অন্ধপ্যাঁচার রাত্রির ঝিম

যখন প্রচণ্ড তৃষ্ণায় গলায় জল ঢালতে যাবে, শোনে তারিনা বাড়ি গিয়ে মারা গেছে…

পুরো বাক্যটাকে বায়বীয় লাগে রোদেলার। সে স্কুলে যায়, বাড়ি ফিরে আসে, যথারীতি বাবা-মা অফিসে, জরিনা কান্নাফোলা চোখে নাস্তা নিয়ে আসে।

রোদেলা সান্ত্বনা দেয়, আরে দুদিনের জন্য গেছে, এর মধ্যেই কান্নাকাটি? ও কালকেই চলে আসবে।

তাজ্জব বড় বড় চোখে তাকায় জরিনা, আপনি ক্যামনে জানলেন?

– আরে ফোনে কথা হয়েছে, বলেছে, একটু জ্বর উঠেছিল, সেরে গেছে।

জরিনার চোখে হাজার বাতির আলো জ্বলে ওঠে। তার মানে তারিনার মরণের খবরটা ভুল সংবাদ?

– একদম।

এভাবে যত দিন গড়াতে থাকে ততোই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয় রোদেলার, তারিনা বাড়ি আছে, জলদিই চলে আসবে।

এই ব্যাপারটা নিয়ে সে একমাত্র জরিনার সঙ্গে ফিসফাস কথা বলে, বলে – তুই আমি দুইজনই তারিনাকে পুরা সুস্থ দেখেছি, না?

আম্মু বলল, ওর মারাত্মক কিডনির সমস্যা, হাত-পা ফুলে উঠে পেশাব বন্ধ হয়ে যাবে। ওকে বাড়ি পাঠানো দরকার।

– হুম, তাই তো, যাওনের আগে কত কানল, কইল, আমার কিছু অয় নাই। আমারে আন্টি বাড়ি পাঠাইতে চায়।

– ওর হাত-পা ফোলার কোনো সিমটম দেখা গেছে?

– না, খালি বলত খাইতে গেলে বমি লাগে, হে তো কত সময় আমারও লাগে। তাইলে আন্টি ওরে … – আম্মু ডাক্তারের কথায় ভয় পেয়েছে।

– আমিও তো তাই বলি, বিড়বিড় করে জরিনা।

চারপাশের বিল্ডিংয়ের কারণে এই বাড়ি সারাদিন অন্ধকার হয়ে থাকে। বিদ্যুৎ বিল বেড়ে যাওয়ায় এ-বাড়িতে দিনে বাতি জ্বালানো নিষেধ।

খুলে দেওয়া জানালা দিয়ে একটা পাঁশুটে বাতাস ঢোকে। সঙ্গে ছাতিম ফুলের গন্ধ।

রমনা পার্কে গিয়ে মায়ের সঙ্গে ছাতিম ফুলের বৃষ্টিতে ভিজেছিল তারা।

বিছানায় হেলান দিতেই কলিংবেলের শব্দ, রোদেলা ঘাড় উঁচু করে, তারিনা দরজা খোল। কিছুক্ষণ তেমন আওয়াজ নেই।

যেন বা ঘরের বদ্ধতা হাত দিয়ে সরিয়ে চিল্লায় রোদেলা, তারিনা?

মা ঘরে ঢুকে বলেন, কী শুরু হয়েছে তোমার? তুমি জানো না, তারিনা নেই?

প্রতিবাদ করে রোদেলা, আশ্চর্য গতকাল রাতেই না বাড়ি থেকে ফিরে এলো …। দরজা তো ও-ই খুলে দিলো।

– দরজা তো জরিনা খুলে দিলো।

ব্যাগ বিছানায় রেখে মা বসে, রোদেলার চুলে হাত বুলিয়ে বলে, তুমি খুব মিস করছ ওকে? কিন্তু তোমার সব কাজ তো জরিনা করত। তারিনার সঙ্গে তেমন খাতিরও হয়নি তোমার। তুমি ইন্টারনেটে ঘোস্ট ঘোস্ট খেলা বন্ধ করো।

– আমি এসব খেলি না, বলে সে বিছানার পাশে গুটিশুটি ঘুমিয়ে থাকা জরিনার দিকে তাকায়। জরিনা কী করে দরজা খোলে?

