অপরাজিত সৌমিত্র: রেখে গেলেন এক অমর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য

সদা কর্মচঞ্চল মানুষটিকে ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত করছিল টানা লকডাউন? কিন্তু ক্লান্ত হওয়ার মানুষ নন তো তিনি। তাই গৃহবন্দি থেকেও ক্রমে আরো আরো মনের দরজা খুলে দিতে চাইছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর নিজের পড়ার ঘর থেকে পাওয়া গেল এক ডায়েরি, যেখানে রয়েছে ছোট ছোট গদ্য, 888sport app download apk এবং আঁকা ছবি। বোঝা যায় লকডাউন তাঁকে মনের দিক থেকে আটকাতে পারেনি। বরং সদা সৃষ্টিশীল সৌমিত্রকে আরো আরো অন্তরমুখী করে তুলেছিল। রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে ছবি আঁকা শুরু করেন। সৌমিত্রর একান্ত আপন হলেন রবীন্দ্রনাথ। এ-কথাও তো মাঝেমধ্যেই বলতেন, ‘রবীন্দ্রনাথ হলেন আমার শেষ আশ্রয়।’ ইদানীং মৃত্যু-চেতনাও আসছিল তাঁর মধ্যে। আশপাশের চেনাজানা মানুষের একের পর এক মৃত্যু তাঁর মনে নিয়ে আসছিল বিষণ্নতা। বাড়িতে একমাত্র নাতি এক দুর্ঘটনায় হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে এখন তাঁর বাড়িতে শয্যাশায়ী। অর্থের প্রয়োজনটা ভীষণভাবে তাগদ দিচ্ছিল তাঁকে। আর তাছাড়া live chat 888sportে শুটিং, মঞ্চে অভিনয় তাঁর এক ধরনের প্রাণের আরাম। তাই লকডাউন সামান্য শিথিল হওয়ার পর শুটিং শুরু হতেই ক্যামেরার সামনে গিয়ে দাঁড়ান ৮৫ বছরের যুবক সৌমিত্র। শরীর সায় দিচ্ছিল না অনেকদিন। নিজেই একবার বলেছিলেন, ‘আমার সারা শরীরে ব্যথা। নিয়মিত ব্যায়াম করে নিজেকে ঠিক রাখতে পেরেছি।’ কিন্তু এই মানুষটি তো আমূল পালটে যেতেন ক্যামেরার সামনে অথবা মঞ্চে দর্শকদের মুখোমুখি যখন। চরিত্রই হয়ে উঠতেন তখন। সব ব্যথা সব অসুখ যেন এক নিমেষে কোথায় সরিয়ে রাখতেন। মঞ্চে তিনি রাজা, এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত দাপটের সঙ্গে নিজের মুঠোয় রাখছেন। আর live chat 888sport-অভিনয়? এই ৮৫ বছর বয়সেও সে তো জীবিকা। ভালো-মন্দ প্রায় সব ছবিতেই অভিনয় করেন। চিত্রনাট্যের দোষগুণ নিয়ে ভাবেন না, পরিচালকের যোগ্যতা-অযোগ্যতা নিয়েও নয়, চরিত্রটিকে নিজের মতো সাজিয়ে নেন। আন্তরিকভাবে ভালো অভিনয় করেন। যখন শট থাকে না, তখন একা হয়ে হাতের কাছে পড়ে থাকা কাগজে ছবি আঁকেন বা 888sport app download apk লেখেন। কিন্তু লকডাউনের আগে শটের ফাঁকে জমিয়ে আড্ডাও মারতেন। যাঁরা তাঁর সঙ্গে মিশেছেন তাঁরা তো জানতেনই তিনি কী দারুণ আড্ডাবাজ। আনলক পর্যায় শুরু হতেই তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন শুটিংয়ে। না বেরিয়ে উপায় ছিল না। তিনি যে মনে করতেন, ‘জীবনের শেষ সংলাপ আমি নাটকের মঞ্চে আমারই বলে যেতে চাই’; বলেন, ‘রঙ্গভূমিই আমার প্রকৃত জায়গা।’ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দুদিন আগেও  ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন। ৪০ দিন টানা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই। তারপর ১৫ নভেম্বর ২০২০, দুপুর ১২টা ১৫-তে একজন মানুষ মারা গেল এই কলকাতায়। তাঁর নশ্বর দেহ দাহ হলো। কিন্তু তিনি রেখে গেলেন এক অমর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য – live chat 888sportে, নাটকে, 888sport live footballে, বাচিক 888sport live chatে, 888sport app download apkয়, অভিনয়ে। তিনি অমর হয়ে রইলেন বাঙালির মণিকোঠায়।

দুই

চিলড্রেন অব লাইট – আলোর সন্তান। বার্গম্যানের ছবিতে যেমন ম্যাক্সভন সিডো, কুরোসাওয়ার ছবিতে তাসিরো মিফুনে, ত্রুফোর ছবিতে জঁ পিয়ের লু, আন্দ্রে ভাইডার ছবিতে ভেরোদ দেপার্দু,  গোদারের যেমন বেলমন্দো, তেমনি সত্যজিতের ছবিতে সৌমিত্র। আন্তর্জাতিক স্তরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয় হয়তো এটাই। কিন্তু বাঙালিদের কাছে সৌমিত্র মানে শুধু সত্যজিতের সৌমিত্র নয়, তাদের আছে এক অনন্য সৌমিত্র যাঁকে বিদেশে বসে অনুভব করা যায় না; কিন্তু বঙ্গদেশে এলেই বোঝা যায়। যেমন ক্যাথারিন বার্জ কলকাতায় এসেছিলেন সত্যজিতের ওপর তথ্যচিত্র করবেন বলে। অনিবার্য কারণে সত্যজিতের ওপর ডকুমেন্টারিটা হয়ে ওঠে না আর, পরিবর্তে তথ্যচিত্র করতে নামেন সত্যজিতের প্রিয় নায়ককে নিয়ে। সত্যজিতের নায়ক সৌমিত্রকে নিয়ে ডকুমেন্টারি করতে নেমে ক্যাথারিন ফ্রান্স থেকে কলকাতায় এসে আবিষ্কার করেন সত্যজিতের ছবির বাইরে আরেক সৌমিত্রকে, যিনি পঞ্চাশ বছর বাংলা live chat 888sportে শিখরবাসী। ক্যাথারিনের ভাষায়, ‘সৌমিত্র এমন একটা মানুষ যিনি বহুর মধ্যে এক। একের মধ্যে বহু। সত্যিই তাই? কী নন তিনি? নট ও নাট্যকার,  live chat 888sport-অভিনেতা, আবৃত্তিকার, কবি পত্রিকা-সম্পাদক, পরিচালক,  আড্ডাবাজ, বাঙালি, রাজনৈতিক কর্মী। সচেতন পড়ুয়া, দায়িত্বশীল স্বামী ও পিতা। আর এই কারণেই ক্যাথারিন তাঁর তথ্যচিত্রটির নাম দিয়েছিলেন গাছ। শোনা যায়, এই নামকরণের সৌজন্যেও সৌমিত্র। যিনি বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষেরই হওয়া উচিত এইরকম বড় গাছ, যা পাখিদের আশ্রয় দেবে, পথিককে দেবে ছায়া।’ বাংলা live chat 888sport তথা সংস্কৃতিজগতের সেই ‘গাছ’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অন্যদিকে সৌমিত্র হলেন বাঙালির হৃদয়ের আইকন। উত্তমকুমার মারা যাওয়ার পর সত্যজিৎ বলেন, ‘বাংলা সিনেমার প্রথম এবং শেষ নায়ক উত্তমকুমার।’ সেই সূত্র ধরে এ-কথা হয়তো বলা যায়। এ-কথাও বলা যায়, বাংলা গণসংস্কৃতির শেষ নায়ক কিন্তু সৌমিত্র। 

