আফগানিস্তানের কাছাকাছি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের এক রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করছেন এক বাঙালি অধ্যাপক। তাঁর উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট ট্রেনটিতে দেশে ফেরা, কিন্তু ট্রেনে ভয়ানক ভিড়, তিল ধারণের স্থানটুকু নেই, ছিল না রিজার্ভেশন। স্যুটকেস নিয়ে লম্বা-চওড়া পাঠানদের ভিড়ে তাঁর তখন রীতিমতো দিশাহারা অবস্থা। তিনি যখন বিপর্যস্ত বোধ করছেন সে-সময় হঠাৎ ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখলেন একটি কামরায় কাবুলিওয়ালাদের জমজমাট আসর, কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তখন সেই অধ্যাপক তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগ করে একটি অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলেন, যা একমাত্র তাঁর পক্ষেই হয়তো সম্ভব ছিল। তিনি কামরার জানালায় মাথা গলিয়ে পশতুভাষায় প্রচলিত একটি লোকপ্রিয় ছড়া বললেন এবং এবং পুশতুতেই কামরায় প্রবেশের জন্য মিনতি জানালেন। বিস্মিত ও উৎফুল্ল সেই দীর্ঘদেহী কাবুলিওয়ালাদের একজন বেরিয়ে এসে তাঁকে কোলে করে এনে একেবারে বাঙ্কারে বসিয়ে দিলেন। শুধু এটুকুই নয়, জুটে গেল সর্বক্ষণব্যাপী নানারকম আপ্যায়ন। এই বিরল প্রতিভার বাঙালি অধ্যাপক হলেন ‘ভাষাচার্য’ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে, ১৮৯০ সালের ২৬শে নভেম্বরে, হাওড়ার শিবপুরে, মামার বাড়িতে। সুনীতিকুমার নিজে শৈশব-কৈশোরে যে-পারিবারিক বেষ্টনীতে বেড়ে উঠেছিলেন তাকে তিনি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার বলেছেন। তাঁর ঠাকুরদা কলকাতার এক ইংরেজ ব্যবসায়ী কোম্পানির অফিসে কেরানির কাজ করতেন। তাঁরা সে-সময় উত্তর কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটে থাকতেন। সুনীতিবাবুর ঠাকুরদা ছেলেবেলায় ফার্সি পড়েছিলেন, সংস্কৃত ও ইংরেজি বেশ ভালোই জানতেন। অলিভার গোল্ডস্মিথ, শেক্সপিয়রের রচনাসমূহ, অ্যারাবিয়ান নাইটস ইত্যাদি বই ছাড়াও 888sport apk ও ইতিহাসের বেশ কিছু বই তাঁর সংগ্রহে ছিল। বাংলা 888sport live footballের প্রতিও ঠাকুরদা মহাশয়ের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। নিয়মিতভাবে তিনি জন্মভূমি পত্রিকা সংগ্রহ করতেন। পঞ্চানন তর্করত্নের বাংলা 888sport app download apk latest versionে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ, কালীপ্রসন্ন সিংহের অনূদিত মহাভারত, বেশ কিছু পুরাণের 888sport app download apk latest version, অক্ষয়চন্দ্র সরকারের সংস্করণে কবিকঙ্কণ চণ্ডী আর বৈষ্ণব পদাবলী, নববিধান সমাজের গিরিশচন্দ্র সেনের বাংলা তাপসমালা ইত্যাদি বই তাঁর সংগ্রহে ছিল। সুনীতিকুমারের বাবা হরিদাস চট্টোপাধ্যায়ও সওদাগরি অফিসে কেরানির চাকরি করলেও ইংরেজি 888sport live footballের প্রতি তাঁর একটা ঝোঁক ছিল, বলা যায় তাঁর ঔৎসুক্যেই সুনীতিকুমারের ইংরেজি 888sport live footballচর্চার সূত্রপাত। এ-প্রসঙ্গে সুনীতিবাবু তাঁর জীবন-কথা বইয়ে