অলোক বন্দ্যোপাধ্যায়
ঘাট আঘাটের বৃত্তান্ত
নীহারুল ইসলাম
অভিযান পাবলিশার্স
কলকাতা, ২০১৪
২০০ টাকা
নীহারুল ইসলামের পঞ্চম গল্পগ্রন্থ ঘাট আঘাটের বৃত্তান্তে মোট ঊনত্রিশটি গল্প স্থান পেয়েছে। গল্পগুলি কালানুক্রম অনুসারে গ্রথিত হয়েছে। প্রথম গল্প ‘ভিমরতি’র প্রকাশকাল জানুয়ারি ১৯৯৯ আর শেষ গল্প ‘ঘাইহরিণী’ প্রকাশিত হয় অক্টোবর ২০০২-এ। অর্থাৎ মোটামুটি চার বছরের সীমিত পরিসরে গল্পগুলি রচিত হয়েছিল – এমন অনুমান হয়তো অমূলক নয়। গল্পগুলির পরম্পরার ক্ষেত্রে লেখকের পরিণতির যে-রেখাচিত্র স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে, তা নিঃসন্দেহে পাঠককে সম্মোহিত করে। আধুনিক ছোটগল্পের অন্বিষ্ট ও পরিপ্রেক্ষিত নানান চাপান-উতোরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে – তাই পূর্বজ ছোটগল্পকারদের সিদ্ধি ও ঐশ্বর্যে বিস্মৃত না হয়েও পরবর্তীকালের সাধনা ও দৃষ্টিকোণকে স্বাগত জানাতেই হয়। এই জটিল 888sport live chatরূপের কাছে এ-সময়ের পাঠকের যে-প্রত্যাশা, তা শুধু গল্পের অন্তিম মোচড়ের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং বহমান জীবনপ্রবাহে নক্ষত্রের আলোর মতো স্নিগ্ধ ও সমুজ্জ্বল অনুভূতিপ্রবাহ বিম্বনের মধ্যেই দীপিত হয়ে ওঠে। ছোটগল্পের তন্নিষ্ঠ পাঠকদের কাছে এ-কথা অজানা নেই যে, ‘পাঠকের মনে বাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়াটি সৃষ্টি করার জন্য গল্পলেখকরা সাধারণত দুটি উপায়ে পূর্ণচ্ছেদ টানেন। গল্পের শেষে একটা অপ্রত্যাশিত চমক দিয়ে পাঠককে স্তম্ভিত করে দেওয়া একটি প্রিয় ও প্রাচীন পদ্ধতি। …পো, মোপাসাঁ এবং ও হেনরি এজাতীয় সমাপ্তির পক্ষপাতী। …আর একদল আছেন, যাঁরা এই চমক পছন্দ করেন না। এঁদের মধ্যে আছেন চেকভ, আছেন হেন্রি জেম্স। দিনের শেষে যেমন ধীরে বিকেলের ছায়া বিকীর্ণ হয়ে পড়ে, এঁরা গল্পের ভেতর সেই ধীর-স্বাভাবিক পরিণামকে আনবার পক্ষপাতী।’
(888sport live footballে ছোটগল্প, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, পৃ ১৯০)
নীহারুলের গল্প এই দ্বিতীয় পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। আলোচ্য সংকলনের বেশিরভাগ গল্পের পটভূমি পদ্মা-ভাগীরথীসন্নিহিত সীমান্ত অঞ্চল। এই প্রান্তিক অঞ্চলের নিম্নবর্গের বিভিন্ন পেশার মানুষ – কৃষক, ভ্যান-রিকশাচালক, ব্যবসায়ী, ভিক্ষুক, বেশ্যা এবং স্থানমাহাত্ম্যে চোরাচালানকারী – ইত্যাকার চরিত্রেরা নীহারুলের কলমের অাঁচড়ে প্রাণ পেয়েছে – এদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে নীহারুল দেখেছেন। ফলে তাঁর গল্পের চরিত্রগুলি এত জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কোনো কৃত্রিম গল্প-নির্মাণের আয়াস ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তিনি বুনে চলেন এদের যাপনচিত্র। তাই কোনো নাটকীয় সমাপ্তিকরণের চটুল হাতছানি তিনি সযত্নে এড়িয়ে যান। বরং অনেক কথাই অনুক্ত থেকে যায় তাঁর গল্পে – পাঠককে অনেকখানি স্পেস দেন তিনি, যে-পরিসরে পাঠক তাঁর কল্পনাশক্তি ও মেধার দ্বৈত সাযুজ্যে নির্মাণ করে নিতে পারেন নিজস্ব অন্দরমহল।