তবে কেন তিনি সত্যজিতের সৌমিত্র-নির্মাণের মধ্যেই শুধু আটকে পড়বেন? ঠিক, সত্যজিতের ২৮টি ছবির মধ্যে ১৪টি ছবিতেই অভিনয় করেছেন তিনি। অর্থাৎ অর্ধেক ছবিতেই। মৃত্যুর আগে সত্যজিৎ যে-ছবির পরিকল্পনা করেছিলেন সেই ছবিতেও প্রধান ভূমিকায় নির্বাচিত হয়েছিলেন সৌমিত্রই। সত্যজিতের সৌমিত্র-নির্ভরতা শুরু হয়েছে সেই  অপুর সংসার থেকে, শেষ শাখা প্রশাখায়। সত্যজিৎ স্বীকার করেছেন, নতুন করে আরেকটি সৌমিত্র নির্মাণ সম্ভব নয় বলে তিনি অনেক ছবির পরিকল্পনা বাতিল করেছেন। এটা ঠিক, সত্যজিৎ সৌমিত্রর শিরোপায় লাগিয়ে দিয়েছেন অভিনয়ের অমূল্য অলিভ পালক। কিন্তু এটাও ঠিক, সত্যজিৎ যতটা সৌমিত্র-নির্ভর, সৌমিত্র কিন্তু তাঁর live chat 888sport-ক্যারিয়ারে ততটা সত্যজিৎ-নির্ভর নন। বরং সচেতনে ছড়িয়ে পড়েছেন বাংলা সিনেমার শিরা-উপশিরায়। ১৯৫৮ সালের পর থেকে বাংলা সিনেমা যখন যে-পথে এসেছে তা সে আর্ট-ফিল্ম, সমান্তরাল ছবি, মিডলরোড সিনেমা বা মূলস্রোতের সিনেমা, সেখানেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতি সৌমিত্রর। উত্তম তারকা, দূরের মানুষ। সৌমিত্র অভিনেতা, কাছের মানুষ। যাকে দেখতে পাওয়া যায় কফি হাউস, লাইব্রেরি বা কোনো বইয়ের দোকানে। তিনি কবি, 888sport app download apkর আসরে নিজের 888sport app download apk পড়েন। হ্যারিসন রোডের বইঠাসা খুপরিঘরে বসে সম্পাদনা করেন এক্ষণ নামক বুদ্ধিদীপ্ত পত্রিকা। তিনি নাটক লেখেন, নাটক করেন। পরিচালনা ছাড়াও তিনি অভিনয় করেন নাটকে। তিনি সংস্কৃতিমান মানুষেরও আইকন।

পঞ্চাশ বছরের live chat 888sport-জীবনে সৌমিত্র ৩৫০টিরও ওপর বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন। যার মধ্যে তপন সিংহের পাঁচটি, মৃণাল সেনের চারটি, তরুণ মজুমদারের ১০টি। ঋত্বিক ঘটকের কোনো ছবিতে অভিনয় করেননি। পঞ্চাশের শেষে ও ষাটের দশকে অন্য ধারার ছবি-করিয়ে হিসেবে যে- চারটি নাম উচ্চারিত হতো, তাঁরা সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল ও তপন সিংহ। বাণিজ্য ও 888sport live chatের মেলবন্ধনে বিশ্বাসী তরুণ মজুমদার। সত্যজিতের অপুর সংসার ছবিতে অভিনয় করার পরেই তপনবাবুর ক্ষুধিত পাষাণ। ঠিকই সত্যজিতের সঙ্গে নিজেই যোগাযোগ করেন সৌমিত্র। তখন কলকাতার সংস্কৃতি জগতে তেমন চেনা মানুষ নন। খবর পেয়েছিলেন পথের পাঁচালীর পর অপরাজিত করছেন সত্যজিৎ। সেই সুবাদেই সত্যজিতের সঙ্গে দেখা করতে যান। সত্যজিতের পছন্দ হয়েছিল সৌমিত্রকে। কিন্তু বয়সটা বাধা হয়ে দাঁড়াল। সত্যজিৎ দেখেও বললেন, ‘এ হে, আপনি যে একটু বড় হয়ে গেলেন।’ অপরাজিত ছবির অপুকে হতে হবে আরো কম বয়সী।  তাই সৌমিত্র নির্বাচিত হলেন না। কিন্তু সৌমিত্রের মুখটা মাথায় ছিল সত্যজিতের। তাই যখন অপুর সংসার করবেন ঠিক করলেন তখন ডাক পড়ল সৌমিত্রের। শোনা যায় সৌমিত্রকে দেখার পরেই নাকি সত্যজিৎ পথের পাঁচালীর তৃতীয় পর্ব করবেন বলে মনস্থির করেন। সৌমিত্র তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ঘোষকের চাকরি করছেন। সত্যজিৎ বললেন, বেশ কিছুদিন ছুটি নিতে হবে। সৌমিত্র জানালেন, চাকরিটা ছেড়ে দেবেন। আজ বোঝা যায় সিদ্ধান্তে ভুল ছিল না। অভিনেতা হতেই চেয়েছিলেন তিনি। প্রথম থেকেই। আর সেই সুযোগ এলো স্বয়ং সত্যজিতের কাছ থেকে। অভিনেতা হওয়ার স্বপ্নটা দেখেছিলেন অনেক আগেই। নাটকে শিশির ভাদুড়ির অভিনয় দেখে। তখন সৌমিত্র কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়েন। সবে হাওড়া থেকে কলকাতায় এসেছেন। অবশ্য হাওড়ার পাকাওয়াকি অধিবাসী নন তাঁরা। সৌমিত্র কৃষ্ণ-নাগরিক।

কৃষ্ণনগরেই জন্ম   এবং  শৈশব,  কৈশোর।  কৃষ্ণনগরে তাদের তিন পুরুষের বাস। এই কৃষ্ণনগরেই সৌমিত্রের জন্ম ১৯ জানুয়ারি, ১৯৩৫। বাবা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন উকিল। মা আশালতার 888sport sign up bonusচারণে উঠে আসে সৌমিত্রের ছোটবেলা – ‘মাঘী পূর্ণিমায় চন্দ্রগ্রহণের মধ্যে সৌমিত্র জন্মেছিল। পরে কয়েকজন জ্যোতিষীর কাছ থেকে শুনেছিলাম যে ওটা খুব পুণ্যলগ্ন ছিল। আবার কেউ কেউ বলেছিলেন যে ওর জন্মমুহূর্তে গ্রহণ থাকার ফলে ওর সারা জীবনেই কিছু না কিছু সমস্যা থেকে যাবে। তবে এসব  কথায় আমরা কেউই বিশেষ মাথা ঘামাইনি। আমার শ্বশুরমশাই থাকতেন কেষ্টনগরে   (কৃষ্ণনগর),  তাই   আমরাও   ওখানেই থাকতাম। আমার স্বামী কলকাতায় থেকে ওকালতি করতেন। কেষ্টনগরে আমার প্রচুর অবসর ছিল। আমার প্রধান অবলম্বন ছিল বই।

বই-ই আমাকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে এবং এখনো করে। তখন অল্প বয়সের প্রবল 888sport live footballানুরাগে মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা বড় ভালো লাগত। তার বিচিত্র ভাষা, ২৩ বিষয়বস্তু আর নায়ক নির্বাচনে আজো মুগ্ধ হয়ে যাই। তাই বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমার দ্বিতীয় সন্তানের নাম মাইকেলের ‘সৌমিত্রকেশরী’ অনুসারে সৌমিত্র রেখেছিলাম। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী বাড়ির সকলের নামের সঙ্গেই ‘কুমার’ করার রীতি ছিল। তাই আমার বড় ছেলের নাম শ্বশুরমশাই সম্বিকুমার রেখেছিলেন। সেখানে ওর নাম শুধু সৌমিত্র রাখাটা ওঁর পছন্দ ছিল না। অবশ্য আমার স্বামী এ-বিষয়ে কোনো আপত্তি করেননি। সেই থেকে ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আর ওর ‘পুলু’ ডাকনামটা ওর দাদার দেওয়া। আমার বড় ছেলে প্রথমে ওকে বেড়ালছানা মনে করে ‘উলি-উলু-পুল’ বলে ডাকত। সেই থেকে ও পুলু।’