এছাড়া তারিনা কাল রাতে বলেছে, গ্রামের ডাক্তারের চিকিৎসায় তার মস্ত উপকার হয়েছে। সে চলতে গেলে হাজার লাফালাফি করলেও পায়ের তলায় শব্দ হয় না?

– ইন্টারেস্টিং তো! আমিও তোমার বাড়ি গিয়ে এই চিকিৎসা করাব।

সে পাকা সিদ্ধান্ত নেয়, সে মায়ের সঙ্গে আর এসব ব্যাপার শেয়ার করবে না।

জরিনাও একমত। কারণ জরিনার কাজিন তারিনা আর সে এক গ্রামে একসঙ্গে বড় হয়েছে। সে তারিনার মৃত্যুসংবাদ হজমই করতে পারছিল না। ফলে তার বিরাট আরামের জায়গা হয় রোদেলা।

এছাড়া জরিনাই একমাত্র সাক্ষী, মা-বাবা বাড়ি না থাকলে জরিনা বেশিরভাগ রোদেলার কাজ করতে পছন্দ করত। তারা তিনজন মিলে ভিডিও গেম খেলত। বড়দের হরর থেকে কত রকম ছবি রোদেলা দুজনকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে।

এছাড়া জরিনা মোবাইল ওপেন করে দেখায়, যে ভোরে তারিনা বাড়ি যায়, সে চুল স্ট্রেইট করে দারুণ সেজেগুজে হিন্দি রিমিক্স গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়েছিল।

কী সতেজ জীবন্ত সুন্দর তারিনা।

রাতে বাতি নেভাতেই প্রতিরাতের মতো জরিনার বদলে এখন তারিনা আসে। মেঝেতে শুয়ে বলে, আপা …

– বল …

– আমি তো ইচ্ছা করলেই টিকটকার হইতে পারি।

– বেশি বাইড়ো না, এগুলো সামলানো তোমার কাম না।

– ঘুমা তো।

– আপু, একটা গল্প পইড়া শোনান না।

– আজ না, ঘুম পাচ্ছে।

সব শব্দ থেমে গেলে মুখের ওপর একটা রাক্ষসের চেহারা আছড়ে পড়ে, ধড়ফড় করে উঠে বসতেই টিক শব্দ করে বের হওয়া চাকু।

– আপু, এইসব ভাইবেন না, যে খারাপ কাজ করে সে বিচার পায়, আমি আছি না?

– তুই কীভাবে? তারিনা বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। এটাও ভ্রম!

ফের শুয়ে পড়ে।

যেন জীবন ডাকছে মৃত্যুকে। রোদেলা তখন টিলা পেরিয়ে অনেকদূর গেছে। ওপরে তাকায়। ডাহুকের ডানার বাতাস তৈরি হচ্ছে। ওমা, দেখে রং! পাখির ডানার শব্দে বাতাসের মধ্য কি রং তৈরি হয়ে যায়?

ধাঁধাঁ নাকি? না তাও না। আসলে সূর্য ঘাড় বাঁকিয়েছে। সারাদিন হেঁটে থুত্থুড়ি খুকির মতো, যেন অনুমতি চাইছে, যাই? এক দুই তিন … এই … পাক্কা গেলাম। কি আহ্লাদী মিঠে সুর! বলতে বলতে পা পা এগোচ্ছে। 

ইস্স! ঝোপটা নড়ছে। সে তখন খুদে শিশু। কঠিন রোগ থেকে সবে উঠেছে। আশ্চর্য! কঠিন রোগ শিশুকে বয়স্ক হওয়ার অনুভূতি দেয়? এরপর প্রকৃতির অবিনাশী ডাক! একটা বনমোরগ পাখি রোদেলার ভীতু চোখের দিকে ময়ূরাক্ষী চোখে চেয়ে আছে যে?

