অনাবৃত

মাহবুব তালুকদার

Onabrito

নাজিয়ার সঙ্গে আর্ট কলেজে গিয়ে দেখা হয়ে যাবে, এমন অবস্থার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। কারো সঙ্গে দেখা হওয়ার জন্য আসলে কোনো প্রস্তুতি থাকে না। তবু তিন বছর পর এভাবে দেখা হতে আমি অপ্রস্তুত হলাম।

এক বন্ধুর চিত্রপ্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলাম। যেতে দেরি হওয়ায় ততক্ষণে দ্বারোদ্ঘাটনের ফিতা কাটা হয়ে গেছে। লোকজন ভিড় করে বিভিন্ন ছবির প্রতি ঔৎসুক্য বা অবহেলা প্রকাশ করছে। দু-চারজন সুন্দরী মহিলার উপস্থিতি এসব অনুষ্ঠানের অপরিহার্য অঙ্গ। তারা ছবি দেখতে আসে, না নিজেদের দেখাতে আসে, বোঝা দুষ্কর। তবু তারা না হলে পরের দিনের পত্রিকায় চিত্রপ্রদর্শনীর সচিত্র প্রদর্শন হয় না। এদের পেছনে আবার উঠতি বয়সের একদল যুবক থাকে, যারা ছবি দেখার বদলে এদের দেখতেই বেশি ব্যস্ত।

যিনি ফিতা কেটেছিলেন, তিনি ওপর তলায় সপারিষদ চা খেতে গেলেন। ফলে ভিড় কিছুটা কমে এলো। 888sport live chatী বন্ধুটির খোঁজ করতে গিয়ে মনে হলো, তিনি প্রধান অতিথির আপ্যায়নে এখন নিশ্চয় ব্যাপৃত। তাকে বিঘ্নিত না করে তার চিত্রকর্ম দর্শনেই মনোনিবেশ করা অধিকতর শ্রেয়। পরিচিত অন্য কাউকে না পেয়ে আমি একাকী নিজেকে একজন প্রকৃষ্ট চিত্ররসিক হিসেবে ভাবতে চেষ্টা করলাম।

নাজিয়া যে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, সেটা প্রথমে লক্ষ করিনি। ওর শাড়ির আঁচলটুকু একনজর দেখেছিলাম। বিপরীত দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকায় চেহারা দৃষ্টিতে পড়েনি। একজন উশকোখুশকো চুলের যুবক ওর দিকে ক্যামেরা তাক করে বলছিল, একটু মিষ্টি করে হাসুন, প্লিজ!

কেন! হাসতে হবে কেন?

আপনার একটা ছবি তুলব।

পেইন্টিংয়ের ছবি তুলুন, আমার হাসির ছবি তোলার দরকার নেই।

বুঝতে পারছেন না। আগামীকালের পত্রিকায় –

তাতে আমার কী? নাজিয়া উলটোদিকে মুখ ফিরিয়ে নিতেই আমার চোখে চোখ পড়ল, আরে তুমি!

হ্যাঁ, আমি। অনুচ্চকণ্ঠে বললাম।

এরপর নাজিয়া কী বলবে আর আমি কী বলব, কিংবা কী বলা উচিত হবে আমার, সেটা নিরূপণ করা কঠিন। তিন বছর সময়ের হিসাবে যদিও খুব বেশি নয়, তবু নাজিয়ার সঙ্গে এখন আমার দূরত্ব অনেক। আমাদের দুজনের মাঝখানে যে বিশ্বাসভঙ্গের দেয়াল, নাজিয়া তাকে ডিঙাবে কী করে? সেই অদৃশ্য দেয়ালের এপাশে দাঁড়িয়ে আমিই-বা কীভাবে সহজ হতে পারব? আমার প্রতিক্রিয়া কি এখন ব্যবধান বাড়ানো না কমানো, স্থির করতে পারলাম না।

বিদেশ থেকে কবে ফিরলে?

দিনসাতেক।

জানো, আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছি। তুমি বিদেশে গেছ জানতে পারলেও ঠিকানা জোগাড় করতে পারিনি। নাজিয়া আরো কাছে এগিয়ে এসে বলল, এখানে অনেক ভিড়। চলো, বাইরে যাই।

তিন বছরের পুঞ্জীভূত অভিমান আমার মধ্যে। বলতে পারতাম, তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য কোনো নির্জনতার প্রয়োজন আমি বোধ করি না। হয়তো বলতাম, এতদিন পরে বিশ্বাসভঙ্গের সাফাই শোনার অবকাশ আমার নেই। কিংবা একান্তভাবে কথা বলার আর কী অবশিষ্ট আছে আজ? এরকম কিছু বললে বেশি বলা হতো না। অথচ আমার কণ্ঠে কোনো স্বর ফুটল না। আমি নিঃশব্দে ওকে অনুসরণ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

আর্ট কলেজের প্রাঙ্গণে বেশ গাছগাছালির ছায়া। চারপাশে কয়েকটা স্ট্যাচু সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কোনোটা বিমূর্ত 888sport live chatের নিদর্শন, কোনোটা অমূর্ত 888sport live chat। নাজিয়া একটির সামনে দাঁড়িয়ে ওটার দিকে চোখ রেখে বলল, তোমাকে কেন খুঁজেছিলাম, জানো?

বিয়ের দাওয়াত দিতে নিশ্চয়ই।

এবারে মুহূর্তে আমার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকিয়ে থাকল সে। বলল, তুমি আমার ওপর এখনো রেগে আছ?

রাগ করার মতো সম্পর্ক তোমার সঙ্গে আমার নেই।

তুমি কি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করতে পারো না?

বিশ্বাসভঙ্গের কিসে ক্ষমা হয়, আমি জানি না।

এ ধরনের রূঢ়তা তোমার আগে ছিল না।

তাহলে বলতে হবে কারো কাছ থেকে শিখেছি। আমার প্রতি এটা কারো ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া।

একটা স্ট্যাচুর আড়ালে গিয়ে নাজিয়া আমার হাত চেপে ধরল, আমাকে এভাবে অপমান করো না, প্লিজ!