পুলুর ছোটবেলার অনেকটাই কেষ্টনগরে

কেটেছে। তখন কেষ্টনগরের পরিবেশটা

খুবই ভালো ছিল। 888sport live football-সংস্কৃতির দিক থেকে বা রাজনৈতিক দিক থেকে।

কৃষ্ণনগরের আগে সৌমিত্রদের আদি বাড়ি ছিল নদীয়া জেলার যেখানে, দেশভাগের পর তা পাকিস্তানে চলে যায়, শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রাম – কুষ্টিয়ার ওপারে, শিলাইদহ থেকে চার ক্রোশ দূরে। সেই কয়া গ্রামের কথা তিনি শুনেছেন দাদু ও বাবার মুখে। তবে সেই গ্রাম নিয়ে তাঁর মনের মধ্যে তেমন অনুভূতি ছিল না। খুব ছোটবেলায় একবারই গেছিলেন। তাঁর বাড়ি বলতে তিনি কৃষ্ণনগরকেই ভাবেন। তাঁর 888sport sign up bonusতে সেই ছোটবেলার কথা, ‘কৃষ্ণনগরে যে পরিবারের মধ্যে আমি বড় হয়েছি –    সেখানে দাদু ছিলেন, ঠাকুমা ছিলেন না – মারা গিয়েছিলেন অনেক আগেই, আর বাবা, কাকা – এই দুজন ছিলেন, পিসিরা –    তাদের বিয়ে হয়ে গেছিল অনেক আগে, তারা মাঝে মাঝে আসতেন-যেতেন, আমরাও যেতাম। বাবা কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন, উইকএন্ডে শুক্রবার দিন বাড়ি ফিরতেন – আমাদের জ্ঞান হওয়া থেকে দেখে আসছি – আবার সোমবার চলে যেতেন। এই অসুবিধাটা কাটাবার জন্যই সম্ভবত আমরা মাঝে মাঝেই কলকাতায় এসে বাড়ি নিয়ে থাকতাম, এতে পড়াশোনার খুব ক্ষতি হতো। ১৯৪৫ সাল নাগাদ, আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, বাবা ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্য সরকারি চাকরি নিলেন, তখন সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট বলে বড় একটা ডিপার্টমেন্ট ছিল, সেখানে। বাবা চাকরি নেবার পর আমরা এলাম কলকাতার কাছে বারাসাতে। বারাসাত গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। তার আগে কৃষ্ণনগরে আমি সিএমএস সেন্ট জন্স স্কুল বলে একটা স্কুলে পড়তাম। বারাসাত থেকে এক বছর পর হাওড়ায়। – হাওড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হলাম। ওখান থেকে চলে গেলাম দার্জিলিং। তার পর বাবা আবার চাকরি বদলালেন – সয়েল ডিপার্টমেন্টে চাকরি নিলেন, আমরা আবার ফিরে এলাম। এই সময় কিছুদিন আবার কৃষ্ণনগর, কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পড়তাম এ বারে। সেই সময় দাদু অসুস্থ ছিলেন – দাদু মারা যাবার পর চলে এলাম হাওড়া। বাবা অবশ্য এর পরও বদলি হয়েছেন, কিন্তু আমরা এখানেই স্কুলজীবন শেষ করি।’

কলকাতায় সিটি কলেজে ভর্তি হলেন সৌমিত্র। পড়াশোনার সূত্রেই তাঁর কলকাতায় আসা। সংস্কৃতিনগরী কলকাতা। সৌমিত্র খুঁজে পেলেন মনের নানা খোরাক।

সিটি কলেজ থেকে প্রথমে আইএসসি, তারপর বিএ অনার্স নিয়ে পাশ করেন। তারপর পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট কলেজ অব আর্টস দু-বছর পড়েন; কিন্তু এমএ পরীক্ষা আর দেননি।

তিন

অভিনয়ে আগ্রহ  খুব ছোটবেলা থেকেই ছিল তাঁর। তার একটা কারণ তাঁদের বাড়িতে এ-ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হতো। আর  তাঁর ছোটবেলার  শহর – মানে কৃষ্ণনগরে সংস্কৃতি, বিশেষ করে নাট্যচর্চার বেশ ভালো পরিসর ছিল। অভিনয়ের প্রাথমিক ভিতটা তাঁর তৈরি হয় সেখানেই। ‘আমার জীবনের শেষ সংলাপ আমি নাটকের মঞ্চেই বলে যেতে চাই’, বলেন সৌমিত্র, – ‘বঙ্গভূমিই আমার প্রকৃত জায়গা।’ পল্লবগ্রাহী নন, বহুমুখী প্রতিভা – কবি, নট ও নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, live chat 888sport অভিনেতা। আপাতত স্বতন্ত্র প্রত্যেকটি মাধ্যমেই তিনি স্বগুণে, স্বজোনে প্রতিষ্ঠিত। সবকটিই প্রিয় কিন্তু প্রিয়তম এরিনা হল নাট্যমঞ্চ। সত্যজিতের ২৮টি ছবির মধ্যে ১৪টি ছবি, অর্থাৎ অর্ধেক ছবিরই নায়ক তিনি। এছাড়া অন্তত ২৫০টি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন, যার মধ্যে তপন সিংহের ২৫টি, মৃণাল সেনের চারটি, তরুণ মজুমদারের ১০টি। আর মঞ্চে অভিনয় করেছেন তিনি ওয়ান ওয়াল থিয়েটার নিয়ে ষাটের কাছাকাছি। তবু নাটকই তাঁর প্রিয়তম জায়গা। তিনি বাংলা সংস্কৃতির ‘গাছ’। সুদূর ফরাসি দেশ থেকে এসে সৌমিত্রকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন ক্যাথারিন বার্জ। তিনি এই তথ্যচিত্রটির নাম দেন গাছ। অবশ্য সৌমিত্র সমীপে ঋণী হয়েই। কেননা সৌমিত্র মনে করেন, প্রত্যেক মানুষেরই হওয়া উচিত বড় গাছ, যা পাখিদের আশ্রয় দেবে। পথিককে দেবে ছায়া। এই চিন্তাটা তিনি পান তাঁর বাবার কাছ থেকে।

ছোটবেলা থেকেই সৌমিত্রের অভিনয়-আগ্রহ। জন্ম কলকাতার মির্জাপুর স্ট্রিটের দিদিমার বাড়িতে হলেও দশ বছর বয়স অবধি কেটেছে কৃষ্ণনগরেই। কৃষ্ণনগর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের শহর। কৃষ্ণনগর গোপাল ভাঁড়ের শহর। সব মিলিয়ে সৌমিত্রের ছোটবেলা কেটেছে সাংস্কৃতিক পরিবেশে। বেশকটি শখের নাট্যদল ছিল তখন কৃষ্ণনগরে। দাদু এইরকম এক শখের নাট্যদলের সভাপতিও ছিলেন। বাবাও নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন – বাচিক888sport live chatী হিসেবেও তিনি বেশ নাম করেছিলেন। সব মিলিয়ে নাটকের পরিবেশের মধ্যেই বাল্যকাল কেটেছে সৌমিত্রের। ভাইবোন বন্ধুবান্ধব ছোটরা মিলে বাড়িতে নাটক করতেন; তখন ওই ছোটদের জন্য যে দু-তিনটে নাটক পাওয়া যেত সেগুলো সংগ্রহ করে এনে। এর কিছু পরে রবীন্দ্রনাথের ‘মুকুট … আমরা ভাইবোনেরা বন্ধুরা মিলে। তক্তপোষ টেনে স্টেজ তৈরি করে আর বিছানার চাদর এনে পর্দা উইংস।’ এইভাবেই এক নাটকের আবহাওয়া। বড় হচ্ছেন তিনি। কলকাতার কলেজজীবনে এসে এরই সম্প্রসারণ ঘটল। সেখানেই তাঁর প্রিয় বন্ধু হলেন গৌরমোহন মুখোপাধ্যায়। সিটি কলেজের গৌরমোহন তাঁর সামনে কলকাতার নানা সাংস্কৃতিক পরিসর খুলে দিতে লাগলেন। এঁর সঙ্গেই প্রথম শিশির ভাদুড়ির নাটক দেখলেন সৌমিত্র। সেই অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে সৌমিত্র বলেন, ‘প্রথম শিশির ভাদুড়ির থিয়েটার দেখলাম, সেটা আমাকে একেবারে মুহ্যমান করে – পাঁচ-সাতদিন আর কিছুই ভাবতে পারছি না একেবারে – শুধু শিশিরবাবুর অভিনয় মাথার মধ্যে ঘুরছে। আবার এটা বলব, একটা বিরাট লাক – কোইন্সিডেন্স বলা যায়, প্রথম কলকাতায় অন্য কারুর থিয়েটার না দেখে শিশিরবাবুর থিয়েটার দেখেছিলাম, সুতরাং উৎকৃষ্টতর বা 888sport live chatের বিচারে অনেক উঁচুদরের অভিনয়টা আগে দেখার ফলে অভিনয়ের মানদণ্ড সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়।’ অতএব, আইডল হিসেবে মানছেন শিশির ভাদুড়িকে। কিন্তু তাঁর অভিনয়ধারাকে অনুকরণ করার কথা কিন্তু ভাবছেন না তিনি। অভিনয়ের অন্য প্রক্রিয়ার সন্ধান করছেন। এবং এটাও মনে মনে ঠিক করে নিচ্ছেন, অন্য কিছু নয়, অভিনয়ই করবেন। আবৃত্তিচর্চা তাঁর আগেই আরম্ভ হয়েছিল। আবৃত্তি যে অভিনয়ের অঙ্গ সেটা উপলব্ধি করছিলেন। শিশির ভাদুড়ির অপরাহ্নবেলায় সৌমিত্র তাঁর সংস্পর্শে আসছেন। বয়স ও 888sport app মানসিক চাপে শিশির ভাদুড়ির থিয়েটারে তখন প্রয়োগ-নৈপুণ্যে ভাটা পড়েছে। যে প্রয়োগকর্তাকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ স্বীকৃতি দেন, সেই শিশিরবাবুর সেই সময় অভিনয়ে উজ্জ্বল হয়ে থাকলেও পরিচালক হিসেবে কোথায় যেন খামতি। এই সময়ই শিশির ভাদুড়ির প্রযোজনা দেখছেন সৌমিত্র। কাছাকাছি আসছেন। প্রযোজনা তেমন পছন্দ না হলেও ব্যক্তি-অভিনেতা নাট্যতাত্ত্বিক শিশির ভাদুড়ি তাঁর প্রিয় হয়ে ওঠে। শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে সৌমিত্রের মুখোমুখি সাক্ষাৎ এক ঐতিহাসিক দিনে – যেদিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শ্রীরঙ্গম। শ্রীরঙ্গমে প্রফুল্লর শেষ অভিনয়, ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’ – প্রফুল্লর শেষ সংলাপ বলে মঞ্চ থেকে নেমে এলেন শিশির। ‘শ্রীরঙ্গমে’ চিরকালীন যবনিকা নামল।

