অথৈ পরমানন্দ

কে এই অথৈ পরমানন্দ?

তাঁকে নাকি দেখা যায় না। ছোঁয়া যায় না।  তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায় না। আসলে তিনি কে?

তবে কি তাঁর চোখ আকাশের মতো নীল? তাঁর কেশ কি ঝুরিবটের মতো কাঁধ পর্যন্ত নামানো? তাঁর গায়ের রং কি সমুদ্রের মতো গাঢ় নীল? পাহাড়ের মতো তিনি কি ঋজু ও বলিষ্ঠ?

তাঁর কণ্ঠস্বর কি সুললিত, নদীর কলতানের মতো মধুর?  কণ্ঠনিঃসৃত শব্দরাশি কি মমতা উদ্রেককারী? তাঁর ব্যক্তিত্ব মোহাবেশ তৈরি করে বুকের ভেতর? যে তাঁর কথা শোনে, সে-ই কেবল অনুভব করে এসব। মাথা নুয়ে সর্বান্তঃকরণে বলে ওঠে, তুমিই প্রভু। তুমি আমার সর্বস্ব। আমি আমার সবটুকু তোমাকে দিতে প্রস্তুত হে অন্তর্যামী!

এভাবেই মানবমনের ভাবনা উতলা হতে শুরু করে। মনের গহিনলোক থেকে কে যেন হাত তুলে তাঁকে বরণ করে নিতে চায় সানন্দে। কে তিনি?

অথচ কদিন আগেও অথৈ পরমানন্দ নামে কোনো ছায়ামানবের অস্তিত্ব ছিল না কারো মনে। কেউ জানতোই না এ-নাম।

হঠাৎ একদিন একটি চিঠি ভেসে এলো রাজীব ঘোষের মেসেঞ্জারে। চিঠির উপর একজন ধ্যানমগ্ন মানুষের ছবি। অনেকটা তথাগত বুদ্ধের প্রচলিত ভঙ্গি। কটি মাত্র বাক্য। শব্দচয়ন অতিশয় মোলায়েম ও হৃদয়স্পর্শী। এর ছোঁয়া পাওয়ামাত্র মানুষের বুকের ভেতর যে চিরচঞ্চল একখানা নদী নিরবধি বয়ে চলে, তা যেন সহসা ছলকে ওঠে এক অনস্বীকার্য অপরূপ আনন্দে। ঘন বনে প্রবহমান ঝর্ণাধারার মতো মগ্নচৈতন্যে টোকা দিয়ে যায় বারবার। 

প্রিয় মানুষ ,

কী নিয়ে এতো ব্যস্ত? কার পিছনে এতো হন্যে হয়ে ছুটছো? এ কি অর্থ-সম্পদ আর কামিনী-কাঞ্চন? নাকি আত্মগর্বে তুষ্ট হয়ে কোনো মহান মানুষ হতে চাইছো? সেরা লেখক, সেরা 888sport apkী, সেরা নেতা বা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোনো পেশাজীবী? কখনো কি দিনশেষে গাছের ডালে-ডালে পাতায়-পাতায় আশ্রয় খোঁজা পাখিদের অবিশ্রান্ত কলতানে কান পেতেছো? কখনো কি নদীর নিরবধি বয়ে চলার ভাষাকে নিজের অন্তরাত্মায় ঠাঁই দিয়ে জানতে চেয়েছো, ওরা কী চায়? এতো স্বার্থপর কেন তুমি? একটুখানি ছাড় দিলেই তো পৃথিবী হতে পারে স্বর্গ, তা কি তোমার অজানা?

