়ার- জ্যোতিষী অঞ্জনী কুমার তেওয়ারি এ-বছরের গুরুপূর্ণিমা  অর্থাৎ ২৩ জুনের পরই বলেছেন যে, এই  সময়ের মধ্যে অন্য কোনো শুভকর্মও করা অনুচিত, যেমন, উপনয়ন, পাটিপত্র, স্বর্ণ বা মণিমুক্তা কেনা, শেয়ারে পরিবর্তন করা যায় এমন ডিবেঞ্চার কেনা ইত্যাদি। এই নিষেধ তাদের পক্ষে কার্যকর হবে না, যে পাত্র ও পাত্রীর জন্ম সিংহরাশিতে। একজনের জন্ম সিংহরাশিতে, আরেকজনের জন্ম বৃহস্পতিতে হলেও এ-নিষেধ খাটবে না। পরের বছরের ১৪ এপ্রিল থেকে ১৪ মে পর্যন্ত উত্তম সময় বটে কিন্তু বিবাহলগ্ন কম। সুতরাং ওই একমাসে মাত্র ০.১ শতাংশ বিয়ে হতে পারে। সামনের বছরের ২৭ আগস্ট বৃহস্পতি সিংহরাশি ছেড়ে গেলে আবার শুভদিনের স্বাভাবিক চক্র ফিরে আসবে। আরেক জ্যোতিষী বেজন দারুওয়ালা এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন। তিনি বলেছেন, তিনি শুধু হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যায় বিচার করেন না – তিনি কোকশাস্ত্র, ভৃগুসংহিতা, পক্ষিশাস্ত্র, অক্ষশাস্ত্র প্রয়োগেও বিচার করেন। বৃহস্পতি ও সূর্য একই  সঙ্গে একই রাশিতে থাকলেও বিবাহ সম্পন্ন হতে পারে, ভূ-সম্পত্তি ক্রয় করা যেতে পারে ও যে-ডিবেঞ্চার শেয়ারে বদলানো যাবে তাও কেনা যাবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো কুম্ভমেলা। বৃহস্পতিবার গুরুগ্রহ, তাঁর সহায়ে উন্নতি সম্ভব আর এক সপ্তাহ পরে বৃহস্পতি সিংহরাশিতে প্রবেশ করবেন যেখানে স্বয়ং গ্রহরাজ সূর্য অবস্থান করছেন। সূর্য ও বৃহস্পতির একই রাশিতে অধিষ্ঠান তো এক বিশেষ শুভ কাল, যা দুর্লভ।

এই মতপার্থক্য মুম্বাইয়ে ও ভারতে এতটা প্রাধান্য পাওয়ার কারণ আছে। ভারতীয় কোটিপতি অরুণ নায়ারের সঙ্গে ব্রিটিশ অভিনেত্রী ও সুপারমডেল লিজ হার্লের বিয়ের দিন ধার্য হয়েছে পরের বছর ২৯ ফেব্রুয়ারি, মুম্বাইয়ে। এই আন্তর্জাতিক বিবাহ মুম্বাইয়ের সামাজিক জগতে একটি প্রধান ঘটনা হতে চলেছে। লিজ তাঁর ফ্যাশন-ডিজাইনার বন্ধু বিখ্যাত ফ্যাশন-বিশেষজ্ঞ দোনাতেলা ভার্সেসকে তাঁর ইচ্ছা জানিয়েছেন। লিজ জানিয়েছেন, ভার্সেস যদি মুম্বাইয়ের বিবাহবাসরের জন্য একটি রক্তবর্ণ শাড়ি ডিজাইন করে দেন তাহলে লিজ খুব খুশি হবেন। লিজ শুধু রঙের ও শাড়ির কথাই বলেছেন – ডিজাইনের দায়িত্ব ভার্সেসের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। লিজ আরো বলেছেন যে, লন্ডনে তাঁর যে দ্বিতীয় বিবাহবাসর হবে, তার জন্য ভার্সেস যেন একটা সাদা অাঁসাম্বেল ডিজাইন করে দেন।

