সৌমিত্র পর্যন্ত কিছু কথা : সৌমিত্রের সঙ্গে

দেবেশ রায়

৪১৫ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে আথেন্সের সিটি ডায়োনিসিয়ার ট্র্যাজেডি প্রতিযোগিতায় নাট্যকার ইউরিপিদেস যোগ দিয়েছিলেন তাঁর ট্রয়ের মেয়েরা নাটকটি নিয়ে। ২০,০০০ দর্শক তাঁকে হারিয়ে দিলেন। জিতলেন – জেনোক্লেস নামে এক নাট্যকার। মজা হলো – এই জেনোক্লেসের কোনো নাটকের একটি লাইনও আর পাওয়া যায় নি। এমন কি, কোনো লেখায় তাঁর নামটিও কেউ করে নি, বা তাঁর কোনো নাটক থেকে কোনো উদ্ধৃতিও কেউ কোথাও দেয় নি। কিন্তু ইউরিপিদেসের ট্রয়ের মেয়েরা নাটকটির এখনো নতুন-নতুন 888sport app download apk latest version বেরচ্ছে, সেই নাটক নিয়ে গ্রিকবিদ্দের ভিতর প্রায়ই আলোচনা হচ্ছে।

কেন এমন ঘটেছিল?

কারণটা খুব সোজা। আথেন্স তখন সাম্রাজ্যবিস্তারী যুদ্ধমাতাল। ইউরিপিদেস ছিলেন যুদ্ধবিরোধী। ট্রয়ের যুদ্ধের কাহিনি নিয়ে লেখা নাটকটিতে যুদ্ধের বিরুদ্ধে বললেন। শুনে, আথেন্সের দর্শকরা তাঁকে হারিয়ে দিতে কোথাকার এক জেনোক্লেসকে জিতিয়ে দিলো। আসলে ইউরিপিদেসকে হারিয়ে দিল। আসলে, যুদ্ধবিরোধিতাকে হারিয়ে দিলো।

কলকাতার ইনডোর স্টেডিয়ামে হাজার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া হচ্ছে। স্টেডিয়ামে হাজার-হাজার দর্শকের বসার ব্যবস্থা আছে, কিছু বাড়তি ব্যবস্থাও করা হয়েছে। কিন্তু হাজার গায়ককে বসাবার গ্যালারি বানাতে হয়েছে। তাঁদের গাইবার মতো পরিসর দিতে হয়েছে। কত গান হাজার কণ্ঠের সমবেত ধ্বনিতে নতুন হয়ে উঠছে। ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ গাওয়া হলো স্বরবিতান মুদ্রিত সুরে। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া প্রচলিত সুরে না। দর্শক-শ্রোতারা অভ্যাস কাটিয়ে উঠতে না-উঠতেই গাওয়া শেষ। কোনটা তা হলে ঠিক শোনা হবে – বহুশ্রম্নত সুরের গানটি, নাকি বিরলশ্রম্নত স্বরলিপিভুক্ত গানটি? শোনার অভ্যেসও তো সংগীতের গ্রাহ্য হওয়ার একটি শর্ত।

ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখা প্রথম দেখানো হচ্ছে ভবানীপুরে একটি হলে। সন্ধ্যার শোতেই তেমন ভিড় হয় নি। আর রাতের শো প্রায় জনহীনই বলা যায়। আমরা দুই বন্ধু দেখছিলাম। দর্শক যে ক-জন ছিলেন, তাঁরাও অনেকে কিছুক্ষণের মধ্যে বেরিয়ে গেলেন। ততক্ষণে সংলাপ, দৃশ্য আর রানওয়ের কালী আমাদের দুই বন্ধুকে বিবশ করে দিয়েছে। বিরতিতে লবিতে গিয়ে সিগারেট ফুঁকে দম নিয়ে এলাম। দুই বন্ধুর মধ্যে কোনো কথা হলো না। বোধ হয় হলেরই কেউ এসে সসংকোচ জিগ্গেস করেছিলেন, ‘আপনারা কি আর দেখবেন?’ দীপেনের (দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়) একটা ভঙ্গি ছিল – দাঁড়িয়ে দুই হাত মাথার পেছনে দেয়া। আমি জানতাম ওটা ওর গভীর মনঃসংযোগের ভঙ্গি। সেই ভঙ্গিতে ও জিজ্ঞাসুকে খুব মলিন হেসে বলল, এই নিরুপায় মলিন হাসিটাও আমার বড় চেনা – ‘কাল তো আর দেখাবেন না, আজই দেখিয়ে দিন।’ ভদ্রলোকও একটু হেসেই, ‘তা হলে বসুন, চালিয়ে দি’, বলে চলে গেলেন। তারপর কত দিন, রাত, বছর গেল, সুবর্ণরেখা দেখা আর শেষ হলো না।

এই ঘটনাগুলি, প্রায় আড়াই হাজার বছরে ছড়ানো মাত্র তিনটি ঘটনাকে, আলাদা করে নিলে অনেক প্রশ্নই তৈরি করা যায়। কিন্তু আমি মাত্র একটি প্রশ্ন তৈরি করতে চাইছি। সেটা খুবই নিকট বর্তমানের একটি 888sport live chatজিজ্ঞাসা। জিজ্ঞাসটি হচ্ছে – যে-সব 888sport live chatরূপ অনিবার্যতই একসঙ্গে অনেক দর্শক-শ্রোতা নির্ভর, যেমন স্টেডিয়াম-সংগীত ও সিনেমা, সেগুলির নান্দনিক বিচার কি প্রচলিত-পুরনো-চিরকালীন অভিজ্ঞতা বা অভ্যাসের সঙ্গে মিলিয়ে বা নিরিখে, বা বিধি-উপবিধি দিয়ে করা যায়। নাকি সেগুলির জন্য নতুন নান্দনিক ধারণা তৈরি করা দরকার?