হে মনুষ্য, তুমি তৃপ্ত? একবার নয়, বারবার একই প্রশ্ন করো, তুমি কি তুষ্ট? নদীর মতো, হাওয়ার মতো, গাছের মতো, আকাশের মতো? প্রশ্ন করো। বারবার করো।

আমি আসবো। আমি রয়েছি তোমারই পাশে। খুঁজে নাও। জড়িয়ে ধরো এ অথৈ পরমানন্দকে। ভালো থাকবে, আনন্দে থাকবে।

ইতি

মায়াহীন বন্ধনহীন নৈর্ব্যক্তিক নির্বিকল্প

অথৈ পরামানন্দ

পত্রের নিচে ছোট করে বলা রয়েছে, ‘আমায় বিলিয়ে দিও সবার মাঝে।’

দেখতে দেখতে পরমানন্দ গ্রুপ হয়ে গেল এদেশে। কেউ তাঁকে দেখেনি, শোনেনি। তবু তিনি এক সংগোপন আবেগ হয়ে হাজার বিশেক 888sport free betলঘুকে শাসন করছে মাটির নিচের ফল্গুধারার মতো। তাদের জীবনের উপর তাঁর রয়েছে এক অপ্রতিরোধ্য নিয়ন্ত্রণ।

রাজীব ঘোষদের মিষ্টির দোকান। 888sport app নগরের বড় মিষ্টির দোকানগুলোর একটি তাদের। দোকানের সাইনবোর্ডটি  নানারকম মিষ্টির লোভনীয় ছবি দিয়ে ভরা। এর ঠিক মাঝখানে রাজীবের ঠাকুরদা প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় শ্রী সদানন্দ ঘোষ বিশাল এক ভুঁড়ি বাগিয়ে হাসিমুখে বসে রয়েছেন। 

ওদের দোকানটি পুরান 888sport appর সবাই চেনে।

888sport app-কলকাতায় নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে রাজীব ঘোষদের। ওপারেও ব্যবসা-বাড়ি রয়েছে। এখানকার চেয়ে সেখানে পসার বরং বেশি।

তবে রাজীব যতই ফ্যাশন করুক, বাপ-দাদাদের মতো ওর ভুঁড়িখানাও কোনো দামি শার্ট বা জিন্স দিয়ে ঢাকবার নয়। শরীরের সঙ্গে মাথার আকৃতি বেমানান, বেশ  ছোট এবং সেখানে চুল খুবই নগণ্য।

কিন্তু ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে, বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের লাভ-লোকসান কিংবা দরকষাকষির বেলায়, ওর মগজ চলে একেবারে মিসাইলের গতিতে। এ পর্যন্ত লোকসানের ইতিহাস ওর নেই বললেই হয়। কোন শেয়ারের কতটুকু সুদূরপ্রসারী প্রভাব তা সে গড়গড় করে বলে দিতে পারে। যা বলে তা ফলেও যায় বারবার; এজন্য শেয়ারপাড়ার অনেকেই ওকে শেয়ারজগতের হোমড়া-চোমড়া ভাবে।

সে নির্দিষ্ট সময় ধরে, দশটা থেকে দুটো-আড়াইটা, একটি সিকিউরিটি হাউজে বসে। সেল-পারচেজ করে ভালো একটা অংক পকেটে পুরে দিব্যি টাইট জিন্স আর ততোধিক স্কিন-টাইট গেঞ্জি গায়ে দিয়ে টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে দুবাই-সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমিয়ে ট্যাক্সহীন স্বর্ণের অলংকার এনে বিক্রি করে 888sport appয়। বেশ লাভ উঠে আসে পকেটে। সব মিলিয়ে চৌকস এক যুবক সে। জগন্নাথ কলেজ থেকে এমএ পাশ করে নিয়েছে দুই সরল বন্ধুর সাহায্য-সহযোগিতার বদৌলতে। ওরা না থাকলে ওর এমএ করা মুশকিল হয়ে পড়তো। বাংরেজিটাও বলতে পারে ফরফর করে। এমনভাবে বলে যেন ইংরেজি ওর মাতৃভাষা। বাংলাটা ভীষণ গায়ে পড়া, ন্যাকা চরিত্রের। বেশিরভাগ সময় সে ইংরেজি বলতে গেলেই বাঁদরের মতো ঘাড়ে বসে থেকে সব এলোমেলো করে দেয়। 

ওরা দুই ভাই এক বোন। সবাই থাকেন ওপারে। ওখানে শুধু মিষ্টির দোকান নয়। বড়ভাই আর জিজু মিলে একটি স্বর্ণের দোকানও খুলেছে। ওকে বলছে, সব ছেড়েছুড়ে চলে আয়।