আশ্চর্য! পরক্ষণেই অদ্ভুত রংধনু বাতাসের মধ্যে সে বিলীন হয়ে যায়।

– কার বই পড়তাছেন আপু?

– চুপ, সকালে উঠতে হবে।

– এই যে একটা বইয়ের মধ্যে ঢুকছিলেন, নাম কী?

– ক্রুশকাঠে কন্যা … হলো? ঘুমো।

– কার লেখা?

– জানি না। চুপ।

মশারির আরো ওপরে ছায়া-আঁধার।

বনমোরগের পরে শহরতলিতে থাকা মামাবাড়ির গাছের প্যাঁচাটার কথা মনে পড়ে। এক পূর্ণিমায় রোদেলা আর দুজন দুজনের দিকে এমন অভিভূত হয়ে তাকিয়েছিল, যেন প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।

ক্রমশ জানালা দিয়ে কুচুটে আলো-ছায়া প্রবেশ করে পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। খুব ভোরে রোদেলা ডাক দেওয়ার আগেই আড়মোড়া দিয়ে শুয়ে থাকা ম্যারিনা জরিনায় রূপান্তরিত হয়ে মায়ের রুমের দিকে এগোয়।

বন্ধের দিন বাবা সোফায় হেলান দিয়ে চা খেতে খেতে ডাকে, রোদেলা আ আ …

ছুটে যায় সে। বাবাকে জড়িয়ে কষে চুমু খায়। বাবা ভালোভাবে  রোদেলাকে দেখে, তোমার শরীর ভালো আছে আম্মু?

– হুম, আমি একদম ফাইন, টানটান দাঁড়ায় রোদেলা।

– এক বছর পর এসএসসি, তুমি কিন্তু পড়ার ব্যাপারে আগের মতো সিরিয়াস না।

চাকু ঝলসে ওঠে। চুপ করে থাকে সে।

– না, মানে তোমার আম্মু বলছিল তুমি নাকি তারিনাকে …

পেছনে তাকায় রোদেলা, হুবহু আগের মতো রান্নাঘর থেকে তারিনা জরিনা দুই কল্লা আগ্রহী হয়ে তাকিয়ে আছে।

জোরে মাথা নাড়ায় রোদেলা, প্রথম প্রথম একটু ঝামেলা লাগত, এখন ঠিক হয়ে গেছে।

– আহ্হা, মেয়েটার জন্য আমারও খারাপ লাগে, বিষণ্ন কণ্ঠ বাবার, কত নিখুঁত কাজ করত। হাই ক্রিয়েটিনিন নিয়েও এখানে কিচ্ছু বোঝা যায়নি, বাড়ি যেতেই হাত-পা ফুলে পেশাব বন্ধ হয়ে …

মা যেন ছিটকে এসে পড়ে, এতসব জেনেও তুমি রোদেলার সঙ্গে এসব গল্প করছ? এরপর রোদেলার দিকে ফেরে, তুমি দিনরাত জরিনার সঙ্গে কী ফিসফাস করো? কী হয়েছে তোমার?

উঠে চলে যেতে যেতে রোদেলা বলে, আমি ঠিক আছি। তুমিই তো ঘুমের মধ্যে হাঁটো, কী থেকে কী দেখো আল্লায় জানে?

– কী বললে? মায়ের কণ্ঠ সপ্তমে, তুমি তো আগে আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে না? রোদেলা!

– আচ্ছা থামো, বাবা পেপারে কী খবর এসেছে পড়ো।

খুবই আশ্চর্যজনক!

