মোটরবাইকে ওঠার আগেই কী ভেবে থমকে দাঁড়ালো শাহীন। মনে হলো, পেছন থেকে কেউ যেন ডাক দিলো। কোনো সিরিয়াস কাজে যাওয়ার আগে এভাবে পেছন দিয়ে কেউ ডাক দিক, সেটা একেবারেই পছন্দ নয় ওর। মেজাজটা একেবারেই খিঁচড়ে গেল। মাথায় হেলমেটটা গলানোর আগে ধীরে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকালো। পরিচিত কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি হলো!
চারপাশ জুড়ে ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার নামছে। কাছেপিঠের দোকানপাটে আলো জ্বলে উঠেছে। রাস্তায় ভিড় বাড়ছে। ওপাশ দিয়ে ধীরগতিতে দুটো রিকশা আর একটা মোটরসাইকেল বেরিয়ে গেল।
এবার বাইকে ওঠার আগে আরেকবার কোমরের দু’পাশে আর পেছন দিকে একবার হাত বুলিয়ে দেখে নিল, দুটো জিনিসই ঠিক আছে। মোবাইল ফোনটা ডান পকেট থেকে তুলে নিয়ে প্যান্টের বাঁ পকেটে রাখলো, একবার ভাবল, বন্ধ করে রাখবে কি না। পরমুহূর্তে ভাবল, সেটা কি ঠিক হবে? যদি কেউ জরুরি কোনো কল করে, তাহলে তাকে পাওয়া যাবে না। তাছাড়া স্পটে গিয়ে সুমনকে মোবাইলে খোঁজা লাগতে পারে। এসব ভেবেচিন্তে মোবাইলটা খোলাই রেখে দিলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো, কোনো কিছুতেই কোনো তাড়াহুড়ো করা যাবে না। কোনো সূত্র রাখা যাবে না কোথাও।
এইসব ভাবতে ভাবতে ধীরে ধীরে বাইক চালিয়ে একসময় বড় রাস্তায় উঠে এসে একটু থামল। কাজের ছকটা আরেকবার মনে মনে ঝালিয়ে নিল।
ঠিক এই সময় একটা মোটরসাইকেল পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ ব্রেক চেপে পাশে এসে দাঁড়ালো কেউ, আরে শাহীনই তো, আধো অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, দেখলাম আমার আন্দাজ ঠিক, যাচ্ছো কোথায়?
মনে মনে বিরক্ত হয়ে রেগে গেলেও মাসুমকে মনের ভাবটা বুঝতে দিলো না শাহীন। বলল, এই তো, একটা জরুরি কাজে যাচ্ছি।
– তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলার ছিল, মাসুম বলে, আচ্ছা ঠিক আছে, জরুরি কাজে যাচ্ছো, যাও। কালকে আসবে তো ক্লাবে, তখন না হয় বলব?