এরপরে আমার ক্ষান্ত হওয়ার অবকাশ ছিল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিতে পারলাম না। বললাম, ব্যাপারটা নাটকীয় হয়ে যাচ্ছে নাকি? তোমার নাটক-ফাটক করে অভ্যাস আছে। কিন্তু আমি নাটকীয়তা বিশেষ পছন্দ করি না।

নাজিয়া আমার হাত ছাড়ল, আমি আর আজকাল নাটক করি না। নাটকের সঙ্গে সম্পর্ক চুকে গেছে।

নাটকের সঙ্গে নাজিয়ার সম্পর্কচ্ছেদ হয়েছে, এ-তথ্য জানা ছিল না। ওর ওপরে যত রাগই থাকুক না কেন, এক সময়ে সব রাগ গিয়ে পড়েছিল নাটকের ওপর। আমি নিজেও ওসব ব্যাপার চুকিয়ে-বুকিয়ে দিয়েছি। আমার নাটক লেখা নিয়ে নাজিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করতে গিয়ে নাজিয়ার পরিচয় হয়েছিল ফরহাদের সঙ্গে। আর ফরহাদ নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে নাজিয়াকে সরিয়ে নিয়েছিল আমার কাছ থেকে। নাটক যেন সমস্ত ঘটনার মধ্যে গ্রিক নিয়তির দেবীর মতো অলক্ষে ফাঁদ পেতে বসেছিল।

ছোটবেলা থেকে অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল নাজিয়ার। কৈশোরে বিভিন্ন নাটকে অংশগ্রহণ করে সে 888sport app download bd পেয়েছে। নাটকের ব্যাপারে আমারও উৎসাহ-উদ্দীপনা কম ছিল না। সেই সূত্রে ওর সঙ্গে পরিচয়। আমরা যখন কজন মিলে গ্রুপ থিয়েটার গঠন করি, নাজিয়াকে আমাদের দলে যোগ দিতে আমি অনুরোধ জানিয়েছিলাম। নাজিয়া সেই অনুরোধ রক্ষা করেছিল। মহিলা সমিতি মিলনায়তনে আমাদের প্রথম নাটকে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিল নাজিয়া। বলা বাহুল্য, সে-নাটক আমার লেখা। গ্রামবাংলার এক স্বামী-নিপীড়িত 888sport promo codeর দুঃখময় জীবনের ইতিকথা। স্বামীটি ছিল মদ্যপ, দুশ্চরিত্র ও পর888sport promo code-আসক্ত, যা হয় আর কি! নাটকটির মধ্যে শরৎচন্দ্র-টাইপের কিছু কান্নাকাটির অবতারণা করেছিলাম, যাতে দর্শকরা, বিশেষত মহিলা দর্শকরা চোখের পানি ফেলার সুযোগ পায়। আমার লেখায় কী ছিল জানি না, কিন্তু নাজিয়ার অভিনয়ে এক ভাগ্যহত অসহায় বঞ্চিত 888sport promo codeর মর্মবেদনা জীবন্ত হয়ে উঠত। আমাদের দলের অপূর্ণতা বা ব্যর্থতা যা-ই থাকুক না কেন, সবকিছু মিলে দর্শকদের কাছে আমরা উতরে যাচ্ছিলাম।

আপনার মধ্যে কোনো প্রেম-ট্রেম নেই? নাজিয়া একদিন গ্রিনরুমে বলছিল।

আমি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম ওর কথা শুনে। তখন আশপাশে অন্য কেউ ছিল না। পুরো মেকআপ নিয়ে পরবর্তী দৃশ্যের অভিনয়ের জন্য নাজিয়া অপেক্ষা করছিল। কখনো বিড়বিড় করে আবৃত্তি করছিল ওর পার্ট। এ-সময়ে নাজিয়া এমন একটা কথা বলবে, ভাবতে পারিনি। আমার অপ্রস্তুত ভাব লক্ষ করে আরেকটু বিমোহিত হয়েছিল নাজিয়া। বলেছিল, খুব ঘাবড়ে গেলেন বুঝি?

আমি ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে যথেষ্ট সপ্রতিভ করে তুলেছিলাম, প্রেম আছে কি নেই, আপনি কেমন করে বুঝবেন?

শুধু আমি কেন, সবাই বুঝতে পারবে। আপনার নাটকে আছে, শুধু হাসি, নয় কান্না। আপনি হাসানো বা কাঁদানোর জন্য নাটক লিখেছেন। এ-দুটো ছাড়া মানুষের আরো অনুভূতি আছে। তা কি বোঝেন?

নিজেকে ভারি নির্বোধ মনে হয়েছিল নাজিয়ার কথার পর। প্রেম বলতে নাটকের প্রেমের কথা বোঝাই সংগত ছিল আমার। অথচ আমি কিনা ওটা সিরিয়াসলি ভেবে বসলাম। নিজের চিন্তার দৈন্যদশায় মনে মনে ভর্ৎসনা করলাম নিজেকে।

একটা নতুন নাটক লিখুন না। যাতে প্রেম থাকবে, রোমান্স থাকবে।

প্রেম আর রোমান্স থাকলেই বুঝি নাটক হয়?

তা কেন হবে? আপনাকে নাটকের বিষয়বস্তু বলে দেওয়ার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে সাধারণত নায়িকারা রোমান্টিক দৃশ্যে অভিনয় করতে বেশি ভালোবাসে। আপনার এই নাটকে একটিও প্রেমের দৃশ্য নেই। একটু যে সাজগোছ করে দু-চারটা মধুর সংলাপ শোনাব, তেমন ভাগ্য হলো কই?

