কথাটা নতুন নয়। সকলেই জানেন।
তবু এই মরণোত্তর রচনার ভিত গড়ার খাতিরে এ-কথা আরেকবার বলা থাকুক যে বাংলায় আত্মজীবনী লেখার চল বেশিদিনের নয়। সাহেবি আমলেই এতে আমাদের হাতেখড়ি। খ্রিষ্টীয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি। পাকা হাতের দু-চারটে লেখা বেরোতে না বেরোতেই ভিক্টোরিয়ান মর্যালিটি আর ব্রাহ্ম ন্যায়নীতিবোধ তাকে এমনভাবে পেড়ে ফেলেছিল যে হাত খুলে লেখার রেওয়াজ কোনোদিনই গড়ে ওঠেনি। একাদিক্রমে এই জোড়া ধাক্কা যদিও বা সামলানো গেল, বঙ্গভঙ্গ সামলানো গেল না। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে বাংলাতে আত্মকথা লেখার গাঙে জোয়ার এসেছে। রয়েসয়ে। সেই জোয়ারে ডিঙি পানসি এমনকি বজরাও ভাসিয়েছেন অনেকে। প্রাক-১৯৪৭ পর্বের বেঙ্গল প্রভিন্স যাঁদের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ারে আছে, যাঁদের বেড়ে ওঠার মধ্যে পুবে-পশ্চিমে-উত্তরে-দক্ষিণে আনাগোনার অসংখ্য সুলুকসন্ধান আছে, তাঁদের কাছ থেকে মূলত দু-রকমের আত্মজীবনী পেয়েছি। বঙ্গভঙ্গকে যাঁরা কালান্তরের সূচক ধরলেন, তাঁদের লেখালেখিতে অবধারিতভাবে দেখা দিলো রকমারি বিভক্তিচিহ্ন। রাজনৈতিকভাবে খণ্ডিত যে-দেশে বসে তাঁরা লিখলেন সে-দেশের নিক্তি ওজনে নিজেকে যাচাই করার তাগিদটাই তাঁদের বেলায় প্রবল হয়ে উঠল। এর দরুন বাঙালি সংস্কৃতিকেও তাঁরা টুকরো-টাকরার হিসেবে দেখলেন। সেভাবেই লিখলেন। তাঁরাই দলে ভারী। এর বাইরেও পথ কেটেছেন কেউ কেউ। তাঁদের চৈতন্যে ১৯৪৭ রেখাপাত করেছে। সংবেদনশীল মানুষকে যেভাবে করে সেভাবেই। কিন্তু লিখতে বসে কোনো এক তরফে ঝোল টেনে চলেননি। যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে তাঁদের হয় পুব থেকে পশ্চিমে যেতে হয়েছে, নয় পশ্চিম থেকে পুবে। চলাচলের ওই রক্তক্ষয় তাঁরা এড়াতে পারেননি। এড়ানো যায় না। কিন্তু স্বীয় অস্তিত্বকে তাঁরা খণ্ডীভূত করেননি। মগজের মধ্যে দেওয়াল তুলে দেননি।
এভাবেই আমাদের হাতে এসেছে প্রতিভা বসুর জীবনের জলছবি, পরিতোষ সেনের জিন্দাবাহার, তপন রায়চৌধুরীর বাঙালনামা, অশোক মিত্রের আপিলা চাপিলা, মণীন্দ্র গুপ্তের অক্ষয় মালবেরি, পবিত্র সরকারের অল্প পুঁজির জীবন, সুনন্দা সিকদারের দয়াময়ীর কথার মতো বই। এ-সবই পশ্চিমবাহিনী স্রোত।
পূর্ববাহিনী স্রোতের মধ্যে হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি আমাদের সজল করেছে। বর্ধমানের পাড়াগাঁয়ের জীবন কীভাবে দেশভাগের ঘূর্ণিপাকে টালমাটাল হলো তার জলজ্যান্ত বয়ান এতে মিলেছে। তুলনায় নাগরিক প্রেক্ষাপটে আবু জাফর শামসুদ্দীনের আত্ম888sport sign up bonus এক জরুরি দলিল। খ্রিষ্টীয় চল্লিশের দশকের কলকাতায় কীভাবে বাঁক বদলাচ্ছিল বঙ্গীয় রাজনীতি, কেমন করে জোরদার হচ্ছিল পাকিস্তানের দাবি, আর তার সুতোর টানে কীভাবে সাড়া দিচ্ছিল বাঙালি মুসলমানের মননবিশ্ব – তার ছবি ফুটেছে আত্ম888sport sign up bonusতে। এমন বই উৎসাহী পাঠকের কাছে আকরের মতো। পড়তে পড়তে আবিষ্কারের নেশা জাগে। কোনো কোনো অনালোকিত অধ্যায় আরো সবিস্তারে পড়ার-জানার-বোঝার আকাঙ্ক্ষা হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের অন্তিম চরণে যে-কলকাতাকে ঘিরে বাঙালির জাগতিক প্রতিষ্ঠার বারো আনা খোয়াবনামা পাক খেত, তার দণ্ডমুণ্ড তো বটেই, সেই দণ্ডমুণ্ডের আশপাশের কুশীলবদেরও কাছ থেকে চিনতে ইচ্ছা হয়। কলকাতার বুকে দাপিয়ে বেড়ানো বা সবে পায়ের তলায় মাটি খুঁজে নেওয়া যে-বাঙালি মুসলমান সমাজ ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের দেশভাগের পর কলকাতার পাট চুকিয়ে 888sport appয় এসে থিতু হন, এক নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেন, সেই সমাজের একটা নিজস্ব চরিত্র আছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক। এবং ভাষিক। এই সমাজের অন্দরমহলে হাওয়াবদলের যে সব লক্ষণ ফুটে বেরোচ্ছিল, কার্যকারণ সম্বন্ধে বাঁধা যে-ঘটনাপরম্পরা এই সমাজকে নড়িয়ে দিচ্ছিল, তার আঁতের কথা বড়ো একটা লেখা হয়নি।