শাহীন কথা বাড়ায় না। বলে, ঠিক আছে।
বাইকে স্টার্ট দিতে দিতে হঠাৎ মাসুম বলে, অস্ট্রেলিয়া থেকে সুমন এসেছে। দেখা হয়েছে? এই তো বিকেলে দেখা হলো, কিছুক্ষণ কথাবার্তাও হলো। কোনো কারণে কিছুটা ব্যস্ত মনে হচ্ছিল।
কোনো কথা বলে না শাহীনও মনে মনে খিস্তি ঝাড়ে, শালার দেখা হতে আর সময় পেল না। মনের মধ্যে নানা ভাবনাচিন্তা নিয়ে চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে বাইক চালিয়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে।
মিনিট দশেক পরে শাহীন পৌঁছে যায় চৌরাস্তায়। বাঁ দিকের রাস্তাটা চলে গেছে ধূপখোলার দিকে। ডানদিকে কিছুদূর গেলেই টেকনিক্যাল। এখানে একটা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে। তারপরেই ‘ক্যাফে ঝিল’ নামের সেই নতুন রেস্টুরেন্টটা।
এখানেই সে আসতে বলেছে সুমনকে। এখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে। সুমনকে নিয়ে চলে যাবে পলিটেকনিকের পেছনে ঝিলটার কাছে। বেশ বড় ধরনের ঝিলটার পাশে ওয়াকওয়ে আছে, মাঝে মাঝে আছে বসার জায়গা। বিকেলবেলার দিকে ঘোরাফেরার জন্য এখানে বেশ লোকজন আসে, তবে তারা সাধারণত সন্ধ্যার পরে আর থাকে না। দু-চারজন যারা থাকে, তারাও একটু রাত হলেই চলে যায়। তখন পথের পাশের বুনো ঝোপঝাড়গুলোতে অন্ধকার জমাট বাঁধতে থাকে আর জোনাকির মেলা বসে।
‘ক্যাফে ঝিলে’র সামনে এসে থামে শাহীন। বাইক থামিয়ে চারদিকের পরিবেশটা একবার দেখে নেয়। শনিবারের সন্ধ্যা বলে লোকজনের বেশ ভিড় দেখা যাচ্ছে। কেমন নিশ্চিন্তমনে মানুষজন চলাফেরা করছে। কারো মনের কথা কেউ বুঝতে পারছে না। যেমন, এখানে কেন এসেছে। নিজে ছাড়া কেউ জানে না, বুঝতেও পারছে না।
এর মধ্যে হঠাৎ শাহীন অনুভব করে, কপালের বাঁ দিকে কানের ওপরের শিরাটা কেন যেন লাফাচ্ছে। ওপরে কিছু বোঝা না গেলে ভেতরে ভেতরে টেনশন চলছে, এটা সম্ভবত সেজন্যই হচ্ছে। সব মিলিয়ে মনের ভেতরে কেমন একটা অস্বস্তি চলছে।
বাইক থেকে নেমে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরায় শাহীন। কিন্তু অস্বস্তি কাটে না। আর ঠিক সেই মুহূর্তে কেন যেন জিনিয়ার মুখটা হঠাৎ মনে পড়ে যায়। আসলে ওর জন্যই তো এতসব আয়োজন। ওদের দুজনার মধ্যে জিনিয়া না থাকলে এসব ঘটনার হয়তো শুরুই হতো না।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে প্রতিশোধের আগুনটা আবার নতুন করে জেগে ওঠে শাহীনের বুকের ভেতরে। এর মধ্যে সুমন সম্পর্কে আরো অনেক খবর নেওয়া হয়ে গিয়েছে, যে কারণে আরো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে সে।
আসলে ও তো একটুও কম ভালোবাসতো না জিনিয়াকে। জিনিয়াও ওকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, এমন কথাই তো বলেছিল। কিন্তু তারপরেও একসময় সুমনকে পেয়ে সবকিছু ভুলে গেল! মেয়েরা কেন এমন হয়? এই প্রশ্নের উত্তর কোথাও কখনো খুঁজে পায়নি শাহীন। আর অন্যদিকে, ওদের সম্পর্কের কথা জেনেও, শাহীনের একজন ভালো বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও সুমন ওর কথা একটুও ভাবলো না? এতটা স্বার্থপর আর নিষ্ঠুর কেমন করে হয় মানুষ!