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় তাঁর সাম্প্রতিক একটি 888sport liveে – ‘সোনালি  পর্যটন : ছায়াছবি’ (শারদীয় কালান্তর, ১৪২০) – কথাটি তুলেছেন।

তাত্ত্বিক-দার্শনিক একটি জার্নালে প্রকাশিত এমন লেখাটিতে বিভিন্ন খেলার জ্যান্ত টেলিকাস্ট বা অলিম্পিক খেলার সম্পাদিত টেলিকাস্টকেও ধরা হয়েছিল এই যুক্তিতে যে, ওই টেলিকাস্টগুলির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ‘খেলা’ নয়, ‘খেলা’কে উপলক্ষ করে এক নান্দনিক অভিজ্ঞতায় দর্শককে ধরে রাখা। এমন চিন্তার মৌলিকতা ও যুক্তির জোর অস্বীকার করা যায় না।

আমি সেই উত্থাপিত প্রশ্নটির সঙ্গে থিয়েটারটাও জুড়ে নিলাম সমস্যার জটিলতা বাড়াতে আর আমাদের এই কলকাতা শহরের দুটো অভিজ্ঞতা জুড়ে নিলাম সমস্যার নৈকট্য বুঝতে। মূল সেই লেখাটিতে থিয়েটারকে প্রাচীন আঙ্গিক মনে করে বাদ দেওয়া হয়েছিল। যে-নিরিখে স্টেডিয়াম-সংগীত বা সিনেমাকে বাছা হয়েছে, আমার মনে হল, প্রাচীন গ্রিসের থিয়েটারেও সেই সমস্যা ছিল। থিয়েটারকে ধরলে সমস্যাটা আর একেবারে আধুনিক কালের নান্দনিক সমস্যা থাকে না, চিরকালীন একটি সমস্যাই হয়ে দাঁড়ায়। অনেক লোক বা ব্যক্তি-ব্যতিরেকী সমাবেশ, কি দৃশ্য888sport live chatের নান্দনিকতা অনেক সময়ই নির্ধারণ করে? সেই নির্ধারণ ক্ষমতা কি সেই সমাবেশের সমাজতত্ত্ব দিয়েও অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে? যুদ্ধোন্মাদ আথেন্স যেমন ইউরিপিদেসকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কলকাতার সিনেমা-দর্শকও যেমন ঋত্বিক ঘটককে প্রত্যাখ্যান করেছিল।

দর্শক বা গ্রাহক সমাবেশের সমাজতত্ত্ব যদি প্রত্যাখ্যানে সক্রিয় থাকে, তা হলে সেই সমাজতত্ত্ব তো গ্রহণেও সক্রিয় থাকার কথা। তিরিশের দশক থেকে কাননবালার ও পঞ্চাশের দশক থেকে সুচিত্রা-উত্তম জুটির এমন জনমোহনীয়তা কি সিনেমার গল্প, চিত্রনাট্য, ক্যামেরা, অভিনয় – এইসবের ওপর নির্ভরশীল ছিল, নাকি, ওসব ছিল অনেকটাই সহায়ক উপাদান? কাননবালাতে ও সুচিত্রা-উত্তমে, ওই সময়কার সিনেমার দর্শক ওই সময়ের ভিতর নিহিত তার আকাঙক্ষার প্রকাশ দেখেছিলেন?

 

দুই

এসব নিয়ে কথাবার্তা বলার অধিকার আছে, এমন কোনো ভুল আত্মবিশ্বাস আমার নেই বলেই তো ধারণা ছিল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কিছু লেখা পড়ে এমন আত্মবিশ্বাস ঘটল। আমাদের অভিনয় জগতে, আমাদের মানে ভারতের অভিনয় জগতে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একেবারে আলাদা। তিনি তো সারাজীবন অভিনয়ই করেছেন – নাটকে ও সিনেমায়। তাঁর মত না হলেও, প্রায় তাঁর মতই, অনেকেই সেটা করেছেন। কিন্তু সৌমিত্র এই একটা বিষয়ে আর সবার থেকে আলাদা যে, তিনি নাটক নিয়ে, সিনেমা নিয়ে, অভিনয় নিয়ে সারাজীবনই লিখে গেছেন, এই কথা প্রমাণ করতে অভিনয় তাঁর স্বনির্বাচিত বৃত্তি, তাই সেই বৃত্তির ভিতরকার সমস্যা ও উত্তরণ চেনা ও বলার দায় তাঁরই। তিনি ছাড়া আর-কেউই তো এমন লেখা কোনো কালেই লেখেন নি। পুরনো ও সমকালীন অভিনয়888sport live chatীদের নিয়ে তাঁর ছোট-বড় নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমাদের নতুন করে সিনেমা-থিয়েটার দেখতে উৎসাহিত করে ও নাটক-ফিল্ম নিয়ে ভাবতেও। এমন কেন আরো সবাই লেখেন না? যদি লিখতেন, তা হলে বাংলা নাট্যাভিনয় ও সিনেমার ইতিহাস ভাবার ও লেখার কাজটা অনেকটাই সাধ্যের মধ্যে আসত। বাংলা সিনেমা সম্পর্কে কয়েকজন নির্ভরযোগ্য আলোচক নিজেদের তৈরি করে তুলেছেন বাইরে থেকে। যেহেতু বাইরে থেকে, তাই তাঁদের লেখাগুলি অনেকটা তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞতায় আমাদের সাহায্য করে। গৌরাঙ্গ প্রসাদ ঘোষ একেবারে একা বাংলা সিনেমার যে-তথ্য সংগ্রহ করে গেছেন তা এখনো ব্যবহার করাই হয় নি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তত্ত্বের ধারেকাছেও ঘেঁষেন না, অথচ তাঁর প্রায় প্রতিটি লেখাতেই নিশ্চিত বোঝা যায় সেই তত্ত্বগুলি তাঁর কাছে একমাত্র প্রয়োগেই সিদ্ধ হতে পারে। তাই তাঁর লেখাগুলিতে তাঁর ও অন্যদের অভিনয়ের কথাই শুধু আসে।

ফলে, তাঁর এই লেখাগুলিতে আমাদের মতো আনাড়িদের জন্যও বেশ দরজা খোলা থাকে। তাঁর কথাগুলি থেকে নতুন কথা জাগে। আমরাও তো সিনেমা-থিয়েটার দেখেছি। তা হলে আমরাও তো এ নিয়ে দু-এক কথা বলতে পারি। সেই সব কথায় সৌমিত্রও উত্তেজিত হয়ে আরো কিছু এমন লেখা লিখতে পারেন। তাতে আমাদের লাভ।

এমন আত্মশিক্ষার্থেই এই আলোচনা করছি বললে অন্তত অর্ধমিথ্যা বলা হবে। তার পাপ না কী পুরো মিথ্যে বলার চাইতে বেশি। তেমন মিথ্যে বলার জন্যই যুধিষ্ঠিরের নরকদর্শন ঘটেছিল।