ওসব কথা নাটক থেকে মুখস্থ না বলে মনে মনে বানিয়ে বললেই  হয়।

তাহলে আপনাদের ডিরেক্টর আর প্রম্পটার আমাকে আস্ত রাখবে না।

আমি নাটকের কথা বলছি না, নাটকের বাইরের কথা বলছি।

তার মানে স্টেজের বাইরে অভিনয় করতে বলছেন?

অভিনয় ছাড়া আপনি আর কিছু বোঝেন না? এর বাইরে আর কি কোনো জীবন থাকতে নেই মানুষের?

আছে। কিন্তু আমি সে-কথা ভাবি না।

কেন?

আমার ভয় হয়, আমি অভিনয় করি বলে সবাই আমার কথাগুলোকে ছলাকলা মনে করবে কি না! কেউ হয়তো আমাকে ভুল বুঝবে।

এসব ভয় অমূলক। কোনো কারণ নেই।

নাজিয়া নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। কী দেখছিল সে-ই জানে। একসময় চোখ নামিয়ে নিয়েছিল।

সেই থেকে শুরু। ক্রমে নাজিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দিনে দিনে ঘনিষ্ঠতর হয়েছিল সে-সম্পর্ক। নাজিয়ার কথায় আমি নাটক লেখায় মনোনিবেশ করেছিলাম। দুটি হৃদয়ের প্রেম-ভালোবাসা ছিল আমার নাটকের প্রধান উপজীব্য। পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে নায়ক-নায়িকার প্রেম এতটুকু মলিন হয়নি, বরং পারিপার্শ্বিকতার আঘাতে ঔজ্জ্বল্য লাভ করেছে। বলা বাহুল্য, নাজিয়ার জন্য আমার অন্তরের যত আকুতি, যত উদ্বেলতা, ওই নাটকের নায়কের মধ্যে প্রকাশ লাভ করেছিল। আমার প্রাণে সঞ্চিত সব আবেগ নাজিয়ার মনে সঞ্চারিত করার জন্য নাটকের চরিত্র ছিল প্রধান অবলম্বন। এহেন ব্যক্তিগত আবেগানুভূতিপূর্ণ নাটক যে মেলোড্রামা হয়ে যাবে, তাতে আর সন্দেহ কি? তবে মেলোড্রামাও অনেক সময় সাফল্য পেতে পারে যদি 888sport app ট্রিটমেন্ট যথাযথ হয়। সেদিক থেকে আমার নাটক মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেল। বিশেষ করে নাজিয়া খুব উৎসাহ বোধ করল নাটকের ব্যাপারে। লেখা হয়ে যাওয়ার পর আমি তাকে পড়তে দিয়েছিলাম। নাজিয়া আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আমি জানতাম, তোমার হবে।

কিন্তু নাটকই আমার কাল হলো অবশেষে। আমাদের গ্রুপ থিয়েটারের পরবর্তী আকর্ষণ হিসেবে আমার নাটকের নাম বিজ্ঞাপিত হয়েছিল। কিন্তু রিহার্সেলে গিয়ে দেখা গেল নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করার মতো কেউ আমাদের গ্রুপে নেই। আগে যে নায়ক হয়েছিল, তাকে দিয়ে আর যা-ই হোক, রোমান্টিক ভূমিকায় অভিনয় করানো চলে না। আমি নিজেকে মনে মনে ওই নাটকের নায়ক হিসেবে কল্পনা করলে কী হবে, অভিনয়-ক্ষমতা আমার আয়ত্তের একেবারে বাইরে। নায়কহীনতার দৈন্যে আমরা যখন গভীর হতাশায় নিমজ্জিত, তখন ফরহাদ আমাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হলো। বড়লোকের একমাত্র ছেলে ফরহাদ। চেহারায় ও চললে-বলনে সার্বক্ষণিক নায়ক সেজে আছে যেন। অভিনয়-প্রতিভাও তখন তার মধ্যে সদ্যজাগ্রত। টিভিতে দু-একটি ছোটখাটো ভূমিকায় তাকে দেখা গেছে এবং বড়সড় ভূমিকার দিকে সে পা বাড়িয়ে আছে। তাকে পেয়ে আমাদের গ্রুপ থিয়েটারের সদস্যবর্গ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া নয়, নিজেরাই চাঁদের কাছে পৌঁছে গেল। নতুন উদ্যম ও উৎসাহ নিয়ে আমার নাটকের মহড়া চলতে লাগল।

গ্রুপ থিয়েটারের আমি তেমন কোনো অ্যাকটিভ সদস্য নই। পরপর আমার নাটক মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে বলে ওদের দলে আমার নাম শিখরে। কিন্তু লেখার পরে সেটার পেছনে লেগে থাকতে আমার কখনো ভালো লাগে না। রিহার্সেলে খুব একটা যাইনি আমি। নাজিয়ার কাছে মাঝে মাঝে খবর নিয়েছি। কিন্তু ওর সঙ্গে আমার বেশিরভাগ সময় কেটেছে পার্কে-রেস্তোরাঁয় বা টেলিফোনে আলাপ করে।

স্টেজ রিহার্সেলের দিন আমি উপস্থিত হলাম। ইচ্ছা হয়েছিল গ্রিনরুমে গিয়ে নাজিয়ার সঙ্গে আলাপ করব। পরে মনে হলো দর্শকের আসনে বসে পুরো নাটকটা দেখা প্রয়োজন। কোনো ভুলভ্রান্তি থাকলে তা সংশোধন করা যাবে। কিন্তু নাটক শুরু হওয়ার পর প্রতিটি সর্গ-উপসর্গ আমার কাছে যন্ত্রণাদায়ক মনে হলো। নাজিয়া ও ফরহাদের প্রেমলীলার প্রতিটি দৃশ্য অসহ্য ঠেকল আমার কাছে। যেসব মধুর আবেগপূর্ণ সংলাপ আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে উৎসারিত হয়েছিল, তা যেন কোনো ভিলেনের মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। মনে হলো, ফরহাদ বুঝি রোমান্টিক ডায়ালগগুলো বলতে গিয়ে স্টেজ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে বিদ্রƒপ করছে। আমারই বানানো-শানানো ছুরি দিয়ে সে যেন আমার বুক টুকরো টুকরো করে কেটে দিচ্ছে।

রিহার্সেলের শেষে নাজিয়া কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কখন এলে?