লিখেছিলেন : ‘বাবার খুব আগ্রহ যাতে আমরা ভালো করে ইংরেজি শিখি। সেকালে উচ্চশিক্ষা মানেই ভালো ক’রে ইংরেজির চর্চা, শেক্সপিয়ার, মিলটন, শেলি, ব্রাউনিং, টেনিসন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ডিকেন্স, থ্যাকারে, অ্যাডিসন, সুইফ্ট্ যার মুখস্থ নয়, সে আবার পণ্ডিত কিসের? অনেক বেশি ইংরেজি বই, ক্বচিৎ সঙ্গে-সঙ্গে সংস্কৃত বইও, যাঁরা পড়তেন, তাঁদের walking library ব’লে সম্মান করা হ’ত।’ এই রকম বিদ্যাচর্চাময় বাতাবরণে সুনীতিকুমারের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া এবং বাইরের জগতের বইয়ের সঙ্গে পরিচিতি গড়ে উঠতে শুরু করে। সুনীতিকুমার তাঁর লেখা পূর্বোক্ত বইটিতে লিখেছেন : ‘বাবা বই পড়ার কদর বুঝতেন। তিনি জানতেন, কেবল কখানি পাঠ্যপুস্তক নিয়ে নাড়াচাড়া করলে কিছু হয় না – পাঠের পরিধি সর্বদা বাড়াতে হয়। এই জন্য খুব বেশি করে, সেকালের ভাষায়, ইংরেজি out-book অর্থাৎ পাঠ্যের বাইরেকার বই পড়া চাই। সে বই কিনে পড়াবার সংগতি ছিল না, তবে কলকাতার পুরোনো বইয়ের দোকানে, আর রাস্তায় ঢালা কম দামের ছেলেদের উপযোগী পুরোনো ইংরেজি বই দু-চার আনায় পাওয়া যেত, বেছে বেছে সেরকম বই বাবা প্রায়ই আমাদের জন্য কিনে নিয়ে আসতেন। আমাদের নিজে পড়াতেন। এই থেকে ‘গ্রন্থ-কীট’ হবার একটি প্রবৃত্তি আমার মনের মধ্যে ছেলেবেলাতেই জেগে ওঠে।’
ভাষাচার্য সুনীতিকুমারকে আমরা জানি জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতার চূড়ান্ত বিরোধী হিসেবে, একই সঙ্গে পৃথিবীর নানা দেশের ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতি সমান 888sport apk download apk latest versionশীল এবং মানবদরদি জ্ঞানমার্গের পথিক হিসেবে। সুনীতিবাবু বাংলা-ইংরেজি-সংস্কৃত ছাড়াও হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া, তামিল, গ্রিক, ল্যাটিন, ফরাসি, জার্মান প্রভৃতি ভাষা উত্তমরূপে তো জানতেনই, সেইসঙ্গে সেই সমস্ত ভাষার 888sport live football ও সংস্কৃতির গভীরতম প্রদেশে গিয়ে রীতিমতো চর্চাও করতেন। ভাষা ও 888sport live football ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস-ভূগোল-নৃতত্ত্ব-পুরাতত্ত্ব-দর্শন-ভাস্কর্য-চিত্রকলা ইত্যাদি তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ষষ্ঠ স্থান অধিকার করার পর সুনীতিকুমার এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন, ভারত সরকারের বৃত্তি পেয়ে তিনি যান লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সেখান থেকে ডি.লিট ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল : Indo Aryan Linguistics : The Origin and Development of the Bengali Language, গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ড্যানিয়েল জোন্স।