সৌমিত্র তাঁর এই আলোচনাগুলি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যেই আটকে রেখেছেন। সিনেমা-থিয়েটারের দর্শকরা কী করে তাঁদের প্রতিক্রিয়া দিয়ে একটি ফিল্ম গ্রহণ করেন, একটি নাটক তৈরি করেন, একজন অভিনেতাকে স্টার বানিয়ে ফেলেন সেই প্রক্রিয়াটি নিয়ে কথা তোলেন নি।

ব্যাপারটি ভাবলে কিন্তু একটু অদ্ভুতই লাগে। নাটক ও সিনেমার প্রধানতম দুশ্চিন্তা দর্শক নেবে কী না, নিল কী না। সে বাণিজ্যিক থিয়েটারই হোক আর গ্রম্নপ থিয়েটারই হোক। নাটক বা সিনেমা না-ধরলে সমস্ত ভাবনাচিন্তা পরিশ্রম বৃথা হয়ে যায়। আর ধরল কী ধরল না তা বুঝে ওঠার জন্য সময় থাকে মাত্র দু-চারটি অভিনয় বা দু-চার দিনের শো। কোটি-কোটি টাকার বিনিয়োগ দর্শক-গ্রাহক নিলেন কী নিলেন না, তা নির্ধারিত হয়ে যায় প্রথম চার-পাঁচ দিনেই। সেই সিনেমাটি বা নাটকটি ফিরিয়ে নিয়ে দর্শক-গ্রাহকের প্রত্যাখ্যানের কারণ আন্দাজ করে ও সেই আন্দাজ অনুযায়ী একটু অদলবদল করে আবার মঞ্চে বা পর্দায় ফিরিয়ে আনার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেন না। এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে এমন 888sport live chatের চর্চা তবু কী করে হয়? কেন হয়? এর একটা উত্তর – যে-888sport live chatী সিনেমা বা থিয়েটারকে তাঁর আত্মপ্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে জানতে পেরে গেছেন ও সেই আত্মপ্রকাশের জন্য নিজেকে তৈরি করেছেন, তাঁর তো কোনো পরিত্রাণ নেই। তিনি বারবার ব্যর্থ হতে পারেন, তবু, সেই ব্যর্থতায় মাথা খোঁড়া ছাড়া তাঁর কিছু করার থাকে না।

এমন দুর্দৈব শুধু সিনেমা, থিয়েটার, গ্যালারি-সংগীত ইত্যাদি 888sport live chatপ্রকরণেই ঘটতে পারে, যেহেতু, এই প্রকরণগুলির সাফল্য নির্ভর করে বহু দর্শক-গ্রাহকের অনুমোদনের ওপর, আর সে অনুমোদনগুলি বাধ্যত ঘটতে হয় এক সপ্তাহের কম সময়ে, তিন-চারটি মাত্র অভিনয়ে।

এমন 888sport live chatপ্রকরণগুলি বেঁচে থাকে কিন্তু এমন পরিচালক ও অভিনেতাদের ওপরই নির্ভর করে, যাঁরা নিজেরাও জানেন যে, তাঁরা প্রতিভাধর নন, অথচ যাঁরা দর্শক-গ্রাহকের অনির্দিষ্ট যে-সমাজ, তারই অজানা কোনো প্রত্যাশাকে বা সুপ্ত কোনো ইচ্ছাকে পূরণ করেন, বা প্রায় পূরণ করেন, বা জাগিয়ে তোলেন। তখন এই দর্শক-গ্রাহক সমাজ সেই পরিচালক-অভিনেতাকে একশ গুণ সমর্থন দেয়। একজন দর্শক দশ-বিশবার একই সিনেমা বা থিয়েটার দেখতে ফিরে-ফিরে আসেন। লোকের মুখে-মুখে সে-কথা রটে যায়। বাইরে থেকে দর্শকরা দু-এক দিনের জন্য চলে আসেন সেখানে, যেখানে সিনেমাটি দেখনো হচ্ছে বা নাটকটি অভিনীত হচ্ছে। সিনেমা-থিয়েটার যেমন পরিচালক-অভিনেতাকে ডোবাতে পারে, তেমনি, আবার সিংহাসনে বসাতেও পারে – ওই পাঁচ-সাতদিনের কয়েকটি শো আর তিন-চারটি অভিনয়ের সীমার মধ্যেই।

কোনো একজন 888sport live chatীর মাহাত্ম্য বা নিশ্চয়তা, কোনো একটি গল্প তৈরির কৌশল, সিনেমাটোগ্রাফির কোনো অভিনবত্ব – কোনো কিছুই এটা নিশ্চিত করতে পারে না যে, দর্শক-গ্রাহক ওই সিনেমটিকে বা নাটকটিকে ‘নেবে’। তাই সেই দর্শক-গ্রাহক সমাজের ইচ্ছেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও কি কম হয়? একজন অভিনেতার জনপ্রিয়তার কারণ খুঁজে বের করে, সেই বৈশিষ্ট্যকেই প্রধান করে গল্প বাছা, এইভাবে ‘স্টার’ তৈরি করা। কোনো অভিনেত্রীর গলায় কোনো গায়িকার কণ্ঠস্বরের গান বসানো, ক্রাইম-থ্রিলার, ডিটেকটিভ গল্প, কিশোর-কিশোরীর প্রেমের গল্প, বুড়োবুড়ির প্রেমের গল্প। এমন অবিশ্যি সব 888sport live chatপ্রকরণেই হতে পারে। এমনকি 888sport app download apkতেও। কিন্তু সিনেমা-থিয়েটারের মতো আর-কোনো 888sport live chatপ্রকরণে তো ঘাড়ের ওপর এমন খাঁড়া ঝোলে না – মাত্রা কয়েকটি শো ও কয়েকটি মাত্র অভিনয়। এরই ভিতর স্টার তৈরি হওয়া, এরই ভিতর একজন দর্শকের বারবার ফিরে আসা, এরই ভিতর কোনো স্বপ্ন খুঁজে পাওয়া, এরই ভিতর কোনো স্বপ্নে জেগে ওঠা।

 

তিন

কাননবালা বাংলা সিনেমার প্রথম সুপার-স্টার। সিনেমা, পুরোপুরি সিনেমা তখনো জন্মায়ই নি। ছবি চলাফেরা করে এই মাত্র। তারপর একটু-আধটু কথা বলল। তখনো পাত্রপাত্রীর গলায় গান শোনা নিয়ে ঝঞ্ঝাট কাটে নি।