তিন খণ্ডে বিধৃত আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনী পড়ে সে-আফসোস অনেকটা মিটেছে। রচনাকাল নয়, পটভূমির কালক্রম মানলে এই তিনটে বইকে আমরা এভাবে সাজাতে পারি – কাল নিরবধি (888sport live football প্রকাশ, 888sport app, ২০০৩ খ্রি), আমার একাত্তর (888sport live football প্রকাশ, 888sport app, ১৯৯৭ খ্রি), বিপুলা পৃথিবী (প্রথমা, 888sport app, ২০১৫ খ্রি)।
যেহেতু এই তিনটে বই বাংলা থেকে ইংরেজিতে 888sport app download apk latest versionের কাজে লেগে আছি কয়েক বছর ধরে, সেহেতু নিবিড় পাঠের অবকাশ ঘটেছে বিস্তর। ঘটে চলেছে। অহরহ। হাতের তালুর মতো চেনা হয়ে যাচ্ছে তিনটে বই। এমনটাই যে একেকটা অক্ষরের সঙ্গে আত্মীয়তা তৈরি হয়ে গিয়েছে এতদিনে। তরজমায় এটা হয়। হামেশাই হয়। এক ভাষাকে আরেক ভাষায় চালান করতে বসলে, একটা বইয়ের একেকটা পৃষ্ঠার সঙ্গে কমসেকম এক থেকে দেড় ঘণ্টা কাটাতে থাকলে হয়। দুটো ভাষার চালচলনের অনেক চেনা দিক অচেনা ঠেকে। আবার অনেক অচেনা দিক চেনা হয়ে যায়। মগজের হালকা ধোলাই হয়। মাঝেমাঝে ঠোকাঠুকি বাধে। দু-রকম সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা দুটো ভাষার পদবিন্যাস থেকে শুরু করে তাদের প্রকাশভঙ্গি ব্যঞ্জনার্থ আলাদা হতে বাধ্য। অনেক কথা নিহিত থাকে। ইশারায় বয়ান হয়। তরজমায় বসে রকমারি কায়দা বাতলাতে হয়। ডুবসাঁতার দিয়ে সাগরের তলায় নেমে মুক্তো তুলে আনার মতো করে তুলে আনতে হয় কাঙ্ক্ষিত 888sport app download apk latest version। এইসব করতে করতে লেখক ও লিখনের অন্তর্লোকের এমনসব চোরাকুঠুরি নজরে আসে যেটা সাধারণ পাঠে আসতে পারে না। চোরাকুঠুরি খোলার জন্য খোঁজ পড়ে চাবিকাঠির। একটা সময় সেটা হাতে চলেও আসে। আর এই চাবিকাঠি দিয়ে সেইসব চোরাকুঠুরির তালা খুলতে থাকে। কী দিয়ে তৈরি সেইসব চোরাকুঠুরি? কোনোটাতে সাজানো থাকে দেশকালসমাজসংস্কৃতির হিরেমানিক। থরে থরে। কোনোটায় থাকে অদ্ভুত আঁধার। চাইলেই দেখা যায় না। দিয়াশলাই লাগে। একজন সাংস্কৃতিক ভাষ্যকারের আছে এইসব অদ্ভুত আঁধার খুবই উপাদেয়। আকাঙ্ক্ষিত।
আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনী জুড়ে হিরেমানিকের রোশনাই যেমন আছে, তেমন আছে অদ্ভুত আঁধার। অজস্র।
আপনারা জানেন যে, আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি, কলকাতায়। মধ্য কলকাতার এন্টালি এলাকায় ক্যান্টোফার লেন নামে একটা ছোটো রাস্তা আছে। আপাতভাবে আনিসুজ্জামানের সূতিকাগার রচনা করা ছাড়া সেই রাস্তার অন্য কোনো বিশেষ কৃতিত্ব নেই। বসিরহাটের পাট চুকিয়ে ওই রাস্তায় ৩১নং বাসায় ভাড়া থাকতেন আনিসুজ্জামানের বাবা এ.টি.এম মোয়াজ্জম, স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে। সেখানেই ভূমিষ্ঠ হন আনিসুজ্জামান। তাঁর জীবনের প্রথম দশ বছর কাটে কলকাতায়। অখণ্ড বাংলার স্নায়ুকেন্দ্র যে ঔপনিবেশিক কলকাতা, তার লোহিত অস্থিমজ্জা নেড়েঘেঁটে। তবে এন্টালি নয়, আরেকটু দক্ষিণে আরেকটু রইস পার্ক সার্কাস মহল্লায়। কংগ্রেস এগজিবিশন রোড নামের যে নাতিদীর্ঘ পথ সৈয়দ আমির আলি অ্যাভিনিউ আর নাসিরুদ্দিন রোডের সংযোগস্থল থেকে পুবে ডানা মেলে ৪নং ব্রিজের গোড়ায় গিয়ে ঠেকেছে, তার ওপর একে একে মাথা তুলে দাঁড়ানো বাড়িগুলোতে যেন ভাবীকালের পূর্ব পাকিস্তান ও তদুপরি 888sport appsের সলতে পাকানো চলেছিল ১৯৩০-৪০ দশক জুড়ে। এরই দুটো বাড়িতে, একাদিক্রমে ১০নং ও ৭-এ কংগ্রেস এগজিবিশন রোডে ভাড়া থেকেছেন আনিসুজ্জামানের পরিবার। এখানে, এর আশেপাশে তাঁর শৈশব কেটেছে। তাঁর সংবেদী কলমের আঁচড়ে সেই সময়ের যে-ছবি ফুটেছে তা আশ্চর্য রকমের তাজা ও রঙিন।