কিন্তু রাজীব তাতে রাজি নয়; সে রয়েছে ওর মা-বাবার সঙ্গে পুরান 888sport appর দোতল বাড়িতে এবং  মাঝে মাঝে বিয়ে না করেও ব্যাংকক-পাতায়ার মৌতাতে বুঁদ হতে প্রায়ই লাপাত্তা হয়ে যায়। 

বসাক লেনের নিজের বাড়ির একটি রুম ওর জন্য বরাদ্দ। সেখানে ঢুকলে মনে হবে এটা বুঝি ফাইভ-স্টার হোটেলের ডিলাক্স রুম। আনন্দ-আয়োজনের সব মেলে ওর রুমে।

সকালবেলায় শেয়ার কেনাবেচা আর সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে যেখানেই থাকুক, মিষ্টির দোকানে সশরীরে হাজির হয়ে ঠিকই হিসাব বুঝে নেবে ম্যানেজারের কাছ থেকে। ওর বাবা আনন্দ ঘোষও মাঝে মাঝে দোকানে এসে বসেন। তবে তা খুবই অনিয়মিত। শরীরের শত্রুতার কারণে ছেলের ওপরই নির্ভর করতে হয় তাঁকে।

এমন এক রাজীব ঘোষের ওপর সহসা কথা নেই বার্তা নেই অথৈ পরমানন্দ চেপে বসেন। রাজীব ঘোষ চালু ছেলে। 888sport appয় জন্মকর্ম। চিঠিটা পেয়ে প্রথমেই ভাবতে শুরু করে, এ-চিঠি কার লেখা? ওর যারা বন্ধুবান্ধব, এরা কোনোকালেই এমন চোস্ত ভাষায় কথা বলার মানুষ নয়। ‘আবে কই যাছ? মদনার বিয়াত গেলি না ক্যালা? সুলেমান বাবুর্চির কাচ্চিটা যা অইছে না, মায়রে বাপ, মিস করছস হালায়’ – এভাবে কথা বলা যাদের নিত্য অভ্যাস, তারা কীভাবে এমন মোলায়েম সুরে ও বাণী দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইবে?

এ-ধরনের সম্ভাবনা নাকচ করে দেয় রাজীব। প্রথমে ভেবেছিল সে বুঝি একা। পরমানন্দের পুষ্পবৃষ্টি বুঝি ওরই ওপর বর্ষিত হচ্ছে। কিন্তু কিছুদিনের ভেতর সে টের পেল, এরকম হাজারটা রাজীব পরমানন্দের নীল সরোবরে মাছের ঝাঁকের মতো কিলবিল করছে। এ-888sport free betয় কোনো বুড়ো-বুড়ির অস্তিত্ব নেই। সবাই তরুণ। বয়স রাজীবের কাছাকাছি অথবা কিছু কম।

ফেসবুকে একজন মন্তব্য করলেন, ‘অথৈ পরমানন্দ হলেন এক অখণ্ড সচ্চিদানন্দের রূপ। এর কোনো দেহকাণ্ড নেই। এ শুধুই এক অনুভব। উপলব্ধির ভেতর লুকিয়ে রয়েছে পরমানন্দের প্রকৃত আস্বাদ।’

অন্যজন বলল, ‘অথৈ পরমানন্দ হলেন এক তৃপ্তির নাম। প্রবহমানতার ভেতর যাঁকে খুঁজে বের করতে হয়।’

আরো একজন মন্তব্য করলেন, ‘উনি কোনো স্বঘোষিত মহান ব্যক্তি নন। তিনি নতুন এক দর্শনশাস্ত্রের রূপকার, পরমানন্দ তত্ত্বের মূল হোতা। এ নির্বাণ নয়। এ মোক্ষ নয়। এ মায়াও নয়। এ হলো প্রশান্তিতত্ত্ব। শরীরের মতোন মনকেও নির্মেদ রাখো। তবেই না প্রাণের ভেতর পুষে রাখতে পারবে প্রশান্তি। ঝরঝর মুখর বাদলধারা – প্রশান্তি। প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়ছে জগৎ – তা-ও প্রশান্তি।

