মুনতাসীর মামুন
গ্রীষ্মের শুরুতে আমি পৌঁছলাম লারনাকা। তখনো দুপুর হয়নি, দুবাই থেকে প্লেন এসে নামল
লারনাকায়। আমার পছন্দ ছিল নিকোশিয়া। সাইপ্রাসের রাজধানীর এ-নামটি শুনলেই মনে হতো –
একবার যেতে হয় নিকোশিয়া, সাইপ্রাস তো বটেই। সাইপ্রাসের বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা
হাবিবুর রহমান ওরফে হাবিব যখন আমন্ত্রণ জানাল, একবার ঘুরে যাওয়ার, তখনই রাজি হয়ে
গেলাম। সময় পেয়েছিলাম এক সপ্তাহ। আমি অবশ্য অতো প্রস্ত্ততি নিয়ে বেরোই না, ফলে
অসুবিধা হয় না। হাবিবের সঙ্গে যখন ফোনে কথা হাচ্ছিল তখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে কি
টিকিট হবে 888sport app-নিকোশিয়া? পথে না-হয় থামব দুবাই।’
দূরপাল্লার 888sport slot gameে এমিরেটস হলে আমার ভালোই লাগে। একদিন একরাত দুবাই রাখে তাদের খরচে। এখন নাকি
সে-সিস্টেম প্রায় উঠে গেছে। দুবাই এক চক্কর ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগে। হাবিব জানাল,
এমিরেটস ঠিক আছে, দুবাইও থামবে। কিন্তু আমাকে নামতে হবে লারনাকায়। এয়ারপোর্ট
সেখানে। আর তারা সব থাকে লারনাকায়, অনুষ্ঠানও হবে সেখানে। সান্ত্বনার স্বরে সে
জানাল, ‘অসুবিধা নেই স্যার, আমরা নিকোশিয়া যাব। এক ঘণ্টার পথ। হরদম আমরা নিকোশিয়া
যাই।’
লারনাকার স্থান নিকোশিয়ার পরই। ঐতিহাসিক এলাকা,
সমুদ্রতীরবর্তী পর্যটনকেন্দ্র, বাণিজ্যকেন্দ্রও বটে। তা দুপুরের আগে পৌঁছলাম আমি।
বিমানবন্দরে দুটো গাড়ি নিয়ে হাবিবরা উপস্থিত। বয়স কারো ছাবিবশ-সাতাশের বেশি বলে
মনে হলো না। হাসিখুশি। প্রথমে তারা বেশ তারকাসমৃদ্ধ এক হোটেলে রেখেছিল। অনুষ্ঠানের
পরদিন জোর করেই আমি হোটেল বদল করি। এসে উঠি ভূমধ্যসাগরের তীরে পুরনো আমলের গ্রান্ড
পা’স হোটেলে।
পুরনো ধাঁচের ইমারত। বয়স পঞ্চাশ তো হবেই। পুরু দেয়াল, উঁচু ছাদ, বারান্দা পেরিয়ে ঢুকতেই খাবারঘর। পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে
দোতলায়। খাবারঘরের সামনে খোলা বারান্দা, সামনে ঘাসের আঙিনা। আঙিনা থেকে একটি কাঠের
জেটি সমুদ্রের ভেতর খানিকটা চলে গেছে, বোট বাঁধা হয় সেখানে। সময় পেলেই আমি জেটিতে
রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। আহ্ এই সেই ইতিহাসখ্যাত ভূমধ্যসাগর, মেডিটেরিনিয়ান সি!
হালকা রোদ, সমুদ্রের লোনা পানি আর হাওয়ার গন্ধ মোহিত করে দেয়। সাগর আর দিগন্ত যেখানে মিলেছে তার ওপারে কি কায়রো? একদিকে লারনাকা,
আর অন্যদিকে কায়রো, দুটিই ছিল প্রাচীন সভ্যতা। আর দুটি সভ্যতার যোগাযোগের মাধ্যম
ছিল এই ভূমধ্যসাগর।
ঘুম ভেঙে গেল কেন জানি না। বিছানার পাশে জানালাটা খোলা। তীরে এসে ঢেউ ভেঙে পড়ছে, তার শব্দ ভেসে আসছে। সাগর ছুঁয়ে আসছে মৃদু হাওয়া।
জানালার সামনে দাঁড়াই। না, সকাল হয়নি, ঢেউ দেখা যাচ্ছে না, আকাশে তারা আছে; কিন্তু
পূর্ব দিকটায় কেমন ফিকে আলো। ধলপহর কি একেই বলে? আমি খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকি।
অন্ধকার চারদিকে, তার মাঝে ভেসে আসছে ঢেউয়ের শব্দ। কেন জানি সেসব অভিযাত্রীর কথা
মনে হয়, যারা এক সময় ভূমধ্যসাগর দিয়ে পাড়ি দিয়েছিল অজানা পৃথিবীর পথে। এক সময়
ভূমধ্যসাগরই তো ছিল সভ্যতা-সংস্কৃতির কেন্দ্র, তারপর এলো আটলান্টিক আর প্রশান্ত
মহাসাগরের যুগ। কিন্তু ভূমধ্যসাগরের কথা মনে হলেই মনে পড়ে জলপাই বাগান, কালো চোখের
দোলানো বেণির চঞ্চলা তরুণী, সুঠামদেহী যুবক আর পালতোলা জাহাজ।
আমি আবার শুয়ে পড়ি। মৃদু হাওয়া বারবার ছুঁয়ে যায়
শরীর। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। যখন ঘুম ভাঙল তখন আলোয় ভরে গেছে ঘর। পর্দা গোটাতে
ভুলে গিয়েছিলাম। জানালা দিয়ে তাকাই। সকালের আলোয় চারদিক ঝলমল করছে। সমুদ্রের
প্রতিটি ঢেউ দেখা যাচ্ছে।
হাবিবকে নিয়ে বেরোব ঠিক করেছি। তা হাবিব
দশটা-এগারোটার আগে আসবে কি-না সন্দেহ। আজকালকার জেনারেশন রাত জাগে, দিনে অনেকটা
ঘুমোয়। হাবিব চাকরি করে না, ছাত্র, ফলে সকালে ওঠার বাধ্যবাধকতা তার নেই। তার আগে
একটু বেরিয়ে আসা যাক। হাত-মুখ ধুয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি। গন্তব্য মোড়ের জোরবাস ক্যাফে।
গতকাল দেখে এসেছি।
হোটেল সুনসান। মরশুম এখনো শুরু হয়নি। রুম সব এখনো
প্রায় খালি। কয়েকদিন পর আর জায়গা পাওয়া যাবে না। নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নামি, আস্তে
আস্তে সামনের দরজার ছিটকিনি খুলি। পশ হোটেলের মতো এখানে রিসেপশনও নেই, নাইটগার্ডও
নেই। বোর্ডাররাই সব। স্থায়ী বাসিন্দা 888sport appsের শফিক। সে আবার হোটেলের শেফও বটে।
মালিকপক্ষের কেউ না থাকলে ম্যানেজার ও।
রাস্তা একেবারে খালি। খানিকটা হেঁটে সমুদ্রতীরে
নামি। সরু বিচ, দৈর্ঘ্য সামান্য। রোদে তাপ নেই, হাওয়াটা শরীর ধুইয়ে দেয়, সমুদ্র
দেখতে দেখতে শেষ সীমায় পৌঁছি। তারপর ঢাল বেয়ে আবার পিচঢালা রাস্তায় উঠি। এ রাস্তা
এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ম্যারিনায় চলে গেছে। উল্টোদিকে, ঢিবির মতো ছোট এক টুকরো
জায়গা। রাস্তাটা তার পাশ দিয়েই গেছে। অনেকটা ট্রাফিক আইল্যান্ডের মতো। তার পাশেই
‘জোরবাস ক্যাফে’।
ক্যাফে মাত্র খুলেছে। মালিক সবলবৃদ্ধ। আমাকে দেখে
হাসলেন, বললেন, ‘গুড মর্নিং’।
‘মর্নিং’। আমিও হাসলাম। ক্যাফের সামনে বাঁধানো
চত্বর। চত্বরের মাঝে একটি গাছ। চারপাশে কয়েকটা টেবিল-চেয়ার। মালিক গতকাল আমাকে
দেখেছেন। অনুমান করে নিলেন কফিই খাব। অর্ডার নিতে এলেন না। একবারে কফির কাপ নিয়েই
এলেন। ধোঁয়া-ওড়া কাপটা টেবিলে রেখে হাসলেন। বললাম, ‘থ্যাংকু।’
আমার একপাশে দুই বৃদ্ধ এই সকালে গভীর মনোযোগ দিয়ে
দাবা খেলছেন। হয়তো কাছের মহল্লায়ই থাকেন। অবসর জীবন। গতকালই দেখেছি, ক্যাফের
অন্যপাশে সরু একটি রাস্তা। সেটি ধরে এগোলে টিলার মতো উঁচু জায়গা। সেখানে কয়েকটি
ফ্ল্যাটের সারি।
আমি ধীরে ধীরে কফি খাই। মাঝে মাঝে কাজানজাকিসের
কথা ভাবি। তাঁর লেখা জোরবা দ্য গ্রিক
পড়েছিলাম, তখন ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তারপর কাজানজাকিসের সবকটি বই আমি
সংগ্রহ করেছি। ওরকম লেখক কয়জন জন্মেছেন? কফি খেয়ে চুপচাপ বসে রাস্তা দেখি। তারপর
উঠে পয়সা মিটিয়ে হোটেলের দিকে হাঁটা শুরু করি। গ্রান্ড পা’স হোটেল পেরিয়ে যাই।
একটু হাঁটা দরকার। রাস্তাটা গেছে ম্যারিনার দিকে। মাইলখানেক হেঁটে আবার হোটেলের পথ
ধরি। সূর্য এখন অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। হোটেলে ফিরে নাস্তা সেরে গোসল করে তৈরি হয়ে
নিতে হবে। চলে আসার সময় হলো হাবিবের।
দুই
ঠিক সাড়ে দশটায় হাবিব চলে আসবে ভাবিনি। সে বোধহয়
আমার ভয়েই ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল। হাবিব যখন দরজায় টোকা দিলো, তখন আমি
শার্টের বোতাম লাগাচ্ছি। ‘কী হলো ঘুমোওনি নাকি?’ জিজ্ঞেস করি আমি।
‘না ঘুমিয়েছি।’ বলল হাবিব, ‘এখন না বেরোলে তো
আবার দুপুর হয়ে যাবে। তাই একটু আগে এলাম।’
হাবিবকে নিয়ে আমি গ্রান্ড পা’স হোটেল থেকে বেরোই।
রাস্তা পেরিয়ে অপর মাথায় নতুন থ্রি স্টার হোটেল, যেখানে আমি উঠেছিলাম। তার
গা-ঘেঁষে সরু একটা রাস্তা চলে গেছে ভেতরে। ওই রাস্তার আশপাশে সাধারণ মানের দু-একটি
বাড়ি। তারপর ফাঁকা জায়গা। সেটি পেরোলেই কিছু বাড়িঘর। বোঝা যায়, পুরনো আবাসিক এলাকা।
খানিকটা পরিত্যক্ত পরিত্যক্ত ভাব। খুবসম্ভব এটি পুরনো লারনাকার পুরনো পাড়া। নতুন
শহর, আবাসিক এলাকা এগোচ্ছে সমুদ্রের দিকে। বাড়িগুলি দেখতে কিন্তু বেশ। ব্রিটিশ
আমলের বাংলো টাইপের পুরনো বাড়ি। চারদিকে জমি। হাবিব এরকম একটি বাড়ি দেখিয়ে বলল,
‘এখানে আমি থাকি, দেখে যান।’
হাবিবরা দু-তিনজন বন্ধু মিলে বাড়িটা ভাড়া নিয়েছে।
বেশ বড়সড় বাংলো। কয়েকটি রুম। পেছনে ভেজিটেবল গার্ডেন করার জন্য বেশ খানিকটা জায়গা।
বাঙালি বিদেশে দলবেঁধে থাকে। ট্রাইবাল কালচার যাকে বলে। আমাদের উৎপত্তি তো ‘বঙ্গ’
ট্রাইব থেকে। কয়েকজন মিলে একটি ফ্ল্যাট বা বাড়ি ভাড়া নেয়, গাদাগাদি করে থাকে।
কিন্তু সাইপ্রাসে অবস্থা খানিকটা ভিন্নরকম, অন্তত লারনাকায়। কয়েকজন মিলে একটি
ফ্ল্যাট বা বাড়ি ভাড়া করে, কিন্তু গাদাগাদি করে থাকে না।
হাবিব ঘুরে ঘুরে বাসা দেখায়। ওর বন্ধুরা হয়তো
কাজে গেছে। বাসা খালি। বাসা দেখে বেরোই। একটু এগোতেই একটি গ্যারেজ। হাবিবের গাড়ি
গ্যারেজে। না, গাড়ি মেরামত হয়নি। আরো
দু-একদিন লাগবে।
‘কপালটাই খারাপ’, জানালো হাবিব, ‘আপনিও এলেন,
গাড়িটা নষ্ট। অন্যের ওপর ডিপেন্ড করতে হবে। নাহলে আপনাকে নিয়ে বেজায় ঘুরতে
পারতাম।’ ‘আমি তো ঘুরছিই। তুমি বললেই তো তোমার বন্ধুরা হাজির। দুপুরের পর না ফারুক
আসবে কাজ থেকে ছুটি নিয়ে।’
‘তা ঠিক, এখন যাবেন কই?’