অমনি চারপাশ ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামলো।

বাবা-মায়ের চিৎকার শোনা যাচ্ছে, কতবার বলেছি, এসব সিনেপাতার কাগজ রাখা বন্ধ করো। মাথার নিচে পর্ন নিয়ে শোও, আমার বারণ শোনো?

ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দ ধরে বাবা চাপা কণ্ঠে শাসায়, চুপ, মেয়েটা…

– মেয়েটা জানুক দেখুক বাপের আলোর দোষের কথা। কী লিখেছে? পূর্বাচলের আকাশে শত শত প্যাঁচা উড়ছিল? তোমার নায়িকার বাড়ির ছাদের ওপর? ন্যাকা!

– পাবলিসিটি খেতে আর কত কী করবে? প্রথমে শরীরে প্যাঁচার ট্যাটু করালো, এখন এই খবর ধীরে ধীরে সব ফাঁস করবে।– কী এমন আছে যে ফাঁস করবে?

– নেই আবার, ভার্সিটিতে থাকতে নাটকের গ্রুপের নাম ছিল প্যাঁচা। নির্দেশনা দিতে গিয়ে নাটকের নাম রেখেছিলে প্যাঁচা, সেই রোলে আজম আর রুহিনী দুজন যৌথভাবে প্যাঁচার চরিত্রে অভিনয় করেছিল, ভুলে গেছি ভেবেছি।

– বৃষ্টিতে ঘর ভিজে যাচ্ছে কণা, আমি 888sport live chatে ব্যর্থ একজন মানুষ, আমাকে আর খুঁচিও না।

– তোমার ডার্লিং তো নিজেকে ব্যর্থ মনে করে না, সে আমার ভাইয়ের সঙ্গে তাল করে সেদিকে বাড়ি নিয়েছে। এখন পরিচালক, প্রডিউসারদের সঙ্গে শোয়।

– তাতে আমার কী? বাবা এড়াতে চায়।

– সে যেখানে যতখানি কথা বলার সুযোগ পায়, তোমার নাম নাকেমুখে নিতে পারলে ও বাঁচে।

– এটা রুহিনীর কৃতজ্ঞতার প্রকাশ।

– আহ হা, আহ্লাদ! জানি তো কত কষ্টে চাকরিটা করছ। রুহিনী তোমাকে থিয়েটারে-সিনেমায় নিজের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য মরিয়া হয়ে আছে। যাক সব ভেসে যাক, বুঝি তো কথা নেই বার্তা নেই, আমাকে না জানিয়ে আমার ভাইয়ের বাড়ি যাও কেন? পাশের বাড়িতেই তো থার্ড গ্রেডের নায়িকাটা থাকে  …

বাবার স্বর উঁচুতে, এজন্য কারো উপকার করতে নেই। একটা লোনের জন্য নিজের ভাই আমার ব্যাংকে ছোটাছুটি করেও নিজের বোনকে জানানোর সাহস পায় না। জাঁদরেল মহিলা!

তারিনা শব্দহীন রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে, রোদেলার হাত ধরে টান দেয়, দেহ আপু আইসো।

– না, আজকেও দুজন মারামারি করবে।

– গুষ্টি কিলাও, বলে পা টিপে টিপে দুজন রান্নাঘরের দিকে যায়। পেছনের দেয়াল ঘেরা আতাফল গাছটায় সত্যিই একটা প্যাঁচা এসে বসেছে! নগরে কোথাও কেউ প্যাঁচা দেখেছে, এমন শোনেনি কেউ, মাও চিল্লাচ্ছিল, নায়িকার মাথায় হাজার হাজার প্যাঁচা? পরে কই ফুরুত হলো?

