যে-মানুষটি একসময় পনেরো-বিশটা রুটি এক-আধলা গুড় কিংবা রাতের বাসি তরকারি দিয়ে গোগ্রাসে সকালের নাশতা খেয়ে ঢেঁকুর তুলত আজ তার সামনের সানকিতে দুটি শুকনো আটার রুটি – রমিজ মোড়ল নির্বাক, অর্ধমুদিত নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সানকির দিকে। বৃদ্ধ ক্ষুধার্ত ক্লান্ত বাঘ যেমন সামনে শিকার দেখেও দৌর্বল্যের কারণে শিকার ধরার আগ্রহ হারায় দুটি শুকনো রুটি দেখে রমিজ মোড়লকেও তেমন অনাগ্রহী দেখাচ্ছে। সানকির পাশে একটি অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাস ও জগ। পিঁড়িতে বসে রমিজ, সামনে স্ত্রী অনুফা নির্বাক দৃষ্টিতে স্বামীর অসহায় মুখের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। দুজনের গায়ে জরাজীর্ণ পরিধান থাকলেও অনুফার শরীর থেকে বোঁটকা গন্ধ ছড়াচ্ছে। বোঁটকা গন্ধ কেন ছড়াচ্ছে সে-কথায় পরে আসা যাক। জীবনের ভারে ক্লান্ত অবসন্ন রমিজের গলা দিয়ে শুকনো রুটি দুটি নামবে কি না ঝিম ধরে ভাবছে সে। ক্ষুধার তীব্রতা যেন বা লেলিহান অগ্নিশিখা – পেটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দিনের পর দিন আধপেটা খেয়ে রমিজ ও অনুফার শরীর ক্রমে অসাড় হয়ে আসছে – পেশিগুলোয় ভর করেছে উত্তাপহীন শৈথিল্য।
রুটি দুটির দিকে হাত যেন অগ্রসর হতে চায় না। রমিজের এই অসাড়তা ও নিরাসক্ততা দেখে অনুফা মায়ার্দ্র হয়ে বলে, ‘আর কিছতা ঘরঅ নাই। জুইত জোগাল না তাকলে আমি কিতা করবাম?’
অনুফার কথায় অসহায়ত্ব ঝরে পড়ে। কিন্তু এই অসহায়ত্বের দায় তো অনুফার নয়, তা রমিজ বুঝতে পারে। অনুফার মতো আলাবোলা 888sport promo codeর পক্ষে কোনো কিছু জোগাড়যন্ত্র করা সম্ভব নয়। এই সামান্য খাবারটুকু সে দিতে পেরেছে তা-ই বা কম কীসের। নিজের রোজগার বলতে কিছু নেই। গ্রামে কাজ থাকলেও বৃদ্ধ বলে রমিজকে এখন আর কেউ কাজে ডাকে না। কারো মনে দয়া হলে ডেকে কাজ দেয়, না-হয় এত দিনে ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হতো।
এখন যে-সময় পড়েছে তাতে ভিক্ষেও জোটে না। বিশ্বাসহারা হয়নি রমিজ, সে বিশ্বাস করে নিয়তি আর রিজিকের বণ্টন অনেক আগেই আল্লাহ পাক করে রেখেছেন – মানুষের কিছু করার নেই।
আষাঢ় মাসের শুরু কেবল। একটি কাঁঠালগাছ রমিজের জীবনের শেষ সম্পদ। কয়েকটি কাঁঠাল হয়েছিল, বিক্রি করে চাল-ডাল-তেল-নুন কিনে কয়েকটা দিন চলেছে। ঘরে একটি পাকা কাঁঠালের গন্ধে পুরো ঘরটি ম-ম করছে। রমিজ কাঁঠালটির দিকে একবার তাকায়, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে অনুফার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কাডলের গেরানডা খুব সোন্দর!’
কাঁঠালের গন্ধের কথা শুনে অনুফার বুকের ভেতরে তখন হু-হু করে এবং এক প্রকার বিষাদে আক্রান্ত হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন তার মনে অতীতের দু-একটি টুকরো 888sport sign up bonus উঁকি দেয়। কয়েক বছর আগেও এমন একটা কাঁঠাল দিয়ে রমিজ উদ্দিন সকালে এক সানকি ভাত খেয়ে দাওয়ায় হুঁকো টানত। আর গত দু-তিন বছর কাঁঠালের একটি কোয়াও মুখে দিতে পারে না, ইচ্ছে হয় না। কাঁঠাল খাওয়ার চেয়ে চারটে চাল আনতে পারলে দুজনের দু-তিনটা দিন আধপেটা খেয়ে পার করা যায়।
অনুফার শরীর থেকে বোঁটকা গন্ধের কথায় আসা যাক। ওর গায়ের গন্ধ ছাপিয়ে ঘরের কোণের পাকা কাঁঠালের সুঘ্রাণ ছোট্ট ঘরের বাতাসকে যেন মাতাল করে তুলেছে। কাপড়ের অভাবে অনুফাকে কয়েক দিন পরপর গোসল করতে হয়। শুধু কি কাপড়ের অভাব? নিজেদের পুকুর না থাকাতে পাশের বাড়ির পুকুরে যেতেও দ্বিধা-সংকোচ। সন্ধ্যার সময় গোসল করতে যায়, যাতে গ্রামের পুরুষের সামনে পড়তে না হয়। এ-কারণেই গরমকালে ওর অতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীর থেকে বোঁটকা গন্ধ বের হয়। আর গায়ের কাপড় সাবান দিয়ে কাচা তো অনেক দূরের কথা, একটু সোডাও জোগাড় করতে ওরা অক্ষম। মাসে একবার কলাগাছের খোল পুড়িয়ে ক্ষার বানিয়ে কাপড় ধুলে গন্ধ কিছুটা কমে। মাথার চুল এঁটেল মাটি দিয়ে ধুয়ে গন্ধ দূর করে।
কাঁঠালের গন্ধটা যেন তাকে ডাকছে। অসহায় ও করুণ চোখে অনুফার দিকে তাকিয়ে রমিজের মন মায়ায় ভরে যায় এবং নিজের ভাগ্য মেনে নিয়ে দুজনের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করার জন্যই হয়তো বলল, ‘তর রুডি কই?’