‘এলোমেলো ঘুরব’, জানাই আমি, ‘তবে, এখন যাব সেইন্ট
ল্যাজারাসে।’
‘মানে, সেইন্ট ল্যাজারাস চার্চ তো, কাছেই,
অসুবিধা নেই।’
আবাসিক এলাকা পেরোতেই খানিকটা পোড়ো জায়গা,
মাল্টিস্টোরিড কিছু বিল্ডিং। একটি ইমারত দেখিয়ে হাবিব বলে, ‘ইন্টার কলেজ, আমার
কলেজ।’ আহামরি এমন কিছু নয়। আমাদের বাণিজ্যিক এলাকা বা আবাসিক এলাকায় একতলা-দোতলা
ভাড়া নিয়ে যেমন কলেজ হয়, তেমন আর কি! কলেজ পেরিয়ে এগোলেই আরেকটি সদর রাস্তা। মনে
হলো, এটিই পুরনো লারনাকা শহরের কেন্দ্র।
কে না শাসন করেছে সাইপ্রাস? খ্রিষ্টের জন্মের
১৪০০ বছর আগে গ্রিক ব্যবসায়ীরা প্রথম পৌঁছেন এখানে। তখন পাফোস, কিটিয়ন, কৌরিয়ন –
এসব নগররাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। এখন সেগুলি লারনাকারই অন্তর্গত। আফ্রোদিতির জন্ম তো
ধরা হয় সাইপ্রাসেই। সমুদ্রের যে-জায়গা থেকে আফ্রোদিতির আবির্ভাব, গিয়েছিলাম
সেখানেও। এরপর অ্যাসিরীয়, মিসরীয়, পারস্য, রোমান, বাইজেনটাইন ফ্রাংকিস, ভেনিশিয়ান,
অটোমান এবং সবশেষে ব্রিটিশ শাসন। ইংল্যান্ডের রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট তো একবার
ক্রুসেডে যাওয়ার সময় সাইপ্রাস দখল করে নেন। বিয়ে করেন নাভারের রাজকন্যাকে এবং
ইংল্যান্ডের রানী বলে ঘোষণা করেন তাকে। এক বছর পর রিচার্ড সাইপ্রাস বিক্রি করে দেন
নাইটস টেম্পলারদের কাছে। এক লাখ দিনারে। তারা আবার একই দামে তা বিক্রি করে দেয়
জেরুজালেমের সিংহাসনচ্যুত রাজা লুসিগনারের কাছে। ঘটনাটি ঘটেছিল ১১৯১-৯২ সালে।
অনেকে রাজত্ব করেছেন বটে সাইপ্রাসে কিন্তু সাইপ্রাস
অন্তর্গত রয়ে গেছে গ্রিক সংস্কৃতিরই। সাইপ্রাস ঘুরলে স্বাদ পাওয়া যায় এক টুকরো
গ্রিসের।
সদর রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছি। খানিকটা এগোতেই
হাতের ডানদিকে পড়ল ল্যাজারাসের চার্চ। গির্জার দুদিকেই সদর রাস্তা। মাঝখানে
দ্বীপের মতো জায়গায় ছোট্ট গির্জাটি। যখন গির্জাটি করা হয়েছিল তখনো তো আর
রাস্তাঘাটের বালাই ছিল না। যারা গির্জা করেছিলেন, জায়গাটা তাদের পছন্দ হয়েছিল।
আশপাশে ছিল হয়তো কিছু বসতি। সরু মেঠো পথ।
দূর থেকে দেখলে ল্যাজারাসের গির্জা এমন আহামরি
কিছু নয়। অন্য কোনো শহরে এরকম গির্জা হলে হয়তো নামতামও না। কিন্তু
এ-গির্জাটি সাইপ্রাসে বাইজানটাইন যুগের সবচেয়ে সুন্দর নিদর্শন, লারনাকার
‘পেট্রন সেইন্ট’ অন্যতম দ্রষ্টব্য।
চার্চের পাথুরে আঙিনায় পা রাখি, লোকজন নেই।
চার্চের জন্য বোধহয় বেশি সকাল। একপাশে কাঠের একটি বেঞ্চ, দর্শক বা ভবঘুরেদের বসার
জন্য। আমি আরাম করে বেঞ্চে বসি।
হাবিব বলে, ‘আপনি দেখেন, আমি আসছি।’ নিশ্চয় এই
তরুণ অবাক যে, আমি গির্জা দেখতে এসেছি। আর এক পৌঢ়ের সঙ্গে এক তরুণ কতক্ষণ থাকতে
পারে? আমি আয়েশ করে বসে রাস্তা দেখি। ফুটপাত দিয়ে দু-একজন হেঁটে যাচ্ছে। গাড়ি
দু-একটি। মেয়েদের বেশি দেখছি না। তাই অবাক লাগছে। আমার মনে পড়ল, একবার এক ব্রিটিশ,
আরেকবার এক জাপানি বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আচ্ছা, শহরটা ঘুরে বেড়ালাম, কোনো
মেয়ে নজরে পড়ল না তো।’ এটি অবশ্য বছর দশেক আগের কথা। কয়েক মাস আগে, 888sport app ক্লাবে এক
নেমন্তন্ন। ভারতীয় উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা আর অ্যাকাডেমিশিয়ানের সম্মানে। ভেতরের এক
কুঠুরি থেকে খেয়েদেয়ে বেরোচ্ছি, তো অ্যাকাডেমিশিয়ান অবাক হয়ে বললেন, ‘একজন 888sport promo codeও
নেই, হাউ স্ট্রেঞ্জ।’ লাউঞ্জভর্তি পুরুষ, ছোট ছোট টেবিলে পানপাত্র সাজিয়ে বসে।
আকাশটা ভারী নীল। গ্রীষ্ম আসেনি পুরোপুরি,
মৃদুমন্দ হাওয়া। কোথায় 888sport app আর কোথায় লারনাকার ‘সেইন্ট ল্যাজারাস চার্চ’। আমার
কাছে সাধারণ কিন্তু খ্রিষ্টান জগতের অর্থডক্স চার্চের কাছে অসাধারণ। এর সঙ্গে
জড়িয়ে আছে। তার বয়স দুহাজারের কাছাকাছি এবং এর উত্থান-পতনের সঙ্গে একটি ধর্মের
উত্থান-পতনের ইতিহাস জড়িত। সত্যিই ইতিহাসের কোনো তুলনা নেই। ‘লা জবাব’।
এই চার্চের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাইবেলের সেই বিখ্যাত
ল্যাজারাসের কাহিনি। জেরুজালেমের তিন কিলোমিটার পূর্বে ছোট এক গ্রাম বেথানি।
সেখানে বাস করতেন সেইন্ট ল্যাজারাস, এখন শুধু ল্যাজারাস, হিব্রুতে এলিজার, ইহুদি,
ছিলেন যিশুর বন্ধু। বাইবেলে আছে –
‘যিশাস লাভড মার্থা অ্যান্ড হার সিস্টার [মেরি]
অ্যান্ড ল্যাজারাস [মেরির ভাই]।’ যিশু বেখানিতে এসে তাদের বাসায় থেকেছেনও মাঝে
মাঝে।
যিশু তাঁর শেষ যাত্রায় যাচ্ছেন গ্যালিলিও থেকে
জেরুজালেম। সেখানে ক্রুশবিদ্ধ হবেন তিনি। এমন সময় বার্তা পেলেন দুই বোনের কাছ থেকে
যে, এলিজা খুব অসুস্থ। বাইবেলের ভাষায় ‘লর্ড, দ্য ওয়ান ইউ লাভ ইজ সিক।’
‘দিস সিকনেস উইল নট এন্ড ইন ডেথ।’ বললেন যিশু।
কারণ ‘ফর গডস গ্লোরি সো দ্যাট গড’স সন মে বি গ্লোরিফাইড থ্রু ইট।’
যাত্রা দুদিন পেছালেন যিশু। রওনা হলেন বেথানির
দিকে। এরই মধ্যে ল্যাজারাস মারা গেছেন। এক গুহায় (কবর) রাখা হয়েছে তাকে। চার দিন কেটে
গেছে ল্যাজারাসের মৃত্যুর পর। যিশু পৌঁছেন বেথানি। শুনলেন বন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ,
গিয়ে দাঁড়ালেন তার কবরের সামনে।
বাইবেলে যোহন-লিখিত সুসমাচারের নাটকীয় বর্ণনা আছে
–
‘যিশু কাঁদিলেন। তাহাতে যিহূদিরা কহিল, দেখ, ইনি
তাহাকে কেমন ভালোবাসিতেন। কিন্তু তাহাদের কেহ কেহ বলিল, এই যে ব্যক্তি অন্ধের
চক্ষু খুলিয়া দিয়াছেন, ইনি কি উহার মৃত্যুও নিবারণ করিতে পারিতেন না? তাহাতে যিশু
পুনর্বার অন্তরে উত্তেজিত হইয়া কবরের নিকটে আসিলেন। সেই কবর একটা গহবর। এবং তাহার
উপরে একখানি পাথর ছিল। যিশু বলিলেন, তোমরা পাথরখানি সরাইয়া ফেল। মৃত ব্যক্তির
ভগিনী মার্থা তাহাকে কহিলেন, প্রভু, এখন উহাতে দুর্গন্ধ হইয়াছে, কেননা আজ চারিদিন।
যিশু তাহাকে কহিলেন, আমি কি তোমাকে বলি নাই যে, যদি বিশ্বাস করো, তবে ঈশ্বরের
মহিমা দেখিতে পাইবে? তখন তাহারা পাথরখানি সরাইয়া ফেলিল। পরে যিশু উপরের দিকে চক্ষু
তুলিয়া কহিলেন, পিতঃ, তোমার ধন্যবাদ করি যে, তুমি আমার কথা শুনিয়াছ। … ইহা বলিয়া
তিনি উচ্চরবে ডাকিয়া বলিলেন, লাসার বাহিরে আইস। তাহাতে সেই মৃত ব্যক্তি বাহিরে
আসিলেন; তাঁহার চরণ ও হস্ত কবর-বস্ত্রে বদ্ধ ছিল। যিশু তাহাদিগকে কহিলেন, ইহাকে
খুলিয়া দেও, ও যাইতে দেও।’
এবং পুনরুত্থান হলো ল্যাজারাসের।
দাবানলের মতো এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। অনেক ইহুদি