– তোমার নায়িকার জাদুমন্ত্রে? মা হাঁপাতে থাকে। তুমি তো সেসবও বিশ্বাস করো। মেয়েটা তোমার স্বভাবেরই, তারিনাকে চারপাশে ঘুরতে-ফিরতে দেখে।

– তোর মতো মাথাপাগলা তো হয় নাই, ঘুমের মধ্যে হাঁটে, হেহ।

কিছু একটা বড় অঘটন টের পেয়ে খুব জোরে চিৎকার করতে থাকে রোদেলা, বৃষ্টি তার পাখা গুটিয়ে নিয়েছে। ফলে রোদেলার টানা আ আ ধ্বনি বিকট শোনায়। তারিনা জরিনা বলে, আপা থামো, কাইজা থাইমা গেছে। কিন্তু কে কার কথা শোনে? বাবা-মা ছুটে আসতে আসতে রোদেলা অজ্ঞান হয়ে যায়।

– আপু আইজ আবার ভঙ্গি ধরছে!

জরিনা বলে, চুপ চুপ, পানি আন গিয়ে …

মা হন্তদন্ত হয়ে রোদেলাকে জড়িয়ে ধরে। কড়া চোখে জরিনার দিকে তাকায়, হেই তুই আবার কারে অর্ডার দেস? দৌড় দে …

প্রকৃতির অবিনাশী ডাক। ডাহুকের ডানার শব্দে কত যে রং তৈরি হচ্ছে … ধীরেপায়ে এবার বনমোরগ নয়, প্যাঁচা এগিয়ে আসছে। চোখে চোখ … ও আমার আপন ভাই না, সৎভাই … ভেতর শয়তান।

– তুমি আগে জানাওনি, বাবার কণ্ঠ, আমি কী করে বুঝব?

– আমি বহুদিন বুঝিনি, এখন যখন আমাদের প্রপার্টি দখল করে নিচ্ছে তখন বুঝেছি, এজন্য বারবার বলি, ওকে হেল্প করো না। মায়ের কথাগুলো অন্ধকারের গোল গোল রিং হয়ে সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়ে … বনমোরগের ছায়া ধরে এগোতেই কামিজের ভেতর মস্ত হাত, আজম মামা! চিৎকার করে বসে পড়ে রোদেলা।

বাবার মুখ এগিয়ে আসে, ভালো ফিল করছ বাবা?

মা মুখে জলছিটা মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, তুমি জ্ঞান হারিয়েও দুঃস্বপ্ন দেখছিলে? আমার ওই শয়তান ভাইটাকে?

কোনো কথা বলে না রোদেলা, জরিনা কাছে আসে – এইবার তুমি সত্য সত্য জ্ঞান হারাইছিলা আপু?

– তুই রান্নাঘরে যা, বলে তারিনা বিছানায় উঠে রোদেলাকে জড়িয়ে দ্বিধাহীন কণ্ঠে কানে কানে বলে, বদমাইশটারে আমি জন্মের শিক্ষা দিমু।

– তুই কী করে কীভাবে পারবি?

– অহন আমি সব জানি।

– কিছু একটা কর। আমি যতবার ভাবি, পড়ার অক্ষর ঝাপসা হয়ে যায়। কিছুতেই ব্যাপারটাকে মাথার তলায় লুকিয়েও পড়ার সময় আর পারি না। মাকে বলে দেব?

– কী যেন কন আপু, আপনি একমাত্র মেয়ে, ফ্যামিলির প্রিস্টিজ নিয়া আন্টি খুবই … আপনিও ভালা কইরা জানেন, এইজন্যই তো এদ্দিন চুপ আছেন। এহন আমি আইছি, দ্যাহেন কী করি?

এ-কথার পরেই রোদেলা নিজের মধ্যে অদ্ভুত এক শক্তি টের পায়। মনে হয়, তারিনা বাড়ি থেকে একটা নতুন শক্তি নিয়ে ফিরেছে। যেটা ক্রমশ রোদেলার শক্তি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

সবাই ঘুমিয়ে গেলে তারিনা আর জরিনা প্যাঁচাটিকে রোদেলার ঘরে নিয়ে আসে।

তারিনা বলে, এইটা আমার গেরামের পোষা প্যাঁচা। এইটা কুথাও থাইকা উইড়া আসে নাই।

– এরে এদ্দিন লুকালে কীভাবে?