অনেকক্ষণ।

সবটুকু দেখেছ? কেমন লেগেছে নাটক?

ভালো।

ফরহাদ বেশ কো-অপারেটিভ। তবু লাভসিনগুলো করতে আমার কাছে বড় অস্বস্তি লাগে। বারবার তোমার কথা মনে হয়।

তাই নাকি?

তোমার ডায়ালগগুলো ভারি মিষ্টি। ঠিক তোমার নিজের কথার মতো। তুমি যেমন করে আমার সঙ্গে কথা বলো।

হবে হয়তো।

তোমাকে অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে তোমার?

কিছু না।

একবার ইচ্ছা হয়েছিল, নাজিয়াকে সব খুলে বলি। ওকে জিজ্ঞাসা করি, প্রেমের দৃশ্যে অভিনয় করতে অতই যদি অস্বস্তি তোমার, তাহলে ফরহাদের বুকের ওপর ওভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লে কেন? কেন দীর্ঘ সময় ধরে ফরহাদের আলিঙ্গনাবদ্ধ থেকে ভালোবাসার

কথা বললে? ফরহাদ যে আদর করার ছলে তোমার ওপর সুযোগ নিচ্ছিল, তা-ও আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। তুমি কেন সেসব সহ্য করলে? কথাগুলো বলতে গিয়ে আমার কণ্ঠে বাকস্ফূর্তি ঘটল না। আমার নাটকে অমনই ভালোবাসার দৃশ্য ফোটাতে চেয়েছিলাম আমি। ওসব সংলাপ তো আমারই লেখা। অন্য কেউ নয়, আমি নিজে আমার সর্বনাশ ডেকে এনেছি। নাটকই শেষ পর্যন্ত আমার কাল হয়েছে।

জানো, ফরহাদ আজ আমাকে লিফট দিতে চাচ্ছিল। নাজিয়া বলল।

গেলেই পারতে। এমন ভাব দেখালাম, যেন আমার কিছু হয়নি।

কেন গেলাম না বলো তো?

আমি কী করে বলব?

তোমার সঙ্গে আজ রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়াব বলে।

মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিলাম ওর কথা শুনে। যে-কারণে আমি নাজিয়ার ওপরে অভিমান করছি, তা হয়তো নিতান্ত অমূলক। অভিনয়ের ব্যাপারটা তো আর সত্যি সত্যি করা নয়। এ জন্য ওকে দায়ী করা সংগত হবে না। নিজেকে অনেকভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলাম বটে, তবু একটা অদৃশ্য কাঁটা বুুকের ভেতর বিঁধে রইল।

রিকশায় চড়ে গুলশানের পথে যেতে যেতে নাজিয়া বলল, তুমি নিশ্চয় রাগ করে আছো। কেন তুমি মন খারাপ করেছো আমি জানি।

কেন?

ফরহাদের সঙ্গে অভিনয় করতে দেখে।

হতে পারে।

আচ্ছা, অভিনয় যে অভিনয়, এটুকু কেন বোঝো না? বয়েই গেছে আমার ওই লোকটার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করতে। তোমার নাটক বলেই তো করেছি। তুমি কি চাও, নাটকটায় অভিনয় না-করি?

কী জবাব দেব বুঝতে পারলাম না। চাই কি চাই না, আমি নিজেই জানি না।

তোমাদের গ্রুপ থিয়েটারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই নাটকের ওপর। অনেক অর্থ ও পরিশ্রম ব্যয় হয়েছে। এরপরও যদি তুমি চাও –

আমি তোমাকে অভিনয় করতে মানা করিনি।

নাজিয়া রিকশার মধ্যেই আমার হাত চেপে ধরে বলল, তুমি কিচ্ছু ভেব না। আমি তোমার আছি, তোমার থাকব।

আর কোনো ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই এরপর। নিজেকে বুঝিয়ে শান্ত করলাম। পারস্পরিক বিশ্বাস হচ্ছে ভালোবাসার ভিত্তি। সেটুকু নষ্ট করলে আর যা-ই হোক, ভালোবাসা থাকে না। তাছাড়া এই সামান্য ঔদার্য যদি না থাকে, তাহলে চলবে কেন? নাজিয়ার কাছে আমার মনের বিস্তৃতি প্রকাশমান হোক, হীনমন্যতা নয়।

নতুন একটা নাটক লেখায় মনোনিবেশ করলাম আমি। এ-নাটকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নায়কবিহীন নায়িকার চরিত্র। একজন নিঃসঙ্গ 888sport promo codeর প্রেম-ভালোবাসা, দুঃখ-শোক ও আনন্দ-অনুভূতি এবারের নাটকের বিষয়বস্তু। নাটকের অদ্বিতীয় চরিত্র হচ্ছে নায়িকা। অন্য চরিত্রগুলো নেপথ্য থাকবে, কথাবার্তা বলবে, কিন্তু মঞ্চে তাদের দেখা যাবে না। নতুন ধরনের এই নাটক সম্পর্কে আমি রীতিমতো উত্তেজিত বোধ করলাম। নাটকে আমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে সফল হবে, সে-সম্পর্কে আমি গভীর আশাবাদী। লেখা শেষ হতেই আমি ছুটে গেলাম নাজিয়াদের বাড়ি। ওকে পড়তে দিলাম। ভেবেছিলাম পরদিন সে আমাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানাবে। নাটকে তার সার্বিক উপস্থিতির কথা ভেবে আনন্দ বোধ করবে। কিন্তু নাজিয়ার প্রতিক্রিয়া ততটা উৎসাহব্যঞ্জক হলো না। পা-ুলিপিখানা আমার হাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে নাজিয়া বলল, নাটকটা ভালোই হয়েছে। তবে –

তবে কী?