সেই সময়ের ছবি আরো কেউ কেউ এঁকেছেন কালি ও কলমে। ছোটো কিংবা বড়ো ক্যানভাসে। যেমন আবদুল্লাহ আবু সয়ীদ। সে-আমলের কলকাতা নিয়ে অবিমিশ্র মুগ্ধতার এক বয়ান আছে তাঁর দিলখোলা জবানে।
কলকাতা সে যুগে ছিল একটা অসম্ভব সুন্দর শহর। ২০ থেকে ৩০ লাখ লোক তখন সেখানে। বড় বড় রাস্তা, বড় বড় ফুটপাত, হাইড্র্যান্ট থেকে পানি তুলে ফুটপাত ধোয়া হচ্ছে প্রতি সকালে। মাজা-ঘষা করা ঝক্ঝকে তক্তকে একটা ছিমছাম শহর। অথচ তার মধ্যে দিয়ে ট্রাম চলছে, গাড়ি চলছে। বিরাট একটা রাজকীয়তায় ভরা সবকিছু। এই শহরের কথা আমি ভুলতে পারি না। আমরা তখন যেতাম করটিয়া থেকে শহর কলকাতায়। করটিয়া তো তখন একটা অজপাড়াগ্রাম, সেখান থেকে যখন কলকাতা গিয়ে সেই ব্যস্ততা, গাড়ি, চিৎকার, সেই বৈভব, সেই বিত্ত-সম্পদ আর জৌলুসের মধ্যে গিয়ে পড়তাম – তখন বিস্ময় ভরা চোখে শহরের সবকিছু থেকে অবাক হতাম। মনে হতো এই শহরেই থাকব আমি, চিরদিন থেকে যাব। (সেতুবন্ধন, ২৭১)
এই কলকাতা আসলে বহিরাগতর চোখে দেখা কলকাতা।
কতক বাইরের আর কতক ভেতরের চোখ মেলে দেখা কলকাতার ছবিও লিখেছেন কেউ কেউ। যেমন আনিসুজ্জামানের সমবয়সী মুস্তাফা জামান আব্বাসী। তাঁর পিতা আব্বাসউদ্দীন তখন কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। সেই সুবাদে তাঁর শৈশবের খানিকটা কেটেছে কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায়। বেনিয়াপুকুরে। আনিসুজ্জামানদের কংগ্রেস এগজিবিশন রোডের ভাড়াবাড়ি থেকে মাইলখানেক উত্তরে। অবিশ্যি তিনি বাড়ির কাছাকাছি মডার্ন স্কুলের ছাত্র ছিলেন বলে দরগা রোডের ওপর সবে মাথা তোলা পার্ক সার্কাস হাইস্কুলের ছাত্র আনিসুজ্জামানের সঙ্গে তাঁর দেখাশোনা হয়নি বললেই চলে। তবে তাঁদের চেনাশোনার চৌহদ্দি কতক একই রকমের ছিল। আনিসুজ্জামানের আব্বার ডাক্তারি চেম্বারে যে জমায়েত হতো, তাতে আব্বাসউদ্দীনের যাতায়াত ছিল। মুস্তাফা জামান আব্বাসী লিখছেন –
কলকাতার পার্ক সার্কাস অঞ্চলের বেনে পুকুর লেনে একটি হলদে বিবর্ণ বাড়ির দোতলার কথা মনে পড়ে। ছ নম্বর বেনে পুকুর লেনে আমাদের বাড়ির ছোট গলিটার সামনেই থাকতেন আবদুল হক ফরিদি সাহেব, পরিণত বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। গলিটার একটু দক্ষিণের দিক এগুলেই সেই হলদে বাড়ি, যার বাসিন্দা সেকালের 888sport live footballিক, রাজনীতিক হাবীবুল্লাহ বাহার, তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা বাহার চৌধুরী ও বাহার সাহেবের ভগ্নী শামসুন নাহার মাহমুদ। আব্বা নিয়মিত প্রাতঃ888sport slot gameে যেতেন। সূর্য ওঠার আগেই, নানা গলি পেরিয়ে একেবারে পার্ক সার্কাস ময়দানে ঠিক সোহরাওয়ার্দি সাহেবের বাসার সামনে নিয়ে ছিল রাস্তাটি। (জীবন নদীর উজানে, ৫৮)
মুস্তাফা জামান আব্বাসীর ধরনটা থাম্ব নেইল স্কেচের মতো। অসম্পূর্ণতাই তার অলংকার। আনিসুজ্জামানের ধরনটা ছোটো ছোটো ব্রাশস্ট্রোকে রয়েসয়ে আঁকা একের পর এক ইম্প্রেশনিস্ট পেইন্টিংয়ের মতো। তাতে অসংখ্য রঙের আনাগোনা। রঙের ওপরে চাপানো রঙের চমক। তার ফাঁকেফোকরে অবাক আলোর ফুলকি। এক কথায় – অনুপুঙ্খ। একটা নমুনা দিলেই খোলসা হবে।