সুনীতিকুমারের প্রজ্ঞার কথা, তাঁর নানারকম বিদ্যাবত্তার কথা স্বল্পপরিসরে বলা সম্ভব নয়। তাঁর জীবনের কয়েকটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে তাঁর মেধা-মনন-পাণ্ডিত্যের পরিসরটি চিনিয়ে দেওয়ার জন্য, তাঁর বিশিষ্ট বিনয়ী সত্তাটিকে বোঝানোর জন্য, যে-ঘটনাগুলো বহুলভাবে আলোচিত নয়। ভারত সরকারের বিশেষ আমন্ত্রণে সাংস্কৃতিক সফরে দ্বীপরাষ্ট্র মাদাগাস্কার থেকে সুবিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক রামামঞ্জি জর্জেস (Ramamonjy Georges) এ-দেশে আসার পর কলকাতাতেও তিনি আসেন। ভারত সরকার থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছিল রামামঞ্জির সভায় যেন কোনো ভাষাতত্ত্বের বিদগ্ধ পণ্ডিত উপস্থিত থাকেন এবং যথাযথ সমাদর যেন তাঁকে করা হয়। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে এই আয়োজন করতে হয়। সভাপতি হিসেবে সুনীতিকুমারকে রাজি করানো হয় এবং ঠিক হয় তিনিই সভাপতি হিসেবে রামামঞ্জি জর্জেসকে সভায় পরিচয় করিয়ে দেবেন। যদিও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সভা শুরুর আধঘণ্টা আগেও সুনীতিবাবু জানতেন না যে তাঁকে এইরকম একটি গুরুভার সভার সভাপতিত্ব করতে হবে। যাই হোক, অপ্রস্তুত সুনীতিকুমার সভার কাজ শুরু করে দিলেন। রামামঞ্জি জর্জেসকে পরিচয় করানো প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবে ভাষার কথা উঠল। সুনীতিবাবু সে-সময়কার মাদাগাস্কারের ভাষার যে নানারকম সমস্যা দেখা দিয়েছে তা একে একে পর্যায়ক্রমে বলে গেলেন। তাঁর সেই সময়কার বক্তব্য শুনে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক যে তিনি বোধহয় রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো তিনি এ-সভার কথা জানতেন না। একেবারে আকস্মিকভাবেই তাঁকে বলতে হয়েছিল। অন্যদিকে রামামঞ্জি জর্জেস বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে সুনীতিকুমারের মনোজ্ঞ আলোচনা শুনছিলেন এবং তাঁর স্বদেশের ভাষায় যে এতরকম কূট সমস্যা ও বিভিন্ন রকম বাঁক রয়েছে তার সব হালহদিস তিনি নিজেও জানতেন না; তাঁর নিজের বক্তৃতার সময় তিনি তা অকপটে স্বীকার করে সুনীতিকুমারের অবিশ্বাস্য ভাষাজ্ঞানের প্রশংসা করলেন। পরিশেষে তিনি বললেন – তাঁর মাতৃভাষা সম্পর্কে যে-রহস্য ও সমস্যার বিষয়ে জানতে পারলেন, দেশে ফিরে গিয়ে সেসব দিক নিয়ে নতুনভাবে গবেষণা শুরু করবেন।
প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য নিয়ে সুনীতিবাবুর কোনো অহমিকা ছিল না। বহুক্ষেত্রেই তাঁকে বলতে শোনা গেছে – ‘এ বিষয়ে আমি সামান্যই জানি।’ যদিও তাঁর এই সামান্য জানা প্রায় সবক্ষেত্রেই অসামান্য জানায় পরিণত হয়েছে। সুনীতিবাবুর এক বিদুষী ছাত্রী (পরবর্তীকালের ধীমতী গবেষক, অধ্যাপিকা, লেখিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য) গ্রিক ভাষার বিদেশি এক অধ্যাপককে সুনীতিকুমারের কাছে নিয়ে যান আলাপ করানোর জন্য। সেই অধ্যাপককে সুনীতিবাবু তাঁর সংগৃহীত গ্রিক বইগুলো দেখাচ্ছিলেন। এমন সময় এক সারির মধ্যেই বই দেখাতে দেখাতে একটি বই বাদ দিয়ে পরের বইগুলো দেখালেন। সুনীতিবাবু একটু দূরে সরে যেতেই কৌতূহলী সেই ছাত্রী সেই বইটি নিয়ে দেখলেন বইটির গ্রন্থকার বইটি সুনীতিবাবুকে উৎসর্গ করেছেন। সুনীতিকুমারের বয়স তখন ছিয়াশি বছর এবং লব্ধপ্রতিষ্ঠ পণ্ডিতের এই অকৃত্রিম বিনয় ও সৌজন্য দেখে সেই বিদেশি গ্রিক অধ্যাপক মুগ্ধ, স্তব্ধ।
