তুমুল বৃষ্টির রাত। কাজ সারতে সারতে দেরি হয়ে গেছে। কাজ বলতে পলাশী-দর্শন। ঐতিহাসিক স্থানগুলো আমাকে খুব টানে। আমি ছোট পকেট ডায়েরিটা নিয়ে নোট করতে থাকি। স্থানীয় মানুষজনের কথোপকথন রেকর্ড করি। এতে দুটো কাজ হয়। এক. একটা 888sport slot gameবৃত্তান্ত প্রস্ত্তত হয়ে যায়। দুই. এই প্রেক্ষাপটের ওপরে সুন্দর ফিকশনও লেখা যায়। ইদানীং নানা ধরনের লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। দুয়েকটি বই বেরিয়েছে বাজারে। একটি ধারাবাহিকের বরাতও পেয়েছি। দেখা যাক, কী হয়।
লালগোলা শিয়ালদা প্যাসেঞ্জারের পলাশী স্টেশনে পৌঁছানোর কথা রাত ১২টায়। শিয়ালদা পৌঁছবে পরদিন খুব ভোরে। কিন্তু যেরকম মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে, দুহাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। পস্ন্যাটফর্মের আলো পর্যন্ত 888sport app পড়ে গেছে বৃষ্টির তোড়ে।
পলাশী স্টেশনে এই বৃষ্টি-বাদলায় আমি ছাড়া আর গুটিকয়েক মাত্র প্যাসেঞ্জার। ভোরবেলায় শিয়ালদা পৌঁছানোর জন্য বসে আছে কিছু ব্যাপারী। একজন স্ট্রেচারে শোয়া রোগী। চিকিৎসার জন্য তাকে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি যে-বেঞ্চটিতে বসে আছি সেখানে আর একটি মাত্র লোক বসে আছে। মুখটা ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। বয়স কত হবে কে জানে।
কোথায় যাবেন এত রাত্তিরে! আমাকে উদ্দেশ করে কথা ছুড়ে দিলো সে।
কলকাতা। জবাব দিলাম।
অ।
আপনি?
আমি কোথাও যাই না। এইখানে চলে আসি মাঝে মাঝে। বড় ভালো লাগে এই এলাকা। ইতিহাস ছড়ানো চারপাশে। এক সময়ে কুষ্টিয়া থেকে ট্রেন ঢুকত পলাশীতে, জানেন বোধহয়। তখন অবশ্য ব্রিটিশ আমল। তারপর তো … যাক সে-কথা।
বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। বুঝলাম, আমাদের অনেকের মতোই সেও দেশভাগটা মেনে নিতে পারেনি।
একটা গল্প বলি শুনুন – আপনার সময়টাও কেটে যাবে। এই ঝড়-বাদলার মধ্যে ট্রেন আসতে কত দেরি করবে কে জানে! আমার নামটা আপনার জানা দরকার, কারণ এই গল্পের নায়ক আমিই। আমার নাম সৌম্য।
সে বলে চলল।
আজ থেকে দশ বছর আগের কথা। এরকম ঝড়-বাদল। ভুল বললাম, সে-ঝড় আরো প্রবল। তখন অবশ্য সকালবেলা। ঘুরে বেড়াচ্ছি নদীয়ার নানা জায়গায়। মোটরসাইকেলটা নিয়ে বেরিয়েছি। আমার সেলসের কাজ। খানদানি যন্ত্র আমার মোটরবাইকটি।
এক-দুশো মাইল এদিক-সেদিক যাওয়াটা কোনো ব্যাপারই নয় তখন আমার কাছে। আশপাশে কেউ কোথাও নেই। পথঘাট একেবারে ভেজা। বৃষ্টিটাও এলো ঝড়ের সঙ্গে। ঝড়টা উঠেছিল প্রথমে ফিসফিসানির মতো। তারপর ক্রমশ গর্জন। প্রবল চিৎকারে দক্ষিণবঙ্গে দাপিয়ে বেড়িয়ে চলে এসেছে নদীয়া জেলায়। আকাশভাঙা জল প্রবাহিত হচ্ছে, যেন নদীপ্রবাহ। উন্মত্ত পশুর মতো ঝড়টা আর্তনাদ করেই চলেছে। অনেক পরে সেটা থেমেছিল। কয়েক হাজার গাছপালা উপড়ে ফেলেছিল। বহু মানুষকে ঘরছাড়া করেছিল; কিন্তু তখন তো সবে শুরু। নখ দিয়ে ঝড়টা আঁচড়াচ্ছে গোটা গাছ। আলগা করে দেবে শেকড়ের বাঁধন। ছবির মতো পূর্বাপর দেখতে পাচ্ছি আমি। মাঝে মাঝে কী এক কুহকে প্রবেশ করি। যা দেখি সেগুলো সত্য নয়, আবার মিথ্যেও নয়। শুনতে পাচ্ছি কে যেন ডাকছে …