যে-গল্পটির শীর্ষক সংকলনটির নামে ব্যবহৃত হয়েছে সেই ঘাট আঘাটের বৃত্তান্তের কথাই ধরা যাক। এক যুবক-যুবতী অপার কৌতূহল আর তৃষ্ণা নিয়ে পদ্মা দেখতে চেয়েছিল। আর এপাশে ওঁৎ পেতে ছিল হিংস্র 888sport promo codeমাংসলোলুপ একদল হায়েনা। কিন্তু করম শেখ তাদের নিবৃত্ত করল এই আসন্ন রাত্রিকালে পদ্মাদর্শন থেকে। ফলে ওই দুর্বৃত্তদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে সে তাদের অত্যন্ত বিরাগভাজন হয়ে ওঠে। তারা তাকে খুন করতেও উদ্যত হয়েছিল – গল্পটির শেষ লাইনগুলি লক্ষ করা যাক – ‘করম শেখ বুঝতে পারল, ওরা তাকে মারতে এসেছিল। কিন্তু ওরা তাকে না মেরে এমনি ফিরে গেল কেন সেটা বুঝতে পারল না’ পাঠক হিসেবে আমরাও কি বুঝতে পারি, এই উদ্যত-অস্ত্রদুষ্কৃতকারীদের ফিরে যাওয়ার কারণ? আসলে মনে হয়, করম শেখ কোনো ব্যক্তি নন, একটা কনসেপ্ট বা আইডিয়া যা অনির্বাণ দীপশিখার মতো চিরায়ত ও প্রোজ্জ্বল এক মানবিক বিবেকের কণ্ঠস্বর, যা কোনো অগ্নিশলাকার সাহায্যে দহিত হয় না বা কোনো ধারালো অস্ত্রের সাহায্যেও ছিন্ন করা যায় না।
নীহারুলের গল্পে অস্তিত্বের দুই মৌলিক স্বরূপের দ্বন্দ্ব প্রায়ই প্রতিফলিত হয় – একদিকে জীবন যা সঞ্জীবনী শক্তিতে ভরপুর আর অন্যপ্রান্তে মৃত্যু যা সমস্ত জীবনীশক্তিকে মুহূর্তে শুষে নেয়। কয়েকটি গল্পের শেষ হয়েছে মৃত্যুর দৃশ্যে। যেমন ‘ভিমরতি’ গল্পে সাবের আলির মৃত্যু, ‘তাহের আলির জীবন যাপনে’ অতৃপ্ত কামনার শিকার তাহের আলি স্খলিতবসনা, স্নানরত রমণী শরীরের দৃশ্যময়তা উপভোগ করার প্রয়াসে শরীর ঘোরাতেই গড়াতে গড়াতে স্রোতকবলিত হয়ে ঘূর্ণির আশ্রয়ে কোথায় যে তলিয়ে গেল কেউ তা জানতেই পারল না। ‘পাগলি তোমার সঙ্গে’ একটি 888sport promo codeর আত্মহত্যার ঘটনাতেই শেষ হয়েছে। যে চেয়েছিল নতুন জীবনের স্বপ্নে বেঁচে উঠতে। গল্পের প্রধান চরিত্রের বক্তব্য খুব পরিষ্কার, ‘কেউ কারও জন্য দায়ী থাকে নাকি? ওসব আমাদের তৈরি করা ধারণা। অমন ধারণার কোনো মূল্য নেই আমার কাছে।’ আবার ‘শতছিটের ঝোলা’ গল্পে একটি বিপ্রতীপ চিত্রের উদ্ভাস আমাদের বিস্মিত করে। প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে অভাবনীয়ভাবে নুরুকে রক্ষা করে তারাই যারা চেয়েছিল তাকে সর্বস্বান্ত করতে। অদ্ভুত এক রসায়নে সৃষ্টি ও ধ্বংস, জীবন ও মৃত্যু, শুরু ও সমাপ্তি নীহারুলের গল্পে এক ভিন্নমাত্রা পেয়ে যায়। তাঁর কথনভঙ্গিটি অত্যন্ত নির্মোহ – এক নিরাসক্ত পর্যবেক্ষকের বিযুক্তি তাঁর বর্ণনায় স্পষ্ট – কোথাও তরল আবেগ তাঁর গল্পকে শিথিল করেনি।
নীহারুলের গল্পের আরেকটি উল্লেখ্য বৈশিষ্ট্য তাঁর নিসর্গচেতনা – গাছপালা পশুপাখি, কীটপতঙ্গ শুধু পটভূমি নয়, এক প্রাণিত চরিত্রে পর্যবসিত হয়েছে। প্রাসঙ্গিক একটি অংশ উদ্ধার করা হলো : ‘তবু ওরা সেখানে আর বসে রইল না। করম শেখের বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলো। ওদের পিছু নিল কয়েকটি জোনাকি। ওদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। ওরা হাঁটছে। আর ওদের টাল সামলাচ্ছে অন্ধকার’। (ঘাট আঘাটের বৃত্তান্ত, পৃ ৮১)
দুই
নীহারুল আজকের সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য গল্পকার। ইদানীং তাঁর লেখা লিটল ম্যাগাজিনের পাশাপাশি বিভিন্ন বাণিজ্যি পত্র-পত্রিকাতেও প্রকাশ পাচ্ছে। সুতরাং পাঠক হিসেবে আমরা চাইব, ভবিষ্যতে তিনি আরো অনেক উজ্জ্বলতর গল্প আমাদের উপহার দেবেন এবং ‘চোর আবলু সাধু’র আবলুর মতো সরলীকৃত সুমতি-কুমতির দ্বন্দ্বমুখর গল্প লেখা থেকে নিবৃত্ত থাকবেন।
ছাপা, বাঁধাই এবং পার্থপ্রতিম দাসের সুশোভন প্রচ্ছদে নীহারুল ইসলামের পঞ্চম গল্পসংকলন ঘাট আঘাটের বৃত্তান্ত এক কথায় চমৎকার।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.