– পারি, সব পারি, খিলখিল করে হাসে তারিনা।

– কিন্তু এই প্যাঁচাটা সেই আজম মামার বাড়ির কাছের প্যাঁচাটাই। প্রেমজ ভাব বাদ দিয়ে এখন লম্পটভাবে তাকিয়ে আছে।

তারিনা তাকে মিথ্যে বলল কেন?

– একে সরাও, তীব্রকণ্ঠে রোদেলা বলে, আমি ঘুমাব।

জরিনা বলে, যাও রান্নাঘরে, প্যাঁচা তুমারে চিনে, সাথে লইয়া যাও।

তন্দ্রার ঘোরে হেঁচকি ওঠে রোদেলার।

একদিন মুদির দোকানে দুজন জড়াজড়ি করে সদাই কিনতে গিয়েছিল।

এর মধ্যেই বেলের শব্দ। মা এসেছে ভেবে ছুটতে ছুটতে দরজায়, খুলে দেখে আজম মামা।

তাদের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে মা, ফলে নিজের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি হয় রোদেলার। পুরোবাড়ির খোঁজখবর নিয়ে হুট করে রোদেলার কামিজের ভেতর হাত ঢুকিয়ে তাকে জাপ্টে কার্পেটের ওপর ফেলে দেয় আজম।

যখন রোদেলাকে দুমড়ে-মুচড়ে তার ভেতর প্রবেশ করবে, অমনি দরজায় শব্দ। ছিটকে দাঁড়ায় আজম। কাউকে জানালে, পকেট থেকে ছোট ধারালো ছুরি সাই করে বের করে, ভয়াবহ ইঙ্গিত করে।

ফের ধাক্কা। ভয়ে নিজেকে বিন্যস্ত করে দরজা খোলে রোদেলা, পেছন পেছন ঘরে ফেরে দুজন। মা রোদেলার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ওদের ওপর চিল্লাতে থাকে, বলে, তোমরা দুজন একসঙ্গে বাইরে যাবে না, কতবার মানা করেছি?

– একা ঘরে ভয় পেয়েছ মা?

দরজার পেছন থেকে সুরুত করে মামা বাইরে বেরিয়ে যায়।

মাকে হতবাক করে কাউকে কিচ্ছু না বলে অঝোরে কেঁদেছিল রোদেলা।

রোদেলার তন্দ্রার মধ্যে ঢুকে পড়ে তারিনা, এরপর ফিসফিস করে বলতে থাকে, ফোন দিয়ে ডাকো তারে।

– এখন অনেক রাত।

– তুমার ফোন পাইলে আসমান জমিন ফাইট্যা লুচ্চাটা ছুইটা আইব।

– এরপর?

– দেখো কী করি?

সত্যিই ফোন পেয়ে রগরগে হয়ে ওঠে আজমের কণ্ঠ। শেষরাতে তন্দ্রা ছুটে গেলে তারিনাকে জড়িয়ে ধরে রোদেলা, ভয় লাগছে, কিচ্ছু হবে না, তারিনার হাত ধরে দরজা খোলে রোদেলা।

ভুতুড়ে ছবির মতো কথাহীন তারিনাকে অনুসরণ করে ইশারা করে হাত দিয়ে আয়, এরপর পেছনে ছায়ার মতো এগোতে এগোতে রোদেলার ঘরে যেতেই রসালু কণ্ঠে আজম বলে, অসমাপ্ত কাজের যে কী কষ্ট! সব কষ্ট এইখানে, লুঙ্গি উঠিয়ে দেখাতে চায়।