একদা এক অপরাহ্ণে সুনীতিবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্যনির্মিত শতবার্ষিকী ভবনের সামনের ফুটপাতে। হঠাৎই অপরিচিত এক কৌতূহলী তরুণ তাঁর কাছে একটি অল্পশ্রুত পদবির উৎস জানতে চাইলেন। সে-প্রশ্নটির মধ্যে কোনো জ্ঞানপ্রকাশক দীপ্তি ছিল না, ছিল না তৎক্ষণাৎ উত্তর দেওয়ার মতো বিশেষ কোনো তাড়না। তরুণটি নেহাতই সুনীতিকুমারের সঙ্গে আলাপের অছিলায় প্রশ্নটি করেছিলেন। কিন্তু সুনীতিবাবু প্রশ্নটিকে হালকাভাবে নিলেন না, গেলেন না বিন্দুমাত্র এড়িয়েও। তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে প্রায় আধঘণ্টা ধরে প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ভাষাতাত্ত্বিক সমাধানসহ নানাভাবে ব্যাখ্যা করে গেলেন। প্রশ্নকর্তা কী করেন, কেন এমন প্রশ্ন ফুটপাতে দাঁড়িয়ে করা হলো – সেসব নিয়ে কোনো কথাই তিনি বললেন না। তখনো সুনীতিকুমার গাড়ির মালিক হননি। হয়তো বাস বা ট্রাম ধরবেন বলেই দাঁড়িয়েছিলেন; কিন্তু তাঁর সামনে দিয়ে একাধিক বাস-ট্রাম চলে গেলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না তিনি। প্রশ্নকর্তার বাহুমূলে হাত রেখে নিরন্তর বলে চলেছেন আগত প্রশ্নের উত্তর বিষয়ে নানাতর দ্যুতিময় কথা। অনুসন্ধিৎসু ছাত্রের অনুসন্ধিৎসা মেটাবেন না, তা কি হয়!
সুনীতিকুমার একবার কায়রোতে গিয়েছিলেন, সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে। তিনি যেসব দেশ বা অঞ্চলে যেতেন সেখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে আহার্যদ্রব্যকেও এক করে দেখতেন। আলোচনার পর ওই দেশের এক অধ্যাপককে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন স্থানীয় এক দোকানে মাংস-আস্বাদ করার জন্য। কায়রোতে সে-সময় ভারতবিদ্বেষ প্রবল, পাকিস্তানপ্রীতি ছিল অত্যুচ্চ। কিন্তু, তাই বলে তো আর মাংসের আস্বাদ থেকে বিরত হওয়া যায় না। বেশ খানিকটা গাড়িতে করে যাওয়ার পর গাড়ি রেখে পুরনো শহরের গলিতে ঢুকতে হলো। সেই গলিপথে পথ আটকে সুনীতিকুমারকে স্থানীয় এক ব্যক্তি ভারতীয় না পাকিস্তানি জানতে চাইলে তিনি তৎক্ষণাৎ অতি পরিষ্কার আরবীয় উচ্চারণে কোরান থেকে একটি আয়াত আউড়ে দিলেন। ফলশ্রুতিতে রীতিমতো আদাব জানিয়ে সে-ব্যক্তি সুনীতিকুমারকে ছেড়ে দিলেন। সেই সঙ্গী সহাস্য-ভঙ্গিতে তাঁকে মাংস খাওয়াতে নিয়ে গেলেন।
সুনীতিকুমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে পড়াতেন বাংলা-সংস্কৃত-ইংরেজি-ভাষাতত্ত্ব প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইংরেজি; এছাড়া গ্রিক-ল্যাটিন-কেলটিক ভাষাও। প্রয়োজনে ও প্রসঙ্গসূত্রে তিনি পড়াতেন খোটানি, আরামীয়, অবেস্তীয়, পারসিক, আরবি ভাষা। মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি নিয়ে তিনি সুবিস্তৃত পড়াশোনা করেছিলেন। ফলস্বরূপ আরব, তুর্কি ও ইরানীয় সভ্যতার বিশিষ্ট দিকগুলো সম্বন্ধে এবং মানবসভ্যতায় এসব সংস্কৃতির অবদান কোথায় সে-বিষয়ে ওয়াকিবহাল হয়েছিলেন। Iranianism; Iranian