অনুফা বলে, ‘আমার লাইগ্যা একটা আছে।’
রমিজ কথা না বাড়িয়ে গ্লাস থেকে দুই ঢোক পানি গিলে গলা ভিজিয়ে রুটি দুটি রোল বানিয়ে পানিতে ভিজিয়ে আস্তে আস্তে চিবুতে শুরু করে, ভাবে – জীবনের শেষ সময়ে এমন হওয়ার কি কথা ছিল? নাকি সবই নিয়তির খেলা? রিজিকের খেলা?
গতরাতে বৃষ্টি হওয়ায় ঘরের ভেতরে পুব-দক্ষিণ কোনায় সামান্য পানি জমে মেঝেটা থ্যাকথেকে হয়ে আছে। এই ঘরে বিছানাপত্র বলতে তেমন কিছু নেই। একটি পাটি, দু-তিনটি কাঁথা আর তিনটি তেলচিটচিটে তিন-চার ইঞ্চি পুরু বালিশ – যেগুলো ঘরের পশ্চিম পাশে দিনের বেলায় গুটিয়ে রাখা হয় এবং রাতে ঘুমানোর সময় বিছানা পাতা হয়। রুটির অর্ধেক খাওয়া হলে অনুফা বলল, ‘ঘর কি টিক করতাইন না? বাইস্যা মাস আইতাছে … ঘর ভাইঙ্গা গেলে কই থাকবাইন?’
অনুফার কথায় রমিজের রুটি চিবুনোতে কোনো প্রভাব পড়েনি; সে ঘরের চালের দিকে তাকিয়ে দেখে একটু জায়গা দেবে গেছে। চালে খড় নেই, ভাঙা খাপকুরু দেখা কঙ্কালের মতো ভেসে উঠেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলে, ‘কিদ্দেয়া টিক করবাম? মুকাম আলিরে কইছলাম দুইলা ড্যাঙ্গা দেওনের লাইগ্যা, হে না করল। লেদু কইছিল ড্যাঙ্গা দিবো, হেও দিলো না। অহন কিতা করবাম? কইতে আনবাম ডেঙ্গা?’
অনুফা কথা বাড়ায়নি। সে জানে এই সংসারে তার কোনো মূল্য নেই। শুধু কথা বাড়িয়ে কী লাভ? বেশি কথা বলতে গেলে রমিজ মোড়ল ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে খিস্তি শুরু করবে। চুল ধরে অভ্যস্ত পাকা হাতে দু-একটা কিল-ঘুসি মারতে তো দ্বিধা করবে না। পতিসেবা পরম ধর্ম, তার কথার অবাধ্য হলে দোজখে যেতে হবে – এই জ্ঞান হনুফা শৈশব থেকে প্রথমে দাদির কাছে এবং পরে মায়ের কাছ থেকে অর্জন করেছে। মা-বাপহারা হনুফার আগের সংসারে একমাত্র ছেলে লেদু ছাড়া আর কেউ নেই। অনুফা রমিজ মোড়লের তৃতীয় স্ত্রী। ‘বাঁজা মাগি’ অপবাদ দিয়ে আগের দুই স্ত্রীকে বিদায় করে হনুফাকে বিয়ে করেছিল। পরির মতো সুন্দর হলেও হনুফা আলাবোলা, সংসার-ধর্ম-কর্ম জ্ঞান বলতে চারটে চাল সিদ্ধ করা আর দু-তিন পদের
ডাল-তরকারি রান্না করা ছাড়া আর কিছু করার জ্ঞান তার ঘটে নেই। গায়ে শক্তি ছিল, এখনো আছে; কিন্তু রমিজের নিজের সংসারের কাজের মোকাম শেষ হলে ধর্মের দোহাই দিয়ে তাকে মানুষের বাড়িতে কাজ করতে দেয়নি রমিজ। মুসলমানের স্ত্রীর মুখ অন্য পুরুষে দেখা না-জায়েজ, হারাম – রমিজ এই বিশ্বাস ধারণ করে আছে আশৈশব থেকে। তাছাড়া 888sport promo codeদের রোজগারও হারাম বলে অনুফাকে মানুষের বাড়িতে কাজে লাগার সুযোগ দেয়নি।
অনুফা চুপ করে বসে থাকে রমিজের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত। গ্রামের রেওয়াজ মান্য করতে হয় – 888sport promo codeরা পুরুষদের খাওয়ায়ে থাকলে খাবে, না থাকলে উপোস করবে।
রুটি খাওয়া শেষ করে দুই গেলাস পানি পান করে হুঁকো নিয়ে আঙিনায় গিয়ে বদ্দিরাজ গাছের শেকড়ে বসে ধীরে ধীরে দম দেয় রমিজ। জোরে দম দিলেই খক খক খ… কাশিটা বড় জ্বালায়। হাভাতের সংসারে ভাত না জুটলেও তামাকের ব্যবস্থা যেভাবেই হোক করা চাই। নিজের মুরোদে না কুলোলে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছ থেকে কয়েক ছিলিম তামাক জোগাড় করে রাখে। খাওয়ার পর তামাক পান না করলে রমিজের মনে হয় জীবনই বরবাদ।