কিছু পুরনো জানা গল্প দিয়ে যে সিনেমা শুরু হয়েছিল তার সমস্ত টানটাই ছিল এই বিস্ময় : ছবি চলে ও কথা বলে। তেমন অসম্পূর্ণ আয়োজনের মধ্যে প্রমথেশ বড়ুয়া বিলেত থেকে কিছু আধুনিকতা নিয়ে এলেন। তিরিশের দশকের সেই মাঝামাঝি সময়ে কলকাতায় হলিউডের ছবি এসে গেছে। হলিউডের ছবিও অসম্পূর্ণ ও কৃৎকৌশলে দুর্বল কিন্তু কলকাতায় তৈরি বাংলা ছবির চাইতে বহুগুণে উন্নত।

বাঙালি দর্শক হলিউডের সিনেমায় নতুন চোখে 888sport promo code শরীরের দৃশ্যতা আবিষ্কার করলেন। বিশ শতকের মধ্যতিরিশের কলকাতায় মেমসাহেব খুব কিছু দুর্লভ দৃশ্য ছিল না। অ্যাংলো-ইনডিয়ান সমাজের মেয়েদের পোশাক-আশাক চলাফেরাও কলকাতার বাঙালি সমাজের চেনা ও দেখা। কিন্তু বাঙালি ‘ভদ্র’ বা ‘গৃহস্থ’ ঘরের মেয়েরা তখন, তখনো, ঘর থেকে বেরোন নি। এমন কি মন্দির-টন্দিরে পুজো দিতেও তাঁরা বেরোতেন না। তার প্রমাণ আজকের কলকাতাতেও দেখা যায়।

বৌবাজার স্ট্রিটকে যদি উনিশ শতকের কলকাতার বাঙালি পল্লির দক্ষিণ সীমা বলে ধরে নেওয়া যায় – বাগবাজারের গঙ্গাপাড় থেকে, তা হলে এই অঞ্চলেই এখনো দেখা যাবে বসতবাড়ির সংলগ্ন অসংখ্য মন্দির। আরো উত্তরের কলকাতাতে তো প্রায় বাড়িতে-বাড়িতেই অমন মন্দির। বসিত্ম এলাকাতেও, এমন নিজস্ব মন্দির না থাকলেও, এমন কোনো ছোট গলিও পাওয়া যাবে না যেখানে একটা মন্দির, প্রায় বাড়ির মন্দিরের মতোই, নেই। এই মন্দিরগুলি তৈরি করে দিতেন বসিত্মর মালিক হিন্দু বড়লোকরা। এই বড়লোকরা অধিকাংশই ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু। মন্দির তৈরি করে দেওয়াটা ছিল তাঁদের নাগরিক আভিজাত্য ও হিন্দু উচ্চবর্ণভুক্তির অবলম্বন। উত্তর কলকাতার এই বাস্ত্ত ও পথ-মন্দিরগুলির প্রতিষ্ঠাতাদের মার্বল-লেখাগুলি যদি দেখা যায়, তা হলেই এটা বোঝা যাবে।

কিন্তু কলকাতায় বাঙালি মেয়েদের একেবারে দেখা যেত না, তাও না। তাঁরা ছিলেন শ্রমজীবিনী মেয়েরা ও দেহজীবিনী মেয়েরা। কলকাতার বাঙালি পল্লিতে সবচেয়ে বেশি বাজার ও বেশ্যাপল্লি ছিল। সেগুলোর মালিকও ছিলেন সম্পন্ন হিন্দু বড়লোকেরা।

এই দৃশ্য-অভিজ্ঞতায় লালিত বাঙালি দর্শকের কাছে প্রমথেশ বড়ুয়া কিছুটা উন্নত ধরনের ক্যামেরা ও রেকর্ডিংয়ের ওপর নির্ভর করে দৃশ্য-পরম্পরা, সংলাপ-পরম্পরা ও সংগীত-পরম্পরা তৈরি করলেন। এই পরম্পরাগুলি বিচ্ছিন্ন, টুকরো-টুকরো, একটি অপরটির সঙ্গে বাঁধা নয়, কিন্তু আবছা একটা সংযোগ তবু গল্পের মতো করে যে থাকত, প্রমথেশ বড়ুয়ার সিনেমার গল্প তৈরি করে তোলার ধারণা ও ক্ষমতার অভাবে সে-গল্পও কোনো গতি পেত না। এতটাই স্থাণু ছিল সেই সিনেমার গল্প যে দেবদাসের মতো জনপ্রিয় ও জনপরিচিত কাহিনি ও সিনেমাতে বলা হচ্ছে এমন করে যেন কতকগুলি স্টিল ফটোগ্রাফির ফ্রেম পরপর চলে যাচ্ছে। এগুলি পুরোপুরি ‘টকি’ও নয়। কারণ দৃশ্যের স্টিল ফ্রেম 888sport alternative linkের কথাগুলিকে ছেঁটে দিতে বাধ্য করছে। দেবদাসে কথা বলা ও হাঁটাচলা ছবি থেকে, কোনো সিনেমা তৈরি করল না আবার কোনো চেনা গল্পও দেখা বা শোনা গেল না। কিন্তু সিনেমার সংক্রমণ-ক্ষমতা প্রমাণিত হলো হয়তো, যদি দেবদাসেই বড়ুয়া-কলার পাঞ্জাবি প্রমথেশ প্রথম পরে থাকেন।

সিনেমার সেই সংক্রমণ-ক্ষমতা বাঙালি দর্শককে একেবারে পর্যুদস্ত করে দিল মুক্তি সিনেমায় ও সেটা ঘটল শুধুই কাননবালার অভিনয় ক্ষমতার অভূতপূর্ব মৌলিক দাপটে। ‘অভূতপূর্ব’ ও ‘মৌলিক’ শব্দ দুটি খুব বেছেই ব্যবহার করেছি। মুক্তির আগে বাংলা সিনেমায় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছিলেন স্থাণু। অনড় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁদের পার্ট বলে যেতেন। তার ফলে, অভিনয়ের সমস্ত জোরটাই পড়ত কণ্ঠস্বরের ওপর। তেমন জোর পড়ায় তাঁদের স্বর ছিল উচ্চগ্রামে, বিভঙ্গ সমৃদ্ধ, স্পষ্ট ও কথা-বলার তাপে জড়ানো। খুব ভাল শ্রম্নতি নাটকের মত। কাননবালা তেমন স্বরের সঙ্গে যোগ করে দিলেন গতি। ‘গতি’ বা ‘চলন’ই সিনেমা-থিয়েটারের সবচেয়ে বড় গুণ। ক্যামেরা, আলো ও স্টুডিয়োর সেট থিয়েটারের গতির ওপর কতকগুলি অনতিক্রম্য বাধা তৈরি করেছিল – হলিউডেও, এখানেও। মঞ্চের খুব ভাল অভিনেতারা সিনেমা করতে চাইতেন না ওই গতি পরিসরের সুযোগের অভাবে।