এতদিনের বন্ধুত্বের যেমন কোনো মূল্যই দেয়নি সুমন, তেমনি ওর পাগলের মতো, অন্ধের মতো ভালোবাসারও কোনো মূল্য না দিয়ে, সব বন্ধন ছিন্ন করে চলে গেছে জিনিয়া।
এভাবে ওকে হারিয়ে দিয়ে নিজে জিতেছে। ওর দুর্দমনীয় লোভ ছিল বিদেশে যাওয়ার। সেই লোভ সে পূরণ করেছে সুমনকে দিয়ে।
শাহীন ভাবে, এখন সত্যিই যদি সুমন আর এই পৃথিবীতে না থাকে তখন কি হবে? তখন সে কি আবার ফিরে আসবে শাহীনের কাছে? এই প্রশ্নটির কোনো উত্তর নেই ওর কাছে।
জ্বলন্ত সিগারেটটা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। দু-আঙুল ঘুরিয়ে সেটাকে দূরে ছুড়ে দেয়। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই পকেটের ভেতরে মোবাইলটা বেজে ওঠে। কিছুটা চমকে উঠে মোবাইলটা তুলে তাকাতেই স্ক্রিনে সুমনের নাম ভেসে ওঠে। রিসিভ বাটনে চাপ দিয়ে হ্যালো বলেই সামনের দিকে তাকায়। দু-মিনিটের মধ্যেই সুমনকে রেস্টুরেন্টের গেটের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে শাহীন মনে মনে বলে, এ তো দেখছি মেঘ না চাইতেই জল। হাত তোলে শাহীন, বাইক লক করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
সুমনকে সঙ্গে নিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে কোনার দিকের একটা খালি টেবিলে দুজনে বসে পড়ে।
হঠাৎ করে এত জরুরি তলব কেন? বসতে বসতে বলে ওঠে সুমন, এমন কি জরুরি কথা, যা অন্যদের সামনে বলতে পারলে না!
চমৎকার একটা ভালো মানুষের মুখোশ পরে আছে সুমন, যেন নিপাট ভদ্রলোক।
আছে, শাহীন বলে, এখন তেমন কোনো ব্যস্ততা নেই তো তোমার?
হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে সুমন, এখন বাজে সাড়ে আটটা, অসুবিধা নেই, দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত থাকতে পারবো।
ঠিক আছে, শাহীন জিজ্ঞেস করে, কী খাবে বলো?
তোমার যা খুশি, আমার কোনো চয়েজ নেই।
তাহলে কাটলেট বা ফিশ ফ্রাই যেটা পাওয়া যায় নিয়ে নিচ্ছি, বলে একটু দূরে থাকা ওয়েটারকে ডেকে অর্ডার দিয়ে দেয়।
এখন বলো কি তোমার জরুরি কথা, হাসতে হাসতে সুমন বলে ওঠে, বিদেশে যেতে চাও নাকি আবার?
ইচ্ছে করলেই কি যাওয়া যায়? যেমন চাইলেই কি সবকিছু পাওয়া যায় ?
কেন পাওয়া যাবে না, সুমন বলে, তেমনভাবে চাইলে নিশ্চয়ই পাওয়া যায়।
ফিশ ফ্রাই আর কফি চলে এসেছে। একটা প্লেট সামনে টেনে নিয়ে শাহীন বলে, আসলেই কি পাওয়া যায়! সবাই কি সবকিছু পায়? অনেকে তো পেয়েও হারায়। এটাই পৃথিবীর নিয়ম।
তুমি ওভাবে কথা বলছ কেন, শাহীন, সুমন একটু অবাক কণ্ঠে বলে, আমি কিন্তু সত্যি সিরিয়াসলি কিছু বলছি না। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড যদি …
শাহীন কোনো উত্তর দেয় না। দুজনেই চুপচাপ খেতে থাকে। একসময় খাওয়া শেষ হলে শাহীন একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে, সিগারেট নেবে নাকি একটা?
না, প্লিজ, এখনো ও রস থেকে বঞ্চিত। হাসে সুমন।
ঠিক আছে, চলো একটা কাজ করি, এখানে বসে না থেকে ঝিলের পার দিয়ে ঘুরে আসি।
এই রাতের বেলা, অন্ধকার না …, খসখসে গলায় সুমন বলে।
স্ট্রিট লাইট আছে। শাহীন উঠে দাঁড়ায়, বিল দেওয়ার জন্য ওয়েটারকে ডাকে, আরে কোনো ভয় নেই, চলো …
কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুমন বাইরে চলে আসে শাহীনের সঙ্গে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঝিলের পাড়ে চলে আসে তারা। প্রায় ৯টা বাজে। স্বাভাবিকভাবেই লোকজন কমে গেছে।
বেশ কিছুটা পথ হেঁটে এসে ওরা একটা বেঞ্চের উপরে বসে। ঝিলের জলের উপর দিয়ে বয়ে আসা হাওয়ার শীতল স্পর্শ ওদের ছুঁয়ে যায়।
শাহীন চারদিকে একবার তাকায়। ঝিলের ওপারে অন্ধকারে ডুবে থাকা ঘরবাড়ির জানালায় জানালায় মৃদু আলোর ইশারা ফুটে উঠেছে।
দুজনেই চুপচাপ বসে থাকে। একসময় নীরবতা ভাঙে সুমন, কি ব্যাপার শাহীন, আসলে তুমি কি কিছু বলতে চাইছো?