যিশুর ধর্ম গ্রহণ করতে আগ্রহী হলেন। ইহুদি প্রধান পুরোহিত প্রমাদ গুনলেন। তিনি তখন
ল্যাজারাসকে হত্যার ষড়যন্ত্র করলেন। যিশু যখন ক্রুশবিদ্ধ হন ল্যাজারাসের বয়স তখন
তেত্রিশ। বেথানি ছেড়ে পালালেন ল্যাজারাস। চলে এলেন কিটিয়ন বা আজকের লারনাকায়।
যিশুর শিষ্য পল এবং বার্নাবাস এর বারো বছর পর
সাইপ্রাসে এসে ল্যাজারাসের খোঁজ পান এবং তাঁকে কিটিয়নের প্রথম বিশপ্র
হিসেবে মনোনীত করেন। সাইপ্রাস সে-সময়ে
এ-নামেই (কিত্তিম) পরিচিত ছিল। বাইবেলে আদিপুস্তকে কিত্তিমের উল্লেখ আছে।
এরপর আরো আঠারো বছর বেঁচে ছিলেন ল্যাজারাস, কিটিয়নের খ্রিষ্টানদের ‘রাখাল’ হিসেবে।
যিশু ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ত্রিশ বছর পর, আবার মারা যান ল্যাজারাস। তখন তাঁকে এখানে
সমাধিস্থ করা হয়। এ কারণে এটি খ্রিষ্টানদের বিশেষ এক তীর্থস্থান।
বেঞ্চ থেকে উঠে আমি গির্জার সদর দরজার দিকে
এগোলাম। গির্জাটি তো ছোটখাটো, পাথুরে। আদি গির্জা তো নয়। অনেকবার তা গড়া হয়েছে।
গির্জার একটা সুবিধা আছে। সবার জন্য তা উন্মুক্ত।
গির্জা উপাসনার জন্য তো বটেই, যে-কোনো সমাবেশের জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে।
উপাসনালয়ের মধ্যে গির্জা একধরনের গোঁড়ামিমুক্ত। গির্জা পরিদর্শনে সেজন্যে কোনো
সংকোচ লাগে না।
ভেতরটা আধো অন্ধকার। আসলে, জানালাগুলি খুব ছোট,
বাইরের আলো তেমন আসে না। তবে, খানিক পর চোখ সয়ে যায়। বাতি জ্বলছে ভেতরে কয়েকটি।
তেমন উজ্জ্বল নয়। দু-একজন ভেতরে আইকন দেখছেন। দেখি, হাবিব এসে দাঁড়িয়েছে দরজার
সামনে। ইশারায় তাকে ভেতরে আসতে বলি।
আমি বেদির দিকে এগিয়ে যাই। আগে পড়ে জেনেছি, এর
নিচে মার্বেলের কফিনে সন্ত ল্যাজারাসের দেহাবশেষের কিছুটা পাওয়া গেছে। তবে, সেটিরও
একটি ইতিহাস আছে। ৮৯০ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হয় কফিনটি। তখন এখানে ছোট একটি গির্জা
ছিল। মার্বেল পাথরের যে-কফিনটি পাওয়া যায় সেখানে খোদাই করে লেখা ছিল যিশুর বন্ধু
ল্যাজারাস, যিনি চারদিন মৃত ছিলেন।
সাইপ্রাস তখন বাইজেনটাইনদের অধীনে। কফিনটি যখন
আবিষ্কৃত হয় তখন সম্রাট ছিলেন ষষ্ঠ লিও, যাকে জ্ঞানী লিও-ও বলা হতো। তিনি সন্তের
দেহাবশেষ রাজধানী কনস্টানটিনোপলে নেওয়ার আদেশ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গির্জাটাকে
নতুনভাবে নির্মাণেরও নির্দেশ দিলেন। কিংবদন্তি অনুসারে, সম্রাট যখন ল্যাজারাসের
দেহাবশেষ নেওয়ার আদেশ দেন তখন কিটিয়নের পাদ্রিরা দেহাবশেষের অংশবিশেষ রেখে দেয়।
মনে হয়, আরেকটি মার্বেল কফিনে তা রাখা ছিল। বেদিটি নতুনভাবে তৈরির সময় ১৯৭২ সালে কফিনটি
আবিষ্কৃত হয়।
আমার চোখে গির্জার রূপ আহামরি নয় বটে, কিন্তু
ভক্তদের কাছে অন্যরকম। সিরিয়ার ব্রিটিশ কনসাল আলেকজান্ডার ড্রুমন্ড ১৭৪৫ সালে
আলেন্দো থেকে এসেছিলেন এখানে। গির্জাটি দেখে লিখেছিলেন, ‘সেলিনাস (ইউরোপীয়দের কাছে
লারনাকা পরিচিত ছিল সেলিনাস নামে) শহরে সেইন্ট ল্যাজারাসকে উৎসর্গীকৃত একটি গির্জা
আছে। এরকম চমৎকার স্থাপত্যিক নিদর্শন আগে আমি দেখিনি।’ আরো একশ বছর আগে ইতালীয়
পর্যটক পিয়েত্রো দেল্লা ভাল্লে একই ধরনের উক্তি করেছিলেন।
গির্জার একটি দেয়াল চমৎকার কাঠের কারুকাজে ভরা।
এর মাঝে মাঝে আইকন। বলা হয়ে থাকে, সাইপ্রাসে কাঠের ওপর এমন চমৎকার কারুকাজ করা
নিদর্শন আর নেই। নিকোশিয়ার কাঠমিস্ত্রি হাজি সাভাস টালিয়াডোরোস ১৭৭৩ সালে এ-কাজ
শুরু করে শেষ করেন ১৭৮২ সালে। এরপর সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয় নকশাটি। আইকনগুলি
অাঁকা হয় সে-সময়ে।
আমরা দুজন চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখি। কিন্তু গির্জাটা
এতো ছোট যে, তারিয়ে তারিয়ে দেখলেও সময় বেশি লাগার কথা নয়। গির্জার ভেতরটা দেখে
বাইরে এসে দাঁড়াই। সূর্য খানিকটা ওপরে উঠেছে। ঝলমল করছে চারদিক। ফুটপাতে লোকের
888sport free bet বাড়ছে। গাড়ি-ঘোড়াও। বাইরে থেকে আবার গির্জাটা দেখি। তিন গম্বুজওয়ালা
গির্জা। ফামাগুস্তার কাছে এরকম গম্বুজওয়ালা আরেকটি গির্জা আছে। তুর্কিরা যখন দখল
করে লারনাকা (সাইপ্রাস), তখন যে সেনাপতি প্রথম এখানে পা রাখেন, তিনি গম্বুজ দেখে
ভেবেছিলেন, এটি বুঝি মসজিদ। পরম 888sport apk download apk latest versionভরে সেখানে তিনি নামাজ আদায় করেন। পরে
শুনলেন, এটি গির্জা। তখন তা ধ্বংসের আদেশ দেন। তবে, অনেকে বলেন, এটি গল্প। আসলে,
ভূমিকম্পে গির্জাটা ধ্বংস হয়ে যায়। ষোড়শ শতকে, ফ্রাংকদের সামনে (অনেকে বলেন তা ঠিক
নয়, ১৭৫০-এর দিকে) গির্জাটি আবার নির্মাণ করা হয়। গির্জার একদিকে তিনতলা গম্বুজ।
তিনতলায় ঘণ্টাঘর। মুসলমান আমলে কোনো চার্চে ঘণ্টা বাজানো নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু
লারনাকা ছিল কসমোপলিটান শহর। ইউরোপের নানা দেশের মানুষের নিত্য আসা-যাওয়া ছিল
এ-শহরে। অনেক দেশের দূতাবাস ছিল, ফলে লারনাকায় এ-নিয়মটা শিথিল করা হয়। অর্থাৎ
এ-গির্জার ঘণ্টার শব্দ লারনাকাবাসী শুনত।
গির্জাকে ঘিরে কিছু কক্ষ। গোটা বিশেক হবে।
সরাইখানার মতো, পর্যটকদের জন্য ছিল, যেমন 888sport appর বড় বা ছোট কাটারা। একটু ঘুরে
উত্তর-পশ্চিম চত্বরে দেখলাম কিছু সমাধি, যেমনটি আছে আমাদের 888sport appর আর্মেনি
গির্জায়।
গির্জার চত্বর থেকে বেরিয়ে আসি। হাবিব বলে,
‘স্যার, এতোদিন এখানে আছি, এতো সুন্দর জায়গাটায় আসিনি। বাইরে থেকে মানুষজন এলে তো দেখাতে
নিয়ে আসা যায়।’
আসলে, প্রবাসী সাধারণ বাঙালিদের জীবন ছকে বাঁধা।
কাজ করতে যাওয়া, ফিরে এসে আড্ডা দিয়ে শুয়ে থাকা বা রেঁধে খাওয়া। আর আমরা ধরে নিই
কেন, সবার ভালো লাগবে ঘুরে বেড়ানো বা ইতিহাস। তবে আমি অনেক জায়গায় গিয়ে পুরনো
ছাত্র বা ছাত্রতুল্য কাউকে পেলে বলেছি, পারলে অমুক জায়গাটা ঘুরে এসো। তারা গেছে
এবং বিস্মিত হয়ে পরে তা আমাকে জানিয়েছে।
ল্যাজারাসের কাহিনি এখানেই শেষ নয়। এটিকে যে
খ্রিষ্টানরা তীর্থস্থান হিসেবে মানেন তার আরো একটি কারণ আছে। কিংবদন্তি অনুসারে,
কিটিয়ন বা লারনাকায় যখন বাস করছেন ল্যাজারাস তখন তাঁর মন খারাপ ছিল কিছুদিন। তাঁর
বন্ধু যিশুর মাকে দেখেননি অনেকদিন। একটি জাহাজ পাঠালেন তিনি জেরুজালেমে, যাতে সন্ত
জন আরো কয়েকজন শিষ্যসহ মা মেরিকে নিয়ে সাইপ্রাস আসেন। কিন্তু ঝড়ের কবলে পড়ে জাহাজ
চলে যায় গ্রিসের মাউন্ট এথোসে। সেখানে তারা মূর্তিপূজকদের ধর্মান্তরিত করেন। তারপর
ফের রওনা হন লারনাকার দিকে। এখানে এসে মা মেরি দেখা করেন ল্যাজারাসের সঙ্গে। তাঁকে