মুক্তিতে কাননবালা এসব ভেঙে দিয়ে সিনেমা-অভিনয়ের এক বন্যা বইয়ে দিলেন তাঁর সংলাপে, সেই সংলাপের স্বরক্ষিপণে গতি এনে, সংলাপের সময় বা গান গাইবার সময় চলনে গতি এনে ও সুরের গতি আর তাঁর শরীরের গতির মধ্যে এক সংগতি তৈরি করে। সিনেমার এই সংগতি প্রতি মুহূর্তে ভেঙে যায় ও প্রতি মুহূর্তে নতুন করে তৈরি হয়। সেটাই সিনেমায় প্রবহমান গতি সৃষ্টি করে। নৃত্যের সঙ্গে এর মিল আছে। নৃত্যে প্রত্যেকটি মুদ্রা বা ভঙ্গি মুহূর্ত স্থায়ী ও তার বাইরের কোনো ধারাবাহিকতা থাকে না। সেই ধারাবাহিকতা তৈরি হয় দর্শকের মনে। সিনেমাতে একটা ফ্রেম পরবর্তী ফ্রেমের অপেক্ষার জন্য অস্থিরতা তৈরি করে। সেই ফ্রেম যখন অভিনেতা-অভিনেত্রীর শরীর বা মুখকে ধরে, তখন সেই ফ্রেম ভেঙে পড়ার একটা গতিও সঞ্চারিত হয়। বাংলা সিনেমায়, বা হয়তো ভারতীয় সিনেমাতেই, কাননবালাই প্রথম 888sport live chatী যিনি সিনেমার অভিনয়ের এই নতুন দৃশ্যতা তৈরি করতে পেরেছিলেন, আর, সম্ভবত মুক্তিতেই। এ-দৃশ্যতা নাটকের অভিনয়ের দৃশ্যতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলা সিনেমাতে কাননবালাই এই নতুন দৃশ্যতা আনতে পেরেছিলেন। আর প্রায় সবাই-ই সিনেমার অভিনয়কে থিয়েটারের অভিনয় ভাবতেন। শিশির ভাদুড়ীও। কাননবালার পক্ষেও এটা সম্ভব হয়েছিল হয়তো অনেকগুলি কারণে। কিন্তু প্রমথেশ বড়ুয়ার কারণে নয়। প্রমথেশ বড়ুয়া যদি এই অভিনয় করাতে পারতেন, তা হলে, দেবদাসেই পারতেন। বা তিনি নিজেও করতে পারতেন। প্রমথেশ সিনেমার অভিনেতা হিসেবে খুব সচেতনতার প্রমাণ রাখেন নি।

এখানে বোধহয় 888sport live chatচর্চার রহস্য আমরা একটু বেশি সোজা করে নিয়ে ভাবি। বিশেষ করে আধুনিক সব 888sport live chatচর্চার রহস্য। যেহেতু সেই 888sport live chatচর্চা আমরা শিখেছিলাম সাহেবদের কাছ থেকে, তাই এমন একটা ধারণা এখনো আমাদের ভিতরে শিকড় গেড়ে আছে যে, লেখাপড়া না-জানলে (মানে, ইংরেজি না জানলে), 888sport live chatে সাফল্য আসে না। চোখের সামনে চোখ ঝলসে দেওয়া সব উদাহরণ দেখেও আমাদের এ ভুল ভাঙে না – যামিনী রায়, নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আলি আকবর খাঁ, বিলায়েৎ খাঁ, রবিশঙ্কর, তৃপ্তি মিত্র, তুলসী চক্রবর্তী, – আরো কতজনেরই তো নাম করা যায় যাঁরা বিশ্বমর্যাদার 888sport live chatী কিন্তু বুদ্ধিজীবী নন। আমার বরং ধারণা অনুভবের যে অস্পষ্টতার ভিতর দিয়ে 888sport live chatীর অনিবার্য অন্তরযাত্রা শুদ্ধ মননচর্চায় একটু ব্যাহতই হয়। 888sport live chatের সঙ্গে অব্যবহিত যে-মনন, তা তো কর্মের মনন। তার সঙ্গে বুদ্ধিজীবিতার কোনো সম্পর্ক নেই। নিজের কর্মের দরকারে 888sport live chatীকে তো প্রতি মুহূর্তে কত সমস্যার সমাধান করতে হয়। তখন সে-সমাধান মনন থেকে আসে না, আসে কর্ম থেকে নিষ্কাশিত জ্ঞান থেকে। অনুভবের সেই যাত্রায় 888sport live chatীকে তো অন্ধের মতো পায়ের হাতের আন্দাজে পথ হাতড়াতে হয়। সেখানে তার একমাত্র ভরসা – নিরলস রেওয়াজ, অনুশীলন থেকে সঞ্চিত কর্মের অভিজ্ঞতা। 888sport live chatীর যে-কাজ তার পরিণততম কাজ বলে আমরা পরে চিনে নিতে পারি, সেটাও তাঁর অনুশীলনেরই অন্তর্গত। আমাদের দেশে, পড়াশোনা, ইংরেজি-পড়া, এমন একটা সামাজিক ক্ষমতা দেয় যে, এমন একটা বিভ্রান্ত চেতনা তৈরি হয়েই থাকে যে-888sport live chatচর্চা, বিশেষ করে আধুনিক 888sport live chatচর্চা, ইংরেজি শিক্ষানির্ভর। এমনকি অভিনয়ও। আমাদের দেশে ইংরেজি-জানা 888sport live chatী অনেক সময় 888sport live chatের সমস্যা মেটাতে মাথার ওপর নির্ভর করে ফেলেন। তাতে কত-যে সর্বনাশ হয়।