culture and its impact on the world from Achaemenian times গ্রন্থে ইরান সম্বন্ধে তাঁর সুচিন্তিত প্রজ্ঞাবান মতামত বিধৃত রয়েছে। যে-আফ্রিকাকে পশ্চিমি সভ্যতার বিদ্বজ্জনেরা ঔপনিবেশিক মানসিকতার বশবর্তী হয়ে অবহেলার চোখে দেখতেন ও বিচার করতেন, সেই হীন মানসিকতাকে সুনীতিকুমার পরিহার করেছিলেন। আফ্রিকার মানুষজনদের জীবনযাত্রা, ধর্ম, 888sport live chat-সংস্কৃতিকে নিবিড়ভাবে জানবার জন্য তিনি আফ্রিকার ত্রিপোলি, ঘানা, ইথিওপিয়া এইসব দেশ একজন ক্রান্তদর্শী পরিব্রাজকের মতো 888sport slot game করেছিলেন। Africanism : the African Personality বইয়ে প্রতিফলিত হয়েছে একজন সহৃদয় ব্যক্তির সঙ্গে বৌদ্ধিক চেতনাসম্পন্ন গবেষকের মন। আফ্রিকার সংস্কৃতিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছেন এই গ্রন্থে। ইউরোপ মহাদেশে তিনি বিভিন্ন উপলক্ষে একাধিকবার গিয়েছিলেন। গবেষণার প্রয়োজনে প্রথমে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স এবং পরবর্তীকালে পর্যটক হিসেবে গিয়েছিলেন গ্রিস ও ইতালি। ইউরোপের প্রাচীন সংস্কৃতির নানাতর দিক তাঁর দীপ্র অনুভূতিশীল মনকে আকর্ষণ করেছিল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, সুইডেন ইত্যাদি পরিচিত দেশে তো গিয়েছিলেনই, অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত স্বল্পপরিচিত আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, লাটভিয়া, তবিলিসি, রোমানিয়া ইত্যাদি দেশ বিষয়ে তাঁর সাংস্কৃতিক অনুসন্ধিৎসা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল এসব দেশে। আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৫১-৫২) যেমন গিয়েছিলেন অধ্যাপনার প্রয়োজনে; তেমনি করে দক্ষিণ আমেরিকার মায়া, আজতেক ও ইউকাটান সভ্যতায় তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন ওই লুপ্ত সভ্যতাগুলোর ধ্বংসাবশেষ দেখার প্রবল আকর্ষণে। এসব দেশের ধর্মীয় কাহিনি বিষয়ে তিনি আগেই প্রগাঢ়ভাবে পড়াশোনা করেছিলেন, তাই অধীত বিদ্যা প্রয়োগ করে অবশিষ্ট কীর্তিস্তম্ভ ও প্রত্নবস্তুসমূহের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চেয়েছিলেন সবকিছু। দেশে ফিরে এই অমেয় অভিজ্ঞতাকে জারিত করে লেখেন একাধিক 888sport live।
সুনীতিবাবু তাঁর ছাত্রছাত্রীদের ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন এবং তিনি কখনোই তাঁদের কাছ থেকে প্রণাম গ্রহণ করতেন না। তিনি চাইতেন না ছাত্রদের মধ্যে কোনো হীনমন্যতা দেখা দিক, নিজেকে ছাত্রদের থেকে খানিকটা অগ্রসর মনে করতেন মাত্র। সুনীতিকুমারের মননের আরেকটি বিশেষ দিক ছিল সব মানুষকে, ভাষাগোষ্ঠীকে সমদৃষ্টিতে দেখা। 888sport live football আকাদেমির সঙ্গে যুক্ত থাকার সময় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের যেসব ভাষা সংবিধানের স্বীকৃতি পায়নি, তাদের তিনি 888sport live footballের ঐশ্বর্যের ভিত্তিতে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। যার ফলে কোঙ্কনি ভাষা মারাঠির বন্ধনমুক্ত হয়ে 888sport live football আকাদেমির স্বীকৃত ভাষা হিসেবে মান্যতা পায়। নানা ভাষাগোষ্ঠী এ-কারণে সুনীতিকুমারের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। তাঁর সনিষ্ঠ উদ্যমে রাজস্থানি, মণিপুরী, ডোগরি ইত্যাদি ভাষাও উপভাষার হীনতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে 888sport live football আকাদেমির স্বীকৃতি লাভ করেছিল।