লন্ডনের দি মেইল অন সানডে কাগজে বেরিয়েছে যে, লিজ তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলেছেন, অরুণ এটা লিজের কাছে পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, তাঁদের পরিবারের ইচ্ছা-অনুযায়ী লিজকে প্রথমে মুম্বাইয়েই বিয়ে করতে হবে, ও সেই বিয়ের আগে ইংল্যান্ডে বা অন্য কোথাও কোনো বিয়ে করা চলবে না। লিজ যখন ভারতে এসেছিলেন, তখন তিনি ভারতকে ভালোও বেসেছিলেন। তাঁর বিয়ের ভারতীয় পোশাক একটা অভূতপূর্ব কিছু হবে বলে তাঁর ধারণা। লিজ এর আগে এস্টি লডারের মডেল ও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ছিলেন। ১৯৯৪-এ তিনি একটি সিনেমার প্রিমিয়ার-অনুষ্ঠানে ভার্সেসের তৈরি একটি কালো পোশাক পরে রাতারাতি খ্যাতির চূড়ায় উঠে যান। সেই পোশাকটি তাঁর শরীরে সেঁটে ছিল নানা মাপের সেফটিপিন দিয়ে। সেফটিপিনগুলো সব বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই এই পোশাকটির নাম হয়ে যায়, ‘সে-ই ফ্রকটা’। আর লিজ হয়ে যান ফ্যাশনবিগ্রহ। তাঁর মুম্বাই-বিয়েতে তিনি তেমন কিছু করে কাউকে শক দিতে চান না। তিনি নাকি ভার্সেসকে বলেছেন, বরং একটু গোঁড়া হতে।

পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে করা উচিত হবে কী না এই নিয়ে জ্যোতিষীরা নানারকম মত দিতে শুরু করেছেন।  অরুণের বয়স ৩৭ ও লিজের ৩৬। তাঁদের জন্মতারিখ ও সময় এখনো প্রকাশিত হয়নি। ফলে, তাঁদের কোষ্ঠীবিচার, যোটক-বিচার ও তাঁদের দাম্পত্যযোগ্যতা বিচার সম্ভব হচ্ছে না। নায়ার-পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে – তাঁরা ধর্মীয় ও পারিবারিক সব রীতি ও আচারই পালন করবেন এবং প্রয়োজনে জ্যোতিষী ও পুরোহিতদের সাহায্যে রিষ্টিবিনাশ ও বিঘ্ননাশযজ্ঞ করবেন। কিন্তু বিয়ের তারিখ এগিয়ে আনা বা পেছানো সম্ভব হয়নি, যেহেতু অরুণের ইতালিয়ান স্ত্রী ভ্যালেন্তিনা পেদ্রোনির কাছ থেকে ডিভোর্স পেতে হয়েছে ও লিজের শুটিং ও মডেলিংয়ের সময়সূচি মেনে চলতে হয়েছে।