পার্ক সার্কাসে তখনো গ্যাসের বাতি জ্বলতো। সন্ধ্যাবেলায় সিঁড়ি কাঁধে একজন বাতির পর বাতি জ্বালিয়ে যেতো – দেখতে ভারি ভালো লাগতো। ভোরবেলায় পাইপ দিয়ে পানি ঢেলে রাস্তা পরিষ্কার হতো। তখনো আমাদের এলাকায় ফুটপাতে তেমন লোক ঘুমোতো না – এক-আধজন ঘুমোলেও রাস্তা ধোওয়ার আগেই উঠে পড়তো। ডিপো থেকে ট্রাম বেরোলে মনে হতো, দিনের কাজকর্ম শুরু হলো। তার আগেই কিন্তু ট্রামডিপোর সামনের রেস্টুরেন্ট দুটি খুলে যেতো। কাজে বেরোবার আগে ট্রামের কর্মীরা অনেকে এখানে খেয়ে নিতেন। আমার মর্নিং স্কুলের সময়ে বাড়িতে প্রায়ই নাশতা হতো না। নগদ পয়সায় একটি রেস্টুরেন্টে বসে নানরুটি আর নেহারি খেয়ে নিয়ে স্কুলে যেতাম। (কাল নিরবধি, ৫০)
কোথাও কোনো বাড়তি রং চাপানো নেই। অথচ পড়তে পড়তে মনে হয় যে ছবিটা চলতে শুরু করেছে। এত গতিমান তাঁর গদ্য। নিরলংকার অথচ বেগবান। জমাট অথচ আলগা। সাদাসিধে অথচ রংচঙে।
এখানে একটা কথা না বললেই নয়। 888sport app download apk latest versionের কাজ যখন হাতে নিই, তখন ওঁর কাছ থেকে ফোন এসেছিল। 888sport app থেকে কলকাতায় ইন্টারন্যাশনাল কল। জিজ্ঞেস করলেন, কেমন লাগছে। বললাম। ওঁর লেখার এইসব প্রসাদগুণের কথা নিয়ে দু-চার কথা হলো। বললাম, ইংরেজি গদ্যের বাক্যবিন্যাস ওঁর বাংলা রচনার ভিত গড়েছে বলে ওঁর লেখাকে ইংরেজিতে আনা অপেক্ষাকৃত সুবিধেজনক। যে যুক্তি পরম্পরায় ইংরেজিতে জটিল বাক্যের গড়ন হয়, আনিসুজ্জামান বরাবরই সেটাকে সামনে রেখে বাংলা লিখেছেন। অ্যাকাডেমিক রাইটিংয়ে এটা এসেই যায়। এ ধরনের পার্সোনাল প্রোজেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এই ব্যাপারটা ওঁকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারত। দেখলাম যে উনি আশ্বস্ত হলেন। বরং লেখাতে আলংকারিক গুণাবলির ঘাটতি আছে বলে কিঞ্চিৎ কুণ্ঠিত শুনিয়েছিল তাঁকে। আমার মনে হয়েছিল, অনেক কসরত করে এমন সহজ-সরল গদ্য লেখা যায়। এমন লেখাই পারে চট করে পাঁচ রকমের পাঠকের কাছে অনুমোদন যাচনা করতে। পাঁচ রকমের সংবেদনে দাগ কাটতে।
এই শৈশবের কথা উনি লিখছেন কবে? প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে। কমসেকম পাঁচ-সাড়ে পাঁচ দশকের দূরত্ব থেকে। যেন একটা মন-কেমন-করা সেপিয়া টিন্ট লাগছে ছবির গায়ে। সেলুলয়েডের মেজাজ আসছে। তাতে পড়তে আরাম হচ্ছে। তাক লাগানো গদ্যের শান দেওয়া ঝলসানি তাতে নেই, আছে ধীর স্থির নম্র গতি। তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এই গতি সংগতিপূর্ণ। তাতে নিজেকে জাহির করার ছটফটানি নেই। নিজেকে গৌরবদানের বাসনা নেই। নিজের মাপটুকুকে দরকারে আরেকটু খাটো করে নিয়ে পরিপার্শ্বকে চিনে নেবার চেষ্টা আছে। আপাতভাবে তুচ্ছ ঘটনার বর্ণনার মধ্যেও বিনয়ের কোনো খামতি পড়েনি।
ইশকুলের উঁচু ক্লাসের ছেলেপুলেরা নিচু ক্লাসের ছেলেপুলেদের ওপর একটু-আধটু জোর ফলায়। জবরদস্তি চালায়। ওঁর বেলাতেও হয়েছে। বলপ্রয়োগ করে সিগারেট ফুঁকতে বাধ্য করা হয়েছে তাঁকে। অথচ রাগ পুষে রাখেননি তিনি।
একবার স্কুলের ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে সঙ্গী কয়েকজনের মধ্যে কে যেন সিগারেট বের করলো এবং আরেকজন তাতে অগ্নিসংযোগের ব্যবস্থা করে দিলো। তারপর হাত বদলে সকলেই এক টান দিচ্ছে। আমাকেও আহ্বান জানানো হলো অংশ নিতে। আমি অস্বীকার করায় প্রথমে মারের ভয় দেখালো, পরে সত্যিই প্রহার। আমাকে সিগারেট খাওয়ানো সমবেত আনন্দলাভের একটা অংশ ছিলো বটে, কিন্তু তার চেয়ে বড়ো কারণ ছিল এই যে, আমি ওই দোষে দোষী হলে কারো বিরুদ্ধে নালিশ করার সুযোগ পাবো না। কিল-চড় খাওয়ার এক ফাঁকে দৌড় দিয়ে পালিয়ে বাড়ি চলে আসি। ইচ্ছে করলে সঙ্গীরা আমাকে ধরে ফেলতে পারতো। তা না করে তারা কেবল চিৎকার করে ঘোষণা করেছিল যে, কাউকে বলে দিলে পরিণাম ভালো হবে না। তাদের বাণীকে আমি শূন্যগর্ভ মনে করিনি। (কাল নিরবধি, ৬২)