বঙ্গীয় 888sport live football পরিষদের তত্ত্বাবধানে তখন ভারতকোষ প্রথম খণ্ড সংকলনের কাজ চলছে প্রবল উদ্যমে। সেই কাজের সঙ্গে জুড়ে গেছেন শঙ্খ ঘোষ, প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের মতো তরুণেরা। সুনীতিকুমার মাঝেমাঝেই পরিষদে চলে আসতেন সে-সময়। বিভিন্ন ভাষার অপরিচিত শব্দ বা অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধানের ব্যাপারে সুনীতিবাবুর শরণ নেওয়া ছিল অনিবার্য ব্যাপার। সেই সব অপরিচিত শব্দের নানান প্রতিশব্দ তিনি একের পর এক লিখে দিতেন। একদা কোনো একটা শব্দে আটকে যাওয়াতে তিনি শঙ্খ ঘোষকে বলেছিলেন : ‘এই ভাষাটা আমার জানা নেই, তবে অনুমান করছি একটা।’ অনুমিত সেই প্রতিশব্দটি লিখে দেওয়ার পর একটি বইয়ের নাম করে সেখান থেকে মিলিয়ে নিতে বললেন, আর বললেন : ‘আমারটার ওপর নির্ভর কোরো না।’ কিন্তু সেই বই মিলিয়ে নিতে দেখা গেল সুনীতিবাবুর অনুমানের সঙ্গে বইতে নির্দেশিত শব্দের পার্থক্য নেই কোনো। ভারতকোষের প্রথম খণ্ড প্রকাশের পরে সেদিন 888sport live football পরিষদে সম্পাদকমণ্ডলীর নানা বিদ্বজ্জনসহ এক সভার আয়োজন করা হয়েছে। উপস্থিত মান্যজনদের মধ্যে সুকুমার সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও রয়েছেন। সে-সভায় নানা আলাপ-আলোচনার মাঝে সুকুমার সেন বজ্রপাতের মতো হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন : ‘এ-বই নিয়ে আপনারা গর্ব অনুভব করছেন? এই সম্পাদকমণ্ডলী? আপনাদের তো লজ্জা হওয়া উচিত।’ বলার পর সে-বইয়ের একাধিক পৃষ্ঠা খুলে-খুলে দেখাতে লাগলেন মুদ্রণপ্রমাদসহ নানা বিচ্যুতি। সুকুমার সেনের প্রত্যক্ষ শিক্ষক সুনীতিকুমার মাথা নিচু করে শুনছেন সব অনুযোগ আর কুণ্ঠিতভাবে শুধু বলছেন : ‘না না, এত বড়ো একটা কাজে ওরকম দু-চারটে ভুল থাকেই -।’ তখন সুকুমার সেন বললেন, ‘কেন, থাকবে কেন? এ-তো একটা কোষগ্রন্থ। আর এত এত যোগ্য সম্পাদক আছেন এখানে, এখানে একটাও ভুল থাকবে কেন?’ ছাত্রের এই প্রবল তর্জন-গর্জনের সামনে বিনীতবাচনে সুনীতিকুমার বললেন : ‘সে একটা শুদ্ধিপত্র জুড়ে দিলেই হবে। কিন্তু আমি আবারও বলছি মহারাষ্ট্রের ভারতকোষের তুলনায় এটা বহুগুণ ভালো।’ ছাত্র সুকুমার সেন মাস্টারমশাই সুনীতিকুমারকে রীতিমতো ধমক দিয়ে বললেন : ‘আপনি মহারাষ্ট্র করছেন কেন বারবার? মহারাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করব কেন? ওখানে কী আছে? ওখানে কী কোনো সুনীতি চাটুজ্যে আছে?’ সুনীতিকুমারকে মানতেই হলো ছাত্রের প্রগলভ উক্তি আর তখনো সুকুমার সেন বলে চলেছেন : ‘কিন্তু আমাদের তো সুনীতি চাটুজ্যে আছেন। আমাদের তো গর্ব সেটা। মহারাষ্ট্রের সঙ্গে কেন তুলনা করব আমরা?’