লিজ ও অরুণের বিয়েতে লিজ কি হিন্দু হয়ে যাচ্ছে না – মুম্বাইয়ে। হিন্দুরীতি অনুযায়ী কন্যাকে সম্প্রদান করেন কন্যার বাবা বা পিতৃস্থানীয় কেউ। সেই দানের ফলে কন্যার গোত্রান্তর হয়ে যায়। ধর্মান্তর না হলেও গোত্রান্তরে বাধা নেই। পুরোহিত দর্পণে বিধান আছে, বর বা পুরুষকে ধ্রুবক ধরে নিয়ে তার সঙ্গে সব রকম 888sport promo codeর বিবাহ হতে পারে, বিবাহ ছাড়াও তাদের সঙ্গম হতে পারে, সঙ্গমের পর তাদের সন্তান হতে পারে। সেই সন্তানরা সম্পত্তিও পেতে পারে। এখানেও সন্তানের অর্থ শুধুই পুত্র ও কখনোই কন্যা নয়। কোন জাতীয় স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমের ফলে উৎপন্ন পুত্র সম্পত্তির কতটা অংশ পাবে, তার তালিকা করে দেওয়া আছে। ব্রাহ্মণীর গর্ভে সম্পূর্ণ অংশ, ক্ষত্রিয়ানীর গর্ভে এক-তৃতীয়াংশের বেশি নয়, বৈশ্যার গর্ভে এক-পঞ্চমাংশের বেশি নয় ও তার ভিতর গোসম্পদ ও প্রাসাদসম্পদ ধরা হবে না। শূদ্রাণীর গর্ভজাত পুত্র কোনো সম্পত্তি পাবে না; কিন্তু পালন পাবে মানে ভাত-কাপড় ও মর্যাদা পাবে যে সে গৃহস্থের শূদ্র-সন্তান। পঞ্চম শ্রেণির শূদ্রাণীর গর্ভজাত পুত্র গৃহস্থের সম্পত্তির কোনো ভাগ তো পাবেই না, তাকে গৃহসীমা, রাজার ক্ষেত্রে রাজ্যসীমা থেকে বের করে দেওয়া হবে। তাকে নির্বাসন দেওয়া হবে বললেও বোঝায় বাসনে তার অধিকার আছে। হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী এই অতিশূদ্রাণীর গর্ভজাত অতিশূদ্র পুত্রকে জন্মমাত্র হত্যা করে ফেলতে হবে, বা হত্যাতুল্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে – যেমন পাহাড়ের মাথা থেকে ফেলে দেওয়া, গভীর নদীর জলে ডুবিয়ে দেওয়া, পশুশালায় রক্ষিত পোষা মাংসাশী পশুদের মুখের সামনে খাদ্য এগিয়ে দেওয়া। হিন্দুশাস্ত্রে শুধু পুরুষের কামসিদ্ধির ব্যাখ্যা আছে। 888sport promo code সেখানে মাত্রই ‘সংযোগে’র বিপরীত কিছু। ‘সংযোগ’ শব্দটি ব্যবহার করে বাৎস্যায়ন 888sport promo codeর সেই ভূমিকা স্বীকার করেছেন। ‘সঙ্গম’ শব্দটিতে শুধু  গমনকর্তা পুরুষ আছে। সে যখনই মনে হবে, তখনই রমণ করতে পারবে, যাকে ইচ্ছে তাকে। অরুণ নায়ার যে লিজকে গ্রহণ করছে, তাতেই তো লিজের বর্ণান্তরণ বা ধর্মান্তরণ ঘটে যাচ্ছে। ঘটে যাচ্ছে কি? হিন্দু ধর্ম জনমান্তরে বিশ্বাস করে, কর্মফলেও বিশ্বাস করে; কিন্তু এক বর্ণ থেকে অন্য বর্ণে রূপান্তরণে বিশ্বাস করে না। কোনো শূদ্র কখনো কি বর্ণহিন্দু বলে গৃহীত হয়েছে?

তাহলে লিজ কী বলে গৃহীত হবে, হিন্দু সমাজে, এ নিয়ে সারা পৃথিবীতেই একটা তর্ক ও তত্ত্ব পাকিয়ে উঠল।