দেন বিশপের একটি আঙরাখা, যা তিনি তৈরি করেছিলেন জাহাজে বসে। ল্যাজারাসের
এ-গির্জাকে আশীর্বাদ করে তিনি ফের ফিরে যান জেরুজালেমে। তখন থেকেই ল্যাজারাসকে
অর্থডক্স চার্চের কিটিয়নের বিশপ হিসেবে মান্য করা হয়।
কনস্টানটিনোপলে ল্যাজারাসের দেহাবশেষ পৌঁছলে
যে-মিছিল হয়েছিল, সম্রাটও তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মিছিল করে তা নিয়ে আসা হয় সন্ত
সোফিয়া গির্জায়। সম্রাট লিও কনস্টানটিনোপলে ল্যাজারাসের 888sport app download for androidে আরেকটি গির্জা
নির্মাণ করেছিলেন। ১২০৪ সালে, ফ্রাঙ্করা দখল করে কনস্টানটিনোপল। তখন ক্রুসেডাররা
ল্যাজারাসের দেহাবশেষ আবার নিয়ে যায় মার্সাই। তারপর এর আর খোঁজ পাওয়া যায় না।
লারনাকায় দেহাবশেষের যে সামান্য অংশ লুকিয়ে রাখা হয়েছিল তা-ই এখনো সংরক্ষিত।
সেজন্যেই গির্জাটি পবিত্র বলে বিবেচিত।
গির্জার চত্বর ছেড়ে রাস্তা পেরোলাম। উলটোদিকের
ফুটপাত ধরে এগোচ্ছি শহরের কেন্দ্রে। অপরদিকের ফুটপাতে হঠাৎ চোখে পড়ল সাইনবোর্ড
অক্সফাম। ইউরোপের অনেক শহরে আছে এরকম সাহায্য সংস্থা অক্সফামের দোকান। এসব দোকানে
পুরনো জিনিসপত্র, বই বা স্মারক বিক্রি হয়। হাবিবকে বললাম, ‘চলো ওই দোকানটা দেখি।’
হাবিব এমন সফরকারী আগে বোধহয় কখনো পায়নি।
অক্সফামের গরিব দোকানে ঢুকলাম। পুরনো কাপড়-চোপড়, পটারি, 888sport free bet login আছে যা মানুষ দান
করেছে। এগুলির বিক্রির টাকা অক্সফাম পাবে। ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি
শরণার্থীদের জন্য অক্সফাম অনেক করেছে। এ দোকানে পুরনো বইয়ের তাকও আছে একটি। অল্প
কয়েকটি বই, গ্রিক ও ইংরেজি ভাষায়। থ্রিলার খুঁজে পেলাম একটি। কয়েকদিন থাকতে হবে,
হাতের কাছে কোনো বই নেই। বইটি নিয়ে কাউন্টারে এলাম।
‘কত দিতে হবে’, জিজ্ঞেস করি।
‘পঞ্চাশ পেনি’, দাম জানাল তরুণী।
দাম আসলে এরকমই হয়। একটি আধুলি দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
হাবিবকে বললাম, ‘চলো, সাইপ্রাসে এসে একটি পুতুল কিনব না, তা কেমনে হয়?’
আমি যেখানেই যাই সেখান থেকেই স্থানীয় একটি পুতুল
আর একটি পটারি জোগাড় করি। গত তিন দশকে এভাবে আমার একটি বেশ বড়সড় সংগ্রহ দাঁড়িয়ে
গেছে। হাবিব বলে, ‘পুতুল কোথায় পাওয়া যাবে তা তো জানি না।’
‘যেখানে সুভ্যেনির কিনতে পাওয়া যায়।’
হাবিব সেটাও ঠিক ধরতে পারল না। বলে, ‘আচ্ছা চলেন,
মিউনিসিপাল মার্কেটে যাই।’
‘চলো।’
খানিকটা এগোতেই ব্যস্ত এক চৌরাস্তায় এসে পৌঁছলাম।
যে-ফুটপাতে আছি সে-ফুটপাতে একটি ক্যাফে, পাশে ঝলমলে দোকান। বুঝলাম, এটি
শহরের বিপণিকেন্দ্র। হাবিব বলে, ‘আপনি এখানে একটু দাঁড়াবেন, আমি সামনের ব্যাংক
থেকে আসি।’ বলে সে উত্তরের অপেক্ষা না করে রাস্তা পেরোনোর প্রস্ত্ততি নেয়। আমি
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ব্যস্ত ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকি। হাবিব রাস্তা পেরোয়। ফুটপাতে
দাঁড়িয়ে না থেকে আমি ক্যাফেতে ঢুকি। কয়েকজন খদ্দের। কাউন্টার থেকে এক কাপ কফি নিয়ে
বসি জানালা ঘেঁষে যাতে ফুটপাতের লোকজন, রাস্তা দেখা যায়। মানুষজনের চলাফেরা দেখি,
কফিতে চুমুক দিই আস্তে আস্তে। ছোট শহর, মানুষজনের মাঝে অতোটা টেনশন নেই। কফি শেষ
হয়, তবু হাবিবের দেখা নেই। বেরিয়ে আসি ফুটপাতে। রেলিং ধরে দাঁড়াই। আকাশ খানিকটা
মেঘলা হয়ে এসেছে। চারদিকের আলো ম্লান। এমন সময়, শহরের নানা শব্দ চিরে হঠাৎ কানে
আসে বাঁশি আর ব্যাঞ্জোর সুর। শুনে মনে হয় ফোক। লারনাকার এই মেঘলা আকাশ, চৌরাস্তায়
ভিড়, মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ার মতো ভেসে আসছে বাঁশির সুর। কেমন অপার্থিব মনে হয়।
হাবিবের দেখা মেলে ওপারে। আমাকে রাস্তা পেরোনোর ইশারা করছে। রাস্তা পেরিয়ে
উলটোদিকের ফুটপাতে দাঁড়াই। ব্যাঞ্জোর সুর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বলি, ‘হাবিব, এই সুর
শোনা যাচ্ছে কোত্থেকে?’ হাবিব ইতিউতি চাইল। বলল, ‘নিশ্চয় কোনো ক্যাসেটের দোকান
থেকে।’
ভালোভাবে তাকাতেই চোখে পড়ে সামনে একটি রেকর্ড, সিডি,
ক্যাসেটের দোকান। যতই দোকানের সামনে আসি, সুর ততই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দোকানে ঢুকি।
মধ্যবয়সী এক মহিলা বসে আছেন এক কোণে, সামনে টেবিল, পেছনের টেবিলে রেকর্ডার,
চারপাশের শেলফে, শোকেসে সিডি, ক্যাসেট, পুরনো রেকর্ড।
‘মিউজিকটা তো চমৎকার’, বলি আমি, ‘আছে নাকি এক
কপি?’
‘হ্যাঁ, চমৎকার’, হাসিমুখে জবাব দেন মহিলা,
‘কিন্তু সিডি তো নেই। আমার কাছে রেকর্ড আছে একটা, তা-ই বাজাই মাঝে মাঝে।’
‘বটে, তাহলে…’ হতাশ হওয়ার সুরে বলি।
‘কোনো সমস্যা নয়।’ বলেন মহিলা, ‘চাইলে সিডি করে
দিতে পারি।’
‘তাহলে তো চমৎকার,’ বলি আমি, ‘দেবেন নাকি রেকর্ড
করে? কত লাগবে?’
‘পাউন্ড দুয়েকের মতো।’
আমি দু-পাউন্ড বের করে তার হাতে দিই। বলি, ‘সময়
তো লাগবে, আপনি রেকর্ড করুন, ফেরার পথে নিয়ে যাবো।’
‘আমরা কাছেই, মিউনিসিপাল মার্কেটে যাচ্ছি’, যোগ
করে হাবিব।
দোকান থেকে বেরিয়ে আবার ফুটপাত ধরি। দু-একটি বাঁক
পেরিয়ে পৌঁছে যাই মিউনিসিপাল মার্কেটে। আমাদের হকার্সের মতো। তবে পরিচ্ছন্ন ও
বিশৃঙ্খল নয়। হাবিব ঠিক জায়গাই এনেছে। সারি সারি দোকান প্রশস্ত চত্বরে। চত্বরের
ওপরে অভিজাত দোকান। দোকানে বা হকার্সে মাল একই। আইকন আর নানা ধরনের ফুলদানি,
পাত্র। না, পুতুল নেই। এই আইকনের বিশেষত্ব আছে। পুরনো বাছাই কাঠের ওপর অাঁকা,
গোল্ড ডাস্টে। ফুলদানি বা পটারিগুলি দেখে মনে হবে গ্রিসে আছি। প্রায়ই আমরা ছবিতে
ধ্রুপদী গ্রিক ফুলদানি বা পত্রের যে-প্রতিলিপি দেখি, এগুলি অবিকল তাই। এমনভাবে
ধ্রুপদী কলায় সাইপ্রাস আছন্ন যে বলার মতো নয়। বেছে বেছে নিজের আর শাহরিয়ারের জন্য
দুটি আইকন কিনি। শাহরিয়ার ছাড়া 888sport appয় আর বন্ধুদের মধ্যে আইকনের প্রশংসা করবে এমন
কেউ নেই। বরং, আমাকে প্যাগানও মনে করতে পারে। দামও সাধ্যের মধ্যে। দু-একটা পটারিও
কিনি। ভেতরের দোকানগুলিও ঘুরে ঘুরে দেখি। একই জিনিস, দাম একটু বেশি। স্বাভাবিক।
তবে, উইন্ডো শপিং খারাপ লাগে না।
এদিকে দুপুর হয়ে আসছে। খিদেটা টের পাচ্ছি।
হাবিবকে বলি, ‘চলো, কোথাও খেয়ে নেওয়া যাক।’
‘তার আগে সিডিটা নিয়ে নিই।’
ভুলে গিয়েছিলাম সিডির কথা। মার্কেট থেকে বেরিয়ে ফিরে যাই সিডির দোকানে। আমাদের দেখে
একগাল হেসে মহিলা বলেন, ‘আপনার জিনিস রেডি।’
‘আপনি কি লারনাকার?’ আচমকা প্রশ্ন করি।
‘না, আপনি ঠিকই ধরেছেন,’ একগাল হেসে বলেন মহিলা,
‘আমি আয়ারল্যান্ডের। আপনি বোধহয় ইন্ডিয়ার?’