সুনীতিকুমার মনে করতেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আর নজরুল ইসলাম ছাড়া আর কোনো কবিই ঠিকঠাক 888sport app download apk লিখে উঠতে পারেননি; এ নিয়ে গুরু সুনীতিকুমার ও শিষ্য সুকুমার সেনের মধ্যে বেশ মধুর তর্ক-প্রতর্ক চলত। শিষ্য একদিন গুরুকে বললেন, তিনি তিরিশের দশকের কোনো কবির 888sport app download apk কি অভিনিবেশ সহকারে পড়েছেন? আর না-পড়লে 888sport app download apkর ভালোমন্দের বিচারই বা করবেন কী করে?
তখন সুনীতিকুমার বললেন : ‘বেশ আপনি যাঁদের কবি মনে করেন, তাঁদের কিছু লেখা পড়তে দেবেন আমাকে। দেখি কেমন সেসব 888sport app download apk।’ সুকুমার সেন মাস্টারমশাইকে আধুনিক 888sport app download apkর পাঠক করে তোলবার প্রবল উৎসাহে ছেলে সুভদ্রকুমার সেনকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে-র বেশ কিছু 888sport app download apkর বই। বইগুলো পেয়ে সুভদ্রকুমারকে সুনীতিবাবু বললেন : ‘পনেরো দিন পরে এসে বইগুলি নিয়ে যেয়ো আবার।’ ঠিক পনেরো দিন পরে সুভদ্রকুমার সেসব বই ফেরত নিতে গেলে বইগুলো সুভদ্রকুমারের হাতে দিয়ে সুনীতিকুমার বলেছিলেন : ‘বাবাকে গিয়ে জানিয়ো, সবকটাই আমি পড়েছি, কিন্তু কিছু বুঝিনি। বাবাকে বলবে, হয় আমি মহামূর্খ, কিছুই বুঝতে পারি না, আর নয়তো উনি মহামূর্খ, কিছুই বুঝতে পারেন না। একে কি 888sport app download apk বলে?’
১৯৩১ সালে বরিশাল জেলার চন্দ্রহার গ্রামের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, তিনি এ-সময়ের খ্যাতকীর্তি কবি-প্রাবন্ধিক-অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের বাবা। মণীন্দ্রকুমারের তখন বয়স তেত্রিশ, তো সে-বয়সেই তিনি একটি বৈপ্লবিক কাজ করেছিলেন। তিনি স্কুলের উঁচু শ্রেণিতে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদেরও সহশিক্ষা চালু করেছিলেন। সে-সময় অবশ্য বারো বছর বয়স পর্যন্ত সব স্কুলে সহশিক্ষা সরকার-অনুমোদিত ছিল। এই কাজে আনন্দাল্পুত হয়ে 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রাক্তন ছাত্র মণীন্দ্রকুমারকে অভিবাদন জানিয়ে চিঠিতে লিখেছিলেন : ‘তুমি তোমার স্কুলে বালিকাদের পড়বার ব্যবস্থা করেছ জেনে যে কি বিপুল আনন্দ অনুভব করলাম তা তোমাকে লিখে জানাতে পারব না। আশীর্বাদ করি তোমার চেষ্টা জয়যুক্ত হোক, সর্বজনসমাদৃত হোক, দেশের মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারিত হোক।’ কিন্তু সে-চেষ্টা কী প্রকৃত প্রস্তাবে সর্বজনসমাদৃত হতে পেরেছিল? না, পারেনি। সবচেয়ে গুরুতর অপ্রত্যাশিত বাধাটি এসেছিল তাঁর শিক্ষকপ্রতিম সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। সুনীতিকুমার দ্রুত এক নির্দেশে জানালেন : ‘Scotch it! Scotch it!