তামিলনাড়ু ও গুজরাট রাজ্য দুটিতে ধর্মান্তর গ্রহণের বিরুদ্ধে আইন হয়েছে। সেই আইন দুটির জন্য শুধু ওই রাজ্য সরকার দুটিই প্রধানত দায়ী যদিও কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রেসিডেন্টও অনেকটা দায়ী। ভারতে প্রচলিত বিধি অনুযায়ী কোনো রাজ্য বিধানসভায় পাস করা আইন ততক্ষণ পর্যন্ত আইন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতি ও রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর না মেলে। মহামান্য পোপ বলেছেন – এই দুটি রাজ্যের এই দুটি আইন ভারতীয় সংবিধানের ২৫ ও ২৮ সংখ্যক ধারায় বর্ণিত ধর্মাচরণের স্বাধীনতার ধারণা, ও মানবাধিকার ধর্মীয় স্বাধীনতাসংক্রান্ত বিশ্ব ঘোষণাপত্রের ১৮ সংখ্যক ঘোষণাটির বিরুদ্ধতা করে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তাদের বার্ষিক সভায় পোপের কথায় আপত্তি করেছে ও পোপকে নিন্দে করেছে। ফলে, ভারতীয় খ্রিষ্টানরা আতঙ্কিত যে, গুজরাটের পর তাঁরাই  হয়তো জাতিদ্বেষীদের লক্ষ্য হয়ে উঠবেন। এই বিশেষ অবস্থায় নায়ার-পরিবারের মতো নেতৃস্থানীয় পরিবার যদি লিজ-অরুণের বিয়ের হিন্দুত্ব ব্যাখ্যা করেন – তাহলে ভালো হয়। যাঁরা হিন্দুই থাকতে চান অথচ সঙ্ঘ-পরিবারে ঢুকতে চান না, তাঁরা একটা ভরসা পাবেন। সঙ্ঘবিরোধী অথচ হিন্দু, কি এখনো ভাবা যাচ্ছে না? সঙ্ঘবিরোধী হলে হিন্দু নয়, আর হিন্দু হলে সঙ্ঘবিরোধী নয় – এই ভাগাভাগিগুলি ভেঙে যায়নি এখনো?

কী করে ভাঙে? এগুলো?

ওয়েন্ডি লিউইস নামে কে-একজন একটা বই বের করেছিল – ‘মেরিলিন মনরো ও জ্যাকলিন কেনেডির গোপন চিঠিপত্র’। বিষয় – প্রেসিডেন্ট কেনেডি তাদের দুজনের মধ্যে কার সঙ্গে শোবেন। সব চিঠিই বানানো, সব ঘটনাই কাল্পনিক কিন্তু পড়তে পড়তে সব এত সত্যি মনে হয় যেন সত্যিই সত্যি। ভার্চুয়্যাল ট্রুথ।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিল ক্লিনটন তাঁর স্ত্রী হিলারির এক রিসেপশনে হাজির হয়ে বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর হাজির হওয়া কী হাজির – আপনার পকেটে কি একটা বন্দুক, না আমাকে শুধুই বলছেন,  ‘কী খবর?’ একপাল কমবয়েসি ছুকড়ি ক্লিনটনকে ঘিরে ধরে জানাল, ‘কী সুইট ক্লিনটন। মোনিকা সো লাকি।’ হিলারি একেবারে গদগদ। ক্লিনটন তাহলে এখনো মেয়েদের টানে? ‘হিলারি লড়ে যাও।’ – ক্লিনটন তার যে কাজের জন্য ইমপিচ হতে যাচ্ছিল সেটাই কমবয়েসিদের ভোট পাইয়ে দেবে হিলারিকে।

‘হ্যালো -’

‘হ্যাঁ, রমাপদবাবু আছেন?’

‘বলছি তো -’

‘স্যার, একটু ধরুন, সিএম কথা বলবেন।’

‘হুঁ-উ-উ’

‘রমাপদদা -’

‘হুঁ উ-উ, বলো।’

‘ঘুমিয়েছিলেন নাকি?’

‘ছিলাম। জাগিয়ে দিয়েছে।’

‘তাহলে শুনেছেন তো সব।’

‘সব কী, জানি না, ওই অর্ডিন্যান্সের কথাটাই তো বলল।’

‘কেন? লেজিসলেচারের কথা?’