একজনের মুখে পুরো সংলাপ কেমন যেন একঘেয়ে মনে হচ্ছে।

একঘেয়ে কোথায়? নিজেকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করলাম, আমি তো বরং প্রতিটি অধ্যায় নতুন নতুন নাটকীয়তা আরোপ করেছি।

তবু চরিত্রটি ঝুলে পড়েছে বলে আমার ধারণা।

নাটককে কি চিরকাল তোমরা সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রের আবরণে অবরুদ্ধ করে রাখবে? তাকে নির্দিষ্ট গ-ির মধ্যে কেন আবদ্ধ করবে! বিদেশে আধুনিক নাটক নিয়ে কত নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে, আমাদের দেশেও সেখান থেকে একটু আলো-বাতাস আসতে দাও। খানিকটা বিক্ষুব্ধচিত্তে আমি বললাম।

নাজিয়া আর কথা বাড়াল না।

গ্রুপ থিয়েটারের অন্য সদস্যরাও আমার নাটক নিয়ে উৎসাহ দেখাল না। ওদের অনেকের ধারণা, যেহেতু গ্রুপ নিয়ে কারবার, সেহেতু একক অভিনয়ের ব্যাপারটা অন্যদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারবে না। গ্রুপ থিয়েটার বলে গ্রুপের সবাইকে মঞ্চে চেহারা দেখাতে হবে আর কি। নাটকের প্রযোজনা, পরিচালনা, মঞ্চ-নির্দেশনা, ব্যবস্থাপনা বা আলোকসজ্জা – এদের গুরুত্ব যেন কিছু কম! দলের অন্য সদস্যরা এসব বিষয়ে দায়িত্ব নিলে নাকি তাদের গুরুত্ব কমে যাবে? আসলে সবাই যার যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। তাতে আঘাত লাগলে ওরা শুনবে কেন?

অবশেষে আমার নাটকটি নাকচ হয়ে গেল। মনে মনে কিছুটা মুষড়ে পড়লাম। নাটকটি দর্শকদের সামনে পরীক্ষিত হয়ে যদি নাকচ হতো, তাহলে বলার কিছু থাকত না। কিন্তু যারা এই বিয়োগান্তক ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের জ্ঞান-গরিমার ওপর আমার আস্থা নেই। এ জন্যই খারাপ লাগল বেশি।

গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে ওখানেই আমার সম্পর্কের ইতি। নাজিয়াও যে আমার পথ অনুসরণ করবে, সে-বিষয়ে আমি আশাবাদী ছিলাম। প্রেমের জন্য এটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে না পারলে কিসের সার্থকতা! কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। গ্রুপ থিয়েটার থেকে নাজিয়া বেরিয়ে এলেও নাটককে আরো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল সে। টিভির নাটকে রীতিমতো নায়িকা হয়ে গেল। তাছাড়া একটা ধারাবাহিক নাট্যানুষ্ঠানে প্রধান ভূমিকায় রূপদানের সুযোগ পেল নাজিয়া। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠল সে। বেশিরভাগ নাটকে ওর বিপরীতে অভিনয় করতে শুরু করল ফরহাদ। অন্যদিকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমশ ক্ষীণতর হয়ে এলো। অধিকাংশ সময়ে বাসায় গেলে জানা যেত, টিভির রিহার্সেলে গেছে নাজিয়া। কখন ফিরবে ঠিক নেই।

তুমি আজকাল আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ। ওর প্রতি অনুযোগ করলাম আমি।

ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হয় আমাকে। নাজিয়া শান্তকণ্ঠে বলল, টিভির রিহার্সেল, ভিটিআর, এসব করে হাতে মোটেই সময় থাকে না।

এসব নাটক-ফাটক কি না করলেই নয়?

বা রে! কিছু একটা করতে হবে তো! অভিনয়কে আমি ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চাই।

কথাটা আমাকে আগে বললে পারতে!

কেন মিছামিছি রাগ করছ? তুমি নিজে আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলে!

দিয়েছিলাম। এখন চাই, তুমি আর অভিনয় করবে না। ফরহাদের সঙ্গে তোমার ঢলাঢলি আমি মোটেই পছন্দ করি না।

নাজিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল আমার কথা শুনে। তারপর বলল, আমার একটা 888sport live chatীসত্তা আছে। তাকে বিসর্জন দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া অভিনয়কে আমি অভিনয় হিসেবে নিয়েছি। বাস্তবের সঙ্গে ওটার কোনো সম্বন্ধ নেই।

নাজিয়ার সঙ্গে বোধকরি আমার সেটাই শেষ কথা। মানে-অভিমানে ওর কাছে আর যাইনি আমি। নাজিয়াও আমার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। সেটা কতটা তার ব্যস্ততার জন্য, কতটা ইচ্ছাকৃত, ভেবে দেখিনি। মাঝখানে কোনো একটা সিনে সাপ্তাহিকের টিভি পাতায় নাজিয়া-ফরহাদের রোমান্সের খবর পড়ে নিজেকে আমি গুটিয়ে নিয়েছিলাম। ওদের বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলাম আমি।

জীবনের একমাত্র প্রেম বিশ্বাসভঙ্গের পরিণতিতে ব্যর্থ হয়েছিল। নাজিয়া যে আমাকে এভাবে ছেড়ে যাবে, ভাবতে পারিনি। বিদেশে গিয়ে মনে হয়েছিল, স্থানের দূরত্ব মনের দূরত্ব সূচিত করবে, এমন কথা নেই। হাজার হাজার মাইল দূরে গিয়ে নাজিয়াকে ভুলে থাকা আমার জন্য সহজ ছিল না। সারাক্ষণ বিষাদ ও বেদনায় ডুবে থাকতাম আমি। কিন্তু স্থান নয়, কালের ভূমিকাই বোধকরি সবচেয়ে প্রবল মানুষের জীবনে। সময় এবং সময়ই হচ্ছে দূরত্ব সৃষ্টির প্রধান উপাদান। এক সময়ে অনুভব করলাম, নাজিয়া 888sport sign up bonusর অতলে নিমজ্জিত একটা নাম।