‘না, কাছাকাছি, 888sport apps।’
‘ওহ্, 888sport apps!’ দেশের নামটা হাবিবদের মতো অনেক
তরুণের কারণে পরিচিত।
‘তা কোথায় আয়ারল্যান্ড, কোথায় লারনাকা।’
‘হ্যাঁ, চলে এসেছিলাম অনেকদিন আগে স্বামীর
সঙ্গে।’
জানালেন মহিলা, ‘সেই থেকে আছি। খারাপ তো না,
ভালোই লাগছে।’
একসময় আয়ারল্যান্ডও ছিল ইউরোপের 888sport apps। অনেকেই
জীবিকার সন্ধানে দেশ ছেড়েছিলেন।
বিদায় নিয়ে বেরোতে বেরোতে ভাবি, কে কোথায়
জন্মগ্রহণ করি, আর কোথায় শেষ নিশ্বাস ফেলি। পৃথিবীর শুরু থেকে মানুষ ঘুরে ঘুরে
বেড়াচ্ছে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়, কমপক্ষে
এক-চতুর্থাংশ মানুষ। তবে, যে যেখানেই থাকুন না কেন, দেশ গরিব বা ধনী যা-ই
হোক না কেন, ফাস্ট জেনারেশনের মন সেখানেই পড়ে থাকে। আচ্ছা, আমাদের দেশে হিন্দুরা
ভারত চলে গেলে আমরা নেতিবাচকভাবে তা দেখি। মুসলমানরা দেশ ভাগ করলে নেতিবাচকভাবে
নয়, ইতিবাচকভাবে দেখি। কেন? পূর্ব ধারণা বা মাইন্ডসেট।
হাবিব অন্য এক রাস্তা দিয়ে যেখানটায় নিয়ে আসে
সেখানে
সার-সার খাবার দোকান। ভেতরে যেমন, ফুটপাতেও তেমন চেয়ার-টেবিল বিছানো। একটি
রেস্তোরাঁ বেছে বাইরে বসি।
‘কী খাবেন?’ জিজ্ঞেস করে হাবিব, ‘কালিমিরা ভালো
পাওয়া যায়।’
‘আমার জন্য মাছ নয়’, বলি আমি, ‘তুমি খেতে পারো।’
কালিমিরটা এখানে ডেলিকেসি। হাবিব গ্রিক মেন্যু
পড়ে অর্ডার দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তার ফোন বেজে ওঠে। হ্যাঁ, হু করে মনে হলো সে পথের
নির্দেশ দিচ্ছে। বললাম, ‘তোমাকে কি কোথাও যেতে হবে?’
‘না, নিকোশিয়া থেকে এক গাড়ি আসছে’, জানালো হাবিব,
‘এখান থেকে ফারুকরাও আসবে।’ নিকোশিয়ায় ওদের কিছু বন্ধু-বান্ধব থাকে। এখানেও আছে।
আজ দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। তারপর বেরিয়েছে। হাবিব বলে, ‘ওদের এখানে আসতে বলেছি।’
ওয়েটার খাবার রেখে যায়। পাঁজরের কাবাব। যাকে
ইংরেজিতে বলি আমরা ‘রিবস’। সঙ্গে শসা গাজর পেঁয়াজের সালাদ। আমি বলি, ‘এক টুকরো
পিত্তা হলে খারাপ হয় না।’ ছোট রুটি যেটা দিয়ে সোয়ার্মা বানায়।
পাঁজরের কাবাব খারাপ লাগে না। ধীরেসুস্থে খাই,
দাঁতের অবস্থা যে ক্ষয়িষ্ণু সেটাও মাথায় রাখতে হয়। বয়সের জ্বালা বড় জ্বালা।
লোকজনের হই-হট্টগোল, তার মাঝে ফুটপাত-ঘেঁষা বারান্দায় বসে হাড় চিবুনো, বেশ পাশা
পাশা মনে হয়। খানিকপর, আট-দশজন তরুণ এসে ঘিরে ধরে আমাদের। 888sport app হলে ভয় পেতাম। খুব
হাসিখুশিমুখে সম্ভাষণ জানিয়ে ওরা ঘিরে ধরে। দু-একজন চেয়ার নিয়ে বসে। বলে, ‘স্যার,
ধীরেসুস্থে খান। আমরা খেয়েদেয়েই বেরিয়েছি।’
এদের সঙ্গে গত কয়েকদিনে পরিচয় হয়েছে। পড়ার
অজুহাতে ভিসা পেয়ে এসেছে। মূল লক্ষ্য, অর্থ রোজগার। সাইপ্রাস সরকারও তা জানে।
তাদের শ্রমিক দরকার। তরুণদের অধিকাংশই শ্রমিক বা হোটেলে কাজ করে। নিকোশিয়ায় যারা
থাকে তারা বেশ বড় একটা বিল্ডিং ভাড়া নিয়েছে। একেক রুমে একজন-দুজন করে থাকে।
সাইপ্রাসে বাঙালি এখনো কম দেখে তাদের থাকা-খাওয়ায় একটা ভব্যতা আছে, যদিও রোজগার
কম। মধ্যপ্রাচ্য বা 888sport app অঞ্চলে যেখানে বাঙালি বেশি, সেখানকার অবস্থা তো আমরা
জানি।
বেশ খানিকক্ষণ হইচই করে তারা চলে গেল। নিকোশিয়ার
পার্টি সন্ধ্যায় ফিরে যাবে। লারনাকা পার্টি আগামীকাল আমাকে নিয়ে নিকোশিয়া যাবে।
‘এখানেও আওয়ামী লীগ-বিএনপি আছে, জামায়াতও’, জানায়
হাবিব, ‘জামায়াতিরা নানারকম ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করে। তবে, আমরা যতটা পারি, মিলেমিশে
থাকার চেষ্টা করি।’
‘সেটাই ভালো,’ বলি আমি, ‘বিদেশে আমরা ছাড়া বোধহয়
আর কেউ এমন পার্টিম্যান না। যেখানেই যাই, পিঠে এক টুকরো বোঝা নিয়ে যাবই। জাতীয় রোগ
বলা যেতে পারে। 888sport appsের পরিচয় না দিয়ে প্রথম পরিচিতি আওয়ামী লীগার, না হয়
বিএনপি, তারপর মুসলমান, সবশেষে বাঙালি।’
ওয়েটার বিল নিয়ে আসে। বিল দেওয়ার চেষ্টা করি।
হাবিব দারুণ অসন্তুষ্ট হয়ে বলে, ‘এটা কী করেন স্যার।’
আমি তারপর থেকে মানিব্যাগ বের করা থেকে বিরত
থাকি। সামান্য এই আনন্দ না হয় পেলোই তারা।
সূর্য এখন ঠিক মাথার ওপরে। আমি বলি, ‘চলো হাবিব,
ফিরে যাই।’
‘যাওয়ার পথে এক জায়গায় নিয়ে যাব’, জানাল হাবিব।
রেস্তোরাঁ ছেড়ে আমরা সদর রাস্তা পেরোই। তারপর
একটি বাঁক ঘিরে একটি সরু ছায়াঘন রাস্তায় পড়ি, অবিকল 888sport appর মহল্লার মতো। আমার
ছেলেবেলার ইসলামপুরের আশেক লেন বা তার পাশে জিন্দাবাহার মহল্লার কথা মনে হয়। একটু
উঁচু উঁচু ইমারত, দোতলা বা তিনতলা, পুরু দেয়াল। রাস্তায় ঠান্ডা ছায়া। কিন্তু, অবাক
হই, পথচারী আমরা দুজন। আমি হাবিবের দিকে তাকাই। নির্বিকারভাবে সে হেঁটে যাচ্ছে।
আমার অস্বস্তি লাগে। দু-একটি বাড়ির নেমপ্লেট আছে। নাম পড়ি, মুসলমান নাম সব।
হাবিবকে জিজ্ঞেস করি, ‘এই ভৌতিক অবস্থা কেন?’