‘হ্যাঁ। ওই দিল্লির মতো তো? ইউটি উইথ বিধানসভা।’

‘হ্যাঁ। ওইটিই তো, শেষ মুহূর্তে আমি বারগেইন করলাম।’

‘বারগেইন করলে? মানে, তোমার সম্মতিতেই -’

‘না, না, রমাপদদা, সে কী কথা? আমি একা সম্মতি দেওয়ার কে, পার্টিতে কথা হয়নি, নিজেদের মধ্যেই তো কথা হয়নি। আমাকে রাত নটায় হোম ফোনে ধরে বলল, তোমরা তো বরাবরই বলে আসছ, গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্টও বলেছ যে কলকাতা জাতীয় শহর, সুতরাং কলকাতার দায়িত্ব কেন্দ্রকে নিতে হবে। তা আমরা যদি কলকাতাকে ইউটি ডিক্লেয়ার করি, তোমরা খুশি তো?’

‘এত এমার্জেন্সি কীসের যে ফোন করে মত চাইছে?’

‘আমিও তো সে-কথাই জানতে চাইলাম তো হোম বললেন, সে-সব মুখে বলা যাবে না, মুখোমুখি বলতে হবে। তুমি কাল ফার্স্ট ফ্লাইটে চলে এসো। এয়ারপোর্ট থেকে আমার বাড়িতে। তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে অপেক্ষা করব। আসার সময় যদি পারো গরম-ভাজা কচুরি নিয়ে এসো কলকাতা থেকে। বোধহয় আজ মিডনাইটের আগেই অর্ডিন্যান্স করতে হবে।’

‘ও। তোমাকে ওই নটার সময়ই জানিয়েছে?’

‘হ্যাঁ। আমি তো পার্টি-অফিসে গিয়ে গোলাপদাদের মানে গোলাপদাকেই বলে এলাম। আপনার তো কেষ্টনগর ছিল?’

‘হ্যাঁ। এমনিতেই দেরি হয়েছিল, তারপর রাস্তায় এক ট্রাক উলটেছিল। ওরা কি তোমার কনফারেন্স নিয়েছে?

‘না। আমি বলেছি কাল সকালে যাচ্ছি। কিন্তু কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না, এমন কী পরিস্থিতি হতে পারে আমি বুঝতে পারছি না। আপনারা তাহলে যা করার করুন। আমরাও যা করার করব।’

‘তাহলে, তাই করেছে? ওদের যা করার? শুধু তোমাকে জানিয়ে রেখেছে – এই তো? তবে তো আমাদের কোনো দায় নেই। আমাদের জড়িয়ে দেবে না তো যে আমরা সম্মতি দিয়েছি -’

‘না, শুধু ইনফর্ম করেছে বললে ঠিক হবে না। আমাকে বলল, কাল মুখোমুখি সব জানতে পারবে। শুধু এটুকু বলছি আজ মিডনাইটের আগেই আমরা অর্ডিন্যান্স জারি করতে বাধ্য হতে পারি। তোমাকে অনুরোধ করছি – কোনো অ্যাকশন আগে থাকতে নিও না। তোমার জেনারেল সেক্রেটারির সঙ্গে কথা হয়েছে।’

‘দিল্লি থেকে ফোন করেছিল ওরা?’

‘হ্যাঁ। গোলাপদাকে শুধু বলেছিল – কিপ ইয়োর অপশন্স ওপেন। তবে ব্যাপারটা কী তা বলেনি, বলেছে আমার কাছ থেকে জেনে নিতে।’

‘তাহলে তো আমাদের মিডিয়াকে বলে দেওয়া দরকার – কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের আগে আমরা কিছু বলব না।’

‘মিডিয়া তো আমাকে রাতে পায়নি। আপনি বলে দেবেন। আমার মনে হয় মিডিয়া আপনাকে কনট্যাক্ট করার আগেই আপনি ওটুকু বলে দিন – কালকের সকালের লেট-সিটি তাহলে ধরতে পারবে। হোম আরো একবার ফোন করেছিল, তখনই ওই বিধানসভার কথাটা ওঠে।’

‘ওরা তুলল?’