সৌমিত্র উপলব্ধি করেছিলেন শিশির ভাদুড়ির অভিনয়ক্ষমতা। রাশিয়ার অভিনেতা চেরকাশফ তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ। এসব জানা সৌমিত্রের। অভিনেত্রী শেফালি দেবীই শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। এরপর থেকেই শিশিরবাবুর বাড়ি নিয়মিত যাতায়াত। দুই প্রজন্মের মধ্যে নাটক নিয়ে নানা আলোচনা। অনেক তাত্ত্বিক বিষয়ও উঠে আসত। মঞ্চ থেকে সরে এসে পড়াশোনা নিয়েই থাকতেন শিশির ভাদুড়ি। আর এখানেই অভিনয় শেখার তাগিদেই সৌমিত্র যেতেন ওঁর কাছে। অভিনয়ের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রয়োগ-কৌশল শিখে নেবার চেষ্টা করতেন।

১৯৫৮ সালে সৌমিত্র অসুস্থ হয়ে বেশ কিছুদিন বাড়িতে আটকে ছিলেন। সেই সময় নিয়মিত জার্নালে লিখতেন। মাঝেমধ্যেই আসতেন শিশিরকুমার। সেই জার্নাল থেকে, ‘দুটো বছর ধরে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই শিশিরকুমারের বাড়িতে যাই। আগে নিচে নেমে আসতেন। এখন ওপরেই ডেকে পাঠান। আস্তে আস্তে কোথা দিয়ে যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে জানতেই পারিনি। অথচ শিশিরকুমারের কাছে আসার সৌভাগ্য হবে কোনোদিন ভাবিনি। প্রথম যেদিন ওঁর সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলাপ হয়েছিল সেদিনটা মনে আছে। ১৯৫৬ সালের ২৪শে জানুয়ারি। শ্রীরঙ্গমে সেদিনই শেষ অভিনয়। সেদিনের নাটক ছিল প্রফুল্ল। আমরা প্রায় বিশ-পঁচিশজন বন্ধু মিলে দেখতে গিয়েছি। সকলেরই মন ভার। সকলেই চুপচাপ। অভিনয় হলো। ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’ বলে শিশিরবাবু হাত দুটো আকাশের দিকে তুলে দাঁড়ালেন। শ্রীরঙ্গমে শেষবারের মত যবনিকা নামল।

সেদিন প্রফুল্লর অভিনয় করেছিলেন শেফালিকা (পুতুল) দেবী। ওঁর ছেলে বাবু (অর্ধেন্দু) আমাদের বন্ধু। বলেছিল সেদিন শিশিরবাবুর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে। এর আগে তাকে কতবার শ্রীরঙ্গমের বাইরে থেকে ফেরত এসেছি, দেখা হয়নি। অভিনয় শিখতে চাই বলাতে উত্তর পেয়েছি – এখন নতুন লোক নেওয়া হবে না – পড়াশোনা করুন এখন, পরে আসবেন। সেদিন আমাকে দাঁড়াতে বলে পুতুল মাসিমা ভেতরে চলে গেলেন। কোর্টের পেয়াদা সব দাঁড়িয়ে রয়েছে। শিশির ভাদুড়িকে স্টেজ থেকে সরিয়ে পজেশন নেবে তারা। ছবি বিশ্বাসকে দেখলাম মেকআপ তুলতে এলেন। মনে হলো মদ্যপান করেছেন। পরে শিশিরবাবুর কাছে শুনেছি যে, ‘ওই একটি দিন ছাড়া ছবিবাবু কোনোদিন মদ খেয়ে শিশিরবাবুর সামনে যাননি। আমার অবশ্য তখন দেখার মতো মনের অবস্থা নয়। বুক ঢিপঢিপ করছে। কত কী শুনেছি। রাগী দাম্ভিক শিশিরকুমার। দেখা করবেন তো? দেখা হলেই বা কী রকম ব্যবহার করবেন? এইসব ভাবছি, এমন সময় ডাক এলো। একটা ঘরে ঢুকতেই দেখি সামনে শিশিরকুমার। ঘরটায় ভিড়, সেদিনকার অভিনয়ে যাঁরা ছিলেন তাঁরা রয়েছেন। দু-একজন কাঁদছেন। থমথমে ভাব।’

সেই আলাপের শুরু। তারপর বহুবার গেছেন তিনি শিশিরকুমারের কাছে, তাঁর বাড়িতে। নানা বিষয়ে আলোচনা। বেশিরভাগ থিয়েটার। এরপর শিশিরকুমারের সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগ পেলেন তিনি। অনেকদিন অভিনয় থেকে দূরে ছিলেন শিশিরকুমার। একবার  বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনে প্রফুল্ল নাটক হবে ঠিক হলো। শিশিরকুমারের প্রযোজনা। সৌমিত্র খবর পেয়ে ছুটলেন শিশিরবাবুর কাছে। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। শিশিরবাবু তাঁকে দেখেই বললেন, ‘পার্ট করবে?’ সৌমিত্র তো এটুকু পাবার জন্যে কতদিন ঘুরেছেন। ‘না’ বলার প্রশ্নই আসে না। ঠিক হলো শিশিরবাবু প্রফুল্ল আর সৌমিত্র সুরেশ। প্রথম দিনের রিহার্সালের 888sport sign up bonusচারণ করেছেন স্বয়ং সৌমিত্র, ‘প্রথম যেদিন রিহার্সালে যাব সেদিন যে কী উত্তেজনা মনে মনে তা বোঝাতে পারব না। শিশিরকুমার রিহার্সালে ব্যাপারটা সম্বন্ধে জনপ্রবাদে