রমিজ বাইরে গেলে একটি রুটির একটু একটু করে ভেঙে মুখে দিয়ে চিবোয় অনুফা। তারপর এক ঢোক পানি দিয়ে গলা পার করে। চাপার দু-তিনটা দাঁত নড়বড়ে হওয়ায় রুটি চিবোতেও জোর পায় কম। কখনো দাঁতের ব্যথায় অস্থির হয়ে বেহুঁশের মতো পড়ে থাকে।
হুঁকো টানে রমিজ মোড়ল আর মাঝে মাঝে রহস্যময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে কী ভাবে সে-ই জানে। হয়তো কিছুই ভাবে না, অথবা ভাবে অনেক কিছুই। তার বিশ্বাস ওই আকাশের সপ্তম তলায় আল্লাহর আরশ। সেখান থেকেই আল্লাহ সব তদারক করেন আর রিজিক বণ্টন করেন। অবশ্যই তার বিশ্বাস পর্যন্তই সার। মুসলমান হলেও চার কলেমা জানবে দূরের কথা একটি কলেমাও জানে না। সেই কবে ঈদের নামাজে যেত আজ তাও ভুলে গেছে। তার মতিগতির পরিবর্তন হয়ে গেছে, ভাবে – ‘যার দুই বেলা খাওন জুডে না, হের আবার ঈদ কী?’ জীবনে কখনো কোনো মৃতের জানাজায় গিয়েছে বলেও কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই।
গ্রামের মাঝখানে দুই শতাংশ জায়গায় নড়বড়ে কুঁড়েঘরটির মালিক রমিজ মোড়ল। অর্থাভাবে গত বছর খড় কিনতে পারেনি বলে ছাউনি দেওয়া হয়নি। পুব পাশে একটু হেলে পড়েছে এবং চালের খাপকুরু ভেঙে যাওয়ার কারণে মাঝখানে সামান্য দেবে গেছে। এক পাশে দেবে যাওয়ার কারণে দূর থেকে উটের পিঠের মতো দেখায়। বর্ষায় এই দেবে যাওয়া জায়গা দিয়ে বৃষ্টির জল বাইরে পড়ার আগে ঘরের ভেতরে পড়ে আর রমিজ মোড়ল ও তার স্ত্রী কাঁথাবালিশ জড়ো করে পশ্চিম পাশে গিয়ে বিছানা পাতে। ওই বিছানার পাশে মানে বলা যায় দু-হাত উত্তর দিকেই চুলো, কয়েকটি হাঁড়ি, থালা-বাসন, মশলার কৌটা, মশলা পেষার শিল-পাটা। এ তো গত বছরের বর্ষার কথা। এ-বছরও ঘরটি মেরামত করার টাকা জোগাড় করতে পারেনি, পারবে বলে রমিজ বিশ^াসও করতে পারছে না। কীভাবে পারবে? রমিজ মোড়লের আগের মতো তেজ ও জেদ ছাড়া শরীরে শক্তি বলতে কিছু নেই। তেজ ও জেদের কারণে গ্রামের মানুষ তাকে ‘বাঘ’ বলে ডাকে। ডাকে মানে কী? গ্রামের কোনো দুষ্টু লোক তাকে ‘বাঘ’ বলে একদিন ব্যঙ্গ করেছিল, তখন থেকে রমিজের উপনাম ‘বাঘ’ আস্তে-ধীরে গ্রামে ছড়াতে থাকে এবং একসময় গ্রাম ছাপিয়ে দশ গ্রামে চাউর হয়ে যায়। এর কিছুদিন পর নাম পড়ে যায় ‘বাঘ মোড়ল’। ‘বাঘ মোড়ল’ নাম পড়ার অবশ্য একটা কারণও আছে। তখন রমিজ মোড়ল সারাদিন নিজের ঘরটির সামনে একটি কাঁঠাল গাছের ছায়ায় একটি জলচৌকিতে বসে থাকত। মাঝে মাঝে হুঁকো টানা, খাবার জোগাড় করতে পারলে খেতে ঘরের ভেতরে গিয়ে খেয়ে আবার ফিরে এসে বাইরে মূর্তির মতো বসে থাকে। ওই যে এক দৃষ্টিতে উদাস তাকিয়ে থাকত তখন গ্রামের দুষ্টু লোকটি বলত, বাঘের মতো ‘ক্ষ্যাপ ধরছে’। সে যা-ই হোক না কেন, তার শরীরের কাঠামো, মুখের অবয়ব এবং দাড়িগোঁফ মিলিয়ে তলস্তয়ের মতোই দেখা যায়।
রমিজ মোড়লকে সহসা কেউ কাজেও ডাকে না। গ্রামে কামলার খুব অভাব হলে কিংবা তার প্রতি কারো অনুকম্পা জাগ্রত হলে বাঁশবেতের হালকা কাজ করার জন্য, কামলার জন্য ডেকে নেয়। গ্রামের কলেজপড়ুয়া হামিদ বলে, ‘সে এখন এই ভুবনের বাতিল মাল।’ এ-কারণেই অকেজো মানুষের দলে গণ্য। ওই যে, আগে বলা হলো তার তেজ ও জেদের কথা – তেজ ও জেদের কারণে দিনরাত উপোস দেবে, কিন্তু ভিক্ষে করবে না। উপরন্তু তার রয়েছে পারিবারিক খান্দান ও ঐতিহ্যের দেমাগ। মোড়ল বংশের লোক হয়ে কারো দানদক্ষিণা গ্রহণ করবে কেন? প্রয়োজনে পেটে বাঁধ দিয়ে পড়ে থাকবে, কিন্তু তবু কারো কাছে হাত পাতবে না। অনেকেই বলেছে অনুফাকে ধান ভানার কাজে পাঠাতে। সজ্জন কুদ্দুসের বাড়িতে অনেকেই কাজ করে, সেখানেও যেতে পারে। তখন তার দেমাগের পারদ কয়েক ডিগ্রি ওপরে ওঠে, চরম মেজাজ দেখিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে, ‘মাইয়া মাইনসের কামাই হারাম। আমার বউ কেউর বাড়িত কাম করতে যাইতো না।’ বিয়ের পর থেকে অনুফা বেগানা পুরুষের মুখ দেখেনি, নিজের মুখও কোনো বেগানা পুরুষকে দেখায়নি। দেখায়নি মানে রমিজের কড়া শাসনের কারণে ঘর থেকেই বের হওয়ার সুযোগ নেই। পর্দার ব্যাপারে এতটাই কড়া সে!
একসময় রমিজের খান্দান ছিল বইকি? এমনিতেই তো আর মোড়ল পদবি জোটেনি। এই পদবি বা উপাধির জোরালো ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল বলেই মোড়ল উপাধি তাদের দেওয়া হয়েছিল। দিন তো খুব বেশি গড়িয়ে যায়নি। এই তো সেদিনের কথা! এমনই মনে হয় রমিজের কাছে। কিন্তু সেদিনের কথা হলেও এর মধ্যে গড়িয়ে গেল পঁয়ত্রিশটি বছর। পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথাই যদি ধরা হয় তাহলে – তখন রমিজ ও তমিজ দুই ভাইয়ের শরীরের গড়ন, শক্তি আর কর্মক্ষমতার দাপট ছিল এই গ্রামে। সাড়ে ছয় ফুট লম্বা তমিজ আর রজিম ছিল তার চেয়ে ইঞ্চি দু-এক খাটো। বাবার সম্পদ ও নামডাকও কম ছিল না। তখন তাদের সংসারের সুখ দেখে শুধু নিজ গ্রামের মানুষই নয়, পাশের কয়েক গ্রামের মানুষও ঈর্ষাকাতর হতো। দুই ভাইয়ের বিয়েও দেওয়া হয়েছিল ঘটা করে। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন টিকল না। ধীরে ধীরে বৃষ্টির পানিতে যেভাবে ভূমি ক্ষয়ে যায়, তাদের সংসারের সুখও সেভাবে অদৃশ্য ইঙ্গিতে ক্ষয়ে গেল। সূত্রপাতটা ছিল তমিজের মৃত্যু দিয়ে। এক রাতে তমিজ কলেরায় পড়ে, দুদিন পর ভোরে তার হৃৎপিণ্ড থেমে যায়, থেমে যায় রক্তের গতি। গলায় গলায় বড় হওয়া দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট ভাই মারা যাওয়ায় রমিজ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে চূড়ান্তভাবে এবং তার মনোজগতে বাসা বাঁধে একটি কথা যে, ছোট ভাই মরে গেলে বড় ভাই আর কত দিনই বা বাঁচবে? তার মৃত্যুও আসন্ন। ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে রমিজের সংসারের কাজকর্মের প্রতি অনীহা, আলস্যে দিন কাটানো, গ্রামে-গঞ্জে ঘাটু গান, বাউল গান, নাটক, যাত্রা, নৌকাবাইচ, কুস্তিখেলা ইত্যাদিতে মেতে থেকে আনন্দ-ফুর্তিতে ডুবে জীবনকে উপভোগ করতে লাগল। সুযোগ বুঝে পাটের ময়ালে পাট বিক্রি করে গঞ্জে নিষিদ্ধ পাড়াতে যাওয়ার গোপন ইতিহাসও আছে। নিজে কিছু হালগিরস্তি করত আর পৈতৃক সম্পত্তির ওপর কলম চালাতে শুরু করল। সম্পত্তি বিক্রির দুষ্টচক্রে পড়লে কেউ আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না; রমিজ মোড়লও পারেনি। না-হয় এক একর পৈতৃক ভিটায় কয়েকটি দশাসই টিনের ঘর ছিল একসময়, সেগুলো শেষ করতে করতে এক শতকের একটি কুঁড়েঘরে তার জীবনযাপনের কী কথা ছিল? গাঁয়ের মুরুব্বিরা জমি বিক্রি করে আমোদফুর্তি করে সম্পদ ধ্বংস না করার পরামর্শ দিলে রমিজ মোড়ল বলত, ‘আমি নিঃসন্তান মানুষ। আমি মইর্যা গেলে আমার জমিন কার লাইগ্যা রাইক্যা যাইবাম?’