চোখের সামনে বরফ ভাঙছে, নদীর পাড় ধসে পড়ছে, পাহাড় দিশাহারা হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে – সব প্রশান্তি। যখন সব পরিস্থিতির গভীরে অবগাহন করে প্রশান্তির দেখা মিলবে তখনই পৃথিবী থেকে হিংসা-দ্বেষ-গ্লানি পরশ্রীকাতরতা-হিংস্রতা-অবসাদ ও হতাশা সব দূর হবে। পরমানন্দ তখনই চোখের সামনে মেঘের ভেলার মতো ভাসতে থাকবেন। তিনি পূর্ণ হবেন যখন মানুষ পূর্ণ হবে এক অনির্বচনীয় নৈর্ব্যক্তিক পরমানন্দময় প্রশান্তিতে!’

রাজীব ব্যবসায়ী ছেলে। সবকিছুতেই একটা সন্দেহ থেকে যায়। কাউকে যে শতভাগ বিশ্বাস করা কঠিন, তিরিশ বছরের আয়ুষ্কালে সে এসব ভালোই বুঝে নিয়েছে। একবার মনে হলো, এ-ব্যাটা 888sport appsের নয়, সে নিশ্চয়ই অন্য কোনো দেশের চতুরালি জানা বেকার এক যুবক। কোনো কাজকর্ম নেই। বসে বসে মোরগ বানাচ্ছে সবাইকে। শালা ধুরন্ধর। হঠাৎ একদিন একটা অ্যাকাউন্ট দেখিয়ে বলে উঠবে, মানুষ বিপদাপন্ন। তাকে সাহায্য করো। এই রইল অ্যাকাউন্ট নম্বর আর এই রইলে তোমরা। ফেলতে থাকো কড়ি।

একবার মনে হলো, লোকটা কোনো সৃজনশীল পণ্ডিত। এককালে রবীন্দ্রনাথের মতো শ্মশ্রুধারী কবি হতে চেয়েছিল। এখন সেই আবেগ তিরোহিত; চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া ব্যর্থ এক মানুষ। তারই মাথা থেকে শব্দগুচ্ছ বেরোচ্ছে। কম বয়সের 888sport promo codeরূপের মোহের মতো অন্যকে নিজের দিকে আকর্ষণ করার এক পাগলামো এটি। হয়তো একদিন ঠিকই বেরিয়ে পড়বে তার কথা।

পরক্ষণে মনে হলো, এদেশের কোনো 888sport free betলঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীর কজন দুষ্ট প্রৌঢ়ের এ-কাজ। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে তার মাথায় একদিন কাঁঠাল ভাঙার চিন্তা এদের।

প্রতি পদে এরকম সন্দেহ ও অবিশ্বাস খোঁচাখুঁচি শুরু করে দিলেও ভেতরে একরকমের উড়ু-উড়ু আকর্ষণ থেকেই যায়। এতো নরোম, এতো কোমল, এতো মোলায়েম যাঁর কথা, তাঁকে কি সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দিতে পারে রাজীবের মতো মানুষ? মানুষ তো সে-ই যার নানারকম সূত্র ছড়িয়ে থাকে নানাখানে, নানাখানে আটকে থাকে জীবনের নানা অনুষঙ্গ, একটা অংক মিলে গেলে অন্যটা অসম্পাদিত পড়ে থাকে, যা লেখা যায় তা সামান্য, যা লেখা যায় না তা প্রকৃতির মতো রং বদলায় যখন-তখন। এতোসব চক্রব্যুহ সমস্যার ভেতর নিরবধি বসবাস করে কীভাবে অস্বীকার করবে পরমানন্দকে?