এমন ঘটনাকে আজকাল ঘোরতর অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। আনিসুজ্জামান তা জানতেন বিলক্ষণ। অথচ যারা তাঁকে সেদিন শারীরিক ও মানসিকভাবে নিগ্রহ করেছিল তাদের ওপর কোনো রাগ পুষে রাখছেন না তিনি। ওই ঘটনা তাঁর চেতনায় রেখাপাত করেছে, তাঁর 888sport sign up bonusপটে পাকা জায়গা করে নিয়েছে। পরিণত বয়সে পৌঁছে ওই ঘটনার কোনো সুদূরপ্রসারী অভিঘাত তাঁকে দীর্ণ করেছে বলেই না এত মনোযোগ দিয়ে তার পুনর্নির্মাণ ঘটিয়েছেন। তবু ‘দুষ্টু প্রকৃতির ছেলেদের’ প্রতি অহেতুক নির্দয় হতে তাঁর বাধছে। তাদের খারাপ ভাবতে আটকাচ্ছে। বরং তাদের আচরণের পেছনে যে-যুক্তি আছে সেটাকে ফলাও করে বলে যেন বেকসুর খালাস দিচ্ছেন তাদের। ‘তাদের বাণীকে আমি শূন্যগর্ভ মনে করিনি’ – এই স্বীকারোক্তির মধ্যে একটা আতঙ্কের চেহারা ফুটে উঠছে। অথচ দেখুন, সেই আতঙ্ককে খামোকা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ভয়ংকর করে দেখানোর কোনো বাঞ্ছা তাঁর নেই।
প্রবৃত্তির এই উদারতা আনিসুজ্জামানের আত্মকথনের এক প্রধান গুণ। এরই পাশাপাশি চলেছে তাঁর রসবোধ। দেশভাগের ঠিক পরপর কিছুদিন যশোরে মাথা গুঁজেছিলেন তাঁরা। এই সময় তাঁর ছোড়দির শ্বশুরমশাইকে একদিন সঙ্গ দিয়েছিলেন পুকুরপাড়ে। মাছধরা দেখেছিলেন। ক্লাস সেভেনের ছাত্রকে বাগে পেয়ে ছিপ আর বড়শি এই দুটো কথার ইংরেজি জিজ্ঞেস করেছিলেন সেই গুরুজন। দশ বছরের আনিসুজ্জামান বলতে পারেননি। তাঁর দিকে একটু তাকিয়ে সেই গুরুজন বলেছিলেন – ‘তোমার কিস্সু হবে না।’ এমন ভর্ৎসনা যে কত বেদনাদায়ক, কত অন্তর্গত রক্তক্ষরণের কারণ, তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। তিনি যে ভুলতে পারেননি, সেই সত্যের মধ্যেই ওই দগদগে ক্ষতস্থান খুলে দেখানোর প্রবৃত্তি রয়ে গেছে। অথচ ওই ভর্ৎসনার পর কী লিখছেন আনিসুজ্জামান? ‘তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ হয় নি।’ একে বৈষ্ণববিনয় বলে তাচ্ছিল্য করবেন তার উপায় নেই। কারণ অবমাননাকর পরিস্থিতির মধ্যেও কৌতুকের আকর খুঁজে পেতে তিনি সিদ্ধহস্ত। সে-কৌতুকের পাত্র যদি স্বয়ং তিনি হন, তাতেও তিনি পিছপা নন।
পিছপা নন ছেলেবেলার দিনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জুতে যাবার অধ্যায়কে খোলাখুলি বলতে। সে-বলার মধ্যে পরবর্তীকালের ভুলচুকের চোরাবালি থাকলেও কাঁচা বয়সের আবেগকে একরত্তি অবজ্ঞা করেননি তিনি। নিজের 888sport sign up bonusর সঙ্গে কাছাকাছি আরো কয়েকজনের 888sport sign up bonus না জুড়ে নিলে পাকা হাতে এমন মর্মস্পর্শী বয়ান লেখা যায় না। আমাদের হতবাক করেছে তাঁর অকপট কথন। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে ও মুসলিম লীগ রাজনীতির পালে হাওয়া লাগার প্রেক্ষিতে। এখানে একটা দরকারি কথা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসে’র আগে পর্যন্ত কলকাতা কোনোদিন দাঙ্গাহাঙ্গামা দেখেনি। কলকাতার কোনো এলাকায় কোনো বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মৌরসিপাট্টা ছিল না। নানান সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশেই থাকতেন, বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিন্দু-মুসলমান ঘরের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে লেখাপড়া করতে যেত। কাল নিরবধি যেহেতু সকলে পড়েননি, সেহেতু একটু দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিতে মন চাইছে।
বাড়ির আবহাওয়া থেকে মনে গেঁথে গিয়েছিল এ-কথাটা যে, হিন্দু ও মুসলমান স্বতন্ত্র। হিন্দুর প্রতি কোনো বিদ্বিষ্ট ভাব জাগেনি, কিন্তু তারা যে আমাদের মতো নয় এটা আরো বুঝতাম স্কুলে সরস্বতী পুজো ও মিলাদের অনুষ্ঠানে কিংবা মাঝে মাঝে একই কল থেকে পানি খেতে গিয়ে। তবে বড়োরা এই ধারণাটাও জাগিয়ে দিয়েছিলেন যে, মুসলমানের প্রতি হিন্দুরা সাধারণত অবিচার করে থাকে। অন্যদিকে হিন্দু শিক্ষক, আইনজীবী ও চিকিৎসকের পেশাদারি দক্ষতাও আবার এমন সর্বজনস্বীকৃত ছিল যে, মুসলমানের কাছেও তাঁরা অত্যাবশ্যক বলে গণ্য হতেন।