কত কী যে শুনেছি। তাছাড়া, সেদিন শিশিরকুমার যেন আমার সম্বন্ধে খুব বেশি হতাশ না হন সে-ভাবনাও ছিল। টেনশনেই বোধ করি গলাটাও সেদিন ধরে গেল। নানান কুলকুচি করেও কিছু যেন হলো না। যাই হোক, নির্দিষ্ট সময়ের কিছুক্ষণ আগেই গেলাম। ছাতে একটা ঘর ফরাসপাতা। বাইরে কিছু লোক ঘুরছে যাদের শ্রীরঙ্গমে অভিনয় করতে দেখেছি। আমি নিতান্ত একলা বোধ করছিলাম। আমি শ্রীরঙ্গমের কেউ নই। বড়বাবু বাইরে থেকে আমাকে রিক্রুট করেছেন। আর ওদের আচার-ব্যবহারের সঙ্গে আমার এমন একটা তফাৎ ছিল যা পেশাদারি অভিনেতার সঙ্গে তরুণ অপেশাদারদের থাকবেই। আমি সারাক্ষণ অসহজ বোধ করেছিলাম। খালি শিশিরবাবুর সঙ্গে একটু সহজ হতে পারছিলাম, তাও সেদিন যেন পুরোটা নয়। রিহার্সালের সময় সুরেশের সেই care free উড়নচণ্ডী চ্যাংড়া ভাবটা আমি সহজে কিছুতেই আনতে পারিনি। সমস্ত দলটার সঙ্গেই আমি তখন খোশখেয়ালে মিলতে পারিনি। নিজের self-consciousness চাপা পড়েনি। যাই হোক, সেদিন তো শিশিরকুমার এলেন – ভেতরে নিয়ে গেলেন। রিহার্সালরুমে। সে-ঘরে দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না, তাই বলে বলে delivery-র রিহার্সাল হতো খালি। আর action-গুলো বলে বলে দিতেন। শিশিরকুমারের পার্ট শেখানোর কথা অনেক শুনেছি। হেমেন্দ্রকুমার রায় তো লিখেছেন যে, শিশিরকুমার অভিনয় শিক্ষক হিসেবে বড় না অভিনেতা হিসেবে – এ-কথাটা বলা শক্ত। ওঁরা যে শিশির ভাদুড়ির কথা বলেছেন তিনি একটা মঞ্চের অধ্যক্ষ এবং আচার্য। আমি সেদিন যে শিশির ভাদুড়িকে দেখলাম তিনি একটা ছোট্ট এলো ঘরে কতকগুলি সাধারণ অভিনেতাকে বাচনভঙ্গি শেখাচ্ছেন। আর চরিত্রের ধারণা বলে দিচ্ছেন।

আজীবন শিশিরকুমারের অভিনয় প্রশিক্ষণের কথা মনে রেখেছেন সৌমিত্র। আর এটাও তিনি স্বীকার করেন যে, শিশিরকুমারের কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন কোনো একটা চরিত্র নিয়ে কীভাবে ভাবতে হয়। এই ভাবার প্রশিক্ষণটা তিনি পান শিশিরকুমারের কাছ থেকেই। যা অভিনয়সূত্রে তাঁর সারাজীবন কাজে লেগেছে। তবে নিজে যখন অভিনয়জগতে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছেন তখন কিন্তু শিশিরকুমারের অভিনয়ধারাকে সরাসরি অনুসরণ করেননি। বেছে নিয়েছেন নিজস্ব বিকল্প এক পথ।

চার

এই যে চরিত্র সম্পর্কে ভাবনার সূত্রপাত এইটেই শিশির ভাদুড়ির কাছ থেকে পাওয়া সবচেয়ে বড় শিক্ষা। সৌমিত্র পরবর্তী সময়ে ঠিক শিশির-ঘরানার অভিনয় না করলেও  অভিনয়ের মধ্যেই এই সাব-টেক্সট তৈরির ব্যাপারটা সারাক্ষণ রাখেন তিনি। সেই অপুর সংসার থেকে শুরু করে আজো। চাকরি নয়,  অভিনয়ই স্বপ্ন, যৌবনে এই হলেন সৌমিত্র, একান্ত বাধ্য হয়ে হয়তো চাকরি করতে হয়েছে কিন্তু অভিনেতা এই স্বপ্ন চিরকালই দেখে যাচ্ছেন। ছোটবেলার অভিনয় বাদ দিয়েও কলেজজীবনে অভিনয় করছেন। আর সেই সময়েই তো সঙ্গ পেলেন শিশির ভাদুড়ির। সেই সময় বাংলা সিনেমা সম্পর্কে যে তাঁর খুব ভালো ধারণা ছিল এমন নয়। ইউরোপীয় সিনেমার প্রতি টান ছিল বেশি। কিন্তু সত্যজিতের পথের পাঁচালী দেখার পর থেকেই বাংলা ছবির ক্ষেত্রে তাঁর ধারণা বদলে গেল। পথের পাঁচালীর পর অপরাজিত হচ্ছে শুনে সরাসরি সত্যজিৎ রায়ের কাছে। না, সত্যজিৎ জানালেন ‘অপরাজিতর অপুর পক্ষে তুমি বেশি বয়সের। তোমার মুখ মনে রইল, ভবিষ্যতে তোমায় ডাকব।’ হ্যাঁ,  ডেকেছিলেন তিনি। অপুর সংসার করবেন ঠিক করার সঙ্গে সঙ্গে সত্যজিৎ ডেকেছিলেন সৌমিত্রকে। ‘তুমিই আমার অপুর সংসারের অপু।’ জানিয়েছিলেন তিনি। তখন রেডিও স্টেশনে কাজ করছেন সৌমিত্র। ছবির কাজ পেয়ে ছুটি নয়, ঠিক করলেন চাকরিটা ছেড়েই দেবেন। স্বয়ং সত্যজিৎ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ডিসিশনটা কি ইমোশনাল?  চাকরি ছেড়ে দেবেন বলছেন – তারপর – আমার ছবিটা ফ্লপ হয়ে গেল – তারপর যদি কাজ না পান?’  এসব নিয়ে মাথা ঘামাননি তিনি। সৌমিত্র অভিনয়ের জন্য ছেড়েছিলেন চাকরিটা। তাঁর সামনে কোনো নিশ্চিত ভবিষ্যৎ ছিল না। কিন্তু শিশিরকুমারের শিষ্য তিনি। যে-শিশিরকুমার থিয়েটারের জন্যে ছেড়েছিলেন কলেজের অধ্যাপনা, সব মিলিয়ে অন্তত তখনকার দিনে মাসিক   তিন-চার  হাজার  টাকা।  পরিবর্তে আশি হাজার টাকার দেনা নিয়ে থিয়েটার করেছেন। এই আদর্শ থেকেই অভিনয়ের জন্যে অনিশ্চিত জীবন বেছে নিয়েছিলেন। আজ প্রমাণিত, সৌমিত্রর সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল। অপুর সংসার মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সৌমিত্রর সামনে খুলে গেল তাঁর স্বপ্নের দরজা। এই রকম একজন অভিনেতার জন্যই যেন প্রতীক্ষায় ছিল বাংলা সিনেমা। শুধু সমান্তরাল সিনেমার পরিচালকরাই নন, সুস্থ বাণিজ্যিক সিনেমার পরিচালকরাও হলেন সৌমিত্রসন্ধানী।

৯ আগস্ট, ১৯৫৮। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন সৌমিত্র, প্রথম। অপুর সংসারের সেই দৃশ্যটা – অপু লেবেলিংয়ের কারখানায় চাকরি খুঁজতে গেছে। শুটিং বেলেঘাটার সিআইটি রোডে। live chat 888sportজীবনের তারিখটার কথা কখনোই ভোলেননি। ২৫০-এর চেয়ে বেশি ছবির অনেক ঘটনাই হয়তো সেভাবে 888sport sign up bonusর মণিকোঠায় রাখেননি সৌমিত্র। রাখার  কথাও নয়। ১৯৫৮ সাল থেকে দীর্ঘ ৬২ বছর পেরিয়ে এসেছেন। এই তো সেদিন অবধি ক্লান্তির ছাপ ছিল না তাঁর মধ্যে। সটান ঋজু অভিনয়। দাপিয়ে বেড়াতেন শহর। আড্ডাতে তেমনই দুরন্ত। যে-কোনো পার্টিতেই তিনি প্রধান। অনায়াসে নেমে যান ডান্স ফ্লোরে। বার্ধক্যও স্পর্শ করতে পারেনি শরীর ও মনকে। ছিপছিপে নির্মেদ শরীর। শেষ দিন অবধি ৮৫ বছরের যুবকের নাম একই, –    সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