এরই ভেতর আরো একটি বাণী ভেসে এলো ওর মেসেঞ্জারে। ‘হে তমাল তরুণ, মন কি উতলা তোমার? সন্দেহ কি চড়ুই হয়ে তোমার ভেতর অথৈ পরমানন্দকে উত্ত্যক্ত করে চলেছে? একবারটি নদীর তীরে যাও। ঘন বর্ষণের পর ভেজা কোনো গাছতলায় দাঁড়িয়ে তাকাও প্রবাহের পানে। আমার আমিকে ত্যাগ করো, পরমানন্দের অথৈ রূপের সঙ্গে নিজেকে মিলাও, প্রবেশ করো গহিনে। চোখ বুঁজে শুধু বলো, আমায় ক্ষমা করো। আমায় গ্রহণ করো। আমায় নিমজ্জিত করো, লীন করো তোমার  প্রশান্ত তরঙ্গরাশি আর মৃদুমন্দ সমীরণের গভীরে। দেখবে উদ্ভ্রান্ত সত্তা শান্ত হবে। সবাইকে বিশ্বাস করতে শিখে যাবে। কাউকে আর সন্দেহের তীর মারতে ইচ্ছে হবে না কোনোদিন।’

এসএমএসটি রাজীবকে কেমন হতবাক করে দিলো। কেমন একটু লজ্জাও লাগল। ইদানীং ওর স্বভাবটাও হয়েছে কাকের মতো। শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নেয়, ধারেকাছে কেউ কিংবা কিছু রয়েছে কি না। ব্যাংকের হিসাব নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গেলে ব্যাংকের লোকদের প্রতি সন্দেহ জাগে। মেরে দিচ্ছে নাকি? বিমানের টিকিট কাটতে গেলে পইপই করে লক্ষ করে, ঠকে গেল না তো? কোনো অপরিচিত মানুষ পাশের সিটে বসে থাকলেও কেমন যেন উচাটন শুরু হয় ভেতরে। লোকটা কোনো ঠগবাজ নয় তো? সরকারি কর্মকর্তাদের ফাঁকিবাজ অর্থলোভী লাগে। বাজারে গেলে দোকানদারকে ভণ্ড-প্রতারক ভেবে গলাবাজি করে যখন-তখন।

এই কদিনে বেশ কতগুলো বিয়ের আলাপ আসতে শুরু করেছে। নিয়মানুযায়ী বন্ধুবান্ধবের দল নিয়ে কনের মুখ দেখতে গেছে। কনের বাপের টাকায় কব্জি ডুবিয়ে খেয়েদেয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু এ-পর্যন্ত একজনার বেলাতেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ হয়নি। কেবলই মনে হয়েছে, কোথাও একটা গণ্ডগোল রয়েছে। সে ঠিক ধরতে পারছে না।

মা বললেন, ‘তোর কপালে মাইয়া জুটব না।’

‘না জুটলে না জুটুক। তবু ঠকতে পারুম না। দুদিন মন খারাপ করা ভালো। সারাজীবন চোখের জলে বালিশ ভিজানোর পক্ষে আমি না।’

এ শুধু কনেদের বেলায় নয়, সবক্ষেত্রেই তা ঘটছে। ব্যাংকক, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, বালি, মালদ্বীপ, ভারত যেখানেই সে পা রেখেছে, মনে হয়েছে, সবার হাতে একটা করে গোপন অদৃশ্য ছুরি রয়েছে। একটুখানি এদিক-সেদিক হলে সোজা ওর ভুঁড়ি বরাবর বসিয়ে দেবে। দেশে এলে এ-অনুভব যেন শতগুণে বেড়ে যায়। সবাইকে শুধু ঠক-বাটপার চোর-জোচ্চোর
খুনি-ডাকাত বলে মনে হয়। শেয়ার কেনাবেচার মতোই ওর ভেতর এক অনিয়ন্ত্রিত অবিশ্বাস কাজ করে। সে এর ভেতর নিজেরই অজান্তে ধরা পড়ে যায়। আঠায় আটক ইঁদুরছানার মতো তখন আর কিছু করার থাকে না। সে নিরুপায়, অসহায়। বিশ^াস করতে পারে না কাউকে।

এসব অন্তর্নিহিত কথা এই পরমানন্দ জানলেন কী করে? বিস্ময় জাগে রাজীবের অন্তরে। সে ফেসবুক গ্রুপে প্রশ্ন করে, ‘আমার মনের কথা অথৈ পরমানন্দ কী করে জানেন?’