!’ অর্থাৎ বাদ দিতে বলছেন এই চেষ্টাকে। মণীন্দ্রকুমার তাঁকে লিখলেন : ‘Co-education is better than no education’। উত্তরে সুনীতিকুমার সম্পূর্ণ উল্টো কথা বললেন : ‘No education is better than ill education’। স্কুলের উচ্চশ্রেণির সহশিক্ষাকে সুনীতিকুমারের মতো আন্তর্জাতিক স্তরের প্রজ্ঞাবান মানুষের যদি মনে হয় ‘ill education’ তাহলে তো চূড়ান্ত হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছু থাকে না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো সুনীতিকুমারকে অমর করে গেছেন তাঁর শেষের 888sport app download apk 888sport alternative linkে। 888sport alternative linkের নায়ক যখন শিলং পাহাড়ে বেড়াতে গেল, তখন সে গল্পের বইয়ের বদলে নিয়ে গেল সুনীতি চাটুজ্যের বাংলা ভাষার শব্দতত্ত্ব, ‘লেখকের সঙ্গে মনান্তর ঘটবে এই একান্ত আশা নিয়ে।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে ১৯২৭ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর – তিন মাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়, যবদ্বীপ, বালিদ্বীপ এবং শ্যামদেশ 888sport slot game করলেন সুনীতিকুমার। এই 888sport slot gameের সরস বিবরণ সুনীতিকুমারের কলমে প্রকাশিত হলো রবীন্দ্র সংগমে দ্বীপময় ভারত ও শ্যামদেশ নামে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাংলা ভাষা পরিচয় বইটি উৎসর্গ করেছিলেন সুনীতিকুমারকে। সুনীতিবাবুর বয়স যখন প্রায় আশি তখন তিনি প্রাচীন জাপানি ভাষা শিখতে আরম্ভ করেন। তাঁর মনে হয়েছিল তা না হলে জাপানের পুরনো ধর্মের মর্মকথা ভালো করে বোঝা সম্ভব নয়। তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল : এত ভাষা উনি কী করে শিখলেন, এত বই পড়ে এত কিছু কী করে মনে রাখেন! তাঁর সৎ বিনীত উত্তর ছিল : ‘আপনারা যা ভাবেন আমি তা নই। কিছুই জানি না। ছাত্রজীবনে কিভাবে যে কয়েকটা সূত্র খুঁজে পেয়েছিলাম যার ফলে কয়েকটা ভাষা মোটামুটি বুঝতে পারি। কারণ, সব ভাষার মূল সূত্রের মধ্যে একটা ঐক্য আছে।’ ইংল্যান্ডের লিডস্ (Leeds) বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব ও ধ্বনি888sport apk বিভাগের বিভাগীয় প্রধান Terence Frederick Mitchell সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে বলেছিলেন : ‘I can’t understand why Indians should come over to England to learn Linguistics. Their country produced Panini and today Dr. Chatterjee is their Countryman.’ সুনীতিকুমার প্রসঙ্গে অধ্যাপক মিচেলের এই শ্লাঘনীয় উক্তিটির মধ্যেই তাঁর বিশেষত্বের একটি দিক মাত্র উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু সুনীতিকুমারের দুর্বার মেধা ভাষাতত্ত্ব নামক একটি পরিধিতে কেবল সীমায়িত ছিল না; পৃথিবীর সমস্তরকম জ্ঞানমার্গের পথে তাঁর ছিল আন্তরিক পর্যটন এবং সেখানে কোনো ক্লান্তি তাঁকে কখনো গ্রাস করেনি।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.