মণি-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই।
আসলে সবটাই মনের ভুল। কেউ ডাকেনি। ব্রিজের ওপর দিয়ে নদীটা পার হয়েছি সবে। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নিয়েছি গাছটার তলায়। সেখানে বাইক থামিয়ে দাঁড়িয়ে ভালো করে সর্বাঙ্গে ওয়াটারপ্রম্নফ জড়ালাম। গাছটা রাস্তার পাশেই। ওদিকে বাঁশঝাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছে হাওয়া। কে যেন ডেকে চলেছে। তীক্ষন শব্দ কানে পৌঁছছে। এখান থেকে গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তা ঢুকে গেছে গ্রামে। গাছের আশ্রয় নিরাপদ মনে হচ্ছে না। মোটরবাইকটা স্টার্ট দিয়ে কোনদিকে যাব ঠিক করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। গন্তব্য কলকাতার লাগোয়া এক জেলা সদর। ওখানে ফ্যাক্টরিতে রিপোর্ট করতে হবে বিক্রিবাট্টার অর্ডারের হালহকিকত। আপাতত এটাই পরিকল্পনা ছিল; কিন্তু এই ঝড়বৃষ্টিতে এখন তো যাওয়ার প্রশ্নই নেই। রাস্তার দুধারে বিশালাকৃতির গাছগুলো দেখলেই আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তায় ভুগছি।
প্রবল বাতাসের মধ্যেই গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তাটা ধরলাম। দুপাশে চাষের ন্যাড়া ক্ষেত। কোথাও আবার চষা জমি। তারপর, তারপর – পাগলের মতো খুঁজে বেড়াতে লাগলাম নিরাপদ আশ্রয়, যে-কোনো রকম একটা পাকা বাড়ি। মজবুত কংক্রিটের গাঁথুনি। সামনেই একটা স্কুলবাড়ির কম্পাউন্ড মনে হলো। গেট খোলা আছে। দুপাশে ফুলের গাছ। টালি বসানো রাস্তা। মোটরবাইকটা থামিয়ে পোর্টিকোর তলায় রাখার সময় খেয়াল হলো – এটা স্কুলবাড়ি নয়, ক্লাব নয়, এমনকি কারো বাসস্থানও নয়। এটা আসলে একটা চার্চ। ক্যাথলিক চার্চ। এখন দুপুরবেলা। আকাশ নয়, ঘড়ি বলছে সে-কথা।
তারপর কী হলো? অজান্তেই বলে উঠলাম আমি।
সৌম্য বলে চলল।
চার্চের ভেতরের আশ্চর্য স্তব্ধতায় প্রবেশ করলাম। বৃষ্টি ও হাওয়ার হাত থেকে কিছুটা নিস্তার পেলাম। ওয়াটারপ্রম্নফের ফাঁকফোকর দিয়ে কীভাবে যেন ভিজেছি কিছুটা। এদিকে চার্চের ভেতরে কিছু মানুষ চুপচাপ বসে আছে। সবার মুখে শোকের ছায়া। কারো কারো চোখে জল টলটল জমাট সাগর – বাঁধ ভাঙতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে। চার্চের ঘণ্টাটাও অস্ফুট শব্দে বাজছে। অর্গান থেকে ভেসে আসছে সুর। এমন একটা পরিবেশ এখানে ছিল! অপেক্ষা করছিল আমার জন্য! ভাবা যায় না। রঙিন কাচে যিশু, মা মেরি, ক্রসের ছায়া!