সিনেমায় নামার আগে থেকেই সৌমিত্র ভালো আবৃত্তিকার। আর ২০২০-তে দাঁড়িয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গের এক নম্বর আবৃত্তিকারই। সত্যজিৎ রায় সৌমিত্রের এই আবৃত্তিক্ষমতাকে অপুর সংসার ছবিতেই ব্যবহার করেন। যেমন তপন সিংহও সৌমিত্রের সঙ্গে তাঁর প্রথম ছবিতেই সৌমিত্রকে দিয়ে ওমর খৈয়ামের 888sport app download apk –    ইংরেজি এবং বাংলায়। বাংলা ছবিতে প্রথম আবির্ভাবেই সৌমিত্রকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন বাংলা ছবির দর্শকরা। কোনো অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁকে। অপুর সংসার মুক্তির পর ঠিক নায়কের মর্যাদা না পেলেও ক্ষুধিত পাষাণ ছবিটি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ছবিতে ‘নায়কে’র আসন পেয়ে যান সৌমিত্র। বাংলা ছবিতে আর-একজন নায়ক এলেন, এই ঘটনাটা সসম্মানে মেনে নেন দর্শকেরা। ১৯৬০ সালে ক্ষুধিত পাষাণ  ছবিটির পাশাপাশি মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায়ের  দেবী। ঠিক কথা, এই ১৯৬০ সাল পর্যন্তই সৌমিত্র সমান্তরাল ছবির নায়ক। পুরোপুরি টালিগঞ্জের নায়ক হয়ে উঠলেন। ১৯৬১-তেই পরিচালক অসিত সেনের স্বরলিপি ও স্বয়ম্বরায়। দুটোরই নায়িকা সুপ্রিয়া চৌধুরী। বাণিজ্যিক ঘরানার মধ্যেও সৌমিত্র নিজের স্বতন্ত্র ইমেজ প্রতিষ্ঠা করলেন। এই দুই বাণিজ্যিক ছবির মধ্যেও একটি সত্যজিতের ছবি করলেন তিনি, তিনকন্যার অন্তর্গত সমাপ্তি। আর এই বছরেই তিনি মুখোমুখি হলেন স্বয়ং উত্তমকুমারের। ছবির নাম – ঝিন্দের বন্দী।

উত্তম বনাম সৌমিত্র ষাটের দশকের বাঙালিরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেরাই দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন – যেমন মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল। ঠিক সেইরকম সিনেমা-সংস্কৃতিজগতের মানুষের মধ্যে পরিষ্কার দুটি ভাগ তৈরি হয়েছিল –    উত্তমভক্ত ও সৌমিত্রভক্ত। সত্যি সত্যিই বাসে, ট্রামে, অফিস-কাছারি বা যে-কোনো আড্ডায় ব্যাপারটা শাক্ত ও বৈষ্ণবদের লড়াইয়ের মতোই। তপন সিনহার ঝিন্দের বন্দী ছবি থেকেই শুরু হয়েছিল এই বিভাজন। অথচ ঝিন্দের বন্দী ছবিতে সৌমিত্র ছিলেন মূলত ভিলেনই। অপু করার পর ময়ূরবাহনের তো আপামর একটি ভিলেন চরিত্রকে অ্যাকসেপ্ট করে নেওয়ার মধ্যে নিঃসন্দেহে দুঃসাহসের পরিচয় আছে। কিন্তু সৌমিত্রের যে দূরদৃষ্টি ছিল তা ঝিন্দের বন্দী-পরবর্তী উত্তম-সৌমিত্রের ‘ফ্যান’দের মধ্যেকার দ্বৈরথ তার প্রমাণ।

অথচ সৌমিত্র যখন বাংলা live chat 888sportে আসছেন তখন বাংলা ছবির সম্রাট হলেন উত্তমকুমার, তাঁর রোমান্টিক-ইমেজে আপ্লুত পশ্চিমবঙ্গ। বাংলা সিনেমায় তখন উত্তমকুমারের বিকল্প নেই। এবং বিকল্প হিসেবে সৌমিত্রই। তিনি এতদিন ধরে টালিগঞ্জের তথাকথিত ‘নায়ক’ কনসেপ্টকে পুরোপুরি পালটে দিলেন। টালিগঞ্জ তাঁকে ব্যবহার করুক বা না-করুক, তিনি তাঁর মনন দিয়ে ব্যবহার করে নিলেন টালিগঞ্জকে। আর এখানেই তাঁর জয়। ৬২ বছর ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকার গোপন মন্ত্র। নায়ক হিসেবে বাংলা সিনেমায় উত্তমকুমারের অগ্রজ আছে। উত্তম তাঁদেরই উত্তরাধিকারী। কিন্তু সৌমিত্রের সেই অর্থে অগ্রজ নেই। সৌমিত্র বাংলা সিনেমায় আউটসাইডার কিন্তু ব্রাত্য নন, বরং আকাঙ্ক্ষিত।

পরপর ফ্লপ দিয়ে শুরু হয়েছিল উত্তমের live chat 888sport-জীবন। চল্লিশের উপাত্ত থেকে পঞ্চাশের বেশ খানিকটা সময় তাঁকে টানা লড়াই করতে হয়েছে। অথচ সেই সময় বাংলা সিনেমায় এক নায়ক-শূন্যতা চলছে। চল্লিশের দশকের দুই নায়ক দুর্গাদাস ও প্রমথেশ বড়ুয়া মারা যান ১৯৫১-র মধ্যেই। তারপর যাঁরা নায়ক হিসেবে এসেছিলেন সেই অসিতবরণ ও রবীন মজুমদার পঞ্চাশের দশকে রীতিমতো প্রবীণ। নায়ক হিসেবে তাঁদের আর মানায় না। সেই অর্থে দুর্গাদাস প্রমথেশের যোগ্য উত্তরাধিকারী হলেন উত্তমই। এর মধ্যে দেবী মুখোপাধ্যায় নায়ক হিসেবে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। কিন্তু আত্মহত্যা করেন অকালেই, ফলে বাংলা সিনেমার একটা নায়ক চাহিদা চলছিলই। যেটা নিজের প্রতিভা ও মিডিয়ার মেলবন্ধনে পুরোপুরি কাজে লাগান পরবর্তীকালে মহানায়ক উত্তমকুমার।

উত্তমকুমারের ১২ বছর পর বাংলা বাণিজ্যিক সিনেমায় আসেন সৌমিত্র। এবং উত্তমের মৃত্যুর আগে অবধি দীর্ঘ ২৫ বছর তিনিই ছিলেন উত্তমের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী। যদিও ব্যক্তিগত স্তরে তাঁদের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতোই, লড়াইটা ছিল শুধু অভিনয়ে। উত্তম ও সৌমিত্রের অভিনয়ের ধারাটা ছিল অবশ্যই দুরকমের।

উত্তম বাংলা ছবির ম্যাটিনি-আইডল। বাংলা ছবির চিরকালীন ‘রোল মডেল’ মেনেই উত্তম হলেন নায়ক। যেখানে মননের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। ‘বয় মিক্স গার্ল’ ও ‘প্রেম বিরহ প্রেম’ – এই সমীকরণের মধ্যেই তৈরি হয়েছে উত্তমের ইমেজ, যা প্রমথেশ বড়ুয়া বা দুর্গাদাসের ইমেজেরই আধুনিক সম্প্রসারণ। খুব সচেতনভাবেই উত্তমকুমার জোর দিলেন আঙ্গিক ও সামান্য উঁচুপর্দার অভিনয় কাঠামোতে। তৈরি করলেন নায়ক ইমেজ আর্কেটাইপ।