মুরুব্বি বোঝাতেন, ‘তুমি কি অহনই মইর্যা যাইবা?’
‘ছোডো ভাই গেল গা, আমি আর কয় দিন থাকবাম?’
‘হায়াৎ-মৌত আল্লাহর হাতে। কে কখন যাইবো কেউ জানে না রমিজ। তুই কাজকাম কর। সহায়সম্পত্তি আর বেচিস না।’
‘আইচ্ছা দ্যাহা যাইবো।’
একরোখা রমিজ কারো কথায় কান না দিয়ে নিজ সিদ্ধান্তেই অবিচল থেকে মনে মনে হিসাব করে – জমি বিক্রি করে খেলেও আরও পঞ্চাশ বছর চলবে। এই হিসাবও বড় কথা নয়। তার বিশ্বাস যে, সে খুব তাড়াতাড়িই মারা যাবে। ছোট ভাই মরে গেছে, সে কীভাবে বাঁচবে? তার অবিচল বিশ্বাস ও সিদ্ধান্তের কারণেই মুরুব্বিদের বুদ্ধি বা পরামর্শকে মান্য না করে সম্পত্তি বিক্রি করেছে আর ফুর্তি করে টাকা উড়িয়েছে।
শুধু রমিজের জেদই নয়। রমিজের জমি বিক্রি করার জন্য গাঁয়ের নকিব উদ্দিনের কারসাজিও ছিল। ফাঁদে ফেলে তার জমি ধীরে ধীরে অল্প টাকায় হাতিয়ে নিতে থাকল নব্যধনী নকিব উদ্দিন। এখন তার দিকে ফিরেও তাকায় না।
রমিজের ভাবনায় ছেদ পড়ে যখন দেখল পাশের গ্রামের তরুণ নাপিত ধীরেন্দ্র সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে – ‘অ্যাই ধীরু, অ্যাই ধীরু, ভাই খাড়া একটু।’
‘না অহন সোমায় নাই। বওনিও করি নাই।’
‘আরে চুল-দাড়িডা খুব বড় অয়া গ্যাছে। এই ভাই। দাদা ভাই আমার, সামনের মঙ্গলবারে ট্যাহা দেয়াম নে।’
রমিজের আকুতিতে ধীরেন্দ্রর মন গলেনি, দাঁড়ায়ওনি। সে জানে চুল-দাড়ি-বগল কেটেছেঁটে দিলেও রমিজের টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এক পোয়া চাল দিলেও হতো। কিন্তু সে সামর্থ্যও তার নেই। সকালবেলা বাকিতে কাজ করে সারাদিন ‘কুসাইট’ লাগবে ভেবে সে ধীর পদক্ষেপে হাঁটতে থাকলে রমিজ ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, ‘কী রে ধীররোয়া, পুটকিডা মোচুইরেয়্যা মোচুইরেয়্যা যাইতাছছ গা ক্যারে? তোর ট্যাহা কি মাইর্যা খাইছি কুনোদিন?’