দুজন পাদ্রিবাবা প্রবেশ করলেন। একজন বৃদ্ধ, অন্যজন যুবক। পেছনে আরো একজন। তার হাতে ধুনো জ্বলছে, সুগন্ধি। চমকে উঠলাম। এই ঝড়-বাদলে কোথায় এসে পড়লাম! পাদ্রিবাবার পেছনেই ওই তো দেখা যাচ্ছে কালো একটা কফিন, মেহগনি বার্নিশ করা, চাকা লাগানো। কোনায় সোনালি গিলটি করা। দুজন লোক ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসছে। একটা শরীর শোয়ানো আছে। জীবন নামক বিয়োগান্ত নাটকের সব ডায়ালগ বলার পর মানুষটি বিশ্রাম নিচ্ছে। একটা মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার গোটা জীবনের সমস্ত কথোপকথন বলা শেষ হয়ে যায়। একটা বিয়োগান্ত নাটকের রচয়িতা হয়ে সে তখন মারা যায়।
প্রিয়জনদের আক্ষেপ ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে-বাতাসে। কিছুক্ষণ বাদে বাদেই কেউ না কেউ এসে কান্নায় ভেঙে পড়ছে। এতে কারো কোনো লাভ হচ্ছে না। যে মারা গেছে তারও না, যারা কাঁদছে তাদের তো নয়ই। কিন্তু মৃত্যুর উপস্থিতিতে সমস্ত দর্শন ও যুক্তি স্তব্ধ হয়ে যায়। এ-সময়ে যা করণীয় অর্থাৎ শোকজ্ঞাপন ইত্যাদির পরে একে একে উপস্থিত মানুষেরা সারি সারি বেঞ্চিতে বসে পড়ছেন।
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম যে, এক শোকসভায় এসে পড়েছি; কিন্তু বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। তুমুল বৃষ্টি। একে একে লোকজন আসছে তখনো। সবাই আধভেজা। ছাতা-পোশাক থেকে
বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ছে। এই এলাকাটায় এত মানুষ থাকে আমার ধারণাই ছিল না। কিন্তু এদের সবার পোশাক-আশাক কেমন যেন সেকেলে। মেয়েরা সব ঘটিহাতা কালো কালো পোশাক পরেছে। ফ্রকের মতো, গাউনের মতো। পুরুষেরা সব চোস্ত প্যান্ট আর তার সঙ্গে সাদা সাদা জামা, বুকের কাছে ঝালর দেওয়া।
চার্চের অর্গানে একটা খুব পুরনো সংগীত বাজছে। ধর্মীয় সংগীত। কিছুক্ষণ বাজার পরই অখ- নীরবতা।
আমি আবার বলে উঠি, তারপর।
সৌম্য বলে চলে, একদম পেছনের বেঞ্চিতে এক কোনায় বসে পড়লাম। বারবার এদিক-ওদিক তাকালাম। আমাকে কেউ দেখছে কি-না। কিন্তু আশ্চর্য! এতগুলো মানুষ এখানে রয়েছে অথচ কেউ আমাকে দেখছে না। একজনের সঙ্গেও চোখাচোখি হচ্ছে না। আমি যেন এক কাচের মানুষ। স্বচ্ছ – ইনভিজিবল – কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছে বলে মনে হলো না। তখন আবার কে যেন ডেকে উঠল, মণি-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই।
ঢংঢং করে চার্চের ঘণ্টা বেজে উঠল। শব্দ করে একরাশ চামচিকে উড়ে বেড়াতে লাগল। স্টেইনড কাচের জানালাগুলোও যেন শোকগ্রস্ত। কাচের একটা ঢাকনা রয়েছে কফিনের ওপরে।
শেষকৃত্যের সব আয়োজন এত নিখুঁত যে, মৃত ব্যক্তি জীবিতাবস্থাতেও নিঃসন্দেহে তা অনুমোদন করত। সত্যি বলতে কী, একটা হালকা হাসিও মুখে লেগে আছে। বন্ধুবান্ধব আর নিকটজনেরা শেষ 888sport apk download apk latest version জানানোর জন্য এমনই এক সময়ে সমবেত হয়েছে, যখন ওই শায়িত মানুষটির সবরকম 888sport apk download apk latest version আর বন্ধুত্বের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। যে-মানুষটি প্রয়াত তার নাম স্যামুয়েল। মানুষের কথাবার্তা থেকেই বুঝতে পারছি। আশ্চর্য! আমার নাম সৌম্য আর এই মৃতের নাম স্যামুয়েল! নামের এত মিল? হাসি পেল অত দুঃখের মধ্যেও।