এবার তোমার সঙ্গে কি জিনিয়াও এসেছে?
না। জিনিয়া আসতে পারেনি, ওখানে ওর কিছু জরুরি কাজ আছে, সেগুলো শেষ করতে পারেনি। তবে জানো তো, হাসতে হাসতে বলে সুমন, ও কিন্তু তোমার কথা প্রায়ই বলে। এবার ফিরে যাওয়ার পরেও ঠিক তোমার কথা জিজ্ঞেস করবে, 888sport app চেনাজানা মানুষদের সঙ্গে তোমাদের বাড়ির সবার খোঁজখবরও নেবে।
কোনো কথা বলে না শাহীন। কিন্তু ওর অজান্তেই বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। রক্তের ভেতরে যেন তাপ সঞ্চারিত হতে থাকে। মেজাজ বিগড়ে যায়, কি চমৎকার অভিনয় করে যাচ্ছে সুমন! ওর ভেতরে লুকানো শয়তানির কিছুই বোঝা যাচ্ছে না বাইরে থেকে।
তাই নাকি! জিনিয়ার এখনো তাহলে মনে আছে আমার কথা! শাহীন বলে, এখন আবার এত করুণা কেন আমার জন্য!
করুণা কেন বলছো, বিষয়টা তুমি ওভাবে নিচ্ছো কেন শাহীন? বিষয়টাকে একটু হালকা করে দিতে চায় সুমন, তোমার একসময়ের বান্ধবী, এখন বিদেশে থাকে, সেখান থেকে তোমাদের সবার একটু খোঁজখবর নেবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।
এর মধ্যে ঝিলপাড়ের লোকজন আরো কমে গেছে। চারদিকে ঝোপঝাড় থেকে এখন শুধু ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। একটু দূরের লাইটপোস্ট থেকে আসা মৃদু আলোয় সবকিছু কেমন যেন রহস্যময় হয়ে উঠেছে।
ওদের সামনে দিয়ে দুজন পথচারী ধীরে ধীরে হেঁটে চলে গেল বড় রাস্তার দিকে।
সুমন ঘড়ি দেখে, প্রায় ৯টা বাজে।
আমার একসময়ের বান্ধবী, এখন তো তোমার বান্ধবী থেকে স্ত্রী। শাহীন বলে, এখন তো আমার চাইতেও এক ধাপ এগিয়ে তুমি।
এসব নিয়ে কি এখনো মন খারাপ করো তুমি? এখনো কি তুমি ওকে সত্যি ভালোবাসো?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শাহীন উঠে দাঁড়ায়, চলো একটু হাঁটি। সুমন ওঠে, তারপর দুজনে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যায় না। মৃদু আলো-আঁধারিতে ঝোপঝাড়ের মাথাগুলো হাওয়ায় দুলছে। কেমন একটা সোঁদা গন্ধ উঠে আসছে আশপাশ থেকে।
সুমন এমন একটা কঠিন প্রশ্ন করে বসলে শাহীন বলে, এই প্রশ্নের উত্তরটা আসলে আমিও ঠিক জানি না। কিন্তু তুমি তো ভালোবাসো।
কী জানি, আলতোভাবে বলে সুমন, এসব নিয়ে এখন আর ভাবি না। বিদেশে জীবনটা চলছে যন্ত্রের মতো। ভালোবাসা নিয়ে আদিখ্যেতা করার সময় এখন আর পাওয়া যায় না।
জিনিয়াও কি এই রকম চিন্তাভাবনা করে? যতদূর জানি, প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে ওর তো গভীর অনুভূতি ছিল। এখন কি তাহলে তাতে ভাটা পড়েছে?