প্রমথেশ বড়ুয়ার বেলাতে তেমনই ঘটেছিল। বিদেশ থেকে সিনেমার কিছু কৃৎকৌশল শিখে এসেছিলেন, বিদেশি সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাও ছিল, 888sport live footballবোধও হয়তো ছিল, তাই মুক্তির মতো একটি গল্প বাছতে পেরেছিলেন। আসলে, সে-গল্পের কোনো মাথামু-ু ছিল না। বাংলা সিনেমার সেই ভ্রূণকালে এমন একটি গল্প বাছার পেছনে কাজ করে এক বিভ্রান্ত চেতনা : সিনেমাটা হতে হবে, সাহেবরা যাকে সিনেমা বলেন, তেমন। এটাই ছিল সেই ভ্রূণকালের ধারণা। যতই ভঙ্গিমূলক বা ধর্মীয় গল্পের ছবি হোক। সেগুলিও সাহেবদের মতো ভাবা সিনেমা। মেয়েদের ঘোড়ায় চড়া, নায়ক-নায়িকার আলিঙ্গন ও চুম্বন এসব বিশ শতকের বিশের দশকেই বাংলার সিনেমায় এসে গেছে। সাহেবদের মত সিনেমা বানানোর জন্য অবাঙালি অভিনেত্রী বা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অভিনেত্রীদের দিয়ে অভিনয় করানো হত।

 

চার

মুক্তিতে কাননবালা কোনো বেখাপ্পা অতিরিক্ত সাহস দেখান নি। জলে হাঁস যেমন নেমে যায়, একটুও পা না হড়কে, যেন হাঁসের শরীরে মাটি আর জলের কোনো পার্থক্যই নেই, সেই সচ্ছলতায় তিনি তখনকার ক্যামেরাকে বাধ্য করলেন তাঁকে অনুসরণ করতে, তিনি ক্যামেরাকে অনুসরণ করলেন না – যিনি ক্যামেরা করছেন তিনিও বাঁধাধরা গতের বাইরে যেতে সাহস পেলেন। কাননবালা তখনকার শব্দগ্রাহক যন্ত্রকেও বাধ্য করলেন তাঁর অন্তরালবর্তী স্বরকে উপস্থিত করতে – তিনি যন্ত্রকে অনুসরণ করলেন না – যিনি শব্দ রেকর্ড করছেন তিনিও বাঁধাধরা গতের বাইরে যেতে সাহস পেলেন। স্বরের অভ্রান্ত গমকে কাননবালা তাঁর অদৃশ্য উপস্থিতি স্পষ্ট করে দিলেন। তাঁর স্বরক্ষিপণও একটু উঁচুতে হত। তাঁর স্বর উচ্চ ও নিম্ন দুই গ্রামেই এমন স্বাভাবিক ছিল যে, তাঁর স্বরান্তরগুলি তাঁর সঙ্গেই মানিয়ে যেত। এ এক এমন স্বাভাবিকতা যাকে আমরা ভগবদ্দও বলে থাকি। স্বাভাবিক বা ভগবদ্দও যাই হোক, ব্যবহার তো করছেন যাঁর স্বর তিনিই। কাননবালা তাঁর নিজেকে ব্যবহারে তাঁর পরিচালক ও 888sport app নির্দেশককে ছাপিয়ে যেতেন। তাঁকে দর্শকের কোথাও অচেনা ঠেকত না। আবার সেই চেনার মধ্যেই স্বরের সুরে দর্শক অচেনাকেও শুনতেন ও দেখতেন। কাননবালা তাঁর অভিনয়ে অচেনা হয়ে উঠতেন, অচেনার রোম্যান্স তাঁকে ঘিরে দর্শকের মনে জেগে উঠত আর দর্শক, বাংলা সিনেমার দর্শক সেই প্রথম একটা বাংলা সিনেমায় তাঁর চেনা গলার স্বরে, তাঁর দেখা কিছু ভঙ্গিতে অচেনায় বুঁদ হয়ে গেলেন। যখন কাননবালা নিজের গলায় গান গেয়ে উঠছেন – ‘আজ সবার রঙে…’ তখন সেই গানের শারীরিক উদ্ভাসন ঘটছে তাঁর গলার শিরায় ও পেশিতে, তাঁর কোমল মুখে ছড়িয়ে পড়ছে গান গাইবার এক বিভা, লয়-তাল রাখার সচেতনতায় একটু আত্মমগ্নতাও এসে যাচ্ছে চেনা মুখটিতে, আর একজন অভিনেত্রীর সম্পূর্ণ নতুন মাধ্যমের অভিনয়ে তৈরি হচ্ছে সিনেমার ভাষা।