নাজিয়াকে চেয়েছিলাম আমি, কিন্তু পাইনি। পক্ষান্তরে ফরহাদ ওকে জয় করেছিল। কিংবা বলা যায়, ফরহাদ ওকে ছিনিয়ে নিয়েছিল আমার কাছ থেকে। ফরহাদ ওকে পেয়েছে, কীভাবে কতটুকু পেয়েছে, সে-প্রশ্ন ছিল আমার মনের সঙ্গোপনে। ফরহাদের ঘরনি হিসেবে নাজিয়া কি আমাকে ভুলে গেছে? ফরহাদ কি প্রেমের প্রলেপ বুলিয়ে নাজিয়ার 888sport sign up bonusময় অতীতকে ঢেকে দিতে পেরেছে? কি জানি!

বিয়ের প্রথম দিনগুলোতে নাজিয়া ও ফরহাদ ছিল উদ্ভ্রান্ত প্রেমের আবর্তে দিশাহার। ব্যাংকক, হংকং আর সিঙ্গাপুরে হানিমুন করে দীর্ঘসময় কাটিয়েছে ওরা। টেলিভিশনে ওদের সিরিজটা জনপ্রিয় হওয়ার পর আরো নতুন নাটকে অভিনয়ের সুযোগ এসেছে। খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার সোপান অবারিত হয়েছে ওদের কাছে। কিন্তু সুখেরও বুঝি একটা সীমা থাকে। নির্দিষ্ট শিখরে পৌঁছার পর সুখ আর সুখ থাকে না। ভারবাহী বেদনায় রূপান্তরিত হয়ে যায়।

মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে সাংসারিক প্রয়োজনে ও পেশাগত চাপে পারস্পরিক সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি হলো ওদের। ফরহাদের বাবা হার্টফেল করে আকস্মিকভাবে মারা যাওয়ার পর, ব্যবসার সব দায়িত্ব এসে পড়ল তার ওপর। ব্যবসার এমন এক পর্যায়ে ছিল তার বাবা, যাতে মরারও অবকাশ ছিল না। কিন্তু মৃত্যু যখন আসে, তখন কাউকে অবকাশ না দিয়েই আসে। তাই নিতান্ত অপ্রস্তুত অবস্থায় সবকিছুর দায়িত্ব নিতে হলো ফরহাদকে। টিভিতে নাটক করা তখন সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু মনে হলো না। অফুরন্ত টাকার মোহে খ্যাতি বা জনপ্রিয়তাকে বোধ হলো অনাবশ্যক, অপ্রয়োজনীয়।

তুমি তো সারাদিন বিজনেস নিয়ে পড়ে থাক। এক সময়ে নাজিয়া বলল, আমি কী করব?

একটা কোম্পানির ডিরেক্টর হয়ে যাও না। আজকাল অনেক মেয়ে এসব লাইনে সাইন করছে।

পাগল নাকি! আমাকে দিয়ে তা হবে না।

তাহলে কী করবে?

নাটক করব, নাটক।

আমি যে মোটেই সময় দিতে পারব না। একটা নাটকে পার্ট করতে যাওয়া মানে কয়েক হাজার টাকা গচ্ছা।

ইম্পপোর্ট-এক্সপোর্টের ব্যাপার! সময়ের অন্য নাম টাকা।

তুমি থাকো তোমার টাকা নিয়ে। আমি আমার নিজের মতো নাটক করতে পারলেই হলো।

আমাকে বাদ দিয়ে?

বা রে! তুমি যে সব নাটকে আমার নায়ক হবে এমন কোনো কথা আছে নাকি? নাজিয়া ঠাট্টার ছলে বলল, তোমার সঙ্গে না হয় চিরকাল অভিনয় করতে পারলাম না। অন্যদের সঙ্গে তো করি।

ফরহাদের ইচ্ছা ছিল না নাজিয়া তাকে বাদ দিয়ে অন্য কারো সঙ্গে অভিনয় করুক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্মতি দিতে হলো। নাজিয়া তার 888sport live chatীসত্তাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে চায়। ওকে বাধা দেওয়ার অর্থ ওর প্রতিভা বিকাশে অন্যায় হস্তক্ষেপ। নাজিয়া যদি নাটক করে খ্যাতির শীর্ষে উঠতে চায়, তাকে বাধা না দেওয়ার মতো উদারতা ফরহাদের আছে, মনে মনে ভাবল সে।

আশ্চর্য নিষ্ঠা ও সাধনা নাজিয়ার। অবাধ অধিকার পেয়ে নাটকের পরিম-লে নিজেকে আরো প্রতিষ্ঠিত করল সে। টিভির নাটকের শ্রেষ্ঠ নায়িকার সম্মানে ভূষিত হয়ে বিশেষ স্বীকৃতি পেল। কিন্তু কে জানত এই স্বীকৃতির পথ ধরেই এগিয়ে আসবে ওর জীবনের বিপর্যয়?