সৌমিত্র বাংলা সিনেমার এই নায়ক আর্কেটাইপকেই অভিনয়ের মধ্য দিয়ে প্রথমে চ্যালেঞ্জ করলেন। তিনি অভিনয়ের মধ্যে নিয়ে এলেন মনন। থিয়েটারের জগৎ, শিশির ভাদুড়ির শিক্ষার জগৎ থেকে এলেও তিনি সচেতনভাবে সিনেমায় এড়িয়ে গেলেন থিয়েটার অভিনয়কে। শুধু থিয়েটারের অভিজ্ঞতা থেকে কাজে লাগালেন স্পেস ও টাইমের নিপুণ ব্যবহারকে। সৌমিত্র বিশ্বাস করলেন বা বাংলা সিনেমায় প্রথম প্রয়োগ করলেন ‘মিনিমালিস্ট অ্যাকটিং’। অভিনয়888sport live chatে এলো এক বুদ্ধিজীবিতা। সংবেদনশীল বাঙালি পেল এক অন্য অভিনেতা যাঁকে উত্তমকুমারের গ্ল্যামার গ্রাস করতে পারে না, বরং তাকে দাঁড় করানো যায় উত্তমের বৈপরীত্যে। বৈপরীত্য? এটা নিয়ে চিন্তার একটু অবকাশ আছে। দীর্ঘ ২৫ বছরে উত্তম ও সৌমিত্র মাত্র ছয়টি ছবি একসঙ্গে অভিনয় করেছেন। ছবিগুলি হলো ঝিন্দের বন্দী, অপরিচিত, স্ত্রী, প্রতিশোধ, দর্পচূর্ণ ও দেবদাস। উত্তম ও সৌমিত্রের অভিনয় এই ছটি ছবিতে পাশাপাশি দেখার সময় দর্শক কিন্তু এক আলাদা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। উত্তম ও সৌমিত্রের সম্পূর্ণ দুই ধারার অভিনয় একই ছবিতে দেখে তারা আবিষ্কার করেন দুজনের অভিনয় পরস্পরের বিপরীত নয়, পরস্পরের পরিপূরক। আর সেই জন্য উত্তম-সৌমিত্র জুটির জনপ্রিয়তার কোনো মার ছিল না। এই চারটি ছবির বিশাল বাণিজ্যিক সফলতাই তার প্রমাণ। এতদসত্ত্বেও উত্তমকেই বাংলা সিনেমার শেষ নায়ক ভাবেন সৌমিত্র। উত্তম নিয়ে তাঁর কাছে যখনই কোনো প্রশ্ন তোলা হয়, সৌমিত্রের একটাই উত্তর : ‘বাংলা সিনেমার শেষ নায়ক হলেন উত্তমদাই’, আর এখানেই সৌমিত্রের জিত। কিন্তু এটা তো ঠিক সৌমিত্রের মতো আর কোনো ভারতীয় অভিনেতা কি এত 888sport app download for androidীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন?  উত্তরটা খুব সহজে না-ই হবে। সৌমিত্রের মতো এত সংখ্যক 888sport app download for androidীয় চরিত্রে এর আগে কেউই করেননি। সত্যজিতের ২৮টি ছবির ১৪টি চরিত্রের কথা যদি বাদও দেওয়া যায়, তাহলেও অন্তত বাংলা বাণিজ্যিক ছবি থেকে ৫০টির ওপর 888sport app download for androidীয় চরিত্র বেরিয়ে আসবে তাঁর অনায়াসে। তার মানে এই নয় যে, সত্যজিৎ ছাড়াও বাংলা সিনেমায় প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব পরিচালকের ছবিতেই কাজ করেছেন সৌমিত্র, তাই এই 888sport app download for androidীয় ৫০। এই সুযোগ কজন অভিনেতার ভাগ্যে আসে? কথাটা ঠিক নয়, প্রচুর অভিনেতার ভাগ্যেই এই সুযোগ এসেছে। কিন্তু তাঁরা নিজস্ব ম্যানারিজম ছাড়িয়ে চরিত্রগুলোকে 888sport app download for androidীয় করে তুলতে পারেননি। পেরেছেন সৌমিত্র।

পাঁচ

মনে রাখতে হবে উত্তমকুমারের মৃত্যু টালিগঞ্জে এক অদ্ভুত আঁধার। তারপর যে আপাত আলো এলো তা কিন্তু মননশূন্য। আর এই মননশূন্য পরিবেশের মধ্যেই অভিনয় করতে হলো সৌমিত্রকে। আর তিনিই বোধহয় একমাত্র অভিনেতা, যিনি এই মননশূন্য পরিবেশের মধ্যে নিজের মধ্যে নিজের আপন বৈশিষ্ট্য বজায় রাখলেন। কিন্তু কোন ম্যাজিকে? কেমন করে? সৌমিত্রের সবিনয়ী উত্তর : ‘আসলে যে-চিত্রনাট্যই হোক না কেন, পরিচালক যিনি হোক, আমি নিজে চরিত্রটিকে নিজের মতো করে যুক্তি পরম্পরায় সাজিয়ে নিই, চরিত্রটিকে নিয়ে ভাবি, যা চিত্রনাট্যে নেই, সেটাও আবিষ্কার করার চেষ্টা করি, তারপর অভিনয়।’

ফলে সৌমিত্র সত্যজিৎ থেকে স্বপন সাহা, সবার ছবিতেই সমান সাবলীল অভিনয় করেন। কোনো ছাঁচের মধ্যে তিনি নিজেকে আটকে রাখতে চান না। কে পরিচালক তাঁর কাছে বড় কথা নয়, বরং কোন চরিত্রে অভিনয় করছেন, সেটাই তাঁর কাছে অনেক বেশি দরকারি। যেমন অপুর সংসারের অপু; কিন্তু আবার অতল জলের আহ্বান বা তিন ভুবনের পারের নায়কও। তিনটি চরিত্রের মধ্যেই আন্তঃআঙ্গিক বা বহিরাঙ্গগত কোনো মিল নেই। বাংলা ছবির নায়ক আর্কেটাইপে কিন্তু তিন ভুবনের পারের নায়ক আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। বাংলা বাণিজ্যিক ছবির ক্লিশে রোমান্টিকতায় অন্য এক টাটকা হাওয়া এনেছিল। 888sport app download for androidীয় চরিত্র? সে এক বিশাল প্রেক্ষাপটে ছড়িয়ে আছে। সত্যজিতের সৌমিত্র সে তো এক আলাদা প্রসঙ্গ। তা বাদ দিয়েও আগুন বা বেনারসী ছবির সৌমিত্রও পুরোপুরি আলাদা। অথবা আকাশ কুসুম ছবির সেই আপাত-মিথ্যেবাদী নায়কের প্রেমে পড়েনি এমন তরুণী কি ষাটের দশকে কেউ ছিলেন?

একের-পর-এক নিজের ক্রাফট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গিয়েছেন সৌমিত্র। শুনতে আশ্চর্য লাগতে পারে, সত্যজিতের পরেই সৌমিত্র সবচেয়ে বেশি ছবি করেছেন আপামর বাণিজ্যিক পরিচালক সলিল দত্তের সঙ্গে। সলিল-সৌমিত্রের যুগলবন্দির একটা ছবির কথা বাংলা ছবির দর্শকেরা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, সেই ছবিটি হলো – বাবুমশাই। নামভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র। অজয় করের সাত পাকে বাঁধার সৌমিত্র, শরৎকাহিনি নিয়ে তৈরি পরিণীতা বা মাল্যদানের সৌমিত্র, এক শরৎ ভাবনারই নায়ক হয়ে ওঠেন – রাবীন্দ্রিক ইমেজের বাইরে। তপন সিংহ বা মৃণাল সেনের সৌমিত্র প্রসঙ্গ নতুন করে উল্লেখ করার মানে হয় না। আতঙ্ক বা অন্তর্ধান ছবিতে সৌমিত্রের আর কেউ বিকল্প হয় কি? আরেকটা ছবির কথা অবশ্যই মনে পড়ছে, হরিসাধন দাশগুপ্তের – একই অঙ্গে এত রূপ। বিজয় বসুর বাঘিনী বা সরোজ দে-র কোনিতে কি আরেক অন্য সৌমিত্রকে খুঁজে পাই? অথবা সংসার সীমান্তেতে? আর এরই বিপরীত এক বাস্তব-চরিত্র রূপায়িত করেন সৌমিত্র, রাজা মিত্রের একটি জীবনে। এই ছবিটি স্বয়ং সত্যজিৎ করবেন বলে ঠিক করেছিলেন, চিত্রনাট্যও লিখেছিলেন। কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক ছবিটি শেষ অবধি তিনি করেননি।

সৌমিত্রের যে-রাবীন্দ্রিক ইমেজ, বা সংস্কৃতিবান চেহারা, তাকে নিজেই তিনি বিভিন্ন বাংলা ছবিতে স্ব-ইচ্ছাতেই তছনছ করে দিয়েছেন। স্বপন সাহা বা বাবলু সমাদ্দারের মতো তথাকথিত বাণিজ্যিক পরিচালকের ছবিতে তিনি যখন অভিনয় করেছেন, তখন তিনি সমান কমিটেড, নিজের চরিত্রটির প্রতি। টালিগঞ্জের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির চাহিদার সঙ্গে তিনি নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। তবে এই খাপ খাওয়ানোর সময় কাজে লাগিয়েছেন নিজের বুদ্ধি ও সংবেদনশীলতাকে দিয়ে। তাঁর ভাষায়, ‘এই দুটোর সংমিশ্রণের জোরেই আমি ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে আছি।’ সত্যজিতের ছবির কথা বাদ দিয়ে সৌমিত্রের ৫০টি 888sport app download for androidীয় চরিত্রের ছবির নাম এই ভাবে সাজানো যেতে পারে – ১) একটি জীবন, ২) কোনি, ৩) হুইল চেয়ার, ৪) বাঘিনী, ৫) স্বরলিপি, ৬) অতল জলের আহ্বান, ৭) আগুন, ৮) বেনারসী, ৯) সাত পাকে বাঁধা, ১০) প্রতিনিধি, ১১) কিনু গোয়ালার গলি, ১২) অতলান্ত, ১৩) বাক্স বদল, ১৪) আকাশকুসুম, ১৫) একই অঙ্গে এত রূপ, ১৬) কাঁচ কাটা হীরে, ১৭) তিন ভুবনের পারে, ১৮) পরিণীতা, ১৯) অপরিচিত, ২০) প্রথম কদম ফুল, ২১) মাল্যবান, ২২) স্ত্রী, ২৩) বসন্ত বিলাপ, ২৪) অশনিসংকেত, ২৫) ছুটির ফাঁদে, ২৬) সংসার সীমান্তে, ২৭) দত্ত, ২৮) বাবুমশাই, ২৯) জব চার্নকের বিবি, ৩০) গণদেবতা, ৩১) ফাদার, ৩২) অগ্রদানী, ৩৩) অমর গীতি, ৩৪) আতঙ্ক, ৩৫) আগুন, ৩৬) একটি জীবন, ৩৭) এক পশলা বৃষ্টি, ৩৮) অন্তর্ধান, ৩৯) পাষণ্ড পণ্ডিত, ৪০) কাকাবাবু হেরে গেলেন, ৪১) নয়নতারা, ৪২) সর্বজয়া, ৪৩) দেখা, ৪৪) ক্রান্তিকাল, ৪৫) অসুখ, ৪৬) আত্মীয়স্বজন, ৪৭) পদক্ষেপ, ৪৮) কাঞ্চনমালা, ৪৯) মহাপৃথিবী ও ৫০) ক্রান্তিকাল।