এখন আমরা সিনেমা সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি, জানছি। সেই জানাগুলি দিয়ে যদি আমরা প্রাক্-সত্যজিৎ বাংলা সিনেমাকে বিচার করি, তা হলে শুধু এটুকুই প্রমাণ হবে যে, সত্যজিৎ এবং মৃণাল-ঋত্বিক ও তারও পরের অনেক অনেক সচেতন, দক্ষ পরিচালক ও অভিনেতা সত্ত্বেও আমরা এখনো সিনেমা কাকে বলে সে-সম্পর্কে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ ধারণায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারি নি। এখনকার অনেক পরিচালক অত্যন্ত গভীরে জানেন – সিনেমা পরিচালকের সৃষ্টি। এও জানেন – সিনেমা অভিনেতার বা সিনেমাটোগ্রাফারের সৃষ্টি নয়। তাঁরা সব সময়ই প্রয়োজনীয় উপাদান। পরিচালকই তাঁর গল্পের অভিনেতা ও সিনেমাটোগ্রাফার বেছে নেন। কিন্তু, এই নিশ্চিত জানার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁরা এই সত্যটিও জানেন – সিনেমা এমনই একটি 888sport live chatকরণ, দর্শকও যার অপরিহার্য স্রষ্টা। তাঁরা এও জানেন – একটা সিনেমা তৈরি করতে পরিচালকের লাগতে পারে, এমন কি, পাঁচ বছরও, তারপরও সেটা দেখানো না হতে পারে, আর একটা সিনেমা গ্রহণ-বর্জন করতে দর্শকের লাগে খুব বেশি হলে সাত দিন, খুব কম হলে এক দিন। আরো কম হলে, এমন কি, একটি মাত্র শো। ঋত্বিক ঘটকের তেমন দুর্ভাগ্যও ঘটেছে। সিনেমা এমন একটি 888sport live chatপ্রকরণ যার কোনো পরিচালকের মৃত্যুর পরে কোনো পুনর্জীবন নেই। এই বাধ্যতা মেনে নিয়েই এখনকার live chat 888sportকাররা সিনেমা তৈরি করেন। এই বিপজ্জনক ও চোরাবালির বাস্তবেও ঋতুপর্ণ, অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ 888sport app download for androidীয় সব ফিল্ম করতে পারছেন এ এক বাংলার বিস্ময়কর সৃষ্টিক্ষমতার জোরেই সম্ভব। আর, তাঁদের এই সব চেষ্টা থেকেই বাংলা সিনেমায় দর্শকদের সৃষ্টিশীল ভূমিকা স্পষ্ট হচ্ছে। চ্যানেলগুলির সিরিয়ালগুলির ফলে বাংলা সিনেমার দর্শক বাছাই হয়ে যাচ্ছে। বাছাইটা দিনে দিনে আরো বাড়বে। হলে যাঁরা সিনেমা দেখতে যাবেন তাঁরা সিনেমাতে সিরিয়ালের মতো গল্প দেখার প্রত্যাশা নিয়ে হলে যাবেন না। ফলে – পরিচালক দর্শকের সিনেমা তৈরির পরিসরের যৌথতার ভূমিকা দিনে দিনে স্পষ্ট হবে। ঘটনাটা এমন নয় যে, সিরিয়ালের দর্শক ও ‘ভালো’ সিনেমার দর্শক আলাদা। একই দর্শক দুটোই দেখেন। সেই দুই-দেখার জায়গাটা যদি আলাদা হয়ে যায় তা হলে দুই রকমের দেখাই থাকবে। একেবারে সাম্প্রতিক অনেক সিনেমাতেই কিন্তু এই প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এখনকার পরিচালকরা জানেন সিনেমা কী ও তাঁর আর দর্শকের ভূমিকা কী। তাঁরা সজ্ঞান সচেতনতায় পরিচালক দর্শকের সমীকরণ খুঁজছেন।

প্রাক্-সত্যজিৎ বাংলা সিনেমার পরিচালকদের এই সচেতনতা ছিলই না। সিনেমার দৃশ্যতা, দৃশ্যতার সংবহনের গতি, ক্লোজ-মিডিয়াম-লং শটের অর্থবৈচিত্র্য, অভিনেতাদের কথা বলার ধরন, স্বাভাবিক আলো ও কৃত্রিম আলোর অর্থান্তর, সিনেমার সেট ও নাটকের মঞ্চের পার্থক্য, আলোর রকমফের, অভিনয়ে অর্থ তৈরিতে চোখ-ঠোঁট-কপাল এই তিন  সঞ্চালনক্ষম অঙ্গের ব্যবহার ও হাঁটাচলা, ঘাড় ঘোরানো ও স্বাভাবিক, দৈনিক ও চেনা অঙ্গভঙ্গিতে অনেক অর্থ তৈরি করা ও অর্থান্তর ঘটানো – সিনেমার নিজস্ব নির্মাণের এই অন্তরঙ্গ উপাদান-রহস্য প্রাক্-সত্যজিৎ বাংলা সিনেমায়, সিনেমাটা যাঁরা তৈরি করছেন তাঁদের, কারো জানা ছিল, এমন কোনো প্রমাণ নেই।

কিন্তু এখানেও, এই সময়েই, আবার এক অভিনেত্রী সিনেমা নির্মাণের সমস্ত পদ্ধতির ওপরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। সেই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে ছিলেন সেই অভিনেত্রী, সুচিত্রা সেন। অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে সুচিত্রা সেন ও উত্তমকুমার এক জুটি হয়ে উঠলেন ও বাংলা সিনেমায় নতুন ধারা তৈরি করে ফেললেন। আমার যদি সন-তারিখের খুব একটা বড় গোলমাল না ঘটে থাকে, তাহলে কি এমন একটা কথা বলা যায় যে ১৯৫৪তে অগ্নিপরীক্ষায় উত্তম-সুচিত্রা জুটি ও ১৯৫৫তে পথের পাঁচালী বাংলা সিনেমার সমান্তরাল অথচ পরিপূরক ধারা তৈরি করে দিলো? পথের পাঁচালী দুনিয়ার live chat 888sportেই প্রাক্তন উপনিবেশের বাস্তবকে আধুনিক 888sport live chatপ্রকরণের বিষয় করে তুলল। কিন্তু যেহেতু বাংলা ভাষার সিনেমা, বাংলা গল্পের সিনেমা, বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে তোলা সিনেমা – তাই বাংলা সিনেমার ওপর পথের পাঁচালীর ও সত্যজিৎ রায়ের প্রভাব একেবারে প্রত্যক্ষ।

সুচিত্রা-উত্তম জুটির বেলায় তাঁদের অভিনীত সিনেমাগুলি একেবারে হয়ে উঠল বাংলারই নিজস্ব। এমনটা সম্ভব হয়েছিল কেন। কাননবালা হলিউডের ছবি-দেখা শহুরে মধ্যবিত্ত দর্শক থেকে শুরু করে সারা বাংলায় ছড়ানো অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের কাছে তাঁদের নিজস্ব নায়িকা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বেশবাস, কেশবিন্যাস, বাকভঙ্গি, চলাফেরা মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়েদের ঘরের বাইরে টেনে আনল। তাঁরা কাননকে দেখতে সিনেমা হলে আসতে শুরু করেছিলেন। মেয়েদের এমন বাড়ির বাইরে আসায় পুরুষতন্ত্রের খুব একটা নিষেধও ছিল না, কারণ, কানন তাঁদের প্রিয় ছিলেন আর সেই প্রিয়তার পেছনে খুব একটা অসামাজিকতা ছিল না। ফলে কানন বাঙালির ঘরের ভিতর এসে পড়েছিলেন। যেখানে সিনেমা পৌঁছেছে সেখানেই বাঙালি মেয়েরা কাননের মতো সাজতেন। যেখানে সিনেমা পৌঁছয় নি, সেখানকার মেয়েরাও অন্যদের দেখে সাজতেন।