সঙ্গে সঙ্গে শত শত বিশ্বাসীর ঝরঝর মুখর আবেগঘন সব উত্তর এসএমএস হয়ে ভেসে আসতে লাগল। এরা সবাই নিজেদের এক-একজন অথৈ পরমানন্দের লৌকিক রূপ বলে ভাবে। যেসব ছবি রাজীবের প্রশ্নের উত্তরে দেখা যাচ্ছে, এর সবগুলো চিত্তাকর্ষক প্রকৃতির নানা দৃষ্টিনন্দন ছবি।

নীলাকাশ-সমুদ্র-বনানী-পাহাড়-মরুভূমি-ঝর্ণাধারা – সব রয়েছে। এর সঙ্গে মিশে রয়েছে অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের মতো মানুষের মুখাবয়বের অর্ধস্ফুট অভিব্যক্তি।

আর মন্তব্য তো গোনাগুনতিহীন। ওর প্রশ্ন পেয়ে সবাই ওকে  যেন পেয়ে বসেছে। উজ্জীবিত বোধ করছে ওকে জ্ঞান দিতে পেরে। এমন বীজক্ষেত্র যেন আর দুটি নেই এ পরমানন্দের জগতে!

‘তিনি আপনার মনের কথা কেন জানবেন না? তিনিই তো সর্বজ্ঞ। তাঁর মর্জিতেই তো আপনি চলেন। পরের জাগা পরের জমিন ঘর বানাইয়া আমি রই। আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।’  

একজন বললেন, ‘তিনি যা বলার তা জানিয়ে দিলেন। এবার আপনি মনুষ্য জ্ঞান ও চিন্তা দিয়ে বাকিটা গড়ে তুলবেন। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তো আপনি কেবল পুতুল। কারসাজি সব তাঁর।’

রাজীব মহাবিরক্ত। সে ব্যাংককের এক নামজাদা ম্যাসাজ পার্লারে ফ্রুট-ম্যাসাজ নেওয়ার সময় পর্যন্ত এসব পরমানন্দগণ ফোন করে বসে ওর হোয়াটসঅ্যাপে। জড়িত গলায় ‘কে’ বলে প্রশ্ন করতেই উত্তর আসে, ‘আজ্ঞে, আমি অথৈ পরমানন্দ।’

মাঝে মাঝে খনখনে গলায় কমবয়সী মেয়েরাও নিজেদের অথৈ পরমানন্দ পরিচয় দিয়ে টেলিফোন করে। একদিন ব্যবসায় মহাঝামেলা বেধেছে। শেয়ার মার্কেট শুধুই নিচের দিকে নামছে। ওর পরিচিত এক লোক দুশ্চিন্তায় স্ট্রোক করে হাসপাতালে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে এক পরমানন্দময়ীর আগমন। একই প্রশ্ন, একই সুর, ‘কীভাবে সময় যায় পরমানন্দর, জানতে পারি কি?’

‘শোয়াশুয়ি করে।’ একরাশ উষ্মা নিয়ে ঝাঁঝালো গলায় রাজীব উত্তর শানিয়ে বসে।

‘হি হি হি। তবু প্রশান্তিতে থাকুন।’ বলে লাইনটা কেটে দিলো মেয়েটি।

আরেকদিন আরো একটি ফোন, ‘আমি বদরুন্নেছা কলেজের পরমানন্দময়ী শুভ্রা। আপনার সময় কি স্থির, পরমানন্দ?’

‘হ্যাঁ, বরফ। আপনি কি বরফের কল নাকি হাঁপর?’