অন্য কারুর ভাবনায় তালিকাটি অন্যরকম হতেই পারে। সেই সুযোগ স্বয়ং সৌমিত্রই তাঁর অভিনয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছেন। অভিনয় থেকে অবসর নেওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না সৌমিত্র। অভিনয়ই তাঁর প্রাণ। তাঁর মতে, ÔI stop breathing if I stop workingÕ। সত্যজিতের সৌমিত্র, সৌমিত্রের সত্যজিৎ, সত্যজিতের সৌমিত্র-নির্মাণ বা সত্যজিতের সৌমিত্র-নির্ভরতা –    যাই বলি না কেন, শুধু ভারতীয় কেন, বিশ্বের live chat 888sport-ইতিহাসে প্রসঙ্গ খানিকটা অভিনবই। আগেই বলেছি,  ছবিতে সৌমিত্রের প্রথম আবির্ভাব সত্যজিতের অপুর সংসার ছবিতে। এই ছবির নায়ক অবশ্যই সৌমিত্র। অপুর সংসার  এক অর্থে প্রেমের ছবি। রোমান্টিক। এবং সত্যজিতের প্রথম নায়ককেন্দ্রিক ছবি। পথের পাঁচালী, অপরাজিত  বা  জলসাঘর বা পরশপাথর ছবিতে প্রচলিত অর্থে কোনো নায়ক ছিল না। অপুর সংসারের নায়ক বাঙালি মধ্যবিত্ত, সংস্কৃতিবান নায়ক – শুধু গুণগত দিক থেকে বাংলা এরকম নায়ক আগেও দেখেছে। কিন্তু সেই নায়কের আর্কেটাইপটাকে 888sport live chatগতভাবে বদলে দিলেন সত্যজিৎ। বাংলা ছবির দর্শকরা স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে, এরকম নায়ক পজিটিভ অর্থেই আগে দেখেননি কখনো। সত্যজিতের চিত্রনাট্য, সিনেমা-ভাবনার সঙ্গে এটা অবশ্যই সম্ভব হয়েছিল সৌমিত্রর অবয়ব ও অভিনয়ের জন্যেই। এরপর থেকেই সত্যজিৎ বারবার সৌমিত্রের রোমান্টিক ইমেজটাকে নিজের ভাবনায় নতুনভাবে ভাণ করেছেন। অপুর সংসারের পরে সৌমিত্র সত্যজিতের দেবী ছবিতে অভিনয় করেন। উমাপ্রসাদের ভূমিকায়। উমাপ্রসাদ অপুর মতো নিম্নমধ্যবিত্ত নন, বরং জমিদারের সন্তান। অপু আর উমাপ্রসাদের মধ্যে মিলটা হলো দুজনেই শিক্ষিত এবং কুসংস্কারমুক্ত। শহুরে শিক্ষিত আরেকটি চরিত্রেরও দেখা পাব আমরা এর পরের ছবিতেই – তিনকন্যার অন্তর্গত সমাপ্তির অমূল্য। সেও উচ্চবিত্ত, গ্রামের অধিবাসী হয়েও শহুরে শিক্ষিত। অপু, উমাপ্রসাদ ও অমূল্য, এই তিনজনে যথাক্রমে অপুর সংসার, দেবী এবং সমাপ্তির নায়ক কি না সে-প্রশ্নে না গিয়ে এটা কিন্তু নিশ্চিত, সৌমিত্রের অভিনয়সূত্রে এই চরিত্র পরস্পরের ক্রমসম্প্রসারণ হয়েছে। আর এটা যেমন একদিকে সম্ভব হয়েছে সত্যজিতের সৌমিত্র নির্মাণে, তেমন সম্ভব হয়েছে সৌমিত্র-বুদ্ধি ও মনননির্ভর অভিনয়ে। মাঝখানে অভিযান ছবিটি বাদ। আবার ফিরে আসব সত্যজিতের ছবিতে। সৌমিত্র অভিনয় করেছেন সেই সংস্কৃতিবান শহুরে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ভূমিকায় খুব সংবেদনশীল এবং পরিশীলিত। চরিত্রগুলো হলো চারুলতার অমল, কাপুরুষ ছবির অমিতাভ রায় এবং অরণ্যের দিনরাত্রির অসীম। এরা প্রত্যেকেই নায়ক না-হলেও ছবির অন্যতম প্রটাগনিস্ট। আসলে সৌমিত্রের মতো সুচারু অভিনেতাকে পেয়েছিলেন বলেই বাংলা ছবির একদিনকার সযত্নে লালিত নায়ক কনসেপ্টটিকে ভাঙতে সাহসী হয়েছিলেন। আর অভিযান ছবিতে সৌমিত্র অবশ্য সব অর্থে নায়কই। তবু বাংলা ছবির ব্যতিক্রমী নায়ক। আসলে সৌমিত্রকে সত্যজিৎ প্রতিষ্ঠিত চালু আদল থেকে সব সময়ই আলাদা রাখতে চেয়েছেন – নিজের চিত্রনাট্যের চাহিদাতেই। আর তাতে সমান সহযোগিতা করেছেন বিকল্পহীন সৌমিত্র। অশনিসংকেত ছবিতে গ্রাম্য পুরোহিত গঙ্গাচরণ। সৌমিত্র সম্পর্কে এতদিনকার সমস্ত নির্মিত মিথকে ভেঙে দিলেন সত্যজিৎ। আর এখান থেকেই সৌমিত্রকে নিয়ে সত্যজিতের অন্য এক্সপেরিমেন্ট শুরু। গঙ্গাচরণ থেকে সরাসরি ফেলুদা। একটা নয়, দুটো ছবি। শখের গোয়েন্দা  সৌমিত্র। তারপর হীরক রাজার দেশের রূপকথার নায়ক উদয়ন, ঘরে-বাইরের পরজীবী ভিলেন সন্দীপ, ইবসেনের নাটক অবলম্বনে গণশত্রুতে প্রতিবাদী ডাক্তার অশোক গুপ্ত এবং সবশেষে শাখা-প্রশাখায় ধনীর সন্তান, উন্মাদ, সংগীতরসিক প্রশান্ত। কত ধরনের চরিত্র। ১৪টা ১৪ রকমের। অথচ প্রতিটিতেই সৌমিত্র অপরিহার্য এবং টালিগঞ্জের মূলস্রোতের অভিনেতাদের থেকে সরাসরি আলাদা। আর বাঙালির প্রিয় ফেলুদা তো সত্যজিতের নির্মাণে তাঁরই যেন অলটার-ইগো। আসলে সত্যজিতের এই সৌমিত্র-নির্মাণ সম্ভব হয়েছে সৌমিত্রের শিক্ষিত সচেতন ধৈর্য, ধ্যান ও মনের জন্যেই। যেমন সৌমিত্রের নিজস্ব চেতনা তৈরি হয়েছে পড়াশোনা, রাজনীতি, রাবীন্দ্রিকতা, জীবনানন্দ-প্রেম, 888sport app download apkর জগৎ,  শিশির ভাদুড়ি ও সত্যজিতের প্রভাব, 888sport app download apk, লেখা এবং স্বার্থহীন থিয়েটার চর্চার মধ্যে।