‘মুসলমান পাড়া।’ নির্বিকারভাবে উত্তর দেয় হাবিব।
আর তখনই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। সাইপ্রাসে
একসময় মুসলমান খ্রিষ্টান দুই সম্প্রদায়ই পাশাপাশি বাস করেছে। সোজা বাংলায়
খ্রিষ্টান ও মুসলমান সাইপ্রাসে ভাগ হয়ে যায়। আমরা আছি খ্রিষ্টান সাইপ্রাসে, যা
গ্রিস-প্রভাবিত। মুসলমান সাইপ্রাস
তুর্কি-প্রভাবিত। যখন দেশ ভাগ হয়ে যায়, তখন 888sport app এলাকার মতো
মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকাগুলি খালি হয়ে যায়। এটি লারনাকার মুসলমান পাড়া।
বাস্ত্তত্যাগীদের পাড়া। শীতল, শূন্য বাড়িগুলি পড়ে আছে শুধু। কয়েকদিন পর সাইপ্রাসের
রাজধানী নিকোশিয়ায় যাই। সেখানেও এরকম একটি পাড়া দেখি, নিস্তব্ধ।
রাস্তাটি জনৈক হাজির নামে। নামফলকও ঠিক আছে।
কিন্তু রাস্তাটি একেবারে সুনসান। ছায়াঘন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আমার মনে হয়,
১৯৪৭ সালের কথা। যদিও আমার জন্ম হয়নি তখন। নিজের ভিটে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট সন্তান
হারানোর মতো কষ্ট। আমাদের এখানে ভিটে ছেড়ে যাওয়ার সময় অনেকে নামমাত্র দামে তা
বিক্রি করে দিয়েছেন, অনেকে সে-সময়ও পাননি। অনেক ভিটে দখল করে নেওয়া হয়েছে। এখানে
বাড়িগুলি দেখে কিন্তু মনে হলো না এগুলি দখল হয়ে গেছে। স্রেফ পড়ে আছে বা মানুষজন
আছে, জানি না কারণ, কোনো বাড়ির জানালা খোলা দেখলাম না। হাবিবকে জিজ্ঞেস করে
সদুত্তর পেলাম না। তারা হয়তো এই রাস্তা দিয়ে নিত্য যাওয়া-আসা করে; কিন্তু মাথায়
ঘোরে চাকরি আর রোজগার। আর বাঙালিদের দেখেছি, যে-দেশে থাকেন সে-দেশের ইতিহাস জানার
চেষ্টা করেন না, জীবনচর্যা বোঝার চেষ্টা করেন না। যে-শহরে থাকেন সে-শহরের সঙ্গে তার
কোনো বন্ধন সৃষ্টি হয় না। হাবিব বরং একটি কাহিনি শোনায় আমাকে।
এই মহল্লার প্রায় শেষের দিকে একটি বড় বাড়ি দেখিয়ে
বলে, ‘এখানে এক মহিলা বসবাস করতেন, মুসলমান অবশ্যই। আধা পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। ঘর
ছেড়ে বেরোতেন না।’ গল্প এটুকুই। কিন্তু, আমার মনে হয়, সুন্দর এক পরিবারের কন্যা
ছিলেন তিনি। রাজপুত্রের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। দেশ বিভাগের সময় দাঙ্গায় তার বাবা-মা
খুন হন। হয়তো লাঞ্ছিতও হয়েছিলেন তিনি। একসময় উন্মত্ততা সব শান্ত হয়। কন্যা তার
ভিটেতে রয়ে যান, যাবেন কোথায়? কেউ যে নেই তার। 888sport sign up bonus নিয়ে থাকেন একা। যে-লারনাকায় এখন তিনি থাকেন
সে-লারনাকা তার অচেনা। সংসারের প্রয়োজনে হয়তো প্রতিদিন বেরোতে হয়। মহল্লার চেনা
পথে হাঁটতেও তার ভয় করে। কেউ নেই। বন্ধু-বান্ধবও। একা একা নিদ্রাহীন রাত। আমি আর
ভাবতে পারি না।
ছায়াচ্ছন্ন পথটি পেরিয়ে এলাম। হঠাৎ, আলোর ঝলকানি,
একটু খোলামেলা জায়গা। বাড়িঘর, না, স্থাপত্যের কোনো সৌন্দর্য নেই। এরকম একটি বাড়ির
সামনে ডাকটিকিটের মতো খোলা চত্বর পেরিয়ে দরজার বেল টেপে হাবিব। মিনিট খানেক পর
দরজা খোলেন হাসিমুখে এক প্রৌঢ়। অ্যাপ্রোন পরা। ঢুকি ভেতরে। লম্বা মতন একটি ঘর।
মাঝখানে লম্বা টেবিল। টেবিলের ওপর নানা ধরনের পটারি। টেবিলের এক প্রান্তে
কাউন্টার। ভদ্রলোক পটারি তৈরি করেন। সুভ্যেনির হিসেবে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করেন।
হাসিখুশি 888sport live chatী মানুষ। আমি ঘুরে ঘুরে দেখি। মিউনিসিপাল মার্কেটে যেরকম দেখেছি
সেরকমই। সহৃদয় 888sport live chatীর স্টুডিও আর বিক্রয়কেন্দ্র। স্পেশাল ভেবেই হাবিব আমাকে এনেছে।
দু-একটি পটারি কিনলাম। খুশি হলেন 888sport live chatী। সযতনে প্যাকেট করে দিলেন। কয়েকটি লাইটার
তুলে দিলেন হাতে উপহার হিসেবে।
888sport live chatীর স্টুডিও থেকে বেরিয়ে মিনিট পাঁচেক চলার
পর আবার পৌঁছলাম সদর রাস্তায়। আরেকটু হাঁটলেই গ্র্যান্ড পা’স হোটেল।
‘বিকেলে বেরোবেন নাকি স্যার?’ জিজ্ঞেস করে হাবিব।
‘না’, বলি আমি। ‘তাদেরও কাজ থাকতে পারে, বরং
আগামীকাল তো ছুটির দিন, পারলে লারনাকার আশেপাশে একটু যেতে চাই।’
তিন
ইউরোপে রোববারে সকাল ১০টার আগে হয় না। আমার সকাল
সবসময়ই খুব সকালে হয়। এখানেও রোববারে তাই হলো। উঠে কিছুক্ষণ ভূমধ্যসাগরের ঢেউ
গুনলাম। তারপর জোরবাস ক্যাফে। ফিরে সাগরের তীরের সেই কাঠের জেটিতে বই হাতে বসলাম।
কয়েক লাইন পড়ি, সমুদ্রের ঢেউ দেখি, দেখতে দেখতে চোখ বুজে আসে। এটাকেই বোধহয় বলে
অবকাশযাপন।
হাবিবরা এলো এগারোটার পরে। ফারুক তার গাড়িটি নিয়ে
এসেছে। তারা বন্ধু-বান্ধব চারজন। আমি মিলে পাঁচজন। সহাস্যে সবাই বলল, ‘চলেন।’
‘তোমরাই বলো কোথায় যাওয়া যায়’, জিজ্ঞেস করি আমি।
‘আমরা তো আশেপাশে তেমন ঘোরার সময় পাই না। আপনি তো
পড়াশোনা করেন, জানেন।’
মহাপন্ডিত ঠাউরেছে তারা আমাকে। সাইপ্রাস সম্পর্কে
বিদ্যা তো 888sport slot gameবার্তা বা ট্র্যাভেল ব্রোশিয়র পড়ে। বললাম, ‘চলো, লেফকারা।’
‘লেফকারা?’ প্রথমে খানিকটা বিস্মিত হলো তারা।
হাবিব বলল, ‘নামটা চেনা চেনা লাগছে। আচ্ছা দেখি।’ মোবাইল ফোনে দু-এক জায়গায় ফোন
করল। তারপর বলল, ‘চিনেছি, কাছেই। নিকোশিয়া লেমোসেস রোডে। এখান থেকে চল্লিশ
কিলোমিটার হবে। খুব বেশি হলে ঘণ্টাখানেকের পথ।’
‘তাহলে তো যাওয়া যায় কী বলো?’ প্রশ্ন করি আমি।
‘সারাদিনই আমরা আছি আপনার সঙ্গে’, জানায় ফারুক।
‘এই চান্সে আমরাও নতুন কিছু দেখে নেব।’
লেমোসেসের পথে রওনা হই। হালা সুলতান পেরিয়ে
কফিনুরের পথ ধরি।
লেফকারা আসলে ছোট একটি গ্রাম। লেসের জন্য
বিখ্যাত। ধর্ম সংশ্লিষ্ট কাপড় বোনার মূল কেন্দ্র ছিল বাইজানটাইন আমলে
কনস্টানটিনোপল। ধর্ম সংশ্লিষ্ট বলতে বোঝাচ্ছি গির্জার বেদি এবং 888sport app ধর্ম
সংশ্লিষ্ট বস্ত্ততে কাপড়ের ব্যবহার। ক্রুসেডের পর সাইপ্রাস হয়ে ওঠে এর কেন্দ্র।
ভেনিস ১৪৮৯ সালে সাইপ্রাস দখল করে। ধনাঢ্য
ভেনেসীয়রা লেফকারায় অবকাশযাপন করতে আসতেন। পাহাড়ি এক ছোট গ্রাম লেফকারা।
ভেনেসীয়দের কাপড়-চোপড়, সেলাই, নকশা প্রভৃতির সঙ্গে এভাবে পরিচিত হন লেফকারার
মহিলারা। ভেনিসের এক ধরনের সূচিকর্ম খুব বিখ্যাত ছিল। লেফকারার মহিলারা ইতালীয়দের
রুচি অনুযায়ী পোশাক তৈরিতে বিখ্যাত হয়ে ওঠে, বিশেষ করে ‘তাইদাহ’ রীতিতে। বিশেষ
ধরনের সূচিকর্মের তাইদাহ। এখন এই ধরনের লেসের নাম লেফকারি টিকা। রুপোর তৈরি
জিনিসপত্রের জন্যও লেফকারা পরিচিত।
হাবিব আর তার বন্ধুরা অনবরত কথা বলে চলছে। দেশের
রাজনীতি নিয়েই কথা চালাচালি হচ্ছে। সমতল পেরিয়ে আমরা পাহাড়ি রাস্তায় উঠছি। মাঝে
মাঝে নিচে নামলে রুক্ষ সমতল। আশেপাশে তেমন বসতি নেই। হঠাৎ হঠাৎ গ্রাম চোখে পড়ে,
একেবারে ছোট গ্রাম। পাহাড়গুলি রুক্ষ সবুজ।
‘লেফকারা কেন বিখ্যাত?’ জিজ্ঞেস করে হাবিব।
‘তার আগে শোনো নামের ইতিহাস’, বলি আমি, ‘সিলিকা
আর চুনাপাথরের সাদা থেকে এ-নামের উদ্ভব। গ্রিক লেফকা মানে সাদা আর অড়ি মানে পর্বত।
টুদো পর্বতের এই নাম তাই লেফকারা। এখন তা লেসের জন্য বিখ্যাত।’
কিংবদন্তি অনুসারে ১৭৮১ সালে ইতালীয় 888sport live chatী
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এই গ্রামে এসেছিলেন বেড়াতে। মিলানের গির্জার মূল বেদির জন্য
লেসের কাপড় কিনেছিলেন এখান থেকে। ওই নকশা এখন পরিচিত লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি নকশা
নামে। আগে মহিলারা এই নকশাদার কাপড় নির্মাণ করতেন আর পুরুষরা গ্রিস ও 888sport app
দেশে ঘুরে ঘুরে তা বিক্রি করতেন। ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ যখন ১৯৫৩ সালে
সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন লেফকারার মহিলারা লিওনার্দোর সেই নকশার কাপড় তৈরি করেন,
যা উপহার দেওয়া হয় রানীকে।
লেফকারার কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। চারদিকেই পাহাড়।
হাবিব ম্যাপ দেখে বলল, ‘আরেকটু এগিয়ে ডানে এগোলে লেফকারা গ্রাম। ভেতরে যাবেন নাকি
স্যার?’