মেয়েটি রেখে দিলো ফোন। এরপর শুরু হলো পুরুষের ফোন। তারা আরো মোলায়েম, নতজানু এবং ন্যাকা।

এককথায় রাজীবের কাছে লাগে অসহ্য রকমের বিরক্তিকর। প্রযুক্তি ও মানবতার যুগে এসব পুরনো বস্তাপচা আধ্যাত্মিকতার চর্চা ওর ভালো লাগে না। সে চায় যৌবনকে ধরে রাখতে, ভোগের পদতলে নিজেকে উজাড় করে দিতে। একটাই জীবন ও জন্ম; একে কেন মানুষের শেখানো বুলি দিয়ে ধ্বংস করবে?

রাজীবের বাবা মারা গেলেন। এ-মৃত্যু সবারই কাম্য ছিল। কেননা, শেষদিকে তিনি প্রস্টেট ক্যান্সারের কষ্ট আর সহ্য করতে পারছিলেন না। মাঝে মাঝে চিৎকার দিয়ে বলে উঠতেন, ‘ভগবান দয়া করো। আর সহ্য হয় না।’

মা এসে পাশে বসলে আরো ক্ষেপে উঠতেন। রক্তচোখ করে তাকে ধমকে উঠতেন, ‘দূর হ কালনাগিনী। তোরে আর সহ্য হয় না।’

রাজীবের বুড়ো মা সিঁটিয়ে থাকতেন সারাক্ষণ আর চোখের জল ফেলতেন নীরবে। সারাজীবন বাবাকে দেখেছে মাকে দাসী-বাঁদীর মতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে। তবু এ-মহিলাই ঘরের সবচাইতে উপাদেয় খাবারটা বাবাকে নিবেদন করে নিজে ধন্য হতেন। কোন মায়ার টানে, কে জানে। এর কোনো মানে হয়?

বাবার মৃত্যুর পর মাকে মনে হলো অনেক বেশি স্বস্তিতে রয়েছেন। না বললেও রাজীব ঠিক বুঝতে পারতো।

অশৌচ চলাকালে হঠাৎ করেই 888sport app শহরটা নড়ে উঠল। নড়বড়ে বাড়িগুলো ধসে গেল। আর্তচিৎকার আর ভয়ে সারারাত কেউ ঘুমাতে পারল না। একটা বিভীষিকাময় অন্ধকার যেন সবার দিকে তেড়ে আসছে। মৃত্যুচিন্তা যে এমন সর্বগ্রাসী ও ভয়ংকর হয় তা সেদিনই বুঝতে পারে রাজীব। সে ভয় পেয়ে ওর সাজানো কক্ষের লাখ টাকার খাটের নিচে আশ্রয় নিয়েছিল। শরীর বাঁশপাতার মতো কাঁপছিল।

এরকম দুঃসময়েও একটি মেয়ে ওর মোবাইলে কোকিলকণ্ঠে বলে উঠল, ‘ভয় নয় অথৈ পরমানন্দ। প্রশান্তিতে থাকুন। কেবল হৃদয়ে প্রশান্তির পাখিরা উড়ে বেড়ালেই আপনি স্থির ও সহনশীল হবেন।’ লাইনটা কেটে গেল।

বছরখানেকের মাথায় ওর চেয়ে বছর দশের ছোট একটি মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নিল রাজীব। বাসররাতে ঘোমটা তুলতেই মেয়েটি মুচকি হেসে বলে উঠল, ‘কেমন আছেন অথৈ পরমানন্দ? আমি আপনার পরমানন্দময়ী। ভূমিকম্পের সময় আমিই ফোন দিয়েছিলাম। মনে পড়ে?’

সঙ্গে সঙ্গে রাজীব চমকে উঠল। শরীরের পরতে পরতে অজানা এক শিহরণ খেলে গেল। সে লজ্জা পাবে কি রেগে গিয়ে চিৎকার করতে শুরু করবে কিছুই বুঝতে পারে না।

দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে কাকে যেন একটা গালি দিয়ে বলে উঠল, ‘শালা অথৈ, শেষ পর্যন্ত আমারেও গেঁথে ফেললি?’

কাকচক্ষু জলের মতো পরমানন্দময়ীর দৃষ্টি টলোমলো, পড়ন্ত বিকালের রহস্যের খানিকটা ছায়া পড়েছে সেখানে। হাসিমুখে তাকিয়ে রয়েছে ওরই দিকে।