এমন সময় আবার সেই আকাশবিদারিত চিৎকার।
মণি-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই। কে এই মণি! আমার কৌতূহল হলো। কোথায় এসেছি আমি! একজন মানুষ ঘোরাঘুরি করছে পোর্টিকোতে। আমি চার্চের গম্বুজঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। মানুষটি আমাকে দেখতে পেয়ে যা বলল, সে এক অবিশ্বাস্য কাহিনি। এটা চুয়াডাঙ্গা জেলার কাপাসডাঙ্গা গ্রাম। ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে তার। বিকিকিনির বড় হাট বসে এখানে। ভৈরব নদের পাড়ে জমজমাট বাজার। গ্রামের পুরনো নাম নিশ্চিন্তপুর। মুঘল থেকে ব্রিটিশ আমল – এ-তল্লাট বর্ধিষ্ণু এলাকা বলে পরিচিতি লাভ করেছিল। একটা নীলকুঠি আছে। সেই বিখ্যাত নীলকুঠি, যেখান থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই এলাকায় নীলের চাষ সংগঠিত করত। নীলকুঠির মূল অংশটি ভেঙে চুরমার। নীলকুঠির কিছুটা সংস্কার করে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি কবরস্থান আছে নীলকুঠি-লাগোয়া। এখানেই সমাধিস্থ করা হতো সাহেবদের।
চমকে উঠলাম। সে কী! কখন যে কীভাবে সীমানা পেরিয়ে ঢুকেছি প্রতিবেশীরাষ্ট্রে। বৃষ্টির মধ্যে আশ্রয় খুঁজেছি কেবল। চেয়েছিলাম শেষ সারিতে বসে অপেক্ষা করব। বেরিয়ে পড়ব বৃষ্টি থামলেই।
কিন্তু অবাক হচ্ছি সমানে। একমাত্র পোর্টিকোর এই মানুষটি ছাড়া কেউ কি আমাকে দেখতে পাচ্ছে? সে-কথা বলাতেই মানুষটি বলে উঠল, যা দেখছ সব সঠিক দেখছ – এতে কোনো তথ্যগত ভুল নেই। কিন্তু এটা আবার সঠিকও বলা যাবে না, কারণ সত্যি সত্যি তো আর তুমি সীমানা পেরোওনি। যা দেখছ তা এক live chat 888sport। অথচ আমরা সবাই তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। তুমিও সবাইকে দেখতে পাচ্ছ। কারণ এ-মুহূর্তে ইতিহাস তোমাকে ছুঁতে চাইছে। তুমি চলে এসেছ অতীতে। চলে এসেছ প্রতিবেশী দেশে। কারণ অতীতে কোনো বেড়া ছিল না, সীমানা ছিল না। এখানে নীলের চাষ হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীল চাষ। আমরা সবাই বিদেশি মানুষ, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষে এসেছি ভাগ্যসন্ধানে।
আমি আর ভাবতে পারলাম না। কারণ হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। আমার আর ভাবার ক্ষমতা নেই। আমি সৌম্য না স্যামুয়েল সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। স্যামুয়েল অর্থাৎ যার অমেত্ম্যষ্টি আজ।
সৌম্য বলেই চলল, আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেই চললাম। বৃষ্টিটা একটু ধরছে মনে হচ্ছে।
সাদা পোশাক পরে দুজন ধর্মযাজক এগিয়ে গেলেন যিশুর মূর্তির দিকে। একজন বয়স্ক, পাকা চুল। ধীর পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছেন। যেন ডিমের খোলার ওপর দিয়ে তার চলন। পায়ের তলায় চুরমার হয়ে যাচ্ছে হালকা প্রতিরোধ। অন্যজন কমবয়সী, খয়েরি চুল। পেছনে পিতলের ঝোলানো ধুনুচি নিয়ে হাঁটছে আরো একজন। পবিত্র সুগন্ধি ধোঁয়ায় আমোদিত চারপাশ। আরো পেছনে, দুজন মানুষ একটা কফিন ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসছে। কফিনটা বসানো আছে একটি চাকা লাগানো
পস্ন­¨vটফর্মের ওপর। শবানুগামী প্রত্যেকের মুখগুলো সাদা। কাউকে কাউকে ভীষণ চেনা মনে হচ্ছে।