নাটক নিয়ে একাকী মেতে থাকার ফলে স্বামীর সঙ্গে ওর দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল আগেই। ব্যবসার গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে ফরহাদ নিজেও এক ভিন্ন জগতে সরে এলো। দিনের আলোতে ওরা উভয়ে দুই ভিন্ন গ্রহের অধিবাসী। রাতে যে-সময়টুকু পরস্পরের কাছে সমর্পিত, তাতে দৈহিক মিলন হয়তো হয়, কিন্তু মনের মিল গড়ে ওঠে না। নিজেদের একান্ত করে পাওয়ার লগ্ন সময়ের কার্পণ্যে নিমিষে মিলিয়ে যায়। ওদের দুজনের দুই পৃথক সত্তা একীভূত হওয়ার সুযোগ হারায়।

তুমি দেখছি ঘরসংসার সব ভুলে গেলে। একদিন অভিযোগ করল ফরহাদ।

বড় হতে গেলে ঘরসংসারের কিছু স্যাক্রিফাইস থাকতে হয়।

কিন্তু আর কত? কতদিন এভাবে কাটবে?

আমি তো লাভ-মেশিন। এই মেশিনে একটা সন্তান বানিয়ে দিলেই পার।

কথাটা ওকে খোঁটা দিয়ে বলেছে নাজিয়া। আড়াই বছরের বিবাহিত জীবনে ওদের কোনো ফল লাভ হয়নি। এ ব্যাপারে দুজনের কারোরই উৎসাহের কমতি ছিল না। তবু কেন যে হচ্ছে না, তা কে বলতে পারে! নাজিয়া জানে, ফরহাদকে আঘাত দিতে হলে এর চেয়ে দুর্বলতম স্থান আর নেই। ফরহাদও বোঝে, ও রেগে গেলে এই অস্বস্তিকর প্রসঙ্গটা দুজনের মাঝখানে অনিবার্যভাবে উপস্থিত হবেই।

ব্যবসায় যখন হঠাৎ মন্দাভাব ঘনিয়ে এলো, ফরহাদের মনে হলো, কেবল ক্লায়েন্টরা নয়, স্ত্রীও তাকে সমভাবে ফাঁকি দিচ্ছে। দু-একটা রম্য পত্রিকায় নাজিয়া সম্পর্কে নানাবিধ গুজব ছাপা হয়েছে, যা এতকাল নজরে পড়েনি। নাজিয়া নিজেও যেন লোকজনের সঙ্গে বেশি মেলামেশা শুরু করেছে। বিশেষত ওর নায়ক-টায়ক ছোকরারা অভিনয়ের বাইরেও ওকে নিয়ে আড্ডা জমাতে সচেষ্ট। ফরহাদ সঙ্গোপনে লক্ষ করেছে, অপজিট সেক্সের প্রতি নাজিয়ার এক ধরনের দুর্বলতা দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। অবশেষে ওর সাম্প্রতিক নায়ককে নিয়ে পত্রিকার পাতায় স্ক্যান্ডাল শুরু হলে ফরহাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল।

এসব কী হচ্ছে? রীতিমতো রেগে গিয়ে ফরহাদ জিজ্ঞাসা করল।

মানে?

আমি জানতে চাই, তোমাকে নিয়ে এত স্ক্যান্ডাল কেন?

শো-বিজনেসে থাকলে ওরকম এক-আধটু হয়েই থাকে।

শো-বিজনেস! দাঁতে দাঁত ঘষল ফরহাদ, কী শো করো তুমি?

ন্যাস্টি কথাবার্তা বলবে না। নাজিয়া রুখে দাঁড়াল, আমি নাটক করি জেনেই তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে।

শুধু নাটক নয়, ওসব নাটকের নাম করে তুমি অনেক কিছু কর।

ইউ শাট আপ!

দুজনের ভেতর ঠোকাঠুকি এভাবেই শুরু। কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল, ফরহাদ নাজিয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়েছে। অফিস থেকে প্রায়ই টেলিফোন করে বুঝতে চায় নাজিয়া কারো সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছে কিনা কিংবা বাসার টেলিফোন কতক্ষণ এনগেজড থাকে! নাজিয়া কোথায় কোথায় কাকে টেলিফোন করে, লাইনম্যান বা সুইচরুমের লোকদের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে বলে প্রায়ই চিন্তা করে ফরহাদ। এমনকি নাজিয়া বাইরে থেকে ফিরলে ফরহাদ বুঝতে চেষ্টা করে কারো কোনো স্পর্শের চিহ্ন ওর পোশাক-পরিচ্ছদে লেগে আছে কিনা! ফরহাদের নিশ্চিত ধারণা, নাজিয়া কোথাও কিছু করে বেড়াচ্ছে এবং একদিন না একদিন ধরা সে পড়বেই।

নাজিয়ার ব্যাপারে ফরহাদ চুপ করে বসে থাকেনি। টেলিফোনের একটা প্যারালাল লাইন লাগিয়ে নিয়েছে ড্রইংরুমে, যাতে কোনো ফোন এলে সে জানতে পারে, কার সঙ্গে কী কথা হচ্ছে। প্রায় বিনা নোটিশে নাজিয়ার বাবার দেওয়া পুরনো ড্রাইভারটিকে বরখাস্ত করেছে সে। নতুন একজন ড্রাইভার রেখেছে, যার আসল কাজ হলো মেমসাহেব কোথায় কোথায় যায়, তার খবর সাপ্লাই করা। সন্দেহবশত ফরহাদ নিজেও দুদিন আলাদা গাড়ি নিয়ে নাজিয়াকে ফলো করেছে, সত্যি সত্যি সে রামপুরা টেলিভিশন অফিসে যাচ্ছে কি না! এসব ঘটনা ফরহাদের মানসিক কষ্ট ও অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলেছে দিনের পর দিন। ওর সন্দেহ নিরসনে নানারকম কথার জবাব দিতে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে নাজিয়ার জীবন। ঘরে আগুন লাগলে পাত্র-পাত্রী নির্বিশেষে তা সবাইকেই পোড়ায়। কেউ বাদ যায় না।

মিনি পর্দার নায়িকা হওয়ার পর থেকে অসংখ্য গুণগ্রাহীর চিঠিপত্র আসত নাজিয়ার নামে। ফরহাদ ওসব নিয়ে আগে মাথা ঘামাত না। নাজিয়া নিজেও দু-চারটা চিঠি তাকে পড়ে শুনিয়েছে। সেসব চিঠির আবেগাপ্লুত ভাষায় কৌতুক বোধ করেছে দুজনে। এহেন চিঠি নিয়ে যে ফরহাদ কখনো সিরিয়াস হয়ে উঠবে, তা ভাবতে পারা যায়নি। আগে বুঝতে পারলে নাজিয়া সতর্ক হয়ে যেত। কিন্তু ওকে সতর্কতার কোনো সুযোগ না দিয়েই একটা চিঠির খাম খুলে ফরহাদ ফেটে পড়ল, এই লোকটাকে তুমি চিঠি লিখেছ?