হিন্দু-মুসলমানের এই স্বাতন্ত্র্যবোধ যে মুসলিম লীগের রাজনীতির আবহাওয়ায় অনেকখানি পুষ্ট হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই। আমার জ্ঞান হতে দেখি, বাড়ির সকলে পাকিস্তান চান, মুসলিম লীগকে সমর্থন করেন এবং জিন্নাহ্কে নেতা মানেন। আশপাশেও এই ভাবটাই প্রবল ছিল। ইন্তু মিয়াদের বাড়িতে যখন হুমায়ুন কবির আসতেন, তখন দূর থেকে তাঁকে দেখতে পেলে কেউ না কেউ সখেদে বলতেন, এতো বড়ো প্রতিভা বাঙালি মুসলমানের মধ্যে নেই, কিন্তু আফসোস এই যে, তিনি কংগ্রেসি। মওলানা আবুল কালাম আজাদের ছবি দেখতাম কাগজে। তাঁর সম্পর্কেও বলা হতো যে, ইসলাম-বিষয়ে জবরদস্ত পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে কংগ্রেসের বড়ো নেতা, এটা খুবই শোচনীয় ব্যাপার। আব্বা একটু বিষণ্নচিত্তেই জানিয়েছিলেন যে, কংগ্রেসি হওয়ার ফলে কলকাতার মুসলমানেরা গড়ের মাঠে ঈদের জামাতে মওলানা আজাদকে ইমামতি করতে বাধা দিয়েছিল এবং তার ফলে ঈদের সময় তিনি আর কলকাতায় আসতেন না। আমার মনে হতো, কংগ্রেসি রাজনীতির প্রতি বিরাগ সত্ত্বেও মওলানা আজাদের ইমামতিতে ঈদের নামাজ পড়তে পারলে আব্বা খুশি হতেন।
এই আবহাওয়ায় আমিও পাকিস্তানের খুদে সমর্থক হয়ে উঠেছিলাম। স্কুলে টিফিনের জন্যে যে-পয়সা পেতাম, হঠাৎ করে একটা সিগারেটের টিনে তা জমাতে শুরু করলাম। উদ্দেশ্য : জিন্নাহ্ ফান্ডে দান করা। (কাল নিরবধি, ৭৫)
এ শুধু অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর একটা বিষয়কে তার পাওনাগণ্ডা বুঝিয়ে দেওয়া নয়, এর মধ্যে আধুনিক বাঙালির মনোজাগতিক বিভাজনের এক নৈর্ব্যক্তিক বিচার আছে। আছে নির্দয় আত্মবিশ্লেষণ। এত দরাজ কবুলিয়ত বাঙালির আত্মকথনে দুর্লভ। এ যেন আংরাখা খুলে নিজেকে উদোম করে দেখানোর শামিল। অশোক মিত্রের আপিলা চাপিলা, যাতে ১৯৩০-৪০-র দশকের 888sport appর আরমানিটোলা মহল্লার জলজ্যান্ত ছবি আছে, সেটাকে বাদ দিলে শৈশব888sport sign up bonusর অতলে এত তলিয়ে দেখার নিদর্শন বাংলায় খুব বেশি নেই।
কংগ্রেস ও লীগ রাজনীতির এই পূর্বাপর বিশ্লেষণ সকলকে সমান তৃপ্তি দেবে এমন নয়। কিন্তু দেশভাগের ওপর রচিত অসংখ্য ইতিহাসগ্রন্থ প্রায় অবধারিতভাবে রাজনৈতিক দলিলকে মাথায় তুলে নাচতে গিয়ে আম-আদমির মনের কথা শুনে দেখেনি। খ্রিষ্টীয় সতেরো-আঠেরো শতকের বাংলার ইতিহাস লিখতে বসে বিদেশি পর্যটকের 888sport slot gameকাহিনিতে মুখ গুঁজে থেকেছে, উপায় না পেয়ে রাজাবাদশার নজরানা নিয়ে লেখা জীবনীগ্রন্থকে আকর ভেবেছে। কিন্তু অদূর অতীতের পুনর্নির্মাণে যে এমনতর আত্মকথনের একটা বড়ো ভূমিকা থাকতে পারে তাকে মান্যতা দেয়নি। অথচ কলোনিয়াল মাইন্ড আর ন্যাশনালিস্ট মাইন্ডের বাঁকবদল বুঝতে গেলে আনিসুজ্জামানের মতো চিন্তাবিদের এমন বাতচিতকে মর্যাদা না দিয়ে চলে না। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানের অস্মিতার প্রশ্নে তা আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
আনিসুজ্জামানের লেখায় ঘর আর বাইরের তফাত তেমন নেই। ঈদের সময় কীভাবে উদ্যাপনে মেতে উঠত কলকাতা, কীভাবে পার্ক সার্কাস ময়দানে মুসলিম লীগ প্রভাবিত মুকুল ফৌজের কসরত চলত, কীভাবে সিনেমা-থিয়েটারের প্রমোদে গা ঢেলে দিত বাঙালি সাধ্যবিত্ত শ্রেণি – এসব হাত খুলে লিখে গেছেন আনিসুজ্জামান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানি বোমার তাণ্ডবে কলকাতার থরহরিকম্প দশা, দ্য গ্রেট বেঙ্গল ফেমিনের ভয়ঙ্কর 888sport sign up bonus সবই তাঁর লেখায় আছে। সবচেয়ে বড়ো কথা, ১৯৪৬-র ১৬ আগস্টের রক্তস্রোত যে কতখানি দাগ কেটেছে তাঁর চৈতন্যে তা একেবারে খুলে