শত হলেও বয়স্ক মানুষ। একটা অজুহাত দেখিয়ে অন্তত অন্তর্হিত হওয়া উচিত ভেবে সে বলে, ‘দিরং অইয়া যাইবো চাচা। আইজ ক্ষেমা করহাইন। আমি অহন কইলমাগাতি যাইতাছি। আইয়ে মঙ্গলবার এইহানেই গাও করবাম …।’ শেষের কথাগুলো রমিজ শুনতে পায় না, ধীরেন্দ্র দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
ধীরেন্দ্র রমিজের কথা পাত্তা না দিয়ে গ্রামের পথ দিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘হালার ভাই হালা, আরো দুইবার মাথা ছাডনের ট্যাহা দ্যাও নাই। মনে করছো আমি ভুইল্যা গ্যাছি? অহন বেইন্যা বেলা বউনি না কইর্যা তোমার বগলে ক্ষুর লাগাইবাম! কুসাইট লাগুক। আমারে তো আর ভূতে কিলায় নাই।’
ধীরেন্দ্র অন্তর্হিত হলে রমিজ নিজের কপালের দোষ দিয়ে কতক্ষণ আবোল-তাবোল বকল, ‘ধীরু অ্যাংকার করে! আহা! একদিন সুযোগ পাইলে সাইর কইর্যা ছারবাম হারামজাদা। আমারে তুই চিনোস না …।’
অনুফা ঘরের পেছন দিক থেকে জঙ্গল থেকে কয়েকটি শুকনো কাঠ এনে রান্নাঘরে রাখে। দুপুরে খাওয়ার মতো ঘরে চাল নেই। সে ভাবছে রমিজ চালের ব্যবস্থা করতে পারলে দুপুরে খাওয়া হবে, নইলে নেই। লাকড়ির জোগাড় তো করতে হবে।
হুঁকোটা রেখে রমিজ কাঁধে গামছা ফেলে আস্তে আস্তে ঘরে এসে কাঁঠালটা উল্টাতেই তার মাথার চাঁদি গরম হয়ে ওঠে। কপালে হাত দিয়ে মাটিতে ল্যাছা মেরে বসে পড়ে। রমিজ হঠাৎ এমন করে বসাতে হনুফা কাছে এসে দাঁড়ালে রমিজ বলে, ‘হারামজাদা উন্দুরে কী কামডা করছে দ্যাখছোস?’
হনুফা হাত লাগিয়ে কাঁঠাল উল্টিয়ে দেখে সামান্য একটু খাওয়া। হতাশ ও করুণ চোখে তাকায় রমিজের দিকে – ‘অহন বেচোন যাইবো?’
রমিজ উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ক্রোধের তাণ্ডবে মনের সব কথা হারিয়ে গেছে। সে গামছটা মাথায় বেঁধে কাঁঠাল নিয়ে রওনা হয় বাজারে। গঞ্জে সকালেও বাজার বসে।
কিছু চাল-আটা আনতে হবে আর সামান্য খড় কিনে ঘরের চাল ঠিক করতে হবে।
হেঁটে গ্রাম ছেড়ে কিছুটা দূরে ছোট নদীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায় রমিজ। সকালের কোমল রোদের মেজাজ চড়ে গেছে। তপ্ত হাওয়ায় রমিজের শরীরের ত্বক চিড়বিড় করছে। নদী তো আর নদী নেই। এখন খালের মতো হলেও নদীর সিনার ভেতরে সামান্য পানি জমে থাকে সারা বছর। বর্ষায় একটু বেশি জল গড়ায়। একটা পুরনো ভাঙা নৌকায় খেয়া পারাপার করে হলুদ মিয়া। নৌকাটি ওপারে বাঁধা। রমিজকে দেখেও দেখেনি এমন ভাব করে সে গলুইয়ে বসে থাকে, নড়ার কোনো ইচ্ছেই নেই। রমিজ কয়েকবার ডাক দেওয়ার পরও কোনো সাড়া দেয়নি সে। উত্তপ্ত রোদের বাড়বাড়ন্ত। রমিজের চান্দি ক্রমে গরম হলে বিড়বিড় করে খিস্তি করে। কিন্তু রমিজ যে মানুষ হিসেবে মূল্যহীন তা নিজে বুঝতে পেরে নদীর কিনারে ঘাসের চাতালে পা ছড়িয়ে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর গ্রামের কুদ্দুস এলে তাকে দেখেই হলুদ মিয়া নৌকা ভিড়ায়। রমিজকে উদ্দেশ করে হলুদ মিয়া বলে, ‘তুমি কিছু দেও না। নাওয়ে উইঠো না’।
রমিজ তার কথা কানে তোলেনি। অস্ফুট উচ্চারণে বলে, ‘দেই নাই, দেয়াম নে। তর ট্যাহা কেউ মাইর্যা খাইছে?’
হলুদ মিয়া আবার বলে, ‘ট্যাহা ছাড়া নাওয়ে উডন যাইতো না।’
সমাজ-সংসারে হেরে যাওয়া এককালের তেজস্বী রমিজ এখন নিরীহ গোবেচারা, পদে পদে লাঞ্ছনাই তার প্রাপ্য। কেউ যখন তাকে লাঞ্ছনা করে, তখন সে বধির হয়ে যায়। বধির না হয়ে উপায়ও নেই। রমিজ বুঝতে পারে কথার প্রতিবাদ করলে লাঞ্ছনা আরো বাড়বে। কুদ্দুস রমিজের প্রতি দয়ার্দ্র হয়ে বলে, ‘এই হলুদ্দেয়া, নাও ছাড়। রমিজ চাচার ট্যাহা আমি দেয়ামনে।’
হলুদ মিয়া নৌকা ছাড়ে। সামান্য নদী, হয়তো বড়জোর বিশ-ত্রিশ হাত প্রশস্ত হবে। বৈঠা দিয়ে দুই পাক দিলেই
এপার-ওপার। তবু হলুদ মিয়া রমিজকে ছাড় দেয়নি। তার কথাগুলো কাঁটার মতো এখনো মগজে বিঁধে আছে। আর ক্রোধ দাপাদাপি করছে করোটির ভেতরে। কুদ্দুস একটি আধুলি বের করে দিয়ে বলে, ‘দুজনের ফারানি, ল।’
কুদ্দুস দ্রুত হেঁটে চলে যায়। রমিজ ধীরে ধীরে বাজারে যায়।
ইঁদুরে খাওয়ার কারণে কাঁঠালটি কম দামে বিক্রি করতে হলো। কিছু চাল আর আটা কিনে সে বাড়ির দিকে রওনা না হয়ে অন্য পথে যাওয়ায় কুদ্দুসের সঙ্গে আবার দেখা হয়।
কুদ্দুস জিজ্ঞেস করে, ‘এইন দেয়া কই যাইবা চাচা?’