কাকে? নাজিয়া বলল, কতজনকে তো দু-চার লাইন জবাব দিয়ে থাকি আমি। ভক্তদের চিঠির জবাব দেওয়া আমার অভ্যাস।

এই বদমাশটা তোমার ভক্ত! ওর চোখের সামনে চিঠিখানা মেলে ধরল ফরহাদ, ডার্লিং বলে চিঠি শুরু করেছে। চিঠির শেষে দিয়েছে শত-সহস্র চুম্বন। এই কি ভক্তির নমুনা?

এসব চিঠি বাস্কেটে ফেলে দিলেই হলো।

তা হবে কেন? আগের চিঠির জবাব পেয়েই তো লোকটার প্রেম উথলে উঠেছে। এখন এদিক থেকে একটা আমন্ত্রণলিপি পাঠালেই হয়।

বাজে কথা বলবে না।

বললেই গায়ে ফোস্কা পড়ে যায়! কাজটা যখন করো, তখন কী?

তুমি একটা ইতর।

আর তুমি! তুমি রাস্তার মেয়েমানুষ!

নাজিয়া সহ্য করতে পারেনি। ফরহাদেরও সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দুজনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পরস্পরের ওপর। পুরুষের প্রবল শক্তির কাছে 888sport promo codeরা চিরকাল পরাজিত। এই অসম শক্তি পরীক্ষায় কী করে টিকবে নাজিয়া? ফরহাদ চুলের মুঠি ধরে কেবল টানাটানি করল না; ওকে মেঝের ওপর ফেলে একের পর এক লাথি মারল পিঠে। ক্ষোভে-দুঃখে-লজ্জায় ওখানেই ধরাশায়ী হলো নাজিয়া। প্রবল পৌরুষের পরিচয় দিয়ে বীরবেশে অন্য ঘরে প্রস্থান করল ফরহাদ।

নাটকের সঙ্গে নাজিয়ার সম্পর্ক সেদিনই শেষ। ফরহাদের সঙ্গেও একইভাবে সম্পর্ক চুকিয়ে দিলো সে। উভয়ের কথা বন্ধ হলো, একসাথে এক ঘরে থাকারও ঘটল ইতি।

ফরহাদ অনেক সাধ্যসাধনা করেছে আবার স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে। নাজিয়ার অনড় মনোভাবের জন্য এগোতে পারেনি। অসম্ভব শক্ত আর অনমনীয় মেয়ে নাজিয়া। অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ওকে একবিন্দু টলাতে পারেনি ফরহাদ। আজ এতদিন পরে নাজিয়ার কাছ থেকে সব ঘটনা জেনে মনে মনে এক ধরনের তৃপ্তি বোধ করলাম আমি। সম্ভবত নাজিয়াকে করুণা করতে পারার

তৃপ্তি। কিংবা ফরহাদের প্রতিও একরকম করুণার উদ্রেকে আত্মপ্রসাদ লাভ। মনে হলো, আমি ব্যর্থ হলেও ভবিতব্য আমার হয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে ওদের ওপর। ফরহাদ আমার কাছ থেকে নাজিয়াকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু নাজিয়াকে সে পায়নি। নাজিয়াও আমার প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের মূল্য দিয়েছে সমভাবে। আর্ট কলেজের চত্বরে বসে নাজিয়ার কথা শুনতে শুনতে অনুভব করলাম, আমার সমস্ত কষ্টের অবসান ঘটে গেছে।

সব ঘটনা শেষে নাজিয়া বলল, চল আমার সঙ্গে।

কোথায়?

আমার ওখানে। ফরহাদ দেশে নেই। ও সিঙ্গাপুর গেছে। কয়েকদিন পরে ফিরবে।

কী হবে সেখানে গিয়ে?

তোমার কাছে আমি একটা জিনিস চাইব।

কী জিনিস?

সব কথা সব জায়গায় বলা যায় না। আগের মতো দৃষ্টি দুলিয়ে হাসল নাজিয়া, তুমি আজ আমার ওখানে থাকবে। জানো, এতদিন ধরে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম।

এই মুহূর্তে নাজিয়াকে মনে হলো বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময়ী 888sport promo code। যার সব বাসনা আবৃত, অথচ অনাবৃত। ওর কথার উত্তর না দিয়ে আমি নিশ্চুপ হয়ে রইলাম।

আমাকে হাত ধরে তোলে। লাস্যে-আলস্যে নাজিয়া একটা হাত এগিয়ে দিলো আমার দিকে।

চকিতে চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, কাছাকাছি কেউ নেই। চিত্রপ্রদর্শনীর সময় শেষে সবাই যার যার স্থানে ফিরে গেছে। যেন প্রাঙ্গণটুকু শূন্য করে গেছে আমাদের জন্যই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, অনেকটা সময় বয়ে গেছে অগোচরে।

কই? ধরো আমাকে। নাজিয়ার কণ্ঠে আহ্বানের ভঙ্গি।

উঠে পড়েছিলাম আমি। কিন্তু ওকে ধরতে পারলাম না। নিজের মধ্যে হাত গুটিয়ে এলো আমার। নাজিয়াদের ছোঁয়া যায়, কিন্তু ধরা যায় না।