‘না। আমাকে বলল, তোমাকে শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছি তুমি একমাত্র সিএম যে চার-চারটি ইন্টারন্যাশনাল বর্ডার নিয়ে আছ। জে অ্যান্ড কে তোমার চাইতে দুটো শর্ট। চন্ডীগড়-টাইপ ইউটি হলে তো তোমরা ইনভেস্টমেন্ট পাবে। তখন আমি বলি – কী বলছেন, কলকাতা চলে যাওয়া কোনো বাঙালি মেনে নিতে পারে? আমাদের অ্যাসেম্বলি ছোট হয়ে যাবে। তখন বলল,  সে তো তুমি গেলাসটা আদ্ধেক-খালি না আদ্ধেক-ভরা কী দেখবে, তার ওপর নির্ভর করবে। ঠিক আছে বলে ছেড়ে দিলো। তারপর অর্ডিন্যান্সের কপিটা ফ্যাক্সে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাতে দেখি, সবগুলি প্রভিশনই তো রেখেছে, কলকাতাই রাজধানী, অ্যাসেম্বলিও থাকছে। যদি পার্টি এতে রাজি থাকে, তাহলে কাল হোমের সঙ্গে কথায় ডিম্যান্ড করব ইমেডিয়েট ডিক্লেয়ারেশন অব ইলেকশন প্রোগ্রাম টু দি ইউটি অ্যাসেম্বলি।’

‘সে-কথা তুমি হোম মিনিস্টারকে বলো কিন্তু আমার মনে হয়, কালকেই দিল্লিতে কোনো পাবলিক পজিশন নিয়ো না। ওরা যদি ইলেকশন ডেট অ্যানাউন্স করে তো করবে। পার্টিকেও তো ডিসিশন নিতে হবে এখানকার পাবলিক রিয়্যাকশন দেখে। পাবলিক রিয়্যাকশন যদি মিলিট্যান্ট ও হোস্টাইল হয়, তাহলে হঠাৎ একটা সুয়িং হয়ে যেতে পারে উলটোদিকে। আর, এমনও হতে পারে যে শহরের মধ্যবিত্তরা ভাবল – ভালোই তো হলো, ইউটি মানে একটু স্পেশ্যাল কেয়ার তো হবেই। দুই রাজ্যপাল, দুটো অ্যাসেম্বলি, দুটো মন্ত্রিসভা, এই সব আর কী! তুমি কাল সন্ধের মধ্যে ফিরে এসো।’

‘রমাপদদা, আমরা যদি কাল সকালে কোনো প্রতিবাদ না করি, হইচই বাধিয়ে না দিই, তাহলেই তো অপজিশন আর মিডিয়া ক্যাম্পেইন শুরু করে দেবে যে, আমাদের সঙ্গে সমঝোতা করেই এটা হয়েছে। এই ক্যাম্পেইন একবার উঠলে -’

‘তুমি এখনই মিডিয়ায় একটা স্টেটমেন্ট করে দাও না, মানে অ্যাপিলও বলতে পার, যে কলকাতা ও সন্নিহিত কয়েকটি জায়গা নিয়ে নির্বাচিত অ্যাসেম্বলিসহ ইউটি গঠনের আকস্মিকতায় আমরা ইত্যাদি। আমি আগামীকাল। বা আজকের। প্রথম ফ্লাইটে দিল্লি গিয়ে এ-বিষয়ে কথা বলছি। আমি আপনাদের কাছে আবেদন করছি যে বিক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ সত্ত্বেও ও’

‘আকস্মিক হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনের যথেষ্ট প্ররোচনার আশঙ্কা সত্ত্বেও আপনারা কোনো প্রকার চক্রান্তের ফাঁদে পা দেবেন না।’

‘এটাও বলে দাও – এখনই আমাদের এই রাজ্যের ভবিষ্যৎ ও শুভাশুভ সম্পর্কে যথোচিত ইত্যাদি।’

‘পশ্চিমবঙ্গবাসীর স্বার্থবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত আমরা মেনেই নেব না।’ (চলবে)