তরুণ সন্ন্যাসীটি ততক্ষণে বক্তৃতা শুরু করে দিয়েছেন। বন্ধুরা! আমরা আমাদের অতিপ্রিয় স্যামুয়েলের জন্য শোক উদযাপন করতে জমায়েত হয়েছি। এই স্যামুয়েল আমাদের কারো স্বামী, কারো ভাই, কারো বাবা এবং কারো-বা একান্ত বন্ধু। সবাই জানেন স্যামি কতটা নিঃস্বার্থ ছিল। নিজের অসুস্থতা সত্ত্বেও সে তার পরিবার এবং আত্মীয়-বন্ধুদের আপ্রাণ সাহায্য করে গেছে।
সৌম্য একটু দম নিল। আবার বলে চলল।
অনাহূত অবস্থায় এমন এক সমাবেশে উপস্থিত আমি যে, উপযুক্ত পোশাকও পরা নেই। নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল। অতীত মানুষের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের জীবনে প্রবেশ করেছি। বাইরের
ঝড়বৃষ্টি থেমে আসছে। চার্চের চালে যে দ্রিমিদ্রিমি বাজনা বাজাচ্ছিল বৃষ্টি – সে-বাজনার আওয়াজও ফিকে হয়ে এলো। কাচের ফাঁক দিয়ে অল্প অল্প বাইরের আলো আসছে। জামাকাপড়ও শুকিয়ে এসেছে। এবার বাইরে যাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু ততক্ষণে কফিনটাকে ঠেলতে ঠেলতে আবার বাইরে আনা হচ্ছে। সেই পাদ্রিদ্বয়, সেই ধূপদান। সুগন্ধি। আত্মীয়স্বজন কফিনের পেছনে। আমিও মাথা নিচু করলাম, সবার পেছন পেছন বাইরে এলাম। কিন্তু, মণি-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই। আবার সেই ডাক।
মুহূর্তে খানখান হয়ে গেল চতুর্দিক। গুঁড়ো গুঁড়ো ময়লার মতো ভেঙে পড়ল প্রেক্ষাপট। ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে নিস্তব্ধ আকাশের নিচে প্রচ- গতিতে মোটরবাইক চালিয়ে ফেলে আসা পথ ধরে ফিরে চললাম। একবার একটু এগিয়ে গিয়ে পেছন ফিরে দেখলাম। কোথায় কবরখানা! কোথায় নীলকুঠি চার্চ! কোথাও কিছু নেই। ফাঁকা ধুধু মাঠ। ডাকটাও আর শোনা যাচ্ছে না। তবে কার গলার আওয়াজ ওটা, আমি চিনি। অবিকল মায়ের গলার আওয়াজ। মণি আমার ডাকনাম। বহুদিন হলো মা চলে গেছেন। মাঝে মাঝেই এক অদ্ভুত স্বপ্নের মতো তাঁকে দেখি। যেমন আজ দেখলাম। মা ফিরিয়ে নিয়ে আসেন আমাকে – প্রতিটি দুঃস্বপ্ন থেকে – ছিনিয়ে নিয়ে আসেন প্রতিটি বিপদ থেকে। চার্চের অশরীরী আবেশ আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, আমি জানি।
ঝড়জলের সাময়িক বিরতি ঘটল। আমার ৫০০ সিসির মোটরবাইক তুমুল গর্জনে এগিয়ে চলেছে কালো পিচের রাস্তা ধরে। আমি খুঁজে বের করব রাতের আস্তানা। অনিশ্চয়তার মধ্যে এছাড়া উপায় নেই। ডাকবাংলোর পথটা দেখা যাচ্ছে। চৌকিদারও চেনা মানুষ। তার কাছেই চুয়াডাঙ্গার নীলকুঠি আর সাহেবদের গল্প শুনতে হবে। এপার আর ওপার। বেড়ার দুদিকে মাত্র কয়েক মাইলের ফারাক। আমি বেড়া পেরোতে চাই। সময়ের বেড়া, ভূগোলের বেড়া, ইতিহাসের বেড়া।
সৌম্য থেমে গেল।
এতক্ষণ ধরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো যে-গল্প শুনছিলাম, তার ঘোর কাটল ট্রেনের আগমনী ঢং ঢং শব্দে। একটি কথাও না বলে চুপচাপ সৌম্য বসে রইল বেঞ্চিতে। দূর থেকে ট্রেনের আলো নজরে এলো। ট্রেন পস্ন্যাটফর্মে ঢুকছে এমন সময় আমিও শুনলাম সেই ডাক – ‘মণি-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই’।
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ট্রেনে উঠে জানালা দিয়ে দেখলাম সৌম্য উঠে দাঁড়িয়েছে – হাঁটতে হাঁটতে চলে যাচ্ছে নজরের আড়ালে।