আমি তো আর লেস কিনব না। গ্রামের ভেতর যেতে হলে
আরো খানিকটা পথ উজোতে হবে। সূর্য ওপরে উঠে যাচ্ছে। আমার সঙ্গীদেরও মনে হলো এতে
তাদের তেমন উৎসাহ নেই। বললাম, ‘ঠিক আছে ভেতরে যাবো না। সামনে ছোটখাটো কিছু বাড়ি
দেখা যাচ্ছে। ওইটুকু পর্যন্ত চলো।’
এক কিলোমিটার এগিয়ে হাতের বাঁ-পাশে পড়লো ছোট এক
স্থাপনা। লেফকারা গ্রামে ঢোকার মুখে ছোট মার্কেটের মতো। পাঁচ-ছটি দোকান, লেস ও
888sport app নকশাদার কাপড় বিক্রির জন্য।
গাড়ি পার্ক করে আমি ঘুরে ঘুরে দোকানগুলি দেখি।
ট্যুরিস্টদের জন্যই ছোট এই মার্কেট। দোকান চালাচ্ছেন সব মহিলা। বিভিন্ন রকমের লেস
সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আমার চোখে অবশ্য এর তারতম্য চোখে পড়ে না। সূক্ষ্ম কাজ করা ছোট
ছোট টেবিল ঢাকনা, রুমালও। দরদাম করি। দাম যে খুব একটা কম তা নয়। কোনো কিছুই কিনি
না। তবে, মহিলাদের উৎসাহের কমতি নেই। হাসিমুখে বিভিন্ন রকমের লেস বের করে দেখান।
ঘণ্টা আধেক পর হাবিব বলে, ‘চলেন স্যার, দুপুর হয়ে গেল।’
বারান্দায় এসে দাঁড়াই। চারদিকে উঁচু পর্বতমালা।
রোদ ছড়িয়ে পড়েছে। কোথাও ছায়াঘন পাহাড়ের কোল, কোথাও আলোর ঝিলিক। বাতাস বিশুদ্ধ।
শুধু মনে হয় লিওনার্দো কী মনে করে কীভাবে পাঁচশো বছর আগে এই দুর্গম এলাকায়
এসেছিলেন?
ফিরে চলি। ফারুক, বলে, ‘নিচে নেমে কোথাও খেয়ে
নেব।’ এবার আমার সঙ্গীরা খুবই উৎফুল্ল। একই রাস্তা, একই নিসর্গ। এখন বিপরীত দিক
থেকে দু-একটা গাড়ি আসতে দেখা যাচ্ছে। খানিকটা সমতলে নেমেছি। হঠাৎ দেখি বিপরীত দিক
থেকে একটি গাড়ি আসছে। ভেতরে সব ছেলে-ছোকরা। চালক কী যেন ইশারা করছে। ফারুকও হাত
নাড়ল, তারপর আমাকে বলল, ‘স্যার বেল্ট বাঁধেন, সামনে পুলিশ।’
নিজের দেশে গাড়িতে বেল্ট বাঁধার বাধ্যবাধকতা নেই।
বিদেশে বাধ্যবাধকতা। একবার অস্ট্রিয়ার এক ছোট শহরে গেছি নজরুলের সঙ্গে। পিছেই
বসেছি। পুলিশ গাড়ি থামালো। নজরুলের সঙ্গে জার্মান ভাষায় কথাবার্তা চালাচালি হলো।
ট্রাফিক পুলিশ চলে যাওয়ার ইঙ্গিত করলে নজরুল জানাল, ‘আপনি বেল্ট বাঁধেননি তাই
থামিয়েছিল। বললাম, আপনি বিদেশি।’ আমি বললাম, ‘আমি তো জানতাম, পেছনে বসলে বেল্ট
বাঁধার বাধ্যবাধকতা নেই, তাই তো পেছনে বসলাম।’ নজরুল বলল, ‘না, এখানে নাকি পেছনে
বসলেও বেল্ট বাঁধার নিয়ম।’
ফারুক জানাল, ইঙ্গিতে ছেলেটি জানিয়েছে, সামনে
পুলিশ আছে। আমার বেল্ট বাঁধা নেই। পুলিশ ধরতে পারে। রাস্তায় চালকদের এই সহমর্মিতায়
সত্যিই অভিভূত হলাম। বেল্ট বেঁধে নিলাম।
এবার সমতলে নেমে এসেছি। খানিকটা দূরে পাহাড়ের
সারি তখনো ঘিরে আছে আমাদের। রাস্তার আশেপাশে দু’একটা দোকান, ঘরবাড়ি চোখে পড়ছে।
একটা ছন্নছাড়াভাব। হঠাৎ দেখি, কালো পোশাক পরা মানুষের জটলা। চলতে চলতেই দেখতে পাই,
দু-একজন পুরুষ, মহিলা হেঁটে আসছেন। সবার পরনে অর্থডক্স খ্রিষ্টানদের বিশেষ কালো
পোশাক। আরেকটু এগোতেই একই ধরনের পোশাক পরা মহিলা-পুরুষদের জটলা। আরেকটু এগোতেই
চোখে পড়ল ছোট এক গির্জা। রোববারের প্রার্থনায় বোধহয় সবাই সমবেত হয়েছেন। আশেপাশে
তেমন কোনো বসতি চোখে পড়েনি। দুপাশে রুক্ষ সমতল ভূমি। আর দুপুরের প্রখর আলোয়
আপাদমস্তক কালো পোশাক আর টুপি পরিহিত মানুষজন – পুরো দৃশ্যটাই কেমন
স্যুররিয়ালিস্টিক।
গাড়ি আরো এগিয়ে যায়। হাবিব-ফারুকরা পরামর্শ করে
কোথায় খাওয়া যায় তা নিয়ে। অনেক আলোচনার পর তারা ঠিক করে সামনে এক বিনোদন এলাকা
আছে। সেখানে ধীরেসুস্থে খেয়েদেয়ে আরেকটি দ্রষ্টব্য দেখাতে নিয়ে যাবে। এর নাম
শুনেছে তারা, কিন্তু যায়নি কখনো।
‘দ্রষ্টব্যটা কী?’ জানতে চাই আমি।
‘আরেকটি গির্জা। ফেরার পথেই পড়বে।’
চার
দুপুর মানে কী, বলা যেতে পারে গনগনে দুপুরে এসে
পৌঁছলাম খাবার জায়গায়। লেমোসেসের হাইওয়ে ছেড়ে গ্রামের রাস্তায় নেমে এসেছি। দুপাশে
জলপাইয়ের ক্ষেত। রাস্তা আর ক্ষেতের মাঝ বরাবর যে-ঢাল তাতে ফুটে আছে অজস্র ডেইজি।
জলপাই ক্ষেত বাদ দিলে মাঝে মাঝে অচষা ক্ষেত। পিঙ্গল বর্ণের মাটি। জনবসতির দেখা
পেলাম না। বসতি কি অনেক দূর? ক্ষেত আর বসতির দূরত্বও তো কম নয়। তবে, অধিকাংশ
যেহেতু জলপাইয়ের ক্ষেত, স্থায়ী। ফলে, বসতি দূরে হলেও অসুবিধে নেই। মাঝে মাঝে
খবরদারি আর পরিচর্যা করা ছাড়া।
বারান্দার ছায়ায় হাত-পা ছড়িয়ে বসি। হাবিবরা
দলবেঁধে যায় খাবার আনতে। আমি হাবিবের কাছ থেকে ম্যাপটা চেয়ে নিই। ছোট একটি
ব্রোশিয়র, লারনাকার দ্রষ্টব্য সম্পর্কে। সঙ্গে ছোট একটি মানচিত্র।
উলটেপালটে দেখে বোঝার চেষ্টা করি কোন দ্রষ্টব্যের
কথা তারা বলছে। যে-পথে এসেছি সে-পথেই যেতে হবে। খানিকটা গিয়ে ডানদিকে বাঁক। আরো
প্রায় নয় কিলোমিটার যাওয়ার পর উঁচু এক পর্বত, তার চূড়ায় আছে এক মঠ, নাম স্টাভরভুনি
মঠ। দ্রষ্টব্য সেই মঠ।
হাবিব আর ফারুক খাবার নিয়ে আসছে। ফাস্ট ফুড যা হয়
আর কী! মাংসের পুর দেওয়া রুটি আর সালাদ আর আলু ভাজা। খাবার সামনে নিয়ে বোঝা গেল
আমাদের খিদে পেয়েছিল যথেষ্ট। আসলে লারনাকা ছাড়ার পর আমরা কোথাও কফি খেতেও বসিনি।
সবাই খুব আগ্রহের সঙ্গেই খেল। সালাদের একটু কণাও পড়ে রইল না। খাবার শেষ হলে বললাম,
‘খানিকটা পরে বেরোই, এই ধরো তিনটের দিকে। এতো রোদে আর ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগবে না।’
কোনো আপত্তি নেই তাদের। তারা বেরিয়ে গেল এদিক-সেদিক ঘুরতে। আমি রেস্তোরাঁ থেকে
বেরিয়ে সামনের বাগানের দিকে এগোলাম। বাগানে বসার জায়গা নেই। বাগান উজিয়ে সরু
রাস্তা। পাশে বৃক্ষ। এরকম এক বৃক্ষের নিচে পেতে রাখা বেঞ্চে বসলাম। সাধারণ বিনোদন
কেন্দ্র যেমন হয় এটি তেমন। শিশুদের জন্য আছে কিছু খেলার ব্যবস্থা। বাবা-মায়েরা
ছেলে নিয়ে সেখানে ব্যস্ত। একটু যাদের বয়স হয়েছে, শিশু নয় যারা, দলবেঁধে
এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লাঞ্চ টাইম যেহেতু, রেস্তোরাঁর দিকেও যাচ্ছে অনেকে।
আবহাওয়া আমাদের দেশের বসন্তের শেষ দিনগুলির মতো। গরম আছে তবে তা সহনীয়। মাঝে মাঝে
বাতাস মৃদু পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। একটা ভোমরার গুনগুন শব্দ। একটা নিঃসঙ্গ পাখি ডেকে
উঠল কোথায় যেন। চোখ বুজে আসে অবসাদে।
তিনটের দিকে ফের আমরা রওনা হই লারনাকার পথে।
কিছুটা এগোতেই হাতের ডানে সরু রাস্তা। রাস্তার দুপাশে সমতল ভূমি। আরেকটু এগোতেই
স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যহীন একসারি ইমারত। খুব সম্ভব মঠে যারা থাকেন বা সংশ্লিষ্ট,
তাদের থাকার জায়গা। বাড়িগুলি পেরোলেই পাহাড়ে ওঠার পথ।
ট্রুডো পর্বতমালার একদম শিখরে এই মঠ। গাড়ি পাহাড়ি
পথ বেয়ে উঠতে থাকে। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে কালো আলখাল্লা পরা পুরোহিত উঠছেন বা
নামছেন।
গ্রিক স্ট্রাভরসের অর্থ ক্রুশ, ভুনো মানে পর্বত।
তাই এই মঠের অন্য নাম ক্রুশের পর্বত। গ্রিক আমলে এখানে দেবতা অলম্পাসের নামে একটি
মন্দির ছিল। বাইজেনটাইন সম্রাট প্রথম কনস্টানটাইনের মা সেন্ট হেলেনা একবার
গিয়েছিলেন জেরুজালেম। যিশু এবং দুই চোরকে যে-ক্রুশকাঠে বিদ্ধ করা হয়েছিল তার
সন্ধান তিনি সেখানে পেয়েছিলেন। সেগুলি তিনি কনস্টানটিনোপলে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন।