– ব্যাটা ডাক শুইনা লুঙ্গি বদলাইতে ভুইল্যা গেছে।

তার দু-মুঠো ভর্তি গুচ্ছ গুচ্ছ মরিচগুঁড়া।

এবং ছিটিয়ে দেয়। আজম হাউমাউ চিৎকার করতে করতে বিছানায় উলটো কুকুরের মতো হাত-পা ছুড়তে থাকলে পুরো

প্রকৃতি স্তব্ধ করে চিৎকার করে ওঠে তারিনা।

ভীষণ ভয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে আজম।

এরপর রোদেলার হাতে ছুরি রেখে, তারিনা ওপরে নিজের দু-হাতের মরণচাপ দিয়ে অসমাপ্ত কাজের কষ্টের জায়গাটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

আহা! রক্ত! রক্ত! বাবা আজ ট্যুরে, মা ঘুমের মধ্যে হাঁটছে … জরিনা দ্রুত ছুরিটা ধুয়ে ক্রাইম মুভির মতো কায়দা করে মায়ের হাতে রেখে দেয়।

– আমি মাকে ফাঁসাতে চাই না তারিনা।

– মা ফাঁসব না। আমার কথা মিলায়া নিও।

– তুমি প্যাঁচা নিয়ে মিথ্যা কেন বললে আমাকে?

– শুন, আজমের সঙ্গে কিন্তু রুহিনীর গভীর পেরেম। তারা দুইজন মিইল্যা জমি দখল করতে করতে এখন আন্টিরে সরানোর প্ল্যান করতাছে।

ভয়ে কেঁপে ওঠে রোদেলা, এখন?

– এই প্যাঁচার মধ্যে রুহিনীর প্রাণ আছে, যেমুন রাক্ষসের মধ্যেই মানুষের প্রাণ, হি হি যাই গো।

– আর আসবি না?

– না আইলে ভালা অইব, মিলায়া দেইখ?

এরপর জরিনা-রোদেলা গোসল করে তাড়িয়ে তাড়িয়ে শয়তানটার চিৎকার শোনে। বেরিয়ে নিজেদের মুছে তারিনার বলে যাওয়া কথামতো পুলিশের নম্বরে ফোন করে। কাজটা করতে পেরে ভেতর থেকে একটা ভার নেমে যায় রোদেলার। আজমের চিৎকার গোঙানিতে রূপ নিয়েছে।

এরপর টানা কদিন প্রচুর জিজ্ঞাসাবাদে, পুলিশ যখনই কাউকে সন্দেহ করে, তার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তি খুঁজে পায় না। ঘুমের মধ্যে হাঁটতে থাকা কেউ কায়দা করে কারো অসমাপ্ত জায়গা কাটতে পারে না। রোদেলার কথা যতবারই আজম বলে, সঙ্গে তারিনার নাম নেয়, বলে ও হারামি, মূল শয়তান। রোদেলারে দিয়া ও-ই সব করাইছে। আহারে আমার …।

যে তারিনাকে বাবা-মা কেউ দেখতে পায়নি, সেই তারিনাকে শেষ পর্যায়ে আজম দেখেছিল।

এর মানে তারিনা নিজে যাদের দেখা দিতে চায়নি, তারা তাদের দেখা দেয়নি।

কিন্তু সবার মাথায় সব বাদ দিয়ে একটা জিনিস লটকে থাকে, একটা প্যাঁচা কে এবং কেন ছুরির নিচে ড্রয়িংরুমের কার্পেটের ওপর রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে যাবে? আর তার সঙ্গে রুহিনীর অন্তর্ধানের কী সম্পর্ক?

যখন একেকজনের মাথায় সহসা একেক বিষয় ঘাই দিয়ে ওঠে, তখন নির্ভার হাস্যোজ্জ্বল রোদেলা আলোর সিঁড়ি ভেঙে এগোতেই থাকে।