জানি না। সুমন বলে, এতসব বোঝার সময় কোথায়?
সুমনের কথার ভেতর থেকে ওদের ভেতরের মানসিক গোলমালটা টের পেয়ে যায় শাহীন। বলে, মেয়েটাকে এইভাবে একেবারে যন্ত্রে পরিণত করতে পারলে, সুমন, বিবেকেও বাধলো না?
আমি তো কিছু করিনি। ওখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতিতে ইচ্ছে না থাকলেও এই পরিবর্তন মেনে না নিয়ে ওর কোনো উপায় ছিল না।
আর তাই বোধহয় ও তোমার সঙ্গে আসতে পারল না?
অনেকটা সেরকম পরিস্থিতিই ছিল। সুমন বলে, মানুষের জীবনে সব চাওয়া-পাওয়া কি পূর্ণ হয় কখনো, হয় না তো।
মনে মনে জিনিয়ার জন্য এখন যেন করুণাই অনুভব করে শাহীন। কারণ সুমন যে একটা হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল এখানে বসে জিনিয়া তো সেটা বুঝতেই পারেনি। বরং বিদেশে যাওয়ার টোপ গিলে ওর ফাঁদে পা দিয়ে ফেঁসে গেছে। না হলে এমন হবে কেন? এতদিনে দূর প্রবাসে জিনিয়ার সব ভালো লাগা আর ভালোবাসার অনুভূতিগুলোকে একে একে খুন করেছে সুমন। সে জিনিয়াকে এমন কোনো কাজে লাগিয়েছে, কে জানে। কোনো কিছুই তো পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে না।
একটা সত্যি কথা বলো তো সুমন, আসলে জিনিয়া এখন কি করছে ?
এসব জেনে তোমার কি লাভ?
কৌতূহল মাত্র। আমাদের দেশের মেয়েরা বিদেশে গিয়ে কত কিছুই তো করে, কত রকমের খবরই তো পত্রপত্রিকায় দেখি …
এসব কথা থাক, শাহীন। জীবনের এক-এক পর্যায়ে, নতুন করে অনেক কিছুই জানতে হয়, শিখতে হয়। অনেক সময় ইচ্ছে না থাকলেও তা মেনে নিতে হয়।
শাহীন এখন যেন পরিষ্কার বুঝতে পারছে, আসলে জিনিয়া এখন রীতিমতো কোনো অসহনীয় পরিস্থিতিতে আছে, যার কথা কাউকে সে জানাতেও পারছে না। আর হয়তো সেজন্যই সুমনের সঙ্গে সে এবার দেশেও আসেনি, অথবা সুমন ওকে আসতে দেয়নি।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে শাহীনের মাথার মধ্যে যেন আগুন জ্বলে যায়। এরকম ঘটনা পত্র-পত্রিকায় আগেও পড়েছে শাহীন, তখন কখনো কখনো মনে হয়েছে, জিনিয়ার জীবনে যদি তেমন কোনো ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে কী হবে, কীভাবে সে মুক্তি পাবে সেই পঙ্কিল জগৎ থেকে?
সুমনের ভালোমানুষী চেহারার অন্তরালে যে কুৎসিত মানসিকতার মানুষটিকে এখন সে চোখের সামনে দেখছে, তাকে কিছুতেই ক্ষমা করা যাবে না, মনে মনে ভাবে শাহীন। জিনিয়ার জন্য মনটা কষ্টে ভরে যায়। জিনিয়া কি কখনো ভাবতে পেরেছিল তার বিদেশ যাওয়ার দুর্দমনীয় ইচ্ছার এই পরিণতি ঘটবে!