স্বাধীনতার পর ও প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময় জুড়ে দেশের নগরজীবনের সমাজচিন্তায় ও পারিবারিকচিন্তায় নতুন বদল ঘটে যাচ্ছিল। মেয়েদের জীবনযাপনের একটি কাগজ বেরোল – ফেবিবনা। ‘ল্যাকমি’ কোম্পানি তাঁদের বিজ্ঞাপনে মেয়েদেরই নিজস্ব জীবনচর্যার একটা আবহাওয়া তৈরি করলেন ও মেয়েদের সাজগোজের বিশেষ-বিশেষ দ্রব্য মফস্বলের দোকানগুলিতেও পৌঁছে গেল। খুব ব্যাপক না হলেও বাঙালি মেয়েদের মধ্যে লিপস্টিকের ব্যবহারও শুরু হল। মেয়েদের অন্তর্বাস বিশেষ করে বিজ্ঞাপিত হত ও সেসব ব্যবহারের পদ্ধতিও বিজ্ঞাপনেই প্রচারিত হত। এমন একটা পরিবেশ কিছুটা অগোচরে তৈরি হচ্ছিল, যে-পরিবেশে মেয়েদের শাড়ি-পরার ধরন, বস্নাউজের ছাঁট, কেশবিন্যাসও একটু একটু বদলে যাচ্ছিল। মেয়েদের নিজেদের ভিতর এই সচেতনতা অনেক বেশি সজীব ছিল।

এঁরাই ছিলেন সুচিত্রা সেনের প্রাথমিক দর্শক। দর্শক, সুচিত্রার ভিতর নিজের ছবি দেখতে চাইল। উত্তমকুমার ও সুচিত্রা জুটি সেই ইচ্ছার আধার হয়ে উঠল এক পারিবারিক সামাজিকতায়। দুজনের চেহারায় পরিপূরকতা ছিল, দুজনের শারীরিক মুদ্রাতেও একটা পরিপূরকতা দর্শক কল্পনা করে নিতে পারতেন। দুজনে যখন সিনেমায় কথা বলতেন বা সিনেমার গল্পের শুরুর দিকে পরস্পরের বিরোধিতা করতেন, সেই বিরোধিতার মধ্যেও একটা যে পরিপূরকতার আভাস তৈরি হতো, তা চিত্রনাট্যের অন্তর্গত নয় – দর্শকের প্রত্যাশার অন্তর্গত ও দর্শকের এই প্রত্যাশা সম্পর্কে উত্তম-সুচিত্রার পূর্ব অনুমানের অন্তর্গত। ফলে, সিনেমার পর্দায় যে সিনেমার গল্প তৈরি হত, পর্দার সামনে সিনেমা হলের অন্ধকারেও একটা সিনেমা তৈরি হতে থাকত। দর্শক ও সিনেমা পরস্পরকে রচনা করে তুলত। আমরা এই লেখাটির একেবারে শুরুতে গ্যালারি-সংগীত, সিনেমা ও থিয়েটারের দর্শক-শ্রোতার সঙ্গে সংযোগের যে নান্দনিক সমস্যার কথা বলেছিলাম, বাংলা সিনেমায় তার একটা মীমাংসা ঘটেছিল সুচিত্রা-উত্তম জুটিতে।

বাংলা সিনেমায় আর একটি বড় ঘটনায় – সুচিত্রা-উত্তমের জনপ্রিয় ধারা ও পথের পাঁচালীর বিশিষ্টতার ধারার মধ্যে এক সাঁকো হয়ে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় – সত্যজিৎ রায়ের নায়ক। সৌমিত্র নিজেই একটি লেখায় ব্যাখ্যা করেছেন – অপুর সংসারের অপু তাঁদের সময়েরই প্রতিনিধি মনে হয়েছিল তাঁর। হয়তো কিছুটা ঠিক। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমাদের নাগরিক জীবন খুব তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছিল। ধুতি উঠে গিয়ে প্যান্ট পরা শুরু হলো মাত্র দু-তিন বছরে। চিনের আক্রমণ, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ, কমিউনিস্টদের দেশদ্রোহী বলে জেলে পোরা – এই সব মিলিয়ে আমাদের চোখটা নিজেদের ভিতর দিকে ঘুরে গেল। বাংলা সিনেমায় অন্তর্মুখী নায়ক বা অভিনেতা প্রায় নেই বললেই হয়। এটা বোধহয় আমাদের সিনেমা-অভিনেতাদের সীমাবদ্ধতা। হিরো, ক্যারেক্টার অ্যাকটিং, ভিলেইন, সাব-ক্যারেক্টার, কমেডিয়ান – এই সব বিভাজনের মধ্যে চরিত্রের বহির্মুখিতাই প্রধান। আমার তো মনেই পড়ে না – তুলসী চক্রবর্তী ছাড়া কোনো অন্তর্মুখী বড় অভিনেতা ছিলেন। তুলসী চক্রবর্তী এক আশ্চর্য অভিনেতা যিনি, তাঁর অভিনয়ে, অনুপস্থিত আর এক বাস্তবতাকে, যা তাঁর মনে আছে, স্পর্শগ্রাহ্য করে তুলতে পারতেন।

সৌমিত্র বাংলা সিনেমার সেই প্রথম অন্তর্মুখী নায়ক। তিনি সত্যজিৎ রায়ের ধারা থেকে জনপ্রিয় বহির্মুখী ধারায় এসে, উভয় ধারার মধ্যে ঐতিহাসিক সংযোগটি ঘটিয়ে দিলেন, যে-সংযোগ অগোচরে দর্শকদের অভিজ্ঞতায় ঘটে গিয়েছিল আগেই।

উত্তম-সুচিত্রা, উত্তম-সৌমিত্র নিয়ে অনেক কথা হয়েছে ও হবে। সৌমিত্র একটি লেখায় – উত্তমের অভিনয়-বৈশিষ্ট্য ও তাঁর সঙ্গে উত্তমের পার্থক্য, আন্তরিক সরলতায় ও সততায় ব্যাখ্যা করেছেন।

ইতিহাস কোনো-কোনো সময় একটু নিঠুর দরদি। সুচিত্রা-উত্তম জুটির সুচিত্রার নায়ক হিসেবে, উত্তমের বিপরীত ধরনের অভিনেতা সৌমিত্র, যখন সাত পাকে বাঁধাতে অভিনয় করলেন, তখনই বাংলা সিনেমার বহির্মুখী ধারার অবসান হয়ে গেল ও জুটির মিলন চিরকালের জন্য ভেঙে গেল। দুজনে আলাদা হয়ে গেলেন – সৌমিত্র তাঁর আরো অজ্ঞাত অন্তর্মুখে ও সুচিত্রাও তাঁর প্রথম অন্তর্মুখে। 