দেখিয়েছেন আমাদের। লুকোছাপার বালাই ঘুচিয়ে দিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বহু সমিধ আহরণ করে দিয়েছেন। এর সমান্তরালে পারিবারিক ইতিহাসের খেই ধরে নিজের আব্বার যে-ছবি এঁকেছেন আনিসুজ্জামান, তাঁর কাছেপিঠে থাকা মানুষজনের যে-বিবরণ দিয়েছেন, তার ভেতর দিয়ে মুসলমান মানসের ওই স্বাতন্ত্র্যচিন্তার একটা ধারাভাষ্য ফুটে বেরিয়েছে। ছেলেবেলায় দেখা অভিজ্ঞতাকে পরে গবেষকের নিক্তিতে যাচাই করে নেবার সুযোগ নির্ঘাত উসুল করেছেন তিনি। ওই ইতিহাসের অনেক কারিগর তাঁর আশপাশে থাকায় মস্ত বড়ো সুবিধে হয়েছে তাঁর।
সেইসব কারিগরের কথা সেই সময়ে কতটুকুই বা জানতেন তিনি! পরের জানা দিয়ে সেসবকে ভরাট করেছেন। তাঁদের ৭-এ কংগ্রেস এগজিবিশন রোডের বাড়ির উলটোদিকে দাস ভবন নামে যে-বাড়িতে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ বসবাস করতেন, তার বিশদ বর্ণনায় বিস্মিত হতে হয়। যেমন – ‘জামিল চৌধুরী (আমাদের সাংস্কৃতিক জগতে সুপরিচিত) আমার দুই ক্লাস ওপরে পড়তেন; তিনি আস্ত রেডিও-সেট খুলে আবার জোড়া দিতে পারতেন শুনে তাঁদের ফ্ল্যাটে গিয়ে একবার খোলস-ছাড়া বেতার বাজতে শুনে এসেছিলাম।’ এমন ছোটো ছোটো ছবির মধ্যে মজার উপকরণ প্রভূত আছে, আছে ইতিহাসের উপাদানও।
এ-ধরনের লেখায় অতীতের ড্রামাটিক রিকনস্ট্রাকশনের একটা রেওয়াজ আছে। ভাষা ও 888sport live footballের লোকজনের লেখায় অবধারিতভাবে আসে লিটারারি অ্যালিউশনের টুকটাকি। তার ধার ধারেননি আনিসুজ্জামান। পণ্ডিতি নয়, আস্থা রেখেছেন আটপৌরে পারিপাট্যে। সংলাপ নয়, ভরসা রেখেছেন বর্ণনায়। অকুস্থল থেকে নিজেকে খানিক সরিয়ে রাখা বিশদ বর্ণনায়। সে-বর্ণনায় ঘটনার ঘনঘটা নেই, অনুভবের বর্ণমালা আছে।
আর বিশেষভাবে আছে পিতাপুত্রের সম্পর্কের আখ্যান। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চেনাজানা ছবির সঙ্গে তার মূলগত প্রভেদ নেই। প্রভেদ যা আছে তা আড়াল ঘোচানো অন্তরঙ্গতায়। আব্বার মধ্যে কোনো রকমের মহত্ত্ব আরোপ না করে তাঁকে নির্মেদ নির্মোহভাবে দেখার অভ্যেস বাঙালি আত্মকথকের সহজাত নয়। তাঁকে আতশকাচের তলায় ফেলে জনসমক্ষে হাজির করা তো নয়ই। অনায়াসে এটা করেছেন আনিসুজ্জামান। অন্দরের দোর হাট করে আমাদের ঢুকতে দিয়েছেন। আব্বার যাবতীয় স্খলন পতন ত্রুটির হিসাব-নিকাশ করেছেন। সামনাসামনি। তাঁর মনোজগতের হদিস খুঁজতে গিয়ে যা লিখেছেন তিনি তার তুল্যমূল্য আমাদের বড়ো একটা জানা নেই।
‘তুমি আমার একমাত্র পুত্র। এই অতুল বিভব, সুবিস্তৃত রাজ্য এবং অসংখ্য সৈন্য-সামন্ত – সকলই তোমার।’ আমাকে লক্ষ্য করে বিষাদ-সিন্ধুর এই লাইন দুটি প্রায় উচ্চরবে নাটকীয়ভাবে মুখস্থ বলতেন আব্বা। আমি যে তাঁর একমাত্র পুত্র ছিলাম – অন্তত সাড়ে দশ বছর বয়স পর্যন্ত – তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু অতুল বিভব বলতে আমি দেখতে পেতাম হোমিওপ্যাথিক ওষুধ ও বই-ভর্তি গোটা তিনেক আলমারি, একটা দেরাজওয়ালা টেবিল, কিছু চেয়ার, একটা বেঞ্চি, খাট একটা, ড্রেসিং টেবিল একটা, গোটা দুই চৌকি। সুবিস্তৃত রাজ্য বলতে ছিল ভাড়া-করা একতলাটা। অসংখ্য সৈন্য-সামন্ত অর্থ একজন কাজের ছেলে – তার 888sport free bet না বাড়লেও নামধামচেহারা পালটাতো। তাদের মধ্যে একজনকে আমার মনে পড়ে – রশীদ নামে বিহারি একটি ছেলে। সর্বসম্মতিক্রমে আমি তাকে পড়াবার ভার নিয়েছিলাম। এখানে রবীন্দ্রনাথের ওপর আমার জিত – রেলিংগুলোকে ছাত্র কল্পনা করতে হতো না।
আব্বা যে 888sport live footballের খুব অনুরক্ত ছিলেন, তা বলা যায় না। তবে তিনি সুর করে কিছু 888sport app download apk পড়তেন ও গান গাইতেন – তার একমাত্র শ্রোতা ছিলাম আমি। তিনি কখনো ফারসি শেখেন নি, কিন্তু সুর দিয়ে আবৃত্তি করতেন,