‘কান্দিফাড়া’, নিস্পৃহ উত্তর দেয় রমিজ। তার চোখ ঢুলু ঢুলু। হাঁটতেও কোমরে ব্যথা অনুভব করে। সে মাটির দিকে তাকিয়ে ধীরপায়ে হাঁটে।
‘কী কামে যাও?’
‘ঘরের চালো টোনা দেওনের লাইগ্যা বাতেন কইছিল ডেঙ্গা দিবো। গিয়া দ্যাহি দেয়নি।’
কর্মব্যস্ত মানুষ কুদ্দুস কথা না বাড়িয়ে দ্রুততর গতিতে বাড়ির দিকে পা চালায়।
বাতেন তার পুরনো আত্মীয়। অনেক ধনী মানুষ। রমিজের মতো দশজন মানুষকে সারাজীবন পালা তার জন্য কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু কখনো মানুষকে সাহায্য করেছে – এমন কোনো ইতিহাস নেই।
বাতেনকে বাড়িতে না পেয়ে বৈঠকখানায় ঘণ্টাখানেক বসে থাকে রমিজ। তারপর হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরে।
এবারো নদী পার হওয়ার সময় হলুদ মিয়া ঝামেলা বাধাল। গাঁয়ের আরো দুজন লোক থাকাতে রমিজ কোনোমতে পার হয়ে বাড়ি আসে।
গতরাতে বৃষ্টির ছাঁটের কারণে ঘুমাতে পারেনি রমিজ-দম্পতি। অনিদ্রার কারণে শরীরটা বেশ কাহিল লাগছে। আজ রাতেও বৃষ্টি আসে কি না ভেবে রমিজের কপালে ভাঁজ পড়ে। আকাশের অবস্থা ভালো নয়। মেঘ জমে আর ভাঙে। ভাঙে আর জমে। মেঘের বড় রহস্যময় খেলা।
অনুফার হাতে চালের পোঁটলা দিয়ে রমিজ আবার আঙিনায় গাছের নিচে হুঁকো নিয়ে বসে। তখন প্রায় বিকেল। খিদে লাগলেও নিঃশব্দে সহ্য করা ছাড়া কাউকে বলার সুযোগ নেই। হুঁকোতে ধীরে ধীরে দম দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। মাথায় হাত বুলায় রমিজ। চুলগুলো খড়ের মতো আঙড়া। এক ফোঁটা তেল দিতে না পারায় তার আক্ষেপের শেষ নেই। অনুফার চুলেও ছয় মাসে এক ফোঁটা তেল পড়েনি। এই সময় রমেশ তেলি তেলের ভার নিয়ে যাচ্ছে। রমিজ ডাক দেয়, ‘ওরে রমেশ, মাথাডা খুব ছড়ছে। আতের তালুডার মধ্যে এক ফোঁডা তেল দিয়া যা ভাই। ভগবান তর মঙ্গল করবো।’
‘হ, তোমার তেল দিয়া যাই …’ বিড়বিড় করে রমেশ তেলি কিছুটা পথ এগিয়ে যায় দ্রুত। অনেকটা দূরে গিয়ে রমিজের করুণ চোখ ও শুকনো মুখটি তার চোখে ভাসে – মায়া লাগে। প্রায় সমবয়সী, কয়েক বছর আগেও কত খেয়ালমশকারি করত। আজ এক ফোঁটা তেল চাইল আর সে চলে এলো! পুরনো সখ্য জেগে ওঠাতে ফিরে এসে কাঁধ থেকে ভার নামিয়ে বলে, ‘তালুডা ফাতো দ্যাহি।’
রমিজের মুখে সুখের হাসি ছড়িয়ে পড়ে। ডান হাতটি পাছার লুঙ্গিতে ঘষে পরিষ্কার করে বাড়িয়ে দিলে রমেশ তেলি ছোট কৌটায় এক কাচ্চার মতো তেল চেটোয় ঢেলে দেয়। সে হুঁকোটা রমেশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘দে, টান দে।’
‘তামুক আছেনি? না খালি উক্কা লইয়া বইয়া রইছো আর ধুয়া ছাড়তাছো?’