শাহীন নিজের অজান্তেই যেন একবার কোমরে হাত দিয়ে জিনিস দুটোর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। আরো একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়, কিছুদিন আগে কারোর কারো মুখে সুমন সম্পর্কে যেসব কথা শুনেছে, এখন ওর কথা শুনে, সেইসব কথা সবটাই সত্য বলে মনে হচ্ছে।
জিনিয়ার সঙ্গে এই খেলাটা তুমি না খেললেও পারতে, সুমন। শাহীনের কণ্ঠটা এবার অন্যরকম শোনায়।
সতর্ক হয় সুমন বলে, এসব তুমি কি বলছো, শাহীন!
আমি কি কিছু মিথ্যে বলছি! জিনিয়াকে তুমি কোন বিপদে ফেলেছ যে সে দেশে আসতেই পারল না? সত্যি কথাটা বলো তো …
এত কথা আমি তোমাকে বলতে যাব কেন? জিনিয়া আমার স্ত্রী, তার বিষয়ে তোমার এত জানার কি প্রয়োজন?
প্রয়োজন আছে, শাহীন বলে, একসময় সে আমার বন্ধু ছিল, তাকে আমি ভালো জানতাম। এখনো আমি তার ভালো চাই।
এখনো কি তাকে তুমি ভালোবাসো? থমকে দাঁড়িয়ে শাহীনের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে সুমন, আসলে তুমি কি চাইছো বলো তো?
শাহীন বলে, তুমি কি মনে করো আমি কিছুই বুঝি না বা জানি না। তুমি ওদেশে যে অনেক বড় ধরনের ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত, সে-খবরও আমি জানি। ওখানকার পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে এখন তুমি 888sport appsে চলে এসেছ। ঠিক কি না …
মানে!
মানে এটাই যে, তুমি যে পাপ করেছ সেই পাপের শাস্তি এবার তুমি পাবে, কোনোভাবেই এড়াতে পারবে না। আমি তোমাকে ছাড়বো না …
তুমি তো অনেক কিছুই জেনে ফেলেছো দেখছি। গম্ভীর কণ্ঠে সুমন বলে, আর শাস্তির কথা বলছো, আমাকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা এখানে কারুর আছে বলে আমি মনে করি না। বলতে বলতে দ্রুত পকেটে হাত ঢোকাতে যায় সুমন।
সুমনের হাতটাকে খপ করে ধরে ফেলে দ্রুত ডান হাতে কোমর থেকে রিভলভার তুলে আনে শাহীন, না, একদম না। ও চেষ্টাটি করো না।
লাইটপোস্টের মৃদু আলোয় এক পলক দেখেই কি বুঝে বা হাত দিয়ে সুমন ধাক্কা দেয় শাহীনকে। পরমুহূর্তে এক ঝটকায় ডান হাত মুক্ত করেই প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকায়।
শাহীন সময় নষ্ট করে না, বাঁ দিকে একটু কাত হয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সুমনের বুক লক্ষ্য করে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে সরাসরি গুলি চালায়। ধুপ করে একটা শব্দ হয়। সেই শব্দ রাতের অন্ধকার ভেদ করে একসময় দূরে মিলিয়ে যায়।
মুহূর্তে থমকে দাঁড়িয়ে যায় সুমন। গুলির ধাক্কা সামলিয়ে টলতে থাকে। তারপর একবার ডানে আবার বাঁ দিকে কাত হয়ে হাঁটু ভাঁজ করে পড়ে যাওয়ার আগে শাহীন দু-হাত বাড়িয়ে ওকে ধরে ফেলে। তারপর একটু টেনে নিয়ে গিয়ে রাস্তার পাশে জোনাকির মেলা বসা একটা ঝোপের পাশে বসিয়ে দেয়। পরে ওর পকেট থেকে রিভলভারটা তুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে দ্রুত পায়ে ঝিলের উল্টো দিক ঘুরে বড় রাস্তার দিকে চলে যায়।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.