চে তাদবির আয় মুসলমানান্
কে মন্ খুদ্রা নমি দানম্।
জিজ্ঞেস করলে এর অর্থ বলতেন, ‘হে মুসলমানেরা, আমি কী করবো, নিজেকেই যে আমি জানিনে।’ এমন দুর্জ্ঞেয় বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবার বয়স আমার তখন হয় নি – বোধকরি, কোনো কালেই হয় নি – কিন্তু এর সুর ও ধ্বনিমাধুর্য মনকে ভরিয়ে দিতো।
আব্বার গলায় যে সুর ছিল, এমন দাবি করা অসংগত হবে। তবু তিনি যখন আমাকে তাঁর পাশে বসিয়ে শুইয়ে গাইতেন, ‘ধনধান্যপুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ তখন সত্যি আমি মোহিত হতাম। গভীর আবেগের সঙ্গে পুরো গানটি আব্বা গাইতেন, এর অনেক অংশ আমারও মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কিছু কিছু স্বদেশী গানও আব্বা শোনাতেন। ‘ভাই হয়ে ভাই মিলবি সবাই, গাইবো কী আর এমন গান’ কিংবা ‘একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি’। শেষ গানের পটভূমি সবিস্তারে শুনেছিলাম তাঁর কাছে। তার থেকেই বোধহয় দেশপ্রেমের অঙ্কুর জন্মেছিল আর ক্ষুদিরাম ও তাঁর সতীর্থ বিপ্লববাদীদের প্রতি 888sport apk download apk latest version জেগেছিল চিত্তে। গীতাঞ্জলির দুটি গানও আব্বা গাইতেন : আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার/ চরণধুলার তলে’ এবং ‘সীমার মাঝে, অসীম তুমি/ বাজাও আপন সুর’ – এর মধ্যে প্রথমটিই ছিল তাঁর প্রিয়, সেটি তিনি গাইতেন খুব আপ্লুত হয়ে। (কাল নিরবধি, ৬৮)
পিতাপুত্রের এমন সখ্য ও সুখের ছবি বাঙালির আত্মকথনে সুলভ নয়। কত সহজে আসক্তি আর নিরাসক্তির জোড়কলমে একটা ঘরানার ছবি গড়ে তুলছেন আনিসুজ্জামান। লক্ষণীয় যে, বাঙালি ও ইসলামীয় সংস্কৃতিজ্ঞানের টুকরো-টাকরা দিয়ে লেখাকে সয়লাব করার জুতসই একটা ময়দান তৈরি করেও তার ধারেকাছে গেলেন না তিনি। ওস্তাদি ফলানোর বদলে দান ছেড়ে দিলেন। শরিয়তি ইসলামের চৌহদ্দি না মাড়ানোর কথা ফলাও করে বললেন।
এমন আব্বার সন্তানসন্ততি ক্রমশ বিলীয়মান এক প্রজাতি। যে-প্রজাতি বাংলাকে র্যাডক্লিফ লাইনে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখেছে, সেই প্রজন্মের শেষ প্রতিনিধিরাও এবারে চলে যেতে বসেছেন। তাঁর প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রজন্ম বুঝি শেষ হয়ে এলো।
এই প্রজন্মের সকলে নয়, কেউ কেউ অখণ্ড বাংলার এই সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান প্রাণে ধরেছিলেন। সাংস্কৃতিক বহুত্বকে মনেপ্রাণে মর্যাদা দিয়েছিলেন। আশৈশব। যখনই দরকার পড়েছে নেড়েচেড়ে দেখেছেন। দেখিয়েছেন। আনিসুজ্জামান তাঁদের অন্যতম ছিলেন। তাই বাঙালির আত্মপরিচয় তাঁকে বারেবারে ভাবিয়েছে। তারই সাপেক্ষে মুসলমান-মানসকে খুঁজে ফিরেছেন। কোনোদিন ওই বহুত্বমুখী চেতনা থেকে চ্যুত হননি তিনি। যখন প্রয়োজন পড়েছে তখন ধর্মনিরপেক্ষতার কবচকুণ্ডল পরিয়েছেন তাঁর চিন্তায়। তিন খণ্ডে বিধৃত তাঁর আত্মজীবনীর আনাচেকানাচে সেই স্থির প্রত্যয় ঠিকরে বেরোচ্ছে।
বলতে সাধ হয় যে, পাকিস্তানের ভূত আর 888sport appsের ভবিষ্যতের মধ্যবর্তী কোনো অচিনপুরের ঠিকানা যেন উন্মোচিত হয়ে চলেছে সেই আলোয়।
উল্লেখপঞ্জি
১. আত্ম888sport sign up bonus, আবু জাফর শামসুদ্দীন, 888sport live football প্রকাশ, 888sport app, ২০০৫ খ্রি।
২. কাল নিরবধি, আনিসুজ্জামান, 888sport live football প্রকাশ, 888sport app, ২০০৩ খ্রি।
৩. জীবন নদীর উজানে, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, মাওলা ব্রাদার্স, 888sport app, ২০০৯ খ্রি।
৪. সেতুবন্ধন : কতিপয় প্রাজ্ঞজনের শৈশব কৈশোর যৌবনকালের আত্মকথন, সং বিধান চন্দ্র পাল, অবসর, 888sport app, ২০১৩ খ্রি।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.