রমিজ হাসে, ‘আছে। টান দে।’
হাসলে মানুষটিকে বড় ভালো দেখায়। রমেশের বড় ভালো লাগে। সে রমিজের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, ‘আহা, মানুষের জীবন! এত দেমাগি মানুষটার এই পরিণতি!’
রমেশ হুঁকোয় দম দেয়। রমিজ হাতের তালুর তেল মাথায় পরম যত্নে আলতো করে ঘষতে থাকে। বিড়বিড় করে বলে, ‘তালুডা খুব গরম অইয়া যায়। তেলফানি কই ফাই ক রমেশ? দ্যাশে বড়ো অভাব। নাই কাজকম্ম।’
কিছুক্ষণ আগের হাসিটি দেখে রমেশের যতটা ভালো লেগেছিল এখন রমিজের খেদোক্তি শুনে ঠিক ততটাই খারাপ লাগে। তার ইচ্ছে হয় আরো কিছুটা তেল দিয়ে যেতে কিন্তু নিজের সামর্থ্যই বা কোথায়! তাকেও বিষণ্নতায় জেঁকে ধরে। এখানে আর বসতে ইচ্ছে হয় না, হুঁকোটি রমিজের হাতে দিয়ে কাঁধে ভার নিয়ে হাঁটতে শুরু করে।
মাথার তালুতে তেল ঘষে পরম প্রশান্তি অনুভব করে রমিজ। রমেশ দৃষ্টির আড়ালে গেলে রমিজ আরো তিনবার মাথার তালুতে হাতের তালু দিয়ে ঘষে।
দিবানিদ্রার চর্চা গ্রামের মানুষের সাধারণত থাকে না – রমিজেরও নেই। সন্ধ্যায় চারটি ভাত পেটে চালান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, জাগে পাখিদের সঙ্গে। দুপুরের পর থেকে আকাশ বেশ গজরাচ্ছে। কালো বুনো ভইষের মতো মেঘখণ্ডগুলো মাতাল হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। যদি জমাট বাঁধে তাহলে বড় ধরনের ঝড় হতে পারে; তুমুল বৃষ্টিও হতে পারে। রমিজ-দম্পতি আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যে রণসাজে আকাশ রুদ্রমূর্তি ধারণ করছে, যদি সেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে খড়ের ঘরটি উড়িয়ে নিতে পারে।
সন্ধ্যার পর শুরু হলো প্রবল ঝড়। রমিজের ঘরটি নাগরদোলার মতো কিছুক্ষণ কাঁপে। তারপর একসময় ভেঙে পড়ে। ঘরের একটি ধরনায় চাপা পড়ে রমিজের শরীর। অনুফা চিৎকার করে মানুষ ডাকাডাকি করে কাউকে পায়নি। একদিকে ঝড়ের তাণ্ডব, অন্যদিকে এই বিচ্ছিন্ন বাড়ি থেকে অনুফার মতো বৃদ্ধার ডাক কত দূরেই বা যাবে? কে-ই বা শুনতে পাবে?
গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘরের ধরনাটি সরিয়ে রমিজকে টেনে ভাঙা চালের নিচে বসায়। রমিজ হাঁপাচ্ছে – ‘এট্টু ফানি দে, এট্টু ফানি’, অস্ফুট উচ্চারণে পানি চাইলে অনুফা মাটির কলসির দিকে তাকিয়ে দেখে ঘরের চালের আঘাতে কলসিটা ভেঙে গেছে। কলসির পানিতে ঘর ভেসে গেছে। বিছানা ভেসে গেছে। সে অ্যালুমিনিয়ামের জগটি নিয়ে ভাঙা বেড়া দিয়ে বের হয়ে পাশের পুকুর থেকে পানি এনে রমিজের মুখে দেয়। এক জগ পানি এক ঢোকে গিলে রমিজ ফ্যালফ্যাল করে অনুফার দিকে তাকিয়ে থাকে – এই দৃষ্টি যেন অমোঘ কৃতজ্ঞতার ভাষা।
পরদিন সকালে অসাড় ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে রমিজ ভাঙা ঘরের দাওয়ায় বসে আছে। অনুফা দৃঢ় পদক্ষেপে আঙিনার বাইরে পা বাড়ায়। দীর্ঘ দাম্পত্যজীবনে কোনোদিন অনুফা ঘরের বাইরে যায়নি, রমিজের অনুমতি ছাড়া কথাটি পর্যন্ত বলেনি, আজ কেন সে না বলে এমনভাবে ধাঙড়ি 888sport promo codeর মতো বের হচ্ছে? রাগে গজগজ করতে করতে রমিজ জিজ্ঞেস করে, ‘কই যাস?’
অনুফার শিরদাঁড়া ঋজু, উন্নত শির, চোয়াল শক্ত, দৃষ্টি তীব্র – ঘাড় উল্টে রমিজের দিকে তাকিয়ে দীপ্ত কণ্ঠে বলে, ‘কুদ্দুইছ্যার বাড়িত কাম করতাম যাই।’
চিতাবাঘিনীর মতো শান্ত অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে সামনের দিকে হেঁটে যায় অনুফা আর রমিজ তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে …।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.