জাহাজে করে ক্রুশ তিনটি নিয়ে রওনা হয়েছিলেন। পথে ঝড়ে পড়ে জাহাজ আশ্রয় নিয়েছিল
সাইপ্রাসে।
স্ট্রাভরোনি তখন পরিণত হয়েছে গ্রিক অর্থডক্সদের
মঠে। সেন্ট হেলেনা একটি ক্রুশ দান করেছিলেন ওই মঠে। সেই থেকে অর্থাৎ চতুর্থ শতক
থেকে মন্দিরটি গ্রিক অর্থডক্সদের পবিত্র তীর্থভূমি। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত
কয়েকবার এই মঠটি আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। পরিত্যক্ত হয়েছে কিন্তু ফের
ফিনিক্স পাখির মতো গা-ঝাড়া দিয়ে
উঠেছে। আরবরা ১৪২৬ এবং তুর্কিরা ১৫৭০ সালে মঠটি ধ্বংস করে দেয়। বর্তমান মঠটি
নির্মিত হয়েছে উনিশ শতকে।
উঠছি তো উঠছি। সরু রাস্তা। নিচে তাকালে গা ছমছম
করে। দুর্গ প্রাচীর চোখে পড়ল। মঠটি চারদিকে উঁচু পাথুরে প্রাচীরে ঘেরা। পৌঁছে
গেলাম মূল ফটকে। গাড়ি ঢোকার কোনো বাধা নেই। সামনে ছোট চত্বর, সেখানে গাড়ি পার্ক
করল ফারুক।
চত্বরের চারদিকে ছড়ানো ধ্বংসপ্রাপ্ত কিছু বেদি।
খুব সম্ভব গ্রিক আমলে যখন মন্দির হিসেবে খ্যাতি ছিল তখনকার নিদর্শন। সামনে নতুন
মন্দির। স্থাপত্যে কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। ভেতরে উজ্জ্বল বাতি, রঙিন কাগজ, ফুল কাপড়ে
সাজানো। দু-একজন পুরোহিত কালো পোশাক পরে গম্ভীর মুখে ঘোরাফেরা করছেন। দেখার তেমন
কিছুই নেই। কিছু আইকন আছে ছড়ানো-ছিটানো। জানি না আর কোনো মুসলমান ওই গির্জায়
এসেছিলেন কিনা। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে এক তরুণ পুরোহিতের সঙ্গে আলাপ হয়। 888sport apps
থেকে এসেছি শুনে বিস্মিত হন, পুলকিতও। 888sport appsের নাম তিনি শোনেননি কিন্তু এতোদূর
দেশের কেউ এই গির্জা দেখতে এসেছেন তাতে নিশ্চয় দৈবের কোনো ইশারা আছে। এই ভেবে তিনি
আনন্দিত।
গির্জা থেকে বেরিয়ে চত্বরে নামি। চারদিক রেলিংয়ে
ঘেরা। রেলিং ধরে তাকাই দিগন্তে। চারপাশে পাহাড়ের সারি। দূরে অনেক দূরে দেখা যায়
সমতলে লারনাকার ঘরবাড়ি। সদর রাস্তা ধরে গেলে লারনাকা পঁচিশ কিলোমিটার। পাখির
রাস্তায় অনেক কম। না হলে ছোট ছোট ঘরবাড়ি দেখা যেত না। আছি আমরা আটশো মিটার ওপরে।
সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ছে। শীতল মৃদু হাওয়া। শুধু মনে হয়, মুনি-ঋষিরা কেন পর্বতচূড়া
বেছে নেন ধ্যানের জন্য। মক্কায় দেখেছি, হজরত মুহাম্মদ (দ.) হেরা পর্বত বেছে
নিয়েছিলেন। সুউচ্চ পাথুরে পাহাড়। চীনে তাও মন্দির দেখেছি, তাও পর্বতশীর্ষে।
হিমালয়ের কাছাকাছি দেখেছি সাধুরা বেছে নিছেন উঁচু পর্বতচূড়া। এখানেও তাই। হয়তো
মহাপুরুষদের মনে হয়েছে, সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পাওয়া যাবে উঁচুতে উঠলে, যেখানে
কোনো কোলাহন নেই, কিন্তু অনুভব করা যাবে প্রকৃতির মাঝে সৃষ্টিকর্তাকে।
এবার লারনাকায় ফেরা। পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে নামার
সময় বোঝা গেল কতটা ওপরে উঠেছিলাম। পাহাড়ের পাদদেশে দেখি দুই পুরোহিত যাচ্ছেন সেই
ঘরগুলির দিকে। একজনের হাতে আইকন, আরেকজনের হাতে রংতুলি। অবসর সময়ে বোধহয় তারা আইকন
গড়েন। পরে তীর্থযাত্রীরা তা কিনে নেয়।
সদর রাস্তা ধরে এগোই। সূর্য হেলে পড়ছে। হাবিবরা
আলোচনা করছে মঠ নিয়ে। আমি বলি, ‘ফেরার আগে হালা সুলতান দেখে যাই না কেন? সেটিও তো
তীর্থস্থান।’
‘কোনো অসুবিধা নেই, সেটি তো লারনাকার ভেতরেই’,
জানায় ফারুক।
লারনাকা ঢোকার মুখেই গাড়ি থামালো দুজন পুলিশ।
একপাশে পার্ক করতে বলল। আমরা সবাই শঙ্কিত। সঙ্গে পাসপোর্ট নেই। পেছনের তিনজনও চুপ।
আমি বসে সামনে। গম্ভীর মুখে গাড়ির দিকে এগিয়ে এলো দুজন। ফারুক বলল, ‘আমিই কথা
বলছি। আপনারা কিছু বলবেন না।’
‘কাগজ’, গাড়ির কাগজপত্র চাইল একজন। গ্লোভ
কম্পার্টমেট থেকে কাগজপত্র বের করে পুলিশের হাতে দিলো ফারুক। আজকাল, শুনেছি, পুলিশ
প্রায়ই তরুণদের দেখলে কাগজপত্র দেখতে চায়। কাগজপত্র না থাকলে কোর্টে চালান। এর
একটাই উদ্দেশ্য অবৈধ অভিবাসীদের চাপে রাখা। কাগজপত্র দেখে ফেরত দিয়ে ফারুকের
আইডেনটিটি কার্ড দেখতে চাইল। ফারুক সেটাও বের করে দিলো। সেটিও ভালোভাবে নিরীক্ষণ
করে আমার দিকে তাকাল। আমার সাদা গোঁফ তাদের বোধহয় আশ্বস্ত করল। এই বৃদ্ধ তো
সাইপ্রাসে থাকতে আসেনি নিশ্চয়ই। দেশের ছেলেপিলেদের নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে। কার্ড
ফেরত দিয়ে ফারুককে আগে বাড়ার নির্দেশ দিলো। মুহূর্তে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এগোলো
ফারুক। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। পেছনের দুজনের কাগজপত্র নেই বা খামতি আছে। কিছুটা
এগোতেই আবার সবাই উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা শুরু করল। হাবিব বলল, ‘তাড়াতাড়ি চলো, হালা
সুলতান তাকেসিতো না হলে আর দেখা যাবে না।’ মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমরা পৌঁছলাম হালা
সুলতানের সামনে। গাড়ি পার্ক করে ঢুকলাম আমরা।
প্রথমেই ছোট এক গম্বুজওয়ালা মসজিদ। সামনে কয়েকটি
কবর। প্রথমে হালা সুলতান সম্পর্কে বলে নিই। হালা সুলতান তুর্কি শব্দ। হজরত
মুহাম্মদ (দঃ)-এর ধাত্রী ছিলেন উম্মে হারাম (অনেকের মতে ফুপু, তিনিই হালা সুলতান
নামে পরিচিত)। উম্মে হারাম ছিলেন উবায়দা বিন আল সামিতের স্ত্রী। ৬৪৭-৪৯
খ্রিষ্টাব্দে উম্মাইদ আমলে খলিফা মুবাইয়া সাইপ্রাস অভিযানে পাঠান। উবায়দা সেই
বাহিনীর সঙ্গে ছিলেন। তাঁর স্ত্রীও ছিলেন সঙ্গে। যে-জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি এখানেই
তিনি খচ্চরের পিঠ থেকে পড়ে মারা যান। তাকে এখানেই দাফন করা হয়। ওই সময় তা ‘বুড়ির
কবর’ নামেই পরিচিত ছিল।
অনেকের মতে, অষ্টাদশ শতকে সাইপ্রাসে আসেন এক
দরবেশ, নাম শেখ হাসান। তিনি সাইপ্রাসে ঘুরে ঘুরে ধর্ম প্রচার করতেন। উম্মে হারামের
কথা তিনিই আবার তুলে ধরেন। তখনকার শাসকদের তিনি বোঝাতে সমর্থ হন যে, স্থানটি
পবিত্র। তারা দরবেশ হাসানকে ১৭৬০ সালে দরগা বানানোর অনুমতি দেন। সেই থেকে এই
স্থানটি খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের কাছে তীর্থের মর্যাদা লাভ করে। মক্কা-মদিনা ও
আল-আকসার পর এটিই মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ। ১৮১৩ সালে, ছোট এই মসজিদটি
নির্মাণ করা হয়।
কবর জিয়ারত করে এগোই। চারপাশে বাগান। তুর্কি
আমলে, মসজিদের সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে গোলাপ বাগানও গড়ে তোলা হয়েছিল। এখন সেসব নেই।
মসজিদের একপাশে দেখলাম, একটি মাটির ঘর কাচ দিয়ে ঘেরা। এটি কি সেই আমলের কোনো ঘর,
নাকি দরবেশ হাসান সেখানে থাকতেন, জানি না। কিন্তু সযতনে তা সংরক্ষণ করা হয়েছে।
হালা সুলতান টেকে সাইপ্রাসের প্রত্নসম্পদ হিসেবে বিবেচিত।
সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। চারদিক নমিত হয়ে আসছে।
গাড়িতে ওঠার পর হাবিব বলল, ‘চলেন সল্ট লেক ঘুরে যাই।’
এই লবণ হ্রদ বা সল্ট লেকও লারনাকার অন্যতম
দ্রষ্টব্য। হালা সুলতান এই হ্রদের পাশেই। একটু ঘুরেই হ্রদের পাশে পৌঁছলাম। এখান
থেকে সোজা রাস্তা চলে গেছে হোটেল গ্র্যান্ড পা’সে।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.